ষোলো
এমন বিষধর সাপ আছে যে দাঁত বসালেই মুহূর্তে শরীর নীল হয়ে যায়, কোনও বৈজ্ঞানিক তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। অনিমেষ শুনেছে বিষ যখন শরীরে কাজ করে তখন আপাত যন্ত্রণার চাইতে নেশা মানুষকে আচ্ছন্ন করে, ঘুম পায়। এবং সেই খানিক ঘুম কখন চিরকালের হয়ে যায় সে টের পায় না।
নতুন হস্টেলের এই ঘরে গতকালের রাত নিঝুম কেটেছে অনিমেষের। চোখের সামনে আকাশের চেহারা পালটানো, শেষ ট্রামের শব্দটা ডুবে গিয়ে হঠাৎ কলকাতা শীতল হল এবং শেষ পর্যন্ত কখন প্রথম ট্রাম নতুন দিনটাকে টেনে নিয়ে এল সে টের পায়নি।
চোখের পাতায় জোনাকির মতো আগুনের ফুলকি নেচে বেড়ায় যার সে ঘুমুবে কী করে! আর চোখ খুলতেই যার মুখ— সে মাধবীলতা।
ভোরের প্রথম আলো যে এত আন্তরিক হয়, এত সহজ নরম অনুভূতি বুকে ছড়ায় জানা ছিল না অনিমেষের। এই আলো এখন পৃথিবীর অনেক জায়গায় এমন সোহাগি হয়ে রয়েছে। কিন্তু অনিমেষের মনে হল, তার মতো এমন আপন হয়ে আর কারও কাছে যায়নি। জীবনে কখনও কোনও নেশা করেনি বা তার সুযোগ আসেনি কিন্তু কাল থেকে নিজেকে কেমন নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। যেন সেই মারাত্মক সাপটা আচমকা ছোবল বসিয়ে দিয়ে গেছে এবং এখন তার আর কিছু করার নেই।
অথচ মাধবীলতাকে গতকাল দুপুরের আগে সে ভালভাবে চিনতই না। ক্লাসে মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু সেই চোখের ভাষা পড়তে কখনওই সচেষ্ট ছিল না সে। কোনও সংস্কারের বশে প্রতিরোধ শক্তি যে তাকে বিরত করেছিল তা নয়, এসব ব্যাপারে সে নিজেই নিস্পৃহ ছিল। এবং ইদানীং রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় সে এমন ডুবে ছিল জীবনের এই দিকটা খেয়াল হয়নি। অথচ গতকালের ওইরকম উত্তেজনাময় ঘটনাগুলোয় যখন তার নার্ভ টানটান ঠিক তখন এমন করে সে নিহত হবে তা কে জানত। হেসে ফেলল অনিমেষ জানলায় দাঁড়িয়ে। অনেকদিন আগে শোনা কথাটা মনে পড়ল, সে জানে না কখন মরে গেছে।
কিন্তু মাধবীলতাকে সে চেনে না। ওর পারিবারিক পরিচয় তার জানা নেই। শুধু এটুকুই মনে হয়েছে মেয়েটি নরম এবং বোকা নয়। কোনও কোনও মেয়ে বোধহয় সহজে আত্মসমর্পণ করার জন্য জন্মায় না, মাধবীলতা এই ধরনের মেয়ে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার সময় অনিমেষ দেখেছে মাধবীলতার নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে এবং সেটাকে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলার ক্ষমতা রাখে। এরকম সতেজ ডাঁটো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে কোনও মেয়েকে অনিমেষ দেখেনি। কলকাতায় এসে নীলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নীলা অবশ্যই খুব ডেসপারেট মেয়ে, কোনওরকম ভিজে ব্যাপার ওর নেই। কিন্তু নীলা কখনওই আকর্ষণ করে না, বুকের মধ্যে এমন করে কাঁপন আনে না। যে-কোনও পুরুষ-বন্ধুর মতো নীলার সঙ্গে সময় কাটানো যায়। তা ছাড়া কয়েকটি বিশেষ ব্যাপারেই নীলার মানসিকতা বদ্ধ, মাধবীলতার মতো এমন দ্যুতি ছড়ায় না।
অথচ গতকাল এমন কোনও সংকেত বা ইঙ্গিত মাধবীলতা দেয়নি যে অনিমেষের এরকম হতে পারে। বরং বলা যায়, মাধবীলতা সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তাকে আহত করে কথা বলছিল। অথচ যেই ট্রেনটা চলে গেল স্টেশন ছেড়ে অমনি অনিমেষকে কেউ যেন আচমকা ছুড়ে দিল এমন এক অসীমে যেখানে শুধুই ভেসে থাকতে হয়, ভেসে যেতে হয়। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল সে যে মাধবীলতাকে ঘিরে এসব ভাবছে এটা তো সে সমর্থন নাও করতে পারে। এমনও হতে পারে মাধবী অন্য কাউকে ভালবাসে!
কথাটা মনে হতেই একটা অস্বস্তি শুরু হল। গতকাল থেকে যে জোয়ার সবকিছু ছাপিয়ে ফুটে উঠেছিল একটু একটু করে তা থিতিয়ে যেতে লাগল। মাধবীলতাকে সে জানে না এবং এ অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করে হয়তো খেলো হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া মাধবীলতার সামাজিক এবং পারিবারিক অবস্থাও তার অজানা। কাউকে পেতে হলে তার যোগ্য হতে হয়। অনিমেষের এই প্রথম মনে হল মানুষ হিসেবে তার যোগ্যতা কতখানি সে কখনও ভেবে দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এমন একটা বিষয় নিয়ে পড়ছে যার বাজারমূল্য শূন্য, বাবার প্রচূর অর্থ নেই, শারীরিক সুস্থতা পায়ের জন্য সবসময় মেনে নেওয়া যায় না। একে কি যোগ্যতা বলে? তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে প্রবেশের পর পড়াশুনায় মন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাস আছে, ক্লাসে যা পড়ানো হচ্ছে একটু চেষ্টা করলেই সে রপ্ত করে নিতে পারবে।
কিন্তু এসব তো যোগ্যতা-বিচারে প্রতিকূল মতামত সৃষ্টি করবে। এই বয়সে নিশ্চয়ই অন্য কোনওভাবে নিজেকে যোগ্য করতে পারে না। যদি অর্থনৈতিক সাফল্য বা সামাজিক পদমর্যাদা যোগ্যতার মাপকাঠি হয় তা হলে মাধবীলতার নাগাল পাওয়া অবশ্যই দুঃসাধ্য। বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত ও-দুটো সাফল্যের কথা তার চিন্তায় কখনও আসেনি। আজ মাধবীলতার জন্যে সেটা সম্ভব নয়। নিজের পছন্দ মতো কিংবা বলা যায় মনের মতো পড়াশুনায় সে চিরকাল নির্ভর ছিল। হয়তো বাবার নির্দেশ মেনে বাংলার বদলে অর্থকরী বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করলে আজ এসব ভাবতে হত না।
অনিমেষ হেসে ফেলল, না, এজন্যে ওর কোনও আফশোস নেই। দেশের জন্যে এককালে যে ধরনের সেন্টিমেন্ট কাজ করত ওর মনে, ইদানীং সেটা নেই বটে কিন্তু অন্যরকম দৃষ্টিতে দেশ— এই সমাজব্যবস্থাকে দেখতে শুরু করেছে। ইদানীং সে বুঝতে পেরেছে যে সাধারণ মানুষ নিজেকে ভারতীয় বলে অনুভব করে না। এই ভারতবর্ষে জন্মে বড় হয়েও কেউ ভারতবর্ষ নিয়ে কোনও চিন্তা করে না। মানুষের চিন্তা-ভাবনা এখন তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে জড়িত। এই দেশ নিজের, এই অনুভূতি যখন মানুষের নেই তখন সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন কী করে আশা করা যায়! রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিশেষ বিশেষ চশমা দিয়ে সমস্যাগুলিকে দেখে। তবু অনিমেষের মনে হয় কমিউনিস্ট পার্টি একমাত্র কাছের দল যার সঙ্গে কাজ করলে এই পরিবর্তন সম্ভব। একটা বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়র বা ডাক্তার হওয়ার চেয়ে একজন আন্তরিক কর্মী হওয়া অনেক কাম্য মনে করে সে।
কিন্তু এসব কথা মাধবীলতাকে বোঝানো যাবে কি! যদি না-যায়, যদি তাকে মাধবীলতা গ্রহণ না-করে তা হলে কি ওর প্রতি অনিমেষের মনে যে অনুভূতি জন্ম নিয়েছে তা মিথ্যে হয়ে যাবে? স্লেট মোছার মতো মুছে ফেলা যায়? সেই ছেলেবেলায় সীতা তার বালক মনে যে ঢেউ তুলেছিল, যার প্রকাশ কখনই সোচ্চার হয়নি, তা তো নেহাতই ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু নয়, ধোঁয়া ধোঁয়া ছিল সব। কিন্তু যে অনুভূতি জলের দাগের মতো এখন অস্পষ্ট হয়েও রয়ে গেছে তাকে কি অস্বীকার করা যায়? আসলে ভালবাসা কখনও কোনও শর্ত মেনে আসে না, আমরা তার ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ করি। কেন যে এমন হয়!
জীবনে আর কখনও এমন করে সময় পার করার তাগিদ অনুভব করেনি অনিমেষ। আজকের প্রথম ক্লাস বারোটায়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় হাতে। একটা মিনিট কাটতে যেন এক প্রহর লাগছে। বারোটা বাজলেই মাধবীলতার দেখা পাওয়া যাবে। এখন, চোখ বন্ধ করলেই সেই ঝকঝকে মুখ, সামান্য নিচু, মুখের ভঙ্গিমায় ধরে রাখা দীঘল চোখের চাহনি— যেন বুকের গভীরে অনন্ত হয়ে মিশে যায়।
দরজায় শব্দ হতে অনিমেষ কপাট খুলল। এই হস্টেলের কনিষ্ঠ চাকর চা নিয়ে দাঁড়িয়ে। দরজা খোলামাত্র ঝড়ের মতো টেবিলে কাপ রেখে উধাও হল। ইদানীং বাসি মুখে চা খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের অভ্যেস পালটে যায়? এই যেমন, চিরকাল সে নিজের জামাকাপড় নিজেই ধুয়ে নিত, জলপাইগুড়িতে থাকার সময় এই অভ্যেসটা হয়ে গিয়েছিল। আগের হস্টেলেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এখানে এসে ওই ছোকরা চাকরটা যখন পাঁচ টাকার বিনিময়ে সারা মাস কাজ করে দেবে বলল তখন অনিমেষ রাজি হয়ে গেল। পাঁচটা টাকা অত্যন্ত মূল্যবান ওর কাছে তবু ওই সময়টুকু বাঁচিয়ে আলসেমি করার বিলাসিতা এখন ভাল লাগে।
এই হস্টেলের চেহারা অবশ্য সবদিক দিয়েই আলাদা। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি এখানে অনেকটাই শিথিল। এর একটা কারণ শুধু কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এখানে আছে। এমন কেউ শুধু সন্ধেবেলায় আইন কলেজে পড়ার সুবাদে দিনে চাকরি করা সত্ত্বেও এ হস্টেলের আবাসিক। স্কটিশচার্চ কলেজ অবশ্য এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সুপারিনটেনডেন্ট ভদ্রলোক ওখানকার অধ্যাপক কিন্তু এটাকে একটা ভাল মেস ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
চায়ের কাপ শেষ করতে না-করতেই দরজায় শব্দ হল। এ-ঘরে সে একা। ছাদের ওপর এরকম নির্জনে ঘর পাওয়া কপালগুণেই সম্ভব হয়েছে। মাঝে মাঝে অনিমেষের মনে হয়েছে ভাগ্যদেবী তাকে খানিকটা কৃপা করে থাকেন। এটা ভাবলে আত্মবিশ্বাস বেশ বেড়ে যায়। অনিমেষ দরজা খুলে দেখল দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে বলল, ‘বাবু, এক বুড্ডা আপকো ঢুঁড়তা হ্যায়?’
‘কাঁহা?’
‘গেটপর বৈঠা হ্যায়।’
কেন কোনও বৃদ্ধ তাকে খুঁজতে এসেছে বোধগম্য হল না অনিমেষের। কলকাতায় এমন কোনও বৃদ্ধের সঙ্গে ওর আলাপ নেই যে এখানে আসতে পারে। দারোয়ানকে বৃদ্ধকে ওপরে পাঠিয়ে দেবার কথা বলতে গিয়ে মত পরিবর্তন করে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে নিজেকে মার্জিত করে সে খানিকটা সময় নিয়ে একতলায় নেমে এল। একতলায় এখন দারুণ কর্মব্যস্ততা। বিরাট চাতালে বাসন মাজা চলছে সশব্দে। এই সকালেই বাথরুমে লাইন পড়ে গেছে। অনিমেষ বাইরের গেটের দিকে এগিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। দারোয়ানটা টুলে বসে খইনি টিপছিল, জিজ্ঞাসা করতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
অনিমেষের মনে হল ওর বুকের মধ্যে একটা লোহার বল আচমকা লাফিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে দিয়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কোনওরকমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল সে কোনায় রকের দিকে। বৃদ্ধ নিজেকে গুটিয়ে থামের গায়ে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। তাঁর পাশে দুটো বড় ঝোলা, ময়লা ধুতির ওপর একটা সুতির কোট যার অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। মাথা পরিষ্কার করে কামানো বলে মুখের চেহারাটা একদম বদলে গেছে। অনিমেষ কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। কোনওরকমে সে উচ্চারণ করল, ‘আপনি?’
বৃদ্ধ চোখ মেললেন, ঘোলাটে চোখ। দৃষ্টি যে স্বাভাবিক নয় বোঝা যায় এবং শরীরের কাঁপুনিটা স্পষ্ট। অনিমেষ একটু সচেতন হয়ে ঝুঁকে প্রণাম করতে যেতেই একটা হাত ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিল, ‘না, অসুস্থ মানুষকে প্রণাম করতে নেই।’
অনিমেষ সোজা হয়ে দাঁড়াতেই শরীর শিহরিত হল। যেন অকস্মাৎ কেউ একটানা সমস্ত ছেলেবেলাটাকে তার সামনে হাজির করল। এই শরীরের সঙ্গে কোনও মিল নেই, কিন্তু ওই কথাগুলো শুধু সরিৎশেখরই অমন ভঙ্গিতে বলতে পারেন। কিন্তু দাদুর এ কী চেহারা হয়েছে! গত দু’-তিন সপ্তাহ সে জলপাইগুড়ি কিংবা স্বর্গছেঁড়া থেকে কোনও চিঠিপত্র পায়নি। কিন্তু সরিৎশেখরের মতো মানুষ দুটো ঝোলা নিয়ে মাথা কামিয়ে এমন নোংরা পোশাকে ঘুরে বেড়াবেন— কল্পনাতেও আসে না। অনেকগুলো প্রশ্ন এখন জিভে কিন্তু অনিমেষ নিজেকে সামলে নিল। সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আপনি হাঁটতে পারবেন?’
‘আমি তো হেঁটেই এলাম,’ সরিৎশেখর জানালেন।
অনিমেষ জানে শত অসুস্থ হলেও দাদু তা নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু বলার মানুষ নন। সে দুটো ঝোলা কাঁধে দিয়ে দাদুর হাত ধরল, ‘উঠুন’!
সরিৎশেখর ক্লান্ত চোখে তাকালেন, ‘তোমার ঘর কদ্দুর?’
ততক্ষণে সরিৎশেখরের শরীরের কম্পন অনিমেষ প্রবলভাবে অনুভব করছে। এ অবস্থায় ওঁকে তিনতলায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে? কিন্তু এ ছাড়া এ হস্টেলে অন্য ব্যবস্থা নেই।
অনিমেষ বলল, ‘তিনতলায়। আপনি আস্তে আস্তে উঠুন।’
হাতের মুঠোয় উত্তাপ লাগছে, সরিৎশেখরের জ্বর এসেছে অবশ্যই। এই শরীর নিয়ে অনিমেষের হস্টেল খুঁজে এলেন কী করে সেটাই বিস্ময়ের কথা। উনি আসবেন এ-খবর কেউ তাকে জানায়নি। অনিমেষের মনে হল, এমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে যার জন্যে সরিৎশেখর চুপচাপ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু মাথা ন্যাড়া কেন? আর যে লোকটি কলকাতায় দীর্ঘকাল আসেনি তার পক্ষে এরকম অসুস্থ শরীরে রাস্তা চিনে এই অবধি আসা কী করে সম্ভব হল?
সরিৎশেখর টলছিলেন। চাতালটার কাছাকাছি এসে অনিমেষ বুঝতে পারল ওঁর পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব নয়। সেই লম্বা-চওড়া শরীরটা এখন কেমন গুটিয়ে ছোট হয়ে এসেছে। যাঁকে একদিন বিশাল মনে হত এখন তিনি অনিমেষের কাঁধের নীচে মুখ নামিয়েছেন। অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিল অনিমেষের। হস্টেলের যারা নীচে এসেছিল বিভিন্ন দরকারে তারা অবাক হয়ে ওদের দেখছে।
একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল, ‘অনিমেষবাবু, ওঁকে কি আপনার ঘরে নিয়ে যেতে চাইছেন?’
অনিমেষ দেখল ওর পাশের ঘরের ছেলে তমাল খালি গায়ে লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে।
সে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু উনি কি ওপরে উঠতে পারবেন?’
সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। সে ঝোলা দুটো তমালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা ধরুন, প্লিজ।’
তমাল ঝোলা দুটো নিতেই সে একটু ঝুঁকে সরিৎশেখরকে দু’হাতে তুলে নিল। ব্যাপারটা এমন ঘটল যে সরিৎশেখর চমকে উঠে প্রতিবাদ করলেন, ‘আরে, তুমি ভেবেছ কী? আমি ঠিক যেতে পারব।’
হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ বলল, ‘পারতেন, কিন্তু এভাবে যাওয়া আরও সহজ হবে। আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন।’
অতবড় মানুষটাকে কোলে করে তুলতে অনিমেষের নিশ্বাস অস্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এককালের দশাসই চেহারাটা এখন যতই গুটিয়ে যাক তবু ওজন কম নয়। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় অনিমেষ নিজের পায়ে আবার সেই যন্ত্রণা বোধ করল। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে খুব কিন্তু সেটা করতে গেলে দাদুর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সেটা সে কোনওমতেই হতে দিতে রাজি নয়।
সরিৎশেখর নাতির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বোধ ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল। অনেক পথ এই শরীর নিয়ে ভ্রমণের ফলে তাঁর চিন্তাশক্তি শিথিল হয়ে পড়ছিল। অনিমেষের হাতে তিনি নিরাপদ এই বোধটুকু তাঁকে আরও নিশ্চিন্ত করে ফেলায় তিনি বললেন, ‘একটা কাল ছিল যখন তুমি আমার কোলে ধামসাতে, আমার কাঁধে চেপে ঘুরে বেড়াতে, আর এমন একটা কাল এল যখন আমি তোমার কোলে চেপে ওপরে উঠেছি। বিধাতার কী নিয়ম, সব শোধবোধ হয়ে গেল।’
নিজের বিছানায় দাদুকে শুইয়ে না-দেওয়া পর্যন্ত অনিমেষের পক্ষে কথা বলা সম্ভব ছিল না। হালকা হলে মনে হল, ওর বুক টনটন করছে, ঘনঘন বাতাস নিচ্ছিল সে। নিতে গিয়ে লক্ষ করল সমস্ত ঘর অগোছালো, ময়লা জামা-প্যান্ট থেকে শুরু করে কাগজপত্র এলোমেলো ছড়ানো। এরকম ঘরে সরিৎশেখর কখনও বাস করেননি। এবং চেতনা ঠিক হলেই তিনি অনিমেষকে অবশ্যই এর জন্যে তিরস্কার করবেন। সেই অবস্থাতেই দ্রুত হাতে ঘরটাকে ঠিক করে ফেলল অনিমেষ। সরিৎশেখর বোধহয় দীর্ঘদিন পর বিছানা পেয়ে আরাম বোধ করছেন। কারণ বালিশে মাথা রাখামাত্রই তিনি নেতিয়ে গেলেন। চোখ বন্ধ, ঘুম ঘুম ভাবটা বোঝা যায়। কপালে হাত রেখে অনিমেষ এবার নার্ভাস হয়ে পড়ল। থার্মোমিটার সঙ্গে নেই কিন্তু জ্বরটা যে বেশ জোরালো তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তমাল ঝোলা দুটো টেবিলে রেখে চুপচাপ দেখছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘জ্বর নাকি?’
‘হ্যাঁ। দুই-তিন হতে পারে।’ অনিমেষ অন্যমনস্ক হয়ে বলল।
‘আপনার কেউ হন উনি?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ, ‘হ্যাঁ। আমার ঠাকুরদা।’
তমাল ব্যস্ত হল, ‘তা হলে আর দেরি করা ঠিক নয়। আপনি ডাক্তার ডেকে আনুন।’
এই হস্টেলেও একজন বাঁধাধরা ডাক্তার আছেন। অমনোযোগী হওয়ার ফলে তাঁর সম্পর্কেও ছেলেদের বিস্তর নালিশ। কিন্তু বিনাপয়সায় দেখানো যায় বলে ব্যবস্থাটা সকলে মেনে নিয়েছে। তাঁকে খবর দিলে আসতে কত বেলা করবেন সে জানে। তার চেয়ে হস্টেলের পাশেই গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে একজন ডাক্তারকে প্রায়ই সে লক্ষ করে থাকে, তাঁকেই ডাকলে ভাল হয়। ভদ্রলোকের চেম্বারে বেশ ভিড় হয় যখন তিনি নিশ্চয়ই ভাল ডাক্তার। কিন্তু দাদুকে এ অবস্থায় একা ফেলে যেতে মন চাইছে না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তমাল বলল, ‘আমি আছি, আপনি তাড়াতাড়ি করুন।’
কৃতজ্ঞ হল অনিমেষ। মানুষকে বিচার করে একটা সিদ্ধান্তে আসা কখনওই উচিত নয়। একটা মানুষের অনেকগুলো মুখ থাকে আর প্রতিটি স্বতন্ত্র ধরনের। একটিকে দেখে অন্যটিকে ধারণা করতে গেলে ঠকতে হয়। তমাল ডিগবয়ের ছেলে। অবস্থাপন্ন। পাউডার-সেন্ট ছাড়া কোনওদিন ওকে বেরুতে দেখেনি অনিমেষ। হস্টেলের চাকরবাকরদের টাকা ছড়িয়ে হাতে রেখেছে। এরকম বড়লোকের দুলালদের আদৌ পছন্দ করত না অনিমেষ। তাই যতটা সম্ভব ওকে এড়িয়ে যেত। প্রায় সমবয়সি হলেও তমাল তাকে বাবু বলে সম্বোধন করে। ডাকটা কানে লাগে, বোধহয় নৈকট্য-স্থাপন করতে না-চাওয়ার এটা একটা চেষ্টা। অথচ আজ দাদুকে নিয়ে সে যখন বিব্রত তখন অন্য ছেলেদের আগে তমালই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।
ডাক্তার সেনের চেম্বারে এই সকালে তিন-চারজন লোক প্রতীক্ষায় বসে। ভদ্রলোক এখনও আসেননি। অনিমেষ অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। হঠাৎ ওর খেয়াল হল তার নতুন হস্টেলের ঠিকানাটা দাদু পেলেন কী করে। মহীতোষ জানেন খুবই সম্প্রতি এবং জেনেই তিনি সরিৎশেখরকে জানিয়ে দেবেন এতটা ভাবা যায় না। ইদানীং দাদুকে সে অনিয়মিত চিঠি দিচ্ছিল। কেন আগের হস্টেল ছাড়তে হল সে বিষয় সবিস্তারে জানিয়ে চিঠি দেবে দেবে ঠিক করেছিল কিন্তু দেওয়া হয়ে ওঠেনি। মহীতোষের পাঠানো আগের মাসের টাকাটা পুরনো হস্টেলের ঠিকানায় এসেছে। তা হলে? দাদু কি ওখানে গিয়েছিলেন? তার নতুন ঠিকানা ওখান থেকে সংগ্রহ করে এখানে এসেছেন? অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।
এর মধ্যে চেম্বারে রোগীদের উপস্থিতি বেড়ে গেছে। খবরের কাগজের পাতা এবং বিভিন্ন জার্নাল অনেকের হাতে হাতে। কিছু পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। তিনি কোনও দিকে না-তাকিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।
অনিমেষ উঠে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যে পা বাড়াতেই একটা লোক বাধা দিল, ‘অপেক্ষা করুন, উনি স্লিপ অনুযায়ী ডাকবেন।’
স্লিপ! অনিমেষের খেয়াল হল রোগীরা এসেই নিজের নাম লেখা কাগজ এই লোকটির হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল। সেটার যে এতখানি প্রয়োজন তখন খেয়াল করেনি। তিন-চার জনের পরেই সে এখানে এসেছে, নতুন করে স্লিপ দিতে গেলে অনেক পিছিয়ে যেতে হবে।
ব্যাপারটা বলতেই লোকটি জানাল, ‘কিন্তু আমি কী করব বলুন। কেউ যাতে রাগ না-করতে পারে তাই ডাক্তারবাবু এ নিয়ম করেছেন।’
‘কিন্তু আপনি তো দেখেছেন যে আমি অনেক আগে এসেছি।’
‘সে-কথা অন্য লোক মানতে চাইবে কেন?’
‘বেশ, আমি তো রোগ দেখাতে আসিনি। ওঁকে আপনি বলুন আমি শুধু একটা কথা বলব।’ অনিমেষ আবেদন করল।
‘না মশাই, ওসব ভাঁওতা দিয়ে ঢুকে অনেকেই রোগের কথা বলে।’ লোকটা সামনে থেকে সরে গিয়ে স্লিপ সাজাতে লাগল।
সঙ্গে সঙ্গে মাথার রক্ত চড়ে গেল অনিমেষের। দ্রুত পা চালিয়ে ছোট ঘরটার ভেতর ঢুকে পড়ল সে। পেছনের লোকটা প্রথমে হকচকিয়ে গিয়ে শেষতক সামলে নিয়ে হাঁ হাঁ করে ছুটে এল। অনিমেষ ব্যাপারটাকে আমল না-দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল প্রৌঢ় ভদ্রলোক ধূপকাঠি জ্বেলে চোখ বন্ধ করে কিছু আওড়াচ্ছেন। ব্যাবসা শুরু করার আগে ঠাকুর-প্রণাম বোধহয়।
অনিমেষ একটু অপেক্ষা করে বলল, ‘মাফ করবেন, আমি তিনজনের পর এসেছি কিন্তু স্লিপ দেওয়ার নিয়মটা জানতাম না। অথচ একজন ডাক্তারের প্রয়োজন খুবই। তাই আইনটা ভাঙতে হল।’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে একবার দেখে শেষে মাথা নেড়ে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কী?’ লোকটি বলতে যাবার আগেই অনিমেষ বলল, ‘আমার দাদু অত্যন্ত অসুস্থ, কাছেই, আপনাকে একবার যেতে হবে।’
‘ইমপসিবল।’ প্রৌঢ় খুব বিরক্ত হল, ‘সকালে এত রোগী ফেলে আমি কলে যেতে পারব না। ইউ ফাইন্ড সাম আদার ডক্টর।’
‘আপনার দশ মিনিটও ব্যয় হবে না। অনুগ্রহ করে চলুন। এখানে আর কে ডাক্তার আছেন জানি না।’
‘কেন সময় নষ্ট করছেন? দশ মিনিটে আমি তিনটে পেশেন্ট দেখতে পারব। প্লিজ গো আউট।’ হাত বাড়িয়ে দরজা দেখিয়ে দিলেন ডাক্তার।
জেদ চেপে গেল অনিমেষের। সে টেবিলের প্রান্তে দু’হাত ধরে বলল, ‘কিন্তু আমার দাদু খুব অসুস্থ, আপনাকে যেতে হবে।’
‘যেতে হবে? গায়ের জোর দেখাচ্ছেন?’ ডাক্তারের কপালে ভাঁজ পড়ল।
‘যদি তাই মনে করেন আমি নিরুপায়।’ অনিমেষ চোয়াল শক্ত করল।
‘ইজ ইট সো? আমি আপনাকে পুলিশে হ্যান্ডওভার করতে পারি তা জানেন? আপনি আমার কাজে বাধা সৃষ্টি করে ভয় দেখাচ্ছেন।’
‘আপনি যাই ভাবুন কিন্তু সেটা পরে ভাববেন। দশ মিনিট যদি ব্যয় করেন তা হলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আপনি যদি চান তা হলে বাইরের ভদ্রলোকদের কাছে আমি সময়টা চেয়ে নিতে পারি।’
‘নো, নেভার। একবার কলে গেলে সেটা উদাহরণ হয়ে থেকে যাবে। আমি দুপুরে যাওয়ার সময় যেতে পারি।’
‘তখন যদি পেশেন্ট মরে যায়!’
‘কান্ট হেল্প।’
‘আপনি কিন্তু আমাকে উত্তেজিত করছেন।’ অনিমেষের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল, ‘হস্টেলের ছেলেরা জানলে আপনি বিপদে পড়বেন।’
‘হস্টেল! এর মধ্যে হস্টেল আসছে কোত্থেকে?’
‘আমি হস্টেলে থাকি। সেখানেই আপনাকে যেতে হবে। চিরকাল যেভাবে টাকা রোজগার করে এসেছেন এবার তার ব্যতিক্রম করতে হবে।’
‘সমাজ সংস্কারক মনে হচ্ছে! কমিউনিস্ট নাকি?’
‘আপনি মিছিমিছি কথা বাড়াচ্ছেন।’
‘কী আশ্চর্য। এত ডাক্তার থাকতে আমাকে নিয়ে— তা কী হয়েছে আপনার পেশেন্টের? সিরিয়াস ব্যাপার হলে হাসপাতালে রিমুভ করুন।’
‘সেটা ওঁকে দেখে আপনি বলবেন। বয়স হয়েছে, খুব জ্বর আর মনে হচ্ছে ভীষণ দুর্বল। রোগটা বুঝতে পারলে আপনার কাছে আসব কেন? নিন, উঠুন।’ প্রায় ধমকের গলায় কথাটা বলতে ভদ্রলোক নার্ভাস হয়ে গেলেন। অনিমেষ ততক্ষণে চেম্বার ছেড়ে ভিজিটার্স রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের উত্তেজিত কথাবার্তা এখানকার মানুষগুলো নিশ্চয়ই শুনেছেন কারণ তাঁরা অবাক চোখে অনিমেষকে দেখছেন। অনিমেষ হাতজোড় করে বলল, ‘দেখুন, আমি আপনাদের কাছ থেকে মাত্র দশ মিনিটের জন্য ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যাচ্ছি। আমার দাদু অত্যন্ত অসুস্থ। হয়তো আপনাদের একটু অসুবিধে হবে কিন্তু দয়া করে মার্জনা করবেন।’
কেউ কেউ উসখুস করলেও মুখে আপত্তি প্রকাশ করল না।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে অনিমেষ ডাক্তারবাবুকে নিয়ে হস্টেলে পৌঁছে গেল। ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত চেম্বার থেকে বেরুবেন কি না এ সন্দেহ ছিল কিন্তু হস্টেলের নাম করতে যে এতটা কাজ হবে বোঝা যায়নি।
হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘হস্টেলে থাকেন সে-কথা প্রথমে বললেই তো হত।’
‘কেন?’
‘কিছু মনে করবেন না, হস্টেলের ছেলেরা দলবদ্ধ হয়ে খুব রাগারাগি করে। তা আপনাদের তো একজন ডাক্তার আছে!’
‘তিনি এত তাড়াতাড়ি আসতে পারতেন না।’
ঘরে ঢুকে অনিমেষ অবাক হল। তমাল সরিৎশেখরের কপালে জলপটি লাগিয়ে পাশে বসে মাথায় পাখার হাওয়া করে যাচ্ছে। ওদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে জ্বরটা আরও বেড়ে যাচ্ছে।’
কালবিলম্ব না-করে ডাক্তার পরীক্ষা করতে বসে গেলেন।
ওরা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। অনিমেষ ভাবল এবার তমালকে ছুটি দেওয়া উচিত। কথা বলতে গিয়েও সংকোচ হল। কেউ যদি খুব আন্তরিক হয় তার সঙ্গে ভদ্রতা করাটা অনেক সময় অত্যন্ত বেমানান দেখায়।
ডাক্তার বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর ব্যাগ খুলে একটা সিরিঞ্জ বের করে ইঞ্জেকশন দিলেন। সামান্য যে ব্যথাটুকু লাগল তাতেই দাদু চোখ খুলে আবার চোখ বন্ধ করলেন।
অনিমেষ বুঝতে পারছিল যে ওঁর চেতনা আর দখলে নেই। হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগল অনিমেষের। যদি কিছু হয়ে যায়? দাদু নেই একথা ভাবতেই বুকে কাঁপুনি এসে গেল। এই মানুষটার কাছে সে এমন ঋণবদ্ধ যে এঁকে ছাড়া কিছু ভাবা অসম্ভব। তার সমস্ত ছেলেবেলা এই মানুষটা নিজের ইচ্ছেমতো সাজিয়ে দিয়েছেন। তার চিন্তা, মানসিক প্রকাশ এঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল একসময়। এখন সেটা যতই নিজের পথে চলুক, মূল ব্যাপারটায় দাদু এখনও জড়িয়ে আছেন। অনেক অনেক দিন পরে সেই ছেলেবেলার স্মৃতিটা ভেসে এল। কোনও আশঙ্কার সামনে দাঁড়ালে একটা লাইন স্মরণ করে কপালে তিনবার মা অক্ষর লিখে চোখ বন্ধ করে প্রণাম করত। ছেলেবেলায় এটা দারুণ কাজ করত। নিজের অজান্তে অনিমেষ এতদিন পরে তার পুনরাবৃত্তি করল। ওঁ, ভগবতে শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ। রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে তার আগ্রহ বা ভক্তির কোনও প্রকাশ কলকাতায় এসে ঘটেনি। দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন সে অনুভব করেনি। মার্ক্স কিংবা লেনিন পড়ার সময় এইসব সংস্কারগুলোকে সে নির্মমভাবে সরিয়ে দিয়েছে। একজন মাও সে-তুং কিংবা হো চি মিনের জীবনে অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের কোনও প্রয়োজন নেই। অথচ রক্তে ডুবে থাকা এই সংস্কার হঠাৎ নিজের অজান্তে ভুস করে মাথা তুলল। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতেই সজাগ হল অনিমেষ। তমাল বলল, ‘ভয় পাবেন না, উনি জলে পড়ে নেই।’
ডাক্তার কোনও কথা বলছিলেন না। এর মধ্যে প্রায় পনেরো মিনিট সময় চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত পাল্স দেখে ভদ্রলোক সহজ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে অনিমেষকে বললেন, ‘মনে হয় খুব টর্চার করেছেন। ইঞ্জেকশনটায় কাজ হয়েছে, এখন স্বাভাবিকভাবে ঘুমোবেন। আমি যে ওষুধ লিখে দিচ্ছি সেগুলো খাইয়ে কাল রিপোর্ট করবেন।’
প্রেসক্রিপশন লেখার সময় অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘ভয়ের কিছু আছে?’
ডাক্তার লেখা শেষ করে বললেন, ‘ছিল। হরলিক্স, বিস্কুট আর মিষ্টি ফল ছাড়া আজকে কিছু দেওয়ার নেই। মনে হচ্ছে তিন-চারদিন কিছুই খাননি আর খুব পরিশ্রম করেছেন। আচ্ছা চলি।’
প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে অনিমেষ ড্রয়ার খুলে টাকা বের করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ফিস কত আমি ঠিক জানি না—।’
ভদ্রলোক খানিকক্ষণ তাকিয়ে বললেন, ‘পড়ো না চাকরি করো?’
‘পড়ি।’
‘আমি চেম্বারে বত্রিশ টাকা নিই। কলে গেলে ডাবল হয়। আমাকে টাকা দেখাতে এসো না ছোকরা। দশ টাকা দাও।’ বিস্মিত অনিমেষের হাত থেকে একটা দশ টাকার নোট তুলে নিয়ে বললেন, ‘ক্লাস কামাই করো। অন্তত একটা দিন এঁকে সবসময় চোখে রাখা দরকার।’ ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে বললেন, ‘আর হ্যাঁ, তোমার রাস্তাটা সবাইকে শিখিয়ে দিয়ো না।’
তমাল ওঁকে পৌঁছোতে নীচে নেমে গেলে অনিমেষ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। আর-একবার মানুষের অন্য মুখ দেখল সে।
ওষুধপত্র আনিয়ে অনিমেষ দাদুর পাশে বসে বাতাস করছিল। সকালে যে সময়টা কাটছিল না সেটা এখন দৌড়ে যাচ্ছে। এখন দুপুর। হস্টেল ফাঁকা। বারোটার ক্লাসটা করা হল না। আজ সকালে যে তাগিদ বুকের মধ্যে ছটফট করছিল সেটা এখন মিইয়ে গেছে। মাধবীলতাকে দেখার ইচ্ছের চেয়ে এই বৃদ্ধের পাশে বসে থাকতে বড় আরাম হচ্ছিল। দাদুর কথাটা মনে পড়ল, সব শোধবোধ হয়ে গেল। মাথা নাড়ল অনিমেষ, না, কখনওই শোধ হয় না।
দুপুর ঘন হলে সরিৎশেখর চোখ খুললেন। নাতিকে দেখে ধীরে ধীরে বললেন, ‘অনি, তোমাকে খুব কষ্ট দিলাম, না?’
অনেকদিন পর অনিমেষ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।