পাঁচ
একতলার ক্যান্টিন রুমে সুবাস সেনের সঙ্গে ঢুকল অনিমেষ। এখানে ও প্রথম এল। বারোটার সময় ক্যান্টিনে ভিড় কম, কয়েকজন ভাত খাচ্ছে। ওপাশে তিন-চারজন ছেলে বেঞ্চিতে পা তুলে বসে গুলতানি মারছে। সুবাস একবার চোখ বুলিয়ে ক্যান্টিনের ম্যানেজারকে বিমানের কথা জিজ্ঞাসা করল। ভদ্রলোক পিছনের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে একবার ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হবে।’
ওরা একটা বেঞ্চিতে বসলে সুবাস দুটো চায়ের জন্য হুকুম দিল। ঘণ্টাখানেক আগে ভাত খেয়ে এসেছে, এখনই চা খাওয়া ওর অভ্যাসে নেই কিন্তু অনিমেষ আপত্তি করল না। কলকাতার মানুষের কাছে এভরি টাইম ইজ টি-টাইম। দেবব্রতবাবুর বাড়িতে রাত দশটাতেও চা হত। অথচ স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানে চা খাওয়ার এত চল নেই। বেশি খেলে শরীর কষে যায়— এরকম একটা ধারণা চা-বাগানের মানুষের। কলকাতার মানুষ হার্ট ভাল করতে ঘনঘন চা খায়— এরকম একটা খবর ক’দিন আগে কাগজে দেখেছে।
সুবাস চা খেতে খেতে বলল, ‘বিমান খুব সিরিয়াস ছেলে। পলিটিক্যাল চিন্তাভাবনা ওর পরিষ্কার। কিন্তু মুশকিল হল সময়মতো কঠোর হতে পারে না, ফলে মাঝে মাঝে গোলমাল করে ফেলে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি তুমি চার বছর কলেজে থেকে কী করে এস এফ-এর সঙ্গে সম্পর্ক না-রেখে চললে!’
অনিমেষ উত্তর দিল না। কথাটা এর আগেও সুবাস জিজ্ঞাসা করেছে। বোধহয় কোনও সন্দেহ ওর মনে ঢুকেছে। সুবাস জিজ্ঞাসা করল, ‘চুপচাপ কেন?’
অনিমেষ বলল, ‘কোনও কারণ নেই। আসলে আমার তো একটা বছর নষ্ট হয়ে গিয়েছে পায়ের জন্য, আর কোনও রিস্ক নিতে চাইছিলাম না।’
সুবাস বলল, ‘রিস্ক মানে?’
অনিমেষ উত্তর দিল, ‘আমি যদি ফেল করতাম তা হলে আর পড়া হত না। বিএ একবারে পাশ করাটা জরুরি ছিল।’
সুবাস ওর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন তুমি গ্র্যাজুয়েট। কতটা লাভবান হয়েছ তুমি?’
‘মানে?’ অবাক হল অনিমেষ।
‘বি এ পাশ করে তোমার ক’টা হাত গজিয়েছে? তুমি কোথাও দরখাস্ত করলে কেউ তোমাকে চাকরি দেবে? সুস্থভাবে বাঁচার জন্য বি এ ডিগ্রিটা তোমাকে কী সাহায্য করবে? এই যে তুমি বাংলা নিয়ে এম এ ক্লাসে ভরতি হয়েছ, ধরে নিলাম তুমি খুব ভালভাবে পাশ করবে, কিন্তু তারপর?’ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সুবাস।
‘এম এ পাশ করলে নিশ্চয়ই একটা চাকরি পাওয়া যাবে।’ অনিমেষ বলল।
‘ছাই পাওয়া যাবে! বোঝা যাচ্ছে তুমি কোনও খবরই রাখো না। স্ট্যাটিস্টিকস বলছে আঠারো লক্ষ বেকার গ্র্যাজুয়েট আর তিন লক্ষ বেকার এম এ আঙুল চুষছে। সংখ্যাটা প্রতি বছর বাড়বে। তোমার যদি কোনও মামা থাকে তা হলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। তবে তার জন্য এম এ পড়ার কোনও দরকার হয় না।’ সুবাস সিগারেট ধরাল। কথাগুলো শুনতে শুনতে অনিমেষ কীরকম অসহায় বোধ করছিল।
সুবাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘একটা জিনিস ভাবলেই ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলায় এম এ হওয়ার পর চাকরি করার সুযোগ কোথায় কোথায় আছে? প্রথমে কলেজে তারপর স্কুলে। এই দুই জায়গার বাইরে দু’-একটা খবরের কাগজ, ব্যস। প্রতি বছর ক’টা চাকরি স্কুল কলেজগুলোতে বাংলার জন্য খালি হচ্ছে? খুব জোর পঞ্চাশটা, অ্যাঁ? অথচ দুটো ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরুচ্ছে প্রায় শ’দুয়েক ছেলেমেয়ে। এই যে প্রত্যেক বছর দেড়শো করে ছেলেমেয়ে বেকার হয়ে থাকছে তারা কোথায় যাবে? চাকরি দরকার বলে ওরা এমন প্রফেশনে ঢুকবে যার সঙ্গে বাংলায় এম এ পড়ার কোনও সংস্রব নেই। এটা কি কর্তৃপক্ষ জানে না ভাবছ? নিশ্চয়ই জানে। আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়।’ কথাগুলো বলতে বলতে সুবাস দরজার দিকে চোখ ফিরিয়েছিল। কথা শেষ করেই বলে উঠল, ‘এই যে, বিমান এসে গেছে।’
অনিমেষ দেখল, ফরসা সুন্দর চেহারার একটি ছেলে ক্যান্টিনে ঢুকছে। শার্ট-প্যান্ট পরনে, চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল। ওর পিছনে আরও দু’জন। ঘরে ঢুকেই বিমান সুবাস সেনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল, ‘আরে সুবাসদা, তুমি কতক্ষণ?’
‘মিনিট দশেক।’ সুবাস ওর বাড়ানো হাতটা স্পর্শ করে বলল, ‘কেমন আছ?’
‘চলছে। তোমাকে কিন্তু এখানে আশা করিনি।’ বিমান ওর সঙ্গীদের কিছু বলতে তারা আবার বেরিয়ে গেলে সে ওদের পাশে এসে বসল।
‘কেন?’
‘শুনেছিলাম তুমি বীরভূমে চলে যাচ্ছ। ওখানকার কাজকর্ম দেখবে।’
‘ঠিকই শুনেছ। আমি গতকাল কলকাতায় এসেছি। তোমার কাছে আসবার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। হঠাৎ এর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় মনে হল তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া দরকার।’ সুবাস অনিমেষকে দেখাল।
পরিচয়-পর্ব শেষ হবার পর অনিমেষকে বিমান জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোন কলেজ থেকে আসছেন?’ সুবাস বলল, ‘ও স্কটিশে পড়ত। আসলে জলপাইগুড়ির ছেলে, এখানে হস্টেলে থাকত। ওর একটা ব্যাপার ঘটেছিল সেটার সঙ্গে আমিও কিছুটা জড়িত।’ বলে সে হাসল।
বিমান জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার?’
অনিমেষ দ্রুত বলে উঠল, ‘না, না, এমন কিছু ব্যাপার নয়।’
সুবাস হাসছিল, বিমান ওদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘স্কটিশের যারা এবার বেরিয়েছে তাদের সাহায্য পাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে।’
সুবাস জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? ওরা কি সব ডান দিকে?’
বিমান বলল, ‘স্কটিশ দেখাশুনা করত অতীনবাবু। ওরা তো এখন আমাদের চিনের দালাল বলে বেড়াচ্ছে। ন্যাচারালি স্কটিশের ইউনিটটা ওদের মতকেই সমর্থন করছে। পুরোপুরি ক্লাস শুরু না-হলে ঠিক বোঝা যাবে না আমাদের দিকে কারা কারা আছে। আপনার কি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে?’
অনিমেষ দেখল বিমান ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল। খবরের কাগজ থেকে আজ কারও জানতে বাকি নেই বিমান কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছে। সেই চিন-ভারত যুদ্ধের সময় থেকেই এইসব ব্যাপার চলছে। অনিমেষ অবাক হত একটা ব্যাপার দেখে, বিদেশি একটা রাষ্ট্রের আক্রমণের ফসল হিসেবে এ দেশের একটা বড় পার্টি ভাগ হয়ে গেল। পার্টির ভাগাভাগিটা সবে অফিশিয়ালি ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু তার প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন থেকে। স্কটিশে যারা ছাত্র ফেডারেশন করছে তারা পার্টিকেই সমর্থন করছে আর বিমান এবং নিশ্চয়ই সুবাসদারা পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা বিরাট অংশটার সঙ্গে রয়েছে। একই পার্টিতে দীর্ঘকাল একসঙ্গে থেকে পার্টির নেতারা চিন যুদ্ধের পর দ্বিমত হলেন। একদল বললেন, চিন আক্রমণকারী, অন্যদল মনে করলেন ওটা সীমান্ত সংঘর্ষ। ব্যস, ভাগাভাগি হয়ে গেল দলটা। কিন্তু সেই সঙ্গে খবরের কাগজে যে কথাটা লেখা হল সেটাই অনিমেষকে গুলিয়ে দেয়, ডানপন্থী কমিউনিস্টরা নাকি রাশিয়ার সমর্থক, বামপন্থীরা চিনের। কেন আমরা বিদেশি রাষ্ট্রের কথায় পরিচালিত হব, এটাই বুঝতে পারে না সে। বিমানের মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ উত্তর দিল, ‘এসব ব্যাপার আমি সিরিয়াসলি কখনও ভাবিনি।’
‘ভাবেননি? নগরে যখন আগুন লাগে তখন কি দেবালয় অক্ষত থাকে? দেশের জন্য যদি চিন্তা-ভাবনা করেন তা হলে একটা সঠিক পথে আপনাকে যেতে হবে। পথটা কী নেবেন সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। ঠিক হয়ে গেলেই সেটা আপনার কাছে সঠিক পথ। আজকের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি ছাত্রের দায়িত্ব আছে।’
সুবাস এতক্ষণ শুনছিল, এবার বলল, ‘আমি এটুকু বলতে পারি অনিমেষ একসময় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সমর্থন করে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। আসলে পলিটিক্যাল কনশাসনেস ওর মধ্যে আসেনি বলে ও এখনও মনস্থির করতে পারছে না।’
বিমান সোজা হয়ে বসল, ‘আপনি ভাবুন, অনিমেষ। যদি কোনও ব্যাপারে অস্পষ্টতা থাকে তা হলে সরাসরি আমার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।’
এইসময় আরও কয়েকজন ছেলে ক্যান্টিনে ঢুকল। ওদের দেখে বিমান একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সুবাসদাও একটু উসখুস করছিলেন। দলটা থেকে একজন এগিয়ে এল, ‘বিমান, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
‘কী ব্যাপার!’ বিমান ওদের দিকে তাকাল।
‘আমাদের ছেলেদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।’ অনিমেষ দেখল যে ছেলেটি কথা বলছে তার মধ্যে কোনও জড়তা নেই। খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরনে।
‘কে বাধা দিচ্ছে, আমরা?’
‘আমাদের কাছে তাই খবর।’
‘কীরকম?’
‘নবাগত ছাত্রদের অভ্যর্থনা জানিয়ে যে সব পোস্টার দেওয়া হয়েছিল সেগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ছাত্র পরিষদের একটাও পোস্টার চোখে পড়ছে না।’
‘তুমি কি বলতে চাইছ ওগুলো আমরা ছিঁড়েছি! কেন ছিঁড়ব? ওইসব পোস্টার পড়লে কি নতুন ছেলেমেয়েরা সব আমাদের বিরোধী হয়ে যাবে? দেখো মুকুলেশ, আমি চাই না কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে বিরোধ করতে। তোমাদের যদি সত্যি কোনও নালিশ থাকে তা হলে ভি সি-র কাছে যাও, আমার কাছে এসেছ কেন?’
‘আমরা কী করব সেটা আমাদের বিবেচ্য। যেহেতু তুমি জি এস, আর বাম ছাত্র ফেডারেশন এই কাজ করছে তাই তোমাকে জানিয়ে রাখা হল। যদি একইরকম আচরণ চলতে থাকে তা হলে পরবর্তীকালে আমরা অন্যরকম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।’
কথা শেষ করে ছেলেটি চলে যাচ্ছিল, বিমান তাকে ডাকল। মুকুলেশ পিছন ফিরে তাকাতে বিমান বলল, ‘তুমি আমাকে জানো, এইরকম ভয় দেখিয়ে কোনও কাজ হবে না। তোমাদের পোস্টার কারা ছিঁড়ছে আমি জানি না, তবে ওইসব পোস্টার লেখার আগে তোমাদের চিন্তা করা উচিত ছিল। নতুন ছেলেমেয়েদের ওয়েলকাম করতে আমাদের গালাগালি করতেই হবে— এটা কী ধরনের ভদ্রতা? কই আমাদের পোস্টারে তো তোমাদের সম্পর্কে কোনও কথা বলিনি। রাজনীতির প্রথম কথাই কি অভদ্রতা?’
মুকুলেশ হেসে উঠল, ‘রাজনীতির পাঠ তোমার কাছ থেকে নেবার আগে আমার আত্মহত্যা করা উচিত। নতুন যেসব মুরগি ঢুকছে তাদের ব্রেন-ওয়াশ করতে পারো, আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। তোমরা কতটা ভদ্র তার বিরাট লিস্ট আমার কাছে আছে। যথাসময়ে ছেলেমেয়েদের কাছে সেটা রাখব।’
বিমান একটু গলা চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি আমাকে চোখ রাঙাতে এসেছ?’
মুকুলেশ দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি জেনারেল সেক্রেটারি, তোমাকে চোখ রাঙানোর সাধ্য কী! কিন্তু মনে রেখো, এই দেশটা ভারতবর্ষ, চিনের দালালদের আমরা ক্ষমা করব না।’ যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল ওরা।
অনিমেষ দেখল সমস্ত ক্যান্টিনঘর এখন চুপচাপ। যারা ওপাশে ভাত খাচ্ছিল তারা তো বটেই, এমনকী ক্যান্টিনের বয়গুলো পর্যন্ত কাজ ভুলে বিমানের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা নৈঃশব্দ্য কিছুক্ষণ সুতোর মুখে ঝুলতে থাকল। এতক্ষণ সুবাস সেন চুপচাপ শুনছিল, এবার নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্যাপারটা কী?’
সে নিজে হলে কী হত কে জানে, কিন্তু অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল বিমান খুব সহজেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। মাথা নেড়ে হেসে বলল, ‘সেই পুরনো চাল, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা। দিনরাত গালাগাল দেবে কিন্তু প্রতিবাদ করলেই ছাত্র ফেডারেশনের আক্রমণ বলে পোস্টার পড়বে।’
সুবাস জিজ্ঞাসা করল, ‘পোস্টার ছেঁড়ার ব্যাপারটা কী?’
বিমান কাঁধ ঝাঁকাল, ‘আরে যাচ্ছেতাই কথা লিখছে! নবীন ছাত্ররা চিনের দালালদের চিনে রাখুন। একজন দেশদ্রোহী আপনার পাশেই আছেন, যার গেঞ্জি চিন থেকে আসছে। এইসব পোস্টার দেখতে দেখতে কোনও ছেলে যদি মাথা গরম করে ফেলে এক-আধটা ছিঁড়ে ফেলে তা হলে আমি কী করতে পারি! ওদের চরিত্র সেই টিপিক্যাল গ্রাম্য ঝগড়াটে বুড়ির মতো হয়ে গেছে।’
সুবাস বলল, ‘দক্ষিণীরা?’
বিমান হেসে ফেলল, ‘ভাল বলেছ। তাদের মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের সংখ্যা সামান্য, শুনছি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে একটা আঁতাত হচ্ছে ওদের। একসময় সবার চরিত্র প্রকাশ পাবেই।’
চার-পাঁচজন ছেলেকে খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে এদিকে আসতে দেখল ওরা। সবাই অনিমেষের সমবয়সি, দু’-একজনের চেহারা বেশ রাগী রাগী। ক্যান্টিনে ঢুকে ওরা সরাসরি কাছে চলে এল, ‘কী ব্যাপার, শুনলাম মুকুলেশ নাকি তোমাকে মারতে এসেছিল?’ একজন খুব উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল।
‘কে বলল?’ অনিমেষ তাজ্জব হয়ে শুনল কী নিরাসক্ত গলায় কথা বলছে বিমান!
‘সত্যি কি না একবার বলো। শালার লাশ নামিয়ে দেব আজই। এত বড় হেক্কড় যে তোমার গায়ে হাত তুলতে আসে! ফ্যাক্ট?’
বিমান ওদের উত্তেজিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, ‘মারামারি করে কোনও লাভ হবে না। এস এফ গুন্ডাদের পার্টি নয়। ওটা যাদের ধর্ম তারা করুক। তোমরা এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে ওরা সেই সুযোগ নেবে।’
আর-একজন বলে উঠল, ‘কিন্তু গুরু, তোমাকে ইনসাল্ট করলে তো আমরা মুখ বুজে বসে থাকব না। মুকুলেশকে এর কিম্মত দিতে হবে। শালা কি গায়ে হাত তুলেছে?’
বিমান হেসে ফেলল, ‘তোমরা এত খেপে গেছ কেন? বলছি তো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি জানি কী করে এটা ট্যাক্ল করতে হবে।’
চুপচাপ শুনছিল অনিমেষ। একটা ব্যাপার লক্ষ করে অবাক হচ্ছিল ও, ছেলেগুলোর প্রশ্নের উত্তরে বিমান একবারও বলছে না ছাত্র পরিষদের ছেলেরা তাকে মারেনি।
দলের আর-একজন বলল, ‘কিন্তু ওদের প্রশ্রয় দিলে শেষ পর্যন্ত রোখা যাবে না। খামোকা জি এস-এর গায়ে হাত তুলবে আর আমরা সেটা সহ্য করব— শালারা টিটকিরিতে হাড় জ্বালিয়ে দেয়।’
বিমান দু’মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ‘সুদীপ এসেছে?’
‘না, দেখিনি।’ একজন জবাব দিল।
‘একটু দেখো। তোমরা ক্লাসে ক্লাসে বলে এসো যে আজ তিনটের সময় লনে আসতে। যা বলার আমরা সাধারণ ছাত্রদের কাছে সরাসরি বলব।’
‘গেট মিটিং?’
‘না, গেট মিটিং নয়। জাস্ট একটা গেট টুগেদার।’
‘মাইক বলব?’
‘দরকার নেই। আমার গলা ওদের কাছে পৌঁছে যাবে। এ নিয়ে তোমরা কোনও গোলমাল কোরো না। তিনটে অবধি অপেক্ষা করতে বলো সবাইকে।’
ওরা চলে গেলে সুবাস বলল, ‘খুব টেনশন দেখছি।’
‘হবেই। সরকার ওদের হাতে, যা ইচ্ছে করলেও ভাইস-চ্যান্সেলার চুপ করে থাকেন, সেটাই ওদের সুযোগ। এটা আমাদের ছেলেরা সহ্য করতে পারে না। যাক, বীরভূমে তোমার কেমন কাজ হচ্ছে বলো।’
সুবাস সিগারেট ধরাল, ‘ওখানে না-গেলে সত্যি কিছুই জানতাম না। এখানে এই কলকাতা শহরের মানুষের যে প্রবলেম আছে, পলিটিক্যাল যেসব ঝামেলা আছে, গ্রামে গেলে তুমি তার সঙ্গে কিছুই মেলাতে পারবে না। কমপ্লিট ডিফারেন্ট ব্যাপার। এমন এক-একটা গ্রাম আছে যেখানে স্বাধীনতা শব্দটার অর্থ জানে না এমন মানুষের অভাব নেই। জওহরলাল, গান্ধী তাদের কাছে শিব নারায়ণের মতো ভগবানেরই একটা রূপ। ওরা কমিউনিস্ট বলে যাদের জানে তারা থাকে অন্য দেশে। যেন বর্গি কিংবা রাক্ষসের মতো ভয়ানক শত্রু, তারাই কয়েকদিন আগে এই দেশটাকে জয় করতে এসেছিল, ভাগ্যিস গান্ধী দেবতার শিষ্যরা ছিলেন তাই দেশ রক্ষা পেয়েছে। এইরকম অবস্থায় কাজ করা যে কী দুরূহ তা তোমরা বুঝবে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে ওদের যত সহজে কোনও সমস্যা বোঝানো যায়, শিক্ষিত মানুষকে তা সম্ভব নয়।’
‘তুমি কলকাতায় ফিরছ কবে পাকাপাকিভাবে?’ বিমান উসখুস করল।
‘যবে পার্টি বলবে। তবে আমার ওখানে থাকতেই ভাল লাগছে। চলো, আজ উঠি, কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল অনেক।’ সুবাস উঠে দাঁড়াতেই বিমান যেন দাঁড়াতে পারল। অনিমেষের মনে হল বিমানের উসখুস ভাবটা নিশ্চয়ই সুবাসদা লক্ষ করেছিলেন। বিমানের পলিটিক্যাল ধ্যানধারণা সুবাসদার কথামতো হয়তো খুবই ভাল কিন্তু সুবাসদার দৃষ্টিভঙ্গি বিমানের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এ ব্যাপারে অনিমেষের কোনও সন্দেহ নেই।
ক্যান্টিনের দরজায় গিয়ে সুবাস থমকে দাঁড়াল, ‘ওই যা, চায়ের দামটা দেওয়া হয়নি। দাঁড়াও দিয়ে আসি।’
বিমান বাধা দিল, ‘দিতে হবে না। ওটা আমার নামে লিখে রাখবে।’ সুবাস শুনল না। দাম মিটিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘এই লিখে রাখা সিস্টেমটা খুব খারাপ ব্যাপার। খরচের হাত বেড়ে যায়, খেয়াল থাকে না।’
বিমান বলল, ‘তুমি তো খুব হিসেবি, সুবাসদা।’
সুবাস বলল, ‘আমাকে খুব কম অর্থে মাস চালাতে হয় বিমান। অনিমেষ, তুমি কি এখন ক্লাসে যাবে?’ অনিমেষের খেয়াল হল ততক্ষণে দুটো পিরিয়ড অবশ্যই হয়ে গেছে। সবে শুরু হওয়া সেশনে পড়ানো এখনও সিরিয়াসলি শুরু হয়নি। তবু খামোকা ক্লাসে না-যাওয়ার কোনও মানে হয় না। ও ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ’।
সুবাস বলল, ‘তা হলে আমি চলি। আবার কবে কলকাতায় ফিরব জানি না, এলে দেখা করব। বিমানের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়ে গেল, এখন কাজকর্ম শুরু করতে কোনও অসুবিধা নেই।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আজই যাচ্ছেন?’
‘না, কাল সকালে। কেন?’
‘কারণ নেই, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।’
সুবাস অনিমেষকে একবার ভাল করে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি স্কটিশের কোন হস্টেলটায় থাকো?’ অনিমেষ ঠিকানাটা বলতে সুবাস মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে, যদি সময় পাই সন্ধেবেলায় তোমার কাছে যেতে পারি।’ অনিমেষ এটাই চাইছিল। সুবাসদার সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বলা দরকার। কী কথা তা এই মুহূর্তে ওর মাথায় নেই, সমস্ত ব্যাপারটা কীরকম ছায়া হয়ে আছে।
ওরা ক্যান্টিনের সামনের প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে আসছে হঠাৎ বিমান চেঁচিয়ে একজনকে ডাকল, ‘সু-দী-প’। বাঁ হাতে একটা মোটা চুরুট জ্বলছে, সুদীপকে এগিয়ে আসতে দেখল অনিমেষ। সমবয়সি একটি ছেলেকে চুরুট খেতে দেখতে খুব বেমানান দেখাচ্ছে। সিগারেট সবার হাতে মানিয়ে যায় কিন্তু ছেলেটি যেভাবে চুরুট থেকে ধোঁয়া ছাড়ছে তাতে ওকে একটুও মানায় না। সুদীপের কথা বলার ঢংটাও অদ্ভুত। কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দগুলোর ওপর একটু জোর দিয়ে আলতো করে ছেড়ে দেওয়া। সুদীপ কাছে এসে বলল, ‘মুকুলেশের ব্যাপারটা শুনলাম। চলো, ইউনিয়ন রুমে বসা যাক।’
বিমান হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘সুবাসদা, তুমি সুদীপকে চেনো তো!’
সুবাস বলল, ‘বাঃ, আমি কি এখানে নতুন এলাম?’ সুদীপ হাসল না শব্দ করল অনিমেষ বুঝতে পারল না।
বিমান বলল, ‘সুদীপ, এর নাম অনিমেষ, ফ্রেশার, স্কটিশ থেকে আসছে।’ সুদীপ ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘স্কটিশচার্চ? ওহো, ওখানকার একটা ছেলের কথা শুনলাম একটু আগে, খুব ইন্টারেস্টিং কেস।’
ওরা লনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিমান জিজ্ঞাসা করল, ‘কীরকম’?
‘একটি ছেলে, নামটা কী যেন-কী যেন-, হ্যাঁ, ছেলেটি নাকি অ্যাকটিভলি পার্টির কাজকর্ম করে অথচ স্কটিশের স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেনি। সবচেয়ে বড় খবর লাস্ট মুভমেন্টে ওকে নাকি পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, লাকিলি বেঁচে গেছে। অনেকে বুলেটের দাগ দেখেছে।’
বিমান বলল, ‘অদ্ভুত ঘটনা। এরকম একটা কেস কোনও কলেজে আছে আর আমরা জানব না? ইম্পসিবল! সুবাসদা, তুমি জানো?’
সুবাসদা হেসে ফেলল। অনিমেষ খুব অবাক হয়ে গেল। এত দ্রুত গল্পটা বাড়তে বাড়তে এইখানে চলে এসেছে। এভাবে যদি এগোয় তবে শেষ পর্যন্ত সে বিরাট বিপ্লবী হয়ে যেতে পারে।
হঠাৎ বিমান অনিমেষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ‘আপনি তো স্কটিশ থেকে এসেছেন। ছেলেটিকে চেনেন? কী পড়ে?’
কাঁচুমাচু মুখে অনিমেষ বলল, ‘ব্যাপারটা ঠিক সত্যি নয়।’
সুবাস হাসছিল, এবার বলল, ‘তোমরা যার কথা বলছ সে তোমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে ঘটনাটা হল পুলিশের বুলেট ওর পায়ে লেগেছিল এটা ঠিক, এক বছর নষ্ট হয়েছে, মারাও যেতে পারত, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ওর কখনও কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাকিটা সবার মনগড়া গল্প।’
বিমান অনিমেষকে একদৃষ্টে দেখছিল, এবার প্রশ্ন করল, ‘পুলিশ আপনাকে কেন গুলি করল?’
অনিমেষ হেসে বলল, ‘ভুল করে। দৌড়াচ্ছিলাম বলে ভেবেছিল আমিই বোম মেরেছি।’
সুদীপ নিবে যাওয়া চুরুট ঠিক করতে করতে বলল, ‘কিন্তু তবু আপনি অভিনন্দনযোগ্য। আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন, কমরেড।’
এই প্রথম কেউ তাকে কমরেড সম্বোধন করল। একই সঙ্গে অস্বস্তি এবং এক ধরনের খুশি অনিমেষকে টালমাটাল করল। কোনটার পাল্লা ভারী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সে মুখ নিচু করে বলল, ‘আপনারা বোধহয় তিলকে তাল করছেন, আমি তার যোগ্য নই।’
বিমান এক হাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আঘাতটা কেমন ছিল?’
অনিমেষ বিমানের এরকম সহৃদয় ব্যবহারে আড়ষ্ট হয়ে উত্তর দিল, ‘আমি প্রায় আটমাস বিছানায় শুয়ে ছিলাম। একটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘তাই নাকি! তা হলে তো আমরা একসঙ্গে পাশ করেছি। অনিমেষ, আপনার পায়ে কি এখনও বুলেটের দাগ আছে?’ বিমান গাঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ, ওটা মৃত্যু অবধি থাকবে। আমার থাইটা বীভৎস হয়ে আছে।’
‘ভালই হল, আপনি আমাদের হাত শক্ত করুন।’ বিমান ওর সঙ্গে করমর্দন করল।
সুবাসকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে অনিমেষ দোতলায় উঠে এল। অনেকক্ষণ ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। বি সেকশনে ঢোকার তিনটে দরজা, অধ্যাপক যদি পড়ানোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দেন তা হলে তাঁর পক্ষে লক্ষ করা সম্ভব নয় কেউ এল কিনা। ওদিকে দেওয়াল ঘেঁষে মেয়েরা, এপাশে দরজার দিকে ছেলেরা বসে আছে। অনিমেষ ইতস্তত করছিল ঢুকবে কি না। এইভাবে ফাঁকা করিডরে দাঁড়িয়ে থাকাও ভাল দেখায় না। এখন যিনি বাংলা ছোটগল্প পড়াচ্ছেন তাঁর সম্পর্কে বাংলা নিয়ে যারাই পড়ে তাদের অসীম দুর্বলতা। গত চার বছরে অনিমেষ ওঁর লেখা সব ছোটগল্প-উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছে। একটা অদ্ভুত জীবন যেন ছিটকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ অন্যরকম আদল নিয়ে পাঠককে স্তম্ভিত করে দেয়। ছোটগল্প যখন পড়ান তখন চট করে মনে হয় আমি প্যারিসের রাস্তায় হাঁটছি মোপাসাঁর হাত ধরে অথবা এডগার অ্যালান পো-র সঙ্গে একটু আগে চা খেয়ে এলাম। পড়ানোটা এত আন্তরিক যে কান বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।
দরজার ধারে বসা দু’-তিনটি ছেলে অনিমেষকে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে ইশারায় ভেতরে আসতে বলল। এরা স্কটিশ থেকে আসেনি। আলাপও হয়নি, ক’দিনের ক্লাসে শুধু চোখাচোখি হয়েছে মাত্র। মাথা নামিয়ে অনিমেষ চট করে দরজা ডিঙিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসে পড়ল। দু’-একজন এদিকে তাকাল মাত্র কিন্তু কেউ কোনও মন্তব্য করল না। অনিমেষকে যারা ডেকেছিল তাদের মধ্যে একজন, যে এখন ওর পাশে বসে আছে, চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন কলেজ?’
‘স্কটিশচার্চ’, অনিমেষ উত্তর দিল।
‘চার্চ?’ ছেলেটা চোখ বড় করল, ‘চার্চ না সার্চ? মেয়ে খোঁজার জায়গা। মাইরি তোমাদের কপাল সোনা দিয়ে বাঁধানো। আমাদের কলেজের ধারেকাছে মেয়ে ছিল না।’ দাঁত বের করে হাসল সে। ছেলেটিকে ভাল করে দেখল অনিমেষ। নীল ফুলহাতা শার্ট আর ধুতি পরনে, সাধারণ মানুষের তুলনায় যথেষ্ট বেঁটে। ওপরের দাঁতগুলো একটু উঁচু বলে মুখ খুললেই মনে হয় হাসছে। ছেলেটির কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা সহজ ব্যাপার ছিল যে অনিমেষ রাগ করতে পারল না। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন কলেজ আপনার?’
‘সিটি। কিন্তু নো আপনি টাপনি। আমি শালা মেয়েদেরই ডাইরেক্ট তুমি বলছি।’
এর মধ্যে কখন পড়ানো থেমে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি অনিমেষ। হঠাৎ ছেলেটি পা দিয়ে ওর পায়ে টোকা মারতে দেখতে পেল ক্লাসসুদ্ধু সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ তুলে তাকাতেই অধ্যাপকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। লম্বা মানুষটা নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চাপা হাসি উঠল ঘরটায়, অনিমেষ বুঝতে পারছিল ওর মুখে রক্ত জমছে। অধ্যাপক এবার হাতের বইটা টেবিলের ওপর মুড়ে রেখে খুব ধীরগলায় অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খুব জরুরি কথা হচ্ছিল কি?’ উত্তর দিতে হলে উঠে দাঁড়াতে হয়, অনিমেষের মনে হল এর চেয়ে লজ্জা সে জীবনে কখনও পায়নি। ওই ছেলেটি যদি মিছিমিছি তার সঙ্গে কথা না-জুড়ত তা হলে এই পরিস্থিতিতে ওকে পড়তে হত না। অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়ে কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে না বলল।
‘আমরা কিন্তু একটু জরুরি কথা বলছিলাম। ছোটগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেটা এখন মানা যায় না। এ ব্যাপারে তুমি বোধহয় আমাদের সাহায্য করতে পারবে।’ অধ্যাপকের ঈষৎ সরু গলা অনিমেষকে কাঁপিয়ে দিল। ও অনুভব করছিল একটা বিরাট ফাঁদ ওর জন্য পাতা হচ্ছে এবং সেটা জানা সত্ত্বেও ওই ফাঁদে পা বাড়ানো ছাড়া তার কোনও উপায় নেই।
অধ্যাপক বললেন, ‘আচ্ছা, আজকালকার একটা গল্পের কথাই ধরা যাক। তুমি ইদানীং যেসব গল্প পত্রপত্রিকায় পড়েছ তার মধ্যে কোন গল্পটা তোমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, আমরা ওই গল্পটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।’ অধ্যাপক ওর দিকে সহানুভূতির চোখে তাকালেন। সমস্ত ছেলেমেয়ের মুখ ওর দিকে ফেরানো। অনিমেষ বুঝতে পারছিল ওর সর্বাঙ্গে ঘাম জমছে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করে গত পূজাসংখ্যা ‘দেশ’ পত্রিকার সেই গল্পটা মনে করল। পড়তে পড়তে সমস্ত শরীর স্থির হয়ে গিয়েছিল, পড়া শেষ হলে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। প্রথম দিন ওই অধ্যাপকের ক্লাসে এসে সেই গল্পটার সঙ্গে ওঁকে মেলাতে চেষ্টা করেছিল সে, মেলেনি। লেখকদের সঙ্গে লেখা মেলে না বোধহয়। মন ঠিক করে ফেলল অনিমেষ, তারপর পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি সত্যি কথা বলতে পারি?’
‘আশ্চর্য! খামোকা মিথ্যে বলতে যাবে কেন?’ অধ্যাপক বিস্মিত হলেন।
এবার অনিমেষের মনে দ্বিধা নেই, সে গল্পটির নাম উচ্চারণ করল। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপকের কপালে তিনটি ভাঁজ পড়ল, ঝাঁকড়া চুলে আঙুল বুলিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নিঃশব্দে পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাচ মুছতে লাগলেন। কয়েকটা মুহূর্তের অপেক্ষা, বোধহয় অধ্যাপকের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই, হঠাৎ ক্লাস ফেটে গেল হাততালিতে। সবাই প্রায় একসঙ্গে অনুরোধ করতে লাগল গল্পটি নিয়ে আলোচনা করতে। অধ্যাপক অনিমেষকে আর-একবার দেখে টেবিল থেকে বই টেনে সবাইকে এক হাত তুলে থামালেন। তারপর বললেন, ‘তুমি বুদ্ধিমান সন্দেহ নেই, কিন্তু বুদ্ধিমানদেরও মনোযোগী হতে হয়। আচ্ছা, আমরা যেখানে থেমেছিলাম—।’
আবার পড়ানো শুরু হল নতুন করে। অনিমেষ ধীরে ধীরে বেঞ্চিতে বসতেই পাশের ছেলেটি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘গুরু, একটা লেগ দেখি!’
আর কথা বলতে এবার ভয় হল। সে জড়সড় হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকল। অধ্যাপক তাকে যে ভাষায় তিরস্কার করলেন সেভাবে কোনও মানুষ তাকে কোনওদিন করেনি। একটুও না-রেগে যে ঠিক জায়গায় শাসনটাকে পৌঁছে দেওয়া যায় সেটা এই প্রথম অনুভব করল অনিমেষ। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ও মুখ নামাল। অধ্যাপকের সরু গলার মধ্যে এমন মাদকতা আছে, শব্দগুলো এমন গল্প হয়ে যায় যে সত্যি অন্যদিকে মন দিতে ইচ্ছে করে না। সামনে সার সার মাথা, অনিমেষ ছোটগল্পের ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে হঠাৎ কেঁপে উঠল। সামনের মাথাগুলোর সামান্য ফাঁক একটা সরলরেখায় অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। সেই রেখার শেষে যে বসে আছে তার দুটো চোখ এখন ওর মুখের ওপর নিবদ্ধ। অমন আয়ত গভীর দৃষ্টি যেন মনে হয় সমস্ত হৃদয় ওই চোখে মাখানো— অনিমেষ বুকের মধ্যে অজস্র ঝরনার চাঞ্চল্য আবিষ্কার করল। দৃষ্টিটা সরছে না কিন্তু একটু বাদেই সরলরেখাটা ভেঙে গেল। মাথাগুলো সামান্য নড়াচড়া করতেই চোখ দুটো হারিয়ে গেল। বুকের মধ্যে থম ধরে গেছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়— অনিমেষ কোনও কারণ বুঝতে পারছিল না। এরকম হল কেন তার? অধ্যাপকের পড়ানোটা কান দুটোয় পৌঁছাচ্ছে না। যেন ওর সব ইন্দ্রিয় হঠাৎ অকেজো হয়ে গিয়েছে। শুধু দুটো চোখ একটা পদ্মফুলের মতো মুখের ওপর থেকে সরাসরি উঠে এসে তার রক্ত নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঘণ্টা পড়েছে, অধ্যাপক ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে করিডরে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কখন টের পায়নি অনিমেষ। কে একজন এসে ওকে বলল, ‘স্যার তোমাকে পরে প্রফেসার্স রুমে দেখা করতে বলেছেন।’
অনিমেষ বেরিয়ে আসছিল, হঠাৎ পিছন থেকে শুনল, ‘লেগটা দিলে না গুরু?’ সে অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই সিটি কলেজের ছেলেটিকে দেখতে পেল।
‘তোমাকে একটু প্রণাম করতাম। টি. জি-কে যেভাবে বোল্ড করলে গুগলি দিয়ে-তুমি মাইরি সাধারণ মাল নও।’ সত্যি সত্যি হাসল ছেলেটি।
অনিমেষ বলল, ‘আমার নাম অনিমেষ, তোমার নাম কী?’
‘পরমহংস রায়। পরম বলে ডাকাই ভাল, শেষেরটা শুনলে খারাপ লাগে।’
‘পরমহংস?’ অনিমেষের মুখ হাঁ হয়ে গেল। এরকম নাম কোনও মানুষের হয়? ঘাড় নাড়ল ছেলেটি, ‘হ্যাঁ, শুদ্ধচিত্ত সংযতাত্মা নির্বিকার ব্রহ্মানন্দে মগ্ন যোগীপুরুষ। আমার ঠাকুরদার আমাকে ওই ভূমিকায় দেখার বাসনা ছিল।’
আরও তিন-চারজন ছেলে ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল, তারা এবার খুব জোরে হেসে উঠল। ওরা যখন কথা বলছে তখন অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে করিডরে যাওয়াআসা করছে। বাংলা ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। অনিমেষ আড়চোখে তাদের দেখছিল। এখন সেই ঝিমঝিমে ভাবটা অনেক কম কিন্তু উত্তেজনা কমে গেলে ওর যেমন হয়, পেটের ভেতর চিনচিন করছিল। না, সেই চোখ দুটোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত সে ক্লাস থেকে বের হয়নি। এখন মুষ্টিমেয় ছাত্রী ওই ঘরে আছে, গেলেই দেখা হয়ে যাবে, কিন্তু অনিমেষের যেতে সাহস হচ্ছিল না। পরমহংস চা খাওয়ার প্রস্তাব করল কিন্তু অনিমেষের এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছিল না তার এরকমটা কেন হচ্ছে? স্কটিশে ওদের সঙ্গে প্রচুর মেয়ে পড়ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিকারের সুন্দরী ছিল। কিন্তু কখনও তাদের দেখে ওর মনে এরকম চাঞ্চল্য আসেনি। নীপা বলে একটা মেয়ে ওদের সঙ্গে বাংলা অনার্সে ছিল। প্রথম দিনের পরই সে ওদের সঙ্গে তুই-তোকারি করেছে, একটা ছেলের সঙ্গে নিজের কোনও তফাত রাখেনি। অদ্ভুত ব্যাপার, ওদের সহপাঠীদের মধ্যে কেউই নীপাকে প্রেম নিবেদন করেনি। অথচ এখন ওই চোখ দুটো দেখার পর থেকে ওর এরকমটা হচ্ছে কেন?
পরের ক্লাস আরম্ভ হবার সময় অনিমেষ দেখল সুদীপ করিডর দিয়ে হেঁটে আসছে। হাতে তেমনি আধপোড়া চুরুট। ওকে দেখে সুদীপ একটা হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলল। অনিমেষের পাশে তখনও পরমহংস ছিল। সে চাপা গলায় বলল, ‘লিডার আসছে, তুমি চেনো নাকি?’
অনিমেষ ঘাড় নেড়ে এক পা এগোতেই সুদীপ কাছে এসে গেল, ‘তোমাকে খুঁজছিলাম, এইটে তোমার ক্লাস?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমাকে আমাদের ভীষণ প্রয়োজন কমরেড।’
একটা অবাক গলায় অনিমেষ বলল, ‘কেন?’
‘শোনো, তুমি অবশ্যই তিনটের সময় লনের মিটিং-এ যাবে আর বাঁদিকের থামের নীচে দাঁড়াবে যাতে প্লাটফর্ম থেকে তোমাকে স্পষ্ট দেখা যায়।’ নেবা চুরুটটা টানল সুদীপ।