৪০. খুব পাকা জুয়াড়ীও

চল্লিশ

খুব পাকা জুয়াড়িও ভাবতে পারেনি, কংগ্রেস এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে গরিষ্ঠতা হারাবে। কয়েকটি ব্যাপারে যে প্রতিকূল পরিস্থিতি হয়েছিল তার জন্যে এমন ভরাডুবি হবে তা বিরোধীরাও আশা করেনি। মুশকিল হল কংগ্রেস হারলেও কোনও দলই একক গরিষ্ঠতা পেল না।

আদর্শের যে কেতাবি কথাবার্তা এতকাল পার্টিগুলো শুনিয়েছে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ বিরোধী চিন্তার শক্তির সঙ্গে হাত মেলাল এবার। কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত এক নেতার তৈরি জোতদারের সমর্থনপুষ্ট মুষ্টিমেয় এম এল এ নিয়ে নির্বাচিত দলকে সামনে রেখে ময়দানে জনসভা করল মার্ক্সপন্থীরা। কারণ, মন্ত্রিত্বের ব্যাপারে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্টদের অন্যান্য দলগুলো বিশ্বাস করতে পারছিল না। অল্প ক’দিন আগে ভোট পাওয়ার জন্যে যারা খেয়োখেয়ি করেছে তারাই একসঙ্গে দাঁত বের করে হাসল।

অনিমেষরা দেখল, শুধু মন্ত্রিত্ব পাওয়ার জন্যে কম আসন পাওয়া গাঁধীবাদী নেতাকে শিখণ্ডী করে কমিউনিস্ট পার্টি রাইটার্স বিল্ডিং-এ বসার স্বপ্ন সার্থক করল। এমনকী স্বরাষ্ট্র দপ্তর পাওয়ার জেন্য তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে উপমুখ্যমন্ত্রী নামে একটি নতুন পদের উপঢৌকনে সন্তুষ্ট হতে হল। কিন্তু প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছিল, এ সবই হচ্ছে জনসাধারণের চাপে। নেতারা গোলাম হোসেনের গলায় ঘোষণা করলেন, জনসাধারণের রায় মাথা পেতে নিলাম। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হল।

পার্টির বিরুদ্ধে এতকাল যে অভিযোগ বিক্ষুব্ধরা করত তা আরও সত্য বলে প্রমাণিত হল তাদের কাছে। যারা ইতিমধ্যে পার্টি থেকে বেরিয়ে এসেছিল তারা আশা করিছল এরকম আদর্শহীন দল থেকে এবার অনেকেই তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু কার্যত তা হল না। পার্টির এই আচরণের যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেওয়া হল। যে-কোনও অপরাধী তার সমর্থনে বড় যুক্তি তৈরি রাখতে পারে যদি তাকে জেরা করার সুযোগ না-দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পার্টিকে জেরা করা মানে দলবিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়া।

অনিমেষরা আশা করেছিল নির্বাচনে হেরে গেলে মার্ক্সবাদীরা সংসদীয় গণতন্ত্রের মেকি পথ ছেড়ে আসবে। বস্তুত এ সম্পর্কে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল। একটি রাজ্য সরকার হাতে পাওয়া মানে কোনওভাবেই দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা নয়। এই শাসন ব্যবস্থায় সমস্ত ক্ষমতা যখন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তখন একটি রাজ্য সরকার কিছুই করতে পারে না। কিন্তু কার্যত দেখা গেল মার্ক্সবাদীরা এতেই সন্তুষ্ট হয়ে পড়ছেন। কেন্দ্রের কাছ থেকে আরও ক্ষমতা পাওয়ার জন্যে মাঝে মাঝে আবেদন নিবেদন চলছে।

অনিমেষরা বুঝে নিল যা করবার তাদের একাই করতে হবে। এ দেশে থিয়োরি আর প্র্যাকটিসের মধ্যে যে আকাশ-জমিন ফারাক তা ওরা যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে কাজ করছিল তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে বল গড়াতে শুরু করেছে। উত্তেজনা মানুষকে একত্রিত করে। অনিমেষরা পশ্চিমবাংলা ছাড়িয়ে এখন সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল।

কিন্তু একথা ঠিক, মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ জনসাধারণের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছিল। তাঁরা চাইছিলেন সরকারে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র, আমলাদের চেহারা, বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশের আসল রূপ কৃষকদের সামনে ভালভাবে তুলে ধরতে। নির্বাচনের আগে তাঁরা কৃষকদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলোর প্রতি এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব তাঁরা বোধ করছিলেন। কিন্তু সরকারে গিয়ে এসব সংস্কার করতে গিয়ে অন্য শরিক দলের কাছ থেকে এঁরা বাধা পেলেন। অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ এবং বর্গাচাষি উচ্ছেদ বন্ধের একটা চেষ্টা তাঁরা করলেন যা বিচার ব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রের বাধায় অকেজো হল।

১৮ই মার্চ ১৯৬৭ তারিখে মার্ক্সবাদীরা শিলিগুড়ি মহকুমা শাখার উদ্যোগে একটি কৃষক সভা করেন। জমির ওপর ভূমি মালিকদের একচেটিয়া অধিকারের অবসান, কৃষক সমিতির মাধ্যমে জমির সুষম বণ্টন, জোতদারদের উৎখাত করার জন্যে কৃষকদের সশস্ত্র করার একটা কর্মসূচি নেওয়া হল। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, যখন যুক্তফ্রন্টের পুলিশ কৃষকদের নির্মমভাবে হত্যা করছে তখন সরকারে থেকেও মার্ক্সবাদীরা সামান্য প্রতিবাদ ছাড়া কিছু করতে পারেনি। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালালেও তাঁরা মন্ত্রিত্বে থেকে যান এবং সেই পথেই কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা করেন।

প্রথম বিস্ফোরণ ৬৭ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে, শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়িতে। দলে দলে গরিব, শুকিয়ে যাওয়া কৃষকরা বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে বেনামি জমি দখল করতে। জোতদাররা প্রতিরোধ করল বন্দুক হাতে। কিন্তু মানুষ যখন মরিয়া হয় তখন সে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। সে সময় তাকে দাবিয়ে রাখা শক্ত। কৃষকরা ব্যাপক হারে জমি দখল করতে লাগল। জোতদারের হাত শক্ত করল পুলিশ। স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাওয়া গরিব কৃষকের রক্ত ঝরল। তারা চেষ্টা করল পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে, জোতদারকে নিরস্ত্র করতে। কিন্তু বিনিময়ে মহিলা এবং শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা করল পুলিশ। নকশালবাড়ির মাটিতে যে রক্ত ঝরল তার প্রতিবাদে কোনও রাজনৈতিক দল কিন্তু গলা খুলল না। যুক্তফ্রন্টে বাস করে মার্ক্সবাদীরা কিছুটা প্রতিবাদ জানানোর ঝুঁকি নিয়ে চুপ করে গেল। কারণ তখন সারা দেশে একটা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে মার্ক্সবাদীরা নাকি খুব কট্টর। তাদের মনোভাব জঙ্গি। শক্তি প্রয়োগ ছাড়া অন্য চিন্তা করতে পারে না। ফলত তাঁদের সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি অন্য শরিক দলের মধ্যে সঞ্চারিত হল। তারা এদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হল। তাই নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে মার্ক্সবাদীরা এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হল না। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্টেক বাঁচানো গেল না। পরস্পরকে প্রতিনিয়ত সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করে একটি পরিবার কখনও টিকে থাকতে পারে না।

নকশালবাড়িতে যে আন্দোলনের সূচনা হল তা সেখানেই আপাতদৃষ্টিতে থেমে গেলেও সারা দেশে তার প্রতিক্রিয়া হল ব্যাপক। এই আন্দোলনের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, ত্রিপুরা, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, অসম ইত্যাদি রাজ্যে ভূমিহীনদের জন্যে জমি দাবি, জোর করে বাড়তি জমি দখলের চেষ্টা, উচ্ছেদ হওয়া বর্গাদাররা মাঠের ফসল কেটে নিতে চেষ্টা করতে লাগল। নকশালবাড়িতে যে রক্ত ঝরেছিল কৃষকের শরীর থেকে তা যেন সমস্ত নিরস্ত্র কৃষকদের বুকে ছড়িয়ে পড়ল।

অনিমেষ এতদিন সংবিধানের কাজে ব্যস্ত ছিল। শিলিগুড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ। নকশালবাড়ির আন্দোলনের পর সারা দেশে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। বেশিরভাগ সময়েই তাকে এবং তার সঙ্গীদের গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হত। একটা ব্যাপার অনিমেষকে প্রায়ই চিন্তিত করত। এত কাছে নকশালবাড়িতে যে ঘটনা ঘটে গেল তার কোনও প্রতিক্রিয়া মধ্যবিত্ত কিংবা শ্রমজীবীদের মধ্যে হচ্ছে না। যেন, এসব করে কৃষকেরা জমি পাচ্ছে তাতে আমাদের কী— এইরকম প্রবণতা দেখা দিচ্ছিল। অনিমেষরা আজ সারা দেশে ব্যাপকভাবে নকশালবাড়ির সমর্থনে পোস্টার ফেলছে। ছোট ছোট জনসভা করছে। ওরা ধরে নিচ্ছিল এইভাবে ওরা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পারবে।

খুঁটিমারি জঙ্গলের মধ্যে অনিমেষের সাময়িক আস্তানাটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। সিরিল প্রায়ই খবর আনছিল যে স্বর্গছেঁড়া অঞ্চলে পুলিশি তৎপরতা বাড়ছে। এখন সারা দেশ গরম। কাগজ খুললেই পুলিশের সঙ্গে নকশালপন্থীদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কথাটা ভাবলে অনিমেষের অবাক লাগে। যেহেতু নকশালবাড়িতে প্রথম বিস্ফোরণ তাই একটা দলের নাম চিহ্নিত হয়ে গেল নকশালপন্থী বলে? অন্ধ্রপ্রদেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কেউ নিহত হলে তাকে বলা হয়েছে নকশাল। কেন? অবশ্যই নিজেদের নকশালবাড়ির কৃষকদের উত্তরসূরি বলতে গর্বিত বোধ করার কারণ আছে কিন্তু সমস্ত দেশে যখন বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা চলছে তখন একটা ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে নিজেদের পরিচয় আবদ্ধ করা কেন? এ সবই বুর্জোয়া মানসিকতার ফসল কিন্তু তারাও ক্রমশ সেটা মেনে নিচ্ছে।

নির্দেশ এসেছে এই এলাকায় যত ব্যক্তিগত মালিকানায় বন্দুক আছে তা জোর করে ছিনিয়ে নিতে হবে। সেই লিস্ট এখন অনিমেষের হাতে। আজ রাত্রে প্রথম অ্যাকশনে বের হবে সে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটুও উত্তেজনা বোধ হচ্ছিল না। সিরিল এবং সে ছাড়া এই তথ্যটি কাউকে জানানো হয়নি। বিকেল হয়ে যাওয়া এই সময়টায় অনিমেষ একা বসে ছিল। বড় বিষণ্ণ লাগে এই সময়টা। তার ওপর জলো বাতাস বইছে। ভুটানের পাহাড় থেকে মেঘ ভেসে আসছে ক’দিন থেকে। প্রথম বর্ষণ শেষ হবার পর কিছুদিন প্রকৃতি চুপচাপ ছিল। এখন যে বর্ষা নামবে তা চলবে একটানা। সময়টা অবশ্যই অ্যাকশনের পক্ষে উপযুক্ত।

সন্ধের খানিক বাদে জুলিয়েন এল। সঙ্গে সিরিল। মালবাজার-মেটেলি অঞ্চলে কাজ করছে জুলিয়েন। আজ ওর আসবার কথাও নয়। অনিমেষ হাত মিলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ এখানে?’

‘কিছু টাকার দরকার। কিছু ভাল মাল আসছে পাকিস্তান থেকে।’

‘কী আছে?’

‘যা আছে তাতে একটা থানা উড়ে যাবে।’

অনিমেষ বলল, ‘ভালই হল। চলুন, দেখি কপালে কী আছে আজ।’ তারপর সে জুলিয়েনকে আজকের পরিকল্পনার কথা খুলে বলল। সিরিল চুপচাপ শুনছিল, শেষ হলে বলল, ‘আজ রাত্রেই এখান থেকে হাওয়া হয়ে যেতে হবে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলেছি।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কার গাড়ি?’

‘পানিরামেরই। ওর গ্যারেজে তিনটে জিপ আছে। চাবি কার কাছে থাকে আমি জেনে এসেছি।’

জুলিয়েন বলল, ‘কাজ শেষ হলে কোথায় যাওয়া হবে?’

‘শিলিগুড়ি চলে যাব।’

‘মোটেই তা করতে যাবেন না। শিলিগুড়ি এখন খুব গরম। রাত্রে জিপ দেখলে পুলিশ ছাড়বে না।’

‘কিন্তু একটা বড় শহরে গিয়ে গা-ঢাকা না-দিলে মুশকিল হবে। শিলিগুড়ি ছাড়া আর কিছু তো মাথায় আসছে না।’

‘জিপ নিয়ে সোজা নাগরাকাটায় চলে যান। সেখানে রাতটুকু কাটিয়ে ভোরের ট্রেন ধরে হাসিমারায় ফিরে আসবেন। ওখান থেকে ভুটানের বর্ডার মিনিট পনেরোর রাস্তা। পুলিশ জিপ খুঁজে পেলে ভাববে শিলিগুড়ির দিকেই গিয়েছেন। আবার উলটো রাস্তায় ফিরে যেতে পারেন এ-কথা ওদের মাথায় ঢুকবে না।’

নাগরাকাটায় অনিমেষ কখনও যায়নি। হাসিমারায় গিয়েছে, ওখান থেকে ফুন্টশিলিং; খুব কাছে। পাশেই নদীর ওপর বিরাট বাঁধের কাজ হচ্ছে। সেখানে ওদের কিছু লোক আছে। আস্তানা পেতে অসুবিধে হবে না। জুলিয়েনের পরিকল্পনা তাই ওর খুব পছন্দ হল। লোকটার মাথায় খুব স্বাভাবিক ব্যাপারটা চমৎকার খোলে।

রাত বারোটায় একদম মৃত হয়ে যায় স্বর্গছেঁড়া। কোথাও সামান্য শব্দ নেই। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অনিমেষ আর জুলিয়েন স-মিলগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল। সিরিলকে বলা হয়েছে মেছুয়া পুল থেকে স্কোয়াডের বাকি সবাইকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেখানে চলে আসতে। অনিমেষের একটুও উত্তেজনা আসছিল না। সে একবার পেটের ভেতর গোঁজা অস্ত্রটা দেখে নিল। সুবাসদার দেওয়া জিনিসটা খুব ভাল। একদিন বৃষ্টির রাত্রে সে নিয়ম-কানুন মেনে পরীক্ষা করেছিল। হাত কাঁপেনি, কিন্তু একটি গুলি ছোড়ার অভিজ্ঞতা ছাড়া তার কোনও সম্বল নেই। বরং জুলিয়েনের হাতের ঝোলার মধ্যে যে মালগুলো আছে তা অনেক নিরাপদ। অ্যাকটিভ করে ছুড়ে দাও। একসঙ্গে অনেকটা জায়গা উড়ে যাবে।

অনিমেষে চারপাশে তাকাল। সামনেই ওদের স্কুল। এখন অবশ্য নামেই স্কুল, আসলে কিছু ভাঙাচোরা টিনের ঘর আর পুজো মণ্ডপ। আসল স্কুল হচ্ছে ওপাশে মাঠের গায়ে। কিন্তু এখানেই ভবানী মাস্টার ওদের পড়াতেন। সেই সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট এই স্কুলের সামনে সে জাতীয় পতাকা তুলেছিল। কানের পরদায় এখনও বন্দেমাতরম চিৎকারটা মাখামাখি হয়ে আছে। অনিমেষ হাসল, সেসব শৈশব-স্মৃতি সুদৃশ্য রাংতায় মোড়া যেন।

ছায়ায় ছায়ায় সিরিল বেরিয়ে এল, ‘রেডি’।

জুলিয়েন বলল, ‘তুমি চলে যাও আগে। হাওয়া দেখলে সিটি দেবে। আমরা আসছি।’

মোট আট জন। অনিমেষ এদের প্রত্যেককে চেনে। একটা সুবিধে এই যে এদের কারও নাম পুলিশের খাতায় নেই। কিন্তু ছেলেগুলোর মুখচোখ দেখে অনিমেষ বুঝতে পারছিল এরা ঠিক স্বাভাবিক নেই। সে ওদের সামনে গিয়ে বলল, ‘কমরেডস, আজ আমরা যা করতে যাচ্ছি তা এই দেশের জন্যেই। মনে কোনও সংকোচ রাখবেন না কেউ।’

ছেলেগুলো কোনও কথা বলল না। অনিমেষ জানে সিরিল ওদের যা বোঝানোর বুঝিয়েছে। দুটো দলে ভাগ হয়ে ওরা রাস্তা পার হল। বৃষ্টির জল মাথায় জমছে। ভাগ্যিস এখন মেঘ ডাকছে না, কারণ বিদ্যুৎ ঝলসালে অসুবিধেয় পড়তে হত।

চৌমাথায় এসে ওরা পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। পানিরামের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিঝুম এই রাতে সেখানে একটাও আলো নেই। এই সময় সিটি বাজল। তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আচমকা কানের পরদায় স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে ঢুকে যেতেই অনিমেষ সোজা হয়ে দাঁড়াল।

পাঁচিলটা কাঁধ বরাবর। ওরা সবাই ডিঙিয়ে এপারে চলে এল। গেটে ভেতর থেকে তালা দেওয়া। একজন একটা ছোট লোহার রডের চাপ দিয়ে তালাটাকে খোলার চেষ্টা করতেই শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর ডেকে উঠল ভেতরে। ততক্ষণে তালা খুলে গেছে। ওরা চট করে বাড়ির দেওয়ালের দিকে সরে এল। কুকুরটা তখন প্রবল শব্দে ডেকে যাচ্ছে। একটা মানুষের গলা শোনা গেল। কুকুরটাকে ধমকাচ্ছে।

কিন্তু আরও মরিয়া হয়ে উঠল ওর গলার শব্দ। অস্বাভাবিক ব্যবহার দেখে লোকটা ঝুঁকে পড়ে বাইরের দিকটা দেখতে চেষ্টা করে হাঁকল, ‘দারোয়ান, দারোয়ান!’

গেটের ডানদিকে দরজা-বন্ধ একটা ছোট ঘর থেকে উত্তর এল, ‘জি সাব।’

‘শালা শুয়ারকি বাচ্চা! রাতভর নিদাতা। দেখো বাহার মে কেয়া হুয়া!’

অনিমেষ দেখল ছোটঘরের দরজাটা খুলে গেল। একটা মাঝবয়সি লোক সন্দেহ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। অনিমেষরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চট করে নজর পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু অনিমেষ চট করে ভেবে নিল, লোকটাকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। ওপরের লোকটা তখনও ঝুঁকে আছে বারান্দায়। কুকুরের চিৎকারও কমেনি। গেটের তালা যে ভাঙা হয়েছে দারোয়ান বোধহয় ভাবতে পারেনি কারণ সেটা ফাঁক করা ছিল না। একটু অসতর্ক হয়েই লোকটা ঘুরে দেখার জন্যে এপাশে এল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ওর খুব অস্বচ্ছন্দ হচ্ছিল, তা ছাড়া রাতদুপুরে বিছানা ছেড়ে উঠে আসার আলসেমিও হয়তো চোখে জড়িয়ে ছিল। অনিমেষরা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে লোকটাকে লক্ষ করছিল। কাছাকাছি আসতেই সিরিল আচমকা ওর মাথায় আঘাত করল। একটাও শব্দ বের হল না, কাটা কলাগাছের মতো লোকটা মাটিতে নেতিয়ে পড়ল। ওরা দ্রুত শরীরটাকে কার্নিশের নীচে নিয়ে এল যাতে ওপর থেকে এ ব্যাপারটা দেখা না-যায়।

তখনই ওপর থেকে চিৎকার এল, ‘দারোয়ান, সব ঠিক হ্যায়?’

কোনও উত্তর না-পেয়ে লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, ‘আরে এ হারামি, কাঁহা হ্যায় তুম?’

অনিমেষ ইশারায় সবাইকে চুপ করে থাকতে বলে গুটিগুটি করে বারান্দায় উঠে এসে সদর দরজার পাশে দাঁড়াল।

কিছুক্ষণ হাঁকাহাঁকির পর বোধহয় লোকটার মনে সন্দেহ ঢুকল। কুকুরটাকে টানতে টানতে সে ভেতরে ঢুকে গেল। জুলিয়েন অনিমেষের পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওরা অ্যালার্ট হবার আগে আমাদের ঢোকা উচিত।’

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ‘না। ওরা কিছুই আন্দাজ করতে পারবে না। ওয়েট করুন।’

ভেতরে তখন অনেকগুলো গলা কথা বলছে। তারপর পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অনিমেষরা ততক্ষণে প্রস্তুত। বিরক্ত গলায় কিছু বলতে বলতে কেউ দরজাটা খুলতেই কুকুরটা তিরের মতো ছিটকে বেরিয়ে এল। কিন্তু বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছোবার আগেই আর্ত চিৎকার করে বেচারাকে শুয়ে পড়তে হল। সিরিলের সঙ্গীদের মধ্যে একজন এত চটপটে হাতে কাজ শেষ করতে পারবে তা অনিমেষও ভাবতে পারেনি। ফলে যে লোকটা দরজা খুলেছিল সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। অনিমেষ লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘পানিরাম কোথায়?’ তিন-চারবার কথা বলার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত লোকটা আঙুল দিয়ে ভেতরটা দেখিয়ে দিল।

সময় নষ্ট করল না অনিমেষরা। লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে অন্দরে ঢুকে পড়ল। বেশ বড় বাড়ি। চারপাশের ঘরগুলোর কিছু মুখ কৌতূহলে বাড়িয়ে হকচকিয়ে গেল।

অনিমেষ চিৎকার করল, ‘আপনারা সবাই বেরিয়ে আসুন নইলে এই লোকটিকে মেরে ফেলা হবে।’ অস্ত্রটি বের করে লোকটির শরীরে ঠেকাল সে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। পিলপিল করে পাঁচ-ছয়জন নারী পুরুষ জড়সড় হয়ে ঘরের কোনায় এসে দাঁড়াল। সিরিল গিয়ে ঘরগুলো দেখে এল। এসে ঘাড় নাড়ল, কেউ নেই।

ঠিক তখনই একটা গুলির শব্দ হল আর অনিমেষ দেখল ওদের দলের একটি ছেলে ছিটকে পড়ে গেল। অনিমেষ দ্রুত মুখ তুলে একটা মোটা লোককে দেখতে পেল। দুই হাতে বন্দুক নিয়ে আবার টিপ করছে। কিছু বোঝার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে গেল ওপরে। জুলিয়েনের হাত শূন্য থেকে নেমে আসার আগেই দোতলার কাঠের রেলিং-এর একাংশ খসে গেল, বন্দুকধারী উবু হয়ে বেস আর্তনাদ করতে লাগল।

দু’জনকে এদের পাহারায় রেখে অনিমেষরা ওপরে উঠে এল। সিরিল চটপটে হাতে লোকটিকে তুলে ধরল, ‘কেয়া পানিরামজি, কেয়া হুয়া?’

সর্বাঙ্গে রক্ত ঝরছে, হাতের বন্দুক পড়ে গেছে, লোকটা তখনও গোঙাচ্ছে। মরে যাওয়ার মতো আহত হয়নি বোঝা যায়। অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, সে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করল, ‘গুলি করলেন কেন?’

‘ডাকু-উ-উ।’ পানিরাম তখনও কাঁপছিল।

জুলিয়েন বলল, ‘আর দেরি করা ঠিক হবে না। শব্দ পেয়ে লোকজন ছুটে আসতে পারে। চটপট— জলদি।’

বেশিক্ষণ সময় লাগল না দুটো বন্দুক হাতাতে। পানিরামের শোয়ার ঘরের সিন্দুকে টাকার স্তূপটা পাওয়া গেল। দুটো বাজারের থলেতে পুরে নিল সেগুলোকে। সিরিল সোনার গয়নাগুলোর দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল, নিষেধ করল অনিমেষ, ‘ওগুলো নিলে ঝামেলা বাড়বে। তুমি গাড়ির চাবি জোগাড় করো।’

এক লাফে নীচে নেমে গেল সিরিল। অনিমেষ দ্রুত বারান্দায় গিয়ে বাইরের দিকটা দেখল। আশেপাশে লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে এ তল্লাটের মানুষের। আর এখানে থাকা যায় না।

ভেতরের বারান্দায় আসতেই জুলিয়েনের গলা পাওয়া গেল, ‘আজ বদলা হল পানিরামবাবু। এতদিনে যে রক্ত শুষেছেন গরিব মানুষের তার হিসেব মেটালেন আজ।’ কথাটা শেষ করে ইঙ্গিত করতেই সিরিলের সেই সঙ্গীটি যে কুকুরটাকে ঠান্ডা করেছিল তার হাত চলল। অনিমেষ দেখল বসে থাকা বিরাট শরীরটা লাশ হয়ে গেল।

অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জুলিয়েন হাসল, ‘উপায় ছিল না। শালা আমাদের চিনতে পেরেছিল। বাঁচিয়ে রাখলে বেশি দাম দিতে হত।’

অনিমেষ আবিষ্কার করল এই ছারপোকাটির মৃত্যু চোখের ওপর দেখে তার একটুও খারাপ লাগল না। বরং অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল নার্ভগুলো। চট করে মনে পড়ে গেল নীচের মাটিতে ওদের একজন শুয়ে আছে। ওরা এবার নীচে নেমে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়াল। এক পলকেই বোঝা যায় প্রাণ গুলি লাগামাত্রই চলে গেছে। বুকের ওপর অনেকটা রক্ত মাখামাখি হয়ে আছে। জুলিয়েন নিচু গলায় নির্দেশ দিতেই ছেলেরা শরীরটাকে তুলে নিল। ঘরের কোনায় দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, ‘দশ মিনিটের মধ্যে যে ঘর থেকে বের হবে তাকেই পানিরাম বানিয়ে দেব।’

ওরা বারান্দায় এসে দেখল অন্তত জনা পনেরো লোক গেটের বাইরে জমা হয়ে গেছে। দু’-একজন গেট টেনে ঠেলে ঢুকব ঢুকব করছিল, ওদের দেখে কী করবে বুঝতে পারছে না। যদিও এখানে বেশ অন্ধকার, মুখের আদল পরিষ্কার দেখা যায় না, তবু কোনও সুযোগ নিতে চাইল না অনিমেষ। শূন্যে মুখ করে গুলি ছুড়ল আচমকা। সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল জটলাটার মধ্যে। কে আগে পালাতে পারে সে চেষ্টা চলল এবার।

পাশের গ্যারেজ থেকে একটা জিপ নিয়ে সিরিল তখন প্রায় নিঃশেব্দ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, ‘দুটো গাড়ি পাওয়া গেল না। একটার আবার ইঞ্জিন খারাপ।’

ওরা সন্তর্পণে মৃত ছেলেটিকে জিপের পেছনের দুই সিটের মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে উঠে বসল এক এক করে। জায়গা কম হচ্ছিল কিন্তু তা নিয়ে কেউ কোনও কথা বলল না। জিপ চলতে আরম্ভ হবার আগে অনিমেষের মনে পড়ে গেল। এক মিনিট দাঁড়াতে বলে সে লাফিয়ে নেমে পকেট থেকে কালো চক বের করে সাদা দেওয়ালের ওপর দ্রুত হাতে লিখল, ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম।’ ‘গরিব মানুষের শত্রু পানিরামরা সাবধান।’

চটপট লিখে জিপে উঠতেই জুলিয়েন বলল, ‘হাতের লেখার প্রমাণ রেখে গেলেন।’

অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আজ থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল যখন তখন সারা শরীর দিয়েই তো প্রমাণ রাখছি।’

গেট পার হবার সময় জুলিয়েন দাঁড়িয়ে ঝোলা থেকে বস্তুটি বের করে পানিরামের বাড়ির ওপর ছুড়ে মারল। প্রচণ্ড শব্দে স্বর্গছেঁড়া কেঁপে উঠতেই ওরা রাস্তায় এসে পড়ল। একটি মানুষকেও কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে না। জিপ ছুটল নাগরাকাটার দিকে। অনিমেষ একটা পা বাইরে রেখে সামনের সিটে কোনওমতে বসে আছে। তার পাশে জুলিয়েন। জুলিয়েনের পায়ের নীচে থলে ভরতি টাকা। পেছনের একটি ছেলের হাতে বন্দুক দুটো।

কেউ কোনও কথা বলছিল না। মুখে কোনও শব্দ কেউ না-করলেও প্রত্যেকেই মৃতদেহটির কথা ভাবছিল। যাবার সময় সে সবার মতোই সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়েছিল। এখন তার শরীর নিথর, জিপের মেঝেতে থলের মতোই পড়ে আছে। প্রথম অ্যাকশনেই একটা বড় দাম দিতে হল। অনিমেষ এই কুড়ি-একুশ বছরের ছেলেটিকে আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু ছেলেটির কথা যত ভাবছিল সে, তত তার ভেতরে ক্ষরণ হচ্ছিল। ওর সঙ্গীরাও এখন চুপচাপ। ডানদিকে বানারহাটকে রেখে ওরা ডায়না নদীর ওপর উঠে আসতেই অনিমেষ সিরিলকে গাড়িটা থামাতে বলল। চুপচাপ সে নীচের নদীটার দিকে তাকাল। অনেকটা জায়গায় চর পড়ে আছে। মাঝখানে সরু ফিতের মতো জলের রেখা। সে ফিরে এসে বলল, ‘গাড়িটাকে ব্যাক করে নদীর বেডে নিয়ে যাওয়া যায় না?’

‘হ্যাঁ, ওপাশে একটা রাস্তা আছে।’

‘তাই করুন।’

ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সিরিল ধীরে ধীরে গাড়িটা পিছু নিয়ে গেল। অনিমেষ সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকাল। সে যা ভেবেছে এরাও কি তাই ভেবেছে! না-হলে কী কারণে জিপটাকে নীচে নিয়ে যেতে বলল তা কেউ জিজ্ঞাসা করল না কেন? আঘাত সব মানুষের ভাবনা এক খাতে বইয়ে দেয়?

ওরা নিঃশব্দে নীচে নেমে এল। বড় বড় বোল্ডারের পাশ দিয়ে সরু প্যাসেজ দিয়ে জিপটাকে কোনওমতে নদীর ওপর নিয়ে এল সিরিল। ছেলেটা খুব ভাল গাড়ি চালায়। ওরা সেই আবছা অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে ঠিক ব্রিজের নীচে একটা নরম জায়গা পেল। অনিমেষ দেখল জায়গা অনেকটা বালি, পাথর টাথর বড় একটা নেই।

সিরিল গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘আমরা সবাই একমত তো?’

সবাই জিজ্ঞাসার চোখে তাকাতেই সিরিল খানিক ইতস্তত করল, ‘সোমরার ডেডবডি ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা—।’

জুলিয়েন বলল, ‘অসম্ভব। সেটা করলে পুরো দল ধরা পড়ে যাবে।’

অনিমেষ সিরিলকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কী ইচ্ছে?’

হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠল সিরিল। সবাই চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। অনিমেষ বুঝতে পারছিল এদের অনেকের কান্নাই সিরিল প্রকাশ্যে কাঁদছে। অনেক চেষ্টার পর নিজেকে শান্ত করল সিরিল, ‘শুধু আমার কথা শুনে সোমরা বাড়ির থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমি ওর মায়ের সামনে কখনও যেতে পারব না। ঠিক আছে, এখানেই হোক।’

বালি নরম বলে অসুবিধে হল না। ওরা সবাই মিলে হাত চালাল। জিপের মধ্যে একটা ছোট ত্রিপল পাওয়া গেল। গর্তটা ফুট চারেক খুঁড়তে প্রায় দেড় ঘণ্টা খরচ হয়ে গেল। এখন এখানে কোনও শব্দ নেই। নদীর দু’ধারে জঙ্গল। মাঝে মাঝে এক-একটা ভারী লরি ওপরের ব্রিজ দিয়ে হুহু করে ছুটে যাচ্ছে। আশেপাশে কোনও জনবসতি নেই। ঠিক ব্রিজের নীচে থাকায় কোনও চলন্ত গাড়ির নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই। একসময় খুঁড়তে খুঁড়তে জল বেরিয়ে এল। খোঁড়া বন্ধ করে জুলিয়েন ছেলেদের বলল, কিছু মাঝারি সাইজের বোল্ডার জড়ো করতে। তারপর গাড়ি থেকে ত্রিপলটা বের করে গর্তের মধ্যে সুন্দর করে বিছিয়ে দিল। ত্রিপলের একটা দিক অনেকখানি বাইরে বের করে রাখল সে।

সিরিল এবার তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে জিপ থেকে সোমবার শরীরটাকে পরম যত্নে বয়ে নিয়ে এল সেখানে। এই পাতলা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল ছেলেটার মুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক যেন গভীর ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে সে।

অনিমেষ জানে না এই কালো ছেলেটি রাজনীতি বুঝত কিনা। লেখাপড়া কতদূর শিখেছে, আদৌ শিখেছে কিনা তাও তার জানা নেই। কিন্তু একটা নতুন ভারতবর্ষ তৈরি করার যে স্বপ্ন এখন তাদের চোখে এ তার শরিক ছিল। কিংবা এসবের কিছুই সে তেমন করে জানত না। বন্ধুর কথায় হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু অনিমেষের মনে হল আসন্ন বিপ্লবের ভিত তৈরি করতে সে একটা ইট পাতল।

জুলিয়েনের মাথা ঠিক ছিল। চটপটে হাতে সে ছেলেটির পকেট দেখে নিল। একটা চারমিনাটের প্যাকেট, দেশলাই আর গোটা তিনেক টাকা ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু বুকের ওপর নেতানো ক্রশ দেওয়া চেনটাকে সযত্নে খুলে নিয়ে সে সিরিলের হাতে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ল। তারপর কপালে, দুই কাঁধে হাত ছুঁইয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ সঙ্গীদের দিকে এগিয়ে এল, ‘কমরেডস। এটা অত্যন্ত বেদনার যে আমাদের একজন সাথি আজ প্রথম অ্যাকশনের দিনেই শহিদ হলেন। আসন্ন বিপ্লবের সূচনায় এই মৃত্যু আমাদের যদিও নিঃসঙ্গ করল কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদের উদ্যমকে আরও শক্তিশালী করবে। যা সত্য তা আমাদের মানতেই হবে। আসুন, আমরা সবাই কমরেড সোমরার কাছে শপথ করি, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমরা যেন তাঁর আত্মার অপমান না-করি।’

সবাই এসে সোমরাকে ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসল। সেই নির্জন মধ্যরাতের নদীর চরে শিরশিরে বাতাস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। প্রত্যেকের হাত সোমরার শরীর স্পর্শ করতেই অনিমেষের মনে হল এখনও তাপ আছে মৃতদেহে। অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল, ‘আপনারা আমার সঙ্গে উচ্চারণ করবেন— যতদিন ভারতবর্ষের বুর্জোয়া শাসন-ব্যবস্থা ধ্বংস না-হচ্ছে ততদিন আমরা বিশ্রাম করব না।’

খুব গম্ভীর বিষণ্ণ কিন্তু দৃঢ় গলায় শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হল। তারপর অত্যন্ত যত্নে সোমরার শরীর গর্তের ভেতরে ত্রিপলের ওপর শুইয়ে দিয়ে ত্রিপলের অন্য প্রান্তটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। সামান্য বালি ছড়িয়ে দিয়ে এক এক করে বোল্ডারগুলো সাজানো হল শরীরের ওপর। এবার প্রত্যেকে বালি চাপিয়ে দিতে লাগল গর্তে। জুলিয়েন চাপা গলায় বলল, ‘কমরেড সোমরা যুগ যুগ জিয়ো।’ ওরা সাড়া দিল, ‘যুগ যুগ জিয়ো।’ ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম—লাল সেলাম, লাল সেলাম।’ ‘কমরেড সোমরা লাল সেলাম—লাল সেলাম, লাল সেলাম।’

সেই রাত্তিরে কতগুলো বুকের গভীর কষ্টের মধ্যে ভীষণ উত্তাপ জন্ম নিচ্ছিল। প্রতিটি শব্দ যেন জ্বলন্ত মশালের মতো ওদের সমস্ত শরীরে সেই তাপ ছড়াচ্ছিল। একসময় যখন সেই গর্তটির কোনও অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছিল না তখন ওরা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল।

নাগরাকাটা স্টেশনের মাইলখানেক আগেই ওরা জিপটাকে বড় রাস্তা থেকে ডান দিকের জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিল। সিরিল চাইছিল ওটাকে জ্বালিয়ে দিতে, কিন্তু জুলিয়েন নিষেধ করল। আগুন জ্বাললেই অনেক দূর থেকে মানুষ আকৃষ্ট হবেই। তা ছাড়া ভোর হয়ে আসছে। নিজের অস্তিত্ব সবাইকে জানিয়ে দেওয়া কখনও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো দু’-একদিনের মধ্যে জিপটা কারও নজরে পড়তে পারে।

যতটা সম্ভব জিপ থেকে হাতের ছাপ মুছে ফেলা হল। সিরিল ইঞ্জিনের তারগুলো ছিঁড়ে রেখে দিয়ে দাঁত বের করে হাসল। অনেকক্ষণ পরে তাকে স্বাভাবিক চেহারায় দেখে অনিমেষের ভাল লাগল। মুশকিল হল বন্দুক দুটো নিয়ে। ওগুলো প্রকাশ্যে বয়ে নিতে দেখলে অনেকের সন্দেহ হতে পারে। জুলিয়েন পথ বাতলাল। নাগরাকাটায় ঢোকার মুখে ওর পরিচিত এক ডেরায় বন্দুক জমা রেখে যাবে। বিশ্বাসী লোক, প্রয়োজনে পেতে অসুবিধে হবে না। টাকাগুলো আপাতত ব্যাগেই থাক।

কিন্তু অনিমেষ এত টাকা সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল না। ধরা পড়লেই সব ফাঁস হয়ে যাবে। কিন্তু জুলিয়েন এত টাকা কোথাও রেখে যেতে রাজি নয়। টাকার পরিমাণ কত তাও জানা নেই। এখন গুনে দেখারও সময় নেই। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল টাকা নিয়ে জুলিয়েন একাই চলে যাবে। প্রয়োজনটা আপাতত ওর মারফত জানতে পেরেছিল অনিমেষ। মালপত্র কেনার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি হাত বদল হয় ততই মঙ্গল। জুলিয়েন অবশ্য আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে নিল। ঠিক হল নাগরাকাটা থেকে দলটা আপাতত ভেঙে যাবে। ঠিক দশ দিন পরে ফুন্টশিলিং-এ সবাই দেখা করবে। জায়গাটা ঠিক করে নেওয়া হল।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা হাঁটা শুরু করল। নাগরাকাটার মুখে এসে জুলিয়েন অনিমেষের দিকে হাত নাড়ল। তারপর বাঁদিকে নেমে গেল সঙ্গীকে নিয়ে। ওদের দু’জনের হাতে দুটো বন্দুক আর দুটো ব্যাগ। লোকটার সাহস আছে প্রচণ্ড। জঙ্গল ছাড়ার আগে সে প্রস্তাব দিয়েছিল এখন যেহেতু কারও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই তাই প্রয়োজনের খরচ চালাতে অর্থের প্রয়োজন হবেই। সে ক্ষেত্রে পানিরামের টাকা থেকে প্রত্যেককে একশো করে টাকা দিয়ে দেওয়া হোক। অনিমেষের এতে সায় ছিল না। সাধারণ ডাকাতির পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে যেন ব্যাপারটা। যদিও তার নিজের কাছে সামান্য কিছু অর্থ আছে, কিন্তু একথা ঠিক যে, অন্যান্যদের পকেটে কিছু না-ও থাকতে পারে। তবু ওখান থেকে টাকা নেওয়াতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু জুলিয়েন বোঝাল, ‘আমরা তো যুদ্ধের জন্যেই টাকাটা নিচ্ছি। যদি শুধুমাত্র টাকার অভাবেই কেউ ধরা পড়ি তা হলে বিপ্লবটা করবে কে? আমরা বিলাসের জন্য এই টাকা নিচ্ছি না। প্রয়োজন মেটাতে নেওয়া, বন্দুকের গুলি কেনার মতোই স্বাভাবিক।’

সেইমতো কিছু টাকা সে সবাইকে দিয়েছিল। ব্যাগের টাকার পরিমাণ দেখে বোঝা গিয়েছিল, যে টাকাটা ওরা খরচের জন্যে নিল তা মূল টাকার দুশো ভাগের এক ভাগও নয়।

সকালে যে ট্রেনটা এল সেটা একদম ফাঁকা। অনিমেষ আর সিরিল অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসল। সিরিল টিকিট কাটতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে নিষেধ করল অনিমেষ। এই ভোরে কাউন্টারে গেলে রেল কর্মচারীটি মনে রাখবে তাদের। মাত্র দু’জন লোক চাদর মুড়ি দিয়ে এক কোনায় ঢুলছিল। অনিমেষ ঠিক করল সামনের কোনও স্টেশনে টিকিট কেটে নেবে। এসব ট্রেনে চেকার বড় একটা ওঠে না।

জানলার ধারে বসার পর প্রথম ক্লান্তি বোধ করল অনিমেষ। একটা পুরো রাত কীভাবে উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেছে টের পাওয়া যায়নি। এখন শরীরে ভার বোধ হচ্ছে। সিরিল ট্রেনে উঠেই একটা বেঞ্চিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছিল। এর মধ্যেই তার ঘুমন্ত শরীর থেকে মৃদু নিশ্বাস বের হচ্ছে। মুখ শিশুর মতো শান্ত। একে দেখলে কে বলবে যে গতরাতে এক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়েছে। কিন্তু ক্লান্তিবোধ করলেও অনিমেষের ঘুম আসছিল না। জানলার বাইরে পৃথিবীটা একটু একটু করে ফরসা হয়ে কচি চেহারা নিয়েছে। নরম কলাপাতার মতো রোদ জঙ্গলের শরীরে। দু’পাশ গাছ-গাছালি আর চা-বাগান রেখে ট্রেন ছুটছিল হাসিমারার দিকে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।

যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। আজ অনিমেষরা যেমন সলতে পাকানোর কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং ভারতবর্ষের সবদিকেই এরকম ছোট ছোট দল এইরকম ঘটনা ঘটাচ্ছে। এভাবে কতগুলো রক্তচোষা বাদুড়কে সরিয়ে দিতে পারলেই ব্যবসায়ীরা ভয় পাবে। আর নির্যাতিত জনসাধারণ বুঝতে পারবে তারা ওদের বন্ধু। অবশ্যই প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে তারা। এইসব ছোট ছোট মশালগুলো একসময় বিরাট অগ্নিকুণ্ডের চেহারা নেবে সারা দেশ জুড়ে। নির্যাতিত মানুষের সেই পথে নেমে আসা স্রোতে ভেসে যাবে বুর্জোয়া ফ্যাসিবাদীর দুর্গ। এইসময় যদি কমিউনিস্ট পার্টিগুলো তাদের সঙ্গে আসত তা হলে বোধহয় ব্যাপারটা আরও দ্রুততর হত। কিন্তু অনিমেষ মাথা নাড়ল, এই ভাল, জনসাধারণ এদের চেহারাটা আরও ভাল করে চিনুক। তা হলে তাদের শক্তি আরও জোরদার হবে।

আজ এই মুহূর্তে স্বর্গছেঁড়ায় কী হচ্ছে অনুমান করতে চাইল সে। ওই ছোট্ট শান্ত জায়গার মানুষগুলো তাদের স্মৃতিতেও এমন ঘটনার কথা খুঁজে পাবে না। পানিরামের মৃত্যুর খবর পেয়ে ওরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে, চা-বাগানের যেসব গরিব শ্রমিক গলায় ফাঁস পরেছিল তারা নিশ্চয় স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস ফেলছে। অনুমান করা যায় এখন পুলিশ ছুটে গিয়েছে বানারহাট থেকে। দলে দলে মানুষ এসে ভিড় করেছে পানিরামের বাড়ির সামনে। ডাকাতির গল্প মুখে মুখে ছড়াচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে লেখাগুলোও পড়ছে লোকে। যদি কেউ তাদের চিনে ফেলে পরোয়া নেই। অন্তত ওই লেখাগুলো স্বর্গছেঁড়ার গরিব কুলি-মজুরদের মনে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে তারা যদি বুঝতে পারে অনিমেষরা ওদের ভাই তা হলে আর কীসের ভয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *