২৫. তিস্তার ওপর সুন্দর ব্রীজ

পঁচিশ

তিস্তার ওপর সুন্দর ব্রিজ তৈরি হয়ে যাওয়ায় জলপাইগুড়ি থেকে স্বর্গছেঁড়া মাত্র এক ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। আগের আসাম রোড এখন নাম পালটে ন্যাশনাল হাইওয়ে হয়েছে। বাষট্টি সালের পর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্যই রাস্তাগুলো চওড়া এবং ঝকঝকে চেহারা নিয়ে সীমান্ত অবধি চলে গেছে। স্কুলে পড়তে অনিমেষ দেখেছিল বসার জায়গা না-থাকলে কেউ বাসে উঠত না। আর এবার দেখল ছাদেও লোক বসেছে। শহরের মধ্যে উঠেছিল বলে সে কোনওক্রমে জায়গা পেয়েছিল বসার, এখন মানুষের চাপে নিশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। কিন্তু গাড়িটা ছুটছে খুব দ্রুত, এখানেই কলকাতা থেকে ফারাক।

ডুয়ার্সে লোক বাড়ছে। মদেশিয়া, নেপালি বা রাজবংশী নয় ভাষা থেকেই বোঝা যায়। পূর্ববাংলার মানুষেরা এখানে স্থায়ী বসতি করেছেন। ক্রমশ সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের কথাবার্তা আচারেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় আসবে যখন উত্তরবাংলার সংকরসংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যার সঙ্গে পূর্ব বা পশ্চিমবাংলার কোনও মিল থাকবে না।

জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু জলপাইগুড়ি শহর, তিস্তার ব্রিজ ছাড়ালেই দু’ধারে ফাঁকা মাঠ আর জঙ্গল। ক্বচিৎ কখনও খড়ের চালের ঘর বা দূরে ছোট গ্রামের ইশারা, ময়নাগুড়ি ধুপগুড়ির আধাশহর এলাকাটুকু ছাড়ালে এই দৃশ্য পালটাবে না। আর ধুপগুড়ির পরই কেমন একটা পাহাড়ি গন্ধ নাকে আসে। গাছপালার চেহারা পালটে যায়। ডুডুয়া নদী ছাড়ালেই দু’পাশে জঙ্গল ঘন হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। মাঝখানের চওড়া হাইওয়ে দিয়ে বাস যখন ছোটে তখন ঝিঁঝির শব্দ কানে আসে। দেখতে দেখতে অনিমেষের মনে হচ্ছিল, এই জায়গাগুলোর অদ্ভুত একটা নির্জন চেহারা আছে কিন্তু খুব শিগগির মানুষ তা নষ্ট করবে। যেভাবে ডুয়ার্সে জনসংখ্যা বাড়ছে এরা আর নির্জন থাকবে বলে মনে হয় না। নিজের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ অত্যন্ত নির্মম হতে পারে। যদি জানা যেত গোলাপের কুঁড়ি সুখাদ্য তা হলে আমরা কখনওই একটা ফুটন্ত গোলাপকে দেখতে পেতাম না।

এই মাঠ জঙ্গল ঝরনাগুলো চিরকাল একই রকম চেহারা নিয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর এতগুলো সরকার এল গেল কিন্তু এই জায়গাগুলোকে দেশের জন্য ব্যবহার করার কথা কারও খেয়ালই হল না। ফলে এখানকার বিভিন্ন গাঁয়ে ছড়িয়ে থাকা গরিব রাজবংশীদের জীবন সেই অন্ধকূপে আটকে আছে। সে যেমন গতকাল ভোট ভিক্ষে করতে গিয়েছিল, এদের কাছেও ভোটের বাবুরা পাঁচ বছরে একবার আসে, স্বপ্ন দেখায়, তারপর কাজ মিটিয়ে চলে যায়। কলকাতার আশেপাশের গ্রামগঞ্জ পশ্চিমবাংলাকে যা দিতে পারে ডুয়ার্সের এই অবহেলিত জায়গাগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সরকার যেমন এ ব্যাপারে উদাসীন তেমনই এখানকার মানুষরাও দেশ এবং নিজেদের সম্পর্কে নিস্পৃহ। কিন্তু একটা সময় আসবেই যখন এই নিঃস্ব মানুষগুলো জ্বলে উঠবে, তখনই অবস্থা পালটাতে পারে।

আংরাভাসা নদী পেরিয়ে এসে রাস্তাটা বাঁক নিতেই বুকের ভেতরটা আচমকা হালকা হয়ে গেল। খুব শান্ত একটা আরামবোধ তিরতির করে সমস্ত শরীরে জুড়ে বসল। অনিমেষ বাঁ দিকের দিগন্ত-ছোঁয়া চায়ের গাছগুলোর দিকে তাকাল। এখন বিকেল। শেষ আলোর রঙে এক ধরনের মায়া জড়ানো থাকে। দূরের খুঁটিমারি জঙ্গলের মাথায় নেমে আসা সূর্যের দিকে তাকালে সেই মায়াটাকেও যেন স্পর্শ করা যায়। স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানের ফ্যাক্টরির ছাদ চায়ের গাছের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই আলো মেখে। রাস্তায় এখন ঘরে-ফেরা কুলিকামিনের ভিড়। অনিমেষ ভিড় বাঁচিয়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল।

বুকের অ্যালবাম থেকে উঠে আসা ছবির মতো কোয়ার্টারগুলো দাঁড়িয়ে, কোথাও সামান্য পরিবর্তন হয়নি। এই বিকেলে মনে হচ্ছে কেমন একটা ঝিমুনি চারধারে। সামনের ফাঁকা মাঠে চাঁপা ফুলের গাছ দুটো প্রায় নিষ্পত্র হয়ে দাঁড়িয়ে। এখন কি আর ছেলেমেয়েরা ওই মাঠে খেলে না? রাস্তা থেকে নামতেই ওদের বাড়ির সামনে যে পাতাবাহারের গাছগুলো গার্ড অফ অনার দেবার মতো দাঁড়িয়ে থাকত তারা অনেককাল আগেই উধাও। এখন কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে চারধার।

বারান্দায় উঠে বন্ধ দরজা দেখে সে মত পালটাল। একটু ঘুরে বাগানের টিনের দরজা খুলে ভেতরের উঠোনে ঢুকল। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এদিকের লিচুগাছগুলো বেশ ঝাঁকড়া হয়ে গেছে। উঠোন পরিষ্কার, তুলসীতলাটা নিকানো। কয়েক পা এগোতেই অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। সেই বুড়ো কাঁঠালগাছটা নেই। ঝাড়ি কাকুর মুখে শোনা অদেখা ঠাকুমাদের স্মৃতিজড়ানো ওই রসালো ফলের গাছটাকে না-দেখে বুকের ভেতর কেমন হুহু করে উঠল। তার নিজের শৈশবে ওই গাছ যেন স্বপ্নের মতো ছিল। মাটির তলায় কাঁঠাল পাকত যখন তখন সেটাকে খুঁড়ে বের করতে কী মজাই লাগত! গাছটা যেন তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলত। অনিমেষের মনে হল, এই বাড়ি থেকে তার ভাললাগার স্মৃতিগুলো একটা একটা করে এইভাবে সরে যাবে। মন খারাপ হয়ে গেল ওর।

উঠোন ধরে একটু এগোতেই রান্নাঘর চোখে পড়ল। দরজা খোলা। একটা বাচ্চা মদেশিয়া ছেলে পা ছড়িয়ে বসে কাঠ টুকরো করছে। একে আগে কখনও দেখেনি অনিমেষ। তাকে দেখতে পেয়ে ছেলেটি বিস্মিত হয়ে গলা তুলল, ‘মাইজি’!

ছোটমার গলা ভেসে এল, ‘কী রে!’

ছেলেটা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে অনিমেষের দিকে। বোধহয় কী বলবে ঠিক করতে পারছে না। অনিমেষ তাকে সুযোগ দিল না, কণ্ঠস্বর ভারী করে বলল, ‘একটু বাইরে আসুন।’

কয়েক মিনিট নীরবে চলে গেল। তারপরে রান্নাঘরের দরজার আড়ালে ছোটমায়ের শরীরের অর্ধেকটা দেখা গেল। মাথায় ঘোমটা টেনে দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে, গলা থেকে স্বরটা বেরিয়ে পড়েছিল, ‘কে’?

অনিমেষ হাসতেই মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ছোটমা, ‘ওমা তুমি! কী আশ্চর্য! কোত্থেকে এলে? গলা শুনে আমি একদম চিনতেই পারিনি। ওরকম করে কথা বলতে হয়! আমি ভাবলাম কে এমন হুট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল!’ একটানা কথাগুলো বলে গেল ছোটমা। অনিমেষ ছোটমাকে দেখছিল। একটা মানুষের চেহারা এত দ্রুত পালটে যেতে পারে! গোলগাল মুখ, শরীর বেশ ভারী, মাথার সামনের দিকের চুল একটু হালকা, দস্তুরমতো গিন্নিগিন্নি ভাব এখন। সেই রোগাটে অল্পবয়সি শরীরটা একদম হারিয়ে গেছে।

ছোটমা ওর দেখার ধরনে একটু নড়েচড়ে বলল, ‘কী দেখছ অমন করে?’

‘মা কী ছিলেন কী হয়েছেন।’ অনিমেষ হাসল।

‘এই, মায়ের সঙ্গে ইয়ারকি?’ তারপরই গলা পালটে বলল, ‘খুব মোটা হয়ে গেছি, না? বিশ্রী দেখাচ্ছে?’

‘উঁহু, এতদিনে তোমাকে মা মা দেখাচ্ছে।’ কথাটা বলার সময়েই অনিমেষের খেয়াল হল ছোটমার কোনও ছেলেপুলে হয়নি।

‘যাক, বাঁচা গেল। তা হলে এখন একটু মান্যিগন্যি করবে। কিন্তু নিজের চেহারাটা কি আয়নায় দেখা হয়? কী ছিরি হয়েছে!’

‘কেন? খুব খারাপ দেখতে লাগছে?’

‘রোগা, মাথায় বাবুই পাখির বাসা, মুখে একরাশ জঙ্গল। খেতে পাও না নাকি? এই চেহারা নিয়ে তুমি দেশের কাজ করবে?’

‘দেশের কাজ?’ অনিমেষ চমকে উঠল, ‘এ খবর তোমাকে কে দিল?’

ছোটমা বলল, ‘বলছি, আগে বারান্দায় উঠে আরাম করে বসো, হাত মুখ ধোও। তোমার বাবা বলল এবার আসবে না তুমি, কিন্তু আমার মন বলছিল ঠিক আসবে। দেখো কেমন মিলে গেল। আঃ, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’

হাতমুখ ধোওয়ার পর ভেতরের বারান্দায় বসে মুড়ি-মুড়কি দিয়ে চা খেতে খেতে অনিমেষ ছোটমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনল। তার কাজকর্মের কথা এখানে পৌঁছে গেছে। এমনকী অ্যারেস্টেড হয়ে থানায় যাবার গল্পও। নীলার বাবাই জানিয়েছেন এখানে। সে-চিঠি পাবার পর থেকে মহীতোষ নাকি খুব গম্ভীর হয়ে গেছেন। ছোটমা বলল, ‘আমার সঙ্গে তো কোনওদিন মন খুলে কথা বলেন না কিন্তু তোমার জন্য উনি খুব ভেঙে পড়েছেন এটা বুঝতে পারছি। তোমার কি পড়াশুনা করার ইচ্ছে নেই?’ অনিমেষ তখন অন্য চিন্তা করছিল। দেবব্রতবাবুর সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই অনেককাল। সে নিজে নীলাদের বাড়িতে যায় না আর উনিও ওর খোঁজখবর নিতে আসেন না। তা হলে এত খবর কোত্থেকে পেলেন উনি। নীলা এখন ইউনিভার্সিটিতে আসা ছেড়ে দিয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষায় বসার আগে না-এলেও চলবে তার। ওদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই অনিমেষের। তা হলে? নিজের অজান্তেই দেবব্রতবাবুদের ওপর রেগে গেল অনিমেষ।

ছোটমা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি পড়াশুনা করবে না?’

অনিমেষ বলল, ‘এম-এ পরীক্ষা দেব, তোমাদের কোনও চিন্তা নেই।’

ছোটমা মাথা নাড়ল, ‘তা হলে তোমার বাবা এত ভাবছে কেন? এম এ পাশ করলেই তো তুমি বড় চাকরি পেয়ে যাবে, তাই না?’

‘নাও পেতে পারি।’

‘কেন?’

‘এ-দেশে এম এ পাশের চেয়ে চাকরির সংখ্যা কম, তাই।’

‘আমি এতসব বুঝি না।’

‘তোমাকে বুঝতে কে বলেছে। তারপর বলো, তোমরা সব কেমন আছ?’ প্রশ্নটা করামাত্র ছোটমায়ের মুখের আলো নিভে গেল। খুব বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি জলপাইগুড়ি হয়ে আসছ?’

‘কেন?’

‘তোমার দাদুর—।’ ছোটমা ইতস্তত করল একটু ‘খুব খারাপ অসুখ হয়েছে। কারও সঙ্গে মিশছেন না। দিদি লোকজনকে ধরে বাজার করায়। তোমার বাবা রবিবার রবিরারে দেখা করতে যান। তোমার দাদু ওনার সঙ্গেও কথা বলেন না। খুব মন ভেঙে গেছে তোমার বাবার। ভেবেছিলেন তোমাকে চিঠিতে জানাবেন, তারপর—।’

ঠিক এইসময় বাইরের দরজায় শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটমা উঠে দাঁড়ালেন, ‘উনি এসে গেছেন। শোনো, উনি বকাবকি করলে চুপ করে থেকো, মানুষটা খুব অশান্তিতে আছে।’ দ্বিতীয়বার শব্দটা হতেই ছোটমা দ্রুত ছুটে গেলেন। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। মহীতোষের সঙ্গে এবার মুখোমুখি হতে হবে কিন্তু কোনওরকম আড়ষ্টতা বোধ করছে না সে।

ঘরের ভেতরে জুতোর শব্দ এবং ছোটমায়ের চাপা গলা শুনতে পেল অনিমেষ। মহীতোষের গলা শোনা যাচ্ছে না। মিনিট কয়েক পরে মহীতোষ খালি পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই অনিমেষ কাছাকাছি হল। ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে মহীতোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন এলি?’

‘মিনিট কুড়ি হবে।’

‘এখন তো ট্রেন ছিল না, জলপাইগুড়ি হয়ে এলি?’

‘হুঁ।’

‘শুনেছিস?’

‘হুঁ।’

‘আমি গেলে আমার সঙ্গেও দেখা করেন না। একমাত্র বড়দি ছাড়া কথা বলার কেউ নেই। প্রথমে চিকিৎসা নিজেই করাতে গিয়েছিলেন, এখন তাও ছেড়ে দিয়েছেন। আমি কী করব বুঝতে পারি না। চোখের সামনে আত্মহত্যা করছেন উনি, আমি পাগল হয়ে যাব।’ মহীতোষ একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন। অনিমেষ দু’হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোটমা ভাঁড়ার ঘরে বসে লন্ঠন জ্বালছেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেল। স্বর্গছেঁড়ায় সন্ধে নেমে গেছে। পাতলা তুলোর মতো আঁধারে বসে থাকা মহীতোষের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছের মতো লাগছে ওঁকে। ভাবভঙ্গিতে সেই তেজ একদম নেই। কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে বসে আছেন মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে। ছোটমায়ের আশঙ্কা মতো দেবব্রতবাবুর চিঠি পেয়ে অনিমেষের ওপর ক্ষিপ্ত হবার কোনও প্রকাশ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বাবাকে এমন করে ভেঙে পড়তে দেখে অনিমেষের খারাপ লাগছিল। মহীতোষ এর মধ্যে বেশ রোগা হয়ে গেছেন, মাথার চুল প্রায় সাদা।

‘দেখা করেননি নিশ্চয়।’

মহীতোষের বলার ধরনে প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি অনিমেষ, ‘কে’?

‘তোর দাদুর কথা বলছি।’

‘ও। হ্যাঁ, হয়েছিল।’ অনিমেষ কথাটা বলতেই মহীতোষ ঘুরে ছেলের দিকে তাকালেন। অনিমেষ টের পেল ছোটমাও সঙ্গে সঙ্গে লন্ঠনটা হাতে নিয়ে ভাঁড়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। অনিমেষ একপলক চিন্তা করল সত্যি কথাটা বলবে কি না। দাদু যে আড়াল করে নিজেকে রেখেছেন সেটার কোনও যুক্তি নেই। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের নিজের মতন করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। দাদু যদি ওভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে শান্তি পান—। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হল ওভাবে কি শান্তি পাওয়া যায়? এও কি একরকম আত্মহত্যা নয়? দাদু অবশ্য তাকে নিষেধ করেছেন কারও কাছে ফাঁস করতে কিন্তু সেটা মান্য করার অর্থ হল দাদুকে আত্মহননে সাহায্য করা। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হল বাবা যেভাবে ভেঙে পড়েছেন তাঁকে সাহায্য করা অবশ্যই কর্তব্য।

মহীতোষ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তাঁর মুখের ওপর ছোটমার হাতে ধরা লন্ঠনের আলো কাঁপছে। অনিমেষ খুব ধীরে ধীরে বলল, ‘দাদু খুব কষ্টে আছেন।’

‘শরীর কেমন দেখলি? লেপ্রসির চিহ্ন—।’ কথাটা শেষ করে উঠতে পারলেন না মহীতোষ। ওঁর গলায় কান্না এসে গেছে বুঝতে পারল অনিমেষ।

কয়েক পা এগিয়ে বাবার মুখোমুখি আর-একটা মোড়ায় বসল অনিমেষ। তারপর বলল, ‘দাদুর কষ্ট আপাতত অর্থের। তুমি যা দাও তাতে কুলোয় না। জ্যাঠামশাই, ছোট পিসিমা তো আছেনই, আমরাও বোধহয় ওঁকে শান্তিতে থাকতে দিতে পারিনি।’

‘জানি না। আমি তো ছেলে হিসেবে কখনও কর্তব্যে ত্রুটি করিনি। তোকে টাকা পাঠিয়ে সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব ওঁকে দিই। কিন্তু প্রয়োজন হলে আমার কাছে চাননি কেন? মুখেটুখে ঘা দেখলি?’

‘না। কারণ ওঁর লেপ্রসি হয়নি।’

অনিমেষের কথা শেষ হতেই মহীতোষ একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন। ছেলের কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। দুটো চোখ বড় হয়ে গেছে, মুখ হাঁ। ছোটমা লন্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কী বলছ?’

এবার অনিমেষ সমস্ত কথা খুলে বলল। দাদুর বাড়িতে যাওয়ার পর যা যা হয়েছিল সব। ভেবেছিল এসব শুনলে ছোটমা এবং বাবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন। কিন্তু তার বদলে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার ঘটল। মহীতোষ শিশুর মতো কাঁদতে আরম্ভ করলেন। দু’হাতে মুখ ঢেকে তাঁর ফোঁপানি সামলাতে পারছিলেন না। ছোটমা আস্তে আস্তে বারান্দা থেকে নেমে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে মহীতোষ শান্ত হলেন। কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারছিল এখনও কথা বলার মতো মনের অবস্থা তাঁর হয়নি। ব্যাপারটা ঘোরাতেই সে বলল, ‘দেবব্রতবাবুর চিঠি পেয়েছ?’

‘কার?’ অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করলেন মহীতোষ।’

‘দেবব্রতবাবুর।’

‘ও হ্যাঁ।’

কিন্তু তারপর আর কোনও কথা নেই। অনিমেষ ভেবেছিল একথা মনে পড়লেই মহীতোষ ওর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, কিন্তু এমন নিরুত্তাপ আচরণের কোনও কারণ খুঁজে পেল না সে। দু’জনে চুপচাপ বসে আছে, কথা খুঁজে পাচ্ছে না অনিমেষ, অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎ মহীতোষ বললেন, ‘ওঁর মেয়ের সঙ্গে তোর দেখা হয়?’

‘বেশ কিছুদিন দেখা হয়নি, কেন?’

‘তুই ওঁদের বাড়ি যাস না?’

‘সময় পাই না—।’

‘মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এমন একটি ছেলেকে বিয়ে করেছে যে মোটেই ওর যোগ্য নয়। দেবব্রতবাবুর সঙ্গে এ নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছে ওর, তিনি মেয়ের মুখ দর্শন করবেন না বলে জানিয়েছেন।’

‘নীলা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে?’ অনিমেষ যেন আকাশ থেকে পড়ল। নীলার মতো প্র্যাকটিক্যাল মেয়ে এমন কাজ করল! তা হলে কি নীলা মোটেই প্র্যাকটিক্যাল ছিল না, ভান করত! কয়েকদিন আগে শচীন ওর সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল, তা কি এই ব্যাপারটাই। কাকে বিয়ে করল নীলা? অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল।

মহীতোষ নিজের মনেই বললেন, ‘ছেলেমেয়েদের ওপর যদি ভরসা না-রাখতে পারি তা হলে বেঁচে থাকব কী জন্য? দেবব্রতবাবু মেয়েটাকে মনের মতো করে গড়তে চেয়েছিলেন যাতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে কিন্তু তার বদলে কী পেলেন? সাবালক হলে প্রত্যেকের নিজের মতো চলার স্বাধীনতা আছে কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখা উচিত, যারা তাকে ঘিরে এতদিন স্বপ্ন দেখে এল, তাদের প্রতি একটা দায়িত্বও রয়েছে। তোর জ্যাঠামশাই বা কাকা সেটা মনে রাখেনি কিন্তু আমার পক্ষে তো এড়ানো সম্ভব হয়নি।’

অনিমেষ বুঝতে পারছিল এসব কথা তাকে উদ্দেশ করেই বলা। কোনও কারণে মহীতোষ তাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারছেন না। কারণটা কী সেটা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দিচ্ছেন উনি। নীলার ব্যাপারটায় এতখানি অবাক হয়ে গিয়েছিল অনিমেষ যে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না। চুপচাপ সে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। এর মধ্যে একসময় মহীতোষ উঠে বাথরুমে গেছেন। অন্ধকারে চোখ রেখে অনিমেষ বুঝতে পারল একটা বয়স হলে খুব নিকট সম্পর্কগুলোর মধ্যে ছোট বড় দেওয়াল তৈরি হয়ে যায়। তখন পরস্পরকে স্পর্শ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। দাদু পিসিমা যে বিচ্ছিন্ন জগতে বাস করছেন তার সঙ্গে বাবা এবং ছোটমায়ের খুব একটা ফারাক এখন নেই। আর এবার আরও সত্য হল, তার সঙ্গে ওঁদের ব্যবধানটা অনেক বেড়ে গেছে। হয়তো বাবা কিংবা দাদু ঠিক একই জায়গায় রয়ে গেছেন কিন্তু সে নিজে এমন দূরত্বে চলে গেছে যে ব্যবধান কমানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু এজন্য কোনওরকম দুঃখবোধ তার হচ্ছিল না। আবার নিষ্কৃতি পাওয়ার আনন্দ টের পাচ্ছিল না মোটেই।

রুটিনমতো মহীতোষ তাসের আসরে চলে গেলে অনিমেষ ভেবেছিল ছোটমায়ের সঙ্গে বসে গল্প করবে। কিন্তু এই ছোটমাকে দেখার পর থেকেই সেই কৈশোরের ছেলেমানুষ মেয়েটিকে সে খুঁজে পাচ্ছিল না। এখন এই মহিলা অনেক গিন্নিবান্নি ধরনের, স্নেহপ্রবণা এবং বাবার সঙ্গে মোটামুটি ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সুন্দর কিন্তু অনিমেষ ওঁর সঙ্গে আড্ডা মারার মেজাজটাকে খুঁজে পেল না। রাত বেশি হয়নি দেখে সে বাড়ি ছেড়ে স্বর্গছেঁড়া ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল।

মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় আসতেই অনিমেষ টর্চের আলোগুলো দেখতে পেল। রাস্তার দু’ধারে ঝাঁকড়া লম্বা গাছগুলোর গায়ে নীচ থেকে আলো ফেলা হচ্ছে যাতে বাদুড় শিকার করা যায়। মদেশিয়া ছেলেদের এই কর্মটি সে ছেলেবেলাতেও দেখেছে এবং এখনও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনিমেষের মনে হল পশ্চিমবঙ্গের এখানে ওখানে বিপ্লবের যত কথাই হোক, কমিউনিজমের বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং প্রচার যাই চলুক না কেন, সাধারণ মানুষের ভঙ্গুর এবং অন্ধ আর্থিকদীনতাপ্রসূত আদিম জীবন একটুও পালটায়নি। মাঝে মাঝে হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির আলোয় ছেলেগুলোকে দেখতে পাচ্ছিল সে। হাতে গুলতি নিয়ে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে রয়েছে।

এদিকে বিদ্যুৎ নেই কিন্তু ও পাশের স্বর্গছেঁড়া আলোয় ঝলমলে। চা-বাগানের কোয়ার্টার ছাড়িয়ে সে বাজার এলাকায় ঢুকল। চমকে যাওয়ার মতো পরিবর্তন হয়েছে জায়গাটার। ঝকঝকে দোকানপাট, মাইকে চাপা স্বরে গান বাজছে। এতরকমের দোকান স্বর্গছেঁড়ায় কখনও ভাবা যায়নি। হাঁটতে হাঁটতে চৌমাথায় চলে এল অনিমেষ। চারধার দিনের মতো পরিষ্কার। স্বর্গছেঁড়া তার সেই রহস্যময় চেহারাটা হারিয়ে ফেলেছে। এখন একটা ছোট শহরের থেকে এর কোনও প্রভেদ নেই। ব্যাপারটা ভাল কিংবা মন্দ সেটা পরের কথা কিন্তু ব্যক্তি-চেহারা হারিয়ে গিয়ে যখন দলের মধ্যে কিছু ঢুকে পড়ে তখন এক ধরনের নিঃস্বতা বোধ হয়।

পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ করতে ইচ্ছে করছিল। ওরা কি আর রাস্তাঘাটে আড্ডা মারে না? এখনও তো রাত তেমন বেশি হয়নি। কয়েক পা এগোতেই থমকে গেল সে। তাদের পার্টির অফিস হয়েছে স্বর্গছেঁড়ায়। ওপরে পতাকা টাঙানো রয়েছে। অফিসঘরের সামনে রাস্তার ওপর কয়েকজন অচেনা মানুষ গুলতানি করছে। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল, সে কাউকে না-জানিয়ে নির্বাচনী প্রচারকর্ম ছেড়ে চলে এসেছে। এইজন্য তাকে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত দিতে হবে। বলা যায় না পার্টিবিরোধী কাজের জন্য তাকে বহিষ্কার করাও হতে পারে। বহিষ্কার কথাটা মনে হতেই সুবাসদার কথা মনে এল। সে তো ভেতরে ঢোকার অনুমতিই পায়নি তাই বহিষ্কার হবার যোগ্যতাও নেই তার। শুধু দলের হয়ে কাজকর্ম করতে তাকে আর দেওয়া হবে না। একদম না-বলেকয়ে চলে আসাটা অন্যায় হয়েছে। নিয়মশৃঙ্খলা অবশ্যই মেনে চলা উচিত। এই কারণে শাস্তি পাওয়া সংগত। কিন্তু গতকাল রাত্রে মনে হয়েছিল এই নির্বাচনী প্রচার ব্যাপারটা পুরোটাই ভাঁওতা। কমিউনিজমে যারা বিশ্বাস করে তারা কেন জনসাধারণের কাছে ভোট ভিক্ষে করবে? প্রসববেদনার কথা কোনও মেয়েকে কি স্মরণ করিয়ে দিতে হয়? কমিউনিস্টরা যদি তাদের আচরণ এবং কাজকর্মে ওই মতবাদকে জনসাধারণের সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারে তা হলে নির্বাচনের সময় প্রতিপক্ষ যতই প্রচার করুক না কেন মানুষ নিজের প্রয়োজনেই কমিউনিস্টদের ভোট দিতে আসবে। তা সম্ভব হচ্ছে না কারণ এ-দেশের কমিউনিস্টরা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি।

পার্টি অফিসের সামনে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেরই নজর পড়েছিল। এমন সময় ভেতর থেকে নিজের নাম ভেসে আসতে শুনল অনিমেষ। আর তার পরেই বিশুকে দেখতে পেল দরজায়। চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গেছে বিশুর। পাজামা, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরায় মনে হচ্ছে একটা হ্যাঙারে সেগুলোকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। অনিমেষ এগিয়ে গেলে বিশু জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে এলি?’

‘আজই।’

‘আয়, ভেতরে আয়।’

ছোট ঘর, শতরঞ্জিও পাতা। একদিকে কিছু পোস্টার স্তূপ করে রাখা। দু’-তিনজন লোক একটা লিস্ট নিয়ে কাজ করছে। দেওয়ালে লেনিনের ছবি।

অনিমেষ বলল, ‘এখানে পার্টির অফিস হয়েছে জানতাম না তো।’

বিশু বলল, ‘কী জানিস তোরা। শহরে থেকে গ্রামের খবর রাখিস?’

ওদের ঘিরে আরও কয়েকজন এসে বসল। অনিমেষ বিশুর কথাটা গায়ে মাখল না। হেসে বলল, ‘তুই পার্টি করছিস জানতাম না তো।’

বিশু বলল, ‘আবার বলতে পারতাম কী জানিস তোরা-!’ বলে হাসল, ‘কিছু হল না, না পড়াশুনা না চাকরি, পার্টির কাজ করছি। একটা নিয়ে তো থাকতে হবে। তবে এটা করার জন্য একটা উপকার হয়েছে। সুনীল পালের স-মিলে সামনের মাস থেকে জয়েন করব।’

সুনীল পাল এ তল্লাটের একজন বিখ্যাত কাঠের ব্যবসায়ী। কিন্তু পার্টি করলে তিনি কেন চাকরি দেবেন সেটা বুঝতে পারল না অনিমেষ। বুঝিয়ে দিল বিশু, ‘ওদের মিলে মারাত্মক ধরনের শ্রমবিরোধ হয়েছিল। শিবুদা, আমাদের লোকাল কমিটির সেক্রেটারি, মিটিয়ে দেন। আজই এই প্রতিশ্রুতিটা পাওয়া যায়।’

অনিমেষ বলল, ‘কিন্তু এটা তো প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘুষ।’

বিশু বলল, ‘প্রতিক্রিয়াশীল? বড়লোক হলেই প্রতিক্রিয়াশীল হবে! কী চিন্তা সব! তা ছাড়া আমরা সমাজের চারধারে ছড়িয়ে পড়তে চাই। সেজন্য কিছু কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই হবে। শুনেছি বিড়লা টাটাদের পি আর ও যারা তারা এককালের পাকা কমিউনিস্ট।’

অনিমেষ নিচু গলায় বলল, ‘তা হলে তোমরা নিজেদের প্রয়োজনে পার্টি করছ!’

‘কে করছে না? সবাই করছে। আমরা পাঁক তুলব আর নেতারা চাটনি খাবে? এদেশের মানুষ কখনওই কমিউনিস্ট হবে না। তারা যেই নিজের স্বার্থে ঘা পড়বে তখনই কমিউনিজমকে বাতিল করবে। এইরকম ঠুকঠাক করতে করতে যতটুকু এগোনো যায় ততটুকুই ভাল।’

বেনোজল চারধারে। অনিমেষ উঠে পড়তে চাইল। বিশু এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে রাজি নয় তাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে বাপির কথা জিজ্ঞাসা করল অনিমেষ। বিশু বলল, ‘বাপি এখন বিগ বিজনেসম্যান। দশটা ট্যাক্সি, গোটা চারেক লরি। দু’নম্বর করে লাল হয়ে গেছে। শালা এখন কংগ্রেসকে ব্যাক করে। আমরা চাইলেও পয়সাকড়ি দেয়। তুই কি কলকাতা থেকে এলি না জলপাইগুড়ি হয়ে-?’

‘আমি দাসপাড়ায় এসেছিলাম ইলেকশনের কাজে।’

‘ইলেকশন?’

‘তোদের পার্টির হয়ে প্রচারের জন্য।’

‘গুরু, তুমি আমাদের লোক। শালা এতক্ষণ নকশা করছিলে?’ দু’হাতে জড়িয়ে ধরল সে অনিমেষকে, ‘তবে ওখানে কংগ্রেসকে হারানো মুশকিল। কেমন বুঝলি?’ খুব অন্তরঙ্গ গলায় বলল বিশু।

‘আমি না-বলেকয়ে চলে এসেছি।’

‘সে কী, কেন?’

‘আমার মনে হয়েছে পার্টি যা করছে তার কোনও ভিত্তি নেই।’

‘সবকিছুর মানে থাকে নাকি? আমরা যদি ক্ষমতা পাই কোনওদিন তা হলে সুদে আসলে পুষিয়ে যাবে।’

‘তাতে দেশের কী হবে?’

‘একটু একটু করে পালটাবে। এই রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোয় এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাই অন্যায়। তুই চলে এসে ঠিক করিসনি। আখেরে নিজেরই ক্ষতি করলি।’ বিশু গম্ভীর হয়ে গেল।

সে-রাতে বাড়ি ফেরার পথে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে এবং কিছুদিন পরে কলকাতামুখী ট্রেনের কামরায় বসে অনিমেষ একটা সিদ্ধান্ত নিল। আমরা যতই নানান ডিজাইনের বস্ত্র শরীরে চাপাই না কেন তাতে শরীরের কোনও হেরফের ঘটে না। পোশাকের চমকে ও ঔজ্জ্বল্যে চোখে সুখ লাগে হয়তো কিন্তু যতক্ষণ না শরীরটাকে সুস্থ করা যায় ততক্ষণ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শুধু পোশাকের কথাই ভেবে যাচ্ছে। কিন্তু অন্য কিছু করার পথ কোথায়? কলকাতায় ফিরে গিয়ে পার্টির নেতাদের খোলাখুলি কথাগুলো বললে কেমন হয়! পরক্ষণেই মনে হল তারও কি দু’পা এগোনো এক পা পিছিয়ে যাওয়া নীতি অনুসরণ করা উচিত নয়? এখন চুপচাপ দেখে যাওয়া দরকার। সে যেমন পার্টির এই পথ মেনে নিতে পারছে না তেমনি ওর মতো অনেকেই সে-কথা ভাবতে পারে। তাই সময় এলে পথ পরিষ্কার হতে বাধ্য। ফোড়া পেকে গেলে পুঁজ না-বেরিয়ে থাকতে পারে? অতএব এখন অপেক্ষা করা দরকার। এইসময় সে পরীক্ষাটা দিয়ে দিতে পারে। মহীতোষ তাঁকে একটুও গালমন্দ করেননি। এ-থেকেই বোঝা যায় তাকে পেছনে জড়িয়ে রাখার মতো কেউ নেই। এই দেশে এম এ পাশ করা নিতান্তই অর্থহীন, তবু কাউকে খুশি করার জন্য আমাদের তো প্রতিনিয়ত অনেক অর্থহীন কাজ করে যেতে হচ্ছেই। এই যেমন পার্টি করছি এমন অহংকার করা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *