৩৭. মাধবীলতাকে চিঠি

সাঁইত্রিশ

মাধবীলতা,

তোমার নাম লিখতে গিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। আদ্যক্ষরটি তোমার মধ্যে মিলেমিশে এমন জড়িয়ে আছে, কী জানি তাই তোমাকে এত ভাল লাগে হয়তো! তোমাকে এই প্রথম চিঠি লিখলাম। লিখতে গিয়ে টের পেলাম প্রতিটি শব্দ লেখার সময় আমি তোমার স্পর্শ পাচ্ছি।

আমি তোমাকে চিঠি লিখছি স্বর্গছেঁড়া চা-বাগান থেকে আট মাইল দূরে একটা গ্রামে বসে। অবশ্য গ্রাম বললেও বোধহয় জায়গাটাকে বেশি সম্মান দেওয়া হবে। স্বর্গছেঁড়ার এত কাছে আছি কিন্তু এখনও ছোটমার সঙ্গে দেখা করার সময় পাইনি। কথাটা পড়লেই তোমার ভ্রূ কুঁচকে যাবে জানি, কিন্তু বিশ্বাস করো, এখানে এসে নিশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছি না। তবে দেখা করার সময় না-পেলেও তাঁর দেখা আমি পেয়েছি। সেদিন গাড়িতে ময়নাগুড়ি থেকে ফিরছিলাম। ডুডুয়া নদী পার হয়ে আংরাভাসার ওপর দিয়ে রাস্তাটা বাঁক নিয়ে যখন চা-বাগানের শরীর জড়িয়ে আমার বুকের মধ্যে মিশে থাকা কোয়ার্টারগুলোর সামনে দিয়ে চলে আসছে তখন দেখলাম ছোটমা আমাদের সেই বাড়িটার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। এক পলক মাত্র, তার মধ্যেই গাড়িটা হুস করে বেরিয়ে এল। দূরত্বটা এমন যে চিৎকার করলেও বোধহয় শোনা যেত না।

এই প্রথম উত্তরবাংলায় এসে নিজের অস্তিত্বকে গোপন রাখতে হেচ্ছ। তবে চারধারে এত সাপের মুখ যে ছোবল আসতে কতক্ষণ! সতর্ক থাকাই মঙ্গল।

এখানে এসে বেশ কিছুদিন রয়েছি। নিজের সম্পর্কে একটা গোপন সত্য আবিষ্কার করেছি। জানো, ছোটবেলায় আমি খুব রোমান্টিক ছিলাম। ভীষণ ভাবপ্রবণ। এই স্বর্গছেঁড়াকে আমি ভীষণ ভালবাসতাম। এর গাছপালা নদী এমনকী বাতাসকেও আমি অনুভব করতাম। মনে আছে প্রথম যখন দাদুর সঙ্গে এই জায়গা ছেড়ে যাই তখন রুমালে স্বর্গছেঁড়ার মাটি বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলাম। জলপাইগুড়ির বাড়ির উঠোনে সেই মাটি রেখে রোজ দেখতাম আর ভাবতাম স্বর্গছেঁড়ায় আছি। কিংবা স্বর্গছেঁড়ার সেই কাঁঠালগাছ, তালগাছ, চা-বাগানের মধ্যে ঘুঘুর ডাক, যা কিনা পৃথিবীর যে-কোনও ঐশ্বর্যের বিনিময়েও ছাড়তে কষ্ট হত, এখানে এসে দেখলাম তারা সবাই একই রকম আছে, ঠিক যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি আমার সেই মনটাকে কিংবা চোখটাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি এখন সেইসব ভাবপ্রবণতার কথা ভেবে হাসি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে জীবনটা বড় দ্রুত পালটে যায়। দৃষ্টিও। আমার সেই আমিটা সম্পর্কে শুধু মমতাই দেখানো যায় কেননা বাস্তবে সে অচল। যে চা-বাগানের গলিতে দুপুর বিকেল চুপচাপ পাখির আওয়াজ শুনে কাটাতে ভাল লাগত সেটা ছিল নিতান্তই অর্থহীন। এখন সেই শূন্যগর্ভ ভাললাগা নয়, কাজের গতি যদি একবার রক্তে মেশে তখন নতুন চোখ খুলে যায়, কিংবা পুরনো চোখ অন্ধ হয়ে যায়। না-হলে কাজ হয় না।

জানো, আমি আর-একটা জিনিস ক্রমশ টের পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি খুব নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছি। কোনও কিছুই আমাকে তেমন স্পর্শ করে না। যেমন ধরো, এই স্বর্গছেঁড়া, এককালে জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে বড় বলে ভাবালুতায় ভুগতাম তা আর নেই। এতবার ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করেছি কিন্তু বুকের মধ্যে কোনও কাঁপুনি হয় না। চা-বাগানের গলিকে গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে নিরাপদ জায়গা বলে ভাবছি। আংরাভাসা নদীর ধার দিয়ে যে খুঁটিমারির জঙ্গল লাল সূর্যের বলটাকে মাথায় নিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকে, তার মতো গোপন শেল্টার আর কিছু নেই। মিটিং বলো, গোপন গেরিলা ট্রেনিং বলো এই জঙ্গল মায়ের মতো আশ্রয় দেবে।

ছোটমা কিংবা আমার বাবা শ্রীযুক্ত মহীতোষ মিত্র মাত্র কয়েক মাইল দূরে আছেন। দশ মিনিটেই পৌঁছে যেতে পারি। পুলিশ আমার অস্তিত্ব জেনে যেতে পারে এই আশঙ্কার কথা ছেড়ে দিলেও দেখা করতেই হবে এমন টান বোধ করি না। খুব খারাপ শোনাচ্ছে কথাটা কিন্তু সত্যি কথা এটাই। ছোটমা কিংবা বাবা তো সে অর্থে আমার বাল্যকালে দূরের মানুষ ছিলেন। জলপাইগুড়ির শহর থেকে আমার বর্তমান ডেরার অবস্থান ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই। কই, একদিনও তো দাদু ও পিসিমাকে দেখতে যাবার কথা আমার মনে পড়ল না। এই দুটি মানুষ তো আমার এই শরীরটাকে তিলতিল করে বড় হতে সাহায্য করেছেন। এইসব আত্মীয়স্বজন, চেনা জায়গা কিংবা তার মতো অন্তরঙ্গ ছবি সম্পর্কে অদ্ভুত উদাসীনতা আজকাল আমাকে নির্লিপ্ত করেছে।

মাধবীলতা, কথাটা কি তোমার সম্পর্কেও খাটে না? তুমি আমাকে ভালবেসেছ। আমি জানি তুমি কতখানি আন্তরিক। এই আমার জন্যেই তুমি একটানে সমস্ত পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছ, হস্টেলে রয়েছ। কিন্তু কী আশায়? পৃথিবীর যে-কোনও যুবতীর মতো তোমার বাসনা হওয়া উচিত একটি সাজানো সুন্দর গৃহের। আমাকে নিয়ে। কিন্তু প্রতিটি দিন আসছে আর আমি সেই গৃহ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছি। তোমাকে ভালবেসেছি অথচ তোমাকে শান্তি দেবার বদলে অথই উদ্বেগে রেখে এসেছি। কাউকে ভালবাসলে এভাবে দূরে চলে যাওয়া যায়? তা হলে ভালবাসতে গেলামই বা কেন?

এইসব ভেবেচিন্তে মনে হয় আমি বোধহয় এখন স্বার্থপর হয়ে গেছি। স্ব অর্থে পর। জীবন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চেহারা নিয়েছে। আর এত বুঝেও এ থেকে বেরিয়ে আসার অভ্যেসটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

ভীষণ একা লাগছিল, তোমাকে চিঠি লিখলাম তাই। এত বড় চিঠি কখনও লিখিনি। আমার সবসময় ভয় যে, আমাকে ভালবেসেছ, শুধু এই কারণে তুমি আরও বড় বিপদে না পড়ো। হয়তো সত্যি যদি পড়ো তখনও আমি কিছুই করতে পারব না। সময় আমাদের সবকটা আঙুল খইয়ে দিয়েছে। আমরা কারও হাত জড়িয়ে ধরতে পারি না, শুধু ঠেকাই মাত্র।

আবার কখন লিখব জানি না। যদি বেঁচে থাকি তা হলে বর্ধমান স্টেশনে দেখা করব পৌষমেলার দিন। যদি দেখো নির্দিষ্ট সময়ে আমি এলাম না তা হলে তুমি কখনও বোলপুরে যাবে না।

জানি, নিজের নিরাপত্তার জন্যেই এত বিশদভাবে লেখা আমার অন্যায় হল। হয়তো নিয়ম ভাঙলাম। এবং জেনেশুনেই।

তাই এই চিঠি জমিয়ে রেখো না।

তোমার অনিমেষ

পুনশ্চ। এখনও তোমার দেওয়া টাকা শেষ হয়নি।

একটানে চিঠিটা শেষ করল অনিমেষ। হাত টনটন করছিল। এখন রাত গভীর। শুধু টি-উ-প টি-উ-প একটি শব্দ কোনও পাখির গলায় সমানে বেজে যাচ্ছে। চিঠিটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখতে না-রাখতেই দরজায় শব্দ হল। ভেজানো দরজা খুলে একটি কৃষ্ণকায় যুবক ঘরে ঢুকে পরিষ্কার হাসল। লণ্ঠনের আলোয় তার চকচকে দাঁত দেখতে পেল অনিমেষ। যুবকটির নাম সিরিল ওঁরাও। শুকনা থেকে আসার সময় সেই অবাঙালি ভদ্রলোকের পরিচয়ে অনিমেষ এর সন্ধান পেয়েছে। আপাতত এরই আশ্রয়ে। অত্যন্ত কাজের ছেলে। সিরিল বলল, ‘চলুন।’

অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এল। খুব ঠান্ডা পড়েছে। বারীনকে আলোয়ান ফেরত দেওয়া হয়নি কিন্তু তাতেও শীত মানছে না। সোয়েটার তলায় আছে। অনিমেষ দেখল আশেপাশে কোথাও আলো নেই। বাইরের ঘরের দেওয়ালে দুটো সাইকেল হেলান দিয়ে রয়েছে। সাইকেলে কাঁচা রাস্তা মিনিট তিনেক গেলেই ফুরিয়ে গেল। খুঁটিমারির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সুন্দর পিচের রাস্তা যেটা নাথুয়া থেকে এসেছে সেখানে সাইকেল চালানো খুব স্বচ্ছন্দের। রাস্তাটা একটু ঢালু, চাকা গড়গড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। আর এই গতির জন্যেই হাওয়ার কামড়ে কাঁপুনি আসছিল শরীরে। দাঁতে দাঁত ধরে রাখতে পারছিল না অনিমেষ। রাত্তিরের জঙ্গলে একধরনের অচেনা শব্দ হয়। ওরা দু’জনে নিঃশব্দে সেই শব্দ শুনতে শুনতে প্যাডেল ঘোরাচ্ছিল। হঠাৎ সিরিল আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিমেষ এগিয়ে এসেছিল কিছুটা, ওকে দাঁড়াতে দেখে অবাক হয়ে বেশ কিছুটা দূরে এসে সাইকেল থামাল। ততক্ষণে সিরিল তার কাছে চলে এসেছে। তারার আলোয় ওর মুখটাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। চাপা গলায় সে বলল, ‘সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না।’

অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে সামনের পথটাকে দেখল। রাত্রেরও নিজস্ব একটা আলো থাকে। চাঁদ না-থাকলে সেই আলো আরও মোহিনী হয়। অনিমেষ দেখল পথটা ওপাশের জঙ্গলের আড়ালে চলে গেছে কিন্তু কোনও বিপদ রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে না। সিরিল নিচু গলায় বলল, ‘হাতি বেরিয়েছে।’

‘হাতি?’

‘হ্যাঁ। কিছুদিন হল ভুটান থেকে একদল এই অঞ্চলে নেমে এসেছে। অত্যন্ত মারকুটে এই দলটা। মনে হচ্ছে সামনের মেছুয়া পুলের মুখটায় ওরা রয়েছে।’

‘কী করে বুঝলেন?’ অনিমেষের কাছে পুরো ব্যাপারটাই কেমন ভৌতিক বলে মনে হচ্ছিল। চোখে দেখা যাচ্ছে না, এমনকী কোনও শব্দও নেই।

‘ওই দিকে তাকান।’ সিরিল আঙুল তুলে দেখাল। সদ্য ত্যাগ করা বিষ্ঠা রয়েছে রাস্তার একপাশে। তার আয়তন এবং পরিমাণ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই পথ দিয়ে হাতি গেছে। ‘আমরা আর একটু হলে ওদের সামনে গিয়ে পড়তাম। তা হলে আর দেখতে হত না। খুব জোর বেঁচে গেছি।’

‘তা হলে যাব কীভাবে! আর কোনও রাস্তা আছে?’

‘আছে। হাতি বেরিয়েছে বলেই সেই রাস্তায় যাওয়া যায়। তার আগে চলুন সাবধানে গিয়ে সন্দেহটাকে মিটিয়ে আসি।’ সিরিলের সঙ্গে খুব আস্তে সাইকেল চালাতে লাগল অনিমেষ। যে-কোনও মুহূর্তে দিক পরিবর্তনের জন্যে দুইজনেই তৈরি। রাস্তার বাঁকে এসে ওরা আরও ধীর হল। তারপরই দু’জনে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল।

সামনেই মেছুয়া পুল। পুলটার গায়ে ছোট ছোট কালো টিলা নড়ছে। অন্তত গোটা কুড়ি হবে। অনিমেষের মনে হল চাপ চাপ অন্ধকার রাস্তাটাকে ঢেকে দিয়েছে। নিঃশব্দে সরে এল ওরা। একটু পিছু হটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। জিপ যাওয়া-আসার জন্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে এই কাঁচা পথগুলো তৈরি করা হেয়ছে। দু’পাশে ঘন জঙ্গলের গায়ের গন্ধ টের পাচ্ছিল অনিমেষ। অবিরাম শিশির পড়ছে এখানে। সিরিল বলল, ‘অন্য সময় হলে ভয় পেতাম এই রাস্তায় যেতে। কিন্তু হাতি বেরিয়েছে যখন তখন মাইল দুয়েকের মধ্যে কোনও বন্যজন্তু থাকবে না। একটু ঘুর হবে তবু এ ছাড়া উপায় কী?’

‘বন্যজন্তু! এখানে এখনও বাঘ আছে নাকি?’

‘মাঝে মাঝে আসে যায়। কখন থাকে বলা যায় না।’

অনিমেষ প্রায় আধঘণ্টা প্যাডেল ঘুরিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। সামনে ধানখেত। সাইকেল চালানো যাবে না, ওরা হাতে করে হেঁটে এল। তারপরেই নদী। মেছুয়াপুলের তলা দিয়ে যেটা বয়ে এসেছে সেটা এখানে বেশ চওড়া। সেদিকে তাকিয়ে সিরিল বলল, ‘এক কাজ করুন, আপনি এখানে থাকুন, আমি ওঁকে ডেকে নিয়ে আসছি।’ সাইকেল মাটিতে রেখে সে প্যান্ট গোটাচ্ছিল।

অনিমেষ বলল, ‘আমার যেতে কোনও অসুবিধে হবে না। চলুন।’

‘না। ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ?’

‘ঝুঁকি? আপনি কি আমাকে খুব বাবু ভাবছেন?’ একটু উষ্ণ হল অনিমেষ।

‘না, না। আমি আপনার কথা বলছি না। দু’জনে যদি যাই তা হলে এসে হয়তো দেখব এই সাইকেল দুটোই নেই। কিছু তো বিশ্বাস নেই। যত রাতই হোক কেউ হয়তো কোনও কারণে বাইরে এসে দেখল লোকজন নেই আর এই দুটো পড়ে আছে, সে কি হাত গুটিয়ে থাকবে?’

‘তা হলে এদের নিয়ে গেলেই হয়!’

‘পারবেন না। স্রোত কীরকম দেখতে পাচ্ছেন? আমি আসছি।’ সিরিল জলে নেমে গেল। স্রোত যে খুব জোরদার তা বোঝা যাচ্ছিল। অনেকবার হোঁচট খেয়ে অনেকটা পিছু হটে ওকে ওপারে উঠতে হল। তারপর প্রায় দৌড়েই মিলিয়ে গেল সে।

মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে হল অনিমেষকে। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা তার। হাত-পা নেড়ে শরীর গরম করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে সমানে। দৃশ্যটা ভাবতেই হাসি পেল। এই নির্জন রাতের ফাঁকা মাঠে একটা লোক পাগলের মতো নাচছে একা একা। কেউ দেখছে না জানলে আমাদের লজ্জাবোধ অনেক কমে যায়।

আবছা অন্ধকারে অনিমেষ ওদের দেখতে পেল। খুব দ্রুত দুটো মানুষ আসছে। ওরা অনেকটা এগিয়ে জলে নেমে স্রোতের টানে টানে নদী পার হয়ে এপারে এল। সাইকেল ছেড়ে অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে দেখল ঠান্ডা জল থেকে উঠে এসে ওরা ঠকঠক করে কাঁপছে। সেই অবস্থায় প্যান্ট ঠিক করতে করতে সিরিল হাসল, ‘বেশি দেরি হয়নি তো?’

‘না, না, ঠিক আছে।’

‘এঁকে আপনি চেনেন?’

অনিমেষ দেখল ওর সঙ্গের মানুষটি মুখ টিপে হাসছেন। বয়স হয়েছে কিন্তু শরীর খুব মজবুত। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ হাত বাড়িয়ে দিল, ‘কেমন আছেন?’

‘চলছে। আমাকে চিনতে পেরেছেন মনে হচ্ছে?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আমি কিন্তু খবরটা পেয়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সন্দেহ ছিল আপনি হয়তো চিনতে পারবেন না। অনেক বছর আগে সামান্য সময়ের জন্য আমাদের দেখা হয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, সেদিন আমরা আত্মরক্ষার জন্যে চা-বাগানের ভেতরে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। কিন্তু সিরিল একবারও আপনার নাম বলেনি।’

‘এটুকু সাসপেন্স রাখা হয়েছিল। দেখছিলাম আপনার স্মৃতিশক্তি কেমন? আপনি এখানে আছেন মহীবাবু জানেন না নিশ্চয়ই।’

‘না।’

জুলিয়েন বললেন, ‘চলুন, এই ঠান্ডায় না-দাঁড়িয়ে কোথাও বসে কথা বলা যাক। ঠান্ডাটা খুব পড়েছে আজ।’

‘এখানে বসার জায়গা আছে?’

‘আছে। আমার সঙ্গে আসুন।’

জুলিয়েনের পেছনে ওরা সাইকেল নিয়ে হাঁটছিল। যেতে যেতে জুলিয়েন বললেন, ‘আপনি এখানে এসেছেন খবর পেয়েছিলাম। কিন্তু দিনদুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে আপনার গোপনীয়তা থাকত না। তাই এই ব্যবস্থা।’

‘আপনি একটু বেশি ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে।’

‘মোটেই না। আমার ওপর ভাল নজর রাখা হয়েছে।’

কথা বলতে বলতে ওরা একটা বসতি এলাকায় চলে এসেছিল। জঙ্গলের পাশে কয়েক ঘর মানুষের অস্থায়ী ডেরা এটা। তারই একটির দরজায় গিয়ে জুলিয়েন টোকা দিলেন। কোনও সাড়া এল না। কয়েকবার নিষ্ফল চেষ্টা করে বলপ্রয়োগ করলেন জুলিয়েন। মাটির ঘর, ছ্যাঁচার বেড়ার দরজা অল্পেই খুলে গেল। জুলিয়েন মদেশিয়াদের ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বুধুয়া আছিস?’

এবার একটি স্ত্রীকণ্ঠ কথা বলল। ঘুম-জড়ানো বিরক্তি। জুলিয়েন নিজের পরিচয় দিতেই একটা ঢিবড়ি জ্বলে উঠল। জুলিয়েন আবার প্রশ্ন করেত জানা গেল বুধুয়া ঘরে নেই। জুলিয়েন ওদের ভেতরে আসতে ইঙ্গিত করলেন। অনিমেষ সাইকেল বাইরে রাখছিল কিন্তু সিরিল তাকে নিষেধ করল। বাইরে থেকে দেখলে যে-কেউ সন্দেহ করবে। অনিমেষ ভেতরে ঢুকে দেখল ঘরটা নেহাত ছোট নয়। বাইরের আকাশের নীচ থেকে এ-ঘরে এসে খুব আরাম লাগল তার। অনিমেষ দেখল এ-ঘরের বাসিন্দাদের অবস্থা অত্যন্ত জীর্ণ। আসবাব বলে কিছু নেই। বাঁশের খাটিয়ার ওপর একটা তেলচিরকুটে বিছানায় নিশ্চয়ই ওই স্ত্রীলোকটি এতক্ষণ শুয়ে ছিল। একটি কালো শিশু এখনও সেখানে ঘুমিয়ে। স্ত্রীলোকটি মধ্যবয়সি এবং বাঁ চোখের ওপর বড় আব আছে। ওদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল সে।

জুলিয়েন বললেন, ‘তুই শুয়ে পড়। আমরা এখানে বসে একটু কথা বলে চলে যাব।’

স্ত্রীলোকটি ঘাড় নেড়ে আবার খাটিয়ায় ফিরে গেল। তারপর সেখান থেকে একটা ময়লা কাপড় তুলে এনে মাটিতে বিছিয়ে দিল।

জুলিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বুধুয়া কি এখন রোজ রাত্রে বের হচ্ছে?’

নীরবে ঘাড় নেড়ে স্ত্রীলোকটি খাটিয়ায় ফিরে যেতেই বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটি বুকের আঁচল সরিয়ে তার মুখে স্তন গুঁজে দিল কোলে তুলে নিয়ে। চোখ সরিয়ে নিতে গিয়ে অনিমেষের খেয়াল হল এই শীতেও ওদের শরীরে কোনও গরম জামাকাপড় নেই।

ওরা তিনজনে কাপড়টার ওপর বসতেই টের পেল মাটি থেকে ঠান্ডা উঠছে। জুলিয়েন বললেন, ‘এই পরিবারটি চা-বাগানের কর্মী ছিল। বুধুয়া লোকটা খুব রগচটা। বছর তিনেক আগে স্ট্রাইকের সময় ম্যানেজারের কুঠিতে ঢিল ছোড়ার অপরাধে ওর চাকরি যায়।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রমাণ করল কী করে?’

‘খুব সহজেই। গুদাম থেকে যখন কাজ করে বের হচ্ছে তখন ওর থলিতে কিছু চা-প্যাকেট ভরে দেওয়া হয়েছিল। বেচারা তা জানত না। গেটে ধরা পড়ে চুরির অপরাধেই চাকরি গেল। আসল রাগটা এখানে অন্যভাবে মেটানো হয়।’

‘ইউনিয়ন থেকে কিছু করা হয়নি?’

‘না। আমরা আজ এই ইউনিয়ন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের জন্যে ওরা ফালতু ঝামেলায় জড়াবে কেন? আর প্রমাণ তো হাতেনাতেই পেয়েছিল। ছ’মাসের মধ্যে ওকে কোয়ার্টার ছেড়ে এখানে চলে আসতে হল। ব্যবস্থা তো দেখতে পাচ্ছেন। কাজকর্ম পাচ্ছে না অথচ পেট মানবে না। রোজ রাত্রে শেষ পর্যন্ত সহজ উপায়টা বেছে নিয়েছে।’

‘মানে?’

‘চুরি। যেদিন ধরা পড়বে এরা ভেসে যাবে।’

‘আপনারা কিছু করছেন না কেন?’

জুলিয়েন বড় বড় চোখ মেলে অনিমেষকে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘আমাদের হাত-পাগুলো খুব ছোট অনিমেষবাবু। আর এরকম বুধুয়া তো সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি ক’জনের জন্যে করতে পারেন?’

এইসময় সিরিল কথা বলল, ‘জুলিয়েন এখন সাসপেনশনে আছে।’

অনিমেষ অবাক হল। এতক্ষণ লোকটির সঙ্গে কথা বলে এই বিপদের একটুও আঁচ পায়নি সে। স্বর্গছেঁড়ার শ্রমিকনেতা জুলিয়েনের সেই চেহারাটা এখন সে স্পষ্ট মনে করতে পারে। কুলিদের বিক্ষোভ থেকে বাঁচতে ছোটমা আর বাবার সঙ্গে সে চা-বাগানের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এই জুলিয়েনের মুখোমুখি হয়েছিল। খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিল সেদিন জুলিয়েন। মিশনারি স্কুলে পড়ে আসা এই মদেশিয়া যুবকটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল সেদিন অনিমেষ। তখন তো সবাই এঁর কথা মানত। আর আজ তো একদম অন্য কথা শুনছে সে।

জুলিয়েন বললেন, ‘কলকাতার খবর বলুন।’

অনিমেষ একটু একটু করে প্রস্তাবিত দেশব্যাপী আন্দোলনের কথা বলল জুলিয়েনকে। এবার সংগ্রাম মুখোমুখি। সৈনিক চাই। ভারতবর্ষের মানুষের মেরুদণ্ডটি ফিরিয়ে আনার জন্য একটা ব্যাপক চেষ্টা করতে হবে। জুলিয়েন বললেন, ‘এসব কথা আমরা জানি অনিমেষবাবু। কিন্তু এখানে অবিলম্বে সংগঠন করা দরকার। আপনারা কবে নাগাদ মুখোমুখি হবার কথা ভাবছেন।’

‘সামনের মাসে বোলপুর থেকে ঘুরে এসে বলতে পারব।’

জুলিয়েন বললেন, ‘ব্যাপারটা এখন আর গোপন নেই। তবে মজার ব্যাপার হল, যে শুনছে সে বিশ্বাস করছে না। পুলিশকে আমার ভয় নেই। কিন্তু সক্রিয় হয়ে কেউ কিছু করলে সব প্রথম বাধা দেবে অন্য পার্টির লোকজন। বিপদটা এখানেই। আমরা যদি সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারতাম তা হলে এক দিনে দেশের বুর্জোয়া ক্যাপিটালিস্টদের সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যেত। কিন্তু তা হওয়ার নয়।’

অনিমেষ বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ থাকা দরকার। কীভাবে হবে?’

জুলিয়েন বললেন, ‘এই ঘরে। এখানে দেখা হওয়া দু’জনের পক্ষেই মঙ্গল।’

অনিমেষ বলল, ‘প্রত্যেকটা চা-বাগানে স্কোয়াড তৈরি করতে হবে। খুব নির্ভরযোগ্য কিছু ছেলেকে ব্যাপারটা বোঝাতে হবে।’

জুলিয়েন বললেন, ‘কী ধরনের অ্যাকশন এখানে করার কথা ভাবছেন?’

‘দেখুন, কৃষকরা জোতদারের কাছ থেকে জিম দখল করবে, এটা করতে তারা স্বভাবতই উত্তেজিত হবে। কিন্তু আমরা শ্রমিকদের বলতে পারি না যে তোমরা চা-বাগান দখল করো। ফ্যাক্টরি দখল করে সাত দিনও তারা চালাতে পারবে না। তাদের ব্যক্তিগতভাবে উত্তেজিত করে কিছু করা যাচ্ছে না। কিন্তু এমন কাজ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ চমকে যায়। প্রত্যেকের অন্ধ বিশ্বাসের ভিত যেন নড়ে যায়। কাজগুলো করতে হবে জনসাধারণের স্বার্থ-বিরোধী মানুষের বিপক্ষে। ফলে পুলিশ যদি অ্যাকশনে নামে তা হলে আমরা সাধারণ মানুষের সমর্থন পাব। একসময় তারা এগিয়ে আসবে, পাশে এসে দাঁড়াবে।’

সিরিল হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘তা হলে পানিরামের গদি লুঠ করলে হয়। শালা রক্তচোষা। এই বাগানের অনেক মানুষ ওর কাছে ধার নিয়ে মাথা বিকিয়ে আছে। সুদ দিতে দিতে সবার মাইনে খতম হয়ে যায়।’

অনিমেষ বলল, ‘পানিরামের তো ভাটিখানা ছিল।’

জুলিয়েন বললেন, ‘এখনও আছে। টাকার পাহাড়ে বসে আছে লোকটা। এই চা-বাগানের মানুষগুলোকে কিনে রেখেছে।’

‘ওর গদিতে টাকা থাকে?’

‘থাকে। সোমবার সকালে ব্যাঙ্কে যায় ওর গাড়ি।’

‘আমাদের এখন প্রচুর টাকার দরকার।’

জুলিয়েন বললেন, ‘সিরিল ঠিক বলেছে। সাধারণ মানুষের ধারণা পানিরাম শয়তানের চেয়ে শক্তিশালী। পুলিশ ওর কেনা। সেই পানিরামকে যদি লুঠ করা যায় তা হলে লোকে ধাক্কা খাবে। সাহস পাবে।’

অনিমেষ বলল, ‘কিন্তু সাধারণ মানুষকে বুঝতে দিতে হবে এটা ক’জন সাধারণ ডাকাতের কাজ নয়। সারা দেশ জুড়ে আগামীকালের বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের এটা প্রতিবাদ। অ্যাকশনের সময় এসব কথা সেখানে লিখে আসতে হবে।’

‘কিন্তু পানিরামের বন্দুক আছে।’ সিরিল বলল, ‘ও তো বাধা দেবেই।’

‘বাধা দিলে জোর খাটাতে হবে।’ অনিমেষ খুব শান্ত গলায় বলল, ‘যদি কোনও উপায় না-থাকে তা হলে পানিরামকে সরিয়ে ফেলতে হবে।’

সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়েন আর সিরিল অনিমেষের দিকে তাকাল। জুলিয়েন সম্মতির মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন। একজন রক্তচোষাকে মেরে ফেললে আরও দশটা ভয় পেয়ে যাবে। এই লোকটাকে চা-বাগানের সমস্ত শ্রমিক দু’বেলা মেরে ফেলার কথা ভাবে। কিন্তু আমাদের এই গরিব মানুষের বুকে অসহায়তা ছাড়া কিছু নেই। ওরা শুধু কল্পনা করতেই পারে। কিন্তু কেউ যদি ওদের করতে না-পারা কাজটা করে দেখায় তা হলে সে ওদের আপনজন হয়ে যাবেই। আপনি ঠিক বলেছেন।’

অনিমেষ জুলিয়েনের এই ব্যাখ্যায় খুব খুশি হল। সে বলল, ‘কিন্তু পানিরামের মতো মানুষ খুন হলে যে পুলিশি তৎপরতা শুরু হবে তা সামলাতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’

জুলিয়েন হেসে দুটো হাত ছড়িয়ে দিলেন, ‘আমাদের চারপাশে এত জঙ্গল। পুলিশের ক্ষমতা কী খুঁজে বের করে সেখান থেকে। আর থানাগুলো এত দূরে দূরে যে পুলিশ আসার আগেই আমরা খবর পেয়ে যাব। কিন্তু আসল ব্যাপারটার কথা কী ভাবছেন?’

অনিমেষ বলল, ‘কী ব্যাপার? অ্যাকশন স্কোয়াড তৈরি করা?’

জুলিয়েন মাথা নাড়লেন, ‘না। ওতে আমাদের খুব কষ্ট হবে না। কারণ, এই সমাজব্যবস্থার প্রতি বিরক্ত ছেলের অভাব নেই এদেশে। আর যৌবনে মানুষ এরকম কাজ করার জন্যে সবসময় উত্তেজিত হয়। আমি সেকথা ভাবছি না। আমি অস্ত্রের কথা ভাবিছ। এসব কাজ তো আর ছুরি কাটারি নিয়ে হয় না। আমাদের প্রচুর অস্ত্র দরকার।’

অনিমেষ বলল, ‘ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু অস্ত্র তো আর এমনি এমনি পাওয়া যাবে না। সেগুলো কিনতে হবে আর তার জন্যে টাকা দরকার। পানিরামের কাছ থেকে মেরে বা ভয় দেখিয়ে সেই টাকা আমাদের পেতে হবে। একটা পানিরাম খুন হলে দেখবেন অন্য পানিরামরা ভয়েই টাকা দিয়ে দেবে।’

সিরিল বলল, ‘আর-একটা সহজ উপায় আছে।’

জুলিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী উপায়?’

‘সব চা-বাগানের সাহেব কনট্রাক্টারবাবু আর বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বন্দুক পিস্তল রাইফেল আছে। আমরা যদি সেগুলো গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিয়ে আসি, তা হলে আমাদের অনেক অস্ত্র হয়ে যাবে।’ সিরিল একটা উপায় বার করতে পেরেছে বলে খুশিতে হাসল।

অনিমেষ বলল, ‘মন্দ বলেননি। প্রথম দিকটায় আমরা এইভাবে চালাতে পারি। তা হলে ডুয়ার্সে কার কার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে তার একটা লিস্ট করা দরকার। তাই না?’

‘খুব সহজ। সদরের সরকারি অফিসে ওই লিস্ট আছে।’

অনিমেষ বলল, ‘তা হলে আমরা তৈরি হই। তবে আমি বোলপুর থেকে ফিরে এসে কাজ আরম্ভ করলেই ভাল হয়।’

জুলিয়েন বললেন, ‘ঠিক আছে। এখন আপনি কী করবেন?’

‘আপার ডুয়ার্সে যেতে হবে। ওদিকে আপনার জানাশোনা কেউ আছে?’

‘নিশ্চয়ই। আপনি কবে যাবেন?’

‘ধরুন কালকেই।’

জুলিয়েন কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘আপনার সাহস আছে। এইভাবে একা একা ঘুরছেন, যদি সঠিক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না-হয় তা হলে বিপদে পড়তে পারেন। ঠিক আছে, আমি আপনার সঙ্গে যাব।’

‘আপনি যাবেন?’ অনিমেষ বিস্মিত, ‘বাড়ির লোকজন?’

‘ছাড়তেই হবে যখন, তখন একটু আগেই ছাড়ি। অবশ্য এখনই কাউকে কিছু বলছি না।’ জুলিয়েন কথা শেষ করতেই অনিমেষ হাত বাড়াল। ওরা যখন খুব আন্তরিক করমর্দন করছে ঠিক তখনই দরজাটা ধীরে ধীরে ফাঁক হল। ওরা তিনজনেই ঘাড় ঘুরোতেই একটি মুখ উঁকি দিয়েই সরে যাচ্ছিল। জুলিয়েন ডাকলেন, ‘বুধুয়া’!

কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর একটি মানুষ আরশোলার মতো হেঁটে এল ভেতরে। অনিমেষ দেখল লোকটার কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে, হাতে একটা বোঁচকা। এই লোকটাই চুরি করতে গিয়েছিল।

জুলিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাথা ফাটল কী করে?’

বুধুয়া মুখ নিচু করল। জুলিয়েন উঠে ক্ষতটা পরীক্ষা করে বললেন, ‘তেমন কিছু নয়। বিশল্যকরণী পাতার রস লাগিয়ে নে। আর এই ব্যাবসা ছাড়তে হবে।’

খুব নিরীহ গলায় লোকটা বলল, ‘খাব কী?’

জুলিয়েন এবং অনিমেষ পরস্পরের দিকে তাকাল। সিরিল জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ কার সর্বনাশ করলে?’

সঙ্গে সঙ্গে হাসল বুধুয়া, ‘সর্বনাশ আর কোথায় করতে পারলাম। পানিরামের ঘরে গিয়েছিলাম আজ। দুটো থালা নিয়ে এসেছি।’

নামটা উচ্চারণ করামাত্র অনিমেষরা চমেক উঠল।

ওরা খোলা আকাশের নীচে বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণ হেঁটে জুলিয়েন বিদায় নেবার জন্য দাঁড়ালেন। অনিমেষ বলল, ‘এসব চুরি ছ্যাঁচড়ামিতে ওদের গা সয়ে গেছে, এবার আমাদের ডাকাতি করতে হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *