০১. শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল

এক

ভরদুপুরে নিজের ছায়া দেখা যায় না। ছায়া যখন দীর্ঘতর হয় তখন তার আদল দেখে কায়াকে অনুমান করাও সহজ কাজ নয়। এই সেদিন যেসব ঘটনা ঘটে গেল এ—দেশে তাই নিয়ে কিছু লিখতে বসার সময় হয়েছে কি না এ সংশয় থাকতেই পারে। সমসাময়িক কিছু নিয়ে লেখার মুশকিল হল আমাদের দেখাটা অন্ধের হস্তিদর্শন হয়ে যায়।

তবু ‘উত্তরাধিকার’—এর পর ‘কালবেলা’ লিখতে বসে আমাকে এই সময়টাকেই বাছতে হয়েছে। আমি যেভাবে দেখতে চেয়েছি তার সঙ্গে অনেকেরই মতে মিলবে না, মিলতে পারে না। ওই সময়টাকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জানতাম এই দাবি করি না কিন্তু আঁচ গায়ে না—লাগুক মনে লেগেছিল। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার সময় আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, কেউ কাউকে স্বীকার করতে চায় না। অতএব, আমার বিশ্বাসটাই আমার কাছে সত্য।

‘কালবেলা’ কি রাজনৈতিক উপন্যাস? আমি জানি না। কারণ এ ধরনের সাইনবোর্ডে আমি বিশ্বাসী নই। আমরা এক দারুণ অবিশ্বাসের কালে বেঁচে আছি। কেউ যদি বিশ্বাস করে ভুল করেন তবে তিনি কিন্তু আমাদের থেকে প্রাণবন্ত। অনিমেষরা যদি ভুলটা বুঝতে পেরে সঠিক পথটাকে খুঁজে পায় তা হলে কিন্তু ভুলটা মূল্যবান হয়ে যাবে।

কিন্তু ‘কালবেলা’ ভালবাসার উপন্যাস। দেশ, মানুষ এবং নিজেকে। কারণ নিজেকে যে ভালবাসতে পারে না সে কাউকেই গ্রহণ করতে পারে না।

উপন্যাসটি লেখার সময় আমি অনেক গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। পৃথকভাবে উল্লেখ না—করলেও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ‘দেশ’ পত্রিকার অজস্র পাঠক—পাঠিকা যেভাবে আমাকে উৎসাহিত করেছেন তাতে আমি ধন্য।

উপন্যাসটি প্রকাশ করার ব্যাপারে শ্রীযুক্ত সাগরময় ঘোষ যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন তা একমাত্র তাঁকেই মানায়। আমার বন্ধু কল্যাণ সর্বাধিকারী প্রতিনিয়ত যে উপদেশ দিয়ে গেছেন তা স্মরণ থাকবে।

শেষ কথা, এই উপন্যাসে সময়টাকেই ধরতে চেয়েছি, কোনও মানুষ কিংবা ঘটনার সরাসরি ছবি তুলতে চাইনি।

সমরেশ মজুমদার

সূচিপত্র

অধ্যায়: এক

অধ্যায়: দুই

অধ্যায়: তিন

অধ্যায়: চার

অধ্যায়: পাঁচ

অধ্যায়: ছয়

অধ্যায়: সাত

অধ্যায়: আট

অধ্যায়: নয়

অধ্যায়: দশ

অধ্যায়: এগারো

অধ্যায়: বারো

অধ্যায়: তেরো

অধ্যায়: চোদ্দো

অধ্যায়: পনেরো

অধ্যায়: ষোলো

অধ্যায়: সতেরো

অধ্যায়: আঠারো

অধ্যায়: উনিশ

অধ্যায়: কুড়ি

অধ্যায়: একুশ

অধ্যায়: বাইশ

অধ্যায়: তেইশ

অধ্যায়: চব্বিশ

অধ্যায়: পঁচিশ

অধ্যায়: ছাব্বিশ

অধ্যায়: সাতাশ

অধ্যায়: আঠাশ

অধ্যায়: উনত্রিশ

অধ্যায়: ত্রিশ

অধ্যায়: একত্রিশ

অধ্যায়: বত্রিশ

অধ্যায়: তেত্রিশ

অধ্যায়: চৌত্রিশ

অধ্যায়: পঁয়ত্রিশ

অধ্যায়: ছত্রিশ

অধ্যায়: সাঁইত্রিশ

অধ্যায়: আটত্রিশ

অধ্যায়: ঊনচল্লিশ

অধ্যায়: চল্লিশ

অধ্যায়: একচল্লিশ

অধ্যায়: বিয়াল্লিশ

অধ্যায়: তেতাল্লিশ

অধ্যায়: চুয়াল্লিশ

অধ্যায়: পঁয়তাল্লিশ

শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। দুপুরের পর থেকেই আকাশ মেঘলা, মাঝে মাঝে তরল মেঘেরা উড়ে উড়ে যাচ্ছিল আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর মাথা মুড়িয়ে। বাতাস আর্দ্র কিন্তু বৃষ্টিটাই যা হচ্ছিল না।

জানলা খুললে অনেকটা দূর দেখা যায়। অনিমেষ চুপচাপ বসে ছিল। এরকম মেঘের দুপুর কিংবা বিকেলে মন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়। খুব আলস্য লাগে তখন। চোখ বন্ধ করলেই সেই মেঘগুলোর কথা মনে পড়ে যায় যারা ভুটান পাহাড় থেকে দল বেঁধে উড়ে এসে স্বর্গছেঁড়া চা—বাগানের ওপর বৃষ্টি ঝরাত। তখন সেই সব বুনো লম্বাটে গাছগুলো কী উল্লাসে আকাশটা ছুঁয়ে রাখত। কান পাতলেই সেই শব্দ।

এ—বছর ঘন মেঘের বিকেল এই প্রথম। মেঘেদের চেহারা কি পৃথিবীর সব জায়গায় একই রকম থাকে? তা হলে স্বর্গছেঁড়া, এমনকী জলপাইগুড়ির মেঘগুলোর চেহারা চালচলন এখানকার থেকে একদম আলাদা কেন? ভীষণ ময়লা আর ঠুনকো মনে হচ্ছে এদের। যেন খুব কষ্ট করে আসছে ওরা, জমতে হয় তাই জমছে।

মেঘ দেখতে গিয়ে অনিমেষ কাছের দূরের ছাদগুলো দেখে ফেলল। তিনতলার ওপর ঘর বলে বেশ কিছু দূর দেখতে পাওয়া যায়। কলকাতার মেয়েরা বিকেলের এই সময়টা ছাদে ছাদে কাটিয়ে দেয়। হয়তো ওদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই কিংবা এই বিরাট শহরে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি মেলে না। অন্তত এ—পাড়ার মেয়েদের দেখলে ওর তাই মনে হয়। কিন্তু এই মেঘ—থমথমে সন্ধেবেলায় যখন সব ছাদ খালি হয়ে গেছে তখন ওই মেয়েটি ঘাড় বেঁকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে অমন করে কী দেখছে? খুব বিষণ্ণ সময় এলেই মানুষ অমন ভঙ্গিতে দাঁড়াতে পারে। মেয়েটিকে এর আগে সে কখনও দেখেনি। ওই হলুদ বাড়িটার ছাদে প্রায় সময় এক বিশাল চেহারার ফরসা মহিলা ঘোরাফেরা করেন। মেয়েটি মাথা নামিয়ে কিছু ভাবল, তারপর এদিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই কী হল কে জানে, এক ছুট লাগাল মেয়েটি, আর দেখা হল না। অনিমেষ হেসে ফেলল। তপন থাকলে বলত, বালিকা জানে না যে ও মরে গেছে। এই সময় ছটফটিয়ে বৃষ্টিটা নামল। জানলা বন্ধ করে আলো জ্বালল অনিমেষ।

এই ঘরের অন্য খাটটায় থাকে ত্রিদিব— ত্রিদিব সেনগুপ্ত, জামশেদপুরের ছেলে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অথচ বাংলা কবিতা লেখে। ত্রিদিবের বিছানার দিকে তাকালেই বোঝা যায় ওর বেডকভারটা খুব দামি, একরাশ নীল রঙের পাখি সেখানে ভিড় করে আছে; দেওয়ালে আঁটা হুকে ত্রিদিবের যেসব জামাকাপড় ঝুলছে সেগুলো ওর পারিবারিক সাচ্ছল্যের সুন্দর বিজ্ঞাপন। ওর টেবিলের কোণে যেসব প্রসাধনদ্রব্য তা কলকাতায় আসার আগে অনিমেষ দেখেনি। অনিমেষ দেওয়ালে টাঙানো ত্রিদিবের আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। কলকাতার জল পেটে পড়লে মফস্‌সলের মানুষ নাকি ফরসা হয়ে যায়। অনিমেষ নিজেকে সুন্দর দেখল। সামান্য বড় চুল, খুব অল্প এবং কালচে গোঁফদাড়ি মুখের আদল পালটে দিয়েছে। চোখ আর নাকে আলো পড়তেই চট করে ক’দিন আগে দেখা ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। যুবক রবীন্দ্রনাথের মুখ কি এরকম দেখতে ছিল? ভাবতে গিয়েই লজ্জা পেল সে, দ্যুৎ, রবীন্দ্রনাথের গায়ের রং ভগবানের মতো ছিল।

কলকাতায় দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর হয়ে গেল। কলেজের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সময়টা কম নয় কিন্তু অদ্ভুত নির্জনতা নিয়ে এখনও সে কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেল। কলেজে থাকার সময় সে বাবার আদেশ পুরোপুরি মেনে চলেছে। জলপাইগুড়ি থেকে নিয়মিত দুটো চিঠি প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন নির্দেশ নিয়ে তার কাছে আসে। একটা ঠাকুরদা সরিৎশেখরের, অন্যটা বাবা মহীতোষের। প্রথমবার এই কলকাতায় আসামাত্রই যে ঘটনাটা ওর শরীর—মনে ছাপ রেখেছিল পাকাপাকিভাবে তার কাঁপুনি থেকে নিজেকে সরাতে সময় লেগেছিল অনেকদিন। ফলে ওই সব চিঠিগুলোর নির্দেশ মান্য করা ছাড়া ওর কোনও উপায় ছিল না। আর তাই এই কলেজের সময়টা অদ্ভুত নিঃসঙ্গ হয়ে কলকাতায় কাটিয়ে দিল।

এই হস্টেল মূলত কলেজ—ছাত্রদের, কিন্তু প্রাক্তন, যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তারা ইচ্ছে করলে থাকতে পারে। সেই সুবাদে অনিমেষের এখানে থাকা। ত্রিদিব এখানে নতুন এসেছে। ও কলকাতার বাইরে যে কলেজ থেকে পাশ করেছে সেই কলেজ আর অনিমেষদের কলেজ একই মিশনারিদের সংস্থার অন্তর্গত। তাই প্রাক্তন ছাত্র না—হয়েও ওর এখানে থাকতে কোনও অসুবিধে হয়নি। মিশনারি হস্টেল বলেই প্রতি বছর বেশ কিছু বিদেশি ছাত্র কলকাতায় পড়তে এসে এখানে থাকে; হস্টেলের অর্ধেক তারাই। বেশির ভাগ আফ্রিকার, কিছু বর্মা মুলুকেরও আছে। আফ্রিকার ছেলেদের ভাবভঙ্গিতে কোনও সংকোচ নেই, বিদেশে আছে বলে মনে হয় না। বিশাল চেহারাগুলো নিয়ে সবসময় হইচই করছে। প্রথম প্রথম ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত অনিমেষ। যে—কোনও আফ্রিকানকে দেখলেই আঙ্কল টমকে মনে পড়ে যায়। ক্রীতদাস করে রেখেছিল সাদা মানুষেরা এই সেদিন পর্যন্ত অথচ ওদের হাবভাবে সেসব কষ্টের কোনও চিহ্ন নেই। আর একটা স্মৃতি চট করে অনিমেষের সামনে উঠে আসে। আসাম রোডে ছুটে যাওয়া মিলিটারি কনভয়ের নিগ্রো অফিসারটার মুখ যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। লোকটা এখন কোথায় আছে কে জানে। আমরা কাউকে অকারণে মনে রেখে দিই চিরকাল, যার হয়তো আমাদের মনে রাখার কোনও কথাই নেই।

শব্দ করে বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে। অনিমেষ দরজা খুলে ভেতরের বারান্দায় এল। হস্টেলের অনেক ঘর বন্ধ, খোলা দরজাগুলো থেকে আলো এসে বাইরের বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। ইউ প্যাটার্নের এই বাড়িটার মাঝখানের বাস্কেটবল কোর্টটা অন্ধকারে ডুবে আছে। ও পাশের একটা ঘর থেকে মাউথ অর্গানের সুর ভেসে আসছে। টানা এবং কান্নার সুর। আন্তরিক না—হলে এরকম বাজানো যায় না। কোনও চেনা গান বা পরিচিত ভঙ্গি সুরটায় নেই। নিশ্চয়ই ওটা ওইসব আফ্রিকানদের কেউ বাজাচ্ছে, হাজার হাজার মাইল দূরে এসে যার খুব কষ্ট হচ্ছে দেশের জন্য কিংবা ফেলে আসা কোনও মানুষের কথা সে ভাবছে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে হল ছেলেটিকে একবার দেখে আসে। মুশকিল হল ওদের দেখলে সে চট করে আলাদাভাবে চিনতে পারে না, কেউ খুব লম্বা, মোটা অথবা রোগা এইভাবে বুঝতে হয়। তিনতলার বারান্দা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে সেই ঘরটার সামনে এল অনিমেষ। একটু সংকোচ হচ্ছিল, গায়ে পড়ে কথা বলতে কেমন যেন লাগে।

ঘরের ভেতর ছেলেটি একা চিতপাত হয়ে খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে। বেশ ঢ্যাঙা চেহারা, জুতো সুদ্ধু পা দুটো খাটের বাইরে ঝুলছে। ঘরটা দারুণ অগোছালো, সাজগোছ করার কোনও চেষ্টাই নেই। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সে ফিরে আসছিল এমন সময় ছেলেটি বাজনা থামিয়ে উঠে বসে বলল, ‘হে—ই!’ কথাটা জড়ানো, মানে না—বুঝলেও অনিমেষ অনুমান করল যে তাকেই কিছু বলছে ছেলেটি। পরমুহূর্তেই এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল ছেলেটি, ‘গেট ইন, প্লিজ!’

এবার বুঝতে পারলেও অনিমেষ লক্ষ করল ওর উচ্চারণে একটা মোটা আওয়াজ এমন জড়িয়ে থাকে যেটা অন্য শব্দগুলোকে স্পষ্ট হতে দেয় না। অনিমেষ ভেতরে ঢুকতেই চকচকে সাদা দাঁতে হাসল ছেলেটি, ‘ইয়া—!’

ওর আসার কারণটা বোঝাতে গিয়ে বিপদে পড়ল অনিমেষ। মনে মনে দ্রুত ইংরেজি করে নিয়েও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না সে। সংকোচ হচ্ছিল ইংরেজিটা ভুল হতে পারে! শেষ পর্যন্ত সহজ রাস্তাটা বেছে নিল অনিমেষ, আঙুল তুলে মাউথ অর্গানটাকে দেখাল। ছেলেটি যেন খুব খুশি হয়েছে এমন ভঙ্গিতে বাদ্যযন্ত্রটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে ফের লুফে নিয়ে বলল, ‘য়ু লাইক ইট?’

‘ইয়েস!’ অনিমেষ ধাতস্থ হল, তারপর জুড়ে দিল, ‘ভেরি সুইট।’

‘থ্যাঙ্কু! ইটস মাই ফ্রেন্ড। মাদার গেভ ইট। সিট ডাউন, সিট হেয়ার প্লিজ।’

ওর টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে খাটের পাশে রেখে সে অনিমেষকে ইঙ্গিত করল বসার জন্য।

এর আগে ইংরেজিতে কখনও কথা বলেনি অনিমেষ। জলপাইগুড়িতে যখন ছিল তখন এ—প্রশ্ন উঠতই না। ত্রিদিব যখন বাংলা হিন্দি বলতে বলতে নিজের অজান্তে অনর্গল ইংরেজি বলে যায় তখন সেটা লক্ষ করেছে অনিমেষ। অনেক শব্দ যার অর্থ অন্যরকম ছিল, ব্যবহারে তার চেহারা পালটে যায়। এই যেমন ছেলেটি তাকে ভেতরে আসার জন্য বলল, গেট ইন। অনিমেষ নিজে গেট কথাটা ভাবতেই পারত না, বলত কাম ইন। অথচ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য গেট আউট তো স্বচ্ছন্দে মনে আসে। জলপাইগুড়ির বাঙালি স্কুলে ইংরেজি ভাষাটা যেভাবে শিখিয়েছে তাতে নিজের মতো করে কথা বলা যায় না। এই মুহূর্তে সে বিব্রত হয়ে পড়ছিল।

চতুর্দিকে ছেলেটির রংবেরঙের জামাকাপড় ঝুলছে। ওর রুমমেটটি এখনও বোধহয় ফেরেনি। কেউ যে রঙিন জাঙিয়া পরে জানা ছিল না অনিমেষের। চেয়ারে বসে ছেলেটিকে ভাল করে দেখল সে। চামড়ার রং কালো হতে হতে তা থেকে কেমন নীলচে জেল্লা বেরুচ্ছে। চোখ দুটো ছোট, মাথার চুলে চিরুনি বোলানো অসম্ভব, এত কোঁকড়া এবং পাক খাওয়া বোধহয় চুল আঁচড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। শরীর ওর বেতের মতো হিলহিলে, সামান্য মেদ নেই কোথাও।

‘আই অ্যাম থম্বোটো। রিয়েল গ্ল্যাড টু সি অ্যান ইন্ডিয়ান ইন মাই রুম।’

চকচকে সাদা দাঁত একবার ঝিলিক খেল। এই প্রথমবার, সে যে ইন্ডিয়ান তা কেউ অনিমেষকে বলল। তার হঠাৎ খেয়াল হল থম্বোটোর মাতৃভাষা ইংরেজি নয় অতএব সামান্য ভুলভাল হলে নিশ্চয়ই সে গ্রাহ্য করবে না। অনিমেষ নিজের নাম বলল, এখন কিছুটা স্বচ্ছন্দ হয়েছে সে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি তো স্কটিশেই পড়ো?’

‘হ্যাঁ, বি. এসসি ফার্স্ট ইয়ার, তুমি?’

‘আমি এম. এ—তে অ্যাডমিশান নিয়েছি, এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। আর্টস।’

‘ও গড, তুমি তা হলে আমার সিনিয়ার, বাট য়ু লুক সো ইয়াং।’ অবাক চোখে তাকে দেখছিল থম্বোটো। সত্যি কি তাকে এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বলে মনে হয় না? কী জানি। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে কেমন লাগছে তোমার?’

‘ভালই। তবে ওই মশলা দেওয়া খাবারগুলো যদি না—থাকত! দ্যাটস হরিবল। আমার স্টমাক প্রায়ই গোলমাল করছে, এ ম্যান ক্যান নট লিভ অন মেডিসিন। তুমি হস্টেলে থাকছ কেন, তোমার বাড়ি এখানে নয়?’

‘না। আমি এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে ডুয়ার্স বলে একটা জায়গা থেকে এসেছি।’

‘সেটা কি ভারতবর্ষ নয়?’

‘কেন নয়? এই পশ্চিমবাংলারই একটা অংশ।’

থম্বোটো চট করে টেবিল থেকে একটা বড় ভারতবর্ষের ম্যাপ সামনে বিছিয়ে বলল, ‘শো মি হোয়ার ইট ইজ!’

অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে পশ্চিমবাংলার মাথায় জলপাইগুড়ি লেখা অঞ্চলটায় আঙুল রাখল। ও দেখল আলিপুরদুয়ার এবং ফালাকাটা ম্যাপে লেখা আছে কিন্তু স্বর্গছেঁড়ার উল্লেখ নেই। থম্বোটো জায়গাটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, ‘এ জায়গা তো হিমালয় পর্বতমালার নীচে, তুমি কি পাহাড়ি মানুষ?’

‘না, না, আমি বাঙালি!’ হেসে ফেলল অনিমেষ।

‘স্ট্রেঞ্জ! তোমাদের এই ভারতবর্ষে স্নো—রেঞ্জ আছে, সমুদ্র আছে, মরুভূমি আছে, আবার ডিফারেন্ট টাইপ অফ পিপল উইদ ডিফারেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজেস একসঙ্গে বাস করছ, কেউ বাঙালি কেউ পঞ্জাবি আবার সকলেই ইন্ডিয়ান, তোমাদের কোনও অসুবিধে হয় না? কী করে তোমরা ইউনাইটেড হলে?’ জানবার আগ্রহ থম্বোটোর মুখে।

অনিমেষ এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ‘আমাদের চেহারা এবং ভাষা আলাদা হলেও কালচারের কোথাও কোথাও এবং ধর্মের মিল রয়েছে। তা ছাড়া ইতিহাস বলে, বারবার বিদেশি—আক্রমণ হয়েছিল আমাদের ওপর। বোধহয় আক্রান্ত হলেই ইউনিটি গড়ে ওঠে।’

মন দিয়ে কথাটা শুনে থম্বোটো বলল, ‘বাট দেয়ার আর হিন্দুস অ্যান্ড মুসলিমস, ক্রিশ্চিয়ানও কম নেই। এরা তো কমপ্লিট আলাদা ধর্মের মানুষ এবং প্রত্যেকের মানসিকতা আলাদা, তাই না?’

অনিমেষ একটু থতমত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ধর্ম তো ঘরের ব্যাপার, বাইরে আগুন লাগলে সেটা ঘরে রেখেই মানুষ আগুন নেবাতে বেরিয়ে আসে।’

হাসল থম্বোটো, ‘তাই যদি হয় তোমরা এত বছর ব্রিটিশকে থাকতে দিলে কেন? খুব দেরিতে হলেও অবশ্য তোমরা ব্রিটিশকে তাড়াতে পেরেছিলে আর এইটে আমাদের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশগুলোকে সাহায্য করেছিল।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে অনিমেষ বলল, ‘হ্যাঁ, ওরা আমাদের হাতে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছে।’

বিস্মিত হল থম্বোটো, ‘ফ্রিডাম কেউ কাউকে দেয় না, ফ্রিডাম আর্ন করতে হয়। তুমি কি বলতে চাইছ তোমরা ফ্রিডাম আর্ন করোনি?’

কথাটা অনিমেষকে হঠাৎ উত্তেজিত করে ফেলল। স্কুল জীবনের শেষ দিকে সুনীলদা যে সব নতুন ব্যাখ্যা ওকে শুনিয়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কে, কলকাতায় আসার পর হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সেই শোনা ব্যাখ্যাকে আরও দৃঢ় করেছে। সে বলল, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম বিভিন্ন পথে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা আমাদের দিয়ে গেছে। রক্ত না—দিলে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না আর যদি তা পাওয়াও যায় তা হলে সে স্বাধীনতা সম্পর্কে দেশের মানুষের মমতা থাকে না।’ এই প্রথম অনিমেষ প্রকাশ্যে এসব কথা বলল। এতদিন এইসব বিষয় ওর ভাবনায় ঘোরাফেরা করত। কিন্তু এখন বলার সময় ওর মনে হল নিজের দেশের এইরকম দুর্বল জায়গা নিয়ে একজন বিদেশির সঙ্গে আলোচনা করা ঠিক হচ্ছে না। থম্বোটো তার নিজের দেশের সমস্যা নিয়ে কোনও কথা বলেনি। এসব কথা বললে ও নিশ্চয়ই ভুল বুঝবে এবং সেটা ওর দেশের মানুষ জানুক তা কাম্য নয়। অনিমেষ গলার স্বর পালটে বলল, ‘এর মধ্যে অনেকগুলো বছর গেছে, এবার আমরা পুরনো ভুলগুলো শুধরে নেব। এবার তোমার কথা বলো, আমরা একই পৃথিবীতে থাকি অথচ তোমাদের দেশের খবর ভারতবর্ষের মানুষ কিছুই জানে না।’ থম্বোটো বলল, ‘ওয়েল, আমাদের দেশ খুবই গরিব এবং বড়লোকেরা যাকে বলে আনডেভেলপড বোধহয় তাই। প্র্যাকটিক্যালি আমরা আফ্রিকানরা এত ছোট ছোট স্টেটে ডিভাইডেড যে—।’

ঠিক এ সময় একজন খর্বকায় মানুষ দরজায় এসে দাঁড়াল। সর্বাঙ্গ ভেজা, পোশাক থেকে টুপটাপ জল ঝরছে, মুখ চোখে খুব বিরক্তি। একে অবশ্য অনিমেষ কয়েকবার দেখেছে, এর মতো বেঁটে এবং রোগা এ হস্টেলের কোনও আফ্রিকান নয়। তবে এর গায়ের রং নিকষ কালো নয় বরং তামাটে ভাবটাই বেশি। মোটা নাক এবং পুরু ঠোঁট থাকা সত্ত্বেও একটা আলগা শ্রী আছে। মাথার চুলে একটু বেশি স্প্রিং থাকায় বৃষ্টির জলেও এলোমেলো হয়নি। ছেলেটি ঘরে ঢুকে খুব উত্তেজিত হয়ে হাত—পা নেড়ে থম্বোটোকে কী সব বলতে লাগল নিজের ভাষায়। থম্বোটো হাসছে কিন্তু কোনও উত্তর দিচ্ছে না। ছেলেটা পাগলের মতো দু’—তিনবার পাক খেয়েও কথা থামাচ্ছে না। ভাষা ঠাওর না—হলেও অনিমেষের মনে হল ছেলেটি বোধহয় এই ঘরে ওকে দেখে রেগে গেছে। আফ্রিকান ছেলেদের ঘরে কোনও ভারতীয়কে সে আড্ডা দিতে দেখেনি, ওরাও কারও ঘরে যায় না। হঠাৎ ছেলেটি অনিমেষের দিকে তেড়ে এসে উলটোদিকের খাটে বসে তড়বড় করে যে কথাগুলো বলল সেটা যে ইংরেজি ভাষায় তা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লাগল। অনিমেষ দ্বিতীয়বার ওকে উচ্চারণ করতে শুনল, ‘ইউ মাস্ত প্রতেস্ত।’ কীসের প্রতিবাদ করার কথা বলছে ও, বুঝতে না—পেরে অনিমেষ থম্বোটোর দিকে তাকাতেই ছেলেটি একটা আঙুল ওর দিকে উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইউ লিভ দিস হস্তেল?’

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল অনিমেষ। একটু আশ্বস্ত হল এই ভেবে যে ওর রাগের কারণ সে নয়, তা হলে প্রতিবাদ করার কথা বলত না। থম্বোটো এবার কথা বলল। এই ছেলেটি ওর রুমমেট। আজ বিকেলে এক সদ্যপরিচিতা মহিলার সঙ্গে ওর বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বৃষ্টি এসে যাওয়ায় ওরা হস্টেলে ফিরে এসে আড্ডা মারবে ঠিক করেছিল। কিন্তু গেটে যে দারোয়ান আছে সে নাকি বাগড়া দিয়েছে এই বলে যে এখানে নাকি মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। যেহেতু এখন আটটা বেজে গেছে তাই ভিজিটার্স রুমটাও বন্ধ ছিল। থম্বোটোর বন্ধু এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করছে। তারা কেউ বাচ্চা ছেলে নয়, নিজের ভাল—মন্দ বুঝতে জানে, এই ধরনের আইন মেয়েদের হস্টেলে থাকতে পারে কিন্তু ওদের ওপর প্রয়োগ করা মানে রীতিমতো অপমান করা। একটু হেসে থম্বোটো যোগ করল, ‘মহিলাটি আমার বন্ধুর মুখ আর দর্শন করবে না জানিয়ে গেছে।’

থম্বোটোর বন্ধু এতক্ষণ চুপ করে কথাগুলো শুনছিল, এবার চিৎকার করে বলে উঠল, ‘শি টোল্ড মি কি—ড।’

অনিমেষ হেসে ফেলল বলার ধরন দেখে। থম্বোটোর বন্ধু চট করে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত হাতে নিজের জামাকাপড় খুলতে লাগল। গেঞ্জি—টেঞ্জি পরেনি, নির্লোম তামাটে বুক দেখলে কেউ নিগ্রো বলে ভাবতে পারবে না। এর পর সে নির্দ্বিধায় প্যান্টের বোতাম খুলে সেটাকে ছুড়ে দিল ঘরের এক কোনায়। অনিমেষ এতটা আশা করেনি, চট করে একটা অস্বস্তি ওকে বিব্রত করে তুলল। পরিচিত কিংবা অপরিচিত যে—কোনও মানুষের সামনেই এইরকম জামাকাপড় ছেড়ে শুধু জাঙিয়া পরে দাঁড়ানোর কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। এদের কি কোনও সংকোচের বালাই নেই? ওর আশঙ্কা হচ্ছিল এবার হয়তো জাঙিয়াটাও শরীরে থাকবে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ছেলেটি খুব ঘেন্নার সঙ্গে বলে উঠল, ‘ইউ ইন্ডিয়ান আর উইদাউট ব্যাকবোন, কাওয়ার্ড।’ এবার শব্দগুলো বুঝতে এতটুকু অসুবিধে না—হওয়ায় অনিমেষের মাথায় রক্ত উঠে গেল। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেল। ওর শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে, দুটো হাতের আঙুল মুঠোয় ধরে রাখতে পারছে না। অনিমেষের মুখ—চোখের ভাব দেখে ছেলেটি বোধহয় ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। থম্বোটো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ছুটে এসে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরল। ওর বিরাট শরীরের কাছে অনিমেষ এই মুহূর্তে অসহায় হলেও প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছিল। জোর না-খাটিয়ে থম্বোটো বলল, ‘আমার বন্ধুর কথায় কান দিয়ো না, ও ঠিক জানে না কাকে কী বলতে হয়।’ তারপর হেসে বলল, ‘তুমি রাগ করেছ দেখে আমি খুশি হয়েছি।’

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল অনিমেষ। এখন শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। থম্বোটো এসে বাধা না-দিলে ও নির্ঘাত ছেলেটিকে মারত। উনি মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন আর সেটা সমর্থন না-করলে জাত তুলে গালাগাল দেবেন। কোনওরকমে থম্বোটোর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল অনিমেষ। আজ অবধি কখনও কারও গায়ে হাত তোলেনি সে, ছেলেটাকে মারলে ও নিশ্চয়ই কোনও প্রতিরোধ করতে পারত না। ওরকম দুর্বল শরীর নিয়ে এ ধরনের কথা বলার সাহস পায় কী করে! মারতে পারেনি বলে জীবনে এই প্রথমবার আফশোস হল অনিমেষের। বাইরে এখনও সমানে বৃষ্টি পড়ছে। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে, আফ্রিকান ছেলেদের মানসিকতা এরকম হয় কি না কে জানে, তবে থম্বোটোর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল। কয়েক পা এগোতে না-এগোতেই পিছনে ডাক শুনতে পেল সে, ‘হেই, হনিমেস।’

ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখল থম্বোটো আসছে। নিজের নামটার এরকম উচ্চারণ শুনে বিরক্তিটা যেন সামান্য মরে গেল। কাছে এসে থম্বোটো বলল, ‘আমার খারাপ লাগছে। আমার বন্ধুটি কিন্তু খুব নিরীহ, শুধু মেয়েদের ব্যাপারে দারুণ সেনসিটিভ। যা হোক, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভাল লেগেছে, তুমি কি আবার আসবে?’

কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে অনিমেষ রাগ করতে পারল না। সে বলল, ‘আজ থাক, আর একদিন হবে।’ ঠিক এই সময় থম্বোটোর ঘর থেকে একটা উদ্দাম সুর ভেসে এল। মাউথ অর্গানটা যেন ঝড় তুলছে। হেরে যাবে নিশ্চিত জেনে মানুষ যখন মরিয়া হয়ে ওঠে, সুরটা সেইরকম তেজি এবং উদ্দাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওরা বাজনাটা শুনল। এই শব্দ করে বৃষ্টি পড়া রাত্রে যখন সমস্ত হস্টেলটা নিঝুম তখন এইরকম ঝিমঝিমে সুর যেন অবশ করে ফেলছিল ওকে। নিচু স্বরে থম্বোটো বলল, ‘আমার চাইতে অনেক ভাল বাজায় ও, না?’

অনিমেষ কী বলবে ঠাওর না-করতে পেরে নিজের মনে ঘাড় নেড়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগল। যে সুরটা ওর পিছন পিছন আসছিল আচমকা সেটা থেমে যেতেই অনিমেষের মনে হল একটা ভারী নিস্তব্ধতা ওর চারপাশ চেপে ধরেছে। ঘরের শেকল খুলে অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল সে। নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে, এই বিরাট কলকাতা শহরে তার কোনও বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই। আলো না-জ্বেলে ঘরে ঢুকে চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ল সে।

অস্বস্তিটা তবু যাচ্ছিল না। কী সহজে ছেলেটি ওকে গালাগালিটা দিল! থম্বোটো না-থাকলে আজ কী হত বলা যায় না। হঠাৎ মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ায় যে উত্তেজনা সমস্ত শরীরকে কাঁপাচ্ছিল তাতে সে কতখানি আঘাত করতে পারত কে জানে কিন্তু সেটা করতে পারলে বোধহয় এখন ভাল লাগত। একটা ছেলে অত দূর থেকে কলকাতায় পড়তে এসে অমন সামান্য কারণে একটা দেশের মানুষের চরিত্র সম্পর্কে এরকম ইঙ্গিত দিতে যাবে কোন যুক্তিতে?

নিস্তেজ হয়ে অনিমেষ শুয়ে শুয়ে দরজা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল। বারান্দায় জ্বেলে রাখা আলোয় বৃষ্টি মাখামাখি হয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। উত্তেজনা কমে আসায় ক্রমশ এক ধরনের অবসাদ এল। অনিমেষ কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, ইউ ইন্ডিয়ানস আর উইদাউট ব্যাকবোন, কাওয়ার্ড। শব্দগুলো হঠাৎ কেমন নিরীহ হয়ে গেল, সে যেন সামান্য ওপরে উঠে এসে ঝুঁকে পড়ে শব্দগুলোকে দেখতে লাগল। এই তিন বছরে কলকাতা শহরে সে যে জীবন কাটিয়েছে, প্রতিদিনের খবরের কাগজে অথবা চারপাশের যে মানুষগুলোকে নিত্য সে দেখেছে তারা কী ধরনের? জলপাইগুড়ি শহর থেকে সেই প্রথমবার ট্রেনে চেপে আসবার সময় ভারতবর্ষের মাটিতে নতুন কিছু গড়ার জন্য যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে বলে উত্তেজনায় টগবগে হয়েছিল সে, এই কয় বছরে তা কোথায় মিলিয়ে গেছে। এখন এই শহরের মানুষগুলোর দিকে তাকালে মনেই হয় না তারা বা তাদের কেউ কেউ ওসব কথা কখনও ভেবেছিল। গড্ডলিকা প্রবাহ সে বইতে পড়েছিল কিন্তু সেটা কী জিনিস তা এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা না-দেখলে বুঝত না। মেরুদণ্ডহীন কথাটা কি একদম প্রযোজ্য নয়? এখনও ভারতবর্ষের নব্বুই ভাগ মানুষ জানে না যে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। যারা জানে তাদের অনেকের মানসিকতায় ব্রিটিশ শাসন আর স্বাধীন ভারতবর্ষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

তার কলেজে পড়ার ব্যাপারে মহীতোষের সঙ্গে কিছুটা তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। মহীতোষ চাননি যে অনিমেষ স্কটিশচার্চ কলেজে ভরতি হোক। ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে পড়াশুনাটা তিনি পছন্দ করেন না। তা ছাড়া হস্টেলটা যখন কলেজ কম্পাউন্ডে নয় তখন কলকাতার রাস্তায় ছেলেকে হাঁটাচলা করতে দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। প্রায় আট মাস বিছানায় শুয়ে থেকে অনিমেষ খুব কাহিল এবং রোগা হয়ে গিয়েছিল, দ্রুত হাঁটাচলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। একটু নজর করলেই বোঝা যায় যে সে একটা পা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বস্তুত কলকাতার কলেজে পড়তে পাঠানোর ইচ্ছাই চলে গিয়েছিল মহীতোষের। মাসকাবারি রিকশার ব্যবস্থা করে জলপাইগুড়ির বাড়ি থেকে আনন্দচন্দ্র কলেজে পড়ার ব্যাপারেই জোর দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মানুষের সহজে শিক্ষা হয় না, বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনিমেষ যে আরও একগুঁয়ে হয়ে গেছে সেটা প্রমাণ হল তার কলকাতায় পড়তে যাওয়ার জেদে। আর-একবার ঠাকুরদা সরিৎশেখর তাকে সমর্থন করলেন। দুর্ঘটনা বারবার ঘটে না। প্রায় বাধ্য হয়ে মহীতোষ ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় এলেন, এবার একা ছাড়েননি। প্রেসিডেন্সির পাশেই হিন্দু হস্টেল, কিন্তু সেখানে ভরতি হওয়ার চেষ্টা বিফল হল। প্রথম ডিভিশনে পাশ করেও যে কোনও কোনও কলেজে জায়গা পাওয়া যায় না সেটা জেনে হতবাক হয়ে গেলেন মহীতোষ। ফলে কলকাতার তিনটি মিশনারি কলেজের দিকে ঝুঁকলেন মহীতোষ, সেন্ট জেভিয়ার্সে মন মানল না। সব দিক দিয়ে দেখেশুনে সেন্ট পল্‌স আসল জায়গা বলে মনে হল। কলেজের মধ্যেই হস্টেল, রাস্তায় পা দিতে হবে না একবারও। কিন্তু অনিমেষ আকৃষ্ট হল তৃতীয়টিতে। স্কটিশচার্চে বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু পড়েছেন। কে কবে ঘি খেয়েছেন এখন গন্ধ শোঁকার কোনও মানে হয় না— মহীতোষ এই কথাটা বোঝাতে পারেননি। মা-মরা ছেলেরা বোধহয় চিরকাল এরকম জেদি হয়। ছেলের সঙ্গে দু’দিন কলেজে গিয়ে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অসহায় বোধ করেছিলেন তিনি। গাদা গাদা মেয়ে রংবেরঙের পোশাকে জটলা করছে কলেজ চত্বরে, তাদের কারও কারও ভঙ্গি বেশ বেপরোয়া। এখানে ছেলের পড়াশুনা কতদূর হবে সন্দেহ থেকে গেল তাঁর। যে চিন্তাটা তাঁকে আরও বিহ্বল করে দিচ্ছিল তা হল সায়েন্সের বদলে অনিমেষ আর্টসে অ্যাডমিশন নিয়েছে। বাবা হয়ে ছেলেকে ডাক্তার করার বাসনা জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দেখলেন এখানেও অনিমেষের ঠাকুরদার রায়ই শেষ কথা হল। যাওয়ার আগে বারবার তিনি ছেলেকে উপদেশ দিয়ে গেলেন। পড়াশুনা করে ভাল রেজাল্ট করতে হবে। এই কলকাতা শহর নতুন ছেলেদের নষ্ট করে দেবার জন্য ওত পেতে থাকে, অনিমেষ যেন কখনও অসতর্ক না-হয়। কোনও বন্ধুবান্ধবকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না কারণ বিপদের দিনে তারা কেউ পাশে থাকবে না। কলেজের ইউনিয়ন থেকে যেন সে সাত হাত দূরে থাকে কারণ মধ্যবিত্ত সংসারের ছেলের এই বিলাসিতা সাজে না। রাজনীতি যাকে নেশা ধরায় তার ইহকাল পরকাল একদম ঝরঝরে হয়ে যায়। যাদের বাপের প্রচুর টাকা আছে তারাই ওসব করুক, যেমন জওহরলাল, চিত্তরঞ্জন, সুভাষ বোস।

বাবার এসব উপদেশ অনিমেষ মন দিয়ে শুনতে বাধ্য হয়েছিল। সে লক্ষ করেছিল বাবা যখন কথা বলেন তখন তিনি ভুলে যান ভারতবর্ষ এখন স্বাধীন। কিন্তু বাবার একটা কথার সঙ্গে সে একমত, ইতিমধ্যে তার একটা বছর নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মন্টু তপন অর্ক এখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। মানুষের জীবন বড় অল্প সময়ের, তা থেকেও যদি একটি বছর অকেজো হয়ে যায় তা হলে সেটা কম ক্ষতি নয়। অনিমেষ মহীতোষকে কথা দিয়েছিল সে সময় নষ্ট করবে না। তাই বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত সে শুধু দেখে গেছে চারধার। স্কটিশচার্চের ছাত্র ইউনিয়ন অবশ্যই ছাত্র ফেডারেশনের দখলে কিন্তু মাঝে মাঝে মিছিল করা ছাড়া তাদের কোনও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। পৃথিবীর কোন প্রান্তে কী হল তার জন্য ওরা মিছিল বের করে অথচ কলেজের জলের কলটা তিন দিন খারাপ হয়ে ছিল সেদিকে খেয়াল করেনি। অনিমেষ শুধু ওদের দেখে গিয়েছিল এই ক’টি বছর। দ্রুত হাঁটা অথবা শারীরিক উদ্যম ফিরে আসতে যে এতটা সময় লাগবে তা সে ভাবেনি, মনে মনে ভেবে যাওয়া ছাড়া তার কোনও উপায় ছিল না। আশ্চর্য, কেউ তাকে কোনওদিন জিজ্ঞাসা করেনি তার পায়ে কী হয়েছে!

ত্রিদিব কখন এসেছে টের পায়নি অনিমেষ। ঘরে আলো জ্বালতেই চোখে লাগল, হাতের আড়ালে চোখ রাখল। ত্রিদিব একা নয়, সঙ্গে আরও দু’জন এসেছে। খাওয়ার ঘরে ওদের দেখেছে কিন্তু আলাপ হয়নি। এই হস্টেলে দুটো খাওয়ার ঘর, একটা বিদেশিদের অন্যটা ওদের। কে এই নিয়ম চালু করেছিল জানা নেই তবে এখনও তা চলে আসছে। অনিমেষ উঠে বসতে একটা তীব্র গন্ধ পেল। ত্রিদিবরা দাঁড়িয়ে আছে আর ওদের শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়া জলে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। তিনজনেই ভিজে কাক। অনিমেষ ত্রিদিবকে বলল, ‘কী ব্যাপার, বৃষ্টিতে ভিজে এলে, অসুখ করে যেতে পারে।’

ত্রিদিব হাসল। বৃষ্টিতে ভিজলে চুলগুলো এমন নেতিয়ে থাকে যে অনেক সময় মানুষের চেহারা পালটে যায়। ত্রিদিবকে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে, ‘আরে এরকম ফাইন বৃষ্টির মধ্যে রোড দিয়ে হাঁটতে যে কী আরাম তা তুমি বুঝবে না। নিজেকে দেওয়ানা মনে হয়।’

‘কিন্তু নিমোনিয়া হলে কী হবে?’ কথার ভঙ্গিটায় অনিমেষ মজা পেল।

‘কবিদের নিমোনিয়া হয় না। ঈশ্বর কবিদের সিনায় এত রকমের ভালবাসা দিয়েছেন যে সেখানে নিমোনিয়া জায়গা পায় না।’ কথা বলতে বলতে ত্রিদিব নিজের অস্থিরতা লুকোতে পারল না। এবার অনিমেষ লক্ষ করল ওরা তিনজনে ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। ত্রিদিবের গলার স্বরটা একটু অন্যরকম, ‘অনিমেষ, মাই রুমমেট, এদের সঙ্গে তোমার আলাপ আছে? নেই? আমরা এই হস্টেলে থাকি তবু কেউ কাউকে চিনি না, আমরা একই পৃথিবীতে থাকি তবু মানুষের আজও জানাশোনা হল না। এ হচ্ছে দুর্গা— দুর্গাপদ, গোবিন্দ।’ আঙুল দিয়ে দ্বিতীয়জনকে দেখাল ত্রিদিব। গোবিন্দ যার নাম সে যখন কথা বলল তখনই গন্ধটার রহস্য বুঝতে পারল অনিমেষ।

‘তুমি তো গুডি বয়, এখনও মফস্‌সলের আলোয়ান গায়ে জড়ানো!’

কথাগুলো জড়ানো, মদ্যপানের প্রতিক্রিয়া প্রতিটি শব্দে। তার মানে ত্রিদিব এবং দুর্গাপদ মদ খেয়েই এসেছে। গোবিন্দর কথায় বিদ্রূপ থাকলেও অনিমেষ জবাব দিল না। এটা জানা কথা, মত্ত হলে মানুষের চিন্তা-ভাবনা অসংলগ্ন হয়ে যায়, তখন যুক্তি অচল।

সে শুধু ত্রিদিবকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি মদ খেয়েছ?’

কলকাতার এই প্রবাস-জীবনে ত্রিদিবকে গৃহসঙ্গী পেয়ে খুশি হয়েছিল অনিমেষ। ছেলেটা কবিতা লেখে, অন্যরকম কবিতা, মনটা ভাল। অবশ্যই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে কিন্তু আচরণে কোনও চালিয়াতি নেই। শুধু, অনিমেষের ইচ্ছে হোক না-হোক ত্রিদিব ওকে কবিতা শোনাবেই। কিন্তু আজ অবধি ত্রিদিবকে সে মদ্যপান করা অবস্থায় দেখেনি। কেউ মদ খেলেই সেই অনেক বছর আগের দেখা মহীতোষের চেহারাটা ওর সামনে উঠে আসে। মত্ত মহীতোষ আর শীর্ণ চেহারার ছোটমাকে ভুলে গেছে অনিমেষ, তবু—। মানুষ দুঃখ পেলে নাকি মদ খায়, বড়লোকরা মেজাজ আনতে ড্রিঙ্ক করে কিন্তু ত্রিদিবের ক্ষেত্রে তো এ দুটোর কোন প্রয়োজন আছে তার জানা নেই। তা ছাড়া এই হস্টেলের যে নিয়মাবলি দরজায় টাঙানো তাতে এ ধরনের আচরণের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে।

ত্রিদিব কথাটার জবাব না-দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জানলার দিকে। পাল্লা দুটো খুলে দিতে দিতে বলে, ‘কেন, মদ খেতে তোমার খারাপ লাগে? পেটে মদ মাথায় বৃষ্টি— লন্ডভন্ড হয়ে যাক সৃষ্টি। তুমি খাবে?’

‘না।’ নিজের অজান্তেই শব্দটা জোরে বলল অনিমেষ।

‘কেন গুডি বয়? মদ খেলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়?’ গোবিন্দ টিপ্পনী কাটল জড়ানো গলায়। অনিমেষ দেখল দুর্গাপদ জামার তলা থেকে একটা চ্যাপটা বোতল বের করছে। নাক সিঁটকে অনিমেষ বলল, ‘মদ খেলে মানুষ কী হয় আমি জানি, আমার দেখা আছে।’

দুর্গাপদ খিকখিক করে হাসল, ‘অনেকের জামাইষষ্ঠী থাকে না, ভাইফোঁটা নিতে নেই, তোমার বুঝি এরকম ব্যাপার— মদ খেতে নেই!’

ত্রিদিব জানলা খুলে দিতেই হুহু করে বৃষ্টির জল ঘরে ঢুকতে লাগল। অনিমেষ দেখল ওর পড়ার টেবিল জলে ভিজে যাচ্ছে। সে তড়াক করে নেমে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে ত্রিদিবের কাছে বাধা পেল। দু’হাত দু’পাশে বাড়িয়ে ত্রিদিব বলল, ‘নিয়ম না-ভাঙলে নিয়মটাকে বোঝা যায় না, মাই রুমমেট।’

‘আমার বইপত্র ভিজে যাচ্ছে।’

‘কাল আমি শুকিয়ে দেব।’

অনিমেষ লক্ষ করল ত্রিদিব ভাবাপ্লুত অবস্থায় কথা বললে হিন্দি শব্দ একদম বলে না। যেমন কবিতা লেখার সময় ওর হয়। হাল ছেড়ে দিয়ে সে ফিরে আসছিল এমন সময় গোবিন্দ ওর সামনে এসে দাঁড়াল, ‘ইনডাইরেক্ট না ডাইরেক্ট?’ বোতলটা সামনে ধরে সে ইঙ্গিত করতেই অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘আমি খাব না।’

‘তা কি হয়! এক যাত্রায় পৃথক ফল।’

‘আশ্চর্য! আমি না-খেলে তোমরা জোর করে খাওয়াবে নাকি?’

ত্রিদিব এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল, ‘সংস্কার ভাঙার কথা হচ্ছিল না সেদিন, তুমি নিজেই তো সংস্কারগ্রস্ত। নাও, খেয়ে নাও— লাথি মারো বিবেকের মাথায়।’

‘ওটা শস্তা নয়, আমি মরে গেলেও খাব না।’ অনিমেষ ফুঁসে উঠল। হঠাৎ কী হল ত্রিদিবের, ওর চোখ মুখ হিংস্র হয়ে গেল। ধস্তাধস্তি শুরু হল বৃষ্টিভেজা ঘরটায়। অনিমেষ ভাবল চিৎকার করে ওঠে। সুপার ছুটে এলে এদের হাত থেকে বাঁচা যাবেই। কিন্তু তারপর যেটা হবে সেটা ভেবে সে চিৎকার করল না। নিঃশব্দ ছিল বাকি তিনজনই। সে কিছুতেই ওই তিন প্রায়-মাতালের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। প্রচণ্ড শক্তিতে ওরা অনিমেষকে মাটিতে চিত করে ফেলে মুখের মধ্যে মদের বোতল গুঁজে দিল। গলগল করে নেমে আসা বিশ্রী স্বাদের তরল পদার্থটিকে জিভ দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারল না অনিমেষ। উগরে ফেলতে গিয়ে কিছুটা পেটের ভেতর চলে গেল। জ্বলছে গলা— কী দুর্গন্ধ! অনিমেষ শেষবার দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিরোধ আনছিল। গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠল, ‘শালা খাচ্ছে না। ঠিক আছে, ওর শাস্তি হল আগাগোড়া ন্যাংটো করা।’

‘নগ্নতা কবিতা নয় অথবা আরও কিছু বেশি।’ ত্রিদিব বিড়বিড় করে উঠল। ওদের হাত চলছে। দু’জন চেপে ধরেছে অন্যজন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দু’পায়ের প্রতিবাদ সত্ত্বেও অনিমেষের নিম্নদেশ নগ্ন হয়ে গেল। পরবর্তী আক্রমণ কী হবে সেটা ভাববার আগেই একটা অস্ফুট আর্তনাদ শুনতে পেল অনিমেষ।

গোবিন্দ বলছে, ‘আরে ব্বাস, এ শালার থাইতে এত বড় দাগ কীসের?’ চোখ বন্ধ অনিমেষের শরীরে আচমকা সেই যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে পড়ল। সে শূন্যে সামান্য লাফিয়েই মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। ত্রিদিব ওকে ছেড়ে দিয়ে অপারেশনের জায়গাটায় হাত দিয়ে অন্যরকম গলায় কথা বলল, ‘কী হয়েছিল এখানে? কীসের দাগ?’

মুখের ভেতর বিশ্রী স্বাদ, গলা জ্বলছে, সমস্ত শরীরে অবসাদ, অনিমেষ থুতু ফেলার চেষ্টা করে জবাব দিল, ‘বুলেটের।’

1 Comment
Collapse Comments

অনেক সুন্দর পুরাটা জন্য অপেক্ষা আছি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *