২৬. অনিমেষের মুখের দিকে

ছাব্বিশ

অনিমেষের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল বিমান। ঘরে সুদীপ ছাড়া আর কেউ নেই। এতক্ষণ গড়গড় করে কিছুটা মিথ্যে বলার পর অনিমেষ এখন ভেতরে ভেতরে নার্ভাস বোধ করছিল। এই সময়টার জন্যে সে মনে মনে অনেক রিহার্সাল দিয়ে আসা সত্ত্বেও বুঝতে পারছিল তার দেখানো কারণ খুব জোরালো নয়।

বিমান সুদীপের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী মনে হচ্ছে?’

নেভা চুরুট দেশলাই কাঠি গিয়ে ঠিক করতে করতে সুদীপ বলল, ‘চট করে মনে হবে ও মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু মফস্‌সলের ছেলেদের মানসিকতা বড্ড ঘোলাটে। দেশের কাছাকাছি গেলে সবরকম দায়িত্ব বিস্মৃত হতে ওদের বেশি সময় লাগে না।’

বিমান বলল, ‘অনিমেষ, আমি তোমার কথায় কোনও লজিক খুঁজে পাচ্ছি না। দাসপাড়ায় বসে তুমি খবর পেলে তোমার দাদুর অসুখ হয়েছে এবং কাউকে কিছু না-জানিয়েই জলপাইগুড়ি চলে গেলে। সেখানে এতদিন থাকলে অথচ আমাদের কাউকে একটা চিঠি দিয়ে ব্যাপারটা জানাতে পারলে না। প্রথম কথা, দাসপাড়ায় তোমাকে ওই খবর দেবার জন্য কে বসে থাকবে? দ্বিতীয়ত, খবর পেলে তোমার টিমকে জানানোর সময় ছিল না এটা অবিশ্বাস্য। তৃতীয়ত, জলপাইগুড়ি থেকে তুমি দাসপাড়ায় ব্যাক করতে পারতে কিংবা আমাকে চিঠি দিতে পারতে।’

অনিমেষ নিচু গলায় বলল, ‘আপনাকে তো বললাম, খবরটা শুনে আমি এমন আপসেট হয়ে গেলাম যে কারও সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি। চিঠি দেবার কথা ভেবেছিলাম কিন্তু কোন ঠিকানায় দেব বুঝতে পারিনি।’

সুদীপ বলল, ‘তোমাকে তো এতটা নির্বোধ বলে মনে হয় না! তুমি এই কথাটা স্পষ্ট বলতে পারছ না কেন অত কাছাকাছি গিয়ে তোমার খুব মন কেমন করছিল দেশে যাওয়ার জন্য এবং তুমি জানতে যে পারমিশন পাবে না তাই কেটে পড়েছিলে চুপচাপ।’

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘না, এ-কথা ঠিক নয়।’

বিমান বলল, ‘আমি তোমার ব্যবহারে মর্মাহত। তোমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের জন্য আমাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। তুমি উধাও হয়ে গেলে, তুমি তো খুনও হয়ে যেতে পারতে! সেক্ষেত্রে পার্টি কী জবাব দিত? মোদ্দা কথা তুমি পার্টির কাছে আমাকে অপদস্থ করেছ।’

হঠাৎ সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার দাদুর খবরটা যদি আমরা যাচাই করি?’

‘স্বচ্ছন্দে।’ অনিমেষ নড়েচড়ে বসল, ‘শহরের অনেকেই জানে এখন।’

‘কী হয়েছিল ওঁর?’

‘লেপ্রসি।’

অনিমেষ দেখল দু’জনেই একসঙ্গে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দু’জনের মুখের অবস্থা দেখে খুব কষ্টে হাসি চাপল সে। আমরা যতই মুখে প্রগতির কথা বলি না কেন, এইসব অকারণ আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু ব্যাপারটাকে সে কাজে লাগাল, ‘ওই খবর পাওয়ার পর আমার মাথা ঠান্ডা থাকতে পারে? আমার ছেলেবেলায় দাদুর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।’

গলার স্বর বদলে গেল বিমানের, ‘দুঃখিত। কথাটা যদি ইউনিয়নের ঠিকানায় জানিয়ে দিতে তা হলে এই ভুল বোঝাবুঝি হত না। যা হোক, উনি কেমন আছেন?’

‘চিকিৎসা চলছে। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব শকিং।’

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি চেষ্টা করব যাতে পার্টি তোমার সম্পর্কে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত না-নেয়। কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। আমাদের মনে রাখা উচিত পৃথিবীর যে-কোনও ব্যক্তিগত সমস্যার চাইতে দলের কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বিমান খুব দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, ‘আমার মনে থাকবে।’

ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি চুকে যাবে বুঝতে পারেনি অনিমেষ। সে নিশ্চিত ছিল ছাত্র ফেডারেশন তাকে বাতিল করে দেবে। সেটা হলে তার আপাতত কিছুই করার থাকছে না। দেশের জন্য কেউ যদি কিছু করতে চায় তা হলে তাকে একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতেই হবে। পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেসের বিকল্প দল এখন একটাই। যদিও ঘোলাজলের মতো একই জায়গায় পাক খাচ্ছে তবু যা কিছু নাড়াচাড়া এই দলেই। বামপন্থী কমিউনিস্ট দলের কাজকর্ম, মতবাদ এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনওরকম আশা করার কিছু না-থাকলেও খুব সামান্য কাজ এই দলে থাকলেই করা যাবে। সেই দু’পা এগোনো এবং এক পা পিছিয়ে যাওয়া ব্যাপার আর কী।

কলকাতায় ফিরে এসে তার মনে হয়েছিল কেউ তাকে মাথার দিব্যি দেয়নি যে রাজনীতি করতে হবে। তার সহপাঠীরা, কলকাতায় লক্ষ লক্ষ মানুষেরা এসব না-করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এম এ পাশ করে একটা যে-কোনও চাকরি জুটিয়ে নিয়ে হাজারটা সমস্যার মধ্যে ওইরকম কাটিয়ে দেওয়া যায়। আজকের ভারতবর্ষে কেউ কি দেশের কথা ভেবে রাজনীতি করে? ব্রিটিশ আমলে যাঁরা দেশের কথা ভাবতেন তাঁদের স্বদেশি বলা হত। এখন বলা হয় না কেন? ব্রিটিশের বিকল্প যদি প্রতিক্রিয়াশীল শোষকরা হয় তো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাও তো স্বদেশি করা হতে পারে। মুশকিল হল, স্বাদেশিকতাকে এখন সংকীর্ণ মনোভাবের প্রকাশ বলা হয়। অথচ বৃহত্তর ব্যাপারটার কোনও মাথামুন্ডু নেই এ-কথা জানলেও কেউ মানতে চাইবে না।

কেন তার মনে হয় আমাদের দেশের মানুষগুলো স্বাধীন নয়? কেন মনে হয় লক্ষটা সংস্কার এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা থেকে লাভবান হয় একটিমাত্র শ্রেণি। যদি এই দেশের মানুষের আর্থিক কাঠামোটা এক করা যেত তা হলে দেশের চেহারাটাই পালটে যেত। এটা ঠিক, আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় কোনও দলেরই সেই কাজ করা সম্ভব নয়। সুদীপরা বলবে সীমাবদ্ধ সুযোগের মধ্যে যেটুকু কাজ করা যায় তাই করা উচিত। অনিমেষের মনে হয় এ একধরনের ফাঁকিবাজি। বিরোধীদল হিসেবে কংগ্রেসের সমালোচনা বা বিক্ষোভ দেখানোর মধ্যে একধরনের বাহাদুরি আছে কিন্তু গঠনমূলক কাজকর্ম, যাতে দেশের সমগ্র মানুষ সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে তা করা সম্পূর্ণ আলাদা। কমিউনিজমের থিয়োরি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। কারণ প্রতিটি দেশের মাটি এবং মানুষের মনের চেহারা এক নয়। কিন্তু এসব চিন্তা তার মাথায় আসে কেন? অনেক ভেবেছে অনিমেষ, কিন্তু নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার সপক্ষে কোনও কারণ খুঁজে পায়নি। চারপাশে এতরকম অসাধুতা যে নিজের মনের কাছেই দোষী হয়ে থাকতে হয়।

এই এবার জলপাইগুড়ি থেকে ফেরার সময় চোখের সামনে টিকিট চেকারকে ঘুষ দেবার জন্য যাত্রীদের হুড়োহুড়ি করতে দেখল। যারা দিচ্ছে এবং যে নিচ্ছে তাদের কেউ তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিতে পড়ে না। এসব দেখে তার মধ্যে কেন ছটফটানি শুরু হয়? সেই কোন শৈশবে বন্দেমাতরম শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সমস্ত শরীরে এক ধরনের আবেগের কাঁটা উঠত, তাই বা কেন হত? সেই সময়ে রক্তে রোপিত স্বদেশি চিন্তাটা এতকাল নানান তাপে চেহারা পালটে কি তাকে এই ছটফটানি দিয়ে গেছে? তাই যদি হয় তবে সুদীপ-বিমানদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকাই উচিত। ওরা কিছু করুক না-করুক কথাবার্তায় অনেক কিছু করার একটা পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে। এটুকুই লাভ। অনিমেষের খেয়াল হল আজ বিমানদের আস্থা ফিরিয়ে আনবার জন্য দাদু তাকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করলেন। এই একটি মানুষের কাছে তার ঋণ ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে এবং পৃথিবীর কোনও দামে তা শোধ করা যাবে না।

কংগ্রেসের অবস্থা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। নেতৃত্ব চিরকালই বৃদ্ধদের হাতে থাকে। পশ্চিমবাংলার কংগ্রেসিরা বিধান রায়ের পর নিজেরা কে কতখানি স্থবির প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েছেন। তাঁদের অন্ধ বিশ্বাস গান্ধীজির নামের মধ্যে একটা জাদুমন্ত্র আছে যার দ্বারা দেশের মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়। এই দেশ মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া কিছু নয়। বিরোধীরা শুধু চিৎকারেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে, তাই ওদের কাছ থেকে কোনও ভয় নেই, মাঝে মাঝে দু’-এক টুকরো রুটি ছুড়ে দিলেই যথেষ্ট। তাঁরা যে মেহনত করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তার দাবিতে চিরকাল তাঁদের গদিতে বসিয়ে রাখা দেশবাসীর পবিত্র কর্তব্য। এইসব ধারণা থেকেই ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের সৃষ্টি। যে গণতন্ত্রকে ধনিক-গণতন্ত্র বলা যায়। এই বুর্জোয়া ডেমোক্রেসি দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না। কংগ্রেস সেটি আমদানি করেছে। বামপন্থী দলগুলো যদি নির্বাচনে জেতে তা হলে ওই বুর্জোয়া ডেমোক্রেসির মধ্যে দিয়েই তাদের যেতে হবে।

বামপন্থী দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেসকে সরাতে চাইছেন। ধনিক শ্রেণির ব্যাকিং যদি না-থাকে তা হলে ফললাভ কষ্টকর। আর সত্যিই যদি ফল পাওয়া যায় তা হলে বুঝতে হবে এতকালে দেশের মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারা বামপন্থীদের ভোট দিচ্ছে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু একটা সাইকেলকে প্যাডেল ঘোরালে সামনের দিকেই নিয়ে যাওয়া যায়, পেছনদিকে প্রয়োজনেও চালানো যায় না। নির্বাচনে জিতলে তাই বামপন্থীদের সম্পর্কে জনসাধারণ বাধ্য হয়ে মোহমুক্ত হবেন।

কিন্তু পাশাপাশি আর-একটা ব্যাপার অনিমেষ লক্ষ করছিল। ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি আগামী নির্বাচনের কথা স্মরণ রেখে কৃষক সভার মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছে। খাস জমি বণ্টন, বর্গাস্বত্ব, খাদ্য, কাজ, মজুরি হল তালিকাভুক্ত। একটু একটু করে অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া থেকে নিম্নবিত্তশ্রেণি গণতান্ত্রিক অধিকার ও ক্ষমতা দখলের জন্য ভাবতে শুরু করেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ব্যাপক রাজনৈতিক নির্যাতন জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। জনগণের একাংশ এর থেকে মুক্তি পাবার আশায় ক্রমশ রাজনৈতিক পরিবর্তন কামনা করতে শুরু করেছে। এই চেতনাটাকে কাজে লাগাচ্ছে বামপন্থীরা। যদিও তাঁদের পথ বুর্জোয়া ডেমোক্রেসির বাঁধা পথেই শেষ হবে কারণ ব্যবস্থাটা যে এক। তবু এই আলোড়নের সময় যুক্ত থাকাই যে-কোনও কর্মীর উচিত। অনিমেষ বিমান-সুদীপের সঙ্গে মিশে গেল।

আজকাল অনিমেষের হাতে তেমন পয়সাকড়ি থাকে না। এবারে বাবার কাছে সে মুখ ফুটে বেশি টাকা চাইতে পারেনি। দাদুর অবস্থা দেখার পর তা সম্ভবও নয়। পরমহংসের মতো টিউশনি যে তার পক্ষে করা সম্ভব নয় এটা বুঝতে পেরেছে। সামান্য ক’টা টাকার জন্য ওরকম বাঁধা জীবন মেনে নেওয়া অসম্ভব। অথচ কোনও আশু সমাধান নেই।

দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে এসে অনিমেষ শুরু করল সেটা হল পড়াশুনা। এতদিন তার ঘরের টেবিল জুড়ে কমিউনিজমের ওপর লেখা নানান বই পত্রপত্রিকা ছড়ানো থাকত। সব কাজ চুকিয়ে রাত্রের খাওয়ার পর বই নিয়ে বসত অনিমেষ। পড়তে গিয়ে অনিমেষ প্রথমে ভেবেছিল সে অসীম সমুদ্রে পড়বে। দীর্ঘদিন সংস্রব না-থাকায় একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাংলা এমন একটা বিষয় যে সামান্য মস্তিষ্ক থাকলে দখল নেওয়া কষ্টকর নয়। একমাত্র ভাষাতত্ত্ব বুঝতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। ব্যাপারটা ফাঁকিবাজি দিয়ে সম্ভব নয়। পালি প্রাকৃতও প্রথমে ওইরকম মনে হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পঠনের ফলে সবকিছুর মেডইজি বেরিয়ে যায়। অনিমেষ ঠিক করল, যাই হোক না কেন এম এ-টা এবারেই সম্মানের সঙ্গে পাশ করতে হবে। কোনও ফলশ্রুতি নেই, পাশ করলেও অন্ধকার-এসব জেনেও করতে হবে। কারণ নিজেকে অযোগ্য ভাবতে সে রাজি নয়। যে বাসনা নিয়ে এ-দেশের মানুষ রাজনীতি করে সেই বাসনাতেই তাকে পাশ করতে হবে।

মাধবীলতা এখন অদ্ভুত চুপচাপ। দাসপাড়ার অভিজ্ঞতা এবং তার পরের ঘটনা অনিমেষ ওকে বুঝিয়ে বলেছে। মাধবীলতা শুনেছে কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যেন অনিমেষ যা করবে তা সে বুঝে-সুঝেই করবে। ক্রমশ মেয়েটা যেন তার ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে ফেলছে। এ নির্ভরতা প্রতি মুহূর্তের অর্থনৈতিক চাহিদার নয়, মানসিকতার। অনিমেষ কোনও অন্যায় করতে পারে না এরকম একটা বিশ্বাস ওর মনে অটল। সেই প্রথম দিকের জ্বলে ওঠা মেয়েটা যেন কোনও জাদুমন্ত্রে এখন সমর্পণের ভঙ্গিতে বসে থাকে তার কাছে। যদি কোনও কথায় বা কারণে ব্যথা পায় তা হলে চোখ তুলে শুধু চাহনিতেই বুঝিয়ে দেয় সে কথা। এরকম মেয়েকে আঘাত দেওয়া যায় না। অনিমেষ অনুভব করে, মাধবীলতা তার জীবনে থাকলে কোনও অশুভ শক্তি তার ক্ষতি করতে পারবে না।

ভিয়েতনামে আমেরিকা তার চূড়ান্ত আঘাতটি হানল। যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মরিয়া হয়ে যায় তখন তার অন্ধতা আসে। কিন্তু এই নৃশংস আঘাতেও ভিয়েতনামিরা ভেঙে পড়ল না। আমেরিকানরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সমস্ত বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আমেরিকার বিরুদ্ধে ধিক্কারে উত্তাল। বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। এমনকী আমেরিকাতেও একই দৃশ্য দেখা গেল।

পরপর কয়েকদিন ওরা আমেরিকান দূতাবাস আর চৌরঙ্গি তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করল, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কুশপুত্তলিকা পোড়াল। ট্রাফিক বন্ধ, নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন ভিয়েতনামিদের সপক্ষে। অনিমেষরা স্লোগান দিচ্ছিল, দুনিয়ার সর্বহারা এক হোক।

কিন্তু ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত মানুষেরা চাপা উষ্মা প্রকাশ করছিল। অবশ্য এত বড় মিছিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস কারও নেই। অনিমেষ শুনল, একজন চাপা গলায় আর একজনকে বলছে, ‘শালা আমাদের হাজারটা সমস্যার সমাধানের নাম নেই, কোথায় ভিয়েতনামে আমেরিকা কী করছে তা নিয়ে কুমিরের কান্না কাঁদছে।’

অনিমেষ কথাটা বিমানকে বলতেই বিমান ক্রুদ্ধ হল। সুরেন ব্যানার্জি রোডের রোদে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই মানসিকতা কংগ্রেসি কুশাসনের ফসল। আমার ঘরে জল পড়ছে বলে অন্যের ঘরের আগুন নেভাতে ছুটব না?’

অনিমেষ বলল, ‘আমরা প্রতিবাদ করছি ঠিক আছে। কিন্তু ভিয়েতনামিদের জন্য আমাদের কিছু করা উচিত।’

বিমান বলল, ‘আমাদের সমর্থন ওদের কাছে পৌঁছে দিলে ওরা জোর পাবে।’

‘তা ঠিক।’ অনিমেষ বলল, ‘অন্যভাবে আমরা যদি সাহায্য করি তা হলে ওদের উপকার হয়, আমরাও কাজে কিছু করতে পারলাম বলে তৃপ্তি পাব।’

‘কীভাবে?’

‘জামাকাপড়, ওষুধ, খাবার এসব পাঠিয়ে।’

‘ভাল। কিন্তু আমাদের ফরেন সার্ভিস সেগুলো পৌঁছে দেবে কি না কিংবা সরকার তাতে অনুমতি দেবে কি না তা তো জানি না। ঠিকই বলেছ, ভিয়েতনামি সংগ্রামীদের জন্য সাহায্য তোলা যায়।’ বিমান বলল।

সংগ্রামী শব্দটার পাশে সাহায্য কথাটা খুব খারাপ শোনাল অনিমেষের কানে। সে বলল, ‘না, লোকের কাছে ভিক্ষে করব না। আমরা একটা বড়সড় অনুষ্ঠান করে টিকিট বিক্রি করে টাকা তুলে ওষুধ কিনতে পারি। আপনি কথা বলে দেখুন।’

অনুমতি পাওয়া গেল। ইউনিভার্সিটি ইউনিয়ন থেকে ভিয়েতনাম এইড কমিটি হল। সুদীপ কনভেনার, অনিমেষ সম্পাদক। কয়েকদিন ধরে জোর আলোচনা চলল। ঠিক হল মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠানটি হবে। সকালে হলে কম ভাড়া লাগে। যেরকমভাবে হোক খরচ কমাতে হবে। সবাই একমত হল যে কোনওরকম হালকা গান-বাজনা বা নাটক হবে না। জনসাধারণকে উজ্জীবিত করতে পারে এইরকম অনুষ্ঠানসূচি করা দরকার। তখনই পালটা কথা এল, অর্থসংগ্রহ যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তা হলে জাগরণের গান-ফান হলে টিকিট বেশি বিক্রি হবে না। দেখা গেল, কমিউনিস্ট পার্টির গণনাট্য সংঘের সঙ্গে একদা যুক্ত থেকে যাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন তাঁরা হয় পার্টি ছেড়ে দিয়ে লঘু অনুষ্ঠান করছেন নয় ডানপন্থী কমিউনিস্ট বলে পরিচিত। ভারতীয় মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কালচারাল ফোরামে কোনও জনচিত্তজয়ী শিল্পী নেই। তা হলে? দু’-একজন তাত্ত্বিক কিংবা প্রচুর কর্মী এবং বক্তা থাকা এক আর প্রকৃত শিল্পী থাকা অন্য কথা। তখন ঠিক হল কমিউনিজমের প্রতি অনুগত অথচ কোনও দলের সঙ্গে জড়িত নন এমন শিল্পীর সন্ধান করতে হবে। এই অবস্থায় সুদীপ প্রস্তাব দিল নাটক অভিনয় করানোর। কলকাতার প্রখ্যাত দল ‘জনবাণী’ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল এবং শ্রদ্ধা প্রচুর। কারণ এই দলের বিখ্যাত পরিচালক-অভিনেতা এখন বাংলাদেশের নাট্যজগতের অন্যতম স্তম্ভ। চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে সফল হলেও নাট্যকর্মেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি। তাঁর দল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। ভারতীয় মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নন তিনি। কিন্তু ‘জনবাণী’ দল সবসময় সর্বহারার পক্ষে নাটক করে। প্রতিটি নাটকই প্রচণ্ড জনসমর্থন পেয়েছে তার পরিবেশনা, প্রযোজনা এবং প্রধান অভিনেতা পরিচালক সুবিমল গুপ্তের জন্য। সুবিমলবাবুর নাটকগুলো কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রচণ্ড সমর্থন করছে জনমানস গঠন করতে। মাঝে মাঝে পার্টির হয়ে পথ-নাটকও করছেন তিনি। এবং সবচেয়ে বড় কথা ওঁর সাম্প্রতিক নাটক ‘ভিয়েতনাম লাল সেলাম’ দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হল।

অনিমেষ আরও দু’জন ছাত্রের সঙ্গে সুবিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেল। মাধবীলতা আগ্রহ প্রকাশ করেছিল যাওয়ার জন্য। সুবিমলবাবুর ফ্যান প্রত্যেকেই। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকের চোখে ঠেকবে বলে সে এল না। সুবিমলবাবুর বাড়িতে ঢুকে অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। সুন্দর সাজানো গোছানো এবং চারপাশে বৈভব ছড়ানো। একজন সংগ্রামী কমিউনিস্ট মানসিকতার মানুষ এত আরামে এ দেশে থাকেন? ঘরের দেওয়ালে লেনিনের বিরাট ছবির পাশে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন। চোস্ত পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে হাতে চুরুট নিয়ে সুবিমলবাবু মোটা গলায় বললেন, ‘আরে বসো বসো। তোমরা ঠিক সময়েই এসেছ বলে খুশি হলাম। তুমি বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো?’

অনিমেষ প্রথম দেখল সুবিমলবাবুকে কিন্তু তার সঙ্গীরা বেশ গদগদ হয়ে পড়েছে। তারা বলল, ‘না না, আপনি তুমিই বলুন।’

‘ভেরি গুড। আমাদের দেশের তরুণ কমরেডদের দেখে খুশি হলাম। নাউ, টেল মি, তোমাদের প্রবলেম কী?’ মুখে চুরুট রেখেই কথা বললেন সুবিমলবাবু।

অনিমেষ নিজেই সামনের চেয়ারে বসে বলল, ‘প্রবলেম নয়। ভিয়েতনামে আমরা কিছু ওষুধ পাঠাতে চাই।’

‘খুব ভাল কথা। কনস্ট্রাকটিভ কাজ।’

‘হ্যাঁ। এইজন্য অর্থ দরকার। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাজাতি সদনে একটি অনুষ্ঠান করে টাকাটা তুলব। আমরা চাই আপনি সাহায্য করুন।’ অনিমেষ হাসল।

‘কীভাবে?’

‘ভিয়েতনাম লাল সেলাম অভিনয় করুন। আপনি পাশে দাঁড়ালে হাউসফুল হয়ে যাবে।’

‘কবে?’

‘বারো তারিখে সকালে হল পাওয়া যাবে।’

‘তোমাদের বাজেট কত?’

‘বাজেট?’

‘এ-বাবদ আমার দলকে কত দেবে?’

‘আমরা ভাবিনি কিছু। খরচ যতটা কমানো যায় তত আমরা সাহায্য পাঠাতে পারব।’

‘বুঝলাম। বোধহয় ওইদিন আমি খালি আছি। ওয়েল, আমার দল কল শো-এর জন্য অনেক বেশি নেয়। যেভাবে খরচ বাড়ছে সামলানো মুশকিল। তবু তোমরা তিন দিয়ো।’

‘তিন, তিন হাজার?’ হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ।

‘নো বারগেন।’

অনিমেষ পাথর হয়ে গেল। এই মানুষটি সর্বহারাদের বন্ধু? কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে পথসভা করেন? ভিয়েতনামিদের সমর্থক? সে খুব নিচু গলায় বলল, ‘এত টাকা দিলে আমরা তো কিছুই ওখানে পাঠাতে পারব না।’

‘আই কান্ট হেল্প। একবার যদি সবাই জেনে যায় ওর কমে আমি শো করেছি তা হলে আমার বাড়ির সামনে একমাইল লাইন পড়ে যাবে কল শো-র। সবাই বলবে ওই টাকায় করুন। কাকে ঠেকাব তখন? তুমি হয়তো ভাবলে আমার মুখে এ কী কথা! রাইট। কিন্তু আমার রাজনৈতিক চিন্তা আর প্রফেশনাল এটিকেট এক নয়। হতে পারে না। একজন সরকারি কর্মী যেমন সরকার বিদ্বেষী স্লোগান দিলেও সরকারের কাজ করে মাইনে নেন পেটের জন্য। আমিও দুটোকে এক করতে পারি না।’

অনিমেষ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়ছিল সে। কোনও চিন্তা মাথায় আসছিল না। এ কী ধরনের কমিউনিজম-মনস্কতা?

সুবিমলবাবু হঠাৎ হাসলেন, ‘ঠিক আছে? তোমরা এক হাজার দিতে পারবে? ওনলি ওয়ান থাউজেন্ড।’

সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠল অনিমেষ, ‘নিশ্চয়ই।’

‘দেন, টিকিট বিক্রি করো। বারো তারিখ বললে না? এগারো তারিখে বিকেলে টাকাটা পৌঁছে দিয়ো। আই উইল বি দেয়ার।’

বাইরে বেরিয়ে এসে সঙ্গীরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল। অনিমেষের খারাপ লাগছিল নিজের কথা ভেবে। ভদ্রলোক যে ওকে নিয়ে খেলা করছিলেন তা সে বুঝতে পারেনি, না-পেরে আজেবাজে চিন্তা করেছে। সুবিমলবাবুকে নিয়ে আজ সবাই গর্ব করে, তিনি কি ভিয়েতনামের সাহায্য অনুষ্ঠানে না-এসে পারেন?

হুহু করে একদিনের টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের আগের দিন টাকাটা পৌঁছে দেওয়া হল। মহাজাতি সদন টইটম্বুর। সকালবেলাতেই ‘জনবাণী’ এসে গেছে। মেকআপ নিচ্ছেন তাঁরা। অনিমেষকে নানান ঝামেলা সামলাতে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। সুদীপের সঙ্গে সুবিমলবাবু কথা বলছিলেন। অনিমেষ দেখল উনি এখনও মেকআপ নেননি।

অভিনয় শুরুর একটু আগে সুদীপ বলল, ‘আজকের অনুষ্ঠানের আগে কেন এটা করছি তা দর্শকদের বলা দরকার। সুবিমলবাবুও বলবেন।’

পরদা উঠল। অত মানুষের সামনে এই প্রথম অনিমেষ কথা বলল মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে। উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে দর্শকদের এবং জনবাণীকে ধন্যবাদ দিল সে। তারপর সুদীপ এসে বলল সে সুবিমলবাবুকে অনুরোধ করছে কিছু বলার জন্য। সুবিমলবাবুর নামের আগে অনেক জনদরদি বিশেষণ দিল সে। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত অনিমেষ দেখল সুবিমলবাবু আর একজন সঙ্গীর ওপর ভর দিয়ে কোনওক্রমে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, ‘আমি অত্যন্ত অসুস্থ। ডাক্তার আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলেছেন। কিন্তু ভিয়েতনামের জন্য ছাত্রবন্ধুরা যখন এই অনুষ্ঠান করছেন তখন কি আমি শুয়ে থাকতে পারি? না, আমি কোনও বিশেষণের যোগ্য নই। একটু অভিনয় করতে চেষ্টা করি মাত্র। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে চিরকাল লড়ে যাব, জনসাধারণকে বোঝাব তাঁরা কী অবস্থায় আছেন। আমি একজন সৈনিক মাত্র। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবু না-এসে পারলাম না। আমার দল অভিনয় করবে, আপনারা সহযোগিতা করুন। আমার সঙ্গে বলুন আপনারা, ভিয়েতনাম লাল সেলাম।’ সঙ্গে সঙ্গে হল ফেটে গেল শব্দে, ‘লাল সেলাম, লাল সেলাম।’

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্টেজ থেকে বেরিয়ে এসে অনিমেষের মুখোমুখি পড়ে গেলেন সুবিমলবাবু। চুরুট বের করে বললেন, ‘একটা দেশলাই দাও তো।’

চোয়াল শক্ত করে অনিমেষ বলল, ‘আমার কাছে নেই।’ আর একজন ছুটে এসে দিল তাঁকে। সেটা নিয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনিমেষকে দেখলেন সুবিমলবাবু। তারপর অদ্ভুত কায়দায় হাসলেন, ‘দেশলাইয়ের বাক্সটা দেখেছ? বারুদমাখানো কাঠিগুলোকে জলবাতাস থেকে বাঁচানোর জন্য এই বাক্সটা দরকার। কোনটা দামি? বাক্স না কাঠি? দুটোই। তাই না?’

কথাটা শেষ করে স্মার্টলি বেরিয়ে গেলেন হল থেকে। সেখানে তাঁর গাড়ি অপেক্ষা করছে। তখন নাটক শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকান মিলিটারির অত্যাচার দেখে দর্শকরা ধিক্কার দিচ্ছে। জনবাণী দারুণ অভিনয় করছে, সুবিমলবাবুর বদলে যিনি করছেন তিনিই সর্বহারাদের কথা সমান দরদে মঞ্চে বলছেন।

অনিমেষ নাটক দেখছিল না। সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে সাজানো, রঙিন বেলুনের মতো মনে হচ্ছিল। বেলুনটা বাড়ে না কারণ সে জানে তা হলে ফেটে যেতে পারে। কিন্তু একটা সুচ দরকার, অবিলম্বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *