পঁয়ত্রিশ
দক্ষিণেশ্বর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিল অনিমেষ। মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়েছিল গাড়ি। বেশিরভাগ কামরায় জানলা দরজা বন্ধ। এ লাইনে যারা যায় আসে তারা এই স্টেশনটি সম্পর্কে একটু আতঙ্কগ্রস্ত। ছিনতাইকারীরা নাকি লাইন দিয়ে প্লাটফর্মের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ট্রেন ছাড়লেই ঘড়ি-টড়ি টেনে নেয়। কিন্তু অনিমেষ তাদের কাউকে দেখতে পায়নি। বরং কামরার দরজা খোলা না-পেয়ে তার উঠতে কষ্ট হয়েছিল। একটু ছুটোছুটি করার পর সামনে যে দরজা পেয়েছিল তাতেই উঠে পড়েছিল সে। চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরোতে ঘুরোতে মাধবীলতা অনেক দূরের মানুষ হয়ে গিয়েছিল।
বালিব্রিজের ওপর ট্রেনটা আসামাত্র গুম গুম শব্দ উঠল। ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে অনিমেষ। ভারী ব্যাগটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে বুঝতে পারল খুব ভুল হয়ে গেছে। এটা তৃতীয় শ্রেণির কামরা নয়। মিলিটারির জন্য সংরক্ষিত যে কয়েকটা বগি প্রতি ট্রেনে থাকে এটি তার একটি। কামরাটা ফাঁকা। মাত্র জনা পাঁচেক পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরা মিলিটারি শুয়ে বসে তাকে দেখছে। মিলিটারিদের কামরায় সাধারণ মানুষ ওঠে না, ভয়েই ওঠে না। বেআইনি তো বটেই, তা ছাড়া অন্য একটা ভয়ও কাজ করে। কিন্তু এখন ট্রেন পূর্ণ গতিতে চলেছে, সেই বর্ধমানের আগে কোনও বিরতি নেই। সারারাত গা ঢাকা দিয়ে কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে থেকে ধরা পড়তে হল— অনিমেষের পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল।
পাঁচজনই তার দিকে তাকিয়ে, সতর্কতা মেশানো কৌতূহল চোখগুলোতে। অনিমেষ হাত জোড় করে নমস্কার জানাল, ‘মাফ করবেন, আমি বুঝতে পারিনি এটা জেনারেল কম্পার্টমেন্ট নয়।’
ওদের মধ্যে যার কাঁধে ফিতে আঁটা সে উঠে বসল, ‘হিন্দিমে বলিয়ে।’
‘ম্যায় হিন্দি আচ্ছা নেহি বলনে সেকতা— ।’
‘কোই ফিকির নেহি, ট্রাই করো।’
‘ইয়ে মিলিটারিকে কম্পার্টমেন্ট হ্যায় হাম নেহি জানতা থা। আপলোক মুঝে মাফি কি দিজিয়ে, নেক্সট স্টেশন মে উতার যাউঙ্গা।’
‘লুক বিফোর ইউ লিপ। দেখনা চাহিয়ে থা।’
‘আই অ্যাম সরি।’
‘কাঁহা যানা হ্যায়?’
‘শিলিগুড়ি।’
‘টিকেট লে লিয়া ক্যা?’
অনিমেষ পকেট থেকে টিকিটটা বের করে দেখাল।
‘হোয়াটস ইয়োর প্রফেশন?’
‘স্টুডেন্ট।’
‘তো ঠিক হ্যায়, বৈঠ যাইয়ে।’ হাত বাড়িয়ে পাশের খালি জায়গা দেখিয়ে দিল লোকটা। এতটা আশা করেনি অনিমেষ। বিরাট মোচওয়ালা লোকটিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে সিটের ওপর ব্যাগটা রেখে সন্তর্পণে বসল সে। ট্রেন হুহু করে ছুটছে। অনিমেষ দেখল সবকটি চোখ তাকে লক্ষ করছে।
‘ক্যা পড়তা হ্যায় আপ?’
‘এম এ।’
‘শাবাশ। বহুৎ পড়িলিখি আদমি হ্যায় আপ। ম্যায় তো কলেজকা শকল নেহি দেখা। ম্যায় ত্রিলোক সিং, আপকি শুভনাম?’
‘অনিমেষ মিত্র।’
সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল লোকটা। শক্ত হাতগুলো এগিয়ে এল হাত মেলাতে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আড়ষ্টতা কেটে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিমেষ বুঝতে পারল লোকগুলো খুব হাসিখুশি, গল্প করতে ওস্তাদ। ভারতীয় সামরিক বিভাগে এরা নিচু তলায় কাজ করে। কিন্তু কোনওরকম কমপ্লেক্স নেই। আমি একজন জোয়ান, দেশরক্ষা আমার কর্তব্য এই বোধ প্রত্যেকের। এতদিন এইসব কথা শেখানো বুলির মতো মনে হত অনিমেষের, কেউ বললে হাসি পেত। কিন্তু এখন এই বিশ্বাসী মুখগুলোর মুখে ওইসব কথা শুনে সে কোনও অস্বাভাবিকত্ব খুঁজে পেল না।
ত্রিলোক সিংকে জিজ্ঞাসা করল অনিমেষ, ‘আপনার দেশ পঞ্জাবে?’
‘নেহি জি। হরিয়ানায়। গাঁওকা আদমি হাম।’
‘কতদিন চাকরি করছেন?’
‘বিশ সাল হয়ে গেল।’
‘আপনাদের গ্রামের অবস্থা কেমন?’
‘গ্রামের অবস্থা যেমন হয়, ভাল। আমরা তিন ভাই। আমি মিলিটারিতে, আর একজন দিল্লিতে ট্যাক্সি চালায় আর বড় ভাই খেতির কাজ করে। আমাদের গ্রামের প্রতিটি বাড়ির একজন ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ করে।’
‘আপনি বিয়ে থা করেছেন?’
সঙ্গে সঙ্গে কামরায় হাসির রোল উঠল। প্রতিটি মুখের দাঁত দেখা যাচ্ছে। ত্রিলোক সিং-এর পাশের লোকটি বলল, ‘আরে শাদির কথা কী বলছ, ওর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই নিয়েই তো আমাদের সমস্যা।’
অনিমেষ অবাক হল। এই লোকটির স্বাস্থ্য দেখে বয়স মাপা মুশকিল। কিন্তু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ভাবা যায় না। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘সমস্যা কেন?’
লোকগুলো আবার একচোট হেসে নিল। ত্রিলোক সিং হাসছে না কিন্তু ঘনঘন মাথা নাড়ছে আপত্তিতে।
‘সমস্যা নয়! ওর মেয়ের বয়স পনেরো, জামাইয়ের সাতাশ। এদিকে ওর জরুর বয়স মাত্র উনত্রিশ। জামাই চায় শাশুড়ি মাঝেমধ্যে তার বাড়িতে গিয়ে থাকুক। সেটা কি সম্ভব?’
ত্রিলোক সিং হাত পা নেড়ে বলল, ‘এসব কথা শুনবে না। বহৎ বুরা বাত। আমার জামাই মাটির মানুষ। ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু গ্রামে নিজেই ট্রাক্টর চালায়। আমার বউকে মায়ের মতো সম্মান দেয়।’
‘ইয়ে কেতাব কি বাত হ্যায়। আমরা দশ মাস বাড়ির বাইরে থাকি। আমাদের বউরা কে কী করছে জানতে পারব? আর উনত্রিশ বছরের শাশুড়ি আর সাতাশ বছরের জামাই— কম্বিনেশনটা খুব খারাপ।’
লোকটা কথা শেষ করতে না-করতেই ত্রিলোক সিং হাত তুলে তেড়ে গেল তার দিকে। আর সবাই হইচই করে ওদের ছাড়িয়ে দিতে দেখা গেল ব্যাপারটা যে স্রেফ মজা তা ত্রিলোকও জানে। বেশ খুশ মেজাজে সে ফিরে এসে বসল। বসে বলল, ‘বাংগালকা ইয়ে কানুন আচ্ছা নেহি হ্যায়।’
‘কী ব্যাপারে?’
‘এই যে তোমরা ত্রিশ-চল্লিশ সাল তক বিয়ে করো না, মেয়েরা ত্রিশ সাল হলেও একা একা ঘুরে বেড়ায়। খুব খারাপ। আরে যৌবন তো আসে পনেরো বছর বয়সে। পনেরো থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে যদি তাকে এনজয় না-করলে তো তার এসে কী লাভ। পাকা কলা খেতে ভাল লাগে, কিন্তু হেজে গেলে কি আর স্বাদ পাওয়া যায়?’
‘বিয়ে করবে কী করে? খাওয়াবে কী?’
‘পরিশ্রম করো। রোজগার করো।’
‘এ-দেশে পরিশ্রম করলেই ভাল রোজগার করা যায় না।’
‘কেন? আমরা পারি তোমরা পারবে না কেন? এই দেখো, আমার বড় ভাই চাষবাস দেখে। তা থেকে যে ফসল আসে তাতে সারা বছরের খাওয়া হয়ে যায়। আমার টাকা আর ভাইয়ের টাকায় অন্যসব খরচ মিটে যায়। আরে বড়লোক হবার কী দরকার, ভালভাবে দিন কাটাতে পারলেই তো হল।’
‘তোমাদের কোনও সমস্যা নেই?’
‘কী সমস্যা?’
‘জোতদারদের অত্যাচার, পলিটিক্যাল পার্টির বিশ্বাসঘাতকতা, যা আয় তার থেকে ব্যয় বেশি, চারধারে ধান্দাবাজ লোক অথচ কিছু করা যাচ্ছে না— এসব সমস্যা নেই।’
ত্রিলোক সিং একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘এ সমস্যা তো সব জায়গায়। কিন্তু সমস্যা আছে বলে তোমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকো তা হলে দোষ তোমাদের। বাঙালিরা কাম করে না শুধু বাত করে। অথচ আমি সুভাষ বোসের নাম জানি, তিনি হিন্দুস্থানের শের ছিলেন। আমার ঠাকুরদা তাঁকে দেখেছেন। তিনি কী করে সারা দুনিয়ার সম্মান পেলেন?’
‘দেখো, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর দশ ডবল হয়ে গেছে। পাকিস্তান থেকে জলের মতো লোক এসেছে। চাষের জমি সব জোতদার বড়লোকের হাতে। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। একটা লোক সারাদিন পরিশ্রম করে যে টাকা পাবে তাতে তার একারই পেট ভরে না। এখানে মুষ্টিমেয় কিছু লোক আরামে থাকে। সরকার তাদের মদত দেয়। মানুষের সামনে যখন কোনও রাস্তা থাকে না তখনই সে দিশেহারা হয়। তোমরা জানো না তাই একথা বলছ।’
ত্রিলোক সিং কিন্তু অনিমেষের কথা মানতে চাইল না। অনিমেষ লক্ষ করল দেশের সরকারের বিরুদ্ধে এই লোকটির কোনও বিরূপ মনোভাব নেই। ওর মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিল, ভারত সরকার বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে সমান ব্যবহার করে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব মানুষ বিতাড়িত হয়ে এ-দেশে এসেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছেন। ক্ষতিপূরণ, কম মূল্যে জমি পেয়ে তাঁরা এ-দেশে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির অণুমাত্র পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষগুলোর জন্যে ব্যয় করা হয়নি। পঞ্জাব-হরিয়ানায় চাষবাসের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছে সরকারের সরাসরি চেষ্টার ফলে। যা এ প্রান্তের মানুষ ভাবতে পারে না। ভারতীয় সামরিক বিভাগে শিখ রেজিমেন্ট আছে কিন্তু বেঙ্গলি রেজিমেন্ট রাখা হয়নি। তাই ত্রিলোক সিং এ-দেশের সমস্যা বুঝতে পারবে না। অথচ আশ্চর্য, আমরা একই দেশের অধিবাসী। বিপ্লবের চিন্তা করলে এদের নিশ্চয়ই বাদ দিয়ে ভাবা যাবে না।
হঠাৎ অনিমেষের মনে হল ত্রিলোক সিং এবং তার সঙ্গীরা রাজনীতির ব্যাপারটা এড়িয়ে কথা বলছে। এ ব্যাপারে তাদের একটা সতর্ক মনোভাব আছে। ভারতীয় সামরিক বিভাগের চাকরির প্রধান শর্ত হল কোনওরকম রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকা চলবে না, রাজনৈতিক বিষয়ে প্রকাশ্যে মতামত ব্যক্ত করাও অপরাধ। অতএব এরা এ বিষয় সযত্নে পরিহার করবেই। এবং অনিমেষ যদি এসব কথা বেশি বলতে থাকে তা হলে হয়তো তাদের অভদ্র ব্যবহার করতে বাধবে না।
বর্ধমান স্টেশনে গাড়ি থামলে অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। বাইরে যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার জন্য ছুটোছুটি করছে। দু’-তিনজন এই কামরার দরজায় এসে উঁকি মেরেই ভয়ে সরে যাচ্ছে। এ-দেশে এখনও মিলিটারিদের সম্পর্কে প্রচুর ভীতি ছড়িয়ে আছে। অনিমেষ ব্যাগে হাত দিতেই ওরা হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘আরে যাচ্ছ কোথায়?’
‘এটা তোমাদের কামরা, আমি বর্ধমান নেবে যাব বলেছিলাম!’
‘তা বলেছিলে, তুমি যাবে কোথায়?’
‘শিলিগুড়িতে।’
‘তা হলে এখানে নামছ কেন? বসো। এখন তুমি আমাদের বন্ধু হয়ে গেছ। এখানেই আরাম করো।’
অনিমেষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বাইরে যা ভিড় তাতে অন্য কামরায় কীরকম জায়গা পাওয়া যাবে তাতে সন্দেহ ছিল। তা ছাড়া এই মিলিটারি কামরায় সে স্বর্গের চেয়েও নিরাপদ। কোনও পুলিশের অনুচর যদি এই ট্রেনে থাকে তা হলে সে ভুলেও সন্দেহ করবে না একজন ‘উগ্রপন্থী’ মিলিটারি কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছে। দুপুরের খাওয়াটা ওরাই জোর করে খাওয়াল। রুটি আর সবজি। লোকগুলো ওই সামান্য খাবার খুব নিষ্ঠার সঙ্গে খেয়ে নিল তৃপ্ত মুখে। অনিমেষ মন খুলে খেতে পারল না, এ ধরনের রান্নায় সে অভ্যস্ত নয়। বাস্তবিক, এরা যে এত অল্পে সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে পারে তা সামনাসামনি না-দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। আমাদের বাঙালি বাড়িতে এই খাবার পরিবেশিত হলে বাড়ির সবাই বিদ্রোহ করত। অথচ এরা, ‘আও জি, খানা খা লেও’ বলে এমন ভাব করছিল, যেন বিয়েবাড়ির ভোজ খেতে ডাকছে।
জানলায় বসে দুপুরের বর্ধমান জেলা দেখতে লাগল অনিমেষ। গুসকরা, বোলপুর—। বোলপুরে সামনের মাসে আসতে হবে। মাটির রং পালটে যাচ্ছে। বর্ধমান থেকে বীরভূম। সামনের মাসে মাধবীলতা এখানে আসবে। বোলপুরে নয়, ও আসবে বর্ধমান স্টেশনে, এসে অনিমেষের জন্য অপেক্ষা করবে। অনিমেষ বোলপুরে না-নেমে একটু এগিয়ে বর্ধমানে এসে ওর সঙ্গে দেখা করবে।
গতরাতে একটুও ঘুম হয়নি অনিমেষের। শীলা সেনের বাইরের ঘরে ওর বিছানা করে দেওয়া হয়েছিল। রাত্রের খাওয়া খেয়েছিল শীলা সেনের সঙ্গেই। একটা রাত ওই বাড়িতে সে থাকল কিন্তু সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। খাওয়া সেরে শুতে যাওয়ার সময় মাঝের ঘরে লোকটাকে দেখেছিল সে। ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন চোখে হাত চাপা দিয়ে। অনিমেষ যে এসেছে, এতক্ষণ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে এবং রাত্রে ওই বাড়িতেই থাকছে— এসব ব্যাপারে সামান্য আগ্রহ দেখাননি তিনি। অনিমেষের মনে হয়েছিল একটা পাথরের পুতুলকে ইজিচেয়ারে শুইয়ে রাখা হয়েছে। অথচ ওই পুতুলটাই শীলা সেনের শরীরে অ্যাসিড ঢেলেছে— ভাবলেই শরীর গরম হয়ে যায়। শরীর বেচে পয়সা আনতে পাঠানো যায় কিন্তু কোথাও যদি বিনামূল্যে মন দিয়ে দেওয়া যায় তা হলে আর সহ্য করা যাবে না। লোকটাকে যদি বেধড়ক পেটাতে পারত তা হলে অনিমেষ খুশি হত।
অপরিচিত বিছানা, সারাদিনের উত্তেজনা ও অস্বস্তিতে ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসছিল না। সারারাত এপাশ ওপাশ করেছিল অনিমেষ। মধ্যরাতে কোথাও শব্দ হলে চমকে উঠেছে। বাল্যকালে ছোটকাকার সন্ধানে গভীর রাতে পুলিশ তাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। সেই দৃশ্যটা বারবার চোখের ওপর ভাসছিল।
শেষরাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিমেষ খেয়াল নেই। চোখ মেলে দেখল সামনে মাধবীলতা। মাধবীলতা? চমকটা এতখানি যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি সে। মাধবীলতা হাসল, ‘কেমন আছ?’
তড়াক করে উঠে বসল অনিমেষ। দরজা ভেজানো। বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে মাধবীলতা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে জানলা দেখল সে। এখনও রোদ ওঠেনি। কলকাতার ভোর ভীষণ আদুরে, এখনও সে আদর সারা আকাশে মাখানো।
‘কখন এলে?’
‘মিনিট দশেক।’
‘ক’টা বাজে?’
‘ছ’টা।’
‘কে দরজা খুলল?’
‘বাঃ, তুমি একদম কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমুচ্ছিলে। বেশ কয়েকবার শব্দ করার পর একজন খুব রোগা ভদ্রলোক দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই? আমি তোমার নাম বলতে তিনি তোমাকে দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। সেই থেকে এখানে বসে আছি। এ-ঘরে আছ অথচ তুমি শুনতে পেলে না, অন্য লোক দরজা খুলল!’
অনিমেষ লজ্জিত মুখে বলল, ‘শেষরাতে হঠাৎ ঘুমটা এল— কিন্তু তুমি এই ভোরে এলে কী করে এখানে?’
‘পায়ে হেঁটে। বেড়াতে বেড়াতে চলে এলাম।’
অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কোথাও মালিন্য নেই, সামান্য ক্লান্তির চিহ্ন নেই। ওর পায়ের কাছে একটা সুন্দর ব্যাগ, ব্যাগটা ভারী। ওটা কী-ইঙ্গিত করল অনিমেষ।
‘তোমার জিনিসপত্র আছে, ব্যাগটা অবশ্য আমার। তোমার ট্রাঙ্ক নিয়ে তো আর হাঁটা যাবে না। সেগুলো আমার কাছে রইল। কাজ চালানোর মতো জিনিসপত্র এটায় দিয়েছি।’
‘তোমার কাছে ওরা গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। কাল রাত্রে সব জিনিসপত্র আমাকে দিয়ে এসেছে।’
‘আমাকে আজই চলে যেতে হবে শিলিগুড়িতে।’
‘জানি। কিন্তু এই বাড়িটা কার?’
‘আমার পরিচিত এক মহিলার। তোমাকে কখনও বলিনি বোধহয়। এখন অ্যাসিডে পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছেন, অথচ এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন।’ কী পরিস্থিতিতে তাকে এখানে আসতে হয়েছিল অনিমেষ সংক্ষেপে মাধবীলতাকে বলল। কাল রাতে শীলা সেন তার সঙ্গে যে সহযোগিতা করেছেন এতটা সে আশা করেনি। মাধবীলতা গালে হাত দিয়ে এসব কথা শুনছিল। অনিমেষ চুপ করলে বলল, ‘কাল তুমি ফোন করলে যখন তখন আমি ভাবতেই পারিনি এতসব কাণ্ড হয়ে গেছে। তোমার টেলিফোন নামিয়ে ফিরে যাচ্ছি এমন সময় দারোয়ান এসে জিনিসপত্র দিয়ে গেল। সঙ্গে একটা চিঠি।’
‘চিঠি? কার চিঠি?’
‘ঠিক চিঠি নয়, জাস্ট একটা ইনফর্মেশন। শিলিগুড়ির স্টেশন পাড়ায় ঢুকে অনন্ত ভাণ্ডারের উলটো দিকে বারীন সরকারের সঙ্গে তোমাকে দেখা করতে বলা হয়েছে।’
‘দেখি কাগজটা?’
‘আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।’
‘কেন?’
‘বাঃ, এসব প্রমাণ কাগজে কলমে থাকা কি ভাল?’
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এমন শ্রীময়ী মুখ আজ অবধি তার চোখে পড়েনি। এ মেয়ে ইচ্ছে করলেই স্থায়ী নিরাপদ তকমাওয়ালা স্বামীর স্ত্রী হতে পারত। অথচ-! অনিমেষের নিশ্বাস ভারী বোধ হল। নিজেকে মাঝে মাঝে এমন অপরাধী মনে হয়। ভালবেসে মেয়েরাই এমন করে বৈরাগী হতে পারে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল দুই হাতে মাধবীলতার মুখ স্পর্শ করতে, হাতের বৃত্তে ওই শক্তিকে আস্বাদ করতে। নিজেকে সংযত করল অনিমেষ। প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে তো আবার স্কুলে যেতে হবে।’
‘আজ যাব না।’
‘কেন?’
‘গিয়ে পড়াতে পারব না বলে।’
অনিমেষ আবার হোঁচট খেল। সেই সময় পায়ের শব্দ হতে সে যেন একটু স্বস্তি পেল। হাত পায়ে রাস্তা মেপে শীলা সেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, ‘আরে আসুন আসুন। আপনি আবার কত কষ্ট করে এতদূর এলেন কেন? আমরাই যেতাম।’
‘কেন! আমি তো ভাই নিজেই সারা বাড়িতে ঘুরে বেড়াই। তোমার বন্ধু এসে গেছে শুনলাম—।’ শীলা সেনের সমস্ত শরীর আলখাল্লা জাতীয় পোশাকে ঢাকা, মাথায় কালো রুমাল, চোখে রঙিন চশমা। তবু এই সকালেই তাঁকে দেখে সহ্য করা মুশকিল।
অনিমেষ বলল, ‘হ্যাঁ। মাধবীলতা ওর নাম, আর ইনি শীলা সেন।’
শীলা সেন বললেন, ‘বাঃ, বেশ সেকেলে নাম তো, মাধবীলতা। শুনলেই মনে হয় খুব শান্ত। তুমি খুব সুন্দর দেখতে, তাই না?’
অনিমেষ দেখল মাধবীলতা হাসি চাপছে ঠোঁট বুজে। সে বলল, ‘দারুণ সুন্দর দেখতে। রাস্তা দিয়ে হাঁটা মুশকিল হয়।’
সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা প্রতিবাদ করল, ‘যাঃ, একদম বিশ্বাস করবেন না। আমি মোটেই সুন্দরী নই।’
অনিমেষ বলল, ‘আপনি বসুন।’
মাধবীলতা এগিয়ে গিয়ে ওঁর হাত ধরে সোফার ওপর এনে বসাল। অনিমেষ দেখল মাধবীলতা স্বচ্ছন্দে শীলা সেনের পাশে গিয়ে বসেছে। ওঁর বিকৃত চেহারার জন্য মাধবীলতার কোনও মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। শীলা সেন বললেন, ‘তুমি বাথরুমে যাবে তো অনিমেষ? তা হলে ভেতরের ঘরে গিয়ে ডান হাতে বাথরুমের দরজা পাবে।’
অনিমেষের প্রয়োজন ছিল। সঙ্গে টুথব্রাশ পেস্ট নেই কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল হল মাধবীলতা ব্যাগ নিয়ে এসেছে। সে এগিয়ে এসে ব্যাগটা তুলতে যেতে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী খুঁজছ?’
‘ব্রাশ, পেস্ট!’
‘সামনের খাপে আছে।’
শীলা সেন বললেন, ‘এই না, ওগুলো তোমার খাপেই থাক। আমি তোমার জন্যে নতুন ব্রাশ বাথরুমে বের করে দিয়েছি, পেস্ট তোয়ালে ওখানে পাবে। তোমার জিনিস কিছুই বের করতে হবে না।’
অনিমেষ বলল, ‘সে কী! আমারটা যখন পেয়ে গেছি তখন খামোকা একটা নতুন ব্রাশ নষ্ট করার কী দরকার!’
শীলা সেন বললেন, ‘তা তো বলবেই ভাই। এখন নিজের জিনিস পেয়ে গেছ এখন আর আমাতে মন উঠবে কেন!’ ইঙ্গিতটা এমন সরাসরি যে মাধবীলতা মুখ ঘোরাল এবং অনিমেষের মুখে আচমকা রক্ত জমল। একটু সময় দিলেন শীলা সেন। এখন তাঁর গলার স্বর অন্যরকম লাগছিল, ‘নষ্ট হবে কেন বলছ! ব্রাশটা না-হয় আমি তুলে রাখব, ভাবব কখনও যদি আবার এখানে আসো তখন তুমি ব্যবহার করবে। আমার ভাইয়ের একটা স্মৃতি না-হয় থাকল।’
ওই মুহূর্তে প্রায়-অন্ধ এই মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি অনিমেষের আর ছিল না। সে দ্রুত ভেতরের ঘরে চলে এল। ডান দিকের দরজাটা বন্ধ। অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাঁদিকের ইজিচেয়ার শূন্য, একটা খাট রয়েছে একপাশে, সেটাও খালি। অর্থাৎ মি. সেন এখন বাথরুমে ঢুকেছেন। লোকটা অদ্ভুত, কেমন কেঁচোর মতো রয়েছে বাড়িতে। গতরাত থেকে ওঁর অস্তিত্ব একবারের জন্যও টের পায়নি অনিমেষ। মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে ফিরে আসছিল অনিমেষ, এমন সময় দরজাটা খুলল। লিকলিকে রোগা শরীরে একটা ধুতি লুঙ্গির মতো জড়ানো, হাতে কিছু ভেজা জামাকাপড় নিয়ে মাথা নিচু করে বের হলেন ভদ্রলোক। অনিমেষের মুখের দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ালেন। অনিমেষ চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেল। তার সঙ্গে কথা না-বললে সে নিজে থেকে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলবে না। এক চৌবাচ্চা জল দেখে স্নান করার ইচ্ছা হল ওর। আজ সারাদিন আর স্নান করার সুযোগ নাও জুটতে পারে। এখন জলে একটু হিমভাব কিন্তু কলকাতার নভেম্বর মাসে শীতের কোনও অস্তিত্ব নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে স্নান করে বেরিয়ে আসবার সময় নজরে পড়ল জল যাওয়ার ঝাঁঝরির কাছে কিছু একটা পড়ে আছে। কৌতূহলে ঝুঁকে দেখল একটা সোনার তাগা সেখানে কাত হয়ে পড়ে আছে। একটা খাঁজে লেগে থাকায় ওটা নর্দমার ভেতর চলে যায়নি। অনিমেষ হাতে তুলে নিয়ে দেখল তাগার ভেতরটা ফাঁপা কিন্তু জিনিসটা যে সোনার তাতে সন্দেহ নেই। পেছন দিকে সুন্দর অক্ষরে লেখা আছে বিশ্বনাথ সেন। শীলা সেনের স্বামীর হাত থেকে পড়েছে এটা? অনিমেষের একবার ইচ্ছে হল ওটাকে নর্দমাতেই ফেলে দেয়। শরীর রোগমুক্ত করার জন্য এর মাধ্যমে দৈবের উপর নির্ভর করার কোনও প্রয়োজন নেই ভদ্রলোকের। যে মানুষ অমন অপরাধ করেছে তার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। শেষ পর্যন্ত ওটাকে পকেটে রেখে বেরিয়ে এল অনিমেষ। বেরিয়েই দেখল কেঁচোর মতো লোকটা অধীর আগ্রহে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। সে বেরোনোমাত্র ছুটে গেল ভেতরে। অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াল। লোকটা পাগলের মতো বাথরুম হাতড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সে ডাকল, ‘এই যে, শুনুন।’
সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল লোকটা। ভয়ে ভয়ে তাকাল অনিমেষের দিকে। পকেট থেকে তাগাটা বের করে মুখের সামনে ঝুলিয়ে ধরল সে। প্রায় বুলেটের মতো ছুটে এল লোকটা, এসে ছোঁ মেরে তাগাটা নিয়ে চলে গেল পাশের দরজা দিয়ে। নেবার মুহূর্তে কী বীভৎস হয়ে গিয়েছিল মুখটা, একটা ঘা-খাওয়া শঙ্খচূড়ের মতো মনে হয়েছিল অনিমেষের। এই মুখ যে-কোনও পাপকর্ম অবলীলায় করে যেতে পারে, অথচ বাথরুম থেকে যখন প্রথম বের হলেন ভদ্রলোক তখন কত নিরীহ দেখাচ্ছিল। খুব অস্বস্তি নিয়ে বাইরের ঘরে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল শীলা সেনের সঙ্গে মাধবীলতার ভাব হয়ে গেছে।
সামনের টেবিলে চা টি-কোজিতে ঢাকা। মাখন লাগানো রুটিতে মাধবীলতা চিনি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। শীলা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি একেবারে স্নান করে এলে?’
‘হ্যাঁ। আবার সুযোগ পাব কিনা জানি না।’
‘কখন ট্রেন তোমার?’
‘ন’টা পঁয়ত্রিশ।’
‘সকালে?’
‘হ্যাঁ।’
চায়ের কাপ এগিয়ে দিল মাধবীলতা। শীলা সেনের হাতে একটা কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার তা হলে এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত।’
শীলা সেন বললেন, ‘সেকী, এখন তো সাতটাও বাজেনি।’
‘আমার মনে হয় দক্ষিণেশ্বর থেকে ট্রেনে ওঠা উচিত। শিয়ালদা স্টেশন নিরাপদ নাও হতে পারে।’
তাই ঠিক হল। এখন সকাল। ওরা এখান থেকে বেরিয়ে চৌত্রিশ নম্বর বাসে চেপে দক্ষিণেশ্বর চলে যাবে। সেখান থেকে ট্রেনে উঠবে অনিমেষ। হাতে যথেষ্ট সময় আছে, তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই।
বিদায় নেবার সময় শীলা সেন কোনও কথা বলতে পারলেন না। শুধু মাধবীলতার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত ফিসফিস করে বললেন, ‘সাবধানে থেকো। ওর জন্যে তোমার সাবধানে থাকা দরকার।’
এই একটি কথা ভীষণ ভার হয়ে দাঁড়াল। ওরা নীরবে হেঁটে এল বিবেকানন্দ রোড অবধি। অনিমেষ সতর্ক ছিল। কোনও সন্দেহজনক মানুষকে চোখে পড়ল না। বড় রাস্তায় এসেই একটা খালি ট্যাক্সি ধরল মাধবীলতা। অনিমেষ প্রতিবাদ করল, ‘সময় আছে, বাসেই যাওয়া যাবে বেশ।’
মাধবীলতা কোনও কথা শুনল না। ট্যাক্সিতে বসে বলল, ‘তুমি চলে যাচ্ছ, একটুখানি সময় অন্তত তোমার পাশে বসি। বাসে তো হাজার লোকের চোখ থাকবে।’
বিবেকানন্দ রোড থেকে দক্ষিণেশ্বর আসতে মাত্র আধ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এই পথটুকু ওরা একটাও কথা বলেনি। মাধবীলতা ওর পাশে বসে একটা হাত মুঠোয় ধরেছিল চুপচাপ। ট্যাক্সি থেকে নামার আগে অনিমেষ বলেছিল, ‘তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?’
মাথা নেড়েছিল মাধবীলতা, না।
ফাঁকা দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তখনই ঠিক হয়েছিল সামনের মাসে পৌষমেলার দিন বর্ধমান স্টেশনে এই ট্রেনে অনিমেষ ফিরবে। মাধবীলতা সেইমতো অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে ওরা একসঙ্গে বোলপুরে যাবে।
ট্রেনে ওঠার আগে টিকিট কেটে প্রায় নিঃসম্বল অনিমেষের পকেটে জোর করে দুশো টাকা গুঁজে দিয়েছিল মাধবীলতা। বলেছিল, ‘আমি চাকরি করছি কার জন্যে, একটুও লজ্জা করবে না। শোনো, গিয়ে চিঠি দিয়ো। তোমার চিঠি না-পেলে আমি কিন্তু কলকাতায় থাকতে পারব না। দেখবে, গিয়ে হাজির হব।’
রাজার মতো শিলিগুড়িতে পৌঁছে গেল অনিমেষ। পাঁচজন সামরিক মানুষ তাকে বন্ধুর মতো আগলে নিয়ে এল। সন্ধেবেলায় শিলিগুড়ির স্টেশন পাড়ায় অনন্ত ভাণ্ডারের সামনের বাড়িটার দরজা খুলে লম্বা চুল, ময়লা পাঞ্জাবি, একটা হাত সামান্য নুলো এক ভদ্রলোক ওকে স্বাগত জানালেন, ‘আপনি অনিমেষ মিত্র? আমার নাম বারীন সরকার। ভেতরে আসুন, আপনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি।’