২২. খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো

বাইশ

খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো। জীবনটা কি এইরকম? যখন কিছু ঘটে না তখন দমবন্ধ গ্রীষ্মের দুপুরের মতো থমকে থাকে সবকিছু। আর যখন ঘটার পালা আসে তখন উত্তাল ঢেউয়ের মতো, কোনও কিছু গ্রাহ্য না-করে বেপরোয়া ছুটে চলে। সেইরকম ছুটে যাওয়ার সময় যেন এই দিনগুলো। অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাবার সুযোগ পাচ্ছিল না।

সুবাসদার সঙ্গে দেখা হয়নি অনেকদিন। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে সে কিন্তু সঠিক সংবাদ পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে দু’বার সুবাসদা নিজে আসবে বলে আর আসেনি। এখন অনিমেষদের কাজকর্ম খুব বেড়ে গেছে। পার্টি অফিস— ইউনিভার্সিটি করতে করতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন লোকের সঙ্গে নিত্য পরিচয় হচ্ছে। কিন্তু পুরনো যারা রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট নয়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে আসছে। যেমন পরহমহংস। যেদিন সময় পায় সেদিন ক্লাস করতে গেলে দেখা হয়। একই রকম আছে ছেলেটা। এই যেমন আজ দেখা হতেই বলল, ‘মালকড়ির শেয়ার পাচ্ছ মনে হচ্ছে গুরু। কামিয়ে নাও যত পারো।’

অনিমেষ হকচকিয়ে বলল, ‘শেয়ার পাচ্ছি মানে?’

পরমহংস বলল, ‘তুমি যদি ভূত হও তা হলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে। তা না-হলে এখান থেকে ফায়দা তুলবে।’

অনিমেষ হেসে বলল, ‘আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে?’

পরমহংস বলল, ‘মাল গুটোচ্ছ বেশ।’

অনিমেষ প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গেল। কোনও লাভ নেই। যে নিয়মটা চালু হয়ে গেছে তার বাইরে চিন্তা করতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই মুহূর্তে তার পকেটে মাত্র দুটো টাকা পড়ে আছে। মাসের শেষ হতে অনেক দেরি এবং এতবড় কলকাতায় তাকে ওই টাকায় মাসটা চালাতে হবে। পরমহংস ওর মুখের পরিবর্তন লক্ষ করে বলল, একসময় তুমি টিউশনি করবে বলে খেপে উঠেছিলে। অথচ এখন সেসব কথা ভুলেও বলো না। তার মানে তোমার টাকার দরকার নেই। ঠিক কিনা?’

অনিমেষ বলল, ‘তা নয়। আসলে আমি বোধহয় খুব উদ্যোগী ছেলে নই। যা মাথায় আসে তাই করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তা ছাড়া পার্টির কাজে এত সময় দিতে হয় যে ধরা-বাঁধা অনেক কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজ করতে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি। কিন্তু আমি এ-কাজ না-করেও পারব না। তার ফলে অনেক আর্থিক কষ্টের মধ্যে আমাকে দিন কাটাতে হয়, বিশ্বাস করো, রাজনীতি করে যারা পয়সা পায় তাদের সঙ্গে আমার এখনও আলাপ হয়নি এবং সেই ভূমিকায় নিজেকে দেখার কোনও আগ্রহ নেই।’

পরমহংস বলল, ‘এরকম নেশার কোনও মানে আমি বুঝতে পারি না। যখন সময় চলে যাবে তখন দেখবে তোমার স্কোরে একটাও রান জমেনি। তুমি কি ভাবছ এই করে দেশের চেহারা পালটে দিতে পারবে? মিছিমিছি নিজেকে নষ্ট করার কোনও মানে হয়!’

অনিমেষ বলল, ‘এইরকম চিন্তা যদি সবাই করে তা হলে আগামী দশ বছর পরে দেশের কী অবস্থা হবে তা ভাবতে পারো?’

পরমহংস বলল, ‘এখন কথাটা মানছ না, পরে বুঝবে। তুমি যা-ই বোঝাতে চাও দেশের সাধারণ মানুষ তা বুঝবে না। তারা একটা জিনিসই জানে, যে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাবে সেই তাদের বন্ধু। ওসব ইজম টিজমে ওদের কিছু যায় আসে না। সব শালা আমরা দারোগাবাবু হয়ে বসে আছি। হাঁসে ডিম পাড়ুক আমরা হাফবয়েল খাব। তা তোমার পরীক্ষা টরিক্ষা দেবার ইচ্ছে আছে?’

অনিমেষ বলল, ‘কোনও লাভ নেই দিয়ে তবুও দেব।’

পরমহংস বলল, ‘লাভ নেই জেনেই তো এম এ পড়তে এসেছি বাংলায়। দু’বছর ভাল ভাল মেয়ের সঙ্গে আড্ডা মারার এই সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? কপালে কোনও ব্যাঙ্ক বা সরকারি অফিসের কেরানিগিরি অপেক্ষা করছে তা তো জানি। কিন্তু পরীক্ষা না-দিলে প্রেস্টিজ থাকে না। তুমি তো ক্লাস করছ না, পড়াশুনা হচ্ছে কি?’

অনিমেষ বলল, ‘লাস্ট দু’মাসে ম্যানেজ হবে না? তুমি কী বলো?’

রামকৃষ্ণের মতো মুদ্রা করল হাতের আঙুলে পরমহংস। তারপর বলল, ‘ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোমাকে শোভনাদি খুঁজছিল, একদিন দেখা কোরো।’

‘কেন, কী ব্যাপার?’

‘টিউশনির জন্যে গিয়েছিলে, বোধহয় সেই ব্যাপারেই।’

‘ভদ্রমহিলা বেশ ভাল।’ অন্যমনস্ক গলায় বলল অনিমেষ।

‘তাই নাকি? স্পিন ধরেছে মনে হচ্ছে!’

‘ইয়ারকি মেরো না। মহিলার মুখে একটা ব্যথার ছায়া ঘোরে।’

‘দয়া করে সেই ছায়াটা সরাবার চেষ্টা কোরো না, তা হলেই উনি আরও ব্যথা পাবেন। তোমার বান্ধবী আসছেন, আমি চলি।’

পরমহংস ঘুরে দাঁড়াতেই অনিমেষ দেখল মাধবীলতা আসছে। বেলঘরিয়া থেকে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি অনিমেষের। সাদা জামা সাদা শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সে পরমহংসের হাত ধরে বলল, ‘এই, পালাবে না।’

মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসল, ‘কী খবর?’

অনিমেষ বলল, ‘কোথায় ছিলে?’

‘লাইব্রেরিতে। আমাদের তো পাশ করতে হবে।’

‘একে চেনো?’

সঙ্গে সঙ্গে পরমহংস সামান্য ঝুঁকে নমস্কার করে বলল, ‘ঈশ্বর, এও আমাকে শুনতে হল, অনিমেষ আমার পরিচয় দিচ্ছে!’

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা হাসছে এখনও। সে বলল, ‘তোমরা কি আগে থেকেই—’

পরমহংস হাত নেড়ে জানাল, ‘অফকোর্স। আমিই তো ফার্স্ট ওর পেছনে লাইন দিই, তুমি তো পেছন থেকে ওভারটেক করে চেয়ার দখল করলে। আমার কপালই এইরকম, বন্ধুরাই শত্রু হয়।’ ওর বলার ভঙ্গি এমন যে মাধবীলতা হাতের খাতা দিয়ে ওকে কপট আঘাত না-করে পারল না। শরীর খর্বকায় বলে পরমহংস মাথা নিচু করে একপাশে সরে গিয়ে উচ্চগ্রামে হাসতে শুরু করল। অনিমেষের মনে পড়ল, তার অ্যারেস্ট হওয়ার বিকেলে এই পরমহংসই ওকে খবর দিয়েছিল বসন্ত কেবিনের ওপরে মাধবীলতা বসে আছে। সে ব্যাপারটা বলতেই পরমহংস বলল, ‘দারুণ ব্যাপার হয়েছিল সেদিন। আমি ইউনিভার্সিটির উলটো ফুট থেকে দেখলাম তুমি ফালতু ফালতু শহিদ হয়ে গেলে—’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘ফালতু ফালতু মানে?’

‘নিরীহ হরিণশাবকের মতো তুমি রাস্তা পার হচ্ছিলে আর পুলিশ ভ্যানটার তখন একটা কেস দেখাবার প্রয়োজন ছিল তাই টুক করে তোমায় তুলে নিল। কোনওরকম বিপ্লব বিদ্রোহ নয়, ঠাকুরঘরে ঢোকার মতো তুমি ভ্যানের ভেতরে ঢুকে গেলে।’

অনিমেষ হাসল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী? পুলিশ চলে গেলে তুমি ছাত্রদের কাছে বিপ্লবী হয়ে গেলে। কমরেড অনিমেষের মুক্তি চাই, বাপস! মেয়েরা গুজব ছড়াতে লাগল। অনেক লড়াই করে তুমি ধরা দিয়েছ এইসব। তা এই মহিলাও বোধহয় সেইসব গুজবের একটি শ্রবণ করে বসন্ত কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি কি ছাই সে সব জানতাম। দেখলাম একা হরিণ কচি ঘাস খাচ্ছে। দেখে নির্মল হৃদয়ে পাশে গিয়ে বসলাম, নিজের পরিচয় দিয়ে লাইন করার চেষ্টা করলাম।’

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘কীসের লাইন?’

‘একটা মোগলাই পরোটা আর চায়ের।’

‘ওমা!’ মাধবীলতা হতবাক।

অনিমেষ বলল, ‘খাওয়াল না?’

‘খাওয়াবে কী! এক ডজন অমাবস্যা মুখে নিয়ে বসে থাকলে কাউকে খাওয়ানোর কথা মনে আসে। আমি শালা আলাপ জমাবার জন্যে কারেন্ট টপিক ব্যবহার করতেই ফেঁসে গেলাম।’ আফশোসের মুখ করল পরমহংস।

‘ডিটেলস প্লিজ।’

‘যেই বললাম, অনিমেষ একটা দারুণ ছেলে। চেনেন নিশ্চয়ই? আমাদের সঙ্গে পড়ে, মাই ফ্রেন্ড। আজ পুলিশকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভ্যানে উঠে বাড়ি চলে গেল। অমনি এই মহিলা ভেঙে পড়লেন।’

‘মোটেই না, একদম ইয়ারকি করবেন না।’ ফুঁসে উঠল মাধবীলতা।

‘বেশ, তা হলে একা একা বসন্ত কেবিনে কী করছিলেন?’

‘আশ্চর্য। আমি ওখানে চা খেতে যেতে পারি না?’

‘একা একা?’

‘হ্যাঁ। আপনারা যেটা পারেন সেটা একটা মেয়ের পক্ষে কি পারা অন্যায়?’

হাত জোড় করল পরমহংস, ‘ক্ষমা করুন, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু এতসব শোনার পরও যদি হৃদয় না-গলে তা হলে আফশোসের কথা।’

‘হৃদয় গলবে কী কারণে?’

‘বাঃ, আমি যদি খবর না-দিতাম তা হলে অনিমেষ আপনার কাছে যেত? সেই সুবাদে আমার একটা মাটন ওমলেট আর কফি পাওনা হয়ে আছে।’

‘ঠিক আছে, এত করে যখন বলছেন, আর একদিন খাওয়াব। আজ আমার কাছে বেশি পয়সা নেই।’

‘নেই তো কী হয়েছে, ধার দিচ্ছি।’

‘মানে? আপনার কাছ থেকে ধার নিয়ে আপনাকেই খাওয়াতে হবে? কী ডেঞ্জারাস লোক!’ কপালে চোখ তুলল মাধবীলতা।

ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অনিমেষের খেয়াল হল টি. এন. জি. সেদিন ক্লাসে বলেছিলেন একবার দেখা করতে। করা হয়নি। ভদ্রলোক যদি এখনও টিচার্স রুমে বসে থাকেন তা হলে দেখা করে এলে হয়। সে শুনল পরমহংস বলছে, ‘ওর ব্যাপারটা নিয়ে আপনি কিছু ভাবছেন?’

‘কী ব্যাপার?’ মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

‘এই যে, শ্রীমান ক্লাস করছেন না, দেশ উদ্ধার করতে পার্টি করছেন, এসব করে ভবিষ্যতে গোলমালে পড়বে তা বুঝতে চাইছে না। আপনার এখন কর্তব্য ওকে বুঝিয়ে বলা।’ পরমহংস গড়গড় করে বলে গেল।

‘আমি কেন?’

‘দোহাই, আর খেলবেন না, আমি মাইরি কিছুতেই এইরকম খেলা সহ্য করতে পারি না। কেমন নার্ভ ছেড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়।’

মাধবীলতা হাসল, ‘দেখুন ওকে আমি খুব অল্প জানি। তবে যদি কেউ মনে করে সে যা করছে তা ঠিক করছে তাতে কোনও বাধা দেওয়া উচিত নয় বলেই বিশ্বাস করি।’

‘কিন্তু যদি সাফারিংস আসে।’

‘সেটা তো জেনেশুনেই ডেকে আনা হচ্ছে, তাই এলে তার জন্যে আফশোস করে লাভ কী। এমন ছেলেমানুষের মতো কথা বলেন না!’

অনিমেষের মনে হল এবার কথার মোড় ঘোরানো দরকার। পরমহংস ক্রমশ ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে আলোচনাটা। আর একটু এগোলেই নিশ্চয়ই মাধবীলতা ফোঁস করে উঠবে আর তখন সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে। সে একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, ‘তোমরা এখন কী করছ?’

পরমহংস বলল, ‘কফিহাউস যাব।’

মাধবীলতা ঠাট্টা করল, ‘কেন, কফি শিকার করতে?’

পরমহংস বলল, ‘কী করি বলুন, অন্য কিছুর এলেম নেই যে।’

অনিমেষ ওদের দাঁড়াতে বলে টিচার্স রুমে চলে এল। যা ভেবেছিল তাই, ঘর ফাঁকা। ফিরে এসে বলল, ‘টি এন জি-র সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, উনি নেই। চলো, বেরিয়ে পড়ি।’

মাধবীলতা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ টি এন জি কেন?’

‘একদিন ক্লাসে আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন, আর যাওয়া হয়নি।’

কথাটা শোনামাত্র দু’জনে অবাক হয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল। পরমহংস বলল, ‘গুরুদেব লোক মাইরি। ছ’মাস আগের কথা আজ মনে পড়ল? এরপর হয়তো দশ বছর বাদে একদিন এসে জিজ্ঞাসা করবে, ‘মাধবীলতা, তুমি যেন কী কথা বলছিলে সেদিন—,’ কথাটা শেষ না-করে দ্রুত পা চালাল সে। চিৎকার করে বলল, ‘কফিহাউসে আছি, ইচ্ছে হলে এসো, নইলে চরে খাও।’

চোখমুখ লাল করে মাধবীলতা বলল, ‘আচ্ছা ফাজিল তো!’

অনিমেষ বলল, ‘কিন্তু ভীষণ হাসিখুশি।’

‘তা অবশ্য, মনে প্যাঁচ থাকলে কেউ এরকম কথা বলতে পারে না। যার যত প্যাঁচ সে তত গম্ভীর। এতদিন পরে দেখা হল তবু হাসি দেখলাম না।’

অনিমেষ চোখ ছোট করল, ‘আমার মনে প্যাঁচ আছে?’

‘আছেই তো।’ মাধবীলতা অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

‘কীরকম?’

‘এতদিন দেখা হয়নি তবু খোঁজ নেবার ইচ্ছে হয়েছিল?’

‘তুমি ক্লাসে আসোনি?’

‘আমি কিছু বলব না।’ গম্ভীর মুখে হাঁটতে শুরু করল মাধবীলতা।

হঠাৎ এই পরিবর্তনের কোনও কারণ বুঝতে না-পেরে অনিমেষের অস্বস্তি শুরু হল। সেদিন বাসে যা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যদি হয় তা হলেই সর্বনাশ। মাধবীলতা মুখ গম্ভীর করলেই মনে হয় বুকের ভেতরটা টলমল করছে। সে দ্রুত পা চালিয়ে মাধবীলতার পাশাপাশি গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই, কী হয়েছে!’

মাধবীলতা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটলেও অনিমেষ ওর গালের নীচে একটা শিরার কাঁপুনি লক্ষ করল। আর প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। চুপচাপ ওরা হেঁটে গেল অনেকটা পথ।

বউবাজার ছাড়িয়ে যেতে গিয়ে অনিমেষ পাশের একটা রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল, ‘একটু চা খাব।’

‘আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই।’ থমথমে মুখ এখনও মাধবীলতার।

‘থাক তা হলে।’

একটু ইতস্তত করল মাধবীলতা, তারপর বলল, ‘আমি বসছি।’

‘না, একা একা চা খাওয়া যায় না।’

কপালে ভাঁজ ফেলে মাধবীলতা অনিমেষের মুখের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকল। বেশ ভিড় দোকানটায়। একটা টেবিলে দু’জন লোক বসে আছে। অনিমেষ সেদিকে এগোতেই বয় একটা কেবিনের পরদা উঁচু করে ধরে তাদের ডাকল। অনিমেষ হাত নেড়ে তাকে নিষেধ করতে যেতেই অবাক হল। মাধবীলতা সেই কেবিনে ঢুকে গেল। এরকমটা কখনওই হয়নি। অনুচ্চারিত একটা শর্ত ছিল যেন ওদের, কোনও নির্জন কেবিনে বসবে না। মাধবীলতার ধারণা কেবিনের পরদা ফেলে লোকে বদমাইশি করতে বসে। অথচ আজ অমন নির্দ্বিধায় সে ঢুকে গেল কেন?

অনিমেষ কেবিনে ঢুকে বিপরীত দিকের চেয়ারে বসতেই বয়টা জিজ্ঞাসা করল, ‘মোগলাই, ফিশফ্রাই, ব্রেস কাটলেট, কবিরাজি— কী দেব?’

অনিমেষ বলল, ‘কিছু না, শুধু চা।’

‘ওনলি চা?’ ছেলেটা যেন তাচ্ছিল্যের গলায় প্রশ্নটা করল। অনিমেষের রাগ হয়ে গেল বলার ধরনে। যেন রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই একগাদা খাবার খেতে হবে নইলে মান থাকবে না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা বলে উঠল, ‘ফিশফ্রাই আছে? তা হলে দুটো দিন।’

ছেলেটি হাসল, তারপর পরদা ফেলে দিয়ে চলে গেল।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কী হল?’

‘তোমার খিদে পেয়েছে।’ মাধবীলতার মুখের ভাব একটুও বদলায়নি।

‘তুমি কী করে জানলে?’

‘মুখ দেখলেই বোঝা যায়।’

‘কিন্তু আমার পকেটে মাত্র দুটো টাকা আছে। এতে মিটবে?’

এবার বিচলিত হল মাধবীলতা। আজ ব্যাগ নিয়ে আসেনি, হাতে শুধু খাতা ছিল। কিন্তু কোমর থেকে রুমাল বের করে তার গিঁট খুলে একটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা বের করল। একটু বিব্রত মুখে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এতে হবে না?’

অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘ছেড়ে দাও, আমি ওকে শুধু চা দিতে বলছি।’

‘না,’ ঘাড় শক্ত করল মাধবীলতা, ‘ফিশফ্রাই খাবই। আমার হাতে সোনার বালা আছে।’

‘সোনার বালা দিয়ে কী হবে?’

‘জমা দিয়ে যাব, পরে দাম দিয়ে ছাড়িয়ে নেব।’

একদৃষ্টে মেয়েটাকে দেখল অনিমেষ। অসম্ভব জেদি কিন্তু ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে ওকে। ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা ওর মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। অনিমেষের মনে হল এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় ঢোকাটাই তার অন্যায় হয়েছে। সে মুখ নামিয়ে টেবিলের কাচের তলায় রাখা মেনুকার্ডের ওপর চোখ রাখল। ফিশফ্রাইয়ের দাম একটাকা চল্লিশ আর চায়ের দাম তিরিশ। অর্থাৎ তিন টাকা চল্লিশ পয়সা ব্যয় করলেই এ যাত্রায় রেহাই পাওয়া যায়। দু’জনের কুড়িয়ে বাড়িয়ে সেটা হয়ে যাবে কিন্তু বাড়ি ফেরা?

সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার রেলের টিকিট আছে?’

ঘাড় কাত করল মাধবীলতা। তারপর খাতাটা খুলে মাসের টিকিটটা দেখাল। অনিমেষ নিশ্চিন্ত গলায় বলল, ‘যাক, প্রবলেম সলভ্ড। তোমার সোনার বালা হাতেই স্থির থাক। আমাদের যা পয়সা আছে তাতে স্বচ্ছন্দে দাম মেটানো যাবে।’

বোঝাটা কমে যেতে হাসল মাধবীলতা। এই হাসি দেখলে মনে হয় একটি সুন্দর মুখের সরল বালক হাসছে। একটু আগে, হেঁটে আসার সময় যে কালো মেঘ জমেছিল তা এখন উধাও, ভাগ্যিস এই টাকার সমস্যাটা উঠেছিল, অনিমেষ মনে মনে বয়টাকে ধন্যবাদ দিল। সে একটু সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এবার বলো, তোমার কী হয়েছে?’

‘যাই হোক, তোমার কিছু এসে যায়?’

‘যায়। যায় বলেই তো তুমি মুখ গম্ভীর করলেই মরে যেতে ইচ্ছে করে।’ অনিমেষ সত্যি কথাই বলল।

‘যাও! যত বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা। আমি যে ক্লাসে ছ’দিন আসিনি, মরে আছি কি বেঁচে আছি খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন নেই, না? আমি তো ভেবেছিলাম আজ তোমার হস্টেলেই চলে যাব।’ মাধবীলতা আবদারের ভঙ্গিতে কথা শেষ করল।

‘পার্টি অফিস থেকে বেরুতে রোজ দেরি হয়ে যাচ্ছিল। এই যাঃ, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার জন্যে নোট নিয়ে যাচ্ছ— মুশকিলে পড়তে হবে। যাক, কী হয়েছে বলো?’

‘মেয়েদের তো এই বয়সে একটাই সমস্যা থাকে। আমার বিয়ের জন্যে সবাই এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি ওদের বোঝা হয়ে আছি যেন। এ-দেশে মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই পাপ।’

‘এ-কথাটা তুমি বলছ, কিন্তু ভাবো তো, ইউনিভার্সিটি অবধি আসার সুযোগ তো তুমি পেয়েছ! এরকম ক’টা মেয়ের ভাগ্যে ঘটছে?’

‘বাঃ তাই একটা লজ্জার কথা ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে?’

‘লজ্জা কেন? মেয়েরা বড় হলে বাপ-মা তাকে সুপাত্রে দিয়ে জীবনটা নিশ্চিন্ত করতে চাইবে না? স্নেহ থেকেই তো এটা আসে।’

‘তা হলে সুপাত্রটিকে মেনে নেব? কী বলো তুমি?’

‘তোমার যদি বাসনা হয়।’

‘দেখো, আমি তোমাকে ধরে রাখিনি। যদি মনে হয় আমাকে তোমার কোনও প্রয়োজন নেই তা হলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারো। কারও দয়া নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। আমি আমার ব্যাপার নিজেই বুঝে নেব।’

মাধবীলতার মুখ আবার থমথমে হয়ে যাচ্ছে দেখে অনিমেষ বলল, ‘তখন থেকে শুধু আমায় বকেই যাচ্ছ, আসল কথাটা বলে ফেলো।’

‘এমন জ্বালায় না!’ মাধবীলতা আনমনে কথাটা বলতেই বয় খাবার দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বললেন?’

‘না না, আপনাকে নয়।’

বয় চলে যেতে অনিমেষ বলল, ‘জ্বালাল তো অথচ নয় বললে কেন?’

মাধবীলতা তার সেরা অলংকার ভুরুর তলায় চাহনি রাখতেই অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। ওর এই চাহনিটায় বুকের মধ্যে যেন লক্ষ জলতরঙ্গ বেজে ওঠে। সে দেখল মাধবীলতা নিজের প্লেটের ফ্রাইটা দু’ভাগ করে একটা টুকরো তার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, ‘অনেক কষ্টে থামিয়েছি।’

‘কী?’ অনিমেষ বুঝতে পারল না।

‘বিয়ে। বাড়িতে খুব ঝামেলা হয়েছে। মা তো কথাই বন্ধ করে দিয়েছেন। বুঝতে পারছি না কতদিন এভাবে চলবে। কোনওরকমে এম এ পাশ করতে পারলে আর চিন্তা করি না।’ মাধবীলতাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।

অনিমেষ দেখল সে খাচ্ছে না, ছুরিটা দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে শুধু। বুকের মধ্যে এক ধরনের চাপ অনুভব করল অনিমেষ। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সে মাধবীলতার কবজি ধরল, ‘তুমি ভেঙে পোড়ো না লতা—।’

কথা না-বলে ঘাড় নেড়ে না বলল মাধবীলতা। তারপর কেমন কান্না-মেশানো গলায় বলল, ‘শোনো, তুমি আমাকে কখনও অবহেলা কোরো না।’

‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না ও কথা।’

মাধবীলতা ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে দিল।

কিছুক্ষণ বাদে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘সেদিন আমি গিয়েছিলাম বলে বাড়িতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?’

‘কথা হয়েছিল। তুমি কে, কোথায় থাকো, এইসব। আমি জানি আমার ব্যাখ্যা ওদের সুখী করেনি। আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারো, যে মেয়েকে তিল তিল করে বাবা-মা বড় করল আদর যত্নে, সেই মেয়ে বড় হয়ে গেলেই কেন তাকে সন্দেহ করতে হবে সবসময়? কেন মনে হয় সে অন্যায় করছে বোধহয়।’

‘স্নেহের আধিক্যই এর কারণ।’

‘কী জানি, অধিকারবোধ বড় অন্ধ করে দেয় মানুষকে।’

খাবারের বিল মিটিয়ে বাকি পয়সা ক’টা টিপস দিয়ে দিতে ছেলেটি খুশি হয়ে নমস্কার করল।

ওরা রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই মাধবীলতা বলল, ‘তোমার আমার দু’জনের কাছেই আর পয়সা নেই, না?’

‘হুঁ।’ অনিমেষ শূন্য পকেটের কথা ভাবতে চাইছিল না। এখনও মাসটা চালাতে হবে। কী করে যে চলবে ঈশ্বর জানে। মুখে বলল, ‘বেশ মুক্তপুরুষ মনে হচ্ছে।’

মাধবীলতা ঠোঁট বেঁকাল, ‘এমন স্বার্থপর না, আমারও যে পয়সা নেই এটা ভুলে গেলে কথাটা বলার সময়!’

ও হাসল। মুক্তপুরুষ বললে যে ছবিটা মনে আসে, মুক্তনারী বললে তা কখনওই বোঝা যায় না। সে বলল, ‘তোমার তো বাবা বাড়িতে পৌঁছালেই পয়সা পাওয়ার সুযোগ আছে কিন্তু ওই দুটো টাকাই আমার শেষ সম্বল ছিল। এখন এই কলকাতায় আমার একটা পয়সাও নেই।’

‘কত লাগবে তোমার?’

‘মানে?’

‘আমি কাল তোমাকে দিতে পারি। আমার কিছু জমানো টাকা আছে।’

‘থাক, দেখি ম্যানেজ করব যা হোক করে।’

‘দেখলে, তোমার মনে কেমন প্যাঁচ! আমার কাছে পয়সা নিলে অহংকারে লাগবে না? যে মেয়েটা—।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল গোটা ত্রিশ টাকা এনো। কবে কখন শোধ করতে পারব আগে থেকে কথা দিতে পারছি না কিন্তু।’

‘আমি যাকে দিই তার থেকে ফেরত নেবার জন্যে দিই না।’

‘বেশ। কিন্তু মহারানি, তুমি কি ভাল করে ব্যাপারটা ভেবে দেখেছ? আমার জীবন এর পর অনিশ্চয়তায় ভরে যাবে। রাজনীতির কাজে কখন কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। চাকরি-বাকরি করে স্থির হয়ে থাকব তারও কোনও সম্ভাবনা নেই। তখন?’

‘তখন আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। এ-কথা বোঝো না কেন আমি কখনওই তোমার বাধা হয়ে দাঁড়াব না।’

শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছানোর পর মাধবীলতা বলল, ‘তুমি যেন কবে বাইরে যাচ্ছ?’

‘সামনের মাসে। নির্বাচনের কাজ করলে অনেক অভিজ্ঞতা হবে। তা ছাড়া জায়গাটা আমার একদম অচেনা নয়।’

‘কবে ফিরছ?’

‘ভাবছি নির্বাচন শেষ হলে বাড়ি ঘুরে আসব।’

‘আমাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে?’

‘তুমি যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার বাড়ি?’

‘সে আর ভাবি না। না, এখন যাব না। যেদিন তোমার পরিচয় নিয়ে যেতে পারব সেদিন আমি যাব। এখন তুমি কাজ করে এসো।’

পকেটে পয়সা না-থাকায় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল অনিমেষ। পথ যদিও দীর্ঘ নয় তবু তার মনে হচ্ছিল সে যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে। এত আনন্দ কেউ পায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *