৩১. সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি

একত্রিশ

সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি আর কালো জামা নীলার শরীরে, কিন্তু শরীরটাকেই চিনতে কষ্ট হয়। এই সামান্য সময়ের ব্যবধানে নীলার চেহারায় অজস্র ধুলো জমা পড়েছে। গালের হনু সামান্য উঁচু হয়েছে, চোখ ভেতরে।

অনিমেষের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা হাসল। কোনও কোনও মেয়ে আছে সময় যার কাছ থেকে সব কেড়ে নিলেও হাসিটাকে দখল করতে পারে না। নীলার এই হাসি সেইরকম, অহংকারী। বলল, ‘অমন করে কী দেখছ, এসো।’

‘তুমি! এখানে?’ অনিমেষ এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে।

‘এখানেই তো থাকি। আমাদের বাড়ি। এসো ঘরে এসো।’

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। ওর চোখে কিছুটা কৌতূহল কিছুটা বিব্রত ভাব। ইশারায় ওকে নিশ্চিন্ত করে সঙ্গে আসতে বলল সে। নীলার পেছন পেছন বারান্দা ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা। ঘরে ঢুকে নীলা বলল, ‘এ পাশের জানলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম তুমি যাচ্ছ। আমি তোমার নাম ধরে চেঁচিয়েছিলাম। তুমি বুঝতে পারোনি, না?’

‘কেউ আমাকে ডাকছে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু—।’ অনিমেষ হাসল।

নীলার এই ঘরের সঙ্গে ওর হস্টেলের কোনও ফারাক নেই। আসবাব বলতে একটা বড় তক্তাপোশ, বিছানায় চাদর পাতা, এক কোনায় আলনায় কয়েকটা ময়লা কাপড় ঝুলছে, ঘরের অন্য কোনায় স্টোভ এবং রান্নার জিনিসপত্র। ও পাশের ঘর থেকে নীলা দুটো কাঠের চেয়ার টানতে টানতে নিয়ে এল। এসে বলল, ‘এখনও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি। বসো।’

বাবার মুখে নীলার ব্যাপারটা শুনেছিল সে। কিন্তু ব্যাপারটা যে এই পর্যায়ে তা ভাবতে পারেনি। দেবব্রতবাবুর বাড়িতে সে যখন ছিল তখন দেখেছে ওঁরা কী বিলাসের মধ্যে বাস করতেন। সেই নীলা এখন যে ঘরটাকে আমার ঘর বলছে তার সঙ্গে ওই জীবনটাকে একটুও মেলানো যায় না। সে ঠিক করল নীলা যদি নিজে থেকে কিছু না-বলে তা হলে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করবে না। নীলাকে চিরকাল এইরকম পরিবেশে দেখেছে এমন ভঙ্গি করবে।

মাধবীলতাকে বসতে বলে সে অন্য চেয়ারটা টেনে নিল। নিয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে এর আলাপ করিয়ে দিই, এর নাম মাধবীলতা।’

মাধবীলতা হেসে বলল, ‘আপনাকে আমি চিনি।’

নীলা চোখ কপালে তুলল, ‘ওমা, কেমন করে?’

‘ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি। আপনি বোধহয় আমার সিনিয়র ছিলেন।’

নীলা চোখে হাসল, ‘তোমরা এক ক্লাসে পড়ো বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে তো এক বছরের সিনিয়ার হবই। কিন্তু আমি তো অনেকদিন ও পাট ছেড়েছি। আমাকে চেনার তো কোনও কারণ নেই। না না, তাই বলি কী করে, আমি যে অনেক ছেলের সঙ্গে ঘুরতাম, চেনা স্বাভাবিক।’ হাসল আবার সে। তারপর অনিমেষকে বলল, ‘তোমার চেহারা কিন্তু বেশ পালটে যাচ্ছে।’

‘কীরকম হচ্ছে?’

‘মফস্‌সলের গন্ধটা আর একদম নেই। বেশ অ্যাট্রাকটিভ হয়েছে।’

কথাটা বলার ধরনে এমন মজা ছিল যে মাধবীলতাও হেসে ফেলল। অনিমেষ বলল, ‘তুমি একটুও পালটালে না।’

‘কে বলল? তুমি এই ঘরে বসেও বলছ আমি আগের মতো আছি?’

অনিমেষ যদি ভুল না-করে তা হলে সে তীক্ষ্ণ অভিমানটাকে স্পর্শ করল যেন। সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হল সে। এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চায় সে। কিন্তু প্রশ্নটা করে নীলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল, ‘আমি তোমার কথা বলার ধরনটায় পরিবর্তন না হওয়াটাই বলতে চেয়েছিলাম, অন্য কিছু নয়।’

নীলা দাঁতে ঠোঁট কামড়াল। তারপর খুব দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল, ‘এদিকে এসেছিলে কোথায়?’

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়ে হাসল। অনিমেষ সহজ গলায় বলল, ‘ওর জন্য একটা হস্টেল দেখতে, জায়গা পাওয়া গেল না।’

‘তুমি কি বাইরে থাকো? এই, তখন থেকে তোমাকে তুমি বলে যাচ্ছি— কিছু মনে কোরো না। তুমিও আমাকে তুমি বলতে পারো।’ নীলা আবার সহজ।

‘না না ঠিক আছে।’ মাধবীলতা এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন তুমি বলাতে সে কিছু মনে করছে না কিন্তু নীলার প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিল না সে। ব্যাপারটা যে নীলার বুঝতে অসুবিধে হয়নি তা অনিমেষের চোখ এড়াল না। কারণ নীলার ঠোঁটে হাসিটাকে চলকে উঠেই মিলিয়ে যেতে দেখল সে। এবার নীলা দরজার কাছে গিয়ে সেই বাচ্চা মেয়েটাকে ডেকে আনল। তারপর একটা ছোট কেটলি ঘরের কোনা থেকে নিয়ে ওর হাতে দিয়ে নিচু গলায় কিছু বলতেই সে ঘাড় নেড়ে ছুটে গেল। সেদিকে তাকিয়ে নীলা বলল, ‘জানো অনিমেষ, এই বাচ্চাটা আমাকে খুব ভালবাসে। ও না-থাকলে আমি খুব অসুবিধেয় পড়তাম।’

‘কে হয় তোমার?’

‘আমার! কেউ না। নীচের ভাড়াটেদের মেয়ে।’

মাধবীলতা বলল, ‘আপনি কি আমাদের জন্য কিছু আনতে পাঠালেন?’

নীলা বলল, ‘কেন?’

‘আমার কিন্তু একটুও খাবার ইচ্ছে নেই।’

‘কেন?’

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। নীলা প্রশ্ন করছে একই ভঙ্গিতে এবং তাতে এক ধরনের জেদ ফুটে উঠছে। মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, ‘আমার ফেরার তাড়া ছিল।’

‘বেশি দেরি হবে না। রাস্তার ওপাশেই চায়ের দোকান।’ নীলা নিশ্বাস ফেলল।

নীলার বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থা নেই, দোকান থেকে আনাচ্ছে, অনিমেষ কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তা ছাড়া ও যতই সহজ ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করুক, কোথাও একটা অস্বস্তি আছে তা বোঝা যাচ্ছিল। নীলার বর্তমান অবস্থার কারণ না-জানলে কথাবার্তাও বেশিক্ষণ চালানো যায় না। সে হেসে বলল, ‘তুমি বাড়িতে চা তৈরি করো না?’

নীলা মাথা নাড়ল, ‘সামনেই দোকান রয়েছে, ঝামেলা করে কী হবে?’

‘ভদ্রলোককে দেখছি না!’

‘ও বেরিয়েছে। আসবে এক্ষুনি। তোমাদের তো আবার হাতে সময় নেই, না-হলে বলতাম একটু বসে যাও।’ নীলা কথাগুলো শেষ করতেই নীচে থেকে একটা লোক উঠে এল। আধাবয়সি পাকানো চেহারা।

‘দিদিমণি, আমি নন্দ।’

‘নন্দ, নন্দ কে?’

‘অ। দাদাবাবু বুঝি আমার কথা বলেনি?’

‘না তো।’

‘আমার নাম নন্দ বকশি। দাদাবাবু আমাকে সাবলেটের কথা বলেছিল। তা খুব ভাল ভাড়াটে আছে সন্ধানে। দেড়শো অবধি রাজি করানো যাবে মনে হয়। ঘরটা একটু যদি দেখান।’ লোকটা খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল।

নীলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ও ভাড়া দেবে বলেছে?’

‘ভাড়া মানে, আইনসম্মত ভাড়া নয়। সাবলেট।’ নন্দ হাসল, ‘যা বাজার পড়েছে দিদিমণি, চিন্তা করবেন না, দাদাবাবু আমাকে সব বলেছে। খুব ছোট ফ্যামেলি, স্বামী-স্ত্রী আর তিনটে বাচ্চা।’

নীলা বলল, ‘ঠিক আছে, কিন্তু একটু যদি ঘুরে আসেন অসুবিধে হবে?’

‘না না, বিন্দুমাত্র নয়। এই ঘণ্টাখানেক বাদে এলে হবে?’

‘হ্যাঁ।’

নন্দ বকশি চলে গেলে নীলা ঘুরে বলল, ‘এমন জ্বালিয়ে মারে না লোকগুলো! বাড়তি ঘর আছে একটু জানলেই হল।’

অনিমেষ লুকোচুরিটা স্পষ্ট বুঝতে পারল। নীলা অন্তত আর্থিক সুখে নেই। হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতার জন্য ওরা হস্টেল খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার চেয়ে নীলাকে বললে কেমন হয়! নীলারা যখন ঘরটা ভাড়া দিচ্ছেই তখন—। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যে থাকবে তার সঙ্গে কথা না-বলে প্রস্তাবটা করা উচিত হবে না।

এইসময় মেয়েটি চা নিয়ে এল। অনিমেষ দেখল যেভাবে হস্টেলে বাইরে থেকে চা আনিয়ে ওরা ভাগ করে খায় সেভাবে নীলা দুটো কাপ আর একটা টিন থেকে বিস্কুট বের করে ডিশে ঢেলে এগিয়ে দিল।

চায়ের স্বাদ এত বারোয়ারি যে কারও ঘরে বসে খেতে ইচ্ছে করে না। নীলা সেটা বেশ আরামেই চুমুক দিতে দিতে আচমকা বলল, ‘আমার একটা চাকরি দরকার অনিমেষ।’

‘চাকরি!’ অনিমেষ হোঁচট খেল।

‘হ্যাঁ। ওর ওপর খুব প্রেশার পড়ছে। একা সামলে উঠছে না। অনেকগুলো স্কুলে অ্যাপ্লাই করেছি কিন্তু হচ্ছে না। কোথাও মেয়েদের চাকরি খালি আছে শুনলে আমাকে জানিয়ো, কেমন?’ নীলা তক্তাপোশটার ওপর এসে বসল।

অনিমেষ আর পারছিল না, এবার জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, ‘মেসোমশাই, মানে তোমার বাবা এসব জানেন?’

কপালে ভাঁজ পড়ল নীলার, ‘এসব মানে?’

‘তুমি চাকরি খুঁজছ। খুব প্রয়োজন—।’

‘নাঃ। অন্তত আমরা বলতে যাইনি। সত্যি কথা বলতে কী বাবার সঙ্গে সেই বাড়ি ছাড়ার দিন থেকে আমার দেখা নেই।’

‘নেই কেন?’

‘তুমি কিছু শোনোনি?’

মহীতোষকে লেখা দেবব্রতবাবুর চিঠির কথা মনে পড়তে ইচ্ছে করেই সে না বলল না, ‘শুনেছি মানে এইটুকু যে তুমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে বাড়ি থেকে চলে এসেছ, ব্যস।’

‘তুমি সেটা শোনার পর আমাদের বাড়িতে যাওনি?’

‘না।’

‘কেন?’

‘অস্বস্তি হচ্ছিল।’

‘কেন?’

‘ওঁরা ব্যাপারটাকে কীভাবে নিয়েছেন জানি না তাই।’

‘মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে বাপ-মা কীভাবে নেয়? ওঃ অনিমেষ, তুমি এখনও মফস্‌সলি রয়ে গেছ। তুমি গেলে অবশ্য খুব খাতির পেতে কারণ তোমার সঙ্গে আমি বের হইনি। কী ভাই, তুমি কিছু মনে করছ না তো!’ শেষের কথাটা মাধবীলতার উদ্দেশে বলা। সে ওটা শুনে সামান্য হাসল।

চায়ের কাপ মাটিতে নামিয়ে রেখে অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, ‘এমন কী ব্যাপার হয়েছিল যার জন্য একদম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হল?’

‘পে-রে-ম।’ চিবুকে, ঠোঁটে হাসি চলকে উঠল নীলার। নিজেকে নিয়ে এরকম ঠাট্টা চেনাশোনা মেয়ের মধ্যে একমাত্র নীলাই করতে পারে। অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল কিন্তু কথাটা এখনকার নীলার মুখে একদম মানাচ্ছে না। নীলা এই সামান্য সময়েই বেশ ভারী, সেই চটুলতা আর নেই। ইচ্ছাকৃত ভাবে পুরনো সময়টাকে ধরার চেষ্টা কথাবার্তায়।

অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘তোমাকে যা দেখেছি তার সঙ্গে এই অবস্থাটা মেলাতে পারছি না।’

হঠাৎ ফোঁস করে উঠল নীলা, ‘কেন পারছ না?’

‘কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।’

‘সেটা তোমার অক্ষমতা, আমার নয়।’

এইসময় মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, ‘তোমার না-হয় কথা বলো, আমি চলি।’

নীলা বলল, ‘ওমা তা কি হয়! তোমাকে ছেড়ে অনিমেষ এখানে গল্প করবে বসে, এটা কি ভাল দেখায়?’

মাধবীলতা বলল, ‘তাতে কী হয়েছে?’

‘আমার সহ্য হবে না।’

‘এ আপনি কী বলছেন!’

‘ঠিক বলছি। আচ্ছা তোমার সঙ্গে তো ওর বেশ জানাশোনা। কখনও তুমি ওকে আসতে বলেছ কোথাও আর ও সেখানে সময়মতো আসেনি, এমনটা হয়েছে?’ প্রশ্নটা করে নীলা আড়চোখে অনিমেষের চেহারাটা দেখল।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘মনে পড়ছে না।’

‘তবেই দেখো।’ কথাটা মাধবীলতাকে বলে নীলা অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার মনে পড়ে!’

‘পড়ছে। সেদিন আমার পায়ে খুব—।’

অনিমেষকে থামিয়ে দিল নীলা, ‘না, কোনও কৈফিয়ত শুনতে চাই না। যে-কোনও কারণেই হোক তুমি আসতে পারোনি। আমি তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি না যে তুমি সাফাই গাইবে। আসলে সেদিন আমাকে খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। একা ভেবে উঠতে পারছিলাম না বলে তোমাকে আসতে বলেছিলাম।’

নীলা ওদের বারান্দা অবধি এগিয়ে দিল। এতক্ষণ নীলার কথাবার্তা বলার ধরন অনিমেষের ভাল লাগছিল না। কিন্তু একটা প্রশ্ন বারবার তাকে বিদ্ধ করছিল, নীলার স্বামী কে? এত বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ও কোন ভাগ্যবানকে বিয়ে করল? যাকে করল তার আর্থিক অবস্থা যখন এইরকম তখন এমন কী বিশেষ যোগ্যতা তার আছে! সে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আর একদিন এসে তোমার মিস্টারের সঙ্গে আলাপ করে যাব।’

‘যেয়ো।’ আবাহনও নেই বিসর্জনও নেই।

চোখের আড়াল না-হওয়া পর্যন্ত নীলাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অনিমেষ। বেশ রাত হয়েছে। মাধবীলতা দ্রুত হাঁটছিল। অনিমেষ পাশাপাশি চলতে চলতে বলল, ‘কেমন দেখলে?’

‘কী?’ মাধবীলতা কিছু ভাবছিল। প্রশ্নটা বুঝতে সময় নিল।

‘নীলাকে।’

‘ভালই তো।’ হাসল মাধবীলতা, ‘তোমার খুব বন্ধু ছিলেন উনি?’

‘তা একরকম বলতে পারো, আবার নাও পারো। কলকাতায় আসার পর হাসপাতাল থেকে গিয়ে যাদের বাড়িতে আমি থেকেছিলাম সেই ভদ্রলোকের মেয়ে নীলা। তখন ও অত্যন্ত আধুনিকা, আমার পক্ষে পাল্লা দেওয়া মুশকিল ছিল এবং সে চেষ্টাও আমি করিনি। আসলে আমি ওকে বুঝতে পারি না। প্রথম দিনই ও আমাকে বলেছিল, ওর নাম নীলা এবং সেটা অনেকের সহ্য হয় না। বোঝো!’ অনিমেষ হাসল।

‘মুখের ওপর সত্যি কথা বলেছিলেন।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সেই মেয়ে যখন এরকম আর্থিক অনটনে রয়েছে স্রেফ জেদের বশে বিয়ে করে, আজ কেমন অস্বস্তি হয়।’

‘কেন? উনি যদি বৈভবের চেয়ে এই কষ্টটাকেই আনন্দের মনে করেন তা হলে তোমার চিন্তা করার কী আছে। ভালবেসে যখন কেউ সিদ্ধান্ত নেয় তখন সে অনেক কিছু অবহেলায় ছেড়ে আসতে পারে। বিশেষ করে মেয়েরা।’ মাধবীলতা গাঢ় গলায় কথাগুলো বলল।

কথাটা মানতে পারল না অনিমেষ, ‘সব কৃতিত্ব মেয়েদের হবে কেন? পৃথিবীর সিংহাসন এক কথায় ছেড়ে দিয়ে ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন যিনি তিনি পুরুষ।’ কথাগুলো বলার সময়েই মনে হল মাধবীলতা কি নিজের কথাই বলছে না? আজ যে হস্টেল খোঁজার প্রয়োজন হল সেটা তো তাকে ভালবেসে, কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সেইজন্যেই। অথচ তাকে এই মুহূর্তে কিছুই ছেড়ে আসতে হচ্ছে না। এ অবস্থায় ওর সঙ্গে তার তর্ক করা সম্পূর্ণ অনুচিত।

মাধবীলতা কিন্তু অনিমেষের কথাটাকে তেমন আমল দিল না। শ্যামবাজারের মোড়ে পৌঁছে বলল, ‘তুমি কিন্তু কালকের মধ্যেই হস্টেলের চেষ্টা করবে, করবে তো?’

‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তুমি ভেবো না। ওহো, তখন নীলার বাড়িতে বসে একটা কথা মাথায় এসেছিল। বলব বলব করেও বললাম না।’ অনিমেষ জানাল।

‘কী?’ মাধবীলতা মুখ তুলল।

‘নীলারা যখন একটা ঘর ভাড়া দিতেই চাইছে তখন সেটা তুমি যদি নিতে তা হলে কেমন হত! হয়তো একটু বেশি খরচ হত—।’ অনিমেষ তাকাল ওর দিকে।

‘যাঃ, তা কি হয় কখনও! আমি খাব কোথায়? স্কুলে যা মাইনে দেবে সবই বেরিয়ে যাবে।’ তারপরেই গলা পালটে গেল মাধবীলতার, ‘ওই মহিলাও আমাকে ভাড়া দিতেন না।’

‘কেন? আমি বললে নিশ্চয়ই দিত।’

‘তুমি ঠিক বুঝবে না।’

‘উঁহু, নীলাকে তুমি বুঝতে পারোনি।’

‘তুমি বুঝেছ?’

‘অনেকটা।’

মাধবীলতা হাসল। তারপর নরম গলায় বলল, ‘উনি যে খুব শিগগির মা হতে যাচ্ছেন এটা বুঝতে পেরেছ?’

অনিমেষ চমকে উঠল। যাচ্চলে! এতক্ষণ ওরা বসেছিল কিন্তু একবারও সে এসব চিন্তা করেনি। চোখেও পড়েনি কিছু। এককালে মনে হত যে মেয়েদের সিঁদুর পরাটা বুঝতে পারে না। কে বিবাহিতা কিংবা অবিবাহিতা সিঁথি দেখে ঠাওর করতে পারে না। মেয়েরা কী একটা কায়দায় সেটাকে বেশ লুকিয়ে রাখতে পারে। আবার নীলার সামনে বসে থেকেও ওর আসন্ন মাতৃত্ব টের পায়নি। এটাও কি আজকাল লুকিয়ে রাখা যায়? কিংবা মেয়েদের এইসব ব্যাপার মেয়েরাই বিশেষ চোখে দেখতে পায় যেটা পুরুষদের থাকে না।

অনিমেষ হাসল, ‘না পারিনি, হার মানছি।’

মাধবীলতা প্রসঙ্গ পালটাল, ‘যা হোক, আমি হস্টেলে থাকতে চাইছি আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে। কোথাও ঘর ভাড়া করে থাকলে নানান কথা উঠবে। একটা মেয়ে একলা আছে জানলে লোকের কৌতূহল বাড়েই। তা ছাড়া তুমিও তখন হুটহাট চলে আসবে আমার ঘরে সেটাও আমি চাই না।’

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল, ‘আমি তোমার কাছে যাই এটা চাইছ না?’

‘ভুল করলে। আমি হস্টেলে থাকলে তুমি দেখা করতে যাবে বই কী। কিন্তু একটা ঘরে আমি একলা স্বাধীনভাবে আছি, সেখানে তুমি আসো এটা আমি চাই না।’ মাধবীলতা নির্দ্বিধায় বলল।

‘তুমি তা হলে আমাকে বিশ্বাস করো না!’ অনিমেষের খুব খারাপ লাগছিল কথাগুলো শুনতে। আচমকা যেন মাধবীলতা সম্পর্কটাকে বদলে দিচ্ছে।

‘তোমাকে নয়, আমি নিজেকেই বিশ্বাস করি না।’ মুখ নিচু করল মাধবীলতা। যেন গভীর চাপ থেকে হুশ করে ওপরে উঠে এল অনিমেষ, উঠেই মনে হল ওই চাপ কতটা কষ্টদায়ক এবং সেটা মাধবীলতাকে এই মুহূর্তে নুইয়ে ফেলেছে। এরকম অকপট স্বীকারোক্তি যে মেয়ে করতে পারে— অনিমেষের ইচ্ছে করছিল মাধবীলতার হাতটা জড়িয়ে ধরে কিন্তু এই হাজার মানুষের ভিড়ে তা সম্ভব নয়।

এইসময় একটা আটাত্তরের সি বাস এসে থামতেই মাধবীলতা বলল, ‘আমি চলি।’

‘কালকে আসছ?’

‘দেখি।’

‘না, এসো।’

মাধবীলতা হাসল। তারপর বাসে উঠে দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে রইল ভিড়ের মধ্যে যতক্ষণ অনিমেষকে দেখা যায়।

আমহার্স্ট স্ট্রিটের মেয়েদের হস্টেলে জায়গা পাওয়া গেল। মাধবীলতা চলে গেলে অনিমেষ থ্রি বি বাস ধরে সোজা চলে এসেছিল এখানে। চট করে হস্টেল কিংবা মেস বলে মনে হয় না। লাল বাড়িটার সামনে চিলতে বাগান, শৌখিন মানুষের বাড়ি বলেই মনে হয়। রাত হয়েছে কিন্তু অফিস ঘরটা তখনও খোলা ছিল। অনিমেষ দেখল একজন বয়স্কা মহিলা টেবিলের ওপাশে বসে আছেন। চোখে চশমা, গোল মুখ, সাদা শাড়ি, বেশ ভারিক্কি ভাব। দরজায় দাঁড়িয়ে নমস্কার করতেই ভদ্রমহিলা মুখ তুললেন, ‘আসুন’। গলার স্বরে ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট।

‘আমি হস্টেলের সুপারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘বসুন।’ অনিমেষ চেয়ার টেনে বসলে মহিলা হাসলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন।’

‘আপনিই কি-?’ অনিমেষ ইতস্তত করছিল।

‘হ্যাঁ।’

‘এই হস্টেলে সিট খালি আছে?’

‘আছে। গতকাল খালি হয়েছে।’

অনিমেষ স্নান করার তৃপ্তি পেল। যে-ক’টা হস্টেল ওরা আজ দেখেছে এইটে তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল। এখানেই যদি জায়গা পাওয়া যায় তা হলে সৌভাগ্যই বলতে হবে। সে মহিলার দিকে ঝুঁকে বলল, ‘এই হস্টেলে জায়গা পেতে হলে কোনও নিয়মকানুন পেরিয়ে আসতে হয় কি?’

‘নিয়মকানুন?’ মহিলার চোখে সামান্য বিস্ময়, ‘হ্যাঁ, বোর্ডারকে অবশ্যই মহিলা হতে হবে।’

‘সে তো বটেই। আমি তা বলছি না। আমি জানতে চাইছিলাম এটা কি ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেল না স্টুডেন্টস হস্টেল?’ অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

‘মূলত এটা ছাত্রীদের হস্টেল ছিল তবে এখন কেউ কেউ চাকরিও করে।’ মহিলা এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘যাঁর জন্যে জায়গা খুঁজছেন তিনি আপনার কে হন?’

‘আত্মীয়।’ উত্তরটা অনিমেষ আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল।

‘আপনি কী করেন?’

‘আমি এবার এম. এ. দেব। আমিও হস্টেলে থাকি।’

‘আত্মীয় মানে, আপনার বোন?’

বোনের মতো বলতে গিয়ে অনিমেষ সামলে নিল। এক পলক মাত্র, তবু তার মধ্যেই অনিমেষ ঠিক করে ফেলল সত্যি কথাই বলবে। ওরা অন্যায় কিছু করছে না অতএব তার মুখোমুখি হতে বাধা কী! সে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আমার এক সহপাঠিনী সম্প্রতি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। কোনও কারণে তাঁর পক্ষে বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ওঁর জন্যেই জায়গা খুঁজছি।’

মহিলা এতক্ষণ যে ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন অনিমেষের উত্তর শোনার পর সেটা পালটে গেল। চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ অনিমেষকে দেখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা হলে আত্মীয় বললেন কেন?’

‘আমি আত্মীয় বলেই ওকে মনে করি।’

আস্তে আস্তে মহিলার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ‘কিন্তু এখানে থাকতে হলে বাবা-মা অথবা ওরকম কাউকে গার্জেন হতে হয়। তাই নিয়ম।’

‘সেটা সম্ভব নয়। আমি শুধু এ-কথাই বলতে পারি আপনার হস্টেলের অন্য মেয়েরা যে আচরণ করে সে তার থেকে ব্যতিক্রম হবে না।’ এইভাবে কথা বলতে অনিমেষের আর অসুবিধে হচ্ছে না। ওর চেতনায় একটা ক্ষীণ অনুভব হচ্ছিল যে এরকম কথা যেহেতু কোনও বয়স্কা মহিলার পছন্দসই নয় তাই মাধবীলতা এখানে জায়গা পাবে না। তা সত্ত্বেও সে সত্যি কথা বলতে চাইল। মাধবীলতা প্রাপ্তবয়স্কা, নিজের ভালমন্দ বোঝে, তাকে কারও আশ্রয় বিনা এঁরা গ্রহণ করবেন না কেন? প্রয়োজনে সে তর্ক করে যেতে পারে। এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথা বলার সময় এসেছে।

‘উনি এম. এ. পড়ছেন বলছিলেন, তখন কি বাড়িতে থাকতেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখন সেটা সম্ভব নয়?’

‘নয় বলেই তো এসেছি।’

‘এ ব্যাপারে ওঁর বাড়ির লোক কোনও আপত্তি করবেন না তো?’

‘প্রাপ্তবয়স্কা বোর্ডার নিয়ে ঝামেলা হবে কেন?’

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন মহিলা। তারপর বাঁ দিকের ড্রয়ার খুলে একটা ফর্ম বের করে অনিমেষের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘আপনি সত্যি কথা স্পষ্ট বলতে পেরেছেন বলে আমার কোনও আপত্তি থাকছে না। আই লাইক ইট। কিন্তু কোনওরকম বাজে ঝামেলা আমি চাইব না, সেটুকু মনে রাখবেন।’

একটা রূঢ় কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে অনিমেষ ফর্মটা ভরতি করতে গেল। সঙ্গে কোনও কলম নেই। ভদ্রমহিলা সেটা বুঝতে পেরে একটা কলম এগিয়ে দিলেন। নাম, বয়স, কী পড়ে অথবা অন্য কিছু করে কিনা, বাড়ির ঠিকানা, গার্জেনের নাম পরপর জানতে চাওয়া হয়েছে। সেগুলোর জবাব লিখতে লিখতে গার্জেনের নামের বেলায় অনিমেষ ইতস্তত করতে লাগল। ভদ্রমহিলা এতক্ষণ লক্ষ রাখছিলেন। এবার হেসে বললেন, ‘আপনার নাম আর ঠিকানা লিখুন।’

ব্যাপারটা খুবই সামান্য কিন্তু নিজের নাম লিখতে গিয়ে অনিমেষ বুকের মধ্যে শিরশিরানি অনুভব করল। এই প্রথম কাগজে-কলমে মাধবীলতার সঙ্গে তার নাম জড়িত হল। মাধবীলতা কোনও অন্যায় করলে হস্টেল কর্তৃপক্ষ তাকে জানাবে। যেন অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব নিল সে আজ থেকে এইরকম বোধ হচ্ছিল।

ফর্ম ভরতি করে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কত দিতে হবে?’

‘এক মাসের চার্জ, আর আনুষঙ্গিক কিছু।’

পকেটে একশোটা টাকা আছে। অনিমেষ ইতস্তত করল। এতে অবশ্যই কুলোবে না। সে বলল, ‘এক কাজ করুন, এখনই রসিদ লিখবেন না। আমার কাছে একশো টাকা রয়েছে। ওটা আমি দিয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল কিংবা পরশু বাকি টাকাটা দিয়ে দেব। ও সামনের মাসের পয়লা তারিখ থেকেই থাকবে। অসুবিধা হবে?’

মহিলা বললেন, ‘আপনার উচিত ছিল সঙ্গে টাকাটা আনা। যা হোক, এখন কিছু দিতে হবে না। দু’দিনের মধ্যে টাকা দিয়ে যাবেন।’

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, ‘আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।’

ভদ্রমহিলা কোনও কথা বললেন না। কিন্তু অনিমেষ দেখল উনি ঠোঁট টিপে হাসছেন।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই একটা হইচই শব্দ উঠল। কেশব সেন স্ট্রিট থেকে একদল ছেলে ছুটে আসছে। এ পাশের লোকজন পালাচ্ছে। তারপরই দুম দুম করে কয়েকটা বোমা ফাটল চৌমাথায়। চারধারে লোক আতঙ্কে আড়ালে যাচ্ছে। অনিমেষ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখল। একটা ছেলে, রোগা, ঢ্যাঙা, হাতে দুটো বোম নিয়ে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, শাসাচ্ছে কাউকে। তার ভয়ে জায়গাটা এখন মধ্যরাতের মতো নির্জন।

অনিমেষের ইচ্ছে হল ওকে জিজ্ঞাসা করে কেন সে এমন করছে! কিন্তু তখনই ছেলেটা আবার দৌড়ে কেশব সেন স্ট্রিটে ফিরে গেল। কয়েক পা হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের খেয়াল হল এই জায়গাটা ভাল নয়। কাগজে দেখেছে প্রায়ই গোলমাল লেগে থাকে এখানে। বোমবাজি হয়। এইরকম জায়গায় মাধবীলতাকে থাকতে হবে। ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হতে গিয়েই হেসে ফেলল সে। আজ নয় কাল, সারা বাংলাদেশেই যদি এরকম হয়ে যায়, তা হলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *