চুয়াল্লিশ
সেদিন যারা গা ঢাকা দিতে পেরেছিল তারা খুব সামান্য সময়ের জন্যেই মুক্তির আনন্দ পেয়েছিল। আনন্দ শব্দটা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে অনিমেষের দ্বিধা আছে। সবসময় পুলিশের ছায়া পেছনে ঘুরছে, প্রতি মুহূর্তে দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকতে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে— এইরকম পরিস্থিতিতে কি জেলের বাইরের খোলা আকাশ আনন্দের হয়! যারা ধরা পড়ছে এবং জেলে ফেরত আসছে তাদের অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু যারা জেলেই পড়ে ছিল তাদের ওপর আক্রোশ মিটিয়ে নিয়েছে পুলিশ।
অনিমেষের পাশে দীর্ঘ সময় পড়ে ছিল ছেলেটি। তার পশ্চাদ্দেশ রক্তাক্ত। মোটা রুল সেখানে প্রবেশ করিয়ে শাস্তি দিয়ে গেছে ওরা ছেলেটিকে। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল ছেলেটি। কাটা ছাগলের মতো ছটফট করেছিল, কিন্তু সামান্য বাধা দেবার মতো মানসিকতা ছিল না ওর। এমনকী এত বড় আঘাত যে ও তার পরে টের পাচ্ছিল বলে মনে হল না অনিমেষের। একটা গাছও বোধহয় ওর চেয়ে বেশি অনুভূতিশীল হয়ে থাকে।
পঙ্গু বলে হয়তো অনিমেষের ওপর এই বীভৎস আক্রমণটি করেনি। কিন্তু বেধড়ক পিটিয়ে গেছে ওরা ওকে। কপালের আঘাত ফুলে চোখ ঢেকে দিয়েছে। একটা দাঁত থুতুর রং পালটে বেরিয়ে এসেছিল। ওরা চলে গেলে অনিমেষ অনেকক্ষণ চুপচাপ পড়ে ছিল তারপর মুখের রক্ত মুছে ছেলেটিকে দেখল। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অর্ধ নগ্ন শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে। দু’হাতে হামা দিয়ে অনিমেষ ছেলেটির পাশে গিয়ে গায়ে হাত রাখল, ‘এই, এই যে, শুনছ—।’
এই ঘরে ওরা যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিন থেকেই অনিমেষ জানে ওর সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হবে না। একটা মানুষের চোখের দৃষ্টি সাদা হয়ে যায় এমন করে তা সে কখনও জানত না। এই ঘরে পায়খানা করে ফেললে রোজ দরজায় বসে অনিমেষকে চিৎকার করে পাহারাদারদের নজর কাড়তে হয়। কিন্তু তবু আজ ওর আঘাত দেখে সে না-ডেকে পারল না। ছেলেটির কাঁপুনি কমছিল না। অনিমেষ ওর পাজামা টেনেটুনে ভদ্রস্থ করে চুপচাপ বসে থাকল।
কী হল? হয় পঙ্গু নয় শরীর থেকে বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ উধাও হয়ে ক্লীবের মতো বেঁচে থাকা— জীবনের এই পরিণতি শেষ পর্যন্ত? এমন যদি হত বিপ্লবের চূড়ায় পৌঁছাতে ওরা সিঁড়ির কাজ করেছে, পরের মানুষেরা সেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাবে তা হলে নিজেদের এতটা অসাড় বলে মনে হত না। পুলিশ-খুনের চেষ্টার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনও খবর তার কাছে নেই। এর মধ্যে একজন এসে জানতে চেয়েছিল সে কোনও উকিলের সাহায্য চায় কিনা। অনিমেষ পরিষ্কার না বলেছে। নিজের কথা তার চেয়ে কোনও উকিল ভাল করে বলতে পারবে না। প্রথমদিকে সে একটা উত্তেজনায় ভুগত। কাঠগড়ায় যদি তাকে বিচারক জিজ্ঞাসা করেন সে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেবে। এই বিচারব্যবস্থার সুস্থতা সম্পর্কে সে স্পষ্ট অভিযোগ জানাবে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত এই উত্তেজনাকে তার ছেলেমানুষি মনে হচ্ছে। ধরা যাক, সরকারি উকিলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে সে মুক্তি পেল। তখন সে কোথায় যাবে? বাকি জীবনটা সে কীভাবে কাটাবে? তার চেয়ে এই ভাল। কোনওরকম পালটা জবাব সে দেবে না। যদি তার যাবজ্জীবন জেল হয় এখন সেটাই তার পক্ষে মঙ্গল। এইরকম বিষাদে সে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছিল। শারীরিক অক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের মানসিক ক্লীবতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। মাঝে মাঝেই তার মাথায় অন্য সব চিন্তা আসতে লাগল। কোর্টে পুলিশ তার কেস তুলছে না। ঠিক যেভাবে ওর সঙ্গী ছেলেটিকে ফেলে রাখা হয়েছে ওকেও যেন ওরা তেমনি দেখছে। নিজেকে এইরকম ছেঁড়া কাগজের মতো দেখতে যখন অসহ্য লাগে তখনই মরে যাওয়ার কথা মনে হয়। এই ঘরে বাস করে আত্মহত্যা করার আপাতত কোনও সুযোগ নেই। গলায় দড়ি কিংবা বিষ খাওয়ার কোনও উপায় নেই। আত্মহত্যার কথা মনে হলেই যার মুখ চোখের সামনে ভাসে তাকে অনেক কষ্ট করে মন থেকে সরাতে চাইছে সে। সেই মুখ যেন ভার হয়ে বলে, ছিঃ! তুমি তো এত দুর্বল নও অনিমেষ।
তখনই হো-হো করে হেসে ওঠে অনিমেষ জেলের ঘরে বসে। শেষের দিকে হাসিটা ভেঙে যায়। গলা বন্ধ হয়ে যায়। দুর্বল কাকে বলে? যে লড়তে পারে না, যার সর্বস্ব কেড়ে নিলেও প্রতিবাদের সামান্য ক্ষমতা যে ধরে না সে কি দুর্বল নয়! এইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে যাকে হাঁটতে হয় তার বল কোথায়? এমনকী আত্মহত্যা করার মতো শক্তিও তার নেই। এইসব ভাবনা মাথায় এলেই সে ছটফট করে। মনে হয় ক্রমশ উন্মাদ হয়ে যাবে। একদম বোধশূন্য হয়ে যাওয়া বরং ভাল। পৃথিবী সম্পর্কে কোনও অভিযোগ থাকে না তা হলে। কিন্তু তা হচ্ছে না যখন তখন অনিমেষ কী করত সে জানে না যদি পাশের ছেলেটি এরকম আহত না-হত।
একটু একটু করে ছেলেটি ওর ওপর নির্ভর করতে শিখল। ওর সঙ্গে কথা বলে অনিমেষের সময় কেটে যায়। এ এক মজার খেলা। অনিমেষ কথা বলতে শুরু করলে ছেলেটি চুপটাপ ওর দিকে চোখ মেলে বসে থাকে। যতক্ষণ না অনিমেষের মুখ বন্ধ হচ্ছে ততক্ষণ দৃষ্টি সরায় না সে। ক্রমশ এ এক নতুন খেলা হয়ে দাঁড়াল। সময় কাটানোর সমস্যা আর নেই। নিজের কথা, যা করার উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু করা হল না, সেইসব কথা ছেলেটিকে বলত অনিমেষ। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করত সে। একটা রক্তমাংসের মানুষ তার কথা শুনছে। ছেলেটির কোনও প্রতিক্রিয়া হত না, তবু মানুষ তো! এইরকম একদিন কথা বলতে বলতে হেসে ফেলল অনিমেষ। এই ছেলেটি যেন গোটা ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হয়ে তার সামনে বসে রয়েছে। যে যাই বলুক, যার কোনও কিছুতেই এসে যায় না।
জেলে বসে সময়ের হিসেব রাখা মুশকিল। মাঝে মাঝে অনিমেষেরই হিসেব গুলিয়ে যায় ঠিক কত বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে জেলের কর্তা এসে অনিমেষকে বলেছিল, ‘মুক্তি পেলে কোথায় যাবেন?’
‘মুক্তি, পাচ্ছি নাকি?’
‘বলা যায় না, যা তোড়জোড় চলছে, পেলেও পেতে পারেন।’
অনিমেষ লোকটির দিকে তাকাল। শুধু পোশাক একটা মানুষের চেহারা পালটে দেয়। এই কয় বছরে এই লোকটি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে না। লোকটি আবার বলল, ‘এখন কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে করতে পারেন। তেমন ইচ্ছে থাকলে আপনি তাদের চিঠিতে জানিয়ে দিন।’
‘কী হবে দেখা করে?’
‘সেটা আলাদা কথা। কিন্তু আপনার এই শারীরিক অবস্থায় জেলের বাইরে যাতে বিপদে না-পড়েন তার জন্যেই যোগাযোগ করা দরকার।’
‘আমি কারও দায় হতে চাই না।’
‘প্রতিবন্ধীদের জন্যে একটা আশ্রম আছে। সেখানে নানা হাতের কাজ শেখানো হয় তাদের জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে। সেখানে যাবেন?’
হেসে ফেলল অনিমেষ, ‘বাঃ চমৎকার। একটু দেখুন না আমার জন্যে।’
সরকার পালটে গেছে এর মধ্যে। অনিমেষ জানল ভারতবর্ষ এখন চুপচাপ, শান্ত। কোনও শোক নেই কিংবা আফশোস। কোথাও আনাচে কানাচে যারা একদা স্বপ্ন দেখত তারা বেঁচে মরে আছে অথবা তাদের অস্তিত্ব আর তেমন জোরদার নয়। পশ্চিমবাংলার মানুষ বিপুল ভোটে বামপন্থীদের নির্বাচিত করেছে। নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের ওপর দেশের মানুষ তাদের আস্থা জানিয়েছে। অনিমেষদের প্রচার এবং বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে এখন আর কেউ ভাবে না। জেলের ভেতরে যারা গোপনে গোপনে এখনও আশা রাখত তারা ভেঙে পড়ল।
অনিমেষের কিন্তু এই খবরে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। তবে নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিলে সে একটি নাম দেখে ঈষৎ চমকে উঠেছিল। পরে হেসে ফেলেছিল শব্দ করে। সুদীপ মন্ত্রিসভায় একটা ভাল জায়গা পেয়েছে। বিমান নয়, ইউনিভার্সিটির ছাত্র ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারির থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে সুদীপ চুরুট মুখে পশ্চিমবাংলার মন্ত্রী হয়ে বসেছে। অনিমেষের মনে পড়ল, সুদীপের মধ্যে একটা পরিকল্পিত ভাবনা সবসময় কাজ করত। কীসে বেশি লাভ হয় কিংবা কোন ঘটনা বেশি প্রচার এনে দেবে এ ব্যাপারে ইউনিভার্সিটিতে সে বিমানের থেকেও সজাগ ছিল।
হঠাৎ জেলের মধ্যে একটা উৎসবের মেজাজ এসে গেল। নতুন সরকার নাকি রাজনৈতিকভাবে নকশাল বন্দিদের মোকাবিলা করবেন। বাইরে এখন বন্দিমুক্তি আন্দোলন চলছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছু কিছু নকশালপন্থীদের তাঁরা মুক্তি দেবেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন এতদিনে জেলে বন্দি থেকে নকশালপন্থীদের যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিংবা এদের মেরুদণ্ডটি ভেঙে দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আর জেলে রাখার দরকার নেই। কীভাবে কখন মুক্তি দেওয়া হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। আদালতে যেসব মামলা চলছিল তা সরকারপক্ষ তুলে নেবার সিদ্ধান্ত করলেন। সরকারের এই উদারতায় নানান মহলে নানান প্রতিক্রিয়া হলেও বন্দিরা স্বাভাবিকভাবে খুশি হল।
এর মধ্যে জেলের সেই কর্তাব্যক্তি অনিমেষের কাছে এসেছিলেন। ভদ্রলোক যে কেন অনিমেষকে পছন্দ করছেন তা সে বুঝতে পারে না। এসে বললেন, ‘ব্যস, হয়ে গেল। আপনাদের জেলবাস পর্ব সমাপ্ত।’
অনিমেষ হেসে বলল, ‘কোনও মানে হয় না। ধরলই বা কেন আর ছাড়ছেই বা কেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘এত মানে খুঁজতে চান কেন? যা ঘটছে তাই মেনে নেওয়া ভাল। আমি এসেছিলাম আপনাকে দুটো খবর দিতে। এক ভদ্রমহিলা প্রায়ই আসছেন আপনার খবরাখবর নিতে। আপনি কারও সঙ্গে দেখা করতে চান না জেনেও তিনি বিরত হননি। গতকাল এসে জানতে চাইছিলেন যে আপনি কবে মুক্তি পাবেন।’
‘আপনি কী বললেন?’ শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ।
‘আমাদের কাছে কোনও সঠিক খবর আসেনি। আমি সামনের সপ্তাহে ওঁকে আবার খবর নিতে বললাম।’ তারপর একটু হেসে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যদি কিছু মনে না-করেন তা হলে জিজ্ঞাসা করছি, উনি আপনার কে হন?’
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘ছেড়ে দিন এসব কথা। আর একটা খবর কী যেন বলছিলেন? আর কেউ আমার খবর নিতে আসছে নাকি?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘না না। আর কেউ আসেনি। আমি একজনের আন্তরিক ধন্যবাদ এবং আশীর্বাদ আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’
‘কার কথা বলছেন?’
‘দীপকের মা।’
‘দীপক?’ অনিমেষ অবাক হয়ে ডানদিকে তাকাল। এই ছেলেটির নাম যে দীপক তা ওর মনেই ছিল না। এখন দীপকের মা প্রতি সপ্তাহে আসেন। ওকে তখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। মহিলা ছেলেকে খাইয়ে যান কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু তিনি কোন কারণে তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন? এই বোধবুদ্ধিহীন ছেলেটি একটি নামের অধিকারী তাই খেয়াল ছিল না অনিমেষের।
ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনার কথা ওঁকে আমি বলেছি। আপনারা এক ঘরে থাকেন এবং আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেন ওর সাড়া না-পেয়েও। একমাত্র আপনি যখন কথা বলেন তখন ওর দৃষ্টি খানিকটা স্বচ্ছন্দ হয়। এসব শুনে মহিলা আপনার কথা জানতে চাইছিলেন। শোনার পর আপনার সঙ্গে কথা বলতে তিনি খুব আগ্রহী। যখন জানলেন যে আপনি কারও সঙ্গে দেখা করতে চান না তখন আমাকে ওই কথাগুলো জানাতে বললেন।’
অনিমেষ হাসল। এ ছাড়া সে আর কী করতে পারে। তার নিজের শরীরের যা অবস্থা তাতে একথা স্পষ্ট যে সে কোনওদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এই অবস্থায় ছেলেটির কোনও উপকারেই সে আসতে পারে না। কথা বলছে নিজের প্রয়োজনে। একা মুখ বন্ধ করে থাকলে সে এতদিনে পাগল হয়ে যেত।
কিন্তু তার পরের দিনই যে এমন চমক ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে কল্পনাতেও আসেনি তার। দু’জন সিপাই সাতসকালে ওদের সেল থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে। অনিমেষকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। দুটো পা ঝুলে পড়ছে। সঙ্গী ছেলেটি, যার নাম দীপক, হাঁটছিল উদাস পায়ে।
অফিসঘরে বসার পর ওদের খবরটা জানানো হল। সরকার দয়াপরবশত ওদের বিরুদ্ধে আনীত সবরকম অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এবং সেই সঙ্গে আশা করছেন ভারতবর্ষের দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে তারা বাকি জীবনটা কাটাবে।
মুক্তি! খবরটা শুনে অনিমেষের একটুও উত্তেজনা হল না। এই মুক্তি নিয়ে কী হবে! এতদিন মনে মনে এই দিনটির আশঙ্কা করেছিল সে। এখন সে কী করবে? চোখ বন্ধ করল অনিমেষ। এভাবে সে মুক্তি চায়নি কখনও। দীপকেরও এই খবরে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। আর হাজারটা শব্দের মতো মুক্তি শব্দটার আলাদা কোনও মানে নেই ওর কাছে। শূন্য দৃষ্টি মেলে সে দাঁড়িয়ে রইল অনিমেষের গা ঘেঁষে। এই জিনিসটি সম্প্রতি ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় কোনও মানুষ এলে তার অস্তিত্ব বোধহয় অনুভব করে দীপক। কারণ সেই সময় সে অনিমেষের কাছছাড়া হতে চায় না। ব্যাপারটা ওর পরিবারের লোকের জানা দরকার। দীপকের চেতনা ফিরে আসবার একটা সূত্র হিসেবে এটাকে ডাক্তাররা কাজে লাগাতে পারেন।
কাগজপত্রে যখন তাদের মুক্তির ব্যাপারটা আইনসম্মত করা হচ্ছিল তখন সেই ভদ্রলোক এলেন, ‘আপনি কোথায় যাবেন কিছু ঠিক করেছেন?’
‘না।’
‘কিন্তু কোথাও তো যেতে হবে।’
‘দেখি। এখান থেকে বের হয়ে তারপর ভাবব।’
‘বুঝলাম। কিন্তু আপনি তো একজন সুস্থ মানুষের মতো ঘুরে বেড়িয়ে ভাবতে পারবেন না। আমি আপনার হয়ে সেই আশ্রেম খোঁজ নিয়েছিলাম।’
‘কোন আশ্রমে?’
‘প্রতিবন্ধীদের। আপনাকে বলেছিলাম।’
‘ও হ্যাঁ। সেখানে যাওয়া যাবে?’
‘যাবে। কিন্তু এই মাসটা আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।’
‘এই মাসটা!’
হ্যাঁ, আর মাত্র আট দিন আছে মাস শেষ হেত। এই ক’দিন আপনি যদি দীপকের সঙ্গে থাকেন তা হলে ওর মা খুব খুশি হবেন।’
‘দীপকের সঙ্গে?’ অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। দীপকের সঙ্গে তার থাকার কথা ওঠে কী করে? সামান্য পরিচয় যেখানে নেই। সে ঘাড় নাড়ল, ‘না, তা হয় না।’
ভদ্রলোক কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘বেশ, যা ভাল বোঝেন করবেন। আশ্রমের ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি।’
কিন্তু দীপকের মাকে এড়াতে পারল না অনিমেষ। এক-একজন বয়স্কা মহিলা আছেন যাঁদের চেহারা এবং কথায় এমন এক স্নেহময়ী জননী-জননী ভাব থাকে যে তাঁদের মুখের ওপর কটু কথা বলা যায় না। দীপকের মা সেইরকম একজন। তিনি ওর হাত ধরে বললেন, ‘বাবা, আমি জানি তোমরা খুব অভিমানী হও। কিন্তু আমার দিকে তাকাও। যে ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল আর যাকে নিয়ে আমি আজ বাড়ি ফিরছি সে তো এক নয়। আমার তো পৃথিবীতে কেউ নেই, আমি কী নিয়ে থাকব?’
অনিমেষ জবাব দিল না। মহিলা তখনও ওর হাত ছাড়েননি। বললেন, ‘আমি সব শুনেছি। তুমি না-থাকলে আমার ছেলে মরে যেত।’
‘না, এটা সত্যি নয়। আপনাকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে।’
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, ‘পৃথিবীর সব চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও মায়ের চোখকে কিছুতেই দিতে পারবে না। আমি এতদিন ধরে ওকে দেখতে আসছি, ও আমাকে একদিনও চিনতে পারেনি।’ কেঁদে ফেললেন উনি। কিছুটা সময় লাগল সামলাতে, তারপর অন্যরকম গলায় বললেন, ‘কিন্তু তোমার পাশে কেমন সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো।’
অনিমেষ হাসল, ‘এটা একসঙ্গে থাকার অভ্যেস থেকে হয়েছে।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘যাই হোক, ও তো একটা পাথর হয়ে ছিল, এটুকু কম কী?’
অনিমেষ বলল, ‘দীপক ভাল হয়ে যাবে।’
কথাটা বলেই কেমন যেন অন্তঃসারশূন্য মনে হল। ভদ্রমহিলা সে-কথায় কান দিলেন না মোটেই। বললেন, ‘তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?’
অনিমেষ অস্বস্তির চোখে তাকাল, ‘এসব প্রশ্ন করবেন না। এইসময় আমি কোনও আত্মীয়স্বজনের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। তা ছাড়া—।’
‘ঠিক আছে।’ ভদ্রমহিলা ওকে থামিয়ে দিলেন, ‘আমি তোমার কিছু জানতে চাই না। তুমি দীপকের সঙ্গে চলো। আমি জানব আমি দুই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। তোমরা দু’জনে মিলে আমার এক ছেলে হলে।’
অনিমেষ ভাববার সময় পেল না। ভদ্রমহিলার মধ্যে এমন তৎপরতা কাজ করছিল যে সে আর আপত্তি তুলতে পারল না। কোনও পরিচিত বাড়িতে গিয়ে তাদের দয়ার ওপর নির্ভর করার চাইতে এটা অনেক বেশি শ্রেয় বলে মনে হল ওর। সে নিজে যাচ্ছে না, তাকে উনি আগ্রহভরে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের ছেলের সঙ্গে একই মমতায় যতক্ষণ উনি তাকে দেখবেন ততক্ষণ কোনও অস্বস্তির কারণ হবে না। তা ছাড়া এই ক’টা দিন চলে গেলেই সে আশ্রমে যেতে পারবে। ততদিন তো মাথার ওপর একটা ছাদ দরকার।
ব্যবস্থা ভদ্রমহিলাই করলেন। দু’জন সিপাই ওকে ধরে নিয়ে এল বাইরে। সেখানে একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল। খুব পুরনো আমলের বৃদ্ধ গাড়ি। তার ড্রাইভারও গাড়ির চেহারার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। অনিমেষের সঙ্গে সঙ্গে দীপক হেঁটে এল। ভদ্রমহিলা এক হাতে অনিমেষকে অন্য হাতে দীপককে ধরে রেখেছেন। গাড়িতে ওরা ওকে তুলে দিয়ে ফিরে গেল। ভদ্রমহিলা দীপককে উঠতে বললে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ভদ্রমহিলা আবার বললেন, ‘খোকা ওঠ, গাড়িটা চিনতে পারছিস না?’
দীপক কথাগুলো শুনল বলে মনেই হল না। তিন-চারবার ডেকে ব্যর্থ হয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘কী করি বলো তো বাবা!’
সিটের ওপর হেলান দিয়ে বসতে পেরেছিল অনিমেষ। এবার ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে সে দীপককে ধরল, ‘এই, গাড়িতে উঠে এসো।’ দু’বার ডাকতে দীপকের দৃষ্টি এদিকে ফিরল। অনিমেষ শক্ত হাতে ওকে টানতেই ছেলেটি গাড়ির ভেতরে ঝুঁকে পড়ল। তারপর কোনওরকম দ্বিরুক্তি না-করে উঠে বসল। খুব খুশি হলেন ভদ্রমহিলা, ‘দেখো তো, তোমার কথা কেমন শোনে ও।’
ছেলেটি সোজা হয়ে সিটে বসেছিল, তার একপাশে অনিমেষ, অন্যদিকে ভদ্রমহিলা। অনিমেষের সঙ্গে জিনিসপত্র বলতে কিছুই ছিল না। জেল থেকে বের হবার সময় সেই ভদ্রমহিলার আনুকূল্যে একটু ভদ্রস্থ হয়ে বেরোতে পেরেছে এই যা। কিন্তু গাড়ির সিটে বসে ওর নিজেকে খুব কুঁজো মনে হচ্ছিল। সে তুলনায় দীপক অনেক খাড়া। জেলের সীমা ছাড়িয়ে গাড়িটা বড় রাস্তায় পড়লে অনিমেষ অনেক পাখির ডাক শুনতে পেল। বেশ নির্জন রাস্তা। কলকাতা বলেই মনে হয় না। একেই কি কপাল বলে? অনিমেষ নিজের কথা ভাবছিল। এতদিন পরে জেল থেকে বেরিয়ে যাদের সঙ্গে সে যাচ্ছে তাদের কাছে যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না। তবু যেতে হচ্ছে। যাচ্ছে কিছুটা পালিয়ে যাতে অন্য সবাই রক্ষা পায়। বিবেক বা চক্ষুলজ্জার সুযোগ নিতে সে কিছুতেই চায় না। তার চেয়ে পথের আলাপ পথেই রেখে যাওয়ার মতন এই ভদ্রমহিলার বাড়িতে ক’টা দিন চোখ বুজে কাটিয়ে দেওয়া বরং ঢের ভাল। রেসকোর্সের পাশ দিয়ে গাড়ি সোজা এগিয়ে এল রবীন্দ্রসদনের সামনে। দূর থেকে রঙিন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, কলকাতা একইরকম রয়ে গেছে। কোনও বড় শিল্পীর অনুষ্ঠান হবে নিশ্চয়ই, না-হলে এই সকালবেলায় এত বড় লাইন পড়ে!
ল্যান্সডাউন রোডে যে বাড়িটায় ওরা ঢুকল সেটাই যে দীপকদের বাড়ি তা না-দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গেট পেরিয়ে বিরাট লন, বাগান এবং তার পাশে ধবধবে সাদা একটা দোতলা বাড়ি। নুড়িপাথরের রাস্তা ঘুরে গাড়িটা এসে দরজায় দাঁড়াতেই দু’-তিনজন ঝি-চাকর ছুটে এল। দীপকের মা নামলেন গাড়ি থেকে। অনিমেষ লক্ষ করল এর মধ্যেই ওঁর ভাবভঙ্গিতে একটা দৃঢ় মর্যাদাবোধ যোগ হয়েছে। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘একটা ইজিচেয়ার নিয়ে আয় আগে।’
চাকর মুখের দিয়ে চেয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল কথাটা শুনে, উনি এবার ধমক দিলেন। ইজিচেয়ার আসতেই গলা নরম করে উনি বললেন, ‘অনিমেষ, তুমি আগে নামো। ওরা তোমাকে ধরুক।’
কর্মচারীরা এতক্ষণে বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা। খুব সন্তর্পণে এরা অনিমেষকে নামিয়ে ইজিচেয়ারে শোওয়াল। কিন্তু মুশকিল হল দীপককে নিয়ে। সে তেমনি খাড়া হেয় বসেই আছে। শত ডাকেও তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অনিমেষ তিন-চারবার ডাকলেও সে তাকাল না। এবার ভদ্রমহিলা ঝুঁকে পড়ে ওর হাত ধরলেন, ‘নেমে আয় খোকা। নিজের বাড়িতে এসেছিস তুই, আয় বাবা।’ দীপকের কোনও প্রতিক্রিয়া হল না কথাগুলোয়। ভদ্রমহিলা একটু ভেবে নিয়ে চাকরদের বললেন, ‘ওকে জোর করে নামা গাড়ি থেকে।’
এবার একটা কাঠের পুতুলের মতো নেমে এল দীপক ওদের হাতে। নেমে এসে যেন কিছুটা সহজ হল কারণ অনিমেষের ইজিচেয়ারের পাশ ঘেঁষে সে দাঁড়াল। ইজিচেয়ার নিয়ে চাকররা চলতে আরম্ভ করলে সেও সঙ্গ ধরল। দীপকের মা বললেন, ‘দেখলে অনিমেষ, ও তোমার কেমন বশ মেনেছে।’
অনিমেষ বুকে ভার বোধ করল। ভদ্রমহিলা প্রতিমুহূর্তে তাকে জড়াবার চেষ্টা করছেন। এটা সে চায় না কিন্তু এখন সে-কথা বলার সময় নয়।
সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি। দোতলায় উঠে যে ঘরটায় ইজিচেয়ার নামাল সেখানে দুটো সুন্দর খাট, চেয়ার এবং ঘরের দেওয়ালে কালীঘাটের পটের দুটো ছবি টাঙানো। ঝি চাকরদের কাজ করতে যেতে বলে দীপককে ওর মা প্রায় জোর করেই একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অনিমেষ, তুমি একটু জিরিয়ে নাও, তারপর হাত-মুখ ধুয়ে নেবে।’
অনিমেষ বলল, ‘আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?’
‘বাঃ, ব্যস্ত হব না। অ্যাদ্দিন পরে ছেলে এল আর আমি ব্যস্ত হব না।’ কথা শেষ করতেই ডুকরে উঠলেন ভদ্রমহিলা। এবং শেষ পর্যন্ত কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারলেন না তিনি। অনিমেষের কিছু করার নেই। সে দীপকের দিকে তাকাল। মায়ের কান্না দীপকের চোখে কোনও ছায়া ফেলছে না। স্থির চোখে সে সামনে তাকিয়ে আছে। এইসময় দরজায় থপথপ শব্দ হল। অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অত্যন্ত বৃদ্ধা এক মহিলা খুব ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলেন। তারপর এগিয়ে এসে দীপকের গায়ে হাত রেখে বললেন, ‘কাঁদছ কেন বউমা। ছেলে ফিরে এসেছে এখন কি কাঁদতে আছে। আহা, খোকা আমার কী রোগা হয়ে গেছে গো।’
দীপকের মা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাতে পারলেন, ‘না মা, কাঁদছি না। কাঁদব কেন? আমার এক ছেলে গেল আর দুই ছেলে ফিরল। একে দেখুন— এর নাম অনিমেষ। খোকাকে যে দেখাশুনা করত।’
বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা এবার শ্লথ পায়ে অনিমেষের কাছে এলেন, ‘তোমার কথা শুনেছি বাবা। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।’
অনিমেষ হেসে ফেলল, “মঙ্গল যা করার তিনি করেছেন।’
সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, ‘ও কথা বোলো না বাবা। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আমাকে দেখো না, স্বামীকে হারালাম তো ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম। ছেলেকে হারালাম তো নাতিকে জড়িয়ে ধরলাম। এবার নাতিকে—।’ কথা শেষ না-করে বললেন, ‘আমি কিন্তু এখনও আশা ছাড়িনি বাবা। বউমা বলত খোকা নাকি আর কখনও স্বাভাবিক হবে না। আবার কালকে এসে বলল ও নাকি একমাত্র তোমার ডাকেই সাড়া দেয়। তবে?’
এবার দীপকের মা এগিয়ে এলেন, ‘অনিমেষ, উনি দীপকের ঠাকুরমা।’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি। আপনাকে প্রণাম করব সে ক্ষমতা আমার নেই। আমি আজকাল কোমর বেঁকাতে পারি না।’
‘থাক বাবা, যথেষ্ট হয়েছে। বউমা, এদের খাবার ব্যবস্থা করো।’ অনিমেষ লক্ষ করল দীপকের মায়ের ব্যক্তিত্ব এই বৃদ্ধার কাছে কেমন নরম হয়ে যাচ্ছে। তিনি মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বৃদ্ধা আর-একটা চেয়ার নিয়ে ওর সামনে বসলেন। ‘খোকা কি সত্যি তোমার ডাকে সাড়া দেয়?’
‘ঠিক সাড়া নয়, তবে মাঝে মাঝে তাকায়।’
‘খুব ব্রাইট ছেলে ছিল ও, দেখো কী হল! প্রেসিডেন্সিতে পড়ত, হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করেছিল। ওর বাবাও খুব ভাল ছেলে ছিল। কিন্তু কখন যে কী হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে অনিয়ম করত। ওর মা বকাঝকা করলেও আমি বাধা দিতাম। বলতাম, খোকা কখনও কোনও অন্যায় করতে পারে না। তারপর একদিন ও আর বাড়িতে ফিরল না। কী দুশ্চিন্তা আমাদের। হাসপাতালে খবর নিই, আত্মীয়দের বাড়িতে খবর নিই। ঘরপোড়া গোরু আমি— কিছুতেই মন মানে না। একটা সময় ওর চিঠি এল। দেশটাকে স্বাধীন করতে চাই, তোমরা আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। কিছুই বুঝলাম না। দেশ তো স্বাধীন, তাকে আবার স্বাধীন করবি কী! সেই সময় পুলিশ এল বাড়িতে। সব তল্লাশি করে কাগজপত্র পেল। যাওয়ার সময় বলে গেল সে নাকি নকশাল হয়েছে। কাগজে তখন এসব খবর সবে ছাপা হচ্ছে। বুক আমার হিম হয়ে গেল। নকশাল মানে জানি যারা পুলিশের গলা কাটে, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙে। আমাদের খোকা ওসব করছে? একদিন রাত্তিরে টেলিফোন এল খোকার। বলল, শত্রুরা নাকি তাদের ঘিরে ফেলেছে। পালাবার পথ নেই। তার মাকে বলল, বারান্দায় ফুলের টবে নাকি বোমা লুকোনো আছে। সেগুলো নিয়ে ওর মা যদি আধঘণ্টার মধ্যে না-পৌঁছোতে পারে তা হলে ওরা মরে যাবে। আমরা দু’জনে মিলে টব ভেঙে দেখলাম সত্যি সত্যি সুন্দর প্যাক করা কতগুলো বাক্স বের হল। ওর মা বলল সে যাবে। আমি বললাম, না, গেলে আমি যাব। কিন্তু কাউকেই যেতে হল না। বাড়ি থেকে বের হবার আগে পুলিশ এল। আমাদের টেলিফোন লাইনে যে আড়ি পাতা ছিল কে জানত! তারা এসে বোমাগুলো নিয়ে গেল। দু’-তিনদিন বউমাকে থানায় যেতে হয়েছিল ওই জন্যে। খোকাকে নাকি পুলিশ সে রাত্রে উদ্ধার করেছে। কীরকম করেছে দেখতেই পাচ্ছ।’ বৃদ্ধা নিশ্বাস ফেললেন জোরে জোরে। তারপর হঠাৎ অনিমেষের হাত ধরে ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সত্যি বলো তো বাবা, তোমরা কি নিজেদের ক্ষমতা জানতে না?’
অনিমেষ বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকাল। বিবর্ণ মণি দুটো তার দিকে স্থির হয়ে আছে। মুখময় অজস্র ভাঁজ। সময়ের রেখাগুলো এখন স্পষ্ট।
সে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমরা বিশ্বাস করি এভাবে মানুষের বেঁচে থাকা উচিত নয়। রাজা নেই, বিদেশি শাসক নেই কিন্তু তাদের জায়গা নিয়েছে সামান্য কয়েকজন মানুষ, যাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর ভারতবাসীর দিন কাটছে। আমরা একটা রাস্তা খুঁজতে চেয়েছিলাম যা আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে।’
বৃদ্ধা অসহিষ্ণু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কীসের জোরে তোমরা এমনভাবে কোনও কিছু চিন্তা না-করে ঝাঁপিয়ে পড়লে?’
অনিমেষ আবার বলল, ‘বিশ্বাস।’
‘কিন্তু এই তো তার পরিণতি হল। খোকাকে দেখো, কোনওদিন ও মুখ ফুটে কথা বলতে পারবে কিনা সন্দেহ, তুমি কি কোনওদিন স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারবে? তবে? কী দাম এইরকম বিশ্বাসের?’ বৃদ্ধা নাতির হাত ধরলেন।
এই প্রশ্নটা জেলে বসে অনিমেষ হাজার বার নিজেকে করেছে। হঠকারিতা থেকে কোনও সুন্দর সৃষ্টি হয় না। কিন্তু আজ এই সময়ের শিকার হওয়া মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে উত্তর দিতে একটুও অস্বস্তি বোধ করল না, ‘বিশ্বাস যদি সত্যি হয় তা হলে অনেক অসাধ্যসাধন করা যায়। আমরা পারিনি কিন্তু তাই বলে কাজটা শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো সাময়িকভাবে সেটা থেমে আছে। আমরা করতে চেয়েছিলাম বলেই ভুলগুলো ধরা পড়েছে। আমাদের আগে কেউ করেনি বলে অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হয়েছিল। কিন্তু আমাদের পরে যারা এই বিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করবে তারা আমাদের ভুলগুলো থেকে অভিজ্ঞতা পাবে। ফলে তারা সফল হবেই।’
‘কিন্তু আগুনে হাত দিয়ে তো তোমাদের হাত পুড়ল।’
‘ঠিকই। তা থেকে মানুষ শিখল আগুনকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। সেইটুকুই লাভ।’
বৃদ্ধা নড়েচড়ে বসলেন, ‘আমি এতসব বুঝি না। খোকার না-হয় কিছু বোঝার শক্তি নেই কিন্তু তোমার আফশোস হচ্ছে না?’
‘হচ্ছে। ভুলগুলো করলাম বলেই আফশোস হচ্ছে।’
অনিমেষের কথা শেষ হওয়ামাত্র পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। একটি মেয়ে হাতে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল, পেছনে দীপকের মা। টেবিলে ট্রে নামানো হলে অনিমেষ দেখতে পেল একটা বড় কাচের বাটিতে জল আর তার পাশে ছোট তোয়ালে রাখা আছে। দীপকের মা বললেন, ‘তুমি মুখ-হাত ধুয়ে নাও অনিমেষ।’
জেলে বাস করে যে অভ্যাস হয়েছিল তার কাছে এই আপ্যায়নকে রাজসিক ব্যাপার বলা যায়। একটু সংকোচের সঙ্গে অনিমেষ হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছলে মেয়েটি সেগুলো ফিরিয়ে নিয়ে গেল। দীপকের মা তখন আর-একটা ভেজা তোয়ালেতে দীপকের মুখ হাত পরম যত্নে মুছিয়ে দিচ্ছেন। দীপক পাথরের মূর্তির মতো সোজা হয়ে বসে। তার চোখ অনিমেষের ওপর। হঠাৎ অনিমেষের মনে একটা নতুন চিন্তা এল। দীপক অভিনয় করছে না তো। সে সব বুঝে না-বোঝার ভান করে নেই তো! কথাটা মাথায় আসতেই শরীর শিরশির করে উঠল তার। এবং কিছু না-ভেবেই সে একটু ঝুঁকে দীপককে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বলবে?’
ব্যাপারটা এত আকস্মিক যে দীপকের ঠাকুমা চমকে উঠলেন, দীপকের মায়ের হাত থেমে গেল। সবাই দীপকের মুখের দিকে তাকিয়ে অথচ সেখানে কোনও প্রতিক্রিয়া ঘটল না। দীপক চোখ সরাল না, দৃষ্টি পালটাল না, শুধু ঠোঁট কেঁপে উঠল বলে অনিমেষের মনে হল। অনিমেষ ধীরে ধীরে ইজিচেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিল।
দীপকের ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হঠাৎ ওকে জিজ্ঞাসা করলে কেন?’
অনিমেষ বলল, ‘আমার যেন মনে হল ও সব বুঝতে পারছে। কিন্তু না, আমার মনের ভুল।’
দীপকের মা বললেন, ‘আমাদের পারিবারিক ডাক্তার একটু বাদেই আসবেন। ওঁর সঙ্গে আলোচনা করে চিকিৎসা শুরু করব। তোমার কথাও ওঁকে ফোনে বললাম। তোমাকেও দেখবেন উনি।’
‘কী লাভ হবে?’
‘এত হতাশ হচ্ছ কেন? বলা যায় না, অপারেশন করে ওরা তোমাকে হয়তো স্বাভাবিক করে দিতে পারে।’
‘না, আমি জানি তা কখনও হবে না।’ কথাটা বলতে বলতে অনিমেষ ডান হাত দিয়ে নিজের পা ঠিক করতে গেল। বেকায়দায় পড়ায় সেখানে ব্যথা লাগছে। তলপেটের নীচের শরীরটা তার ইচ্ছেমতো চলে না। বসবার সময় যদি সেগুলো বেকায়দায় থাকে তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। ইজিচেয়ারে বসে থাকার দরুন বেশ কষ্ট হল পা দুটোকে স্বাভাবিক করতে। সে চাইছিল না দীপকের মা ব্যাপারটা বুঝে তাকে সাহায্য করেন।
এইসময় মেয়েটি খাবারের প্লেট নিয়ে ফিরে এল। টোস্ট, ডিমসেদ্ধ আর দুটো সন্দেশ। অনিমেষের সামনে একটি টিপয় এগিয়ে দিয়ে তাতে প্লেট রেখে মেয়েটি দীপকের খাবার এগিয়ে দিল। তারপর নিচু গলায় দীপকের মাকে কিছু জানাল সে। কথাটা শুনে তিনি চকিতে দীপককে দেখলেন। তারপর মেয়েটিকে বললেন, ‘তুই যা আমি আসছি।’
অনিমেষ খাবারগুলোর দিকে তাকাল। অনেক অনেক বছর বাদে কেউ তাকে ভদ্রভাবে খাবার খেতে দিল। দীপকের ঠাকুমা তখন টোস্ট নিয়ে দীপকের মুখের সামনে ধরেছেন। সে মুখ খুলছে না, একদৃষ্টিতে অনিমেষকে তখন থেকেই দেখে যাচ্ছে। অনেক অনুনয়, পিঠে হাত বোলানো ব্যর্থ হল। সে মুখ খোলার কথা মাথায় যেন আনতেই পারছে না। অথচ দীপকের মা আগে জেলে গিয়ে ছেলেকে খাইয়ে আসতেন নিজের হাতে। অনিমেষের মনে হল ঠাকুমার বদলে মা খাওয়ালে দীপক সহজেই খেত। কিন্তু কথাটা বলতে গিয়েই সে চুপ করে গেল। বৃদ্ধা এতে যে আঘাত পাবেন তাতে সে নিঃসন্দেহ।
দীপকের মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি হাত গুটিয়ে আছ কেন, খাও।’ কথাটা শুনে অনিমেষ প্লেট থেকে একটা টোস্ট তুলে দীপকের চোখে চোখ রাখল। তারপর সেটা মুখের কাছে ধরে সামান্য হাঁ করতেই দীপকও যেন একই ভঙ্গিতে মুখ খুলল। ওর ঠাকুমা সেই সুযোগে খাবার তার মুখে গুঁজে দিতে সে অনিমেষের অনুকরণে চিবোতে লাগল।
দীপকের মা বললেন, ‘তোমার খুব বাধ্য হয়েছে দেখছি খোকা।’ ঠাকুমা বললেন, ‘হ্যাঁ, কী আশ্চর্য। দেখো, এখন কী সুন্দর খাচ্ছে খোকা।’
দীপকের মা মাথা নেড়ে মেয়েটির সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ঠাকুমা তখন নানান আদুরে সংলাপ বলে নাতিকে খাইয়ে চলেছেন। অনিমেষের অস্তিত্ব এই মুহূর্তে আর যেন ওঁর স্মরণে নেই। অনিমেষের খিদেও পেয়েছিল। প্লেট শেষ করে সে পুরো গ্লাস জল খেয়ে নিল। এইসময় দীপকের মা ফিরে এলেন। উনি অনিমেষকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।’
‘আমার সঙ্গে?’ অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল।
মাথা নাড়লেন মহিলা।
দীপকের মুখে শেষ খাবারটুকু গুঁজে দিয়ে ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও এখানে আছে তা লোকে জানল কী করে?’
‘জেলখানায় গেলেই তো জানা যায়।’ দীপকের মা জানালেন।
অনিমেষ সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল, ‘নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। মাধবীলতা।’
ঠাকুমা বললেন, ‘মেয়েছেলে! চেনো নাকি তুমি?’
অনিমেষ তখন নিস্পন্দ। মাধবীলতা এসেছে তার কাছে। বুকের মধ্যে একটা রিমঝিমে অনুভূতি শুরু হয়ে গেল তার। চট করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কোনওরকমে দু’হাতে টাল সামলাল সে। আর তখনই অদ্ভুত অবসাদ অনিমেষকে আচ্ছন্ন করল। যে কারণে সে এতগুলো বছর মাধবীলতার সঙ্গে দেখা করেনি, নিজের এই পঙ্গু শরীরটা নিয়ে মাধবীলতার ভার বাড়াতে চায়নি ঠিক সেই কারণেই এখন সে অস্থির হল। আজ তার মুক্তির দিন এ-কথা মাধবীলতা জানতে পারল কী করে? অবশ্য তার খেয়ালে ছিল না জেলখানায় গেলেই যে কেউ তার বর্তমান ঠিকানা পেয়ে যেতে পারে। ভদ্রমহিলা তো সবাইকে জানিয়েই অনিমেষকে এখানে নিয়ে এসেছেন। মাধবীলতা এখন তার অপেক্ষায় বাইরে অপেক্ষা করছে এবং তাদের মধ্যে জেলখানার লোহার গরাদ নেই, তবু অনিমেষের সংকোচ হচ্ছিল।
ঠাকুমা প্রশ্নটা আবার করতেই অনিমেষের চমক ভাঙল। সে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। দীপকের মা বললেন, ‘আমি কি মেয়েটিকে এখানে আসতে বলব?’
অনিমেষ নিচু গলায় বলল, ‘আমার পক্ষে তো—।’
‘না না ঠিক আছে। তুমি বসে থাকো। আমি ওকে এখানে আসতে বলছি। তোমার আত্মীয় না বন্ধু?’
‘আত্মীয়।’ অনিমেষ দ্রুত জবাব দিল।
‘ও কি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে?’ ঠাকুমার গলার স্বর এখন অন্যরকম। একটু সতর্ক সন্দেহ সেখানে।
‘আমি জানি না।’
‘যেই জেল থেকে ছেড়ে দিল অমনি সব এসে জুটেছে। এতদিন যখন জেলে কষ্ট পাচ্ছিলে তখন এরা দেখতে যেত?’ ঠাকুমা ফোঁস করে উঠলেন।
দীপকের মা বললেন, ‘না, কেউ ওর সঙ্গে দেখা করেনি বলেই তো জেলে শুনেছি। হয়তো আজ জেলে গিয়ে খবর পেয়ে এখানে এসেছে।’
ঠাকুমা দীপককে জড়িয়ে ধরলেন, ‘যেই আসুক বলে দাও ও এখানেই থাকবে। ও কাছে না-থাকলে আমাদের খোকা কখনও ভাল হবে না। অনিমেষকে আমরা ছাড়তে পারব না বলে দিচ্ছি।’
দীপকের মা খানিক ইতস্তত করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। অনিমেষ দেখল শুধু দীপক নয়, তার ঠাকুমাও এখন তার মুখ থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। সে আবার ইজিচেয়ারে হেলান দিল। মাধবীলতাকে কী কথা বলবে সে? এই ক’বছরে ওর কোনও খবর সে পায়নি। এখনও কি সেই হস্টেলে রয়েছে মাধবীলতা। একথা নিশ্চিত মাধবীলতা বাড়িতে ফিরে যায়নি কিংবা আর কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেনি। এখনও যদি ও হস্টেলেই থেকে থাকে তা হলে সেখানে অনিমেষের যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এক ধরনের গোপন লজ্জা অনিমেষকে আচ্ছন্ন করল। অনেকদিন দেখা হয়নি, মাধবীলতার চেহারা এখন কেমন হয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরাধবোধ তাকে বিদ্ধ করল। একটি মেয়ে সারাজীবন তার জন্যে সবকিছু উপেক্ষা করল অথচ বিনিময়ে নিজের পঙ্গুত্ব ছাড়া সে কিছুই দিতে পারবে না তাকে। অনিমেষ দু’হাতে মুখ ঢাকল।
পায়ের শব্দ হচ্ছিল। দীপকের মায়ের গলা শোনা গেল, ‘আসুন।’
অনিমেষ অনেক চেষ্টায় শক্তি সঞ্চয় করে মুখ তুলল, দরজায় মাধবীলতা দাঁড়িয়ে। তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ, নীচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে আছে সে। সমস্ত শরীরে যে এখন তিরতিরে কাঁপুনি এসেছে তা অনিমেষের চোখ এড়াল না। অনিমেষ অবাক হয়ে মাধবীলতাকে দেখল। এ কাকে দেখছে সে? যেমন করে পাহাড়-ভাঙা পাথরের চাঁই নদীর জলে ঘষা খেয়ে মসৃণ চেহারা নিয়ে নেয় কিংবা সমুদ্রের উদ্দাম ঝড়ের মোকাবিলা করে জাহাজের রিক্ত অবস্থা হয় তেমনি একটি চেহারা নিয়ে মাধবীলতা এখন দরজায় দাঁড়িয়ে। অল্পবয়সি পেলবতার বদলে একটা রুক্ষ হাওয়া তার সর্বাঙ্গে। ওই ক’বছরে সময় যেন অনেকগুলো বয়সের ভার তার শরীরে চাপিয়ে দিয়েছে। চোখের কোলে কালি, হাত শীর্ণ, শরীরে একটা আটপৌরে শাড়ি দীনতার চিহ্ন হয়ে জড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ছাড়া আর কিছু অলংকার মাধবীলতার নেই। এত দূর থেকেও যেন অনিমেষ মাধবীলতার বুকের নিশ্বাস অনুভব করল। সে দেখল খুব দ্রুত মাধবীলতা নিজেকে সামলে নিচ্ছে। অনিমেষ প্রাণপণে নিজের চোখ দুটোকে শুকনো রাখার চেষ্টা করছিল।
মাধবীলতা ধীর পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কখন ছাড়ল?’
‘সকালে।’ অনিমেষের নিজের গলা অচেনা মনে হল।
‘আজকে তো কথা ছিল না। হঠাৎ কী মনে হতে গিয়েই শুনতে পেলাম।—’
‘হ্যাঁ, হঠাৎই হয়ে গেল।’
অনিমেষ দেখল মাধবীলতার চোখ তার পায়ের দিকে। সে দৃষ্টি ফেরাতে অন্য প্রসঙ্গে এল, ‘এঁরা আমাকে নিয়ে এসেছেন। খুব আদর যত্ন করেছেন।’
ঠাকুমা বললেন, ‘আমার এই নাতিটি অনিমেষের সঙ্গে এক ঘরে ছিল। পুলিশ তো ওর সব কেড়ে নিয়েছে। কথা বলতে পারে না, কোনও অনুভূতি নেই। শুধু অনিমেষের ওপর একটা টান আছে।’
মাধবীলতা ঘাড় ঘুরিয়ে দীপককে দেখল। দীপক তখনও অনিমেষের দিকে তাকিয়ে আছে। দীপকের মা বললেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো।’
একটু অস্বস্তি নিয়েই মাধবীলতা অনিমেষের পাশের চেয়ারে বসল। অনিমেষ আড়চোখে দেখল মাধবীলতা সেই খেটে খাওয়া মেয়েদের মতো, যাদের কাছে সামান্য প্রসাধন বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।
ঠাকুমা বললেন, ‘তুমি ওকে জেলে দেখতে যেতে?’
মাধবীলতা মাথা নিচু করল, ‘খবর নিতে যেতাম।’
‘দেখা করতে না?’
‘দেখা হত না।’
‘কেন? বউমাকে তো খোকার সঙ্গে দেখা করতে দিত। তোমাকে দিত না কেন?’
প্রশ্নটা শুনে মাধবীলতা একটু দ্বিধা নিয়েই বলল, ‘হয়তো এক-এক জনের বেলায় এক-এক রকম নিয়ম।’
অনিমেষ দেখছিল মাধবীলতাকে। ওর কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছে, মুখে খসখসে ভাব। খুব অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক দেখাচ্ছে ওকে। এখন পর্যন্ত মাধবীলতা তার শরীর নিয়ে একটাও প্রশ্ন করেনি। মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে তার পায়ের দিকে কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। এইসময় চা নিয়ে এল মেয়েটা। দীপকের মা নিজের কাপটি মাধবীলতার দিকে এগিয়ে দিতে সে মাথা নাড়ল, ‘না, আমি খাব না।’
‘কেন?’
‘আমি সকালে এক কাপ খাই, বেশি খেলে শরীর খারাপ লাগে।’
‘ও।’
অনিমেষ একটু অবাক হল। সেই মাধবীলতা এই কথা বলছে? রেস্টুরেন্টে বসে ওরা একসময় আধঘণ্টা পরপর চা নিত, এর মধ্যেই কেমন বয়স্ক মানুষের মতো কথা বলছে মাধবীলতা।
চা খেতে খেতে দীপকের মা বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না, তুমি বলছি তোমাকে।’
মাধবীলতা একটু শক্ত হল, তারপর বলল, ‘বলুন।’
‘তুমি কি অনিমেষকে নিয়ে যেতে এসেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু অনিমেষ প্রতিবন্ধীদের একটা আশ্রমে যেতে চাইছিল। সত্যি বলতে কী সাত দিন এখানে থাকতে ওকে জোর করে রাজি করিয়েছি।’
মাধবীলতা দাঁতে ঠোঁট চাপল। কথা বলল না।
‘তোমার কাছে যাওয়ার কথা ও কিন্তু বলেনি।’
মাধবীলতা স্পষ্ট গলায় বলল, ‘এটা আমাদের ব্যাপার।’
‘ও!’ দীপকের মা একটু অবাক হলেন যেন, ‘আমি অবশ্য তোমাদের সম্পর্কটা কী তা জানি না।’
মাধবীলতা চকিতে অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর উজ্জ্বল মুখে দীপকের মাকে বলল, ‘আমি ওকে নিয়ে যেতেই এসেছি।’
দীপকের ঠাকুমা উষ্ণ গলায় বললেন, ‘আমি বাবা মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ও কাছে থাকলে খোকার উন্নতি হবে। আমরা খোকাকে যেমন চিকিৎসা করাব অনিমেষকেও তেমনি সেবাযত্ন করব। ভদ্রতা না-করেই বলছি ওর থাকাটা আমাদের প্রয়োজনে লাগবে। তুমি ওর কে হও তাই স্পষ্ট করে বলতে পারছ না, তোমার সঙ্গে ওকে যেতে দেব কেন?’
মাধবীলতা অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল। তারপর সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে না?’
অনিমেষ এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে! এই মেয়েকে সে কখনও সুখের স্বপ্ন দেখাতে পারেনি। জীবনের বাকি দিনগুলোতে আরও দুঃখের বোঝা চাপাতে চায়নি ওর ওপর। কিন্তু মাধবীলতার মুখের দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
সে দীপকের মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে চাইল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, দীপককে ভাল করে চিকিৎসা করালে ও নিশ্চয়ই সেরে যাবে।’
‘তুমি তা হলে যেতে চাইছ?’
‘হ্যাঁ।’
দু’জন বয়স্কা মহিলার মুখ একসঙ্গে থমথমে হয়ে গেল। এবার অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কোথায় যাব?’
‘আমাদের বাসায়। বেলগাছিয়া।’
‘তুমি জানো নিশ্চয়ই আমি হাঁটতে পারি না। জীবনে কখনও হাঁটতে পারব না।’
‘জানি, জেনেই এসেছি।’
‘তুমি একা বাসা নিলে কেন? কবে থেকে নিলে?’
‘নিতে হল।’
মাধবীলতার এইরকম কথা বলার ভঙ্গিতে অনিমেষ বুঝল আর প্রশ্ন করা উচিত হবে না। অন্তত দু’জন বাইরের মানুষের সামনে মাধবীলতা বিশদ হতে চাইছে না।
অনিমেষ দীপকের মাকে বলল, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না।’
‘না, মনে করব কেন? শুধু জানতে ইচ্ছে করছে তোমাদের সম্পর্কটা কী?’
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে হাসল।
ভদ্রমহিলা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের কি বিয়ে হয়ে গেছে?’
প্রশ্নটা এতই আকস্মিক যে অনিমেষ জবাব দেওয়ার আগেই মাধবীলতা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘ওমা, তাই বুঝি।’ দীপকের ঠাকুমা যেন চমকে উঠলেন, ‘তুমি তো এত বছর জেলেই ছিলে, বিয়ে করলে কখন?’
‘জেলে যাওয়ার আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল।’ মাধবীলতা জবাব দিল। দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বউমা। যদি এরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকে তা হলে অনিমেষ জেল থেকে বেরিয়ে নিজেদের বাড়িতে যাবে না কেন? আশ্রমে যেতে চাইছিল? তুমি কিছু বুঝতে পারছ?’ দীপকের ঠাকুমা এখনও অসহিষ্ণু।
দীপকের মা হেসে বললেন, ‘মান অভিমানের ব্যাপার। আমাদের বেশি বুঝতে চাওয়া ঠিক নয়। তবে তুমি কিন্তু ওকে ভাল ডাক্তার দেখিয়ো।’
মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল। ওর ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে তত স্বস্তি পাবে।
ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার বাড়িতে আর কে কে আছেন?’
‘কেন?’
‘এরকম মানুষের চিকিৎসার খরচ তো কম নয়, তাই বলছি।’
‘আমি আমার সাধ্যমতন নিশ্চয়ই করব।’
‘তুমি কি চাকরি করো?’
‘হ্যাঁ, আমি স্কুলে পড়াই। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আপনারা ওকে এখানে যত্ন করে এনেছিলেন। এবার আমি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি।’ মাধবীলতা বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দীপকের মা বললেন, ‘আরে ট্যাক্সি ডাকতে যাবে কেন? আমার গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে অনিমেষকে। তুমি বসো আমি ড্রাইভারকে খবর দিচ্ছি।’
‘কী দরকার। এটুকু আমাকে করতে দিন।’ মাধবীলতা শক্ত গলায় বলল।
দীপকের মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী দেখলেন তিনিই জানেন, এবার গলা নামিয়ে বললেন, ‘বেশ, গাড়ি যদি না-নিতে চাও নিয়ো না, আমি ওদের কাউকে ট্যাক্সি ডেকে দিতে বলছি। এ পাড়ায় চট করে ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল। তাতে নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি হবে না।’
মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল। দীপকের মা চলে গেলে সে আবার অনিমেষের সামনে এসে বসল, ‘তোমার সঙ্গে কোনও জিনিসপত্র নেই, না?’
অনিমেষ বলল, ‘আমি তো একদম খালি হাতে জেলে গিয়েছিলাম। বেরুবার সময় ওরা হাত ভরে দেবে কেন?’
মাধবীলতা বলল, ‘তোমার হস্টেল থেকে পাওয়া সেই সুটকেস এখনও আমার কাছে আছে। জামাগুলো ছোট হবে কিনা জানি না।’
একটু বাদেই দীপকের মা এসে জানালেন ট্যাক্সি এসে গেছে। বললেন, ‘তোমাদের ঠিকানাটা রেখে যাও, যদি কখনও দরকার পড়ে—।’
মাধবীলতা একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে টেবিলের ওপর রাখল। কাগজ এবং ডটপেন তার ব্যাগেই ছিল। অনিমেষ ঠাকুমার মুখের দিকে তাকাল। তাঁর মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। দীপক এখনও তেমনি তাকিয়ে আছে। দীপকের মা সঙ্গে লোক নিয়ে এসেছিলেন যারা তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে এখানে এনেছিল। তারা সাবধানে অনিমেষকে ইজিচেয়ার থেকে আর-একটা সাধারণ চেয়ারে বসাল। তারপর সেই চেয়ারটি নিয়ে হাঁটা শুরু করতেই অনিমেষ ওদের বলল, ‘একটু দাঁড়াও ভাই, আমাকে একটু দীপকের কাছে নিয়ে চলো।’
লোকগুলো অনিমেষকে চেয়ার-সমেত দীপকের সামনে নিয়ে এলে সে বলল, ‘চললাম ভাই।’ বলে ডান হাতটা আলতো করে দীপকের কাঁধে রাখল। হঠাৎ একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। দীপকের দুটো হাত সচল হয়ে অনিমেষের হাত জড়িয়ে ধরল। তার চোখ বিস্ফারিত, একটা গোঙানি উঠছে মুখ থেকে। অনিমেষের মনে হল তার হাত ভেঙে যাবে, দীপকের মুঠোয় এত শক্তি কল্পনা করতে পারেনি সে। প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল অনিমেষ কিন্তু দীপক একটুও মুঠো আলগা করছে না। ওর মা ছুটে এলেন। লোকগুলো চেয়ার মাটিতে না-নামালে অনিমেষ নিশ্চয়ই পড়ে যেত। সকলে মিলে অনেক চেষ্টার পর দীপকের হাত ছাড়ানো গেল। ওর মা আর ঠাকুমা তখন ওকে ধরে রেখেছেন। গোঙানিটা এখনও বন্ধ হয়নি। অনিমেষের হাতে তখনও জ্বলুনি হচ্ছিল। সে দীপকের দিকে আর-একবার তাকাতে দেখল বেচারার কশ বেয়ে লালা গড়াচ্ছে। বীভৎস দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।
ঠাকুমা তখন উত্তেজিত গলায় বলছেন, ‘ডাক্তারবাবুকে ডাকো, ওর বোধহয় জ্ঞান ফিরে আসছে, ও বউমা, যাও।’
একটু বাদেই ছেলেটা শান্ত হয়ে এল। দীপকের মা তাকে একটা ডিভানে শুইয়ে দিতেই সে চোখ বন্ধ করল। বোঝা যাচ্ছিল খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে দীপক। এত বছর এক ঘরে বাস করেও একদিনের জন্যেও এরকম ব্যবহার করতে ওকে দেখেনি অনিমেষ। সে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
মাধবীলতা পাশ থেকে চাপা গলায় বলল, ‘এবার চলো।’
লোকগুলো চেয়ার তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। দীপকের মা এবং ঠাকুমা ঘরে রয়ে গেলেন।
অনেক কষ্টে অনিমেষকে ওরা ট্যাক্সিতে তুলে দিল। দু’হাতে ভর করে অনিমেষ জানলার কাছে জায়গা নিল। মাধবীলতা ট্যাক্সিতে উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার অসুবিধে হচ্ছে না তো!’
দীপকের ব্যবহারে অনিমেষ তখনও অন্যমনস্ক ছিল। বলল, ‘কেন?’
মাধবীলতা ব্যাপারটা ভুল বুঝল। তার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে একটু অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি!’
অনিমেষ হেসে ফেলল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না।’
মাধবীলতা ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ফেলল, ‘বেলগাছিয়ায় চলুন।’