৩২. পয়লা তারিখে খুব ভোরে

বত্রিশ

পয়লা তারিখে খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল অনিমেষের। বালিশে মুখ রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকতেই মাথার ভেতর চিন্তাটা হঠাৎ নড়ে উঠল। আজ মাধবীলতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে হস্টেলে আসবে। কথা আছে, সকাল আটটার মধ্যে অনিমেষ, বেলঘরিয়া স্টেশনে ওর জন্যে অপেক্ষা করবে। নিমতা থেকে মাধবীলতা রিকশা নিয়ে সেখানে আসবে। তারপর ট্রেন ধরে শিয়ালদায় নেমে ওরা হস্টেলে যাবে। প্রথম দিন অনিমেষ সঙ্গে গেলে মাধবীলতার সুবিধে হবে।

অনিমেষ চেয়েছিল নিমতার বাড়িতে যেতে। শেষবার সে নিজে মাধবীলতার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ভদ্রলোক জেদ ধরে আছেন সত্যি কিন্তু ভাল করে বোঝালে হয়তো বুঝতেও পারেন। কিন্তু মাধবীলতা তাতে কিছুতেই রাজি হয়নি। বলেছিল, ‘আমার বাবা তোমাকে অপমান করবেন আমি সেটা দাঁড়িয়ে দেখতে পারব না। যা কিছু শুনতে হয় তা আমিই শুনব।’

অনিমেষ একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ‘ঠিক আছে। তবু একটা কথা বলি, জানি তুমি রেগে যাবে শুনলে, কোনওভাবেই কি অ্যাডজাস্ট করা যায় না?’

মাধবীলতা রাগল না। ওর ঠোঁটের আদল ফুটল শুধু। তারপর খুব নিচু গলায় বলল, ‘আমি আর টেনশন সইতে পারছি না। প্রতিদিন এক কথা শুনতে শুনতে আমার নার্ভ সহ্যের সীমায় এসেছে।’ তারপর খানিক চুপ করে বলল, ‘তুমি এত চিন্তা করছ কেন। আমি নিজে একজন মেয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাকে হাজারটা চিন্তা করতে হয়েছে।’

মাধবীলতা তাই একাই বাড়ি থেকে বের হতে চেয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি যাতে অনিমেষ না-যায় তাই বেলঘরিয়া স্টেশনে ওকে অপেক্ষা করতে বলেছে। ব্যাপারটা অনিমেষের ভাল লাগেনি। মাধবীলতা তার জীবনের এই ঝুঁকির সঙ্গে ওকে জড়াতে চাইছে না এটা ভাবলেই নিজেকে অক্ষম বলে মনে হচ্ছিল। এ মেয়ে যা কিছু করবে তা নিজের দায়িত্বে করতে চায়। অনিমেষের অস্বস্তিটা এইখানেই।

অনিমেষ দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। হাতিবাগান থেকে বেলঘরিয়াতে পৌঁছাতে মিনিট চল্লিশেক লাগবে। ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। একটি মেয়ে আজ তার জন্যে জীবনের বাঁধা রাস্তার সব সুখ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসছে এটুকু ভাবলেই নিজেকে সম্রাট বলে মনে হয়। জামাকাপড় পরতে পরতে অনিমেষ ভাবছিল যদি মাধবীলতা কোনও কারণে বাড়ি থেকে না-বেরুতে পারে তা হলে সে কী করবে? যদি বাড়ির লোকেরা জোরজবরদস্তি করে ওকে আটকে রাখে? অনিমেষ ঠিক করল, যদি বেলা দশটার মধ্যেও মাধবীলতা স্টেশনে না-আসে তা হলে সে কোনও নিষেধ মানবে না। সোজা মাধবীলতার বাবার মুখোমুখি হবে। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে নিজের অজান্তেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল অনিমেষ। ঠিক এইসময়েই দরজায় শব্দ হল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অনিমেষ বলল, ‘কে’?

এইসময় কেউ এসে কথা বললে দেরি হয়ে যাবে বলে অনিমেষ বিরক্ত হচ্ছিল। বাইরে থেকে কেউ সাড়া না-দেওয়ায় সে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দু’হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠল। বাইরে এখন ঝকঝকে রোদ্দুর। আর সেই রোদ্দুর পেছনে রেখে মাধবীলতা দুই চোখে হাসছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ শরতের আকাশ হয়ে গেল অনিমেষের। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনওরকমে বলল, ‘তুমি!’

মাধবীলতা তখনও হাসছিল। সেই হাসিতে একই সঙ্গে আনন্দ আর সংকোচ। দুটো চোখের চাহনি নিঃশব্দে অনেক কথা বলে দিচ্ছে ওর। একটা হলুদ শাড়ি পরে আসায় সমস্ত চেহারায় মিষ্টি ঔজ্জ্বল্য এসেছে। বিব্রত অবাক অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাগ করেছ?’

‘কী আশ্চর্য! রাগ করব কেন? কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে?’ অনিমেষের বিস্ময় তখনও কাটছিল না। এই সকালবেলায় মাধবীলতা ওপরে উঠে এল কীভাবে? সাধারণত কেউ দেখা করতে এলে দারোয়ান এসে খবর দিয়ে যায়। অনিমেষ দেখল সুন্দরী একটি মেয়ে ভেতরে এসেছে, এ খবর ঘরে ঘরে জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। কারণ এক-একটা অজুহাত দেখিয়ে অন্যান্য বোর্ডাররা বাইরে বেরিয়ে মাধবীলতাকে দেখছে। অস্বস্তি হল ওর। সেই সময় মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ঘরে যেতে বলবে না?’

‘আমার ঘর?’ অনিমেষ নিজের ঘরটার দিকে তাকাল। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মাধবীলতাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সচেতন হয়ে গেল সে। খবরটা প্রচারিত হতে বেশি সময় লাগবে না। হস্টেলের নিয়মকানুন তো আছেই, একটি অবিবাহিতা মেয়ে ছেলেদের হস্টেলে একা বসে গল্প করছে এ খবর ইউনিভার্সিটিতে দারুণ মুখরোচক হবে। সে কোনও কথা না-বলে দরজায় তালা লাগিয়ে বলল, ‘চলো, বের হব।’

মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘মানে’?

‘আমাকে একটু বেরোতে হবে, কাজ আছে।’ অনিমেষ কপট গলায় বলল। ওকে কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে অনিমেষ সিঁড়ির দিকে এগোল। হস্টেলের এই ছাদের ঘরে আজ অবধি কোনও মেয়ের পদার্পণ হয়নি। যতটা করলে অভদ্রতা না মনে হয় ঠিক ততটা আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় বারান্দায় ছেলেরা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাধবীলতা অনিমেষের পেছন পেছন নীচে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় কাজ আছে তোমার?’

‘বেলঘরিয়া স্টেশনে।’ অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলল।

‘ইয়ারকি না?’ এতক্ষণে সহজ হল মাধবীলতা, ‘এমন মুখের ভঙ্গি করেছিলে না যে মনে হচ্ছিল এসে খুব অন্যায় করেছি।’

‘অন্যায় কিছুটা হয়েছে বই কী! ওইভাবে হুট করে ওপরে উঠে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। আফটার অল এটা ছেলেদের হস্টেল।’ গেটে এসে অনিমেষ চারধারে নজর বুলিয়ে দারোয়ানকে দেখতে পেল না।

রাস্তায় নেমে মাধবীলতা বলল, ‘বাঃ, সেটা আমি জানব কী করে! এখানে এসে দেখলাম কেউ নেই। একটু ভেতরে ঢুকে তোমার নাম জিজ্ঞাসা করতেই একজন ঘরটা বলে দিল। ডেকে দেবার কেউ না-থাকলে আমি কী করব!’

‘কিছু না! শুধু কতগুলো তৃষিত মফস্‌সলের ছেলের বুকে ঈর্ষা জাগিয়ে দিলে।’

‘কিন্তু তুমি আমাকে ভেতরে বসতে বললে না কেন?’

‘নিজের ওপর বিশ্বাস নেই বলে।’

‘অভদ্র!’ বলে মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে নিল।

অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে ওর মুখখানা দেখল। আচমকা বেশ লাল দেখাচ্ছে। জরুরি কথা বলার ভঙ্গিতে সে বলল, ‘এবার কাজের কথাটা বলো তো। সাতসকালে কেন এখানে হাজির হলে? আর একটু দেরি হলেই তো আমি বেরিয়ে যেতাম।’

মাধবীলতা তখনও স্বচ্ছন্দ নয়। অনিমেষের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘বলছি, কিন্তু তার আগে সত্যি করে বলো তুমি রাগ করোনি আমি তোমার ঘরে উঠে গিয়েছিলাম বলে।’

অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘আচ্ছা মেয়ে তো! বললাম না আমি রাগ করিনি।’

ওরা হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম রাস্তায় চলে এসেছিল। সকালবেলায় কলকাতার চেহারাটা অনেক নরম থাকে। দোকানপাট এখনও খোলেনি, শুধু সিগারেট পানের দোকানগুলো ছাড়া। ফুটপাতে হাতিবাগান বাজারে যাওয়া-আসা মানুষের ব্যস্ততা। রোদ এখনও বাড়ির মাথায়। এইসময় কলকাতাকে একদম অনুত্তেজিত দেখায়। মাধবীলতা বলল, ‘চলো, কোথাও বসে চা খেতে খেতে কথা বলি। সক্কাল থেকে স্থির হতে পারিনি।’

ওরা পাশাপাশি হেঁটে হাতিবাগানে এল। এখন ভাল রেস্টুরেন্টগুলোয় ধোওয়ামোছা চলছে। আটপৌরে চায়ের দোকানে খবরের কাগজ পড়তে আসা মানুষের ভিড়। অনিমেষ রাধা সিনেমার পাশে দোতলায় একটা রেস্টুরেন্টে উঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘চা পাওয়া যাবে?’

ছোকরা মতো একটা লোক, তখনও বেয়ারার পোশাক পরেনি, বলল, ‘দেরি হবে।’

‘কতক্ষণ?’

ওদের দিকে তাকিয়ে লোকটা কী বুঝল কে জানে, জিজ্ঞাসা করল, ‘শুধু চা?’

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, ‘টোস্ট পাওয়া যাবে?’

বোঝা যাচ্ছিল শুধু চা বললে লোকটা কাটিয়ে দিত। বাঁ দিকে হাত তুলে বলল, ‘বসুন দশ মিনিট।’

রেস্টুরেন্টে সব ঝাঁট পড়েছে। চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর উলটে রাখা আছে। পেছন থেকে লোকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘কেবিনে গিয়ে বসুন।’

অনিমেষ রাস্তার ধারে কেবিনে ঢুকল। কেবিনটা ছোট। দেওয়াল ঘেঁষে টেবিল। পাশাপাশি দু’জন বসতে পারে। ওরা বসতেই সামনের হাতিবাগান বাজারের ওপরটা চোখে পড়ল। পরদাটা গোটানো থাকা সত্ত্বেও এখানে আলো কম। চেয়ারে বসে মাধবীলতা বলল, ‘জানো, কাল রাত্তিরে একদম ঘুমুতে পারিনি।’

অনিমেষ তাকাল। মাধবীলতাকে প্রথম থেকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। এখন কারণটা বুঝতে পারল। আজ অবধি কখনও সে ওকে ভোরে দেখেনি। তাই একটু আলস্যমাখানো অযত্ন মুখে চুলে। স্নানের পর মেয়েদের শরীরে যে টানটান তেজ থাকে তা ভোরবেলায় পাওয়া যায় না। ভোরবেলায় তাই মেয়েদের কাছের মানুষ মনে হয়। এতক্ষণ ওকে দেখার আনন্দে এবং উত্তেজনায় সমস্ত ব্যাপারটা গুলিয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে মাধবীলতার বেরিয়ে আসার কথা। অথচ সে এখন তার সামনে বসে। এদিকে বলছে গত রাত্তিরে সে ঘুমুতে পারেনি। কেমন একটা ভয় হঠাৎ এসে জুড়ে বসল। তা হলে কি কোনও কারণে মত পালটেছে মাধবীলতা? গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুম হয়নি কেন?’

‘কোনওদিন তো বাড়ির বাইরে থাকিনি। একা নতুন জায়গায় কিছুতেই ঘুম আসছিল না। নানান চিন্তা আসছিল আর ভেবেছি কখন সকাল হবে।’ মাধবীলতা হাসল।

হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, ‘নতুন জায়গা মানে? তুমি কি গত কালই চলে এসেছ?’

‘হ্যাঁ।’ মাধবীলতা একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল।

‘কেন? কী হয়েছিল?’

‘চলে আসতে হল। ভয় ছিল গতকাল থেকেই আমাকে থাকতে দেবে কি না। কিন্তু সুপারকে বলতে দেখলাম রাজি হয়ে গেলেন। নইলে কী বিপদে পড়তে হত!’

‘কী হয়েছিল?’ আবার প্রশ্নটা করল অনিমেষ।

‘বাড়িতে গিয়ে মাকে বললাম তোমরা যদি চাও তা হলে আমি হস্টেলে চলে যেতে পারি। মা বলল, তোমার বাবার সঙ্গে বুঝে নাও, আমি এর মধ্যে নেই। বাবা আমাকে দেখামাত্র জানতে চাইলেন আমি কারও প্রেমে পড়েছি কি না। অস্বীকার করলাম না। তারপর যা হয়ে থাকে তাই হল। আমি নাকি ওঁর মুখ পুড়িয়ে দিয়েছি। দুধকলা খাইয়েছেন কালসাপকে। বললেন মত পরিবর্তন করতে। অসম্ভব শুনে জানিয়ে দিলেন আমার মুখ দর্শন করতে চান না। আমি যেন ওই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আমারও খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওরা জানতেও চাইল না কোথায় যাচ্ছি। তবু একটা কাগজে নিজের ঠিকানাটা লিখে রেখে এলাম। ভাল লাগছে না একটুও।’ মাধবীলতা মুখ নামাল।

অনিমেষের কষ্ট হচ্ছিল, গাঢ় গলায় বলল, ‘দেখো, পরে অনুশোচনা করার চেয়ে সময় থাকতেই শুধরে নেওয়া ভাল। হাজার হোক ওঁরা তোমার মা বাবা।’

মাধবীলতা দাঁতে ঠোঁট কামড়াল, ‘এই একটা কথা তুমি কতবার বললে! তুমি কিছুতেই বুঝছ না একটা মেয়ে বাড়ির প্রতিকূল মনোভাবের বিরুদ্ধে কতক্ষণ লড়তে পারে? অনবরত চাপ দিচ্ছে সবাই বিয়ের জন্যে। উঠতে বসতে খোঁটা খেতে হচ্ছে। হয় হ্যাঁ বলো নয় না। আজ থেকে দু’বছর আগে হলে হ্যাঁ বলতে কোনও অসুবিধে হত না। স্বচ্ছন্দে বিয়ে হয়ে যেত আমার। বাবা বলতেন বড় ভাল মেয়ে, আমি দায় থেকে উদ্ধার পেলাম। কিন্তু এখন আমি কী করে রাজি হই! যে সব মেয়ে মনে করে মনের কোনও সতীত্ব নেই আমি সেই দলের নই। শরীরের চেয়ে মন আমার কাছে কম মূল্যবান নয়। যে চোখে আমি তোমাকে দেখেছি সেই চোখে আমি অন্য পুরুষকে দেখব কী করে?’ কথা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল মাধবীলতা।

অনিমেষ দেখল ওর মুখ কাঁপছে, আর তারপরেই চোখের দুটো কোণ চিকচিক করে উঠল। মাধবীলতার মুখে এখন ভাঙচুর। চোখ দুটো ভরা পুকুর। অনিমেষের বুকের মধ্যে পাথর গড়াতে লাগল। নিজের অজান্তেই ও একটা হাত মাধবীলতার কাঁধে রাখল, ‘কেঁদো না, তোমার চোখে জল একদম মানায় না। আমি সহ্য করতে পারব না।’

সামলাতে সময় লাগল ওর। আঁচলে চোখ চেপে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘আচ্ছা বলো তো, বাবা-মা কেন নিজের মেয়েকে এত সন্দেহ করে? কেন নিজের জেদ মেয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়? আমি কি ছেলেমানুষ? আমার কি বোঝার বয়স হয়নি? আমি কি তোমাকে বিয়ে করার জন্যে এখনই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম? এতদিন যেমন ছিলাম তেমনি কি ওদের কাছে আরও কিছুকাল থাকতে পারতাম না? তবে কেন এত জোরজবরদস্তি!’

অনিমেষ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ এখন পরিষ্কার। সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘কিছুদিন যেতে দাও দেখবে ওঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। নিশ্চয়ই জেদ করবেন না আর। তুমি যদি কোনও অন্যায় না-করো তা হলে কেউ তোমার দোষ দেবে না।’

‘না, কথাটা ঠিক নয়। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি এই খবরটা আত্মীয়রা জানামাত্রই দুর্নাম রটাতে শুরু করবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না।’ মাধবীলতা মুখ নামিয়ে কথা বলছিল। এইসময় পায়ের শব্দ হল। খেয়াল হতেই অনিমেষ হাত সরিয়ে নিল মাধবীলতার কাঁধ থেকে। দু’হাতে দু’প্লেট টোস্ট আর দুটো চায়ের কাপ নিয়ে লোকটা আশ্চর্য কৌশলে চলে এল। টেবিলে ওগুলো রেখে অভ্যস্ত হাতে পরদা নামিয়ে দিয়ে লোকটা চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার চেহারা পালটে গেল। পরদাটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের একবার মনে হল উঠে সরিয়ে দেয় ওটাকে। সেইসময় মাধবীলতা বলল, ‘তুমি আমাকে কখনও কষ্ট দিয়ো না।’

‘এ-কথা বলছ কেন?’

‘আমার যেন মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার কোথাও অস্বস্তি আছে।’

‘কীরকম?’

‘আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারটায় যেন তোমার কোথাও অস্বস্তি আছে। সত্যি করে বলো তো আমি কি তোমার ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি?’

‘লতা!’ অনিমেষ প্রতিবাদ করতে চাইল।

‘না অনি, আমি যা করছি নিজের দায়িত্বেই করছি। তোমার যদি মনে হয় জড়িয়ে যাচ্ছ তা হলে স্বচ্ছন্দে সরে যেতে পারো। আমার খুব কষ্ট হবে, সারাজীবন হয়তো কাঁদব কিন্তু আমি তোমার গলার কাঁটা হয়ে আছি এ আমার সহ্য হবে না।’ মাধবীলতার গলা বুজে এল।

অনিমেষ আর পারল না। চকিতে দুই হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরল সে। বোধহয় একটা সুতোর আড়ালে নিজেকে ধরে রাখছিল মাধবীলতা, আর পারল না। অনিমেষের বুকে মুখ রেখে হুহু করে কেঁদে ফেলল। তার দু’হাত এখন অনিমেষের পিঠ আঁকড়ে ধরেছে। থরথর করে কাঁপছে শরীর। অনিমেষের সমস্ত শরীর এখন অচৈতন্য, মনের কোনও বাঁধ নেই, দু’হাতে মাধবীলতার মুখ তুলে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।’

মাধবীলতার দুই চোখে জলের ধারা গড়াল, ঠোঁট কাঁপল, ‘আমিও না।’ এই প্রথম কোনও যুবতী শরীরকে বুকের ওপর অনুভব করল অনিমেষ। চোখের সামনে মাধবীলতার ভেজা স্ফীত ঠোঁট চুম্বকের মতো তাকে টানছিল। ধীরে ধীরে মুখ নামাল অনিমেষ। তারপর সেই উষ্ণ নরম সিক্ত ঠোঁটে আকণ্ঠ চুম্বন করল। দু’জনের চোখ এখন বন্ধ, সমস্ত বিশ্বচরাচর যেন এই পরদা ঘেরা ছোট্ট কেবিন হয়ে গেছে। ঠোঁটের স্পর্শের মধ্যে দিয়ে অনিমেষ মাধবীলতার সব অন্ধকার মুছিয়ে দিল, মাধবীলতার সব না-বলা কথা জেনে নিল।

চেতনা ফিরতেই মুখ সরিয়ে নিল মাধবীলতা। আস্তে আস্তে তার হাত শিথিল হল। যেন একটু লজ্জা পেয়েই সে সরে বসতে চাইল। মুখে এখনও একটা মিষ্টি অথচ নোনতা সুখের স্বাদ, অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। আর তখনই সেই বন্ধ চোখের পাতায় আচমকা সেই দুপুরটা ছিটকে চলে এল। জলপাইগুড়ি শহরের বিরাম করের বাড়িতে সদ্য-কিশোর অনিমেষ রম্ভার সামনে দাঁড়িয়ে। সামনের বিছানায় রম্ভা শুয়ে রয়েছে জ্বরতপ্ত শরীরে। মুখচোখ লাল, চুল উসকোখুসকো। অনিমেষ যখন তার অনুরোধে জ্বর দেখতে নিচু হয়েছিল তখনই সাপের মতো তাকে জড়িয়ে ধরেছিল রম্ভা। সেই সদ্য-কিশোরীর সতেজ আক্রমণ প্রতিহত করার আগেই দুটো জ্বরো ঠোঁট তাকে চুম্বন করেছিল। বিশ্রী, পোড়া বিড়ির স্বাদ পেয়েছিল যেন অনিমেষ। দাঁড়িয়ে উঠে নিজের ঠোঁটে ঘিনঘিনে ভাব অনুভব করেছিল। জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে সেই তার প্রথম চুম্বন। কিন্তু তার স্মৃতি অনেক দিন একটা অস্বস্তির চেহারা নিয়ে মনের ভেতর ছিল। আজ অনিমেষের মনে হল এতদিনে সেই বিশ্রী স্মৃতিটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ সামনে রাখা প্লেট টেনে নিয়ে বলল, ‘খাও’।

টোস্টে হাত না-দিয়ে চায়ের কাপটা টেনে নিল মাধবীলতা। ধীরে ধীরে একবার চুমুক দিয়ে বলল, ‘ভাল লাগছে না।’

‘কেন, ঠান্ডা হয়ে গেছে?’ অনিমেষ হাত দিয়ে দেখল কাপটা আর গরম নেই।

মাধবীলতা তাই দেখে বলল, ‘না, খাওয়া যাবে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না।’

বুঝল না অনিমেষ, ‘কেন?’

‘সে তুমি বুঝবে না।’

‘বাঃ তুমিই তো চা খেতে চাইলে।’

‘চেয়েছিলাম।’

অনিমেষ ওর চোখে চোখ রাখতে চাইল কিন্তু মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনিমেষ ধমকের সুরে বলল, ‘খেয়ে নাও তো, সকাল থেকে কিছু খাওনি আর আজেবাজে বকা হচ্ছে। খাও বলছি।’ টোস্টের প্লেটটা মাধবীলতার সামনে এগিয়ে দিল সে।

খাওয়া হয়ে গেলে মাধবীলতা বলল, ‘আমি কিন্তু তোমার ভরসায় পরীক্ষা দেব!’

‘আমার ভরসায়! আমি তো পড়াশুনা শুরুই করিনি।’

‘এবার করো।’

‘তুমি স্কুলে পড়ানো আর পরীক্ষার জন্যে তৈরি— দুটো পারবে?’

‘পারতে হবেই।’

‘আচ্ছা লতা, আমি ভবিষ্যতে কী করব বলে তুমি ভাবছ?’

‘মানে?’

‘আমি কীরকম চাকরি বাকরি করব বলে তুমি আশা করো?’

মাধবীলতা একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘ওসব আমি কিছুই ভাবিনি। একটা কিছু নিশ্চয়ই তুমি করবে, আর যাই করো আমি সমর্থন করব।’

‘এ কোনও কথা হল? বাংলায় এম. এ. পাশ করে চাকরি পাওয়া যাবে না। অধ্যাপনা বা মাস্টারি করার মতো ব্রাইট রেজাল্ট আমার হবে বলে মনে হচ্ছে না। তখন কী হবে তাই ভাবছি।’

‘আমার চাকরি তো রয়েছে।’

‘আশ্চর্য মেয়ে!’

‘কেন, আমার তো দুটো হাতপা-ই আছে।’

‘ইয়ারকি কোরো না। আমার ব্যাপারে তুমি একটুও সিরিয়াস নও।’

‘খুব বেশি সিরিয়াস বলেই কিছু ভাবি না।’

‘তা ছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে। আমার বাড়ির লোক তোমাকে কীভাবে নেবে তা জানি না। যদি—।’

‘ওসব কথা থাক। তোমার দাদু পিসিমার কথা যা শুনেছি তাতে আমার বিশ্বাস ওঁরা আমাকে নিশ্চয়ই ভালবাসবেন।’

হঠাৎ অনিমেষের হাসি পেল। ওর মনে হল মেয়েদের মন সত্যিই বিচিত্র। এতদিনের রক্তের সম্পর্ক যাদের সঙ্গে তারা যাকে বুঝতে পারল না, সে বিশ্বাস করছে দু’জন অপরিচিত লোক তাকে গ্রহণ করবে। যুক্তি নয়, হৃদয়াবেগই মেয়েদের সাহসী করে তোলে।

কথা ঘোরাল অনিমেষ, ‘আমার ভয় হচ্ছে হয়তো তোমাকে আমি সুখী করতে পারব না। সেদিন সুবাসদার সঙ্গে কথা হবার পর থেকে আমার চিন্তাভাবনা সব পালটে যাচ্ছে। যদি এমন সময় আসে যখন আমি বাঁধাধরা জীবনে না-থাকি তা হলে তুমি কী করবে?’

‘কিচ্ছু না। এখন যা করছি তাই করব।’ মাধবীলতা অনিমেষের হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই মনে হয়েছিল তুমি সাধারণ নও। ঘরসংসারের বাঁধা জীবনে তোমাকে মানায় না। সেটা করতে গেলে তোমার ওপর অন্যায় করা হবে। তোমার পক্ষে যেটা স্বাভাবিক তাই তুমি করবে। আমি কোনওদিন তোমার বাধা হয়ে দাঁড়াব না।’

‘আচ্ছা, এত ছেলে থাকতে তুমি আমাকে ভালবাসলে কেন?’

‘কী মনে হয় তোমার?’

‘জানি না।’

‘কেন, তুমি কেন ভালবাসলে?’

অনিমেষ মাধবীলতার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখ হাসছে। মনে মনে সে বলল, তোমায় না-ভালবাসলে আমি মরে যেতাম। কিন্তু মুখে কিছু বলল না সে। কারণ মাধবীলতার চোখের হাসি এখন ঠোঁটে ছড়িয়েছে। অনিমেষ হেসে ফেলল শব্দ করে। ওদের দশটা আঙুল এখন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে বিশ্বাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *