২৪. কদমতলায় বাস থেকে নামতেই

চব্বিশ

কদমতলায় বাস থেকে নামতেই রিকশার হর্ন আর মানুষের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। সঙ্গে একটি কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, অনিমেষ চুপচাপ হেঁটে রূপমায়া সিনেমার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রতি বছর শহরটা একটু একটু করে চেহারা পালটাচ্ছে। নতুন নতুন দোকান এবং তাদের সাজানোর ঢঙের অভিনবত্ব চোখে পড়ছে। রূপমায়ার আগে নাম ছিল আলোছায়া। জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছিল সে এখানে, ছবিটার নাম দস্যু মোহন। হলটাকে ভালভাবে দেখল অনিমেষ। এতগুলো বছরেও একই রকম আছে। তবে আগে হিন্দি ছবি হত না, এখন তাই চলছে।

খুব চেনা রাস্তায় দীর্ঘদিন পরে হাঁটলে এক ধরনের অনুভূতি হয়। অনিমেষ খুশি খুশি মেজাজে চারপাশে তাকাচ্ছিল। চৌধুরী মেডিক্যালের কাউন্টারে রামদা বসে আছেন। অনিমেষকে দেখে হাত তুলে ডাকলেন। ভদ্রলোকের হাসিটা খুব সুন্দর। কখনও চুলে তেল দেন না বলে সবসময় ফেঁপে থাকে সেগুলো। ওঁর ওষুধের দোকানের সামনে এলেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় অনিমেষের। নানান ট্যাবলেট ক্যাপসুল এবং ওষুধের বোতল দেখতে দেখতে একধরনের নিরাপত্তা আসে। এখানে বসে থাকলে কোনও অসুখ আক্রমণ করতে পারবে না। দোকানের মধ্যে ঢুকলে যে ওষুধ-মার্কা গন্ধটা নাকে আসে তা বেশ আরামদায়ক মনে হয় তখন।

রামদা হাসলেন, ‘কবে আসা হল?’

‘এইমাত্র।’ কাঁধের ব্যাগটা দেখাল অনিমেষ।

‘এইভাবে, শুধু একটা ব্যাগ নিয়ে?’ রামদা বিস্মিত।

‘কাজে এসেছিলাম এদিকে, হঠাৎ চলে এলাম। তা আপনাদের খবর কী?’

‘আমি সবসময় ভাল। ও হ্যাঁ, কে যেন বলছিল তুমি এখন পার্টি করছ?’

‘বাঃ, এখানেও খবর এসেছে? খুব না, একটু একটু।’

‘এইটেই খারাপ লাগে। যখন কিছু করবে তখন হয় পুরোদমে করবে নয় একদম ধারে-কাছে যাবে না। মাঝামাঝি থাকাটা মারাত্মক। জানো তো, অখিলদা মারা গেছেন!’

‘অখিলদা, মানে কংগ্রেসের-!’

‘হ্যাঁ, তবে ওঁকে তোমার অন্য পরিচয়ে চেনা উচিত ছিল। জলপাইগুড়ি শহরের খেলাধুলোর উন্নতি যে লোকটা না-থাকলে হত না।’

অনিমেষের মনে পড়ল মানুষটাকে। যে-কোনও স্পোর্টস বা খেলায় এই লোকটিকে না-হলে চলত না। অর্থবান মানুষ, খেলার জন্য দু’হাতে অর্থ বিলিয়েছেন। এমনকী বৃদ্ধ বয়সেও নিজে ফুটবল খেলতে নামতেন। হাফপ্যান্ট পরা ফরসা হাসিখুশি সেই মানুষটি লেফট আউটে দাঁড়িয়ে এই বয়সেও এমন কিক করতেন যেটা রামধনু হয়ে গোলে গিয়ে ঢুকত। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছিল?’

‘মার্ডার! রাত্রে খেলার মাঠ থেকে ফেরার পথে—।’ রামদা গম্ভীর হলেন।

‘কেন?’

‘সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। ওরকম হাসিখুশি মানুষকে কি সুস্থ মাথায় মারা যায়? পুলিশ কোনও হদিশ পাচ্ছে না। শহরটা কেমন পালটে যাচ্ছে। এখন কেউ কাউকে পছন্দ না-করলে সহজেই সরিয়ে দিতে পারে।’

অনিমেষ রামদাকে দেখল। ওঁর সুন্দর মুখটা এখন বিমর্ষ। যতদূর জানা আছে রামদা কোনও রাজনীতিতে নেই। বাবুপাড়া পাঠাগারের সূত্রে গল্প-উপন্যাস পত্রিকা নিয়ে ডুবে থাকেন। তা হলে শহরটা ভেতরে ভেতরে পালটে যাচ্ছে! এটা কি রাজনীতির কুপ্রভাব? প্রসঙ্গটা এড়াতে রামদা একটা কাশির লজেন্স বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ক’দিন থাকছ?’

‘ঠিক নেই।’ বলে লজেন্সটা কাগজ থেকে ছাড়িয়ে মুখে ফেলল অনিমেষ।

রামদা তখনই একজন খদ্দেরকে ওষুধ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অনিমেষ বলল, ‘চলি’। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েই রামদা আবার হাত তুলে দাঁড়াতে বললেন। গলায় ঝাঁঝ লাগছিল অনিমেষের। ওর মনে পড়ে গেল আগে যখনই এখানে আড্ডা মারতে আসত তখন এই লজেন্সটা তার বরাদ্দ থাকত। কথাটা তার খেয়ালে ছিল না কিন্তু রামদা সেটা মনে রেখেছেন। তার নিজের মনের অবচেতনায় ব্যাপারটা থেকে গিয়েছিল বলেই ওটা নেওয়ার সময় সে অন্যমনস্ক-স্বচ্ছন্দতায় নিয়েছিল। রামদাকে আজ নতুন করে ভাল লাগল তার।

কাজ শেষ করে রামদা ওর সামনে এসে কাউন্টারের ওপর দু’হাত রেখে বললেন, ‘তোমার দাদু এসেছিলেন।’

‘দাদু?’

‘হুঁ। এখন তোমাদের ওঁকে একা রাখা উচিত নয়।’

‘কেন, কী হয়েছে?’

‘তুমি কিছু জানো না?’

‘না।’

‘সত্যি?’

‘বিশ্বাস করুন।’ অনিমেষ খুব নার্ভাস হয়ে পড়ছিল। দাদু তো এই সেদিন গয়া থেকে ওর কাছে ঘুরে ফিরে এসেছেন। চিঠিতেও তো কিছু লেখেননি।

‘কিছুদিন হল ওঁর কানে একটা ঘা মতো হয়েছিল।’

‘কানের ভেতরে?’

‘না, লতিতে। কিছুতেই সারছিল না বলে ডক্টর সেনের কাছে যান। তিনি সাসপেক্ট করছেন—।’ অনিমেষের দিকে তাকালেন রামদা। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটু ভাবলেন। অনিমেষ বুঝল যে রামদা কোনও অপ্রিয় কথা বলতে দ্বিধা করছেন। সে একটা হাত বাড়িয়ে রামদার হাতে রাখল, ‘বলুন, এখন আমি আর বালক নই।’

‘ডক্টর সেন এটাকে এক ধরনের লেপ্রসি বলে সন্দেহ করছেন। কিন্তু, শোনো শোনো, আপসেট হয়ো না, এটা জাস্ট সন্দেহ। তোমার দাদুকে উনি যেসব পরীক্ষা করাতে বলেছিলেন তার একটাও করতে চাননি। সামান্য কয়েকটা টেস্টে এটা ধরা যাবে। আর আজকাল তার প্রচুর ওষুধ আছে, কোনও সমস্যাই নয়। আমার কাছে উনি এসেছিলেন কয়েকটা ওষুধ কিনতে আর ইঞ্জেকশন নিতে। ওঁকে অনেক বোঝাতে চাইলাম কিছুতেই শুনলেন না। বললাম, ডক্টর সেন ভুল করতে পারেন, আপনি আর-একজনকে দিয়ে যাচাই করান, স্কিন টেস্ট করুন। বাট হি ইজ টোটালি এ চেঞ্জড ম্যান। তুমি যখন এসে পড়েছ ওঁকে ভাল করে বোঝাও।’

অনিমেষের মাথায় আর কিছু ঢুকছিল না। দাদুর কুষ্ঠ হয়েছে? থেকে থেকে শরীরে একটা কাঁপুনি আসছিল। কাউন্টারের ওপর দু’হাতের ভর রেখে নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর খুব নিচু গলায় বলল, ‘কিন্তু রামদা, ব্যাপারটা কি ঠিক?’

রামদা দ্রুত হাত নাড়লেন, ‘এটা একটা অনুমানমাত্র। অনেক সময় শুধু ভিটামিনের অভাবে শরীরের ঘা শুকুতে চায় না, ডায়েবেটিস থাকলেও হতে পারে। ব্যাপারটা আসলে কী তা পরীক্ষা না-করলে কী করে বোঝা যাবে? কিন্তু তার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। শুনছি আজকাল বাড়ি থেকে বেরও হচ্ছেন না। তুমি ওঁকে বোঝাও।’

রামদার দোকান থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নেবে কিনা ভাবল অনিমেষ। খবরটা শোনামাত্র শরীর কেমন অবসন্ন হয়ে গেছে। দাদুর যদি সত্যি কুষ্ঠ হয়ে থাকে তা হলে— কোনও হিসাব মেলাতে পারছিল না অনিমেষ। সে দ্রুত হাঁটা শুরু করল নিজেকে শক্ত করতে। রূপশ্রী সিনেমার সামনে দিয়ে থানার পাশ ঘুরে করলা নদীর ধারে হনহন করে হেঁটে আসার পথে একটাও চেনা মুখ পড়ল না। অনিমেষ এই মুহূর্তে পরিচিত কাউকে দেখতেই চাইছিল না। কারও সঙ্গে কোনও খেজুরে কথা বলার মতো মেজাজও নেই।

বাড়িটাকে রং করা হয়েছিল অনেকদিন আগে কিন্তু এখনও বেশ ঝকঝকে দেখাচ্ছে। সরু গলি দিয়ে হেঁটে এসে বাড়ির সামনে গেটটায় হাত রাখল অনিমেষ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। ঝিম মেরে আছে চারধার। এখন দুপুর। বাইরের সব দরজা জানলা বন্ধ। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় অত বড় এলাকা জুড়ে তৈরি বাগান এবং বাড়িতে কোনও মানুষ নেই। সামনের অংশে আগে ভাড়াটেরা থাকত। এখন সেগুলোও যে ফাঁকা তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনিমেষ ভেতরে ঢুকে দরজায় শব্দ করল।

বেশ কিছুক্ষণ সাড়া নেই, তারপরই একটা সরু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে, ‘কে এল আবার, ও হেম, দেখো না একবার।’ অনেক কষ্টে বোঝা যায় এই গলা সরিৎশেখরের। অনিমেষের মেরুদণ্ডে কেউ যেন বরফ ঘষে দিল। এ কী গলা হয়েছে ওঁর! শ্লেষ্মাজড়ানো অথচ ভাঙা কাঁসির মতো বিরক্তি মাখানো এরকম সরু স্বর সরিৎশেখরের কণ্ঠ থেকে বেরুবে চিন্তাও করা যায় না।

পিসিমার গলা শুনল অনিমেষ, ‘আপনি দেখুন না, আমার সময় নেই।’

‘কেন কী রাজকার্য করছ তুমি, অ্যাঁ?’

‘আমার পিন্ডি চটকাচ্ছি। এগুলো না-রাঁধলে গিলবেন কী?’

‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না? রান্না শেখাচ্ছ আমাকে?’

‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আপনার চাকরানি হয়ে জীবনটা গেল আমার। কেন, ওখান থেকে একটু উঠে গিয়ে দেখতে পারছেন না?’

অনিমেষ চুপচাপ সংলাপগুলো শুনছিল। দাদু আর পিসিমার সম্পর্ক প্রায় আগের মতো থাকলেও মনে হচ্ছে কোথাও যেন সুর কেটে গেছে। অনিমেষ আর-একবার দরজায় টোকা দিল। গনগনে আঁচের মতো মেজাজ এগিয়ে আসছে বোঝা গেল। দুপদাপ পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। শব্দ করে দরজা খোলার সময় হেমলতা বিড়বিড় করছিলেন, ‘আসার আর সময় পায় না, ভরদুপুরেও—।’

দরজা খুলে যেতে ও হাসতে চেষ্টা করল। কিন্তু এ কী হয়েছে পিসিমার চেহারা! শুকিয়ে প্রায় দড়ি পাকিয়ে গেছে শরীর। গায়ে সেমিজ নেই, সাদা ফিতেপাড় ধুতিটা গোড়ালি ঢাকেনি। গাল ভেঙে গেছে। বাইরের কড়া রোদ চোখে পড়তে দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়েছিল একটু পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাবা, দেখুন কে এসেছে!’

অনিমেষ নিচু হয়ে প্রণাম করতেই উনি দু’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। হেমলতার মুখ অনিমেষের বুকে এবং তখনই ফোঁপানি শুরু হল। কান্নাটাকে আর ধরে রাখতে পারছেন না হেমলতা, দমবন্ধ গলায় শুধু উচ্চারণ করছেন, ‘অনিবাবা, অনিবাবা!’

অনিমেষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সেই স্বর্গছেঁড়া থেকে শৈশবে এই মহিলার সঙ্গে চলে আসার পর থেকে অনেক মান-অভিমান এবং সুখের স্পর্শ পেয়ে সে যৌবনে পৌঁছেছিল। কিন্তু কখনও এমন করে হেমলতা ব্যক্তিগত আড়াল সরিয়ে তার বুকে মাথা ঠোকেননি। নিজের মাকে এখন আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। মায়ের স্নেহ-ভালবাসা দু’-একটা সুখ এবং দুঃখের স্মৃতিতে আধো আলোছায়ায় মুখ বুজে আছে। কিন্তু একদিকে সরিৎশেখরের ব্যক্তিত্ব অন্যদিকে হেমলতার স্নেহের প্রশ্রয় তার বালককাল ও কৈশোর জুড়ে ছড়ানো— এ তো অস্বীকার করা যায় না। আজ হেমলতা তার বুকে এমন করে ভেঙে পড়তে অনিমেষের নিজেকে সামলানো মুশকিল হচ্ছিল।

কয়েক মুহূর্ত এই অবস্থায় থাকতেই ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল, ‘কে এল, ও হেম, কে এল এখন?’

হেমলতা ফিসফিস করে অনিমেষকে বললেন, ‘অনেক কথা আছে অনিবাবা, তোকে পরে বলব।’ তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গলা তুললেন, ‘আপনার নাতি এসেছে, অনিবাবা। কী কালো হয়ে গেছে দেখুন।’ কথাটা বলতে বলতেই হেমলতা ভেতরে ঢুকলেন। এই মুহূর্তে তাঁকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। যেন বিশ্বজয় করে এসেছেন এমন ভঙ্গিতে হেলেদুলে এগোচ্ছিলেন। একটু আগের কান্নাটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যেন অনিমেষ এ-বাড়িতে আসতেই তাঁর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, আর কোনও কিছু নিয়ে তাঁকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

অনিমেষ আড়ষ্ট পায়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। এই ঘরের আসবাব, চেহারা, এমনকী গন্ধটা অবিকল একই রকম রয়েছে। স্বর্গছেঁড়া থেকে জলপাইগুড়িতে এসে সরিৎশেখর এই ছ’কামরার বাড়িটা প্রথমে তৈরি করেছিলেন মাথা গোঁজার জন্য। তারপর বড় বাড়ি হল, অনেক যত্নে সেটাকে তৈরি করলেন সরিৎশেখর। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওখানে গিয়ে থাকার ইচ্ছে হল না তাঁর। এখনও সেই পুরনো ঘরেই রয়ে গেছেন। অনিমেষ বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চমকে গেল।

ভেতরে উঠোন জুড়ে যে কাঁঠালগাছটা ছিল সেটা আর নেই। অনেকটা জায়গা ন্যাড়া দেখাচ্ছে এখন। আর তার ঠিক মাঝখানে বেতের রং-ওঠা চেয়ারে আপাদমস্তক ঢেকে এই রোদে বসে আছেন সরিৎশেখর। একটা নস্যিরঙা চাদরে ওঁর মাথা ঢাকা, শুধু চোখ আর নাক বেরিয়ে আছে বাইরে। বারান্দার কোণে এসে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হল। অনিমেষের মনে হল একটা শীতল হাওয়া যেন তার শরীরে কনকনানি ছড়াচ্ছে। এইমাত্র সামান্য ক’দিনের ব্যবধানে একটা মানুষের চেহারায় এতখানি পরিবর্তন ঘটতে পারে চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কাঁধের ব্যাগটাকে বারান্দার টুলের ওপর রেখে অনিমেষ উঠোনে নামল, ‘কী হয়েছে আপনার?’

সরিৎশেখর চিৎকার করে উঠলেন। সেই গম্ভীর স্বর নেই, বাচনভঙ্গিতে যে ব্যক্তিত্ব অনেকের সাহস হরণ করত তা উধাও, চিনচিনে গলায় শব্দটা ছিটকে বের হল, ‘কাছে এসো না, কাছে এসো না, দূর থেকে কথা বলো!’

অনিমেষ ভাল করে দাদুকে দেখল। নাক চোখ তো স্বাভাবিকই আছে। সে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল আবার, ‘কেন, কী হয়েছে?’

‘কেন, শোনোনি কিছু? এখানে আসার পথে কেউ তোমায় বলেনি?’

‘না।’ মিথ্যে কথাটা শক্ত গলায় বলল অনিমেষ।

‘সেকী। লোকে আমায় আজকাল দেখলেই সরে দাঁড়ায়। পাড়ায় একটা কম্পাউন্ডার পাই না যে আমাকে ইঞ্জেকশন দেবে আর তোমাকে কেউ কিছু বলল না! কেন, তোমার পিসিমা তো দরজা খুলে অনেকটা সময় নিল, সে কিছু বলেনি?’

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা রান্নাঘরের বারান্দা থেকে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি বলতে যাব কেন? আপনার দুর্গতির কথা আপনি বলুন। আমার তো আর ভীমরতি হয়নি আপনার মতো।’

‘অ।’ চাদরে মোড়া মাথাটা একটু দুলল। তারপর অনিমেষকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানালেন, ‘শোনো, আমার কুষ্ঠ হয়েছ। জানি, সব কুষ্ঠ সংক্রামক নয়। তবু আমি ঝুঁকি নিতে চাই না। তাই কেউ এখানে আসুক আমি পছন্দ করি না। তোমার বাবাকে আমি জানিয়েছি, কিন্তু সে কথা শুনতে চায় না। সপ্তাহে একদিন এসে তোমার পিসিমার কাছে খবর নিয়ে যায়।’

হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘শুনলি অনিবাবা, শুনলি। অন্য কাউকে উনি রোগ ধরাবেন না কিন্তু আমার বেলায় সে কথা একদম মনে পড়ল না। স্বার্থপর কীরকম দেখ তুই। সেই যে ছেলেবেলা থেকে গু-মুত ফেলাচ্ছেন তা থেকে আর নিস্তার নেই।’

সরিৎশেখর মাথা নাড়লেন, ‘নিজের শরীর তো আর আয়নায় দেখো না, হয় তুমি নয় আমি, যে কেউ আগে যেতে পারি। আমি ছাড়া তোমার আর কেউ নেই। এই বয়সে তোমার যদি আমার রোগ হয় তা হলে কী এমন বেশি হবে। আমার তো এই শরীরের ওপর কোনও মায়া নেই। গয়ায় গিয়ে মুক্তপুরুষ হয়ে এসেছি। কিন্তু আমার ওপর তো তোমার খুব মায়া আছে। তাই তোমাকে দূরে যেতে বলছি না। আর তা বললে যে ক’দিন বেঁচে আছি খাব কী?’

হেমলতার গলাটা আচমকা পালটে গেল, ‘ওই আর-এক ন্যাকাপনা হয়েছে, বাবা নিজে নিজের শ্রাদ্ধ করে এসেছেন। আর তাই জগতের ওপর শরীরের ওপর ওঁর কোনও মায়া নেই! তাই যদি হবে তো রোগ হয়েছে বলে মানুষের সামনে যাচ্ছেন না কেন? ভাত একটু শক্ত থাকলে খাবার সময় আমার পিন্ডি চটকান কেন? এর নাম মুক্তপুরুষ, না? আপনার দুটো বউ যে আগেভাগে মরে গেছে সেটা তারা কপাল করে এসেছিল বলেই, বুঝলেন?’

অনিমেষ একটু কড়া গলায় বলল, ‘পিসিমা, আপনি একটু চুপ করুন।’ তারপর দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সরিৎশেখর চোখ বন্ধ করলেন। এখন ওঁর চামড়া কুঁচকে মুখের আদল দুমড়ে দিয়েছে। সময় বড় নির্মম। অনিমেষ আদেশের গলায় বলল, ‘চাদরটা সরান, আমি দেখব।’

‘কুষ্ঠ, কুষ্ঠ, অনেক পাপ করেছি সারাজীবন, তার ফল।’ চাদর সরাবার চেষ্টা না-করে সরিৎশেখর বিড়বিড় করলেন।

‘আপনি অশিক্ষিতের মতো কথা বলছেন। সামান্য ক’দিন আগেও আপনি এরকম কথা বলতেন না। চাদরটা সরান।’ সরিৎশেখর বুঝলেন আর প্রতিরোধ করে লাভ নেই। একান্ত অনিচ্ছায় তিনি মাথা থেকে চাদর সরালেন। সাদা কদমফুল দেখল অনিমেষ। আধ ইঞ্চি খোঁচা খোঁচা পাকা চুলে ছাওয়া মাথাটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সরিৎশেখরকে চেনা যেত না আচমকা দেখলে। অনিমেষ সতর্ক চোখে সরিৎশেখরের কানের দিকে তাকাল। বাঁ কানটা সামান্য ফুলেছে। লতির পেছন দিকটা ঘা হয়েছে বেশ। বোধহয় কানের ভাঁজ থেকে চটচটে রস জড়ানো ক্ষত ছড়িয়েছে। একটা লালচে ওষুধ বোধহয় লাগানো হয়েছে সকালে। অন্য কানটা একদম স্বাভাবিক। কানের লতিতে, নাকের পাটায় লালচে ভাব বা ফোলা নেই। গলা, কপালের ওপরের চামড়ায় বয়সের জন্য যেটুকু বিধ্বস্ত তার অতিরিক্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনিমেষ এই অল্প বয়সে অনেক কুষ্ঠরোগী দেখেছে। জীবনের প্রথমবার সেই তিস্তার ওপরে নৌকায় বসে থেকে শুরু করে কংগ্রেসের হয়ে বন্যার সাহায্য দেওয়ার সময় পর্যন্ত ওদের কাছ থেকে লক্ষ করেছে। আজ সেই সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বুঝতে পারল রোগটা কুষ্ঠ নয়। কিন্তু ডাক্তারের সন্দেহ এবং দাদুর এই আচরণ শুধু অনুমানের ওপর তা কী করে হয়? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার রক্তে চিনি আছে?’

‘চিনি?’

‘ব্লাড সুগার!’ অনিমেষ জোর করে রসিকতার চেষ্টা করছিল।

‘জানি না। থাকলেও থাকতে পারে।’

‘পরীক্ষা করিয়ে দেখবেন?’

‘পয়সা নষ্ট করে লাভ কী?’

‘যদি রোগটা সেই কারণেই বেড়ে থাকে তা হলে স্বস্তি পাবেন। ঠিক চিকিৎসা হবে।’

‘লাভ কী?’

‘মানে?’

‘এই শরীরটা নিয়ে আমি এক ফোঁটা চিন্তা করি না।’

‘কিন্তু অন্য লোককে বিব্রত করছেন।’

‘বিব্রত না-হলেই হয়।’

‘আপনি কানের কাছে ওই রোগ হয়েছে বলে চেঁচাবেন আর লোকে তা শুনবে না? শুনলাম ইঞ্জেকশন নিতে গিয়েছিলেন।’

‘কে বলল?’

‘একটু আগে আপনিই তো কম্পাউন্ডারের কথা বললেন।’

‘অ। হ্যাঁ, ডাক্তার সেন অনুমান করছিলেন। যদি হয় তা হলে লেপ্রসির প্রাথমিক ওষুধপত্র এবং ইঞ্জেকশন লিখে দিতে বলেছিলাম।’

‘ব্যস। নিজে নিশ্চিন্ত না-হয়ে সেগুলো ব্যবহার করতে লাগলেন! দাদু, আপনি তো এরকম অবৈজ্ঞানিক চিন্তা কখনও করতেন না?’

হঠাৎ সরিৎশেখর দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। কিছুক্ষণ তাঁর শরীরটা নিশ্চল হয়ে রইল। জলপাইগুড়িতে ভরদুপুরের খরা রোদেও হাওয়া বয়। সেই হাওয়ায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ নতুন চোখে দাদুকে দেখল। এই সেই সরিৎশেখর যিনি তার সামনে এতকাল বিশাল বৃক্ষের মতো মাথা উঁচু করে ছিলেন। এখন তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে কিছুতেই মন চায় না।

অনিমেষ বুকের গভীর থেকে ডাকল, ‘দাদু!’

সরিৎশেখর খানিকবাদে মুখ তুললেন। একবার সতর্ক চোখে চারপাশে তাকিয়ে নিলেন। হেমলতাকে ধারে-কাছে দেখতে না-পেয়ে বললেন, ‘বারান্দা থেকে টুলটা নিয়ে এসো।’

অনিমেষ সামনে বসলে সরিৎশেখর কিছুটা সামলে নিলেন, ‘আমি আর পারছি না। এভাবে বেঁচে থাকতে আমি পারব না।’

অনিমেষ নড়ে উঠল, ‘কী হয়েছে আমাকে বলুন।’

সরিৎশেখর একটা কালো পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিলেন। শুধু ওঁর ঠোঁট দুটো নড়ছিল, ‘সারা জীবনে আমি কিছু পাইনি। দু’বার বিয়ে করেছিলাম কিন্তু ভাগ্যে সইল না। বড় মেয়েটা সেই বাল্যকালে বিধবা হয়ে ঘাড়ে চেপে রইল। বড় ছেলে দুষ্টগ্রহের মতো সারাজীবন আমার চারপাশে ঘুরছে আর আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তোমার বাবা আমাকে টাকা দেয় কিন্তু আমি বুঝি সে বাধ্য হয়েই দেয়। কারণ তার মনে একটা নরম ভাব আমার সম্পর্কে আছে। কিন্তু আমার সমস্যা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না। তার ভাইদের ব্যাপারে সে নাক গলাতে চায় না। ছোটজনের সম্পর্কে আমি কিছু ভাবি না। শুনেছি সে এখন মস্কোতে আছে।’

সরিৎশেখর একটানা কথা বলে দম নিতে থামলেন।

অনিমেষ সোজা হয়ে বসল। ছোটকাকা প্রিয়তোষ এখন মস্কোতে? কথাটা সে জানত না। কমিউনিজম শব্দটা যাঁর জন্য সে প্রথম শুনেছিল তিনি নাকি পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছেন— এরকম কথা কানে এসেছিল। এতদিন কলকাতায় থেকেও ছোটকাকাকে সে দেখেনি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে খোঁজখবর নেয় কিন্তু তেমন উৎসাহ পায়নি। আবার এও শুনেছিল ছোটকাকা দিল্লিতে আছে। এখন দাদুর মুখে ছোটকাকার রাশিয়ায় থাকার খবর পেয়ে সব হিসেব গুলিয়ে গেল তার।

সরিৎশেখর বললেন, ‘প্রিয় ইজ ডেড টু মি। যে ছেলে ওই অবস্থায় গিয়ে নিজের বাবাকে স্মরণ করে না তার কোনও অস্তিত্ব আমি স্বীকার করি না। ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সারাজীবন সে শুধু অসম্মানের কারণ হয়ে থাকল। তোমার মাকে নিয়ে এসেছিলাম নিজে পছন্দ করে, সেও চলে গেল। সারাজীবন আদর্শ নিয়ে কঠোর মানুষ হয়ে কাটিয়ে এইসব জুটল। ধর্মকর্ম কোনওদিন মানতে পারিনি। শান্তির জন্য সেখানে যাওয়া কাপুরুষতা বলে ভাবতাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমি শেষ হয়ে গেছি। তোমার বাবা যে টাকা দেয় তাতে চলে না। এর কাছে ওর কাছে হাত পাতি। নিজেকে কেমন ভিখিরির মতো মনে হয়। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে শুনতে পাই কেউ অবাক হয়ে বলছে এই বুড়োটা এখনও বেঁচে আছে! এতদিন যেভাবে কাটিয়ে এসেছি এখন সেটা তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। কেঁচোর মতো থাকতে ইচ্ছে করে না একদম। আমার মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে বুঝে তোমার জ্যাঠা যখন এসে জুড়ে বসেন তখন আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। ভাবলাম নিজের শ্রাদ্ধ করে এলে শরীরের প্রতি জগতের প্রতি কোনও মায়া থাকবে না। ভুল সব ভুল। অনিমেষ, আত্মহত্যা করতে পারব না, কিন্তু দীর্ঘজীবন বেঁচে থাকার মতো পাপ আর কিছু নেই।’

অনিমেষ এতক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। অজান্তেই নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছিল সে। দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কুষ্ঠরোগ একটা বাহানা?’

ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর, ‘কাজ হয়েছে খুব। যেই শোনে আমার কুষ্ঠ হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে দুদ্দাড় করে পালিয়ে যায়। তোমার জ্যাঠামশাই আর কাছ ঘেঁষছে না। ছোট পিসি আসবে না যদ্দিন বেঁচে আছি। শুধু তোমার বাবা মনে হয় কথাটা আধা বিশ্বাস করেছে। প্রতি সপ্তাহে আসে, আমার আপত্তি বলে কাছে আসে না। শহরের লোকজন প্রায় একঘরে করে দিয়েছে আমাকে। যতই আধুনিক হোক, মানুষ যখন কল্পনা করে নিজের শরীরের মাংস খসে খসে পড়ছে তখন সব আধুনিকতা ফুস করে উধাও হয়ে যায়। আমাকে এখন কেউ বিরক্ত করে না। আমার যা কিছু অভাব তাই নিয়ে একা একা চুপচাপ বসে থাকি। শুধু তোমার পিসিমাকে ঠকাতে আমার খারাপ লাগছে। মেয়েটা, আমার যাই হোক আমাকে ছেড়ে যাবে না। কুষ্ঠ বলে সে আমলই দেয় না।’

অনিমেষ অবাক হয়ে গেছিল। এভাবে কোনও মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কখন! কেন? এইসময় হেমলতা হড়বড় করে বারান্দায় চলে এলেন, ‘একদম ভুলে গেছি। হ্যাঁরে তুই খেয়ে এসেছিস?’

‘কেন বলুন তো?’

‘না-হলে আবার রান্না শুরু করি। শুধু সেদ্ধভাত ছাড়া আমরা কিছু খাই না। গোয়ালাটা যা বাজার করে দেয়—।’

একটা বেজে গিয়েছিল খেয়াল আছে। এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। অনিমেষের ভেবে নিতে একটুও সময় লাগল না। পিসিমা যদি রান্না শুরু করেন তা হলে ওঁর নিজের খেতে হয়তো সন্ধে হয়ে যাবে। সে স্বচ্ছন্দে বলল, ‘আমি শুধু স্নান করব। আসার সময় খেয়ে এসেছি।’

‘ঠিক বলছিস তো অনিবাবা?’

অনিমেষ হাসল, ‘ঠিক বলছি। আপনি চিন্তা করবেন না।’

‘বেশ। তা হলে স্নান করে একটু বাতাসা দিয়ে জল খাস। স্নানটা করে নে বরং। গল্প করতে করতে বাবার আর খেয়াল নেই। আসুন খাবেন।’

অনিমেষ চমকে উঠল, ‘এখনও খাওয়া হয়নি?’

‘হবে কী করে? সকালে একটু সুজি দিয়ে দুধ দিয়েছিলাম তাই খেয়েই তো পেট ঢাক হয়ে আছে। সারাদিন একবারই তো ভাত খায়, তাও এই সময়। কই আসুন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ হেমলতা ডাকলেন।

সরিৎশেখর কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালেন। অনেকটা বেঁকে গেছেন এরই মধ্যে। হাঁটতে গিয়ে টলে গেলেন সরিৎশেখর। অনিমেষ চট করে তাঁকে ধরে ফেলে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে হাঁটিয়ে আনল। সরিৎশেখর ফিসফিস করে বললেন, ‘মনে রেখো আমার কুষ্ঠ হয়েছে।’ অনিমেষ হাসল।

বারান্দার এক কোনায় টেবিলে খাবারের ব্যবস্থা। ধরে ধরে ওঁকে সেখানে তুলে দিতেই একই স্বরে বললেন, ‘মাঝে মাঝে এক-একটা দুপুর উপোস দেওয়া ভাল, ওতে শরীর সুস্থ থাকে।’

অনিমেষ এবার আর হাসতে পারল না।

স্নান সেরে বাইরে বেরোতেই মনে হল পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে। অথচ এখন আর খাওয়ার কথা বলা চলে না। চুল আঁচড়ে সে রান্নাঘরের সামনে আসতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। চামচে করে দাদু ভাত মুখে দিচ্ছেন আর পিসিমা একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ একটা ঢোক গিলতে গিয়ে দাদু কাশতে শুরু করলেন। সমস্ত শরীর বেঁকেচুরে একাকার, চোখ উলটে যাচ্ছে। পিসিমা দু’হাতে বুক মালিশ করতে করতে বিড়বিড় করতে লাগলেন। অনিমেষ ভয় পেয়ে একলাফে দাদুর সামনে গিয়ে হাজির হল। সরিৎশেখরের সামনে বড় বাটিতে ভাত ডাল আর একটা তরকারিগোছের কিছু গুলে একেবারে কাই করে দেওয়া হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে শক্ত কিছু খেতে অসুবিধে বলে দাদুর জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু তাও তো গলায় আটকে গেছে ওঁর।

একটু সামলে ঘাড় নেড়ে দাদু উঠে পড়লেন। তারপর এগিয়ে বেসিনে ঝুঁকে পিসিমার দেওয়া জলে মুখ ধুতে লাগলেন। অনিমেষ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই বমির শব্দ শুনতে পেল। হুড়হুড় করে এতক্ষণের কষ্টের খাওয়া বেসিনে উগরে দিলেন, সরিৎশেখর। অনেকটা শ্লেষ্মা খাবারের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার পর যেন খুব আরাম হল ওঁর। পিসিমার গলা শোনা গেল, ‘আঃ, এতক্ষণে যা খেলেন সব বমি করে দিলেন। ছি ছি ছি। এই করলে শরীর টিকবে? দেখলি অনিবাবা, কাণ্ডটা দেখলি?’

তোয়ালেতে মুখ মুছে সরিৎশেখর আবার বাইরে এসে বসলেন। অনিমেষ দেখল দাদু এখনও হাঁপাচ্ছেন। কাছে গিয়ে বসতেই হাসবার চেষ্টা করলেন। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কেমন বোধ করছেন!’ দাদুর পেট তারই মতো শূন্য ভাবতে অস্বস্তি হচ্ছিল।

‘ভাল। পেটে কিছু পড়লেই খারাপ বোধ হয়।’

একটা প্লেটে বাতাসা আর জল নিয়ে পিসিমা সামনে দাঁড়াতেই অনিমেষ খেয়ে নিল। অত্যন্ত সামান্য; কিন্তু খেয়ে নিতেই খিদে বোধটা চাপা পড়ে গেল। পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক’দিন ছুটি তোর?’

‘পুজোর ক’টা দিন থাকব।’

‘পুজো তো দু’দিন বাকি। তা এখানে থাকবি না স্বর্গছেঁড়ায় যাবি?’

‘আজ একটু ওখান থেকেই ঘুরে আসি।’

‘সেই ভাল। আমি আজকাল আর মাছ ডিম রাঁধতে পারি না। এইরকম নিরামিষ ঘ্যাঁট তোর একদম ভাল লাগবে না।’

পিসিমা চলে যেতে দাদু বললেন, ‘মানুষ সবসময় প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু একা একা থাকতে থাকতে একটা সময় আসে যখন অন্যলোকের ছায়াও সহ্য হয় না।’

অনিমেষ বুঝতে পারল। পিসিমা-দাদুর এখনকার যে জীবন তা তাদের সুবিধে অসুবিধে নিয়ে নিজেদের মতো করে তৈরি। সেখানে একদিনের জন্য এসে দাঁড়ালেও সেই নিয়মটা ওঁদের পালটাতে হবে। আর তার পরে যখন আবার ওঁরা একা হয়ে যাবেন তখন এই পালটানো নিয়মটার কথা ভেবে ওঁরা কষ্ট পাবেন। তার চেয়ে স্বর্গছেঁড়ায় চলে যাওয়াই উচিত।

অনিমেষ দেখল দাদু ওর দিকে অদ্ভুত শান্ত মুখে চেয়ে আছেন। হঠাৎ যেন তার মাথায় একটা চিন্তা ছিটকে গেল। সে বলল, ‘মাঝে মাঝে একটা দুপুর উপোস দেওয়া ভাল, ওতে শরীর সুস্থ থাকে।’

কথাটা শুনে সরিৎশেখর চমকে উঠলেন। তারপরই সরু গলায় হো-হো করে হাসতে লাগলেন। হেমলতা অনেকদিন পরে বাবার গলায় হাসি শুনে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল, হঠাৎ হাসছেন যে?’

হাসি না-থামিয়ে ঘাড় নেড়ে সরিৎশেখর বললেন, ‘ও তুমি বুঝবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *