০৯. প্রায় পাঁচ বছর অনিমেষ

নয়

প্রায় পাঁচ বছর অনিমেষ কলকাতা শহরকে দেখছে। যদিও যাতায়াতের চৌহদ্দিটা খুব সীমিত তবু একটা ধারণা ওর মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে এখানকার মানুষ অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত প্রয়োজনের বাইরে আর কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। আর আগ্রহ বলে যেটা মনে হয় সেটার জন্য যদি কিছু মূল্য দিতে হয় তবে তারা সে ব্যাপারে নিজেদের জড়াবেই না। খুব সামান্য কারণে পথে-ঘাটে ভিড় জমে যায়, কিন্তু যখনই জনতা বোঝে এরপর তারা জড়িয়ে যাবে তখনই তারা সরে পড়তে আরম্ভ করে।

নির্জন দুপুরে ত্রিদিবের আনা একটা পত্রিকা পড়ছিল অনিমেষ। কলকাতা শহরের বয়েস বড়জোর দেড়শো বছর। তার আগে ইতস্তত কিছু জায়গায় মানুষের বসতি ছিল। কলকাতার অরিজিন্যাল বাসিন্দা বলে কেউ নিজেদের দাবি করতে পারে না। চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি এবং বর্ধমানের কিছু বর্ধিষ্ণু পরিবার যাঁদের অর্থকৌলীন্য চাষের দৌলতে পরিচিত ছিল তাঁরাই ইংরেজের সঙ্গে কর্মসূত্রে মিলিত হবার জন্য কলকাতায় এসে বসতি স্থাপন করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর কলকাতার চেহারা খুলল। তখন শ্যামবাজার থেকে বউবাজার অঞ্চলের বাসিন্দারাই ছিলেন শহরের মাতব্বর। ব্রাহ্মণদের তখনও কলকাতায় আগমন হয়নি ব্যাপক হারে। আসলে বাংলা দেশের বিভিন্ন গ্রামে যেসব তর্কালংকার কিংবা ন্যায়রত্নরা ধর্মের দোহাই পেড়ে আধিপত্য করতেন তাঁদের বংশধররা পড়েছিলেন বিপাকে। তাঁদের অহংকার সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর অব্রাহ্মণরা জীবিকার প্রয়োজনে দ্রুত ওই শিক্ষা গ্রহণ করে। রাজপুরুষের অনুগ্রহ না-থাকলে কোনও ধর্মই আধিপত্য পায় না, ফলে সেইসব তর্কালংকারের সন্তানাদিরা ইংরেজিশিক্ষার দিকে যখন ঝুঁকলেন তখন অন্যান্যেরা অনেক এগিয়ে গেছে। বাঙালির চরিত্রে চাকরি করার যে প্রবণতা জন্ম নিল তা তার রক্তে মিশে গেল। ধর্মের দোহাই দিয়ে যখন আর বাঁচা যায় না তখন বাংলা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে শুরু হল কলকাতা অভিযান। ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁর বাবার হাত ধরে হেঁটে আসতে হয়েছিল কলকাতায় শুধু পয়সার অভাবে।

কলকাতা হল সরগরম। শ্যামবাজার থেকে বউবাজারকে বলা হল ঘটি এলাকা। পূর্ববঙ্গের মানুষ তখনও কলকাতায় বিদেশি এবং কালীঘাট-বেহালার কিছু মানুষ অনেক আগে থেকেই রয়ে গেলেও তাঁরা ঠিক এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে কলকাতার চেহারা রাতারাতি পালটে গেল। হু হু করে পূর্ববঙ্গ থেকে মানুষ আসছে। কলকাতা বেলুনের মতো ফুলে জায়গা করে নিচ্ছে। এই নেওয়া এখনও শেষ হয়নি। উত্তর কলকাতার মানুষ যাদের আভিজাত্যের গর্ব ছিল আকাশছোঁয়া তাদের কলসি গড়িয়ে গড়িয়ে তলানিতে ঠেকল। নতুন সম্প্রদায় জন্ম নিল দক্ষিণ কলকাতায়, পূর্ববঙ্গের ধনবান শিক্ষিত মানুষেরা এসে দেশের ওপরতলার চেয়ারগুলো দখল করে নিজেদের আলাদা গোত্রের বলে চিহ্নিত করে নিলেন। নতুন এক ধরনের অভিজাত সম্প্রদায় গড়ে উঠল যাঁদের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের কোনও যোগাযোগ থাকল না। স্বাধীনতার পর কলকাতা অন্যরকম চেহারা নিয়ে নিল। বেলঘরিয়া থেকে যে কলকাতার শুরু তা থমকে দাঁড়াচ্ছে গড়িয়ায় গিয়ে। কিন্তু এই কলকাতার চেহারাটা কতগুলো খণ্ডে খণ্ডে ভাগ হয়ে গেল যেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাবে না। বেলঘরিয়া-দমদম এলাকার সঙ্গে টালিগঞ্জ-যাদবপুর-গড়িয়ার মানুষদের চরিত্রগত মিল বেশি, কারণ এইসব এলাকার মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে এসে কলোনি স্থাপন করেছিলেন। দেশত্যাগের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা এঁদের জীবনযাত্রার ধরন পশ্চিমবঙ্গবাসীদের থেকে অনেক ধারালো করে দিয়েছে। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং জেদি হওয়ায় ক্রমশ এঁরা কলকাতার ওপর নিজেদের অধিকার কায়েম করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরের কলকাতা কোনও ভাবপ্রবণতার সঙ্গে জড়িত থাকল না। উত্তরে চিৎপুরের গোড়া থেকে কাশীপুরের বিস্তৃত অঞ্চল অবাঙালি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। বড়বাজারের সঙ্গে উত্তর ভারতের কোনও শহরের তেমন পার্থক্য নেই। বস্তুত কলকাতার বাঙালিরা বড়বাজারের কোনও কোনও এলাকাকে বিদেশ বলে মনে করে। মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের ওখানে একচ্ছত্র আধিপত্য। পূর্বে রাজাবাজার এলাকায় কয়েক হাজার অবাঙালি মুসলমানের বসবাস। ট্যাংরা চিনে পাড়া হিসেবে চিহ্নিত। ধর্মতলা এলাকায় বাঙালি পরিবার গোনাগুনতি। পাশেই পার্ক সার্কাস পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ইংরেজ শাসনের আর-এক ফসল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিজস্ব এলাকা। খিদিরপুর-মোমিনপুর এলাকায় অবাঙালি মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকার। ক্রমশ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এবং তার সন্নিহিত এলাকা দক্ষিণ ভারতীয়দের জন্য নির্দিষ্ট হতে চলেছে। অর্থাৎ মূল কলকাতার যে এলাকা সেখানে বাঙালিরা খুবই সংখ্যালঘু। প্রবন্ধের শেষে লেখক তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন এই বলে যে, এই কসমোপলিটন শহর বিক্ষিপ্তভাবে কোনও ঘটনায় ফুঁসে উঠতে পারে কিন্তু কখনও একই ভাবপ্রবণতায় আলোড়িত হতে পারে না।

এখন ঘরে কেউ নেই। ত্রিদিব কলেজে চলে গিয়েছে। কাল রাত থেকে জব্বর ঘুমিয়েছে অনিমেষ। ঘুম যখন ভাঙল তখন প্রায় এগারোটা। ওর যাতে অসুবিধে না-হয় তাই ত্রিদিব ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে গেছে। মাথার পাশে কিছু পত্রিকা আর একটা চিরকুট পেয়েছিল অনিমেষ। ‘ঠাকুরকে বলে গেলাম খাবার ঘরে দিয়ে যাবে। আজ হাঁটার চেষ্টা কোরো না।’

হাঁটার কথাটা পড়তেই চলকে এল চিন্তাটা। তার পা গতকাল দারুণ জখম হয়েছিল, হাঁটতে গেলে যন্ত্রণায় অস্থির হচ্ছিল সে। সারারাত শুয়ে থাকায় সে এ কথাটা যেন ভুলেই গিয়েছিল। হাত দিয়ে শুয়ে শুয়েই পা টিপে দেখল অনিমেষ। না, কোথাও লাগছে না। কিন্তু মাটিতে পা পেতে দাঁড়ালেই ওটা মালুম হবে। যেন ব্যাপারটা ভোলার জন্যেই সে বিছানা ছেড়ে উঠছিল না। দু’-তিনটে পত্রিকা উলটে-পালটে সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে পারা যায়! হাতমুখ ধোয়া দরকার, তা ছাড়া বাথরুমে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অনিমেষ আশা করছিল এখনই ঠাকুর খাবার নিয়ে আসবে। ঠাকুর এলে তার কাঁধে ভর দিয়ে ওসব সেরে নিতে বাথরুমে যেতে পারবে সে। কিন্তু ঠাকুরের জন্যে আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

অনিমেষ ঘরে একবার নজর বুলিয়ে নিল। না, একটা লাঠি জাতীয় কিছু নেই যেটায় ভর দিয়ে হাঁটা যায়। কপালে যা আছে তাই হবে এইরকম ভেবে অনিমেষ প্রথমে ভাল পা মাটিতে রাখল। তারপর সন্তর্পণে অন্য পা নামিয়ে ভাল পায়ে শরীরের ভার রেখে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। না, এখনও কোনও যন্ত্রণা ঝাঁপিয়ে পড়ছে না, কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তে সেটা দাঁত বসাবে। অনিমেষ কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল খানিক। এতক্ষণ যেটা সামান্য ছিল, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সেটা প্রবল হল। বাথরুমে যাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। বিপদটা ইচ্ছে করে ডেকে না-এনে আর-একটু শুয়ে থেকে ঠাকুরের অপেক্ষা করা যদি যেত! দ্বিধায়, ভয়ে ভয়ে সে জখম পা সামান্য বাড়িয়ে একটু একটু করে শরীরে ভার রাখতে লাগল। না, ব্যথা লাগছে না, ধীরে ধীরে সমস্ত ভার ছেড়ে দিতে থাইয়ের কাছটায় সামান্য চিনচিন করতে লাগল মাত্র। অনিমেষ এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ওই মুহূর্তে সেসব প্রাকৃতিক প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে নিজের পা দুটো লক্ষ করতে লাগল। কী আশ্চর্য! কালকের যন্ত্রণাটা এখন বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল? অনিমেষ দুরুদুরু বুকে পায়ের ওপর আবার চাপ রাখল। হয়তো দাঁড়িয়ে আছে বলে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, হাঁটতে গেলেই টের পাওয়া যাবে। ঠিক এই সময় ঠাকুর হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। এক হাতে খাবারের থালা, অন্য হাতে জলের গ্লাস। অনিমেষকে দাঁড়াতে দেখে সে অবাক হয়ে গেল যেন, ‘ত্রিদিববাবু কইল আপুনি হাঁটিতে পারবা নাই, ঠ্যাং ভাঙ্গি গেছে!’

ত্রিদিব কী বুঝিয়েছে অনুমান করে নিয়ে অনিমেষ বলল, ‘সবটা ভাঙেনি, তুমি খাবারটা টেবিলে রেখে এসে আমাকে একটু ধরবে?’

ঠাকুরের হাঁটা-চলা সবসময় দ্রুত, মুহূর্তেই সে অনিমেষের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। অনিমেষ হাঁসফাঁস করে উঠল, ‘আরে, এভাবে নয়। তুমি চুপচাপ দাঁড়াও, আমি তোমাকে ধরে হাঁটব।’

কিন্তু সেটা ঠাকুরের পছন্দ নয়। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাঁটিবার কী কারণ?’

অনিমেষ বলল, ‘বাথরুমে যাব।’

ঠাকুর হাসল, ‘আপুনার খাটিয়ার নীচে একটা পাত্র রাখি গেছে জমাদার। ওইটার মধ্যে করি ফেলেন।’

খবরটা জানত না অনিমেষ। কিন্তু ব্যবস্থাটা মনঃপূত হল না তার। সে একটু জোরেই আদেশ করল, ‘যা বলছি তাই শোনো, তুমি বাথরুমের দিকে হাঁটো।’

ঠাকুরের শরীরে ভর রেখে কয়েক পা হাঁটতেই অনিমেষ আবিষ্কার করল কালকের সেই মারাত্মক ব্যথাটা মোটেই নেই। থাই-এর কাছে কোনও শিরা সামান্য চিনচিন করা ছাড়া তার কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না। এটা কেমন করে সম্ভব মাথায় ঢুকছে না, কিন্তু অদ্ভুত একটা স্বস্তিতে মন এখন শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আনন্দ যখন খুব প্রবল হয় তখন বিস্ফোরণে নয়, চুপচাপ সেটার অনুভবেই বোধহয় পূর্ণতা পায়। অনিমেষ ঠাকুরকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বারান্দায় বেরিয়ে এল। চারপাশে এখন কড়া রোদ ছড়ানো, দু’চোখ বন্ধ করে আলো সইয়ে নিল সে।

ভরদুপুরে স্নান করে ভাত খেয়ে বেশ আরাম হল। একটা সিগারেট পেলে বেশ হত। অনিমেষ খোলা জানলার পাশে চেয়ার পেতে মৌজ করে বসেছিল। কাল যে দারুণ ভয় সে পেয়েছিল সেটা মিথ্যে হওয়ায় এখন খুব হালকা লাগছে। ট্রামে উঠতে গিয়ে এমন কিছু বেকায়দায় লাগেনি যে পায়ের জোড়া হাড় ফের ভাঙতে পারে। কিন্তু ব্যথা হওয়ামাত্র সে কথাটাই মনে এসে বদ্ধমূল হয়েছিল। এমনকী, হস্টেলের ডাক্তার পর্যন্ত স্পেশালিস্ট দেখিয়ে দিলেন। এইজন্যেই বোধহয় সবাই তাঁকে ঘোড়ার ডাক্তার বলে। অনিমেষ সিদ্ধান্তে এল, ওটা নিশ্চয়ই মাসল পেইন, শিরায় টান ধরেছিল আচমকা। মানুষ কত সহজে ভয় পেয়ে যায়!

আজ ক্লাস কামাই হল। এত বেলা অবধি ঘুমিয়ে এখন আর-একরকম আলস্যি এসে গেছে। কালকের কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল অনিমেষ। বিমান ধরেই নিয়েছে সে ছাত্র ফেডারেশন করবে। এ-কথা ঠিক সে ছাত্র ফেডারেশনকে সমর্থন করে এই কারণে যে কংগ্রেসকে সমর্থন করার কোনও যুক্তি তার কাছে নেই। কিন্তু তাই বলে যেভাবে বিমান তাকে সবার কাছে উপস্থিত করল সেটা কখনওই শোভন নয়। নাকি তাকে সামনে খাড়া করে বিমানরা একটু যুদ্ধে এগিয়ে গেল। সুবাসদার সঙ্গে কাল যদি অমন করে দেখা না-হয়ে যেত তা হলে এসব ঘটনা ঘটত না। অনিমেষের মনে পড়ল সুবাসদা বলেছিলেন যাওয়ার আগে সন্ধেবেলা তার সঙ্গে দেখা করে যাবেন হস্টেলে এসে। কিন্তু সুবাসদা আসেননি। হয়তো বৃষ্টির জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বিমানদের চেয়ে সুবাসদাকে তার অনেক গভীর এবং কাছের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। অথচ ওরা দু’জনেই এক দলের সক্রিয় কর্মী। ছাত্র ইউনিয়নের কথা ভাবতেই শচীনের কথাগুলো মনে পড়ল। কংগ্রেসের সমর্থনে এবং কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে শচীন যাই বলুক, নিশ্চয়ই তার পালটা বক্তব্য রাখা যেতে পারে। কিন্তু শচীনের কথাগুলো আরও ভাল করে শোনা দরকার। শচীনের কথা মনে হতেই চট করে নীলার মুখ ভেসে এল। নীলা একা পায়চারি করতে ওদের ফেলে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল। কথাটা ভাবতেই অনিমেষ সোজা হয়ে বসল। আজ নীলা তাকে বাসস্টপে অপেক্ষা করতে বলেছিল। কথাটা স্মরণেই ছিল না তার। এখনও সেখানে যাওয়ার যথেষ্ট সময় আছে, কিন্তু অনিমেষ আবিষ্কার করল বেরুতে একদম ইচ্ছে করছে না। আলসেমি এমন পেয়ে বসেছে যে ইচ্ছে করছে আবার শুয়ে পড়ে। নীলা নিশ্চয়ই বাসস্টপে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবে এবং অনিমেষ না-গেলে বিরক্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক। কেউ আসবে বলে না-এলে মেজাজ ঠিক থাকে না। আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ে কোথাও ওর জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকেনি। এবং যে মেয়ে সোজাসুজি কথা বলে সে দাঁড়িয়ে থাকবে ভাবলেই এক ধরনের বুক-ভরা আনন্দ হয়, তবু অনিমেষ দোনামোনা করতে লাগল। একথা ঠিক, তার পায়ের দোহাই দিয়ে সে নীলার রাগ কমাতে পারবে। ঘরের মধ্যে চলাফেরা করতে লাগছে না বটে কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে ট্রাম-বাসে চড়তে গেলে যদি আবার কালকের মতো যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়! সবাই বলবে তার আজকের দিনটা অন্তত রেস্ট নেওয়া উচিত এবং সে তাই করছে। অনিমেষ এত সব যুক্তি খাড়া করেও ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিল না।

আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে শুয়ে পড়বে বলে অনিমেষ যখন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন দরজায় শব্দ হল। আস্তে আস্তে জায়গাটুকু পেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দারোয়ানকে দেখতে পেল সে। তার শরীরের দিকে দ্রুত একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে দারোয়ান জিজ্ঞাসা করল, ‘শরীর ঠিক আছে বাবু?’

তার শরীর খারাপ হয়েছিল বলে সবাই খবর নিতে আসছে দেখে অনিমেষের ভাল লাগল, ‘এখনও ঠিক— তবে কালকের থেকে ভাল।’

‘আপনি গেটে যেতে পারবেন?’

‘কেন?’

‘একজন মেয়েছেলে আপনার খবর নিতে এসেছে।’

‘মেয়েছেলে?’ অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। মেয়েছেলে মানে নিশ্চয়ই নীলা। কিন্তু ও খবর পেল কী করে? তিনটে বাজতে তো এখনও কিছু দেরি আছে। ওর পরিচিত এই হস্টেলের কোনও ছেলেকে নীলা চেনে না যে তার মুখে খবর পেয়ে দেখতে আসবে। নাকি মেয়েদের সেনসিটিভনেস এত বেশি যে ঠিক মনে মনে জেনে যায় কী হয়েছে। মেয়েরা যাদের ভালবাসে তাদের সম্পর্কে তারা নাকি এইরকম অনুভব করতে পারে। কিন্তু নীলার সঙ্গে তো তার সেরকম সম্পর্ক নয়। অনিমেষ দারোয়ানকে বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে চলো, সিঁড়ি ভেঙে নামতে সাহায্য লাগতে পারে।’

ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল অনিমেষ। দারোয়ানের সাহায্য লাগল না। কিন্তু নীচে নামার পর থাই টনটন করতে লাগল। অনিমেষ আশঙ্কা করছিল এই বুঝি আবার যন্ত্রণাটা শুরু হল। সিঁড়ির মুখে একটু সময় নিল সে। ওপর থেকে নীচে নামার চেয়ে নীচে থেকে ওপরে ওঠায় কষ্ট বেশি হবে। এই হস্টেলের খুব কড়া নিয়ম কোনও মেয়েকে কারও ঘরে গিয়ে দেখা করতে দেওয়া হবে না। এমনকী, তিনি যদি কোনও আবাসিকের মা হন তবুও নয়। নিয়মটা হয়তো ভাল কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড় হওয়া উচিত— এই মুহূর্তে অনিমেষ অনুভব করল। পরক্ষণেই থম্বোটোর বন্ধুর কথা মনে পড়ায় হেসে ফেলল সে। তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আধভেজানো গেটের সামনে কেউ নেই। মেঘের ছায়ামাখা রোদ সেখানে নেতিয়ে আছে। এই ভরদুপুরে কলকাতা ভীষণ নির্জন হয়ে যায়, কেমন ভার হয়ে থাকে চারধার। অনিমেষ দারোয়ানের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই সে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দিল। কয়েক পা এগিয়ে ডান দিকে ঘুরতেই গেস্টরুমের খোলা দরজা দিয়ে যাকে অনিমেষ দেখতে পেল ক্ষীণতম কল্পনাতেও তাকে আশা করেনি সে। হতভম্ব হয়ে যাওয়ার ভাবটা লুকোতে পারল না অনিমেষ। তারপর সন্তর্পণে পা ফেলে গেস্টরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি’?

উঠে দাঁড়ালেন মহিলা, ‘দেখতে এলাম, পা কেমন আছে?’

অনিমেষের সব গোলমাল হয়ে গেল। শীলা সেনের দিকে সে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। গতকাল সন্ধ্যায় ট্যাক্সিতে সামান্য আলাপ আর সেইটুকুনিতেই তিনি ছুটে এসেছেন তার শরীরের খবর নিতে। কলকাতার মানুষ মাত্রই যে স্বার্থপর নয় এটা বোধহয় তার একটা নজির। ওঁর মতন সুন্দরী মহিলা, যিনি নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল, এতটা করবেন ভাবা যায় না। স্লিভলেস জামার বাইরে মাখনের মতো দুটো স্বপ্নের ডানার দিকে তাকাল অনিমেষ। ভেতরে ভেতরে যখন আলোড়ন ওঠে তখন মুখে কথাগুলো মিলিয়ে যায়। চেষ্টা করলেও সে সময় শব্দ আসে না। আবেগটা কমাতে সময় লাগল তার।

মহিলা একটু বিস্মিত হলেন, ‘আমি কি এসে অন্যায় করলাম কিছু?’

দ্রুত ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, ‘না, না, একথা ভাবছেন কেন? আপনি বসুন।’ গেস্টরুমটা মোটেই সাজানো নয়। কিছু চেয়ার-টেবিল এদিক-ওদিকে ছড়ানো। অনিমেষ চৌকো টেবিলের গা ঘেঁষে থাকা চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে নিজে আর একটায় বসল। বসে বলল, ‘আপনি সত্যি আমাকে অবাক করে দিয়েছেন।’

শীলা সেনের দুই ভ্রূর মাঝখানে চট করে কয়েকটা আঁচড় জাগল, ‘কেন? আমি এলাম তাই? আশ্চর্য! কালকে যাকে অমন অসুস্থ দেখে গেলাম তার খোঁজ নেব না।’

অনিমেষ আপ্লুত গলায় বলল, ‘সচরাচর তো দেখা যায় না এমন!’

শীলা সেন তাঁর টানটান খোলা চুলের রাশটাতে সামান্য ঢেউ তুলে বললেন, ‘আমি অন্যরকম। তা আমার প্রশ্নটার উত্তর পেলাম না কিন্তু?’

‘এখন ভাল আছি। এই তো ওপর থেকে হেঁটে নীচে নেমে এলাম।’ অনিমেষ জানাল। নিজের শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করতে সংকোচ হচ্ছিল ওর।

‘কিন্তু কালকে কী হয়েছিল, একা হাঁটতে পারা যাচ্ছিল না দেখলাম।’ শীলা সেনের মুখের প্রতিটি রেখায় আন্তরিকতার ছাপ।

‘শিরায় টান পড়েছিল, প্রথমে বুঝতে পারিনি। এমন কিছু নয়।’

‘নিশ্চয় সামান্যও নয়, নইলে আজ কলেজ যাওয়া হত।’ শীলা সেন ভ্রূভঙ্গিতে সন্দেহটা জানিয়ে দিলেন, ‘যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হলাম। কালকে বাড়িতে ফেরার পর বারবার করে মনে হচ্ছিল বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা হয় জেনেও আমি কিছু করলাম না। কারও কষ্ট হলে এত খারাপ লাগে, মনটা কেমন হয়ে যায়।’

এই ভরদুপুরে অনিমেষ মহিলাকে ভাল করে দেখল। কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত কোনও বাঙালি মহিলার একজন নিগ্রো যুবকের সঙ্গে এমন যোগাযোগের সম্ভাবনা নেই যার ফলে ছেলেটি আসক্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে তাই হয়েছে। শীলা সেন কি তা হলে মধ্যবিত্ত নন? উনি যে পাড়ায় এবং যে বাড়িতে বাস করেন সেটাকে কিছুতেই অতি আধুনিক বলা যায় না। উনি এখন যে ভাষায় কথা বলছেন তা কোনও সোসাইটি মেয়ে বলে কিনা অনিমেষের জানা নেই। তবু থম্বোটোর বন্ধুর সঙ্গে একটা ট্যাক্সি চেপে আসার সাহস এঁর আছে। থম্বোটোর বন্ধু এঁর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব করার সাহস রাখে। তা হলে ইনি কী? গতকাল মুহূর্তের জন্য হলেও অনিমেষের মনে হয়েছিল শীলা সেনের পুরুষ-ধরা জীবিকা। গতকাল ট্যাক্সিতে এঁকে খুব রহস্যময়ী এবং মোহিনী বলে মনে হয়েছিল। আজ এই দুপুরে সামনাসামনি বসে অবশ্য কোনও রহস্য দেখতে পাচ্ছে না সে, কিন্তু মহিলা দু’হাতে টানটান করে সৌন্দর্যের লাগাম ধরে রেখেছেন। বয়সে নিশ্চয়ই বছর দশেকের বড় হবেন, কিন্তু লাবণ্য হল এমন একটা জিনিস যা সহজেই নিচু হয়ে দশ বছর নেমে আসতে পারে।

অনিমেষ বলল, ‘আপনি এসেছেন জানলে থম্বোটোর বন্ধু অবাক হয়ে যাবে।’

শীলা সেন বললেন, ‘থম্বোটোর বন্ধু? ও, মোসাম্বার কথা বলা হচ্ছে? সে আছে নাকি হস্টেলে?’

অনিমেষ বলল, ‘আমি ঠিক জানি না। সকাল থেকে দেখা হয়নি। খোঁজ করব?’

শীলা সেন হেসে উঠে দ্রুত ঘাড় নাড়লেন, ‘না, না, তার দরকার নেই। আমি এসেছিলাম তাও বলতে হবে না। এই ছেলেগুলো এত প্যাশনেট হয় যে রিজ্‌ন বুঝতে চায় না।’

বলি বলি করে অনিমেষ বলে ফেলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব যদি কিছু মনে না করেন?’

আবার ভ্রূভঙ্গি হল, ‘মনে করার হলে নিশ্চয়ই মনে করব।’

‘তা হলে থাক।’

‘উম! বেশ, কথাটা কী?’

অনিমেষ প্রশ্নটা সাজাতে সময় নিচ্ছিল। সেই ফাঁকে শীলা সেন হেসে উঠলেন, ‘নিশ্চয় বলা হবে কী করে ওর সঙ্গে আলাপ হল, আমি কী করি— এইসব তো? ঠিক আছে, আমিই জবাব দিয়ে দিচ্ছি— প্রশ্ন করতে হবে না। আমি একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে আছি যাদের সঙ্গে এইসব আফ্রিকান কান্ট্রিগুলোর ভাল রিলেশন আছে। ওর দেশ থেকে যেসব ছেলে এখানে পড়তে আসে আমরা তাদেরও ব্যবস্থা করি। আর এইসব করতে গেলে শুচিবাই হলে চলে না। কিছু বোঝা গেল?’

অনিমেষ স্বীকার করল, না, এত কথাতেও তার কাছে কিছুই স্পষ্ট হল না। শুধু চাকরি করতে গিয়ে কেউ কি এরকম প্রশ্রয় দেয় অচেনা পুরুষকে? তা ছাড়া শীলা সেন মোসাম্বার কাছে তাঁর এই উপস্থিতি লুকিয়ে রাখতে চান। সেটাও কি স্বাভাবিক? সে মহিলার মাথার দিকে তাকাল। সিঁথি দেখে ও কিছুতেই বুঝতে পারে না কেউ বিবাহিতা কি না। স্বর্গছেঁড়া কিংবা জলপাইগুড়ির মতো সিঁথিতে গাঢ় সিঁদুর এখানকার মেয়েরা পরে না। চুলের আড়ালে যদি কোনও সিঁদুর টিপ থেকেও থাকে তবে তা খালি চোখে দেখা যায় না। শীলা সেন বিবাহিতা কিনা জিজ্ঞাসা করা অশোভন। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল সে এত কৌতূহলী হচ্ছে কেন? এই মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী? কিছুই না। মাত্র এক দিনের আলাপ। তার মতো সাধারণ অবস্থার ছেলের পক্ষে এইরকম মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। কথাটা ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা করল অনিমেষ, ‘কিন্তু আপনি এসেছেন একথা জানতে পারলে মোসাম্বা খুব আহত হবে। তার চেয়ে—।’

চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন শীলা সেন, ‘আই অ্যাম ফেড আপ। ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে আমার পেছনে। ওসব কথা ছেড়ে দেওয়া যাক। আমরা বরং চা-বাগানের গল্প করি। একটা চা-বাগান অনেকখানি জায়গা নিয়ে হয়, না?’

অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছিল, অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘হাঁ, আট-দশ মাইল জায়গা নিয়েও একটা চা-বাগান হতে পারে।’

‘বাব্বা! তা হলে তো অনেক টাকার দরকার হয়, তাই না?’

‘হ্যাঁ। আগে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি এক-একটা চা-বাগানের মালিক ছিল। স্বাধীনতার পর ওরা দেশি কোম্পানির কাছে বাগানগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত মালিকানায় কিছু চা-বাগান আছে।’ অনিমেষ তথ্যটা জানাল।

শীলা সেন বললেন, ‘সত্যি, আমরা কিছুই খবর রাখি না। রোজ সকালে এক কাপ চা না খেলে চলে না অথচ সেটা কী করে তৈরি হচ্ছে সে খবর রাখার প্রয়োজন অনুভব করি না। যে জায়গায় থাকা হয় তার চারধারে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, তাই না?’

অনিমেষ হেসে ফেলল।

সঙ্গে ভ্রূভঙ্গি হল, ‘হাসা হল কেন?’

‘আপনি আমাকে তুমি বলুন। ওভাবে কথা বললে অস্বস্তি হয়।’

‘ও মা, তাই নাকি! আমি ভাবলাম তুমি বললে রাগ হয়ে যাবে। আজকাল ছেলেরা ভীষণ অভিমানী হয়ে গেছে, আত্মসম্মান আত্মসম্মান করেই মরল। তোমাকে তুমি বলতে পেরে আমি বেঁচে গেলাম।’ তৃপ্তির ছাপ ওঁর চোখে।

অনিমেষ বলল, ‘আমাদের ওখানে কাছাকাছি কোনও পাহাড় নেই, তবে পাহাড়ি আবহাওয়া মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। আর সারাদিন আমরা এমন কত জিনিস ব্যবহার করি যার সম্বন্ধে খোঁজ নেবার খুব প্রয়োজন পড়ে না। এই যেমন আমি এখনও জানি না টেলিফোনের সিস্টেমটা সঠিক কী! এরকম তো কত কিছু আছে! তাই চা তৈরির সিস্টেমটা না-জেনেও অনেকে খুব চমৎকার চা তৈরি করতে পারেন, তাই না?’

দাঁতে ডান গাল কামড়ে আলতো করে ছেড়ে দিলেন শীলা সেন, ‘তুমি তো খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারো। তোমার কি এখন কোনও কাজ আছে?’

অনিমেষ মাথা নেড়ে না বলল।

‘তা হলে চলো আমার সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসবে।’ শীলা সেন উঠে দাঁড়ালেন।

‘কিন্তু আমার তো হাঁটতে কষ্ট হবে। কালকে অমন হল, আমি আজ বেরুতে চাই না।’ অনিমেষ আপত্তি জানাল।

শীলা সেনের কথাটা একদম পছন্দ হল না, ‘ইস জোয়ান ছেলের এত ভয় করলে চলে! আর কিছু হলে তো আমি আছি। আচ্ছা বাবা আচ্ছা, তোমাকে এক পা-ও হাঁটতে হবে না। বাইরে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।’

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। উনি এতক্ষণ এখানে বসে আছেন বাইরে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে! আশ্চর্য ব্যাপার! এতক্ষণে তো প্রচুর মিটার উঠে গেছে। কিন্তু যেতে যে তার একটুও ইচ্ছে করছে না। সে হেসে বলল, ‘আজকে আমাকে ভীষণ আলসেমিতে পেয়েছে। আজ থাক।’

শীলা সেন সর্বাঙ্গে তাকে দেখলেন। তারপর খুব আস্তে বললেন, ‘জানো, আজ অবধি কেউ আমার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেনি। শুধু সবাই যেচে এসে আমাকে এইরকম আমন্ত্রণ জানায়, আমি রাজি হলে কৃতার্থ হয়ে যায়। আর নিজে থেকে যদি কাউকে বলি সে আকাশ হাতে পায়। তুমি যে বলতেই আমার কথায় রাজি হলে না এতে তোমার ওপর আমার অন্যরকম ধারণা হল। আচ্ছা, আজ তা হলে চলি ভাই, তোমার যখনই ইচ্ছে হবে আমাকে টেলিফোন কোরো, সারাটা সকাল আমি বাড়িতে থাকি।’

শীলা সেনের পেছন পেছন গেট অবধি এল অনিমেষ। ট্যাক্সি ড্রাইভার সিটের ওপর শরীর এলিয়ে শুয়ে ছিল। ওঁকে দেখে সোজা হয়ে বসল।

গাড়িতে ওঠার সময় শীলা সেন ঘাড় বেঁকিয়ে বললেন, ‘টেলিফোন নম্বরটা মনে আছে তো? থ্রি ফাইভ আর চারটে শূন্য?’

নির্জন গলি দিয়ে ট্যাক্সিটাকে বেরিয়ে যেতে দেখল অনিমেষ। এতক্ষণ কথা বলেও মহিলাকে সে একটুও বুঝতে পারল না। উনি কেন ওর কাছে এলেন, কেন বারে বারে টেলিফোন নম্বর দিচ্ছেন— উদ্দেশ্য কী হতে পারে? নিছক ভদ্রতায় কেউ এতটা করে না। অনিমেষের সন্দেহ হল উনি তাকে এমন কিছুতে জড়াতে চাইছেন যাতে ওঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে। সেটা কী তা জানা যাচ্ছে না কিন্তু তার মতো আদার ব্যাপারীর জাহাজের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কোনও কারণ থাকতে পারে না। মহীতোষ বা সরিৎশেখর এরকম মহিলার সঙ্গে অপ্রয়োজনে তার আলাপের কথা শুনলে আঁতকে উঠবেন। কিন্তু এতক্ষণ ভাবা সত্ত্বেও অনিমেষ অনুভব করল শীলা সেন সম্পর্কে তার কৌতূহল কিছুতেই কমছে না।

ফিরে আসার জন্য অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াতেই দারোয়ানের সঙ্গে চোখাচোখি হল। লোকটা যে মিটিমিটি হাসছে এটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না। প্রায় চার-পাঁচ বছর সে লোকটাকে দেখছে কিন্তু এরকম মুখ করতে কোনওদিন দেখেনি। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বলবে?’

‘মেয়েছেলেটা আপনার কে হয়, বাবু?’

‘চেনাশোনা, কেন?’

একটু ইতস্তত করল দারোয়ান, তারপর বলে ফেলল, ‘ও মেয়েছেলেটা ভাল না।’

‘কেন?’

‘ও মেয়েছেলেটা নিগ্রোসাহেবের সঙ্গে খুব ঢলাঢলি করে। একদিন আটটার পর নিগ্রোসাহেব জোর করে ওকে নিয়ে ঢুকতে চেয়েছিল ঘরে। ভাল মেয়েছেলে হলে রাজি হবে কেন? তা ছাড়া একদিন মাল খেয়ে এসেছিল।’

‘মাল খেয়ে? নেশা করেছিল?’ অনিমেষ অবাক।

‘হ্যাঁ বাবু, নিগ্রোসাহেবও মাল খেয়েছিল। সেদিন অবশ্য মেয়েছেলেটা ট্যাক্সি থেকে নামেনি, কিন্তু আমার চোখ এড়াতে পারেনি।’

‘তুমি কী করে বুঝলে উনি মদ খেয়েছেন?’

‘এ আপনি কী কথা বললেন বাবু। আমি শুকনো নেশা করি বলে ভিজে নেশার গন্ধ টের পাব না! হে হে হে।

শীলা সেন মদ খান কি না-খান, ভাল মেয়ে কি খারাপ মেয়ে তাতে তার কী এসে যায়। একটা ব্যাপার সে অনুভব করতে পেরেছে, শীলা সেন তাকে খুঁজতে এই হস্টেলে হয়তো আর আসবেন না। কিন্তু তিনি অনিমেষের টেলিফোনের প্রতীক্ষায় থাকবেন। ফাঁদ হোক বা নাই হোক, অনিমেষ আর সেখানে পা বাড়াচ্ছে না।

সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসতে কষ্ট হল না। এতক্ষণে কালকের হারানো মনের জোরটা আবার ফিরে এসেছে। শরীরে যে আলসেমি ঘুমঘুম ভাবটা কিছুক্ষণ আগে এসেছিল সেটা আর নেই। জানলার ধারে এসে দাঁড়াতেই ফাঁকা ছাদগুলো আর সিসে-রঙা আকাশটা দেখতে পেল। এইরকম শূন্য দুপুরে কেমন ফাঁকা লাগে কলকাতায়। নীলা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাসস্টপে এসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে! কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে অনিমেষের অস্বস্তি আরম্ভ হল। শীলা সেনের আসার আগে তার এমনটা হয়নি। পরিষ্কার পাজামার ওপর একটা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এল সে। দরজায় তালা দিয়ে নামতে নামতে খেয়াল হল ত্রিদিবরা এসে তাকে না-দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু একটা মেয়ে তার জন্যে বাসস্টপে অপেক্ষা করে আছে আর সে ঘরে বসে থাকবে? তার পা এখন যথেষ্ট সুস্থ, শীলা সেনের সঙ্গে দেখা করতে যে যদি অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে যেতে পারে তা হলে নীলা কী দোষ করল!

ট্রামে ওঠার পর অনিমেষের মনে হল সে বোধহয় একটু দুঃসাহসের কাজ করে ফেলেছে। কারণ, এখন পা বেশ ভার ভার ঠেকছে। ও নিজেকে প্রবোধ দিল এটা শুধু মানসিক ব্যাপার। স্কুলে মণ্টু একটা থিয়োরি দিয়েছিল। এক হাতে খুব যন্ত্রণা হলে সেটা কমাতে অন্য হাতে খুব জোর চিমটি কাটতে হয়। নতুন জায়গায় ব্যথা হলে পুরনোটার ধার কমে যায়। ব্যাপারটা করলে কেমন হয়! কিন্তু অনিমেষ সাহস পেল না।

ইউনিভার্সিটির সামনের স্টপে নেমে পড়ল অনিমেষ। চকিতে মুখ ঘুরিয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নীলাকে খুঁজল। না, নীলা নেই। তাকে আসতে বলে নীলা চলে যাবে? অনিমেষের বুকে অভিমান জমতে শুরু করতেই সে একজনের হাতের ঘড়ি দেখতে পেল। চারটে বাজতে সামান্যই দেরি এখন। তা হলে নীলা এতক্ষণ অপেক্ষা করে করে নিশ্চয়ই চলে গেছে। অভিমান চেহারা পালটে ফেলল আচমকা। নিজেকে খুব অসহায় এবং হৃতসর্বস্ব বলে মনে হচ্ছে। যদি নীলা তার জন্যে অপেক্ষা করে কোথাও চলে যায় তবে সেটা নিশ্চয়ই খুব বেশি সময় আগে নয়। নীলা এখন কোথায় থাকতে পারে? পরপর যে জায়গাগুলো চোখে ভাসল সেগুলো হল কফিহাউস, লাইব্রেরি কিংবা ওর নিজের বাড়ি। এমনও হতে পারে ও চলে গিয়েও আর-একবার ফিরে আসতে পারে অনিমেষ এল কি না দেখবার জন্য। চিন্তাটা সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিল সে। নীলার মতো মেয়ে তা করবে না। সময়মতো না-আসায় অনিমেষকে ও আর আশা করবে না।

অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা নিয়ে অনিমেষ দাঁড়িয়ে ছিল। চারধারে মানুষের ব্যস্ততা, ট্রামবাসের আওয়াজ, ছেলেমেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে, অনিমেষ একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। আধ ঘণ্টা আগেও নীলার সঙ্গে দেখা করার জন্য তার ব্যস্ততা ছিল না। কিন্তু এখন সেই নীলাকে দেখতে না-পেয়ে সব কিছু ফাঁকা মনে হচ্ছে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে সব কিছুই তার জন্যে অপেক্ষা করবে কিন্তু সে সময়মতো সেই অপেক্ষার জায়গায় পৌঁছোতে পারবে না। আর এসব কথা কাউকে বলা যায় না, শুধু বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *