চোদ্দো
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ফলাফল প্রায় একতরফা হয়ে গেল। ছাত্র পরিষদ যে ক’টা সিট পেয়েছে তা এত সামান্য যে ওদের ক্যাম্পে এখন লোকজন নেই বললেই চলে। হঠাৎই যেন উত্তেজনা হ্রাস পেয়ে গেছে, যেসব ছেলেরা ছাত্র পরিষদের হয়ে কাজকর্ম করেছিল তারা এখন এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চলাফেরা করছে যেন ও ব্যাপারের সঙ্গে ওদের কোনও সম্পর্ক নেই। দল হেরে গেলেই যে এমন করে পিছিয়ে যেতে হয় সেটা অনিমেষ জানত না, এখন জানল। বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন এখন তুঙ্গে। ডানেরা তো আমলই পায়নি। অনিমেষ ওর ক্লাসের শতকরা আশিটি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। বিমান বলেছিল, ‘এটা তো জানা কথাই। বিধান রায়ের সিটের মতো তোমার জেতা নিশ্চিত ছিল।’ বিধান রায় নাকি কখনওই হারেননি। চৌরঙ্গি এলাকায় তাঁর একবার হারো-হারো অবস্থা হয়েছিল কিন্তু শেষতক জিতে গেছেন। মানুষের ব্যক্তিগত ভাললাগা পার্টির ওপরে গিয়ে তাঁকে জিতিয়ে দিত। অনিমেষ বোঝে ক্লাসের ছেলেরা যখন ওর সঙ্গে কথা বলে তখন বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গেই বলে। হয়তো ওর মিষ্টি লাজুক চেহারা এবং সেই বুলেটের চিহ্ন ছেলেমেয়েদের মানসিকতায় ওর সম্পর্কে দুর্বলতা এনে দিয়েছে। আশ্চর্য! আজ যেটা চরম আঘাত মনে হচ্ছে কাল সেটা তুরুপের তাস হয়ে যেতে পারে— শিক্ষাটা জানা ছিল না, এখন জানল।
ইউনিয়নের কাজকর্মে অনিমেষ এখন সক্রিয় কিন্তু কতগুলো ব্যাপারে ওর মনে কিছু অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে। কোনও ইস্যু নিয়ে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন সেটা কী হবে তা আগেই ঠিক করা থাকে। নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার কোনও প্রয়োজন হয় না। অনিমেষ লক্ষ করেছিল এ ব্যাপারে কারও কোনও ক্ষোভ নেই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কতগুলো নির্দিষ্ট নীতি ঠিক করে রেখেছেন, এই ইস্যুগুলো সামনে এলে সেই নীতির আলোয় পথ ঠিক করে নেওয়া হয়। এক রকম বিশ্বাসে সকলে তা মেনে চলে।
অফিস-বেয়ারার নির্বাচনের সময় যে ক’টা নাম কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছিল অনিমেষ তার মধ্যে ছিল। তার মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তা দল স্বীকার করেছে। ফিফথ ইয়ারের ছাত্র হওয়ায় সে আরও দু’বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে, তাই এখন থেকে যদি সে দায়িত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা পায় তা হলে সামনের বছরে যখন সিনিয়াররা থাকবে না তখন তাদের জায়গা নিতে পারবে। সুদীপের প্রস্তাব ছিল, সহ-সম্পাদকের দুটো আসনের একটায় অনিমেষকে নেওয়া হোক। কিন্তু সে ব্যাপারে কতগুলো অসুবিধার মধ্যে যেটা অন্যতম সেটা হল কলেজ জীবনে অনিমেষ ছাত্র ফেডারেশনকে কোনও সাহায্য করেনি। সে সময় বিভিন্ন কলেজে ছাত্র ফেডারেশনের হয়ে যারা সত্যি খেটেছে এবং এই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে তাদের দাবি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে।
এই ব্যাপারটা নিয়ে যখন চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে ঠিক সেসময় অনিমেষ একটা গোলমাল করে বসল। ভিয়েতনামে আমেরিকার নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে ছাত্র সংসদ থেকে একটা কার্যক্রম নেওয়ার কথা উঠলে বিমান বলেছিল, ‘সারা বাংলা ছাত্র ধর্মঘটের যে কার্যসূচি নেওয়া হয়েছে তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একদিন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টসদের ক্লাস বয়কট করতে বলা হবে, ধরো আগামী মঙ্গলবার।’
ব্যাপারটা যখন ঠিক হয়ে যাচ্ছে তখন অনিমেষ বলে ফেলেছিল, ‘আচ্ছা এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করলে হয় না?’
সুদীপ চমকে ওর দিকে তাকিয়েছিল আর বিমান খুব ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করেছিল, ‘কেন, তোমার কি পার্টির নির্দেশ মানতে আপত্তি আছে?’
মাথা নেড়েছিল অনিমেষ, ‘না, না, আমি সে-কথা বলছি না। আলোচনা করলে সবার বুঝতে অসুবিধা হবে না, তাই।’
‘ভিয়েতনামে যে লড়াই চলছে সেটা তুমি স্বীকার করো তো?’
‘নিশ্চয়।’
‘তা হলেই হল।’
তারপর প্রসঙ্গটা অন্যদিকে চলে গেল।
পরবর্তীকালে অফিস-বেয়ারারদের নাম ঘোষণা করার সময় অনিমেষকে সরিয়ে রাখা হল। অনিমেষের একটু সুবিধা ছিল যে সে কিছু আশা করেনি তাই তার কোনও ক্ষোভ হল না। তবে সুদীপ ওকে একদিন আড়ালে ডেকে বলেছিল, ‘অনাবশ্যক কৌতূহল না-দেখালে তুমি অনেক উঁচুতে উঠতে পারবে অনিমেষ। পার্টির বিশ্বাস অর্জনের জন্য কাজ করে যাও।’
পরমহংস একা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলার সময় অনিমেষের একটা খটকা লাগছিল। এরা কেউ কোনও বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয়। বাংলায় এম এ পড়তে এসেছে একটা ডিগ্রি পাওয়ার জন্য। যারা একটু আশাবাদী তারা পরবর্তীকালে ডক্টরেট করে কোনও কলেজে লেকচারারের কাজ পাবে বলে ভাবছে। বাকিরা হয় স্কুলে নয় আর কী যে করবে জানে না। কিন্তু মজার কথা হল, তা নিয়ে কারও তেমন দুশ্চিন্তা নেই। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাদের এরকম নির্লিপ্ততা তারা তো ভিয়েতনাম অথবা কিউবার কথা দূরে থাক, ভারতবর্ষ নিয়েই কোনও চিন্তা-ভাবনা করে না। অথচ ভিয়েতনাম নিয়ে যে আন্দোলনের কথা অনিমেষরা ভাবছে সেটা ছাত্রদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা অত্যন্ত সত্যি কথা, অস্বীকার করার মানে হয় না। কথাগুলো বিমানের সঙ্গে আলোচনা করতে এখন ভয় পায় সে। বিমানের আলোচনা শুনলে মনে হয় যেন তামাম ছাত্ররা ওদের সঙ্গে একমত হয়ে ভিয়েতনামের ঘটনার প্রতিবাদ জানাবে এবং এ ব্যাপারে কোনও ছাত্রের দ্বিধা নেই।
অনিমেষের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বিমানরা কি সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে মেশে না? তাদের মনের খবর কি জানে না? নাকি, নিজেদের ধ্যানধারণা যাতে সবাই বাধ্য হয়ে মেনে নেয় সেই ব্যবস্থাই চায়!
অনিমেষ বোঝে যে, কতগুলো বিশেষ আদর্শ সামনে রেখে না-এগোলে কোনও কাজ করা যায় না। হয়তো সেটা ফর্মুলার চেহারা নিয়ে নেয় কিন্তু ছোটখাটো অসংগতি বৃহত্তর স্বার্থের জন্য মেনে নিতে হয়। মাও সে-তুঙ, চে-গুয়েভারা, লেনিন কিংবা হো চি মিন যা করেছেন সেগুলো কি সব ক্ষেত্রে ত্রুটিহীন? কমিউনিজম তাই প্রচ্ছন্নে একটা আদর্শের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবকে মেনে নেয়— না-মানলে কোনও কাজ হয় না। গড়াতে গড়াতে বল একসময় হয়তো গর্তে গিয়ে পড়বে, প্রতি পায়ে আলোচনার নামে দ্বিধা প্রকাশ মানেই তার গতি হ্রাস।
প্রতিবাদ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে একটা বিরাট জমায়েত ডাকা হল। বিমান সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ঘোষণা করল যে দুটো নাগাদ ছাত্রদের একটা মিছিল বেরুবে। তার আগে অফিস-বেয়ারারদের এবং মেম্বারদের নিয়ে একটা গোপন বৈঠক হয়ে গেছে। তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, পুলিশ যদি বাধা দেয় তা হলে গ্রেপ্তার এড়িয়ে প্রতিরোধ করা হবে। অর্থাৎ একটা গোলমাল সৃষ্টি করে এই প্রতিবাদকে লাইম-লাইটে আনতে হবে যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে। গ্রেপ্তার এড়ানো হবে এইজন্যে চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে পুলিশভ্যানে উঠলে কোনও কাজের কাজ হবে না। বিশেষ করে সমস্ত কলেজ স্ট্রিট এলাকায় যখন একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে।
অনিমেষ কিন্তু একটা প্রস্তুতির গন্ধ পাচ্ছিল। ব্যাপারটা সবাইকে জানানো হয়নি, কিন্তু সহজ ভঙ্গিতে যে পুলিশের মুখোমুখি বিমানরা হবে না এটাও ঠিক। হঠাৎ ওর মনে অভিমান এল, সেই ইলেকশনের পর থেকে সে নিয়মিত দু’বেলা ইউনিয়নের কাজকর্ম করে যাচ্ছে, কয়েকদিন পার্টি অফিসে গেছে সুদীপের সঙ্গে, কিন্তু তবু সে বিমানের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। একদিন বিমান বলেছিল কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বারশিপ তো চার আনা দিয়ে কেনা যায় না, দীর্ঘদিন তাকে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসতে হয় যা তার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করবে, অভিমান হলেই এই কথাটা মনে পড়ে। কে জানে হয়তো তারও এখন সেই অবস্থা চলছে।
ক্লাস বয়কটের ডাকটা কিন্তু খুব কার্যকরী হল না। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা কেমন গা-এলানো ভাব দেখাচ্ছে, যেন সবাই দর্শক হয়ে থাকতে চায়, কেউ মঞ্চে উঠতে চাইছে না। অনিমেষরা করিডরে ঘুরে ঘুরে ছেলেমেয়েদের চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘বন্ধুগণ, একটা দিন আমরা ক্লাস বয়কট করছি সাম্রাজ্যবাদীদের জঘন্য কার্যকলাপের প্রতিবাদে, প্রতিবাদ না-করলে আমরা কীসের মানুষ? আপনারা সবাই নীচের লনে নেমে আসুন। লন থেকে আমরা মিছিল করে মার্কিন দূতাবাসে যাব এবং সেখানে আমাদের প্রতিবাদ জানাব।’
জোর করে কাউকে বের করে আনার নির্দেশ ছিল না তাই দেখা গেল বিভিন্ন কলেজ থেকে আসা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র একতৃতীয়াংশ ওই জমায়েতে এসেছে। অবশ্য তাতেই লন ভরে গেছে।
অনিমেষ যখন ছেলেমেয়েদের কাছে আবেদন জানাচ্ছিল তখন ওদের মুখগুলোকে কেমন মুখোশ বলে মনে হচ্ছিল। কোনওরকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না সেখানে। নিজের ক্লাসের সামনে দিয়ে যখন সে নেমে আসছে তখন ঘটনাটা ঘটল।
সিঁড়ির মুখটায় কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনিমেষ ওদের দিকে একটুও লক্ষ না-করে এদের নিস্পৃহতার কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। এমন সময় একটি মেয়েলি গলা কানে এল, ‘শুনুন’!
অনিমেষ দেখল, মেয়েদের মধ্যে একজন তার সামনে এগিয়ে আসছে। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি শুরু হয়ে গেল। সেই যে চোখ এতদিন ক্লাসের ছেলেদের মাথার ফাঁকে একটা সরলরেখায় তাকে ছুঁয়ে থাকত তা এখন সামনাসামনি। অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর গলা শুকিয়ে কাঠ এবং নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে।
‘আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে।’ মেয়েটির গলার স্বর স্পষ্ট।
‘বলুন।’ অনিমেষ নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল।
‘আপনারা কী চান?’
‘মানে?’
‘আমরা এখানে পড়াশুনা করতে এসেছি। এতদিন ধরে যে পরিশ্রম করেছি সেটাকে জলে ভাসাবার রাইট আপনাদের কে দিল?’
‘এসব কথা কেন বলছেন আমি বুঝতে পারছি না,’ অনিমেষ আন্দাজে ব্যাপারটা বুঝেও না-বোঝার ভান করল। ও কী বলতে চাইছে সেটা শোনা দরকার।
‘আপনারা আজ ক্লাস বয়কট করতে বলছেন, কাল ধর্মঘট করতে হবে। এই করেই বছরটা যাক। আপনারা যদি পরীক্ষায় পাশ না-করেন তা হলে দল আপনাদের চিরদিন খাওয়াবে, কিন্তু আমরা কেন বলি হচ্ছি?’
‘আজ তো আমরা কাউকে জোর করছি না। যারা মনে করবে প্রতিবাদ করা উচিত তারাই আসবে— এটাই আমাদের আবেদন।’ অনিমেষ শান্ত গলায় বলল।
‘আশ্চর্য! আপনারা একটা সাইকোলজিকাল প্রেশার ক্রিয়েট করছেন না?’ মেয়েটি যখন কথা বলছিল তখন অন্যান্যরা যে তাকে সমর্থন করছে এটা স্পষ্ট।
‘আপনি এম এ পড়ছেন। আপনার বোধবুদ্ধি সাধারণ মানুষের চেয়ে ওপরে। আপনি কি মনে করেন না ভিয়েতনামে আমেরিকা যে বর্বর অত্যাচার করছে বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমাদের তার প্রতিবাদ করা উচিত।’ অনিমেষ সরাসরি মেয়েটির চোখের দিকে তাকাল।
‘পৃথিবীর সব জায়গায় যে অত্যাচার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ব আপনাদের কে দিল? আর আজ নিজের নাক কেটে কি আপনি ভিয়েতনামে অত্যাচার বন্ধ করতে পারবেন? আপনি এখানে চেঁচালে আমেরিকা তা শুনে সুড়সুড় করে নতিস্বীকার করবে?’
‘বাঃ, আপনি বিশ্বজনমত কথাটা মূল্যহীন মনে করেন?’
‘সুন্দর! আপনাদের কতকগুলো সিলেক্টেড শব্দ আছে, সেগুলোর বাইরে আপনারা কিছু বলতে চান না বা পারেন না। আজ ভারতবর্ষে লক্ষ মানুষ নানান ভাবে অত্যাচারিত, তাদের কথা না-বলে, তাদের উপকার না-করে আপনারা ভিয়েতনাম নিয়ে মেতেছেন। ওখানে যারা লড়াই করছে তারা কিন্তু আপনাদের মুখ চেয়ে নেই। থাকলে আজকে লড়তে পারত না। আচ্ছা নমস্কার।’ আচমকা কথা শেষ করে মেয়েটি সঙ্গীদের নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে গেল।
ঠিক এরকম আক্রমণের জন্য অনিমেষ প্রস্তুত ছিল না। কথাগুলো শুনতে শুনতে সে মেয়েটাকে কীভাবে বোঝাবে তা ভেবে নিচ্ছিল। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়াতে সেটা সম্ভব হল না। ওই মেয়ে এত ভাবে, অনিমেষের সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। তা হলে যে মুখগুলোকে তার মুখোশ বলে মনে হচ্ছিল সেগুলো সত্যি তা নয়? সেই বিখ্যাত কথা, আইডেন্টিফিকেশন না-হলে কোনও রেসপন্স পাওয়া যায় না— সেটা এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? অর্থাৎ ভারতবাসীর কাছে সিংহলই যেখানে সুদূর সেখানে ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাদের জন্য আন্দোলন করে জনমত গঠন করা সত্যের খাতিরে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত কিন্তু তাতে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে পাওয়ার চিন্তা বাতুলতা। যদি এরকম কোনও ইস্যু হত— এই যে, প্রতি বছর এম এ পাশ করে ছেলেরা বেকার থাকবে জেনেও সরকার যে সিস্টেমটা চালু রেখেছে সেটা ভেঙে ফেলা দরকার, প্রতিটি ছেলের পূর্ণ শিক্ষার শেষে যোগ্য সংস্থানের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে— এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে যদি দাবি ওঠে তা হলে সবাই সাড়া দেবে? অনিমেষের মনে হল, দেবে।
জমায়েতে দাঁড়িয়ে অনিমেষ এইসব কথা ভাবছিল। কোনও মানুষকে প্রথম দেখায় বিচার করা যে নেহাতই ছেলেমানুষি তা আজ প্রমাণ হল। কোনওদিন কথা হয়নি, শুধু চোখে দেখে সে মেয়েটি সম্পর্কে যে কল্পনা তৈরি করেছিল তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। মেয়েটি এত সিরিয়াস, এত স্পষ্ট কথা বলতে পারে এবং কী নির্লিপ্ত হয়ে নিজেকে আড়ালে রেখে দিয়েছে তা কি ওই চোখ দেখে আন্দাজ করা যায়?
অনিমেষ অনুভব করল আজ কথা বলার সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার বুকের মধ্যে যে কাঁপুনি এসেছিল এখন তার একটুও অবশিষ্ট নেই। এক ধরনের রোমান্টিক ধারণার বদলে সে মেয়েটি সম্পর্কে অন্যরকম কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
মিটিং-এর শেষে স্লোগান উঠল, ‘ভিয়েতনাম যুগ যুগ জিয়ো। আমেরিকার কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও, ভেঙে দাও।’ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় যেন গমগম করছে এখন। কথা ছিল বিমানের ভাষণের শেষে ওরা এক জায়গায় চলে আসবে। অনিমেষ গিয়ে দেখল বিমান নির্দেশ দিচ্ছে কী করতে হবে। মিছিল একটা দিক দিয়ে কলেজ স্ট্রিটে নামবে না। হেয়ার স্কুলের গেট দিয়ে একটা মিছিল এগোবে, অন্যটা কলেজ স্কোয়ারের দিক দিয়ে। পুলিশ রয়েছে হ্যারিসন রোড আর মেডিক্যাল কলেজের সামনে। এদিকটা যখন তারা বাধা পাবে তখন অন্য মিছিলটা ইডেন হস্টেলের পাশ দিয়ে কলুটোলার চলে যাবে। অনিমেষের ওপর নির্দেশ হল কলেজ স্ট্রিটের দিকে মিছিলের সঙ্গে যেতে।
এত চটপট সবাই ব্যাপারটা বুঝে নিল যে চমকে যেতে হয়। যেন কোনও শিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর মতো মিছিলটা দূটো মুখ হয়ে এগোতে লাগল। সুদীপ কলেজ স্ট্রিটের মিছিলটাকে আকারে ছোট করে দিল। কারণ ওদের কাজ শুধু পুলিশকে ব্যস্ত রাখা।
সুদীপ অনিমেষ এবং আরও কয়েকজন এই ছোট মিছিলটাকে লিড করে স্লোগান দিল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ; ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ; মার্কিন সরকার নিপাত যাক, নিপাত যাক; তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’ ঢেউয়ের মতো স্লোগানগুলো চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত উত্তেজনা এখন। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল ওপরের বারান্দাগুলোয় ছেলেমেয়েরা ভিড় করে ঝুঁকে ওদের দেখছে।
সুদীপ সেটা লক্ষ করে বলল, ‘একদিন ওরা আসবে অনিমেষ। রাতারাতি সবাই সৈনিক হবে এটা আশা কোরো না। ব্যবধান তো থাকবেই।’
মিছিলটা ট্রাম লাইন অবধি গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। অবশ্য স্লোগান চলছে সামনে। উত্তেজনায় সবাই অস্থির। অনিমেষ ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে কোনও পুলিশ দেখতে পেল না। সুদীপ মিছিলটাকে নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ পর্যন্ত যেতেই কফি হাউসের গলি দিয়ে ভ্যানগুলো এগিয়ে এল। সামনে একটা জিপ, তাতে কয়েকজন অফিসার বসে আছে।
পুলিশ দেখে আরও জোরদার হল স্লোগান। অনিমেষ লাইনের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছিল, ‘সাম্রাজ্যবাদীদের দালালদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও, ভেঙে দাও।’ সরবে তার সমর্থন বাজছিল গলায় গলায়। ‘মার্কিন-দালাল কংগ্রেস সরকার নিপাত যাক নিপাত যাক,’ ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন ভাঙা যায় না, যাবে না,’ ‘ভিয়েতনাম লাল সেলাম লাল সেলাম,’ ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’
চারপাশে ঝটপট দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাতে সেকেন্ড হ্যান্ড বইওয়ালারা ছুটোছুটি করে নিরাপদে রাখছে তাদের বইপত্তর। বৃষ্টি আসার আগে যেমন আচমকা দমকা হাওয়ায় চারদিক আলোড়িত হয় এখন সেই অবস্থা।
সুদীপ বলল, ‘মেইন মিছিলটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে চলে গেছে। আমরা আবার কলেজ স্কোয়ারের সামনে ফিরে যাই চলো।’
মিছিলের মুখ ফেরাতেই চোখে পড়ল কলুটোলা মির্জাপুর স্ট্রিটের মুখটায় অজস্র পুলিশ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবস্থা হল এই যে ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে হবে। কারণ দু’দিকের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম-বাস চলছে না, একটা ট্রাম হিন্দু স্কুলের সামনে আটক হয়ে রয়েছে। কয়েকজন নাছোড়বান্দা যাত্রী ছাড়া সেটা প্রায় ফাঁকাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে যেন সবাই আরও মুখর হয়ে উঠল। অনিমেষ স্লোগান দিল, ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ।’ গলায় গলায় সমর্থন ছড়াল ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।’
ঠিক সেই সময় জিপটা কাছাকাছি এগিয়ে এল। জিপের সামনে একজন অফিসার পোর্টেবল মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, ‘এই এলাকায় একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি আছে। আপনাদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে রাস্তা ছেড়ে চলে যান। একশো চুয়াল্লিশ ধারা বলবৎ থাকলে মিছিল করা আইনত অপরাধ।’
‘পুলিশ তোমার হুকুম আমরা মানি না, মানব না।’
‘জুলুমবাজ পুলিশকে চিনে নিন— এই মাটিতে কবর দিন।’
‘ভিয়েতনাম লাল সেলাম— লাল সেলাম।’
উত্তেজনা এখন এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। সুদীপ চিৎকার করে বলল, ‘কমরেডস, কংগ্রেস সরকারের দালাল ওই পুলিশরা আমাদের ওপর জুলুমবাজি করতে চাইছে। কিন্তু আমরা প্রথমে এমন কিছু করব না যাতে ওরা সুযোগ পায়। মনে রাখবেন, রক্তে রাঙা ভিয়েতনাম বাংলাদেশের আর-এক নাম।’
ঠিক সেই সময় দুম দুম করে আওয়াজ উঠল। পায়ের তলার রাস্তা কাঁপিয়ে দুটো বোমা ফাটল কলুটোলার দিকে। অনিমেষ দেখল, একটা পুলিশ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। দু’-তিনটে ছিটকে ওপাশে পড়ে গেল। মুহূর্তে ওদিকটা ফাঁকা হয়ে গেল, পুলিশগুলো পড়িমড়ি করে মির্জাপুরে রাখা ভ্যানগুলোর দিকে ছুটে গেল।
ব্যাপারটার জন্যে একদম প্রস্তুত ছিল না অনিমেষ। হঠাৎ কাণ্ডটা হওয়ায় মিছিলের সবাই হকচকিয়ে গেছে। সুদীপ সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সজাগ করিয়ে গলা তুলল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।’
সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের দিকে পুলিশ বাহিনীর সামনে দুমদাম বোমা এসে পড়ল। ধোঁয়ায় চারদিক এখন ঢাকা। ওদিকের পুলিশ পিছু হঠেছে। সমস্ত এলাকা এখন জনশূন্য। সুদীপ চিৎকার করে বলল, ‘কমরেডস, আপনারা গেটের সামনে চলে আসুন। ওরা যদি আক্রমণ করে তা হলে ভেতরে ঢুকে যাবেন। অনুমতি ছাড়া কোনও শিক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ ঢুকতে পারে না।’
সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে সবাই গেটের কাছে চলে এল। অনিমেষ তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সে দু’পাশে চোখ বুলিয়ে বোমার উৎসটা খুঁজল। প্রথম যে বোমা দুটো পড়েছে সেগুলোর দিকে তার খেয়াল ছিল না, কিন্তু শেষের দুটো যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পড়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ ধরনের পরিকল্পনার কথা তার জানা ছিল না। সে মুখ তুলে দেখল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যালকনিগুলোয় মেয়েদের ভিড় এবং তাদের নজর সব ওর দিকে। সুদীপ চিৎকার করে অনিমেষকে ডাকতেই টিয়ার গ্যাস চার্জ করল পুলিশ। ঠিক অনিমেষের সামনে একটা শেল এসে পড়ে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করল। অনিমেষ দেখল শেলটা এখনও অবিকৃত এবং ধোঁয়া একটা দিক থেকেই বেরুচ্ছে। চোখ জ্বলছে কিন্তু অনিমেষ পকেট থেকে রুমাল বার করে শেলটাকে তুলে কয়েক পা এগিয়ে পুলিশের দিকেই ছুড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে একরাশ পায়রার পাখার ঝটপটানির মতো সোচ্চার হাততালি বাজল। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল অনর্গল টিয়ার গ্যাসের শেল বৃষ্টি।
অনিমেষ সুদীপের কাছে সরে এলে সে বলল, ‘ওরকম হিরো হবার জন্য মাঝরাস্তায় দাঁড়াবার দরকার ছিল না। ওরা যে-কোনও মুহূর্তেই ফায়ারিং শুরু করতে পারে।’
সে-কথায় কান না-দিয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘বোমা ফাটাল কে? এরকম হবে আগে জানতাম না!’
সুদীপ খিঁচিয়ে উঠল, ‘আমি কি জানতাম? পুলিশ নিজের লোক দিয়ে বোমা ফাটিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করছে। অ্যাকশান নেবার জন্যেও একটা অজুহাত দেওয়া দরকার। এটাও বোঝো না?’
দু’চোখ এখন জলে ভরা। ভীষণ চোখ জ্বলছে, একটু রগড়ালে জ্বলুনিটা বাড়ছে। কতগুলো ছেলে ভেতর থেকে কয়েকটা জল ভরা বালতি নিয়ে এল। দেখাদেখি অনিমেষ রুমাল জলে ভিজিয়ে চোখে চাপা দিচ্ছিল। অনিমেষ দেখছিল একটি ছেলে, যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে মনে হচ্ছে না, মাঝে মাঝে ছুটে রাস্তায় নেমে গিয়ে অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে শেল কুড়িয়ে নিয়ে এসে বালতিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এই সময় ওপরের বারান্দাগুলোয় মেয়েদের চিৎকার উঠল। পুলিশ এবার বারান্দা তাক করে শেল ছুড়ছে।
সুদীপ বলল, ‘শালাদের কাণ্ডটা দেখছ। মেয়েরা ওদের কোনও ক্ষতি করেনি তবু ওখানে শেল ছুড়ছে। একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করা যায়?’
‘আমরা অ্যাটাক করব।’ সুদীপের মুখ এখন শক্ত। কথাটা বলেই সে ছুটে গেল ও পাশে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না অ্যাটাক করব বলতে সুদীপ কী বোঝাচ্ছে? রাইফেলধারী পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কি ছাত্রদের আছে! ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মাথায় আর-একটা বোধ উঁকি দিল। এখন যে ব্যাপারটা হচ্ছে সেটা কি হওয়া উচিত? যে ইস্যু নিয়ে ওদের বিক্ষোভ জানানোর কথা সেই ইস্যুটা তো ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। আর সেটা এমন একটা ব্যাপার যে তা নিয়ে এত বড় কাণ্ড হওয়া ঠিক নয়। এ যেন মশা মারতে কামান দাগার মতো ব্যাপার। হঠাৎ ওর খেয়াল হল বিমান নিশ্চয়ই এতক্ষণে আসল মিছিল নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ বিমানের যাওয়াটা নিরাপদ করার জন্যেই এখানে ওদের পুলিশকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
একটা চিৎকার, সেই সঙ্গে হ্যা হ্যা— অ্যা-অ্যা শব্দে কতগুলো ছেলেকে ছুটে যেতে দেখে অনিমেষ থতমত হয়ে গেল। এরকম শব্দ কী কারণে মানুষের গলা থেকে বের হয় কে জানে কিন্তু ছেলেগুলোকে কেমন অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে অবিরাম বোমাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই দেখল, ও পাশের থেমে-থাকা ট্রামটা দাউদাউ করে জ্বলছে। আচম্বিতে তার মনে সেই ছবিটা ভেসে এল। প্রথম যে-রাতে সে কলকাতায় পা দিয়েছিল, এমনি করে একটা ট্রামকে জ্বলতে দেখেছিল।
শব্দ করে ট্রামের শরীরটা ফাটছে। যে ছেলেগুলো ছুটে গিয়েছিল তারা চক্ষের নিমেষে গা ঢাকা দিল। আর সেই মুহূর্তে যে শব্দ হল সেটা যে রাইফেল থেকে হচ্ছে তা অনিমেষকে বলে দিতে হবে না কাউকে। প্রাচী সিনেমার পাশের গলিতে এইরকম একটা শব্দ তার শরীরে ছিদ্রচিহ্ন রেখে গেছে চিরকালের জন্য। সেদিন যে বোকার মতন গলির মাঝখান দিয়ে ব্যাগ হাতে ছুটেছিল সে আজ তড়িৎগতিতে গেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফায়ারিং হচ্ছে এই খবরটা বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরে সোচ্চার হয়ে ছড়িয়ে যেতেই ওপরের বারান্দার ভিড়টা হাওয়া হয়ে গেল আচমকা।
অনিমেষ আড়াল থেকে দেখল, পুলিশ বাহিনী রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। জায়গাটায় থাকা বিপজ্জনক বুঝতে পেরে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখতে পেল আড়ালে আবডালে ছেলেরা শেলটার নিয়ে নিয়েছে। দূরে দমকলের আওয়াজ ভেসে আসছে। গাড়িটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। চোখে চেপে ধরে ধরে ভেজা রুমালটা এখন প্রায় শুকনো। জ্বলুনিটা বাড়ছে। এখন কী করা যায়। কোনও বিশেষ নির্দেশ দেয়নি বিমান। সুদীপকেও সে দেখতে পাচ্ছে না। পরপর কয়েকটা বোমা ফাটল আচম্বিতে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ফায়ারিং শোনা গেল। অনিমেষ দৌড়ে দোতলায় উঠে এল। এ পাশের বারান্দাটা ফাঁকা। একদম রাস্তার ধারে বলে কোনও দর্শক এখানে নেই। সে উঁকি মেরে দেখল, দমকলের লোকরা কাজে নেমে পড়েছে। অঝোরে জল ঝরছে ট্রামটার ওপরে। আর তখনই ইট বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রাশি রাশি ইটের টুকরো এমনভাবে দমকলের লোকদের ওপর এসে পড়া শুরু হল যে ওদের পক্ষে কাজ করা শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াল থেকে ইট পড়ছে এবং পুলিশের পক্ষে এই মুহূর্তে কিছু করা অসম্ভব।
যা হোক যা চাওয়া হয়েছিল তা সফল হয়েছে। আজকের এই ঘটনার কথা নিশ্চয়ই আগামীকালের কাগজে থাকবে। ব্যাপারটার প্রচার যত বাড়বে তত ভিয়েতনাম সম্পর্কে ছাত্ররা যে উদ্বিগ্ন তা প্রকাশ পাবে। বিমান কি শেষ পর্যন্ত মার্কিন দূতাবাসে মিছিল নিয়ে পৌঁছাতে পারল? খবরটা এখন জানা যাবে না যদি কেউ না ফিরে আসে। হঠাৎ নীচে চোখ পড়তে অনিমেষ দেখতে পেল তিনটে পুলিশের জিপ হেয়ার স্কুলের দিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে ঢুকে পড়েছে। কী ব্যাপার? সুদীপ বলেছিল পুলিশ নাকি অনুমতি ছাড়া এখানে থাকতে পারে না! তবে কি অনুমতি পেয়ে গেছে?
এতক্ষণে খেয়াল হল এত যে গোলমাল হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা টিয়ার গ্যাসে নাস্তানাবুদ, কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলার তো দূরের কথা কোনও অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। ওঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে কিছুতেই ছাত্রদের বোঝানো সম্ভব নয়। অতএব হাল ছেড়ে বসে আছেন। পুলিশের খুব একজন বড় অফিসারকে ভাইস চ্যান্সেলারের ঘরের দিকে যেতে দেখতে পেল সে। কয়েক মিনিট যেতে না-যেতেই অফিসারটি নেমে এসে কিছু বললেন ওঁর সহকর্মীদের। আর তারপরই বিশ্ববিদ্যালয়চত্বর পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেল।
অনিমেষ সুদীপকে দেখতে পাচ্ছে না, ছাত্রদের তরফ থেকে কী করা উচিত এখন? হুকুম পাওয়ামাত্র পুলিশ ছুটে গেল সেই অংশটায় যেখান থেকে লুকিয়ে ইটবৃষ্টি করা হচ্ছে। কেউ কাউকে সতর্ক করার চেষ্টা করার আগেই একটা কনস্টেবল দুটো ছেলেকে টানতে টানতে ভ্যানটার কাছে নিয়ে এল। ছেলে দুটোকে চেনে না অনিমেষ এবং চেহারা দেখে মনে হয় না ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কী করে এখানে এল কে জানে! ছাত্র-আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগল না। চারদিকে ধোঁয়া, ভাঙা ইট কাচ ছড়িয়ে— পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নিয়ে নিয়েছে। এই যদি পরিণতি হয় তা হলে এতসব করা কী জন্যে? এবং এই পরিণতির কথা তো নিশ্চয়ই জানা ছিল। কয়েকটা ছাত্র একটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এরকম লড়াই করতে পারে না। আর লড়াইটা কী নিয়ে হচ্ছে, না কয়েক হাজার মাইল দূরে একটি বিদেশি রাষ্ট্র অন্য একটি দেশের ওপর অত্যাচার করছে বলে প্রতিবাদ জানাতে। অনিমেষ মাথা নাড়ল আপন মনে, না এভাবে চলতে পারে না। হয়তো এরকম টুকরো টুকরো কিছু বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে প্যানিক সৃষ্টি করা যায় কিন্তু সেটা কি ফলপ্রসূ?
বিশাল চত্বরটায় পুলিশ গিজগিজ করছে। অনিমেষ ফাঁকা দোতলার বারান্দা দিয়ে হেঁটে নিজের ক্লাসের সামনে এসে দেখল কুড়ি-পঁচিশটা মেয়ে চোখে রুমাল দিয়ে বসে আছে।