০২. হাঁটুর খানিকটা ওপরে

দুই

হাঁটুর খানিকটা ওপরে গভীর তামাটে দাগ অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের আদল নিয়েছে। হঠাৎ দেখলে একটু অস্বস্তি হয়। সুন্দর নির্লোম থাই-এর মধ্যিখানে একটা কুৎসিত চিহ্ন সারা জীবন আঁকা থাকবে। সাধারণত ফুলপ্যান্ট পরলে চিহ্নটি কারও চোখে পড়ে না, অনিমেষও সেটা মনের আড়ালে রেখে দেয়। সামান্য পা টেনে হাঁটা ছাড়া এই চিহ্নটি ওকে কোনও পীড়া দেয় না। চোখের বাইরে থাকলেই সব জিনিসের ধার কমে যায়। কিন্তু যখনই ওই প্রসঙ্গ ওঠে অথবা খবরের কাগজে পুলিশের গুলি চালানোর কথা লেখা হয় তখনই অনিমেষের থাই টনটন করতে থাকে। ব্যথাটা আচম্বিতে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়।

কখন জ্ঞান ফিরেছিল অনিমেষ জানে না। মানুষ জলে ডুবে গিয়ে কী দেখে সেটাও অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু চোখের সামনে অজস্র ঘোলাটে ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে— এ ছাড়া সে কিছু জানে না। প্রথম যখন নিজের অস্তিত্ব টের পেল তখন সে বিছানায়, মাথার ওপরে ছাদ এবং নাক-জোড়া কড়া ওষুধের গন্ধ। সামান্য মাথা ঘোরাতে ও বুঝতে পারল এটা হাসপাতাল এবং সবে ভোর হয়েছে।

কলকাতায় পড়তে এসে যখন শিয়ালদায় নেমেছিল তখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। অথচ এই ভোরবেলায় সে হাসপাতালে শুয়ে আছে কেন? অনিমেষের চিন্তা করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে পরিচিত মুখগুলোকে দেখতে চাইছিল। সরিৎশেখর, দাদুকে, ও এক পলকেই লাঠি হাতে এগিয়ে আসতে দেখল চোখের পরদায়। মহীতোষ, ওর বাবা, গম্ভীর মুখে ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে সাইকেল থেকে নামছেন। ছোটমা মাঠের মধ্যে দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলেছেন, ঘোমটা একটু নেমে এসেছে। না, সবাইকে সে মনে করতে পারছে, আলাদা আলাদা করে প্রতিটি মুখের আদল দেখতে পাচ্ছে। আর তারপরেই সিনেমার মতো চোখের পরদায় জ্বলন্ত ট্রামটা ভেসে উঠল, কিছু ছেলে যেটায় আগুন লাগিয়ে একটু আগে ছুটে গেছে। শব্দ হচ্ছে ট্রামটা থেকে, লকলকে আগুন ট্রামের তার ছুঁয়েছে। বারুদের গন্ধ বাতাসে, অনিমেষ সেই ট্রেনে-পরিচিত বৃদ্ধের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিল। কার্ফু শব্দটার কার্যকর ক্ষমতা সে ওই প্রথম দেখল। এমন নিস্তব্ধ মৃত শহরের নাম কলকাতা এটা আবিষ্কার করে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। সেই বৃদ্ধের মুখটা এখন মনে পড়ছে না, তিনিও কি—। সঙ্গে সঙ্গে যেন শব্দটা শুনতে পেল অনিমেষ। ট্রামের পাশে দাঁড়ানো পুলিশগুলোকে তেড়ে আসতে দেখে সে একটা গলির মধ্যে ঢুকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। এত অন্ধকার জলপাইগুড়ি শহরে কখনও দেখেনি সে। আর তখনই ওর থাই-এর মধ্যে গরম ছুরি বসিয়ে কেউ যেন শূন্যে ঠেলে দিল। প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল অনিমেষ, আর কিছু মনে নেই। না, ঠিক তা নয়, কতগুলো অস্পষ্ট মুখ— কিছু না-বোঝা কথাবার্তা এর পরে সে শুনেছে। নিজের মায়ের মুখ, ছবিতে থাকা মৃত মায়ের মুখ কি ওর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল? একটা গান গাইছিল কেউ, তার সুর বা কথা কিছু মনে নেই। আর তারপরেই কে যেন এসে ভুল নামে তাকে ডেকেছিল, তারা কে?

‘জ্ঞান ফিরেছে।’ গলাটা খসখসে কিন্তু ভাল লাগল অনিমেষের। সে চোখ খুলে যাঁকে দেখল তিনি একজন নার্স। সব নার্সকেই একই রকম দেখায়। এঁর চেহারা মোটেই সুন্দরী নয় এটুকু বোঝা যায়। অনিমেষ কথা বলতে চেষ্টা করল, ভীষণ দুর্বল লাগছে, ‘আমি কোথায়?’

‘এটা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল। দু’দিন আগে আপনি এখানে এসেছিলেন। এখন আরাম করে ঘুমোন।’ নার্স হাসলেন। ওঁর কালো মাড়ি দেখতে অনিমেষের একটুও খারাপ লাগল না। কিন্তু হঠাৎই মনে হল কোমরের নীচ থেকে নিজের পায়ের অস্তিত্ব সে টের পাচ্ছে না। তলাটা যেন অসাড় হয়ে আছে। ব্যাপারটা কী বুঝে ওঠার আগেই শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল এবং পায়ের ওপর রাখা চাদর মাথা অবধি টেনে নেওয়ার মতো হঠাৎই একটা আচ্ছন্নতা ওকে ঢেকে ফেলল।

আবার যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল। কয়েক মুহূর্তের অস্বচ্ছতা, তারপরেই সব কিছু পরিষ্কার দেখতে লাগল অনিমেষ। তার কাছে কেউ নেই, সেই নার্সটিকেও দেখতে পেল না। কিন্তু ওপাশে বেশ কথাবার্তা চলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখল ওপাশের বেডগুলোতে আরও মানুষ শুয়ে বসে আছেন এবং তাঁদের কাছে মানুষজন এসেছেন। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল সে যে এই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে তা কি বাড়ির লোকেরা জানে? অনিমেষ উঠে বসতে গিয়ে যন্ত্রণাটাকে আবিষ্কার করল। সে পারছে না, হাত আঙুল কিংবা মাথা তার ইচ্ছেমতন কাজ করলেও কোমরের নীচে ইচ্ছেটা পৌঁছাচ্ছে না।

আঘাত এবং যন্ত্রণাটা যে গুলি থেকে সেটা এখন স্পষ্ট। কিন্তু কে গুলি করল ওকে? সেই গলির মধ্যে পালিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো না পিছনে ধেয়ে আসা পুলিশ? সে মনে করতে পারল আঘাতটা পিছন থেকেই এসেছিল এবং সে ধাক্কা খেয়েও পিছনে মুখ ঘোরাতে পারেনি। ট্রামের আগুনে দেখা পুলিশগুলো রাগী গোখরোর মতো তেড়ে আসছিল। কিন্তু হাতে সুটকেস আর বেডিং দেখেও কি ওরা বুঝতে পারল না? খামোকা ওকে পুলিশ গুলি করল কেন? গুলিটা যদি আর একটু ওপরে লাগত, একটুও অস্বাভাবিক ছিল না— তা হলে?

‘ঘুম ভেঙেছে তা হলে?’

অনিমেষ দেখল একজন কালো চেহারার স্থূলকায় নার্স ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। সকালের নার্সটি নন। যদিও সব নার্সের পোশাক এক তবু এঁর কথা বলার ভঙ্গি এবং চাহনিতে এমন একটা ব্যাপার আছে যা অস্বস্তি এনে দেয়।

‘হাঁ করে কী গিলছ ভাই, তোমার সামনে এখন অনেক পরীক্ষা।’

‘পরীক্ষা, কীসের পরীক্ষা!’ নিজের গলার স্বর অনিমেষের অচেনা, সে তো এরকম গলায় কথা বলে না। নার্স বললেন, ‘তুমি তো আকাশ থেকে পড়েছ, নামটাও লেখা হয়নি, আর পায়ে যে মালটি ঢুকিয়েছিলে সেটা শান্ত ভদ্র ছেলের ঢোকে না। একজন বাবাজি রোজ দু’বেলা এসে তোমার খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে। তা আজ যদি কথা বলতে ইচ্ছে না-করে চোখ মটকে পড়ে থাকো, আমি গিয়ে বলে দিই জ্ঞান ফেরেনি। খবরদার, চোখ খোলা চলবে না।’ একনাগাড়ে কথা বললেও মুখের চেহারা একটুও পালটালেন না মহিলা।

‘বাবাজি?’ এ সবকিছু হেঁয়ালির মতো লাগছিল অনিমেষের।

‘পুলিশ। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গেলে আর বাবাজিদের চিনলে না? দিয়েছে তো পা ফাঁসিয়ে, এখন থাকো বিছানায় শুয়ে। এবার পুলিশ অন্য ঠ্যাংটা ধরে টানাটানি করবে। কী, ঘুমুবে না খবর দেব?’ মহিলার কথা বলার মধ্যে এমন একটা ঠাট্টার ভঙ্গি ছিল যে, অনিমেষ অসহায় হয়ে পড়ল। সে কাতর গলায় বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আমি পুলিশকে কিছু করিনি, আমি কলকাতার কিছু চিনি না।’

‘ওসব গল্প আমার কাছে বলে কোনও লাভ নেই।’

কথাবার্তা একদম অস্বাভাবিক। জলপাইগুড়িতে সে কোনও মহিলাকে এরকম কথা বলতে শোনেনি। কলকাতার সব মেয়ে কি এই ভঙ্গিতেই কথা বলে? ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছে কলকাতার মানুষদের মনে দয়ামায়া কম, কেউ কারও কথা ভাবে না, স্বার্থপর হয়ে যায় সবাই। কিন্তু নার্সরা এরকম হবে কেন?

জলপাইগুড়িতে তার খবর এখনও পৌঁছায়নি। তার পকেটে অবশ্য এমন কিছু ছিল না যা থেকে কেউ তার ঠিকানা খুঁজে পাবে। অবশ্য সুটকেস খুললে সব কিছু পাওয়া যাবে। বাবার বন্ধুকে লেখা চিঠিও ওতে আছে। তা হলে কি সুটকেস বেডিং-এর হদিশ কেউ পায়নি? ও দুটো হারালে সে কী করবে? তার সব শার্ট প্যান্ট তো ওই সুটকেসেই আছে। খুব দুর্বল লাগছে এখন।

‘জ্ঞান ফিরেছে?’

অনিমেষ দেখল একজন ডাক্তার— ডাক্তারই, কেননা— গলায় স্টেথো ঝোলানো, ওকে প্রশ্ন করছেন। শরীরের পাশে নেতিয়ে থাকা ডান হাতের কবজিটা তুলে পাল্‌স দেখলেন তিনি, তারপর বললেন, ‘পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলবেন না।’

‘বাঁধা গৎ।’ মোটা গলার চাপা হাসি কানে এল।

‘যা বলেন, তবে এ কেসে আর একটু ব্লিডিং হলে বাঁচানো যেত না।’ অনিমেষ ডাক্তারকে চলে যেতে দেখল। শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে? অনিমেষের ইচ্ছে করছিল ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে তার পা আস্ত আছে কি না? সে নিজে উঠে বসে যে দেখবে তেমন শক্তি নেই। যদি পা বাদ দিয়ে থাকে ওরা তা হলে সে কী করবে? চিরকাল খোঁড়া হয়ে হাঁটা-, মেঝেতে কিছু ঘষটে আনার শব্দ হতে অনিমেষ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। একজন রোগা মানুষ কিন্তু কাতলা মাছের মতো মুখ, সবুজ হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা, ওপাশ থেকে একটা টুল ঘষটে খাটের কাছে নিয়ে এল। লোকটার চোখ সে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না; কারণ, নাকের পাশে আর ভ্রূর তলার ঢিপি মাংস সে দুটোকে প্রায় ঢেকে রেখেছে।

‘বিপ্লব হল?’ মুখের ভেতর চিবিয়ে ছিবড়ে ছুড়ে ফেলছে এমন ভঙ্গি কথা বলার। প্রশ্নটা বুঝতে পারল না, কীসের বিপ্লব, তার সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক?

‘ফেরেব্বাজি আমি একদম পছন্দ করি না। যা জিজ্ঞাসা করব চটপট জবাব দেবে, তোমার চোদ্দো পুরুষের ভাগ্য যে হাসপাতালে শুয়ে আছ।’ কথা বলে নিঃশব্দে হাঁ করে হাসল লোকটা। অনিমেষ দেখল ওর দাঁতগুলো খুব ছোট, চোখের মতো, আছে কি নেই বোঝা যায় না। সে খুব সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কে?’

‘তোমাদের পরিত্রাতা, ঈশ্বর। ঈশ্বরকে চেনো? যার ডাকনাম ভগবান?’ বলেই ভেংচিয়ে উঠল লোকটা, ‘আপনি কে? নবাবসাহেব আমাকেই প্রশ্ন করছেন উলটে। একদম না। যা জিজ্ঞাসা করার তা আমিই করব।’ হাতের ডায়েরি খুলে প্রথম প্রশ্ন হল, ‘বাপ-মা’র দেওয়া নামটা কী?’

‘অনিমেষ।’ ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, জিভ টানছে অনিমেষের।

‘পুরো নাম বলার অভ্যেস নেই নাকি? আচ্ছা ত্যাঁদোড় তো! যেন রবীন্দ্রনাথ, হিটলার, বললেই চিনে ফেলতে হবে। পুরো নাম ঠিকানা বলো!’

অনিমেষ বাধ্য হয়ে লোকটার হুকুম তামিল করতেই খিঁচুনি শুনতে পেল, ‘আবার নক্করবাজি! বোম ছুড়লে শ্যালদায় আর ঠিকানা দিচ্ছ সেই জলপাইগুড়ির, ওখান থেকে বিপ্লব করতে এসেছিলে?’

অনিমেষ এতক্ষণে বিপ্লব শব্দটার অর্থ ধরতে পারল। সেদিন যে ট্রাম জ্বলছিল, বোম পড়ছিল, লোকটা তাকেই ব্যঙ্গ করছে। নার্স যার কথা বলছিলেন বাবাজি তিনি যে সুবিধের নন সেটা এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর কোনও ভয় লাগছে না অনিমেষের। সে সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে কেউ সত্যি কথা বলে না, না?’

‘নো, নেভার। পুলিশদের কারবার সেরা মিথ্যুকদের সঙ্গে। এবার আসল ঠিকানাটা বলে ফেলো। আরে বাবা, বাপ-মা থাকলে তারা এতক্ষণে হেদিয়ে মরছে, ঠিকানা জানলে আমি খবরটা দিয়ে দেব।’ স্নেহ-স্নেহ মুখ করার চেষ্টা করতেই লোকটার চোখের তলার মাংসের ঢিবি নেচে উঠল।

‘আমি ঠিকই বলছি। জলপাইগুড়ি শহরের হাকিমপাড়ায় আমি থাকতাম। বাবা স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানে কাজ করেন।’ কথা বলতে এখন ক্লান্ত লাগছে। লোকটা যদি সত্যিই দাদুকে খবরটা দিয়ে দেয়! ঠিকানা লিখে নিয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার সঙ্গে আর যারা ছিল তাদের নাম বলো?’

‘একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। উনি ফুটপাতে পড়ে গিয়েছিলেন, নাম জানি না।’

‘বৃদ্ধ— ইয়ারকি?’

‘আমরা নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে এসেছিলাম। স্টেশনে নেমে দেখলাম খুব গোলমাল হচ্ছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর উনি আমায় নিয়ে বেরিয়েছিলেন।’

‘বেশ, বেশ, বলে যাও।’ পকেট থেকে একটা চারমিনারের প্যাকেট বের করেও কী ভেবে আবার বুক পকেটে রেখে দিল লোকটা।

‘আমি এর আগে কখনও কলকাতায় আসিনি!’

‘বাঃ, গুড, চলুক।’

‘আমরা যখন রাস্তায় এলাম তখন চারপাশ নিস্তব্ধ আর একটা ট্রাম দাউদাউ করে জ্বলছিল।’

‘দাউদাউ করে জ্বলছিল, অ্যাঁ? কেমন লাগল দেখতে?’ লোকটা ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘গপ্প বানানো সবার ক্ষমতায় আসে না, বুঝলে ছোকরা! আমরা ট্রাম পোড়ানোর জন্য একমাত্র যাকে ধরতে পেরেছি সে হল তুমি। আর তোমার গল্প হল সেই সন্ধেতে প্রথম তুমি কলকাতার মুখ দেখেছ?’

কথা বলার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে, নীরবে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

‘কিন্তু চাঁদু, ওই পোড়োবাড়ির আখড়ায়— যেখান থেকে বিপ্লব পরিচালনা করা হচ্ছিল সেখানে তোমাকে পাওয়া গেল কী করে? সব তখন ভোঁ ভোঁ, ওনলি তোমার হাফ-ডেডবডি পড়ে ছিল তো?’ যেন আসল জায়গায় এতক্ষণে হাত দিয়েছে এমন ভঙ্গি করল লোকটা।

অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। চেতনায় অস্পষ্ট হলেও তার মনে আসছে কারা যেন তাকে চ্যাংদোলা করে ছুটে যাচ্ছিল। তারপর কেউ ভুল নামে ওকে ডেকেছিল—। সে চোখ না-খুলেই বলল, ‘আমি জানি না, আমার কিছু মনে নেই।’ এতক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলে যেটা সে ঠাওর করেনি সেটাই ঘটে গেল। হঠাৎই যেন তার পায়ের তলায় মাটি সরে যেতে সে তলিয়ে যাচ্ছিল। সে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেও সব কিছু নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কে যেন তাকে টেনে নিয়ে হুহু করে নীচে নেমে গেল এবং তারপর সব অন্ধকার।

ঠিক কত ঘণ্টা জানা নেই, ঘুম থেকে ওঠার মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ খুলল অনিমেষ। এখন বেশ ভাল লাগছে, গতকাল জ্ঞান ফেরার পর যে অবসাদ সমস্ত শরীরে জড়িয়ে ছিল সেটা এখন নেই। দুটো হাত মাথার ওপর এনে সে দেখল বেশ জোর পাচ্ছে, কিন্তু উঠে বসতে গিয়ে খচ করে কোমরে লাগতেই প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা পাক খেয়ে গেল থাইতে। কিছুক্ষণ মুখ বুজে শুয়ে থেকে যন্ত্রণাটাকে কমিয়ে আনল অনিমেষ। হাত দিয়ে যেটুকু পারে বুলিয়ে সে বুঝতে পারল তার পা দুটো আস্তই আছে, মনে হয় কেউ বাদ দেয়নি। হ্যাঁ, পায়ের আঙুলগুলো সে নাড়াচাড়া করতে পারছে। অদ্ভুত স্বস্তি এল মনে, কী আরাম! ওর নাকি খুব ব্লিডিং হয়েছিল? যারা তাকে গলি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা কি অযত্ন করেছে? নাকি পুলিশই দেরি করেছে তাকে হাসপাতালে ভরতি করতে?

অনিমেষ দেখল, ও পাশের বেডে একজন বৃদ্ধ উবু হয়ে বসে আছেন। খুব রোগা হাড়-জিরজিরে চেহারা। চোখাচোখি হতেই ফোকলা মুখে সরল হাসি হাসলেন, ‘তা হলে ঘুম ভাঙল, কেমন বোধ করছ বাবা?’ ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, ভাল।

‘কাল বিকেলবেলায় সেই লোকটা খুব খিঁচোচ্ছিল বুঝি? আমি নার্সকে বললাম, কেন এসব লোককে ঢুকতে দেন? তা সে মাগি জবাব দিল লোকটা নাকি পুলিশ। তা বাবা, কী করেছিলে, ডাকাতি না ছেনতাই?’

অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘ওসব কিছু নয়।’

অনিমেষ দেখল, এটা একটা বিরাট হলঘর। তার বিছানা, একদম দেওয়াল ঘেঁষে। এক পাশে সাদা দেওয়াল, অন্য পাশে সারি সারি বিছানা। অনিমেষের মনে হল, বৃদ্ধের বসে থাকার ভঙ্গিটা খুব স্বাভাবিক নয়। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ওভাবে বসে আছেন কেন?’

‘শুতে পারি না ভাই, শুলেই শরীরের সব হাড় পটাপট গায়ের মধ্যে ফোটে। না-খেতে পেয়ে মাংস বলে তো কিছু নেই। আবার লোকে যেভাবে বসে থাকে সেভাবে বসলে খচখচ করে। এই যে উচ্চিংড়ের মতো বসে আছি— এটাই আমার আরাম।’ তারপর মাথা দুলিয়ে ফাঁকা মাড়িতে একগাল হেসে বললেন, ‘সকলে মিলে যে নিয়মটাকে তৈরি করে আমরা সেটাকেই স্বাভাবিক বলি। কেউ কেউ যদি নিজের মতো কিছু করে নেয় সেটা চোখে ঠেকলেও জেনো তাতেই তার আরাম।’

পায়ের শব্দে অনিমেষ দেখল গতকালের সেই অসুন্দর অথচ ভাল লাগা নার্সটি এসে দাঁড়িয়েছেন। নিজেই কথা বলল সে, ‘এখন ভাল আছি।’

‘খুব ঘুমিয়েছেন!’ তারপর খাটের পিছনে টাঙানো একটা কাগজ দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাত্রে জ্বর এসেছিল?’ মহিলা ঝুঁকে পড়ে ওর কপাল ছুঁয়ে বললেন, ‘না, এখন টেম্পারেচার নেই।’ অনিমেষ অবাক হল। ঘুমের মধ্যে তার কখন জ্বর এল আবার চলেও গেল সে টের পায়নি। মহিলা সতর্ক করলেন, ‘এখন নড়াচড়া একদম বন্ধ। যদি আবার হাঁটতে চান হাড়টা এমন জায়গায় ফেটেছে যে অবাধ্য হলে আর জোড়া লাগবে না। খুব ভাগ্য যে বেঁচে গেছেন।’

অনিমেষ মহিলার দিকে তাকাল। ছোট্ট শান্ত মুখ, গলার স্বরে দূরত্ব নেই। টুকটাক কাজ সেরে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার সঙ্গে তো কিছুই নেই যা দিয়ে একটু পরিষ্কার হবেন। হাসপাতালে ওসব কিছু পাওয়া যায় না। বাড়িতে খবর গেছে?’

‘জানি না, কাল একজন পুলিশ এসেছিল— ওরা যদি খবর দেয়।’ বলতে বলতে সে দেখল, ও পাশের অনেক বিছানার চার পাশে কাপড়ের ঘেরাটোপ, সম্ভবত প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো প্রকাশ্যে করা থেকে আড়ালের ব্যবস্থা। আশ্চর্য, অনিমেষ নিজে ওরকম তাগিদ অনুভব করছে না এখন আর করলেও এই মহিলার সামনে মরে গেলেও—।

‘ঠিকানাটা বলুন, দেখি হাসপাতাল থেকে চেষ্টা করে যদি খবর দেওয়াতে পারি।’ মহিলা টুলটাকে টেনে নিয়ে পাশে বসলেন। অনিমেষ এবার অনুভব করল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার চোখ দুটো ভারী, সম্ভবত সেখানে পিচুটি জমেছে। কোনও মহিলার দিকে এই চোখে তাকানো অস্বস্তিকর। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় আমার বাড়ি।’

‘জলপাইগুড়ি! ওমা, সে তো অনেক দূরে। কলকাতায় আপনি কোথায় থাকতেন?’

‘যে-দিন গুলিটা লাগল সে দিনই আমি প্রথম কলকাতায় এসেছি। এ-কথা কাউকে বোঝাতে পারছি না। কলকাতার কিছুই চিনি না আমি। বাবার এক বন্ধু এখানেই থাকেন, তাঁর বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। এই যাঃ, পুলিশকে ওঁর ঠিকানাটা বলতেই ভুলে গিয়েছি।’ অনিমেষের সত্যি আফশোস হল।

‘কী ঠিকানা?’

‘সাত নম্বর হরেন মল্লিক লেন, কলকাতা— কলকাতা বারো বোধহয়। বাবার বন্ধুর নাম দেবব্রতবাবু, ওঁকেও আমি কখনও দেখিনি।’ অসহায়ের মতো তাকাল সে।

‘কলকাতা বারো? তা হলে তো এই এলাকা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন খবর দিয়ে দেব।’

‘আপনি নিজেই দেবেন?’

‘দিলামই বা। আপনি আগে কলকাতায় আসেননি।’ হেসে উঠলেন, ‘আপনাকে আপনি বলতে আমার খারাপ লাগছে, একদম বাচ্চা ছেলে, আমার চেয়ে অনেক ছোট।’

‘ঠিক আছে, আপনি আমাকে তুমি বলবেন। আমার নাম অনিমেষ।’

‘এখানে কী জন্য আসা হয়েছিল?’

‘পড়তে। আমি এবার স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি।’

‘দেখো কী কপাল! এ বছরটা নষ্ট হয়ে গেল তো!’

‘নষ্ট হল মানে? আমি কি হাঁটতে পারব না?’

‘পারবে না কেন? তবে অনেকদিন বিছানায় আটকে থাকতে হবে। হাঁটুর ওপরের হাড়টা ফ্র্যাকচার হয়েছিল, বয়স অল্প বলে জুড়ে যাবে। তুমি তো মরেও যেতে পারতে।’

কথা শেষ করতেই ও পাশের একজন রুগি কিছু চেঁচিয়ে বলতে মহিলা উঠে তাঁর কাছে চলে গেলেন। অনিমেষ শিথিলভাবে শুয়ে রইল। ভীষণ মন খারাপ লাগছে।

দুপুরে একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল, কিন্তু গরমে জামা ভিজে গেছে, ঘেমো গন্ধ বেরুচ্ছে বিছানা থেকে-গা-ঘিনঘিনে ভাবটা আর ঘুমুতে দিচ্ছিল না ওকে। পাশের বেডের বৃদ্ধ সেইরকম ভঙ্গিতে বসে বসেই দুপুরটা ঘুমুলেন। এখন ওয়ার্ডে কেউ হাঁটাচলা করছে না। মাঝে মাঝে ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসছে বাইরে থেকে। খাওয়ার সময় বৃদ্ধের মুখে শুনে সে জেনেছে ওটা ট্রামের শব্দ। খাওয়া— অনিমেষ কোনওদিন চিন্তাও করেনি এভাবে শুয়ে শুয়ে মানুষ খেতে পারে। এমনকী প্রাকৃতিক কাজগুলো পর্যন্ত এই বিছানায় সারতে হল। ভাগ্যিস তখন কোনও নার্স ছিল না, জমাদার টাইপের একটা লোক অনিমেষকে খুব সাহায্য করেছে। ট্রামের শব্দটা শুনে ওর মনে হল, কলকাতা শহরের বুকে সে শুয়ে আছে, কিন্তু একটা চলন্ত ট্রাম সে দেখতে পেল না। এখন নাকি কলকাতা একদম স্বাভাবিক, রাস্তায় বন্দুক হাতে পুলিশ নেই। কেউ বোম ছুড়ছে না, ট্রাম পোড়াচ্ছে না। কলকাতা শহর যেমন হঠাৎই ফুঁসে ওঠে তেমনি চটজলদি ঠান্ডা হয়ে যায়। বৃদ্ধের মুখে এ-খবর শুনে অনিমেষ অবাক হয়ে গিয়েছিল। যে জন্য আন্দোলন হয়েছিল তা যেমনকে তেমনই রয়েছে। এরকম ভালুক-জ্বরের মতো আন্দোলন করে কার কী লাভ হয়? আবার এমনও তো হতে পারে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে এর প্রকৃত কারণটা ধরতে পারছে না। কলকাতাকে জানতে হলে এই শহরে মিশে যেতে হবে। অসহায়ের মতো অনিমেষ নিজের পায়ের দিকে তাকাল।

কোথাও যেন ঘণ্টা বাজল ট্রেন ছাড়ার আর সঙ্গে সঙ্গে পাশের বিছানার মানুষেরা নড়েচড়ে বসতে লাগল। এটা তা হলে ভিজিটার্স আওয়ার। রোগীদের আত্মীয় বন্ধুরা আসছে। সে দেখল বৃদ্ধের কাছে কেউ আসেনি এবং তাতে যেন তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। উনি তেমনি উবু হয়ে বসে সব দেখছেন। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।

কিন্তু কয়েক মিনিট বাদেই একটা অপরিচিত গলায় নিজের নাম শুনে তাকে চোখ খুলতেই হল। একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ওর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। ফরসা, মাথায় পাতলা চুল, লম্বা, ধুতি পাঞ্জাবি পরা। ওকে চোখ খুলতে দেখে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম অনিমেষ?’

নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল সে।

‘কোথায় বাড়ি?’

‘জলপাইগুড়ি।’ ইনি কে? দেখে তো পুলিশ বলে মনে হচ্ছে না।

‘বাবার নাম কী?’ ভদ্রলোক খুঁটিয়ে দেখছিলেন।

‘মহীতোষ-’ কথাটা শেষ করতে দিলেন না ভদ্রলোক। যেন উত্তর পেয়ে গেছেন, আর প্রয়োজন নেই এমন ভঙ্গিতে হাত তুলে হাসলেন, ‘আসার কথা ছিল আমার বাড়িতে, তার বদলে চলে এলে এই হাসপাতালে! কী আশ্চর্য!’

এবার অনিমেষ অনুমান করল ভদ্রলোকের পরিচয়, ‘আপনি—।’

‘তোমার বাবার বন্ধু দেবব্রত মুখার্জি। সাত নম্বর হরেন মল্লিক লেন এখান থেকে দু’পা রাস্তা কিন্তু ওই নার্স মহিলা যদি না-যেতেন তা হলে জানতেই পারতাম না। ওঁর কাছেই সব শুনলাম, কী গেরো বলো দেখি। বিধিলিপি কে খণ্ডাবে! আমি তোমার বাবার টেলিগ্রাম পেয়েছিলাম যে দিন তোমার আসার কথা তার পরের দিন। কী ডাক ব্যবস্থা বোঝো! তা পেয়ে অবধি দুশ্চিন্তায় অস্থির, এই বিরাট শহরে কোথায় আছ কে জানে! তা আজ খবর পেয়েই মহীকে টেলিগ্রাম করলাম চলে আসার জন্য। এখন কেমন আছ?’ ভদ্রলোকের কথা বলার মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে, অনিমেষের ভাল লাগল। সে বলল, ‘শুধু এই পা-টা—।’

‘ঠিক আছে, আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছি, তুমি কিছু চিন্তা কোরো না।’ বলে দেবব্রতবাবু মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের আলাপ করিয়ে দিই— নীলা, এদিকে আয়।’

এতক্ষণে অনিমেষ লক্ষ করল, দেবব্রতবাবু একা নন, একটি লম্বা স্বাস্থ্যবতী মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। যদিও গায়ের রং চাপা তবু ওকে দেখলে চট করে উর্বশীর কথা মনে পড়ে যায়। জলপাইগুড়ির বিরাম করের মেজ মেয়ে উর্বশী এখন কলকাতায় আছে।

‘আপনার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে অবধি বাবা ছটফট করছেন, পারলে সেই দুপুরেই ছুটে আসতেন।’ রেডিয়োর ঘোষিকারা যেভাবে কথা বলে থাকেন সেইভাবে বলল মেয়েটি।

‘অনিমেষ খুব ভাল ছেলে, ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। নীলাও এবার পাশ করেছে, বুঝলে। বিদ্যাসাগর মর্নিং-এ ভরতি হয়েছে। আচ্ছা নীলা, তুই একটু ওর কাছে বস, আমি ডাক্তারদের কাছ থেকে ঘুরে আসি।’ দেবব্রতবাবুকে সত্যি চিন্তিত দেখাচ্ছিল, তিনি চলে গেলেন।

কী কথা বলবে অনিমেষ বুঝতে না-পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। নীলাও সেইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় অনিমেষ বলল, ‘আমার বোধহয় কলেজে ভরতি হওয়া হবে না।’

‘আগে সেরে উঠুন তো। যেমন চটপট পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়াতে গিয়েছিলেন! মফস্‌সলের লোক তো—।’ হাসল নীলা।

‘কলকাতার লোকেরা বুঝি খুব বুদ্ধিমান হয়?’

‘হয়ই তো। যাক, বাবা চাইছিলেন আজই আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু নার্স যা বললেন তাতে কী হবে কী জানি!’

‘আপনাদের বাড়িতে এ অবস্থায় গেলে অসুবিধে করব।’

‘বাব্বা, খুব জ্ঞান দেখছি।’

‘এখন এ কথা বলছেন পরে অসহ্য হবে।’

‘তাই নাকি! এত জেনে বসে আছেন। বরং হয়তো উলটো ব্যাপার হবে।’

‘তার মানে?’

‘আমার নাম শুনলেন তো?’

‘নীলা!’

‘জানেন তো, ওটা কারও কারও সহ্য হয় না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *