৩৮. খুব দ্রুত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে

আটত্রিশ

খুব দ্রুত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এতটা হবে অনিমেষ ভাবেনি। যারা এর আগে কখনও রাজনীতির সঙ্গে সামান্যও যুক্ত ছিল না তারাও আসতে শুরু করেছে। এক ধরনের ছেলে থাকে পরিবারে তারা ঠিক আমল পায় না নানান রকম ব্যর্থতার জন্যে, কিন্তু তাদের মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মন আছে। সেই মনই তাদের টেনে আনছে। আগে হলে অনিমেষ এ নিয়ে সূক্ষ্মবিচারে বসত, এরকম উচ্ছ্বাসকেই হাউই বলে বাতিল করত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেকসময় মরা মরা বলতে বলতেও তো রাম শব্দটা বেরিয়ে পড়ে। অ্যাডভেঞ্চার করা হোক কিংবা তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাসই হোক, এই করতে গিয়ে যদি কিছু ছেলে সিরিয়াস হয়ে যায় সেইটেই সবচেয়ে বড় পাওয়া। জুলিয়েনকে সঙ্গে পেয়ে কাজ করতে সুবিধে হচ্ছে। দীর্ঘকাল এদিকে ইউনিয়ন করায় ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলোতে জুলিয়েন বেশ পরিচিত। চা-শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, হপ্তার বা মাসের মাইনেতে যাদের সংসার চলে তাদের জুলিয়েন সরিয়ে রাখছিলেন। বলেছিলেন, ‘এইসব মানুষ খুব সুখে নেই কিন্তু নিশ্চিত আয় থেকে সরে আসার ঝুঁকি কেউ নেবে না। বরং চা-বাগানে যারা নানান কারণে অবাঞ্ছিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।’

বাঙালিদের সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনিমেষের এক ধরনের বিরক্তি এসে গেছে। তাঁরা যেন নেতা হতেই জন্মেছেন। দলে যে ক’জন এসেছেন তাঁরা শুধু নানান ধরনের যুক্তি তুলে জ্ঞান দিতে চান। কাজ করবার খুব উদ্যম তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না। বরং দলের মধ্যে একটা উপদল গঠন করার ব্যাপারে বেশ তৎপরতা চোখে পড়ে।

শিলিগুড়ির সঙ্গে অনিমেষের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। প্রায়ই তাকে যেতে হচ্ছে সেখানে। বড় বড় নেতাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এদিকে নির্বাচন এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন পার্টি থেকে প্রচার শুরু করার আয়োজন চলছে। অনিমেষদের দল নিবার্চন বয়কট করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নির্বাচন বুর্জোয়া ফ্যাসিবাদীদের একটা নতুন ধরনের খেলনা মাত্র কিংবা এমন একটা মাদকদ্রব্য যা দিয়ে দেশবাসীকে পাঁচ বছরের জন্যে বুঁদ করে রেখে দেওয়া যায়। অবশ্য নির্বাচনকে প্রতিরোধ করার কোনও নির্দেশ এখন পর্যন্ত পার্টি থেকে আসেনি।

এই যে প্রস্তুতি চলছে সেটা আর এখন গোপন নেই। বিভিন্ন পার্টি থেকে তাদের হঠকারী উগ্রপন্থী ইত্যাদি বিশেষণ দেওয়া হলেও সরাসরি সংঘর্ষে এখনও ওরা লিপ্ত হয়নি। কিন্তু হাওয়া গরম হয়ে উঠছে দ্রুত। অনিমেষের আশঙ্কা, পুলিশের আগে তাদের হয়েতা অন্য পার্টিগুলোর সঙ্গে লড়তে হবে। সংগঠন যত জোরদার হচ্ছে অন্য পার্টিগুলো ততই নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন বোধ করছে। এই সঙ্গে আর-একটা সমস্যা মাথা চাড়া দিচ্ছে। যে সব ছেলেকে ওরা দলে টানছে তাদের কোনও কাজ না-দিয়ে কতদিন আর চুপচাপ বসিয়ে রাখা যায়। মার্ক্সবাদের ব্যাখ্যা বা গেরিলাযুদ্ধের প্রকরণ শোনার মতো মানসিক ধৈর্য এদের নেই। জোর করে বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। শুধু ডুয়ার্স কেন, সারা পশ্চিমবাংলায় পার্টিতে এই ধরনের হুলিগান ঢুকছে। নেতাদের বক্তব্য, ভাঙচুর পাথরের টুকরো গড়াতে গড়াতেই মসৃণ হয়। কিন্তু এদের সামলে রাখা যে খুব মুশকিল তা অনিমেষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

কিন্তু যে জিনিসটা অনিমেষকে ভীষণ বিচলিত করছিল তা হল বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট দল গঠন করার মধ্যেই তাদের সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এখন অবধি কোনও যোগাযোগ করা যায়নি। দেশে বিপ্লব দরকার, কেন দরকার কীভাবে সেটা সম্ভব এইসব কথা যাদের বোঝাতে হবে তাদের কাছে এখনও পৌঁছানো যায়নি। যায়নি তার একটা বড় কারণ যে এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সরাসরি প্রচার করতে গেলে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো বাধা দেবে। তা ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করা যায় তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করবে না। এবং এই সরকার তো তাদের চেনাশোনা মানুষই চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে লড়ার ব্যাপারে খুব একটা মানসিক জোর পাবে বলে মনে হয় না। লোকাল কমিটির বক্তব্য, স্রোত যদি জোরদার হয় তা হলে জল নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। এখনই তাড়াহুড়ো করে বোকামি না-করে উপযুক্ত সময়ের জন্যে অপেক্ষা করা দরকার। বিপ্লব হলে সাধারণ মানুষ নিজের স্বার্থেই পথে নামবে। হয়তো ঠিক, তবু অনিমেষের অস্বস্তিটা যাচ্ছিল না।

জুলিয়েনের ওপর সমস্ত ভার দিয়ে অনিমেষ ট্রেনে চাপল। রিজার্ভড বার্থ কিংবা সিট নয়, বারোয়ারি কামরায় উঠল সবার নজর এড়াবার জন্যেই। শিলিগুড়ি থেকে অনেকেই যাচ্ছে বোলপুরে। যতটা সম্ভব পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, কারণ বোলপুরের মিটিং অত্যন্ত গোপনে হচ্ছে। প্রথমে বসার জায়গা পায়নি অনিমেষ। শেষে একটা বাঙ্কের ওপরে বাবু হয়ে বসতে পারল একসময়। এবং এই ট্রেনের দুলুনিতে হঠাৎ মনে হল খুব ক্লান্ত লাগছে। এই দিনগুলোয় নিশ্বাস ফেলার সময় পায়নি। কিন্তু যত দ্রুত ভাল কাজ হয়েছে বলে বোধ হচ্ছিল ঠিক ততটা কি হয়েছে? এতদিন এখানে রইল অথচ সে স্বর্গছেঁড়া বা জলপাইগুড়ির বাড়িতে যায়নি। প্রথম দিকে এড়িয়ে ছিল, শেষের দিকে সত্যি আর সময় হয়নি। অনিমেষ খবর পেয়েছে, মহীতোষ জেনে গেছেন সে উত্তরবাংলায় আছে। পরিচিতজনেরা নিশ্চয়ই খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। স্বর্গছেঁড়া ছাড়া সব জায়গাতেই সে প্রকাশ্যে ঘুরেছে অতএব তাকে দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। খবরটা ওঁকে বিহ্বল করে দেবে। নিশ্চয়ই ভেবে কোনও কিনারা করে উঠতে পারবেন না। যারা খবর দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কথাও জানিয়েছে। বাবার জন্যে অনিমেষের খারাপ লাগছিল। বাঁধা লাইনে তাকে ঘিরে যে আশা উনি করেছিলেন সেটা পূর্ণ করা সম্ভব হল না। কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে ওঁর! অনিমেষ এ নিয়ে ভেবেছে। প্রথমে নিশ্চয়ই খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, তারপর একসময় নির্লিপ্ত হয়ে কোনও সম্পর্ক না-রাখার জন্যে ছোটমাকে হুকুম করবেন। হয়তো জ্যাঠামশাইকে দাদু যেভাবে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন সেইভাবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। অনিমেষ জানে সে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে বললে তা মহীতোষের কাছে আরও দুঃখজনক হবে। বরং তার নিজের কথা লিখে সে বাবাকে একটা চিঠি দেবে। পাশাপাশি সরিৎশেখরের মুখ মনে পড়লে অনিমেষের কিন্তু অস্বস্তি হয় না। সে যে সব ছেড়েছুড়ে সক্রিয় রাজনীতির অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই খবর মোটেই সরিৎশেখরকে চিন্তিত করবে না। একটা মানুষ দীর্ঘ জীবন যাপন করে শেষ পর্যন্ত কী লাভ করে তা সরিৎশেখরের চেয়ে কেউ বেশি জানে না।

অনিমেষ এই রাতের ট্রেনে একা একা যেতে যেতে শুধু একজনের জন্যে অস্বস্তি অনুভব করছিল। মাধবীলতা তাকে ভালবাসে এবং তার মূল্য দিতে একটুও পিছপা নয়। অথচ অনিমেষ যে রাজনীতি করে তার ছায়ায় সে পা রাখছে না। অনিমেষের সঙ্গে জড়িয়েও সে আড়ালে আড়ালে থাকছে। একটি মানুষকে নিঃশর্তে ভালবেসে মাধবীলতারা সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারে। তার কাজকর্মের সঙ্গে নিজের মানসিক সংযোগ না-থাকলেও তা নিয়ে বিরক্ত করে না। কিন্তু উত্তরবাংলায় দিনরাত এই অনিশ্চিত উত্তেজনায় কাটিয়ে আজ অনিমেষের মনে হচ্ছিল মাধবীলতাকে মুক্তি দেওয়া দরকার। এভাবে সে যদি তার জন্যে অপেক্ষা করে তা হলে নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হয়। একজন আমার মুখ চেয়ে রয়েছে অথচ আমি তার জন্যে কিছুই করতে পারছি না এই বোধ তাকে কিছুতেই শান্তি দিচ্ছিল না। মাধবীলতাকে কখনও বিয়ে করতে পারবে কিনা তা সে জানে না। শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? অনিমেষ জানে, ভাল করে বুঝিয়ে বললেও মাধবীলতার কোনও পরিবর্তন হবে না। ও সেই দলের মেয়ে নয় যারা প্রেমিক অক্ষম বুঝলেই সুড়সুড় করে বাবার আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে সংসারী হবে। মুশকিলটা এখানেই। তবু, অনিমেষ মনে মনে ঠিক করল, এবার সে সরাসরি মাধবীলতাকে নিষেধ করবে তার জন্যে অপেক্ষা করতে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। অন্তত ওই নরম মনের মেয়েটাকে বাঁচাবার জন্যে তাকে রূঢ় ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া তার নিজেরও মুক্তি নেই।

রামপুরহাট ছাড়তেই ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় বাড়ল। পৌষমেলার জন্যে সবাই বোলপুরে যাচ্ছে। আগে কখনও বোলপুরে সে যায়নি। পৌষমেলার কথা কাগজেই পড়েছে। বোলপুর স্টেশনের চেহারা দেখে ওর মনে হল এখানে সভা করে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। এত মানুষের ভিড়ে পুলিশের পক্ষে সন্দেহ করার কোনও কারণ থাকবে না। মেলার মানুষের জঙ্গলে তারা স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারবে। শিলিগুড়ির খবর অনুযায়ী রাত দশটায় বোলপুর ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গোয়ালপাড়া বলে একটা গ্রামে তাকে যেতে হবে। সেখানে গ্রামের ভাটিখানার পাশ দিয়ে নদীর দিকে একটু এগোলে বাঁ হাতের চার নম্বর বাড়িটা আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কোনও কারণে স্থানের পরিবর্তন হলে বোলপুর কোঅপারেটিভ স্টোর্সের সামনে বিকেল পাঁচটায় এলেই জানা যাবে। সবাইকে জানানো হয়েছে যে তারা যেন বোলপুরে পৌষমেলা দেখতে যাচ্ছে এমন প্রকাশ পায়। অনিমেষ এ ব্যাপারে অবশ্য খুবই আশ্বস্ত। শান্তিনিকেতন দেখার এমন সুযোগ পাওয়া গেল সেটা উপরি লাভ। তার ওপর সঙ্গে মাধবীলতা থাকায় তাদের তো ভ্রমণবিলাসী বলেই মনে হবে। কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। নিশ্চিন্ত হতে গিয়েই অস্বস্তিতে পড়ল অনিমেষ। আবার সে লতাকে বর্মের মতো ব্যবহার করছে। না, এই শেষ, মাধবীলতা যদি বর্ধমানে আসে তা হলে তো আর সেখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। বোলপুরে মিটিং শেষ হলে যে সময় হাতে থাকবে তখন সে মাধবীলতাকে বোঝাবে, পরিষ্কার হয়ে নেবে।

বর্ধমানে ট্রেনটা থামতেই বুকের মধ্যে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ এরকম উত্তেজনা তার সমস্ত শরীর মনকে আক্রমণ করবে একটু আগেও সে টের পায়নি। মাধবীলতাকে দেখতে পাবে শুধু এই কারণেই তার অবচেতন মন এত অধীর ছিল? এই তো সেদিন সে কলকাতা ছেড়ে গেল! তবে? অনিমেষ নিজেকে সংযত করল। ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবার পরও কিছুক্ষণ বসে রইল সে। তারপর ধীরে ধীরে নীচে নেমে দু’পাশে তাকাল। প্রচুর মানুষ বিপরীত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে সবাই পৌষমেলার যাত্রী। স্পেশাল ট্রেন না-দিলে কোনও ট্রেনেই এত লোকের জায়গা হবে না। অনিমেষ কুলিদের সামলে এগোল। মাধবীলতাকে চোখে পড়ছে না। আর-একটু খোঁজাখুঁজির পর অনিমেষ আবিষ্কার করল তার শরীর ক্রমশ অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। মাধবীলতা কি আজকের তারিখটার কথা ভুলে গেছে? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না। তন্নতন্ন করে প্ল্যাটফর্মটা খুঁজে সে ওভারব্রিজের নীচে এসে দাঁড়াল। মাধবীলতার কিছু হয়েছে! হয়তো খুব অসুস্থ হয়ে শুয়ে রয়েছে হস্টেলে। এও তো হতে পারে, ওর বাবা জোর করে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। কিংবা যদি মাধবীলতা এতদিনে তার ভুলটা বুঝতে পেরে থাকে। কথাটা ভাবতেই অনিমেষের বুকের ভেতরটায় দাউদাউ চিতা জ্বলে উঠল। কোনও চিন্তা আর মাথায় সুস্থভাবে আসছে না। শুধু মনে হল এই ট্রেনটায় তার কলকাতায় চলে যাওয়া উচিত। সরাসরি হস্টেলে পৌঁছে মাধবীলতার খোঁজ না-করলে সে শান্তি পাবে না।

ঠিক সেই মুহূর্তে সে শূন্য চোখে ওপরে তাকাতেই নড়ে উঠল। প্রথমে কী দেখেছে তা বুঝতেই কয়েক পলক গেল। তারপর চোখের সামনে কয়েক লক্ষ পদ্ম ভোরের রোদ পেয়ে ঝকমকিয়ে উঠল। যেন বুকের চিতায় কেউ নরম হাত রাখল। অনিমেষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে সেই উজ্জ্বল হাসিতে মাখামাখি মুখটাকে নীচে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। সামান্য সময়, তারপরেই মাধবীলতা ওভারব্রিজটা প্রায় দৌড়ে পার হয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসছিল। অনিমেষের মনে হল একটা ঝরনা যেন উদ্দাম বেগে তার দিকে ছুটে আসছে।

অনিমেষ একটুও নড়ল না। মাধবীলতাকে দেখে ওর যে শান্তি বুকে ছড়াচ্ছিল তা ক্রমশ অভিমানের ছায়ায় যাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ও তাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেছে কিন্তু অযথা এই উদ্বেগে রেখে মজা পাচ্ছিল। সামনে এসে দাঁড়াল মাধবীলতা, ‘ওমা, তোমার চেহারা কী হয়েছে? আয়নায় মুখ দেখেছ?’

‘তাই এতক্ষণ চিনতে পারোনি?’ অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল।

‘পারিনি তো! ঢ্যাঙা, রোগা আর কী কালো হয়ে গেছ।’ মাধবীলতার মুখ সত্যি সিরিয়াস, ‘খুব অত্যাচার করেছ বুঝতে পারছি। খাওয়া দাওয়া করতে না?’

‘ওখানে তো কোনও শরৎচন্দ্রের নায়িকা ছিল না যে আমাকে পিঁড়ি পেতে খাওয়াতে খাওয়াতে হাওয়া করবে!’ অনিমেষ মুখ ঘোরাল।

‘খুব কথা শিখেছ। একটু আগে যখন দেখতে পেলাম তখন সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে না-দেখতে পেয়ে তুমি না কেমন বোকা বোকা মুখ করে তাকাচ্ছিলে।’ মাধবীলতা ঠোঁট টিপে হাসল।

‘খুব আনন্দ লাগছিল তাই দেখে?’

অনিমেষের গলার স্বরে এমন একটা পাঁচিল ছিল যে মাধবীলতার হাসি চট করে নিভে গেল। সে চট করে অনিমেষের হাত ধরল, ‘এই, রাগ করেছ আমার ওপরে? আসলে আমারই ভুল। এখানে এত ভিড় যে ভাবলাম দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। তার চেয়ে ওভারব্রিজের ওপরে গিয়ে দাঁড়ালে তোমাকে আমি ঠিক দেখতে পাব। তা করতে গিয়ে তোমাকে যেই দেখতে পেলাম বুকের ভেতরটা এমন করতে লাগল যে—। আসলে তোমাকে লুকিয়ে তোমায় দেখতে আমার খুব ভাল লাগছিল। এই, রাগ কোরো না, প্লিজ!’

অনিমেষ দেখল এই পদ্মের মতো মুখ উদগ্রীব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর অনিমেষ নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল। না, এ মেয়ের ওপর সে কখনওই রাগ করতে পারবে না।

স্পেশাল ট্রেনটা ছেড়ে দিতে হল। এত ভিড় যে ঝুলে যাওয়ারও উপায় নেই। পরের ট্রেনটা প্রায় ঘণ্টা আড়াই পরে। এতক্ষণ এখানে চুপচাপ বসে থাকার কোনও মানে হয় না। ওরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। অনিমেষ আড়চোখে মাধবীলতাকে দেখছিল। তাকে যাই বলুক মাধবীলতা নিজেও কিন্তু বেশ রোগা হয়েছে। তবে এবার ওকে খুব প্রাণবন্ত লাগছে। উচ্ছ্বাস একটু বেশি। অনিমেষকে দেখে ওর খুশি হওয়ার ব্যাপারটা আর চেপে রাখছে না। বাসস্ট্যান্ড অবধি ওরা হেঁটে এল। আসতে আসতে অনিমেষ জানতে পারল মাধবীলতার বাবা একদিন হস্টেলে এসেছিলেন। মেয়েকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। একটি ভাল পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি চান মাধবীলতা সুখী হোক। এই ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে হলে ওরা স্বচ্ছন্দে সারাজীবন আমেরিকায় থাকতে পারে। ছেলেটি সেখানেই সেটল্‌ড। মাধবীলতা তার বাবার কথা মন দিয়ে শুনে বলেছে সেটা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক তিতিবিরক্ত হয়ে ফিরে গেছেন। এবং যাওয়ার আগে অনিমেষের নাম জেনে গেছেন। মাধবীলতাই বলেছে। মেয়ে যে এমন মারাত্মক ভুল করছে তা তিনি বিশ্বাস করতেই পারছেন না। নিশ্চয়ই হস্টেলে গিয়ে অনিমেষ সম্পর্কে খোঁজখবর করবেন এবং কে জানে স্বর্গছেঁড়ায় অভিযোগ জানিয়ে চিঠিও দিতে পারেন। এসব বলে মাধবীলতা হাসল, ‘তোমাকে বোধহয় আমি খামোকা ঝামেলায় ফেললাম।’

‘কীরকম?’

‘এবার বাবা-মায়ের কাছে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে।’

‘সে দায় বোধহয় আর নেই। কিন্তু তুমি কী ঠিক করছ?’

‘মানে?’

‘তোমার বাবা একটুও অসংগত কথা বলেননি।’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘তোমার এসব পাগলামি না-করে অন্য কোথাও বিয়ে করে সংসারী হওয়া উচিত। আমার কথা ছেড়ে দাও। এইসব করতে করতে কখন কী হবে কেউ বলতে পারে না। আমার জন্যে তুমি বসে থাকবে কেন?’ এসব কথা বলার জন্যে অনিমেষের মানসিক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বলতে হবে ভাবেত পারেনি। সুযোগ এসেছে যখন— অনিমেষের কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মাধবীলতাকে বাঁচাতে এগুলো বলতেই হবে।

‘বেশ, আমি তা হলে এখান থেকেই কলকাতায় ফিরে যাই।’ মাধবীলতার চোখের দৃষ্টি পালটে গেল। মুখ গম্ভীর এবং ঠোঁটের কোনায় ভাঁজ পড়ল।

‘এখান থেকে ফেরার দরকার নেই। বোলপুরে চলো। সত্যি বলছি, এ ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলার দরকার। যত দিন যাচ্ছে আমার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।’ শেষ কথাটা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলল অনিমেষ।

মাধবীলতা তখন দাঁড়িয়ে পড়েছে। একদৃষ্টে সে অনিমেষের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কী হয়েছে?’

‘কেন?’

‘এরকম উন্মাদের মতো কথা বলছ!’

‘উন্মাদ?’

‘তুমি কি আমাকে একটুও চিনতে পারোনি?’

মাধবীলতার মুখ দেখে অনিমেষের মনে হল এ বিষয়ে আর একটা কথা বলা মানে রাস্তার মধ্যেই একটি দৃশ্য তৈরি করা। তা ছাড়া ওই মেঘ-জড়ানো মুখের দিকে সে আর তাকাতেও পারছিল না। বলল, ‘বড্ড খিদে লেগেছে। ট্রেনে কিছুই খাওয়া হয়নি। চলো কিছু খাই।’

মাধবীলতা কিছুক্ষণ মাথা নামিয়ে ভাবল। তারপর অন্যরকম গলায় বলল, ‘এরকম কথা আর কখনও বোলো না। আমি আলু বেগুন ময়দা নই।’

কথাগুলো যেন মাধবীলতাকে কাঠিন্যের পরদায় ঢেকে দিল। স্টেশনে দেখা সেই উজ্জ্বল মেয়েটা যেন চট করে ডুব দিল গভীরে। অনিমেষ আর এ ব্যাপারে কথা বলতে সাহস পেল না। বাসস্ট্যান্ডেও প্রচুর ভিড়। ছাদে লোক বসেছে। ডাবল ভাড়ায় ট্যাক্সি ছুটছে। সেদিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, ‘এদিকে এসো।’

মাধবীলতা উত্তরের অপেক্ষা না-করে এগিয়ে যেতেই অনিমেষ অনুসরণ করল। পাশের একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে একগাদা খাবারের হুকুম দিল মাধবীলতা। আগে হলে প্রতিবাদ করত অনিমেষ, কিন্তু এখন চুপচাপ খেয়ে নিল। মাধবীলতা নিজে একটা শিঙাড়া আর চা ছাড়া কিছু নিল না।

মেয়েরা চিরকালই ছেলেদের খাইয়ে এক ধরনের সুখ পায়। ব্যাপারটা শরৎচন্দ্র-মার্কা সুখ বলে ঠাট্টা করত অনিমেষ। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব কথা বলতে বাধল তার। এখন মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালে একটা ঠান্ডা স্রোতের স্পর্শ পাচ্ছিল সে। এ মেয়েকে কী করে বোঝানো যায়, বোঝাতে গেলে নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। অথচ অনিমেষ বুঝতে পারছে, বুঝলে মাধবীলতার উপকার হত।

কোনওরকমে একটা প্রাইভেট ট্যাক্সিতে জায়গা পেয়ে গেল ওরা। ড্রাইভারের পাশে চারজনকে বসিয়েছে। অস্বস্তিতে দম বন্ধ হবার জোগাড় কিন্তু কোনও উপায় নেই। পুরো ট্যাক্সিতে এগারোজন লোক। ভাড়া ডবল। মাধবীলতা জানালার পাশে বসলেও তার শরীরের চাপ অনিমেষের ওপর। নিজেকে পাশের লোকের ওপর প্রায় চাপিয়ে দিয়েও অনিমেষ ওকে স্বচ্ছন্দ রাখতে পারছে না। মাধবীলতার শরীরের স্পর্শ অনিমেষকে বিব্রত করিছল। বিব্রত মাধবীলতাও। ধুলোর ঝড় উড়িয়ে ট্যাক্সিটা বর্ধমান ছাড়িয়ে বীরভূমে ঢুকল। মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, ‘তোমার মাথায় কোনও বুদ্ধি নেই।’

‘সে তো জানা কথাই, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল কেন?’

‘আমি যদি সরাসরি বোলপুরে গিয়ে নামতাম আর তুমি যদি এতদূর এগিয়ে না-আসতে তা হলে এত ঝামেলা পোয়াতে হত না।’

‘সাবধানের মার নেই বলে একটা কথা আছে।’

‘তোমার আবার সব তাতেই বাড়াবাড়ি। পুলিশ যেন তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে!’ মাধবীলতা ঝাঁঝালো গলায় জবাব দিল। ট্যাক্সির ভেতর খুব গুলতানি চলছে। সহযাত্রীরা সব কলকাতা থেকে আসছে। ওদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে অনিমেষের খেয়াল হল আজ রাত্রে কোথায় থাকবে তাই ঠিক হয়নি। সারারাত মাধবীলতাকে নিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। এদিকে যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে কোনও হোটেলে জায়গা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কথাটা মাথায় ঢোকামাত্র অনিমেষের অস্বস্তি শুরু হল। একা থাকলে সবকিছু ম্যানেজ করা যায় কিন্তু একজন মহিলাকে নিয়ে তো তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আর-একটা সমস্যার কথা তার খেয়ালে আসেনি। হোটেলে যদি একটা ঘর পাওয়াও যায় তা হলে মাধবীলতার সঙ্গে এক ঘরে রাত্রে থাকাটা কীভাবে সম্ভব? না, তার ব্যক্তিগত সংকোচ নেই, নিজের ওপর আস্থা আছে তার। কিন্তু মাধবীলতা নিজে কীভাবে নেবে ব্যাপারটা? ওরকম গভীর মনের মেয়ে এই ব্যবস্থাটাকে মেনে নিতে কি পারবে! হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতাকে এখানে আসতে বলেই সে ভুল করেছে। আগে থেকে ভেবে কোনও কাজ করছে না বলেই শেষমেষ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে সে।

বোলপুরে মাটিতে নামতেই মেলার গন্ধ পাওয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী আজ নাকি ভাষণ টাষণ দিয়ে গেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের তৎপরতা এখন বেশি হবে। আর মাধবীলতা বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ রাখছিল। রোদের তেমন তেজ নেই এখন। কিন্তু এই মুহূর্তে ভাল করে স্নান সেরে খেতে ইচ্ছে করছে। মাধবলীতা বলল, ‘মেলা তো রাত্তিরে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখন তো কোথাও গিয়ে উঠতে হবে। চলো দেখি।’

‘হোটেলে জায়গা পাওয়া যাবে?’

‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো পাওয়া যাবে না।’

অনিমেষ একটা রিকশাওয়ালাকে ডাকল। লোকটি খুব তৎপরতার সঙ্গে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় বাবু? ট্যুরিস্ট লজ?’

অনিমেষ বলল, ‘ট্যুরিস্ট লজে জায়গা পাওয়া যাবে?’

সঙ্গে সঙ্গে লোকটির মুখ হাঁ হয়ে গেল, ‘আপনারা জায়গা বুক করেন নাই?’

‘না। হঠাৎই এসে পড়লাম, তাই।’

‘এখানে বাবু মাছি ঢোকার জায়গা নেই কোথাও। ট্যুরিস্ট লজ, হোটেল, বোর্ডিং সবখানে লাইন দিয়ে লোক বসে আছে। কোনও চান্স নেই।’

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। অবস্থা খুব খারাপ। মাধবীলতা একটু এগিয়ে এল, ‘আচ্ছা ভাই, এসেছি যখন তখন কোথাও থাকতে হবে তো। তুমি এখানকার লোক, একটা জায়গার কথা বলো না!’

রিকশাওয়ালার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘না দিদি, ভদ্দরলোকের থাকার জায়গা নাই। সারা বছর সব ফাঁকা পড়ে থাকে কিন্তু পৌষমেলার সময় যেন হাভাতের ভিড়ে পড়ে যায়।’

অনিমেষ বলল, ‘একটা রাত তো, যেমন হোক একটা জায়গা পেলেই হয়ে যাবে। সারাক্ষণ তো মেলাতেই ঘুরব আমরা। একটু দেখো না।’

লোকটি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘উঠে আসেন, দেখি কী করা যায়।’

স্বস্তিতে বসতে পেরে আরাম লাগল। হিম-মাখা হাওয়ায় রিকশা সাঁতরে যাচ্ছে যেন। অনিমেষ বলল, ‘দেখো কপালে কী আছে!’

মাধবীলতা হাসল, ‘আমি যখন সঙ্গে আছি তখন বিফল হবে না।’

বোলপুর ডিঙিয়ে শান্তিনিকেতনকে পাশে রেখে রিকশাওয়ালা শ্রীনিকেতনের রাস্তায় চলে এল। প্রায় মিনিট দশেক ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর ডান দিকে একটা মাটির রাস্তায় ঢুকে পড়ল সে। অনিমেষ দেখল সুন্দর সুন্দর বাড়ি হয়েছে এদিকে। মেলার ভিড়-ভাট্টার ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি এখানে। শুধু ট্যুরিস্টরা বড় রাস্তা দিয়ে শ্রীনিকেতনে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা ওদের বসে থাকতে বলে একটা বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। অনিমেষ দেখল বাড়িটার সদর দরজা জানলা বন্ধ। প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় যে এখানে লোকজন থাকে না। খানিক বাদে একটি দারোয়ান গোছের লোককে সঙ্গে নিয়ে রিকশাওয়ালা ফিরে এল। এসে একগাল হাসল, ‘আপনারা তো একটা রাতই থাকবেন?’

অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল।

রিকশাওয়ালা বলল, ‘নেমে আসেন। সব কথা হয়ে গেছে। এ হল এ-বাড়ির মালি। বাড়ির বাবু বোম্বেতে থাকেন। এবার আসবেন না তাঁরা। আপনাদের একটা ঘর খুলে দিচ্ছে, আরাম করে থাকুন।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কত দিতে হবে?’

‘তিরিশ টাকা। এত শস্তায় আরামের জায়গা আর কোথাও পাবেন না বাবু। তবে একটা কথা জানলা খুলতে পারবেন না।’

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’

‘মানে সবাই জানে এখানে কেউ থাকে না। জানলা খুললে পাশের বাড়ির লোক টের পেয়ে গেলে মালিকের কানে যাবে। মানে, একটু গোপনে গোপনে থাকতে হবে বাবু। একটা রাত, শীত কাল, কোনও অসুবিধা হবে না।’

‘তোমায় কত দিতে হবে?’

‘সে যায় হয় দেন। আপনাদের যা মন চায়।’

অনিমেষ দুটো টাকা দিতে গিয়ে কী ভেবে তিন টাকা দিল। মুখ দেখে মনে হল লোকটা আরও বেশি আশা করেছিল। এতক্ষণ মালি কোনও কথা বলেনি। চুপচাপ ওদের দেখছিল। অনিমেষরা রিকশা থেকে নামতেই বাড়ির ভেতর ফিরে চলল সে। রিকশাওয়ালা ফিরে যেতেই অনিমেষরা বাড়ির ভেতর ঢুকল। সামনে বাগান আছে কিন্তু ভাল করে যত্ন নেওয়া হয় না বোঝা যাচ্ছে। সদর দরজা নয়, পাশের খিড়কি দরজা দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। বেশ বড় বাড়ি। ভেতরে বাঁধানো চাতাল। চাতালের ওপাশে ঠাকুর চাকরের ঘর আর এদিকে ভেতরে যাওয়ার দরজা। মালি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একটা দরজা খুলে প্রথম কথা বলল, ‘এই ঘরে থাকবেন।’

অনিমেষ দেখল ঘরটা বেশ সুন্দর। বেশ বড় খাট বিছানা চেয়ার সাজানো আছে। ওরা বসামাত্র লোকটি বললি, ‘শুনলেনই তো, জানলা খুলবেন না। আর আমি ছাড়া কেউ ডাকলে সাড়া দেবেন না।’

অনিমেষ বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু স্নান করব কোথায়?’

‘ওপাশে বাথরুম আছে।’ লোকটি একটু এগিয়ে অ্যাটাচড বাথ দেখিয়ে দিল।

মাধবীলতা বলল, ‘যাঁর বাড়ি তিনি আসেন না।’

‘আসেন। তবে এবার আসবেন না। কিন্তু কেউ যদি তাঁর হয়ে আসেন তা হলে চুপচাপ আপনাদের চলে যেতে হবে।’

‘সে কী!’ আঁতকে উঠল অনিমেষ।

‘দ্যাখেন, ভেবে দ্যাখেন।’

মাধবীলতা বলল, ‘আর ভাবতে পারছি না। কেউ এলে আমরা চলে যাব।’

‘ভাল কথা। আপনারা খেয়ে এসেছেন?’

‘না। এদিকে হোটেল আছে?’

‘আছে। তবে আমি এনে দিচ্ছি।’

‘না না। আমরা গিয়ে খেয়ে আসব।’

‘সেটা ঠিক হবে না। বারবার যাওয়া-আসা করলে লোকে দেখবে। একবারে বেরিয়ে গিয়ে রাতে ফিরবেন। টাকা দিন।’

মাধবীলতা ব্যাগ খুলে দশ টাকা বের করে দিতে লোকটি বলল, ‘ভাড়াটা।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওটাও এখনই দিতে হবে?’

‘হ্যাঁ বাবু। দিতেই তো হবে, আগে আর পরে।’

লোকটি টাকা নিয়ে দরজা ভেজিয়ে চলে গেল। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এই বড় বাড়িটার বন্ধ ঘরে সে আর মাধবীলতা ছাড়া আর কেউ নেই। সংকোচ কাটাতে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেমন বন্দি বন্দি লাগছে নিজেকে, না?’

মাধবীলতা তখন হাতের ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখছিল। এদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কার বাড়িতে কারা এল! লোকটা বোধহয় মাঝে মাঝেই ঘরটা ভাড়া দেয়।’

‘কী করে বুঝলে?’ অনিমেষ এগিয়ে এল।

মাধবীলতা আঙুল দিয়ে একটা লেডিস রুমাল দেখিয়ে দিল। কোঁচকানো রুমালটা টেবিলের কোণে পড়ে আছে। মালিটার চোখ এড়াল কী করে?

অনিমেষ মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখল। তারপর বলল, ‘খুব খিদে পেয়ে গেছে। আমি স্নান করে আসি।’ কথা শেষ করেই সে ব্যাগটা তুলে নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল।

রাত জেগে ট্রেনে আসা, দেরিতে স্নান খাওয়ার জন্যে অিনমেষের আলসেমি বোধ হচ্ছিল। কিন্তু মাধবীলতার পীড়াপীড়িতে ওকে উঠতে হল। বাইরে মিষ্টি রোদের আলপনা, এখন ঘরে বসে থাকার নাকি কোনও মানে হয় না। অথচ অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল এই ঘরে মাধবীলতার মুখোমুখি বসে গল্প করেত। এরকম নির্জনে থাকার সুযোগ ওদের আগে কখনও হয়নি। বেশ সংসারী সংসারী লাগছে। কিন্তু মাধবীলতার বাইরে যাওয়ার জন্যে যে ছটফটানি তার একটা কারণ ওর চোখ এড়াচ্ছিল না। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তির। বিশেষ করে মাধবীলতার মতো মেয়ে, যে এক কথায় নিজের বাড়ি ছেড়ে তার জন্যে হস্টেলে এসে উঠেছে, সে এই নির্জন ঘরে তার সঙ্গে থাকতে যেন ভয় পাচ্ছে। ব্যাপারটা মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। অনিমেষের মনে হল, যত শক্ত হোক, মেয়েরা কোনও কোনও জায়গায় এক। আগাম কিছু চিন্তা করে দুর্ভাবনায় ভোগে অথচ সেটা মোটেই মুখে প্রকাশ করবে না।

বড় রাস্তায় বেরিয়ে অনিমেষের মনে হল আজকের দুপুরটা সত্যিই চমৎকার। পৌষমেলায় এখানে বোধহয় প্রতি বাড়িতে অতিথি আসে। বাড়িগুলোর সামনের লনে কিংবা বাগানে রোদ পোয়ানোর ভিড় দেখলেই তা বোঝা যায়। বেশ উৎসবের মেজাজ এখন শান্তিনিকেতনে। শ্রীনিকেতন থেকে যে রাস্তাটা সোজা শান্তিনিকেতনের ভেতরে চলে গেছে ওরা সেই পথ ধরল। বেশ ভিড় এখানেই। পাশাপাশি হাঁটতে মাধবীলতা বলল, ‘দারুণ!’

‘কী দারুণ?’

‘জায়গাটা।’

‘তাই বলো।’

‘কেন, তুমি কী ভেবেছিলে?’

‘আমি তো অনেকরকম ভেবে থাকি। সেগুলো তো আর সত্যি হয় না।’

‘যেমন?’

‘ধরো, আজ দুপুরে তোমার সঙ্গে ঘরে বসে গল্প করব ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি যেমন করে বাইরে আসার জন্যে ছটফট করছিলে তাতে নিজেকে রাক্ষস টাক্ষস মনে হচ্ছিল।’ অনিমেষ খুব লঘু গলায় বলল।

মাধবীলতা চট করে অনিমেষের মুখ দেখে নিল। হলুদ শাড়ি আর ফরসা গালে এমন একটা শ্রীমাখানো ওর চেহারায় যে অনিমেষ সেই দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পর চোখ ফেরাতে পারল না।

মাধবীলতা মুখ নামিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘তুমি কিস্যু বোঝো না।’

‘বুঝি না?’

‘না। আমরা যদি সারাদুপুর ঘরে বসে থাকতাম তা হলে দারোয়ানটা যা অনুমান করেছিল তা সত্যি বলে ভাবত। আমরা যে এখানে বেড়াতে এসেছি, ঘরে বসে থাকতে নয়, এটা ওকে বোঝানো দরকার ছিল।’

‘যাচ্চলে! ও যে আমাদের সম্পর্কে এত ভাবছে তা তুমি জানলে কী করে?’

‘আমরা যখন রিকশা ছেড়ে দিলাম তখন থেকে লোকটা আমার মাথার দিকে তাকাচ্ছিল। যে কেউ বুঝতে পারবে আমি বিবাহিতা নই।’

‘সিঁদুরের কথা বলছ? আমরা তো খ্রিস্টানও হতে পারি।’

‘বাজে বোকো না। বিবাহিতা মেয়েদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।’

অনিমেষ চমকে মাধবীলতাকে দেখল। ও মাথা নিচু করে হাঁটছে। তর্ক করতে পারত অনিমেষ। শুধু দারোয়ানের জন্যেই ঘরছাড়া হতে হল এটা সে মানতে পারছে না। কিন্তু মেয়েরা কখনও কখনও সত্যি কথাটা আড়াল করতে একটা কিছু বাহানার ঘোমটা টানে, জেনেশুনে সেটা নিয়ে টানাটানি করে কী লাভ?

সারাটা দুপুর ওরা শান্তিনিকেতন দেখল। আজ খুব ভিড়। বেশিরভাগ ঘরবাড়ির দরজা বন্ধ। কিন্তু ছড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যগুলো, মাঠঘাট, ছাতিমতলা, শ্যামলী অথবা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে সময়টা কখন ফুরিয়ে গেল। মাধীবলতা বলছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে ছিলেন আর তাঁর চারপাশে সেইসব বিখ্যাত মানুষ ঘিরে আছেন— কথাটা ভাবলেই কেমন শিহরন লাগে।’

অনিমেষ বলল, ‘ধরো, এই পথ দিয়ে নন্দলাল হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁকে দেখে রামকিঙ্কর শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গেছেন। দিনু ঠাকুর, দীনবন্ধু এনড্রুজ, প্রভাত মুখার্জি, জগদানন্দ রায়ের সঙ্গে একটু এ-দিক ও-দিকে গেলেই দেখা হয়ে যাবে। আর এইসব ছেড়েছুড়ে অপারেশনের জন্যে শেষবার কলকাতায় যাওয়ার আগের ভোরে ছেলেমেয়েরা তাদের গুরুদেবকে গান শোনাচ্ছে বাইরের মাঠে দাঁড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথের চোখে জল। সেই ভোরটায় তাঁর শান্তিনিকেতন কখনওই শান্তির ছিল না তাঁর কাছে।’

মাধবীলতা বলল, ‘আমি এই প্রথম এলাম এখানে। আমাদের জন্যে কেউ এত সুন্দর জায়গা তৈরি করে গিয়েছিলেন, পড়াশুনা শুধু ভালবাসা থাকলে কতটা আন্তরিক হতে পারে— এখানে না-এলে বুঝতাম না।’

‘অথচ দেখো, ছেলেবেলা থেকে আমরা গল্প শুনতাম এখানকার ছেলেরা নাকি মেয়েলি, এই গোরু সরে যা— বলে, অথচ এখানে এসে একজনও তো তেমন চোখে পড়ল না।’

‘আমার কিন্তু এখান এসে একটা লাভ হয়েছে।’

‘কী?’

‘তোমাকে।’

‘মানে!’

‘তুমি যতই বিপ্লবের কথা বলো, দেশের সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তন চাও, আসলে ভেতরে ভেতরে তুমি খুব রোমান্টিক।’

‘কী করে বুঝলে?’

‘রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গেলে তোমার মুখ চোখ অন্যরকম হয়ে যায়। ঠিক কি না বলো?’ দু’চোখে ঝকঝকে হাসি মাধবীলতার।

অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াল। ‘যা কিছু সচল তাই তো বিপ্লবের অবলম্বন। জড়পদার্থ কখনও বিপ্লব করতে পারে না। প্রকৃত বিপ্লবী যে সে কিন্তু মনে মনে ভীষণ রোমান্টিক। চে গুয়েভারা কিংবা মাও সে তুং তো কাঠখোট্টা লোক ছিলেন না। অবশ্য রোমান্টিক যে, সেই বিপ্লবী হবে এমন আশা করা যায় না, কিন্তু বিপ্লবী যে, তাকে কিন্তু রোমান্টিক হতেই হবে। রোমান্স মানে জানো তো?’ মাধবীলতার দিকে দুষ্টুমিচোখে তাকাল অনিমেষ।

‘সুন্দরের প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং অজানাকে জানতে চাওয়া।’

‘বাঃ, গুড। এরকম সুন্দরী মহিলাকে যখন জানতে চেয়েছি তখন অবশ্যই আমাকে রোমান্টিক বলা যায়।’

‘আমি মোটেই সুন্দরী নই। আর তোমাদের জানার আগ্রহটা একবার মিটে গেলেই তো প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল।’

‘সেটা যাকে জানতে যাচ্ছি তার বিশালতার ওপর নির্ভর করে।’

মাধবীলতা ভ্রূকুটি করল। তারপর হাতে রাখা শালটা খুলে শরীরে জড়িয়ে নিল। এখন বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বাতাসে। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। সারাদুপুর ধুলো মেখে শরীর বেশ ক্লান্ত। কাছাকাছি কোনও রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ছিল না যে সেখানে গিয়ে চা খাওয়া যায়। কোঅপারেটিভের সামনের মাঠটা বাসে বাসে ভরতি। সারা বাংলা ছাপমারা বাসগুলো মেলার যাত্রী নামিয়ে এখানে জিরোচ্ছে। অনিমেষরা কোঅপারেটিভের সামনে এসে দাঁড়াতেই আলো জ্বলে উঠল। তেরাস্তার মোড় এটা। কোনও খবর থাকলে এই সময়েই এখানে সেটা পাওয়ার কথা। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? চলো, মেলায় যাই।’

অনিমেষ বলল, ‘মেলা তো সারারাত ধরে চলবে। একটু জিরিয়ে যাই। পা ব্যথা করছে।’

‘বাব্বা, এটুকু হেঁটেই পা ব্যথা। তা হলে চলো কোথাও বসি।’

অনিমেষ এখন এই জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি নয়। অথচ সে কথা মাধবীলতাকে বলাও যাচ্ছে না। মাধবীলতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে, আর মেলায় যাওয়ার কথা তুলল না। অনিমেষ দেখছিল স্রোত বয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। এত মানুষের ভিড়, রিকশার আওয়াজ ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। প্রায় মিনিট কুড়ি দাঁড়ানোর পর অনিমেষের মনে হল সব ঠিকঠাকই আছে। না-হলে কেউ না-কেউ এতক্ষণে এসে যেত। গোয়ালপাড়া এখান থেকে কত দূর কে জানে। মাধবীলতার সামনে খোঁজখবর নিতে বাধছে। আবার এই ব্যাপারটা মাধবীলতাকে লুকিয়ে করতেও সংকোচ হচ্ছে ওর। সে বলল, ‘চলো, এবার মেলার দিকে যাওয়া যাক।’

ভিড় বাঁচিয়ে পাশে হাঁটছিল মাধবীলতা। হঠাৎ বলল, ‘তোমার কোনও কাজে বাধা দিইনি আমি। বলতেই তো পারতে এখানে দাঁড়ানোটা তোমার একটা কাজের মধ্যে পড়ে।’

অনিমেষ কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ও দেখল, কথাটা বলার পর তার উত্তর শোনার আগ্রহ মাধবীলতার মুখে নেই। সে চারপাশের বাগান লোকজন আগ্রহ নিয়ে দেখছে। মেলার মাঠ যত এগিয়ে আসছে তত শব্দ বাড়ছে। মাইক বাজছে। জমজমাট ভিড় আর অজস্র দোকানের আলো মানুষদের চুম্বকের মতো টানেছ। সেদিকে তাকিয়ে একটা চিন্তা বিদ্যুৎচমকের মতো অনিমেষের মাথায় ঝলসে উঠল। আজ রাত্রে ওদের যে গোপন মিটিং হচ্ছে সেখানে মাধবীলতাকে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তা হলে এই সময়টা মাধবীলতা কোথায় থাকবে? মিটিং কতক্ষণ চলবে আগে থেকে বলা যাচ্ছে না। মাধবীলতা অবশ্য জানে অনিমেষ গোপন মিটিং-এ যোগ দিতে শান্তিনিকেতনে এসেছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনও আলোচনা করেনি, ঔৎসুক্য দেখায়নি। এই রাত্তিরে একা যুবতী মেয়েকে রেখে যাওয়াটা অত্যন্ত দায়িত্বহীন ব্যাপার হবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল। অবশ্য তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে মাধবীলতাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে সে মিটিং-এ যেতে পারে। একা থাকার ঝুঁকি থাকছে বটে কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে তবু কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

মেলায় ঢুকে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল মাধবীলতা। তেষ্টা পেয়েছিল। ওরা দু’কাপ চা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খাচ্ছে এমন সময় খুব চাপা গলায় নিজের নামটা শুনতে পেল অনিমেষ। ব্যাপারটা এত আকস্মিক যে, হাতের কাপের চা চলকে উঠল, অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে দেখল ওর ঠিক পাশেই একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। আলোয়ানে মোড়া শরীর এবং মাথার ফাঁক দিয়ে শুধু এক গাল দাড়ি আর চোখ দেখা যাচ্ছে। এক মুহূর্ত, কিন্তু অনিমেষ চিনতে পারল।

অনিমেষ বলল, ‘বলো।’

সুবাসদা বলল, ‘তোমার এভাবে ঘুরে বেড়ানোটা ঠিক হচ্ছে না।’

‘কেন?’

‘বোলপুর স্টেশনে আমাদের দু’জন ছেলেকে পুলিশ ধরেছে। মেলা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও।’ সুবাসদা যেন নিজের মনেই কথা বলছিল। অনিমেষ আড়চোখে মাধবীলতার দিকে তাকাল। চা খেতে খেতে মাধবীলতা এর মধ্যে একটু সরে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি অন্যদিকে। বুঝতে অসুবিধা হল না যে সে অনিমেষের সঙ্গে সুবাসদার কথাবার্তায় অসুবিধে না-হওয়ার জন্যে এইরকম ভঙ্গি করছে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাদের মিটিং হচ্ছে তো?’

সুবাসদা বলল, ‘হ্যাঁ। কারণ যারা ধরা পড়েছে তারা জানত না কোথায় মিটিং হবে। ঠিক সময়ে নির্দেশ পাবে জেনে এসেছিল। মেয়েটি কে?’

‘আমার আত্মীয়।’ কথাটা আচমকা মুখে এসে গেল অনিমেষের।

‘বিশ্বাস করা যায়?’

অনিমেষ নীরবে ঘাড় নাড়ল।

‘তুমি দায়িত্ব নিচ্ছ?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু কী ব্যাপার?’

সুবাসদা আলোয়ানের নীচ থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে অনিমেষের হাতে দিয়ে দিল, ‘এটা ওর কাছে রাখতে বলো। সাবধানে।’

‘কী আছে এতে?’

‘এমন কিছু যা সঙ্গে থাকলে আমার বিপদ হবে। মনে হেচ্ছ আমি খুব সেফ নই। তোমরা কোথায় উঠেছ?’

‘একটা বাড়িতে।’

‘ওকে সেখানে ফিরে যেতে বলো। মিটিং-এর পর আমি গিয়ে জিনিসটা ফেরত নিয়ে নেব। তোমরা আর দাঁড়িয়ো না।’ কথাটা শেষ করেই সুবাসদা চোখের পলকে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

মাধবীলতা চায়ের দাম দিয়ে অনিমেষের দিকে ফিরতেই সে খালি কাপটা নামিয়ে রেখে প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল। সামান্য ভ্রূকুটি কিন্তু মাধবীলতা ওটাকে নিয়ে ওর দিকে তাকাল।

অনিমেষ বলল, ‘কী আছে জানি না তবে খুব গোপনে রাখতে হবে। তুমি রাখতে পারবে?’

মাধবীলতা বলল, ‘না-পারলে কী করবে? আমি রাখব জেনেই তো তুমি প্যাকেটটা নিয়েছিলে।’

অনিমেষ বলল, ‘আমি তোমাকে জড়াতে চাইনি কিন্তু।’

‘ঠিক আছে। কথা বাড়িয়ো না।’ মাধবীলতা প্যাকেটটাকে কাপড়ের আড়ালে এমনভাবে চালান করে দিল যে অনিমেষ স্বস্তি পেল। এক মুহূর্ত মেলার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, ‘আমার পক্ষে মেলায় ঘোরা ঠিক হবে না। তুমি কী করবে?’

‘আমি একা একা ঘুরতে পারব না। ভাল লাগে একা একা ঘুরতে?’

‘তা হলে?’

‘তোমার মিটিং কটায়?’

‘দেরি আছে।’

‘তা হলে চলো বাড়িতে ফিরে যাই।’

‘এখন বাড়িতে ফিরে কী করবে?’

‘গল্প করব। মুখোমুখি বসে।’ মুখ টিপে হাসল মাধবীলতা।

‘আমি যখন বেরিয়ে আসব তখন একা থাকতে পারবে?’

‘কী আশ্চর্য। ঘরটার তো দরজা জানলা আছে। আর সেটা এই খোলা আকাশের চেয়ে নিশ্চয়ই বেটার, তাই না?’

খারাপ লাগছিল মেলা ছেড়ে যেতে কিন্তু প্যাকেটের ভেতরে কী আছে না-জেনে এভাবে ঘুরে বেড়ানোর ঝুঁকি নেওয়ার মানে হয় না। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে অনিমেষ ডাকল। মাধবীলতা প্রতিবাদ করতে গিয়ে কী ভেবে চুপ করে গেল।

বিপরীতমুখী ভিড় ঠেলে ওরা যাচ্ছিল। রিকশায় ওঠার পর যেন ঠান্ডাটাই আরও বেড়ে গেল। অনিমেষের শীতবস্ত্র এই ঠান্ডার পক্ষে মানানসই নয়। উত্তরবাংলায় যা গায়ে দেওয়া যায় তা এখানে বয়ে আনার কথা মনে ছিল না। মাধবীলতার গায়ে চাদর আছে কিন্তু বোধহয় মেয়েদের শীতবোধ একটু কম।

রিকশাটা বড় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে ওরা কাঁচা পথটা হেঁটে আসছিল। দু’পাশের বাড়িগুলোর আলো জানলা দরজা বন্ধ থাকায় বাইরে আসছে না। ওরা গেট সরিয়ে বাগানে ঢুকল। অন্ধকার ঝুপসি হয়ে রয়েছে বিরাট বাড়িটায়। কোনও মানুষ আছে কি না টের পাওয়া যাচ্ছে না। খিড়কি দরজা দিয়ে ওরা চাতালে ঢুকে দেখল একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ওদের শব্দ পেয়ে দারোয়ান মুখ বের করে বলল, ‘ও আপনারা। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে?’

অনিমেষ বলল, ‘রাত্তিরে আবার বের হব তাই একটু বিশ্রাম নিতে এলাম।’

‘খাওয়াদাওয়া কোথায় করবেন?’

অনিমেষের খেয়াল হল রাত্তিরে সে একাই বেরুবে। অতএব মাধবীলতার জন্য খাবার দরকার। সে একটু এগিয়ে আলো-জ্বালা ঘরটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে ভেতরে উনুন জ্বলছে। লোকটি আটা মাখছিল।

‘ভাবছি খেয়েই বের হব। তুমি তো নিজের খাবার বানাচ্ছ। আমাদের জন্যে কয়েকটা রুটি আর তরকারি করে দাও না। দামটা নিয়ে নাও।’

‘ডিম খাবেন?’

‘ডিমের ঝোল রুটি? বাঃ, খুব ভাল।’

‘করে দেব।’

‘টাকাটা এখন নেবে?’

‘থাক খেয়েই না-হয় দেবেন।’

লোকটি ওদের পেছনে পেছনে ঘর অবধি এল। দরজাটা ভেজানো ছিল। অনিমেষ সেটা খুলে দেখল টেবিলে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে।

দারোয়ান বলল, ‘বিজলি আলো জ্বালবেন না বাবু। লোকে টের পাবে।’

একটু বিরক্ত হলেও অনিমেষ বলল, ‘ঠিক আছে।’

দরজা ভেজিয়ে লোকটি বিদায় হলে অনিমেষ বলল, ‘কেমন চোর চোর লাগছে নিজেকে। এভাবে মাথা নিচু করে থাকতে ভাল লাগে না।’

‘উপায় না-থাকলে কী করা যাবে। কত লোক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই শীতে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কথা ভাবো তো!’ মাধবীলতা গায়ের চাদর খুলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে চিন্তা করছিল। তারপর কী ভেবে সেটাকে একটা আলমারির মাথায় রেখে দিল।

‘ব্যবস্থা না-করে যারা আসে তাদের তো ভুগতেই হবে।’ অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে হ্যারিকেনের পলতেটা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখল সেটা কাজ করছে না। ঘরের মধ্যে কেমন একটা ভুতুড়ে আলো ম্যাড়ম্যাড় করছে।

মাধবীলতা বলল, ‘আমরা কি ব্যবস্থা করে এসেছিলাম?’

‘আমাদের সঙ্গে বাচ্চা নেই।’

‘নেই!’ বলে হেসে ফেলল মাধবীলতা।

অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলল, ‘ইয়ারকি হচ্ছে?’

‘ইয়ারকি কেন! তোমার মতো বৃদ্ধ রাশভারী মানুষের সঙ্গে ইয়ারকি মারতে পারি?’ মাধবীলতা খাটের ওপর গুছিয়ে বসল।

অনিমেষ বলল, ‘আমি বৃদ্ধ রাশভারী?’

‘তা নয় তো কী? ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা ছেলে সবসময় গোমড়া মুখ করে থাকবে? যেন পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা তার মাথায়। চমৎকার!’

‘কথাটা এই প্রথম কেউ আমাকে বলল।’

‘তোমার দুর্ভাগ্য।’

‘হঠাৎ এ-কথা মনে হচ্ছে কেন?’

‘হঠাৎ নয়। আজ অবধি আমাকে নিয়ে তুমি কোনও সিনেমা দেখতে যাওনি। এই বয়সে ছেলেরা সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন নিয়ে আলোচনা করে, সমরেশ বসুর ‘বিবর’ নিয়ে তর্ক করে, তুমি করো না। তোমার ব্যবহার একটু অ্যাবনরম্যাল না?’

কথাটা অনিমেষের মাথায় কখনও আসেনি। সে মাধবীলতার প্রতিবাদ করল না। হেসে বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

‘কিছু নয়। এগুলো করছ না বলে আমার অবশ্য বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই’ মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করল।

অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে মাধবীলতার মাথায় হাত রাখল, ‘আমার সঙ্গে ঝগড়া করছ কেন?’

‘ঝগড়া? কই না তো!’

‘তা হলে এত কড়া কথা শোনাচ্ছ যে! সবাই তো একরকম হতে পারে না।’

‘একরকম হওয়ার কথা আমি বলিনি।’

প্রায় অজান্তেই অনিমেষ মাধবীলতার মাথায় হাত দিয়েছিল। মাধবীলতার মুখ এখন গম্ভীর অথচ ছেলেমানুষির কতগুলো রেখা সে মুখে অদ্ভুত মায়ায় খেলা করছে। অনিমেষ খুব থীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। মাধবীলতা মুখ নামিয়ে অনিমেষের বাজুতে গাল রাখল। নরম এবং উষ্ণ চাপ অনিমেষকে বিহ্বল করে তুলছিল। সে মুখ ফিরিয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাতেই দেখল তার দু’গাল বেয়ে জলের ধারা নামছে। বিস্মিত অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কাঁদছ?’

মাথা নেড়ে না বলল মাধবীলতা কিন্তু চোখের জল মোছার কোনও চেষ্টা করল না। অনিমেষ কিছুক্ষণ ওইভাবে নীরবে বসে থেকে ধরা গলায় বলল, ‘লতা, এখনও সময় আছে। তুমি ভেবে দেখো।’

মাধবীলতার চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। সে মুখ সামান্য তুলে অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ বলল, ‘তুমি যাই বলো না কেন আমি তো ক্রমশ অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জানি না কোনওদিন আমাদের বিয়ে-থা করার সুযোগ আসবে কিনা। কলকাতা শহরে একটি যুবতী মেয়ের পক্ষে কোনও নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি ছাড়া অনন্তকাল অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।’

‘সেটা আমি বুঝব।’ মাধবীলতার গলার স্বর শক্ত।

‘না। আমাদের এই সমাজে একটা মেয়ে একলা বিপ্লব করতে পারে না।’

‘বললাম তো সমস্যা আমার। আমি তোমার বিপ্লবের ব্যাপারে যখন কথা বলছি না তখন তুমি আমাকে আমারটা ভাবতে দাও।’

‘কিন্তু?’

‘কীসের কিন্তু?’

‘আমার জন্যে একটা মেয়ে এভাবে অপেক্ষা করছে অথচ তাকে এক ফোঁটা সুখ দেবার ক্ষমতা আমার নেই!’

‘সুখের তুমি কী জানো?’

অনিমেষ বলতে যাচ্ছিল কিছু কিন্তু মাধবীলতা খুব দ্রুত তার মুখে হাত চাপা দিল, ‘কথা বোলো না। আমার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে কেউ নেই। সুখ তো সারাজীবন ধরে সমুদ্রের মতো দুলতে পারে না, এক বিন্দুতে মুক্তোর মতো স্থির হয়ে থাকে। আমার কাছে এই মুহূর্তটুকুর চেয়ে দামি আর কিছু নেই।’

অনিমেষ দু’হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরতেই মাধবীলতা মুখ উঁচু করে তাকে চুম্বন করল। মুহূর্তেই সব বাঁধ ভেঙে গেল অনিমেষের। এই মেয়ে যার মুখ হাজার পদ্মের চেয়ে সুন্দর, যার শরীর স্বপ্নের আলোয় উজ্জ্বল তাকে এমন করে কাছে পেয়ে তার সমস্ত বিবেকের দরজা হাট হয়ে খুলে গেল। প্রচণ্ড ঝড়ে উড়ে যাওয়া পাতার যেমন ব্যক্তিগত ক্ষমতা থাকে না তেমন ভাবে সে টালমাটাল হল। মাধবীলতার মতো মেয়ে যে কিনা প্রতিটি কথা ওজন দিয়ে বলে, অনাবশ্যক কৌতূহল দেখায় না, নিজেকে যন্ত্রণা দিয়েও মুখ খুলে কষ্টের কথা বলে না, সে অনিমেষকে আঁকড়ে ধরল লতার মতো আন্তরিকতায়। যেমন করে প্রথম বৃষ্টিপতনের সময় মাটি সোঁদা গন্ধ ছড়ায়, যেমন করে রোদ্দুরে পুজোর গন্ধ এলে কাশগাছ সাদা ফুলে মুড়ে যায় ঠিক তেমনি করে সে নিজেকে খুলে ধরল। ঝড়ের মতন সে সমস্ত কৃপণতা ছেড়ে অনিমেষকে গ্রহণ করল আকণ্ঠ এবং আশরীর।

ঝড় থেমে গেলে চারধার কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ভেঙে যাওয়া প্রকৃতির ছড়ানো ছিটানো চেহারায় এমন একটা রিক্ততা থাকে যা বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। মাধবীলতা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল। অনিমেষ সেদিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছিল না। উত্তেজনার মুখে যে বোধটির হদিশ থাকে না সেটি এখন তাকে আচ্ছন্ন করল। সে উঠে বসতেই মাধবীলতার হাত তাকে আঁকড়ে ধরল। অনিমেষ দেখল মাধবীলতার মুখ এখনও অন্যদিকে ফেরানো অথচ তার প্রতিটি নড়াচড়া সে টের পাচ্ছে।

‘উঠো না।’ মাধবীলতার গলার স্বর পালটে গেছে।

অনিমেষ আবার নিঃশব্দে ওর পাশে শুয়ে পড়ল। এতক্ষণ উন্মাদনায় যেগুলো টের পায়নি সেগুলো অনুভবে এল। মাধবীলতার শরীরের গন্ধ, স্পর্শ এবং পাশাপাশি থাকার এক আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তার মনে হচ্ছিল যে আজ তার জীবনের অন্যতম পাওয়ার দিনটিকে সে ব্যবহার করতে পারল না। এমন তাড়াহুড়ো করে কোনওরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া যৌবনের ব্যবহার সে কখনও চায়নি। অথচ বাস্তবে তাই হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ বাদে অনিমেষ কথা বলল। নিজের গলার স্বর এখন নিজের কাছেই অচেনা লাগছে, ‘তুমি রাগ করেছ?’

মাধবীলতা তখনও একই ভঙ্গিতে শুয়ে, বালিশ থেকে মুখ সরায়নি, শুধু তার একটা হাত অনিমেষের হাত আঁকড়ে আছে। প্রশ্নটা কানে যেতে ধীরে ধীরে হাত ছেড়ে দিয়ে চিত হল। তারপর খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন’?

কেন? অনিমেষ ধাক্কা খেল। এই কেন-র উত্তর সে কী করে দেবে? এখন উত্তর না-দেবার চেয়ে প্রশ্ন করার লজ্জায় সে চুপ করে রইল।

মাধবীলতা কিন্তু বিষয়টা থামাতে চাইল না, ‘উত্তর দিলে না যে!’

অনিমেষ বলল, ‘আমি এইভাবে চাইনি।’

মাধবীলতার ঠোঁট নড়ল, ‘ও’।

অনিমেষ খোলাখুলি বলল, ‘তোমার যোগ্য হয়ে, তোমার মর্যাদা দিয়ে তোমাকে গ্রহণ করার সঙ্গে আজকের এই ঘটনা মেলাতে পারছি না। বিশ্বাস করো, আমি এক মুহূর্তও চিন্তা করিনি এরকম কিছু ঘটতে পারে।’

মাধবীলতা তার দুই চোখ অনিমেষের মুখের ওপর রেখে বলল, ‘তুমি কি আমার যোগ্য নও? তুমি কি আমার অমর্যাদা করেছ? আমি ছাড়া অন্য কাউকে তুমি স্ত্রী বলে ভাবতে পারতে?’

‘না, কখনও না।’

‘তা হলে?’

‘কী তা হলে?’

‘নিজেকে এত অপরাধী ভাবছ কেন? তোমার মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনতে আমার খারাপ লাগছে।’

‘কিন্তু— ’ আশঙ্কার কথাটা বলতে গিয়ে অনিমেষ চুপ করে গেল। মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘তোমাকে বিব্রত করব না।’

অনিমেষ বলল, ‘আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।’

মাধবীলতা দু’হাতে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখল, ‘তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না। তুমি শুধু এমনি করে ভালবেসো।’

অনিমেষ এখন শান্ত। মনের মধ্যে যে কাঁটা ফুটেছিল তার দপদপানি না-কমলেও এই মুহূর্তে মাধবীলতার আলিঙ্গনে সে অনাস্বাদিত শান্তি পেল। নারী-পুরুষের আলিঙ্গনে কামবোধ ছাড়াও আর এক ধরনের আনন্দ আছে, তার অস্তিত্ব জেনে সে পূর্ণ হল।

দরজায় শব্দ হতে মাধবীলতা লাফ দিয়ে উঠে বসল। অনিমেষ দেখল সে দ্রুত বেশবাস চুল ঠিক করে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে দরজা খুলে দিচ্ছে। দারোয়ান খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকে ওদের দিকে একবার রসালো চোখে তাকিয়ে ওগুলো রেখে বেরিয়ে গেল।

মাধবীলতা দরজা ভেজিয়ে বলল, ‘এসো খেয়ে নেবে।’

অনিমেষের আলস্য লাগছিল, ‘একটু বাদে।’

‘উঁহু, তোমার দেরি হয়ে যাবে। অনেক রাত হয়েছে।’

কথাটা মনে করিয়ে দিতেই অনিমেষ তড়াক করে খাট থেকে নামল। নেমে ঘড়ি দেখল। সত্যি প্রায় সময় হয়ে গেছে। এখান থেকে গোয়ালপাড়া যেতে হলে কত সময় লাগবে তার জানা নেই। শুনেছে কো-অপারেটিভ অফিসের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা শান্তিনিকেতনের উলটোদিকে চলে গেছে সেটি দিয়ে মাইলখানেক যেতে হবে।

সে দেখল মাধবীলতা তার সামনে খাবারের থালা দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি খাবে না?’

‘এখন ভাল লাগছে না। পরে খেয়ে নেব।’

‘কী আশ্চর্য। নাও, খেয়ে নাও।’

‘না গো। তুমি খাও।’

‘কী ব্যাপার?’

‘বলছি তো পরে খাব। তুমি আর দেরি কোরো না।’

অনিমেষ আর কথা বাড়াল না। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বলল, ‘লোকটাকে বলে যাচ্ছি কাল ভোরে বাসনপত্র নিয়ে যাবে। আর সেইসময় টাকা দিয়ে দেব। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি শিগগিরই ফিরে আসছি।’

‘ঠিক আছে।’ অনিমেষকে এগিয়ে দিতে দরজায় দাঁড়াল মাধবীলতা।

অনিমেষের খুব খারাপ লাগছিল মাধবীলতাকে এভাবে একা ফেলে যেতে। অন্তত একটু আগের ঘটনার পরে তার চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু নিজেকে শক্ত করল সে। দরজা খুলে একবার পেছনে তাকাতেই মাধবীলতা মুখ তুলে হাসল, ‘এসো, আমি তোমার জন্যে জেগে থাকব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *