২৮. কার্ডটা হাতে নিয়ে হতভম্ব

আঠাশ

কার্ডটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। প্রিয়তোষ মিটার যে ছোটকাকা তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু এরকম আচমকা ছোটকাকা এই হস্টেলে এলেন কোত্থেকে? ওঁর তো এখানে থাকার কথাই নয়। সেই কবে বাইরে চলে গেছেন, মস্কো বোধহয়, দাদু তো সেরকমই বলেছিলেন, কবে ফিরে এলেন? কার্ডটায় আর কিছু লেখা নেই কিন্তু কাগজটা খুব দামি, ছুঁলেই বিদেশি বলে মনে হয়। ওর ইচ্ছে করছিল তমালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে কিন্তু তমাল ততক্ষণে নীচে নেমে গেছে। অনিমেষ নিজের ঘরে ঢুকল।

মিত্রকে মিটার বলা দু’চক্ষে দেখতে পারে না অনিমেষ। বাঙালি পদবিগুলোকে এভাবে বিকৃত করলেই সাহেব হওয়া যায়? দারোয়ান অবশ্য ওঁকে সাহেব বলেছে। তার মানে ছোটকাকার চেহারাটা পালটে গেছে? সেই রোগাটে পাজামা পাঞ্জাবি! ভাবতে গিয়েই সচকিত হল। এই চেহারাটা তো সেই সময়ের যখন পুলিশ তাদের বাড়ি সার্চ করতে এসেছিল। কিন্তু তারপর যখন ছোটকাকা কলকাতা থেকে প্লেনে জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন তখন তো রীতিমতোই সাহেব। মন্ত্রীর পেছন পেছন প্লেন থেকে নেমে এসেছিলেন ছোটকাকা। চোখ বন্ধ করতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল অনিমেষ, অ্যাশ কালারের সুট, লম্বা সরু নীল টাই, চোখে চশমা, হাতে বড় অ্যাটাচি ব্যাগ। তা হলে তো ছোটকাকা এতদিনে আরও কড়া সাহেব হয়ে গেছেন। আট-নয় বছর তো হয়ে গেল। অনিমেষের মনে পড়ল পুলিশ আসার আগে যে রাতে ছোটকাকা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সেই রাত্রে সে প্রথম একটা কাগজে ‘মার্ক্সবাদী’ শব্দটা দেখেছিল। ছোটকাকা তখন কট্টর কমিউনিস্ট ছিলেন। তারপর যখন ফিরে এলেন তখন তিনি কী, বুঝতে পারেনি অনিমেষ। কংগ্রেসি বিরাম করের সঙ্গে যেমন দোস্তি তেমনি কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গেও ভাব করার চেষ্টা ছিল তখন। দালাল বলে একটা বিক্ষোভও হয়েছিল তখন। আর এখন ছোটকাকা কোন ভূমিকায়? যে ভূমিকাতেই হোক সরিৎশেখর যখন প্রচণ্ড অর্থকষ্টে জর্জরিত তখন তিনি সাহেবি করে বেড়াচ্ছেন, এটাকে ক্ষমা করা অসম্ভব। অনিমেষ ঠিক করল সে গ্র্যান্ড হোটেলে যাবে না। যে মানুষ অবহেলায় নিজের স্বার্থের জন্য বাবা দিদিকে ছেড়ে এতকাল বাইরে ডুব দিয়ে বসে ছিলেন তাঁর সম্পর্কে আজ আর কোনও দুর্বলতা তার নেই।

সকালবেলায় একজন দাড়িকাটা পঞ্জাবি তার কাছে এল। অনিমেষ তখন বইপত্র নাড়াচাড়া করছে, দেখে অবাক হল। নমস্কার করে লোকটা বলল, ‘সাব, গাড়ি লেকে আয়া।’

ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কীসের গাড়ি?’

‘সাব ভেজ দিয়া গ্রান্ড হোটেলসে।’

ছোটকাকা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন। অনিমেষের আর অবাক হওয়ার মতো নার্ভ ছিল না। তাকে এত খাতির কেউ করতে পারে? সামনে দাঁড়ানো লোকটার বিনীত ভঙ্গি দেখে ও দ্বিতীয়-চিন্তা করল। যে-কোনও কারণেই হোক ছোটকাকার তাকে দরকার। সে যতই এড়াতে চাইবে তিনি ছাড়বেন না। এই লোকটিকে ফিরিয়ে দেবার পর তিনি যদি নিজে আসেন তা হলে খামোকা বিব্রত হতে হবে। মুখের ওপর তাঁকে কালকের ভাবনাগুলো বলা যাবে না। সম্পর্কটাকে তিক্ত না-করে মানসিক সম্পর্কহীন একটা সাক্ষাৎকার সেরে আসাই ভাল।

ইচ্ছে করেই পাজামা পাঞ্জাবি পরল অনিমেষ। গ্র্যান্ড হোটেলে যেতে হলে যেসব পোশাকের কথা মনে পড়ে তা অবশ্যই ওর নেই। না-থাকলে মানুষ যেমন একটা বোহেমিয়ান ভাব দেখিয়ে উপেক্ষা করতে চায় সেও তেমনি ইস্ত্রি না-করা পাঞ্জাবি গায়ে চাপাল। গাড়িতে বসে অনিমেষ বুঝতে পারল, এগুলোকে লাক্সারি ট্যাক্সি বলে। খুব যত্ন করে রাখা বলে বেশ আরামদায়ক। জিজ্ঞাসা করে জানল হোটেলের বড় সাহেবরা কলকাতায় থাকাকালীন দিনরাতের জন্য এরকম গাড়ি ভাড়া করেন। সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে এ-গাড়ির ভাড়া।

গ্র্যান্ড হোটেলে সে কখনও আসেনি কিংবা সে সুযোগই হয়নি। চৌরঙ্গি দিয়ে যেতে যেতে অনেকদিন সে ওদিকে তাকিয়েছে। একজন দীর্ঘদেহী পঞ্জাবি দারোয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার পাশের গালচে বিছানা আলো-ঝলমল প্যাসেজ দিয়ে সুবেশ মানুষরা যাতায়াত করেন। মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মতন ওরও মনে হত ভেতরটা নিশ্চয়ই রহস্যময়। আজ সেই প্যাসেজ দিয়ে হাঁটবার সময় সে অকারণেই স্মার্ট হতে চাইল। ড্রাইভারই তাকে বলে দিয়েছে ছোটকাকার স্যুট নম্বর। কয়েকজন বিদেশি নারীপুরুষ হাসতে হাসতে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। রিসেপশনে হদিশ নিয়ে অনিমেষ ওপরে উঠে এল।

এই কলকাতা শহরের বুকেই এমন টিপটপ সাহেবি পরিবেশ অনিমেষের জানা ছিল না। মিছিল স্লোগান অভাব দৈন্যতার বাইরে ইংরেজি ছবির মতো ছিমছাম আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ নির্দিষ্ট নম্বরের সামনে এসে কপালের ঘাম মুছল। ঘর নয়, একটা পুরো স্যুট নিয়ে আছেন ছোটকাকা। নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ লাগছে এজন্য। অথচ দাদু জলপাইগুড়িতে, ব্যাপারটা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। না, আজকে এসব চিন্তা করবে না সে। দেখা করতে এসেছে, দেখা করেই চলে যাবে।

বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। খুব সামান্য সময়, কিন্তু ছোটকাকাকে চিনতে পারল অনিমেষ। প্রচুর পরিবর্তন হয়ে গেছে চেহারার। একটু রোগাটে অথচ ছিমছাম শরীর। ঠোঁটের ওপর বেশ ঝোলা গোঁফ, মাথার চুল পাতলা কিন্তু যথেষ্ট লম্বাটে। চিনতে দেরি হওয়ার কারণ গোঁফ এবং চুলের রং লালচে আর গায়ের রং এত ফরসা যে চট করে বিদেশি বলে ভুল হতে পারে। সুন্দর একটা গন্ধ আসছে ওঁর শরীর থেকে। অনিমেষ প্রণাম করবে কিনা বুঝতে না-পেরে বলল, ‘কেমন আছেন?’

ছোটকাকার মুখ এতক্ষণ অপরিচয়ের আড়াল সরাবার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই দু’হাতে ওর কাঁধ ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে ব্বাস, ইউ, অনি, তুই কত বড় হয়ে গেছিস! একদম অ্যাডাল্ট? আরে রাস্তায় দেখলে তো আমি চিনতেই পারতাম না। আয়, আয়, ভেতরে আয়।’ দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে ঘরে ঢোকালেন ছোটকাকা।

ওঁর স্পর্শে অনিমেষ একটু আড়ষ্ট হল; এভাবে অনেকদিন তাকে কেউ জড়িয়ে ধরেনি এবং ছোটকাকার শরীর থেকে এমন মূল্যবান গন্ধ বের হচ্ছে যাতে সে অভ্যস্ত নয়।

ঘরটা বেশ বড়। সুন্দর করে সাজানো। একটি মানুষ যত রকমের আরামের উপকরণ না-পেলে বিরক্ত হবে তার সবগুলিই আছে। অনিমেষ ঘরে আর তিনজন মানুষকে দেখতে পেল। একবার তাকানোতেই মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে একজনকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু ছোটকাকার উচ্ছ্বাস তাকে এত বিব্রত করছিল যে কিছু ভাববার সুযোগই পাচ্ছিল না। ছোটকাকা এখন ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘আরে অনি, তুই আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস লম্বায়? এই সেদিন জন্মালি আঃ, সময়টা এত দ্রুত চলে যাচ্ছে যে তাল রাখা মুশকিল। দেখি তোর চেহারাটা কেমন হয়েছে! হুম, গুড, দাড়ি রেখেছিস কেন? কারণ, শুধু রাখলেই হল না, ওটার কিছু যত্ন-আত্তিও দরকার। এখন কী পড়ছিস যেন!’

‘এবার এম এ দেব।’ অনিমেষ কথাটা বলতেই প্রিয়তোষের চোখ কপালে উঠে গেল যেন, ‘অ্যাঁ, এম এ? নো, দেন ইউ আর কোয়াইট অ্যাডাল্ট। নাঃ, তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমি এবার বুড়ো হয়ে যাব।’

ছোটকাকা শিশুর মতো ওর হাত ধরে কথা বলছিলেন। অনিমেষ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ওঁর সম্পর্কে নরম হতে লাগল। এই আচরণ যদি আন্তরিক না-হয় তা হলে মানুষ সম্পর্কে কখনওই কারও বিশ্বাস করার কারণ নেই। হঠাৎ ছোটকাকা অপেক্ষারত তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন। এ হল আমার ভাইপো। দীর্ঘকাল বাদে ওকে আমি দেখলাম। ন্যাচারালি—।’

সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’

ছোটকাকা বললেন, ‘আপনারা আমাকে মিনিট দশেক সময় দেবেন। আমি ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা সেরে নিচ্ছি। না না, আপনাদের উঠতে হবে না, আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি। ততক্ষণ কিছু ড্রিঙ্ক বলছি আপনাদের জন্য।’ টেলিফোন তুলে রুমসার্ভিসকে নির্দেশ দিয়ে ছোটকাকা ওকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন। ওঁকে এখন খুব স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে।

এটি শোওয়ার ঘর। অমন লোভনীয় বিছানা অনিমেষ কখনও দেখেনি। একপাশে সুন্দর বেঁটেখাটো সোফাসেট। ছোটকাকার সঙ্গে সেখানে বসল অনিমেষ। অনিমেষ দেখল ছোটকাকা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই বললেন, ‘একদিন আমি তোর মতন ছিলাম।’

খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা কিন্তু অনিমেষের অস্বস্তি হল। সে বলল, ‘আপনি কবে এসেছেন কলকাতায়?’

‘গতকাল। তোর হস্টেলে গিয়েছিলাম। কত রাতে ফিরিস?’

‘কাল একটু দেরি হয়েছিল।’

‘নো নো, আমি কিছু মনে করছি না এজন্য। দেরি করে ফেরার বয়স তো এটাই। এবার কলকাতায় এসে আমার একটাই অভিজ্ঞতা হল, তুই বড় হয়ে গেছিস। প্রেম করছিস?’

আচমকা প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ লাল হয়ে গেল। কোনওরকমে বলল, ‘কী যে বলেন!’

ছোটকাকা তখনও হাসছেন দেখে কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার ঠিকানা কোত্থেকে পেলেন?’

ছোটকাকা হাত নাড়লেন, ‘সেটাও বেশ কাকতালীয়। অনেকদিন আগে জলপাইগুড়ি থেকে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। দ্যাট ওয়াজ লাস্ট ওয়ান। তাতে জেনেছিলাম তুই কলকাতায় স্কটিশে ভরতি হয়েছিস। এখানে এসে সেকথা মনে পড়তেই স্কটিশ কলেজে ফোন করলাম, ওরা কিছুই বলতে পারল না। তখন খেয়াল হল তুই কলকাতায় এলে নিশ্চয়ই হস্টেলে উঠবি। কলেজ থেকে নাম্বার নিয়ে পরপর হস্টেলগুলিতে রিং করতে লাগলাম। আলটিমেটলি তোকে পেয়ে গেলাম। আমার যদি খেয়াল হত তুই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিস অনেক আগেই, তা হলে এ বুদ্ধি মাথায় আসত না এবং দেখাও হত না।’

‘আপনি কি মস্কোয় আছেন?’

‘হ্যাঁ। এখন ওখানেই সেটল্ড।’ তারপর গলা পালটে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবার খবর কী? কেমন আছেন?’

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এই বিলাসবহুল হোটেলে বসে দাদুর কথা জিজ্ঞাসা না-করে ছোটকাকা তো সরাসরি জলপাইগুড়িতে চলে যেতে পারেন। কী উত্তর দেবে ঠিক করার আগেই ছোটকাকা একটা হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ ধরলেন, ‘বুঝতে পারছি প্রশ্নটা শুনে তুই ডিস্টার্বড! তাই তো?’

অনিমেষ খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল, ‘না, তা কেন হবে! আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্নটা করতে পারেন। দাদুর শরীর ভাল নেই।’ উত্তরটা দিতে পেরে অনিমেষ স্বস্তি পেল। এখানে, এই হোটেলে বসে ছোটকাকাকে রূঢ় কথা বলে সে দাদুর সমস্যার কোনও সমাধান যখন করতে পারবে না তখন বলে লাভ কী।

‘তুই সত্যিই বুদ্ধিমান।’ ছোটকাকা উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে একটা সাদা বোতল থেকে গ্লাসে পানীয় ঢেলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই ভদকা খাবি?’

‘ভদকা?’ না, না।’

‘ঠিক আছে।’ গ্লাসে ঠোঁট ঠেকিয়ে ছোটকাকা বিছানার ওপর বসলেন এবার, ‘তুই জানিস কিনা জানি না, জলপাইগুড়ি ছাড়ার পর আমি বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলাম। লাস্ট যেবার ওখানে যাই সে খবর তো তুই জানিস। তারপর নানান ঝামেলায় আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এইসময় বড়দার চিঠি পাই— বাবা চলে গেছেন। তখন আমার বাইরে যাওয়া ঠিকঠাক। সেদিনই দিল্লি যাব। ভাবলাম বাবা যখন নেই তখন আর জলপাইগুড়িতে ফিরে কী হবে! বড়দা টাকা চেয়েছিল তাই পাঠিয়ে দিলাম। মস্কোতে গিয়ে তোর বাবাকে চিঠি দিলাম। মেজদা যে আমার ওপর চটেছে তা উত্তর পেয়ে বুঝলাম আর সেই সঙ্গে জানলাম বড়দা আমাকে ব্লাফ দিয়েছে, বাবা বেঁচে আছেন। তুই বোঝ ব্যাপারটা! বাবাকে চিঠি দিয়েছি তারপর, উত্তর পাইনি। দিল্লি থেকে এক বন্ধুকে দিয়ে টাকা পাঠিয়েছিলাম, উনি রিফিউজ করেছেন। নাউ, আই হ্যাভ নাথিং টু সে। কেউ যদি আমাকে এজন্য দোষী করতে চায় করতে পারে এবং তাতে আমার কিছু এসে যায় না। বাবা ভাল নেই বললি, কী হয়েছে?’

অনিমেষ বুঝতে পারছিল ছোটকাকা নিজেও জানেন তাঁর কথাগুলোর পেছনে খুব জোরালো যুক্তি নেই। তাই স্রেফ জেদের বশে কথাগুলো বলে যাওয়া। এবং ঘুরে ফিরে দাদুর কথা জানতে চাওয়ার মধ্যেই সেই দুর্বলতা প্রকাশিত।

অনিমেষ বলল, ‘বয়স হয়েছে, টাকাপয়সা হাতে নেই, খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে।’

ছোটকাকা বললেন, ‘খুলে বল, ইন ডিটেইলস।’

অনিমেষ তাকাল, ‘আপনার ভাল লাগবে না। এখন ওই বাড়িটুকু ছাড়া দাদুর কোনও সম্বল নেই। তাই পাবার জন্য আত্মীয়রা যাওয়া-আসা করছে বলে দাদু সবাইকে বলেছেন ওঁর লেপ্রসি হয়েছে।’

‘লেপ্রসি! বাবার কুষ্ঠ হয়েছে?’

‘হয়নি। কিন্তু হয়েছে বলে বেড়ালে ভিড় এড়ানো যায় তা জানেন দাদু। আমি এবার গিয়ে দাদুকে চিনতে পারিনি। খুব বেশিদিন মনে হয় বাঁচবেন না।’

‘বড়দি?’

‘শরীর ভাল নেই। একবেলা খান। শুকিয়ে গেছেন।’

ছোটকাকা হাতের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করলেন। তারপর আচমকা প্রশ্ন করলেন, ‘শুনলাম তুই রাজনীতি করিস। এস এফ?’

বিস্মিত অনিমেষ কাকার মুখে হাসি দেখতে পেল, ‘হ্যাঁ’।

‘তুই সি পি এম-এর কাজকারবারে বিশ্বাস করিস?’

‘খানিকটা।’

‘খানিকটা? হোয়াই?’

‘ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি বলতে তো সি পি এম-ই। কিন্তু এই দলের কাজকর্ম আমার ভাল লাগে না, অথচ উপায় নেই।’

‘ও। তা ভাল না-লাগলে রাজনীতি করতে কে বলেছে! এম এ পাশ করে চাকরি জোগাড় করে সংসার কর।’

‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’

ছোটকাকা ওর মুখের দিকে সকৌতুকে তাকালেন, তারপর হো-হো করে হাসতে লাগলেন। শেষে খুব ধীর গলায় বললেন, ‘অনি, রাজনীতি করতে এসে কোনও আদর্শ বা ফর্মুলা সামনে রেখে এগোয় বোকারা। যখন যা তখন তা যে হতে পারে সেই ভাল পলিটিশিয়ান। গতকাল তোর হস্টেলের একটি ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে তোর সম্পর্কে জানতে পারলাম। তোকে দেখে আমি আমার অতীতকে দেখতে পাচ্ছি। পার্টি যখন নিষিদ্ধ হল তখন ওই একটা আদর্শ নিয়ে আমরা বেঁচেছিলাম। কিন্তু তাই যদি আঁকড়ে থাকতাম তা হলে আমাকে আজ খুঁজে পাওয়া যেত না। রাজনীতি করবি একটা মজবুত সিঁড়ির কাছে পৌঁছাবার জন্য। যেই সেই সিঁড়িটা পেয়ে যাবি আর পেছন দিকে তাকাবি না। তোদের এখানে যারা বড় নেতা তাদের অনেকের ব্যক্তিগত চরিত্র আমি জানি। সেসব জানলে তুই শিউরে উঠবি। যারা বাইরের ঘরে বসে আছে তাদের তুই চিনিস?’

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। না।

‘এরা এসেছে আমার মন গলাতে। মস্কো যাওয়ার প্রবেশপত্র পাওয়া ওদের উদ্দেশ্য। না, এরা সি পি আই নয়। আজ সারাদিন আমি দফায় দফায় মিটিং করব তোদের নানান নেতাদের সঙ্গে। তুই যেমন করেই হোক একটু সামনের সারিতে চলে আয়, তারপর তোর ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে।’

অনিমেষ আর পারছিল না। ছোটকাকা যেসব কথা বলে যাচ্ছে তা হয়তো সত্যি কিন্তু এ কীরকম চিন্তাভাবনা। চোখের সামনে জলপাইগুড়ির বাড়ির সামনে সেই বিক্ষোভটার ছবি ভেসে উঠল। ছোটকাকা যেটা এড়াতে বিরাম করের বাড়িতে গিয়ে বসেছিলেন। সে স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি কে জি বি-র এজেন্ট?’

‘অ্যাঁ! গুড! এখন কি সি আই এ-র সঙ্গে কে জি বি-র এজেন্ট বলা আপ টু ডেট গালাগালি? আরে বোকা, সি আই এ কিংবা কে জি বি অনেক বুদ্ধিমান সংগঠন। তারা এমন লোককে কাজ করতে পাঠায় না যাকে দেখে তুইও বুঝতে পারবি। তোর উদ্দেশ্য কী?’

‘কী ব্যাপার?’

‘কেন রাজনীতি করছিস?’

‘এ দেশের মানুষ যাতে শোষিত না-হয়, কোনও ধাপ্পায় না-ভোলে—’

ওর কথা থামিয়ে ছোটকাকা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা তো সি পি এম-ও বলছে—।’

‘বলছে। কিন্তু এই সংবিধানের মধ্যে সেটা করা সম্ভব নয় তা ওরা জানে।’

‘দেন, ইউ আর থিঙ্কিং সাম আদার ওয়ে। সেটা কী?’

‘জানি না।’

‘এনি আর্মড রেভ্যুলেশন?’

‘জানি না।’

‘পাগলামি করিস না। এ দেশের মানুষের মনে লোভের পোকা থিকথিক করছে। এদের নিয়ে কোনও কাজ করা সম্ভব নয়। আমি যা বললাম তাই কর।’

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, ‘আপনি ওঁদের দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।’

হাসলেন ছোটকাকা, ‘দরকার হলে ওরা দশ ঘণ্টা অপেক্ষা করবে।’

‘আমি চলি।’

‘যাবি?’

‘হ্যাঁ।’

ছোটকাকা একটা ব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বের করে ওর হাতে দিলেন, ‘আমি আজ রাত্রেই ফিরে যাব। তোর যদি কখনও দরকার হয় এই ঠিকানায় আমাকে চিঠি দিবি।’ এটা অন্য ধরনের কার্ড, গতকালের মতো নয়। একসঙ্গে ইংরেজি এবং সম্ভবত রাশিয়ান, যা অনিমেষ বুঝতে পারল না, লেখা আছে। অনিমেষ ওটা পকেটে রেখে বেরিয়ে আসছে, ছোটকাকা আবার ডাকলেন, ‘অনি, আমার একটা উপকার করবি?’

‘বলুন।’

‘তোকে প্রমিস করতে হবে।’

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে অনিমেষ সেটাকে ঝেড়ে ফেলল, ‘বলুন।’

‘আমি তোকে দুটো প্যাকেট দেব, তুই দু’জনকে ও দুটো পৌঁছে দিবি?’

‘কাদের?’

ছোটকাকা একটা সুটকেস খুলে দুটো সুদৃশ্য প্যাকেট বের করে অনিমেষের সামনে ধরে বললেন, ‘ওপরে নাম লেখা আছে।’

খুব বেশি ওজন নয়, অনিমেষ প্যাকেট দুটোর নাম পড়তে গিয়ে খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করল। একটাতে সরিৎশেখর মিত্র, অন্যটায় ছোট্ট করে লেখা, তপু, মানে তপুপিসি। অনিমেষ বিহ্বল চোখে ছোটকাকাকে দেখল। এতগুলো বছর চলে গেছে অথচ ছোটকাকা এখনও তপুপিসিকে মনে রেখেছেন? একসময় ছোটকাকার ওপর সে রেগে গিয়েছিল তপুপিসিকে অবহেলা করার জন্য। অথচ একটা মানুষ যে গোপনে গোপনে আর একজনকে মনে রেখে দেয় চিরকাল, এটা জেনে সব গোলমাল হয়ে গেল তার। রূপশ্রী সিনেমার সামনে বাচ্চাদের নিয়ে তপুপিসি যেদিন পথের পাঁচালী দেখতে যাচ্ছিল সেদিনই বোধহয় ছোটকাকার সঙ্গে তার শেষ দেখা। কী নির্লিপ্ত হয়ে তপুপিসি ছোটকাকাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। আর নীল কাগজে ছোটকাকাকে লেখা তপুপিসির সেই চিঠিটা, যেটাকে সে বাড়ি সার্চ করার আগে পুলিশের চোখ থেকে সরিয়ে রেখেছিল, যা কিনা পরে ছোটকাকার হাতেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল, তার কথা মনে পড়ল। সেই লাইন দুটো কখনওই ভুলবে না অনিমেষ, ‘তোমার রাজনীতিই এখন সব, আমি আর কেউ নই। তাই তুমি যত ইচ্ছে রাজনীতি করো, আমি দায় তুলে দিলাম।’

‘তপুর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?’

প্রশ্নটা শুনেই ঘাড় নেড়ে না বলল অনিমেষ। তপুপিসি কি এখনও জলপাড়গুড়ি গার্লস স্কুলে আছে? কী জানি।

‘ওর কোনও খবর জানিস না তুই?’

‘না।’

‘তা হলে?’

‘যদি দায়িত্ব দেন তা হলে খুঁজে বের করে দিয়ে দিতে পারি।’

‘এটুকু অন্তত কর।’

হঠাৎ অনিমেষের মাথায় চিন্তাটা চলকে উঠল, ‘কিন্তু তপুপিসি যদি না-নেয়!’

ছোটকাকা স্থির হয়ে গেলেন। এতক্ষণ যে মানুষটা প্রচণ্ড প্রতাপে নানান কথা বলছিলেন এই সময় তাঁকে কী নিঃসহায় দেখাচ্ছে। মৃদু গলায় বললেন, ‘যদি না-নিতে চায় তা হলে তিস্তায় ফেলে দিস।’ তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘আমার ভাগ্যটা এমন। কোনও সম্পর্ককেই আমি সহজ স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না অনি, তোকে দেখে আমার এই ভয়টাই হচ্ছে। আমি যে ভুল করেছি তুই তা করিস না।’

অনিমেষ প্যাকেট দুটো হাতে নিয়ে বলল, ‘যাচ্ছি’।

‘তুই কি আজকে আবার আসবি?’

‘কখন?’

‘কখন বলি! সারাদিন ঝামেলা লেগেই থাকবে। এয়ারপোর্টে আসতে পারবি ছ’টা নাগাদ?’

‘এয়ারপোর্টে?’

‘তখন কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।’

‘দেখি।’

‘তুই সিগারেট খাস অনি?’

দ্বিধা না-করে উত্তর দিল অনিমেষ, ‘মাঝে মাঝে।’

‘দেন ওয়েট।’ ছোটকাকা ঘরের কোনায় ফিরে গিয়ে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট আর ছোট্ট অথচ সুন্দর লাইটার এনে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। অনিমেষ প্যাকেটটা দেখল। রাশিয়ান সিগারেট। বিদেশি সিগারেট সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই। বন্ধুদের দেখেছে খুব লালায়িত হতে। লাইটারের বোতামে চাপ দিতেই একটা নীল হলকা বেরিয়ে এল। খুব দামি নিশ্চয়ই এটা। ছোটকাকা বললেন, ‘গ্যাসের। ফুরিয়ে গেলে কিনে নিস।’

‘আমার অত পয়সা নেই। এটা রেখে দিন। আমার কাজে লাগবে না।’

‘কেনার দরকার নেই। ওটা গ্যাস শেষ হয়ে গেলে কাউকে দিয়ে দিস।’

বাইরের ঘরে বেরিয়ে আসতেই লোক তিনটে উঠে দাঁড়াল। তাদের মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য তারা একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি। বরং বেশ নেশা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। একজন অকারণেই হাসছিল। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ—। ছোটকাকা বললেন, ‘সরি, দেরি করিয়ে দিলাম আপনাদের। বসুন। বসুন। কী খাচ্ছেন? সিভাস রিগ্যাল? আমার আবার ভদকা না-হলে চলে না।’ অনিমেষ বেরিয়ে যাচ্ছিল, ছোটকাকা ওকে দাঁড়াতে বললেন, ‘আমার ভাইপো; অনিমেষ মিত্র, খুব ইনটেলিজেন্ট ছেলে।’ লোক তিনটে তাকে নমস্কার করছে দেখে অনিমেষ প্যাকেট-হাতেই সেটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। ছোটকাকা তখন বলছেন, ‘এম এ পড়ছে, ছাত্র ফেডারেশন করে। খুব অ্যাকটিভ।’

‘আচ্ছা!’ সেই চেনা চেনা লোকটি বলল, ‘বিমানকে চেনো?’

‘হ্যাঁ।’ অনিমেষ জবাব দিল।

‘কী নাম যেন?’

‘অনিমেষ মিত্র।’

‘ঠিক আছে মিত্রসাহেব, মনে থাকবে।’ লোকটি ছোটকাকার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘তবে ওকে মানে-, বুঝতেই পারছেন!’

‘অফ কোর্স।’ ছোটকাকা অনিমেষকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এদের যে তুই এখানে দেখলি কাউকে বলার দরকার নেই।’

‘কেন?’ চাপা গলায় বলল অনিমেষ।

‘রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হল চোখ খোলা আর মুখ বন্ধ রাখা। এটার সঙ্গে যে মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারে তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ ছোটকাকা হাসলেন।

অনিমেষ খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আর হৃদয়?’

‘ওটার ব্যবহার নির্বোধরাই করে। ইমোশনাল ফুলদের জায়গা রাজনীতিতে নেই। ও কে, চেষ্টা করিস এয়ারপোর্টে আসতে আর ইন কেস অফ এনি ডেঞ্জার চিঠি লিখবি। এই ভারতবর্ষের যে-কোনও অসাধ্য সাধন মস্কোয় বসে করা যায়।’ দরজা বন্ধ করলেন ছোটকাকা।

সেদিন দুপুরে ইউনিয়ন অফিসে গেল অনিমেষ। ইদানীং এই ঘরটাকে সে এড়িয়ে যাচ্ছে। বিমান, সুদীপ এবং অনেকে কথা বলছিল। ওকে দেখেই সুদীপ বলল, ‘তোমার কী হয়েছে? আজকাল অন্যরকম লাগছে।’

‘কী হবে!’ অনিমেষ হাসল, ‘খুব ব্যস্ত ছিলাম।’

‘কী ব্যাপার?’ বিমান জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার কাকা এসেছেন মস্কো থেকে। এখানে পলিটিক্যাল কনফারেন্স আছে। ওঁর সঙ্গে থাকতে হয়েছিল।’ অনিমেষ বলল।

বিমান জিজ্ঞাসা করল, ‘কী নাম বলো তো?’

‘প্রিয়তোষ মিত্র।’

‘আচ্ছা! আমি ঠিক জানি না। তুমিও তো কখনও বলোনি!’

‘এমন কী ব্যাপার যে বলব! তবে দেখলাম নেতারা জানেন।’ অনিমেষ দেখল ওদের খুব পাজল্‌ড দেখাচ্ছে। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সুদীপের সামনে রাখল, ‘কাকা দিয়েছেন তোমাদের খেতে।’

নির্লিপ্তের মতো প্যাকেটটা তুলেই চেঁচিয়ে উঠল সুদীপ, ‘আরে রাশিয়ান সিগারেট! এ প্যাকেট ফ্রম দ্য ল্যান্ড অফ কমিউনিজম।’ সবাই হুমড়ি খেয়ে প্যাকেটটাকে দেখতে লাগল। সুদীপ সন্তর্পণে প্যাকেটটা খুলে সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে বলল, ‘থ্যাঙ্কু অনিমেষ, আমি যেন মস্কোর গন্ধ পাচ্ছি।’ চারপাশ থেকে আরও কতগুলো আগ্রহী হাত এগিয়ে এল সিগারেটের জন্য।

প্রচণ্ড একটা জ্বলুনি অনিমেষকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এল। তিরিশের বি বাসে চেপে এই প্রথম দমদমে যেতে যেতে অনিমেষ আজ সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যত ভাবছিল ততই জ্বলুনিটা বাড়ছিল! ছোটকাকা হঠাৎ মস্কো থেকে উড়ে এলেন কেন? ওঁর ঘরে যাঁরা বসে ছিলেন কিংবা যাঁদের সঙ্গে মিটিং করেছেন তাঁদের সঙ্গে ওঁর কী সম্পর্ক? সকালবেলায় তার মস্তিষ্ক ঠিক কাজ না-করায় ছোটকাকা একতরফা কথা বলে গেছেন। হয়তো তিনিই সঠিক, আজকাল যে সুবিধেবাদী-রাজনীতির শিকার সবাই তাতে ওই পথেই চলা লোভনীয়। কিন্তু অনিমেষের মনে হল ছোটকাকাকে কিছু কথা স্পষ্ট বলা দরকার।

এয়ারপোর্টে এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেল অনিমেষের। স্টেশনের যাত্রীদের থেকে এখানকার মানুষগুলোর হাবভাব আলাদা। কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর সে ছোটকাকাকে দেখতে পেল। সেই তিনটে লোক এখনও সঙ্গে আছে।

ওকে দেখে ছোটকাকা এগিয়ে এলেন, ‘এসেছিস!’

‘হ্যাঁ।’

‘খুব দেরি হয়ে গেছে আমার। তোকে যা বললাম তা করিস।’

‘কী ব্যাপারে?’

‘ওঃ, ওই প্যাকেট দুটোর কথা বলছি।’

‘আচ্ছা!’

‘আর হ্যাঁ, এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস, আখেরে কাজ দেবে।’ ইঙ্গিতে পেছনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখিয়ে দিলেন উনি, ‘মনে রাখিস, প্রত্যেকটা স্টেপ সামনে এগিয়ে যাবার জন্যই ফেলতে হয়।’ কথাটা বলে ছোটকাকা ঘুরে সুটকেস হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, অনিমেষ পেছন থেকে ডাকল।

‘কী হল?’

‘এই লোকগুলোকে কি আপনি লোভ দেখিয়ে গেলেন?’

কথাটা শোনামাত্র ছোটকাকার মুখ বিস্ময়ে চুরমার। অবাক চোখে দেখছেন তিনি অনিমেষকে। তারপর কয়েক পা ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বলছিস?’

‘আপনি যে রাশিয়ান সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়েছিলেন সেটা পাওয়ার জন্য আমার কমরেড বন্ধুরা লালায়িত হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই আরও বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় আপনার পেছনে ছুটছে। এদের নষ্ট করে আপনার কী লাভ হচ্ছে?’ অনিমেষ খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল।

‘উত্তরটা তোকে দেব না। তোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। তোরা কী চাস?’

‘এই করাপশন থেকে দেশটাকে বাঁচাতে চাই। শুনুন, যেসব লোকেদের আপনি দেখে এসেছেন কিংবা নিজের মতো মনে করেন তার বাইরেও কেউ কেউ আছে।’ অনিমেষ দৃঢ় প্রত্যয়ে জানাল।

‘গুড। একই ভ্রান্ত আবেগ! অনি, ভারতবর্ষের এই সিস্টেমে তোর ওই কেউ কেউ লোকগুলো হয় না-খেয়ে মরবে নয় একদিন দালাল হয়ে যাবে। অতএব ভেবে দেখ। আই ফিল পিটি ফর ইউ।’

ছোটকাকা আর দাঁড়ালেন না। সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অনিমেষের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ সে টের পেল তার কোনও জোর নেই। কীসের ওপর ভিত্তি করে এইসব লোভী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলবে? সামনে যে কোনও পথ খোলা নেই। চুপচাপ রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া সেও তো একরকম এসকেপিজম। তা হলে? এই ঘোলাজলে পাক খাওয়া যেখানে অবধারিত সেখানে ছোটকাকাকে মুখের ওপর জবাব দেবার কোনও উপায় নেই।

এয়ারপোর্ট থেকে বাস স্ট্যান্ড অনেকটা দূর। অনিমেষ হেঁটে যাচ্ছিল। ঠিক সেইসময় পেছনে গাড়ির শব্দ হওয়ায় সে ঘাড় ঘোরাল। গাড়িটা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সেই তিনজন। ছোটকাকাকে সি-অফ করে ফিরছেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কলকাতায় যাবে তো?’ অনিমেষ ঘাড় নাড়ল।

‘উঠে এসো।’ কথার মধ্যে একটা নকল ভালবাসা টের পাওয়া যাচ্ছে। অনিমেষ এক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপরই হাসল, ‘না। আপনারা যান। আমার এখানে একটু দরকার আছে। দেরি হবে।’

তিনটে লোক স্বাভাবিক হয়ে গেল। চলে যাওয়ার আগে সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার কাকার সঙ্গে কথা হয়েছে। একদিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। কোনও চিন্তা নেই।’

ছুটন্ত গাড়ির পশ্চাদ্দেশ দেখতে দেখতে অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল, ‘শালা’।

অনেক রাত্রে হস্টেলে ফিরল অনিমেষ। উলটোডাঙা থেকে সোজা হেঁটে এসেছে। ভীষণ ক্লান্তি শরীরে। আশেপাশের দোকান বন্ধ এখন। হস্টেলের গেট আধভেজানো। হঠাৎ পাশের ল্যাম্পপোস্টের ছায়া থেকে কেউ দ্রুত সরে এল ওর কাছে। চমকে অনিমেষ তাকাতে হতভম্ব হয়ে গেল। সুবাসদা। ঝড়ো কাকের মতো চেহারা। চাপা গলায় ডাকল সুবাসদা, ‘অনিমেষ’!

‘সুবাসদা! আপনি?’ যতটা না দেখে তার চেয়ে ওর হাবভাবে অবাক হল সে।

‘অনিমেষ, তুমি কি আমাকে একটা রাত থাকতে দিতে পারো?’

অনিমেষ একটু দ্বিধা না-করে বলল, ‘নিশ্চয়ই, আসুন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *