২০. জীবনে প্রথমবার থানায় এল অনিমেষ

কুড়ি

জীবনে প্রথমবার থানায় এল অনিমেষ। কলেজ স্ট্রিট ছাড়ার পর থেকেই ও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। ভ্যানের ভেতর গোটা ছয়েক কনস্টেবল এবং একজন সার্জেন্ট। তারাও ওকে তেমন পাত্তা দেয়নি, কারণ এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। ভ্যানের জানলা দিয়ে অনিমেষ রাস্তায় নজর রেখেছিল। প্রতিদিনের কলকাতা স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। দোকানপাট খোলা, লোকেরা হাঁটাচলা করছে। এই একই দৃশ্য অনিমেষ রোজ পথ চলতে দেখেছে কিন্তু আজ এই ভ্যানের তার-ঘেরা ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখতে ভীষণ ভাল লাগছিল। ক্ষুদ্র দিয়ে বিশালকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে এক বেদনা-জড়ানো আনন্দ আছে। কিন্তু এতক্ষণ অনিমেষের মনে কোনওরকম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়নি। সে যে বন্দি এবং কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ও সেখানে তার ভাগ্য-নির্ধারিত হতে পারে— এসব চিন্তা তার মাথায় আসেনি। সে জানে ওরা অযথা তাকে ধরেছে। কোনও অন্যায় যখন সে করেনি তখন ভুল বুঝতে পারলেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে।

কিন্তু বিমানদের ব্যাপারটা নিয়েই ও বেশি চিন্তিত ছিল। তাকে ভ্যানে তোলামাত্রই অতগুলো ছাত্র একসঙ্গে স্লোগান দিয়ে উঠল তার নাম ধরে। বুক-ভরা আন্তরিকতা না থাকলে অমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হয়? বিমান এর আগে যে কথাগুলো বলেছে সেটা ভাল করে ভেবে দেখা দরকার। ভুলভ্রান্তি প্রতি দলের থাকে। কাজ করতে গেলে তা হওয়া স্বাভাবিক। সি পি আই সম্পর্কে তার কোনওরকম মোহ নেই। কমিউনিজমের প্রতি যে আকর্ষণ সে বোধ করে তার জন্যে বিমানদের সঙ্গেই কাজ করা উচিত। সুবাসদা যে কথাটা বলেছিল তাও হয়তো মিথ্যে নয়। দলের নেতৃত্ব কোনও নতুন পথ দেখাতে পারছে না, দীর্ঘকাল নেতারা একই চেয়ারে বসে আছে, কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি ক্যাডারদের সামনে নেই। কিন্তু তবু যত অল্পই হোক কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠার জন্যে যে জঙ্গি মনোভাব দরকার তা বিমানদেরই আছে। একক বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যে কাজ দুঃসাধ্য হবে, আদৌ সম্ভব হবে না, তা ওদের সঙ্গে থাকলেই হতে পারে। মতবিরোধ ঘটতেই পারে কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে মানিয়ে চলা নীতি অনুসরণ করা উচিত।

সার্জেন্টের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকতেই অফিসার ওদের দিকে তাকিয়ে বলল ‘কী ব্যাপার?’

‘কলেজ স্ট্রিট থেকে তুলে আনলাম।’

‘কী অবস্থা?’

‘একদল ঢুকবে অন্যদল ঢুকতে দেবে না।’

‘সিরিয়াস কিছু?’

‘নাঃ, দু’-একটা ছুটকো বোমা ফেটেছে, ব্যস।’

‘তা হলে খামোকা একে আনতে গেলে কেন? ফরনাথিং ট্রাবল ইনভাইট করা। এখনই হয়তো ফোন আসবে সুড়সুড় করে ছেড়ে দিতে হবে। স্টুডেন্টস প্রবলেম খুব ডেলিকেট ব্যাপার এটা তোমাকে বোঝাতে পারলুম না আজও।’ খুব বিরক্তির গলায় কথা বলছিলেন ভদ্রলোক। অনিমেষ দেখল ভদ্রলোকের মুখটা পুলিশের মতো নয়। মাথায় টাক থাকায় অনেকটা বিদ্যাসাগরের মতো দেখাচ্ছে। পরনেও পুলিশি পোশাক নেই।

সার্জেন্ট বলল, ‘একদম খালি হাতে ফিরে আসব?’

অফিসার এর উত্তর না-দিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করলেন যে অনিমেষের হাসি পেয়ে গেল। সার্জেন্ট সেটা দেখে চিৎকার করে ধমকে উঠল তাকে।

অনিমেষ বলল, ‘খামোকা চেঁচাচ্ছেন কেন?’

‘ইউ শাট আপ। এমন মার মারব জন্মের জন্যে বোমা ছোড়া বেরিয়ে যাবে।’ সার্জেন্ট একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে ওর দিকে মুখ খেঁচাল।

‘বোম? কে বোম ছুড়েছে?’ অফিসার চটপট জিজ্ঞাসা করলেন।

‘এই শ্রীমান স্যার। অল্পের জন্যে ভ্যানে লাগেনি।’

‘আই সি! চেহারা দেখে তো সুবোধ মনে হচ্ছিল। পুলিশভ্যানে বোমা মারার জন্যে কপালে কী জুটবে তা জানা আছে?’

‘আমি বোম ছুড়িনি। উনি মিথ্যে কথা বলছেন!’ অনিমেষ বলল।

‘মিথ্যে কথা বলছি? দূর থেকে দেখলাম ইউনিভার্সিটির গেটে বোম পড়ল। রাস্তা ফাঁকা। কাছাকাছি আসতেই দেখলাম তুমি ফুটপাত থেকে নেমে আসছ। এসব মিথ্যে কথা?’ ধমকানির সুরটা সার্জেন্টের গলা থেকে যাচ্ছিল না।

অফিসার ভদ্রলোকের মুখের চেহারা ততক্ষণে বদলে গেছে।

অনিমেষ বলল, ‘আমি বোমা ছুড়িনি, যে ছুড়েছিল তাকে ধরতে গিয়েছিলাম।’

কথাটা শেষ হতেই এক লাফে সার্জেন্ট ওর সামনে এসে দাঁড়াল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই লোকটার দুটো হাত ওর সর্বাঙ্গে ঘোরাফেরা করতে লাগল। পকেট থেকে আরম্ভ করে কোমর কিছুই বাদ গেল না।

লোকটা হতাশ হয়ে আবার চেয়ারে ফিরে গেল। তারপর কয়েক সেকেন্ড চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘স্যার, একে দু’নম্বর দেওয়ার দরকার। মিস্টিরিয়াস কেস। খালি হাতে বোমবাজকে ধরতে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছে। দাওয়াই না-দিলে সত্যি কথা বলবে না।’

‘তুমি খালি হাতে গিয়েছিলে? যদি বোম ছুড়ত তা হলে?’ অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমি অতটা ভাবিনি। তা ছাড়া দেখামাত্র লোকটা পালিয়ে গেল।’ অনিমেষ সত্যি কথাটাই বলল।

‘লোকটা? কোন লোক? তুমি চেনো?’

‘কী আশ্চর্য! আমি চিনব কেমন করে? ওকে কখনও দেখিনি আমি।’

‘কোন পার্টির লোক?’

‘তা জানি না।’

‘বোম ছুড়ছিল বলছিলে, কাদের দিকে বোমগুলো ছুড়ছিল?’

‘আমরা যারা গেটে ছিলাম তাদের দিকে।’

‘তোমরা মানে যারা বন্ধ্ ডেকেছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তার মানে লোকটা তোমাদের অ্যান্টি পার্টি এই তো? অর্থাৎ ছাত্র পরিষদ করে নিশ্চয়ই, কী বলো?’

অনিমেষ টের পাচ্ছিল অফিসার তাকে কথার জালে ঘিরে ধরে কোনও কিছু তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতে চাইছে। সে সতর্ক হল, ‘আমি এসব কিছুই বলছি না। একটা লোক বোম্বিং করছিল এবং সে চাইছিল না আমরা গেটে দাঁড়িয়ে স্ট্রাইক কনডাক্ট করি। কিন্তু সে কোন দলের লোক তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কারণ তাকে আমি চিনি না।’

হঠাৎ অফিসার একশিট সাদা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আজকে যা যা ঘটেছে তা এখানে লিখে নাম সই করে ঠিকানাটা দিয়ে দিন। আমি একটা রেকর্ড রাখতে চাই।’

একমুহূর্ত ভেবে অনিমেষ কাগজটা টেনে নিল। সে যদি না-লেখে তা হলে এরা কিছু করতে পারে না। এই ঘরে ঢোকার আগে একটা খাঁচার ঘর সে দেখেছে। কয়েকটা অপরাধী মার্কা চেহারা সেই খাঁচায় শুয়ে বসে আছে। ওটাকে বোধহয় লক-আপ বলে। থানায় ধরে নিয়ে এলে লক-আপে রাখা হয়। পুলিশের লক-আপ সম্পর্কে নানান গল্প শুনেছে অনিমেষ। আজ কীরকম অভিজ্ঞতা হয় কে জানে! না-লেখার পেছনে কোনও অজুহাত খুঁজে পেল না সে। যা সত্যি কথা তা লিখতে দোষ কী!

এখনও কেউ তাকে চেয়ারে বসতে বলেনি। শব্দ করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কাগজটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। সার্জেন্ট বলছিল, ‘আমার মন বলছে এ বোম্বিং-এ ইনভলভ্‌ড। একটু ধোলাই দিলে—।’

‘লেট হিম রাইট।’

লেখা শেষ করে অফিসারের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিল অনিমেষ। সেটা হাতে নিয়ে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অনিমেষ মিত্র?’

‘হ্যাঁ?’

‘হস্টেলে থাকা হয়?’

‘হ্যাঁ।’

সার্জেন্ট সোজা হয়ে বসল, ‘কোন হস্টেল? হস্টেলগুলো স্যার ক্রিমিন্যালদের আড্ডা।’

‘স্কটিশচার্চ।’

‘বাড়ি কোথায়?’ অফিসার কাগজটা থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না।

‘জলপাইগুড়িতে।’

‘এর আগে কখনও অ্যারেস্টেড হয়েছেন?’

‘না।’

‘এনি পুলিশ এনকোয়ারি?’

হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। পুলিশের খাতায় নিশ্চয়ই তার নাম আছে। হাসপাতালে যে পুলিশ অফিসারটি তাকে জেরা করতে গিয়েছিলেন তিনি নিশ্চয়ই তা রেকর্ড করে রেখেছেন। কথাটা এখন বললে আর দেখতে হবে না। সার্জেন্টটা ওকে বোমবাজ প্রমাণ করার জন্যে তো মুখিয়ে আছে। তার পায়ে বুলেট লেগেছিল জানলে রক্ষে রাখবে না। সেবার নীলার বাবার দৌলতে—। ও ঘাড় নাড়ল ‘না’।

‘এতক্ষণ ভাবতে হল কেন?’ প্রশ্নটা সার্জেন্টের।

প্রশ্নটার উত্তর দিল না অনিমেষ। অনেক অপ্রিয় কথা চুপ করে থাকলে এড়ানো যায়।

সার্জেন্ট বলল, ‘আমি শিয়োর স্যার—।’

অফিসার বললেন, ‘ছেড়ে দাও এসব কথা। অনিমেষবাবু, আমি চাই না ফরনাথিং কেউ হ্যারাসড হোক। আপনার স্টেটমেন্ট আমাদের কাছে থাকল। কিন্তু এর পর যদি কখনও আপনার সম্পর্কে সামান্য অভিযোগ পাই তা হলে ভীষণ বিপদে পড়বেন। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে নিশ্চয়ই। কলকাতায় পড়াশুনো করতে এসেছেন তাই মন দিয়ে করুন। ইউনিয়নবাজি করে নিজের বারোটা বাজাচ্ছেন কেন?’

অনিমেষ হাসল, ‘উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। তবে প্রত্যেকের বোমার ধরন-ধারণ আলাদা এটা মনে রাখাই ভাল।’

কথাটা শেষ হওয়ামাত্রই অফিসারের মুখটা বুলডগের মতো হয়ে গেল, ‘গেট আউট, গেট আউট।’

অনিমেষ সুযোগ নষ্ট করল না। দ্রুত পায়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল। ওর ভয় হচ্ছিল যে-কোনও মুহূর্তেই অফিসার তার ভুল বুঝতে পেরে ওকে আটকাতে নির্দেশ দেবেন। এত সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার কথা ভাবা যায় না?

রাস্তায় নেমে অনিমেষের অস্বস্তি শুরু হল। যেরকম সমারোহ করে তাকে নিয়ে আসা হল এভাবে কিছু না-ঘটেই ছাড়া পাওয়া তার সঙ্গে ঠিক মানাচ্ছে না।

ব্যাপারটা যে সত্যি বেমানান তা কয়েক মুহূর্ত বাদেই ভাল করে বোঝা গেল। ইউনিভার্সিটির পথে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওদের দেখতে পেল অনিমেষ। জনা কুড়ি ছেলে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। ওদের সামনে সুদীপ, মুখখানা খুব গম্ভীর। অনিমেষ অনুমানই করতে পারেনি ছাত্রমিছিলটা ওরই উদ্দেশে থানার দিকে এগোচ্ছে। স্লোগানে নিজের নাম শুনতে পেয়ে চমকে গেল ও। তার জন্য দল এত চিন্তা করছে—নিজেকে ভীষণ মূল্যবান বলে মনে হল ওর। ফুটপাত ছেড়ে সে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।

ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সবাই। অনিমেষকে কেউ এখানে আশা করেনি। সুদীপ অত্যন্ত বিস্মিতের গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’

অনিমেষের হঠাৎই মনে হল সে যেন একটা অন্যায় করে ফেলেছে। এবং এই অন্যায়টি মোটেই ছোট মাপের নয়। সে নিচু গলায় বলল, ‘ছেড়ে দিয়েছে।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ছাড়ল কেন?’ সুদীপের গলায় অসহিষ্ণু ভাব।

‘ওরা ভেবেছিল আমি বোম ছুড়েছি তাই ধরেছিল। কিন্তু ও সি বোধহয় বুঝতে পেরেছেন এটা ঠিক নয় কিংবা প্রমাণ করা যাবে না, তাই।

‘অসম্ভব। পুলিশ রাতারাতি চৈতন্যদেব হয়ে যায়নি। ভুল বুঝতে পারলেও ওরা দু’দিন লক-আপে রেখে দেয়। মিস্টিরিয়াস ব্যাপার।’

অনিমেষ অনুভব করল ওর এই বেরিয়ে আসায় সুদীপ আশাহত। ধারণাটার সমর্থন মিলল আর একটি কথায়। সুদীপের পাশে দাঁড়ানো একটি ছেলে বলে উঠল, ‘এখন কী হবে সুদীপদা! ওকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে আমরা যে কালকেও ধর্মঘট ডেকেছি। এখন তো তার কোনও মূল্য থাকবে না।’

সুদীপ বলল, ‘দ্যাটস দি পয়েন্ট। তোমার রিলিজের ব্যাপারের মধ্যে কিছু একটা আছে। যাক সে-কথা। এখন হয় তোমাকে দু’দিন কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে— না, না। সেটা আর সম্ভব নয়।’ নিজেই কথাটা ঘুরিয়ে নিল সে, ‘এতগুলো ছেলে যখন তোমাকে দেখতে পেয়েছে তখন খবর চাপা থাকবে না।’

সঙ্গের ছেলেটি বলল, ‘সুদীপদা, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আমরা অনিমেষকে সঙ্গে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যাই। যেন থানায় বিক্ষোভ করে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছি—।’

সুদীপ বলল, ‘গুড। ইটস এ গুড প্রপোজাল। তাই করো।’ তারপর চাপা গলায় অনিমেষকে বলল, ‘ইউ আর বিকামিং এ হিরো আউট অফ নাথিং।’

অনিমেষকে কিছুই করতে হল না। মিছিলটা প্রচণ্ড উন্মাদনা নিয়ে ফিরে এল বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনিমেষকে চুপ করে থাকতে হল কিন্তু সেটাই তার কাছে খুব কষ্টকর হয়েছিল। ছোট্ট একটা জনসভায় সুদীপ আগামীকালের প্রস্তাবিত ধর্মঘট তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করল। কিন্তু ব্যাপারটা যে খুব জোরালো এবং আন্তরিকতাপূর্ণ হচ্ছে না এটা অনিমেষ স্পষ্ট অনুভব করছিল।

বিমানকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল অনিমেষ। পুলিশ ওকে দিয়ে স্টেটমেন্ট লিখিয়ে নিয়েছে কিন্তু গায়ে হাত দেয়নি।

বিমান শুনে বলল, ‘নিজের হাতে লিখে না-দিলেই পারতে। এটাকে ওরা মুচলেকা বলে প্রচার করলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। তা ছাড়া তোমার ওইভাবে রাস্তা পেরিয়ে ধাওয়া করতে যাওয়া উচিত হয়নি। বোমাটা তোমার শরীরে সোজাসুজি এসে পড়তে পারত। হঠকারিতা থেকে কোনও সুফল পাওয়া যায় না। কমিউনিজমের সার্থকতা ব্যক্তিগত কৃতিত্বে নয়, সামগ্রিক দলবব্ধ উন্নয়নে। যাক, আজ আমরা জিতেছি। একটি ছেলেও ক্লাস করতে ঢোকেনি।’

অনিমেষ বলল, ‘পুলিশের হাত থেকে এত সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনও কারণ নেই কিন্তু। মানে, সুদীপের কথা শুনে মনে হচ্ছিল ও ঠিক বিশ্বাস করছে না ব্যাপারটা। অথচ আমি কিছুই জানি না—’

বিমান হাসল, ‘হয়। এরকম পরিস্থিতি হয়েই থাকে। যাক, তুমি কিন্তু অনেকদিন পার্টি অফিসে যাওনি, আজ যাবে।’

অনিমেষ এতক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সারাদিন স্নান-খাওয়া নেই, তার ওপর এরকম একটা টেনশন গেল, এখন খুব কাহিল লাগছিল। বিমান সেটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় অনুমান করল, ‘না, ঠিক আছে। তুমি হস্টেলে ফিরে যাও। খাওয়া-দাওয়া করে রেস্ট নাও। আগামীকাল আমার সঙ্গে যেয়ো। জরুরি কাজের দায়িত্ব নিতে হবে।’

‘কী কাজ?’ অনিমেষ কৌতূহলী হল।

‘নির্বাচন আসছে। বাই-ইলেকশন। তোমাকে প্রচারে নামতে হবে। হাতে-কলমে অন্তত পনেরো দিন কাজ করো। থিয়োরি আর প্র্যাকটিক্যালের মধ্যে কীভাবে ব্রিজ তৈরি করতে হয় শেখো। আচ্ছা এসো।’

অনিমেষ বেরিয়ে আসছে এমন সময় বিমানের কণ্ঠ ওকে থামাল, ‘অনিমেষ, সুবাসদের সম্পর্কে সতর্ক থেকো। যারা পথভ্রষ্ট তারা কখনওই এগোতে পারে না। ও কে!’

এতক্ষণ বেশ চলছিল। হঠাৎ একদম আকাশ থেকে পেড়ে আনার মতো যাওয়ার সময় সুবাসদার প্রসঙ্গ টেনে আনল বিমান। সমস্ত উদ্দীপনা, নির্বাচনে কাজ করবে বলে যা অনিমেষকে আপ্লুত করেছিল, সুবাসদার প্রসঙ্গ তুলতেই কেমন মিইয়ে যেতে আরম্ভ করল। বিমান কি সুপরিকল্পিত ভাবেই ওই সময় সুবাসের নাম করে তাকে সতর্ক করে দিল?

অনিমেষ অনুভব করল, অবিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা একবার কোথাও প্রবেশ করলে লক্ষ বার চুনকামেও দূর হয় না। কিন্তু তবু অনিমেষ নিজেকে প্রফুল্ল রাখতে চাইল। এতদিন পরে সে হাতে-কলমে কমিউনিজমের পক্ষে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। আগামী মাসে পশ্চিমবাংলার দু’জায়গায় উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। তাকে কোথায় পাঠানো হচ্ছে? অনিমেষ যেন এখনই অধৈর্য হয়ে পড়েছিল।

ট্রাম রাস্তায় পা দিতেই সে নিজের নাম শুনতে পেল। চিৎকার করে যে তাকে ডাকছে সে রাস্তার ওপারে। বেশ কিছুদিন পরমহংসকে দেখতে পায়নি অনিমেষ। এখন ওকে সামনে দেখে ভাল লাগছে। অমন খাটো শরীরেও কী উজ্জ্বল মুখ। কাছাকাছি হতেই পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘বিপ্লব হল?’

বলার ধরনে এমন একটা স্নেহমিশ্রিত শাসন আছে যে না-হেসে পারল না অনিমেষ, ‘কোথায় আর হল?’

পরমহংস খপ করে ওর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে পানের দোকানের সামনে আনল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘নিজের বদন চেয়ে দেখো একটু।’ অনিমেষ দেখল দোকানের আয়নায় তার ছায়া পড়েছে। নিজের এরকম বিধ্বস্ত চেহারা সে কখনও দেখেনি। এমনকী জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনজার্নি করে এসেও নয়। মাথার চুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে, মুখ ময়লায় কালো, চোখের তলায় কে যেন কালি লেপে দিয়েছে। পরমহংসের গলা পেল সে, ‘একদিনেই যদি এই হাল হয় তবে দেশে বিপ্লব করবেন উনি! ননির পুতুল।’

কুচকুচে কালো কচি দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে অনিমেষ বলল, ‘আছ বেশ!’

পরমহংস বলল, ‘আছি কোথায়? চিরজীবন হয় হাতল নয় পোস্ট অফিস হয়েই কাটালাম। তোমার মতো মেয়ে-কপালে হয়ে জন্মানোর ভাগ্য চাই।’

‘হাতল মানে?’

‘চেয়ারে থাকে। না-থাকলেও ক্ষতি নেই। থাকে একস্ট্রা আরামের জন্য। যাক, পুলিশ প্যাঁদায়নি তো?’

‘না।’ হেসে ফেলল অনিমেষ।

‘যাচ্চলে! হিরো হয়ে যেতে পারতে প্যাঁদালে। যে দুটো কারণে তোমার জন্যে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম— টিউশনি করার ইচ্ছে আছে?’

‘আছে। কিন্তু আপাতত সময় পাব না। পার্টির কাজে বাইরে যেতে হবে।’

‘বাঁচা গেল। পড়াশুনার ইতি হয়ে গেল তো?’

‘তা কেন? অসুখ-বিসুখের জন্যেও তো অনেকে কামাই করে।’

‘ভাল। আমি এখন কাটছি। প্রয়োজন হলে খবর দিয়ো।

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘ফোকটে ছুটি পাওয়া গেল, পিচ ছেড়ে দু’-একটা স্ট্রোক করে আসি। টিউশনি সেরে আসি।’ পরমহংস চলে যেতে যেতে আবার ঘুরে এল। রসগোল্লার মতো মুখ করে বলল, ‘দ্বিতীয় কথাটাই বলা হয়নি তোমাকে!’

‘কী কথা?’

‘ডান দিকের ওই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সামান্য এগিয়ে সোজা দোতলায় চলে যাও। কুইক।’ কথাটা শেষ করে হনহন করে চলে গেল পরমহংস।

ধাঁধার মতো লাগল কথাগুলো। অনিমেষ নির্দেশ মেনে বসন্ত কেবিনের দরজায় আসতেই নাকে খাবারের গন্ধ টের পেল। এতক্ষণ যা হয়নি এই মুহূর্তে প্রচণ্ড ক্ষুধার অস্তিত্ব টের পেল ও। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসতেই ওর মনে হল শরীরের সব রক্ত ঢেউ হয়ে যাচ্ছে। কোনওক্রমে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল অনিমেষ।

দোতলার হলের একটা কোনার টেবিলে মাধবীলতার সামনে যে মেয়েটি বসে ছিল অনিমেষকে দেখতে পেয়েই সে উঠে দাঁড়াল, ‘যাই ভাই।’ মাধবীলতা ঘাড় নাড়তেই মেয়েটি আড়চোখে অনিমেষকে একবার দেখে পাশ দিয়ে নেমে গেল।

রেস্টুরেন্টে আরও অনেকে আছে। আলটপকা ছুটি পাওয়ায় ছেলেমেয়েরা আড্ডা মারছে টেবিলে টেবিলে। এদের মধ্যে দু’-একজোড়া এখনই বেশ প্রসিদ্ধ। ওরাও অনিমেষকে দেখছিল। খুব শান্ত ভঙ্গিতে সে মাধবীলতার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘বসতে পারি?’

ছোট্ট একটা ভাঁজ ঠোঁটে পড়ল কি পড়ল না, কিন্তু চোখ দুটো অনেক কথা বলে ফেলল। মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল, সম্মতির।

অনিমেষ ঠিক উলটো দিকে আরাম করে বসে টেবিল থেকে একটা নিটোল জলের গ্লাস তুলে পুরোটা খেয়ে নিল।

মাধবীলতা তাকে দেখছে। এতক্ষণ সে একবারও চোখ সরায়নি। অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের, বলল, ‘কেমন আছেন?’

‘চমৎকার।’ কথা বলল মাধবীলতা। শব্দের উচ্চারণে অনিমেষের মনে হল কথাটার মানে খুব খারাপ আছি, খুব।

‘এখানে কখন এসেছেন?’

‘এসেছি!’

কথাটা যেন একটা পেরেট ঠোকার মতো, নিশ্চিত কিন্তু অবহেলায়। অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। এই দু’দিন মেয়েটির কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করেনি কিন্তু তার প্রতিটি মুহূর্তে মাধবীলতা জড়িয়ে ছিল সে টের পায়নি। বুকের মধ্যে রিমরিম শব্দ, চোখ খুললেই নিজেকে সম্রাট মনে হয়।

মাধবীলতা বলল, ‘দু’দিন কী হয়েছিল?’

অনিমেষ কথা বলতে পেরে বেঁচে গেল। বলল, ‘হঠাৎ আমার ঠাকুরদা এসেছিলেন, আর তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন বলে বেরোতে পারিনি। হস্টেলে একা ওরকম মানুষকে রেখেও আসা যায় না। অথচ একটু ভাল বোধ করতেই আর থাকলেন না। আজই ফিরে গেলেন।’

‘সেকী! তা হলে এলেন কেন?’

‘আমাকে দেখতে। আমি ওঁর কাছে মানুষ হয়েছিলাম। সে অনেক কথা।’

‘আমি শুনতে চাই।’

‘কেন?’

‘আমার মনে হচ্ছে শোনা দরকার।’

‘কী কথা?’

‘আপনার কথা।’

‘বেশ। তবে আজ থাক, অন্যদিন—।’

‘আজই তো বলছি না। সময় হলে বলবেন।’

অনিমেষ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আজ সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।’

মাধবীলতা বলল, ‘আমি জানি।’

‘আপনি কখন এসেছেন এখানে?’

‘যেমন রোজ ক্লাস করতে আসি।’

‘তা হলে আমাকে যখন ভ্যানে তোলা হল তখন দেখেছেন?’

‘দেখেছি।’

‘ও।’

‘কিন্তু আমি জানতাম আপনি ফিরে আসবেন।’

‘মানে?’ অনিমেষ চমকে উঠল। সুদীপের প্রকাশ্য সন্দেহটা কি মাধবীলতার মনেও সঞ্চারিত হয়েছে!

‘আমি প্রার্থনা করেছিলাম তাই জানতাম।’

হেসে ফেলল অনিমেষ, ‘তাই বলুন! কিন্তু কোনও কিছু প্রার্থনা করলেই যদি পূর্ণ হত তা হলে পৃথিবীতে কোনও কষ্ট থাকত না।’

‘তা ঠিক। কিন্তু আমি যখন ভীষণভাবে কিছু চাইব তখন সেটা বিফল হবে না। কারণ আমি নিজের জন্যে কিছু চাইনি কখনও এবং এই প্রথম কিছু চাইলাম। হয়তো চাওয়া শুরু হল।’

বুক ভরে নিশ্বাস নিল অনিমেষ। ওর কষ্ট এখন পরম পাওয়ায় নতজানু, ‘আমি কিন্তু ভরসা করতে শিখলাম।’

মাধবীলতা হাসল, ‘আমরা কিন্তু কেউ কাউকে জানি না।’

‘জেনে নেব।’

‘জানার পর যদি আফশোস হয়!’

‘আফশোস নয়, ভয় হতে পারে।’

‘ভয়! ভয় কেন?’

‘নিজের যোগ্যতা যদি না-থাকে তা হলে—।’

‘যোগ্যতা সেদিনই হারাবেন যেদিন অবহেলা করতে শিখবেন। চেহারা এমন হয়েছে কেন? আজ স্নান হয়নি?’

‘সময় পেলাম কোথায়?’

‘সেকী! খাননি?’

‘ভেবেছিলাম হস্টেলে ফিরে খাব। হল না।’

মাধবীলতা সোজা হয়ে বসে বয়কে হাত নেড়ে ডাকল। অনিমেষ তাই দেখে আপত্তি জানাল, ‘আরে করছেন কী—!’

‘আপনি খাবেন তাই ব্যবস্থা করছি।’

‘কিন্তু আমার কাছে পয়সা নেই।’

এত দ্রুত মেঘ কখনও আসে না আকাশে, দুটো চোখে সমস্ত শরীর যেন জল ছুড়ে দিল। মাধবীলতার মুখ পলকেই লাল, ঠোঁট থরথর করছে। অনিমেষ কথাটা সহজ গলায় বলেছিল, বলেই বুঝতে পেরেছিল কী হয়ে গেল ব্যাপারটা। সে মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি বুঝতে পারিনি!’

‘ভরসার কথা বলছিলেন না?’

‘ক্ষমা চাইছি।’

‘আপনার কোনও দোষ নেই। দিতে পারার মধ্যে একটা অহংকার আছে তাই অনেকেই তা পারে। কিন্তু নিতে জানতে হয়। সেটা বড় কঠিন।’

‘লতা—!’

মাধবীলতা হাসল। চোখের কোণে মুক্তো অথচ মুখে শরতের প্রথম সকাল। নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপে একটু দেখল অনিমেষকে, তারপর বলল, ‘মনে আছে তা হলে! লতা বড় জড়িয়ে ধরে, বিরক্তি আসবে না তো কখনও?’

অনিমেষ উত্তরটা দিতে গিয়ে দেখল বয় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মাধবীলতা চোখের জল মোছার চেষ্টা করল না। শান্ত গলায় বলল, ‘পেট ভরে যায় এমন খাবার কী আছে তোমাদের?’

ছেলেটি চটপট জবাব দিল, ‘কষামাংস আর মোগলাই পরোটা।’

মাধবীলতা বলল, ‘খুব তাড়াতাড়ি আনো। এক জায়গায়। আমাকে শুধু এক কাপ চা দাও।’

সেটা শুনে আপত্তি করতে যাচ্ছিল অনিমেষ, হাত প্রসারিত করে মাধবীলতা বলল, ‘একদম লজ্জা করতে হবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *