২৭. দাসপাড়ার উপনির্বাচনের কংগ্রেসপ্রার্থী

সাতাশ

দাসপাড়ার উপনির্বাচনে কংগ্রেসপ্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন। কলকাতার মানুষ খবরের কাগজের এই সংবাদটাকে তেমন গুরুত্বই দিল না, যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, না-জেতাটাই ছিল আশ্চর্যের। ভোটের ফলাফল বের হলে অনিমেষরা হিসেব করেছিল মোট ভোটের সত্তর শতাংশ বাক্সে পড়েছে। বাকি ত্রিশভাগ যারা ভোট দেয়নি তাদের সমর্থন পেলে কী কাণ্ড হত বলা যায় না। দেখা গেল আগেরবার বিরোধী প্রার্থী যত ভোট পেয়েছিল এবার তা থেকে হাজার খানেক বেড়েছে।

বিমান বা সুদীপ এই নির্বাচন নিয়ে কোনও কথা বলছে না। যা গিয়েছে তার সম্পর্কে ভেবে কিছু লাভ নেই। পার্টির নেতারা নিশ্চয়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ত্রুটিগুলো সামলে নেবেন সামনের বার। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করতে বিমান জবাব দিয়েছিল, ‘পর্যালোচনা চলছে।’

সুবিমলবাবুর ব্যাপারটার পর থেকে অনিমেষ নিজের ভেতরে যেন আর উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছিল না। এই মানুষটির দ্বৈতসত্তার কথা জেনেও পার্টি তাঁকে মূল্যবান বলে মনে করে, কমরেডের সম্মান দেয়, এটা কেমন কথা? ক্রমশই সে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছিল। এখন অভ্যেসবশত ইউনিয়ন অফিসে যায়, কথা শোনে কিন্তু আলোচনায় উৎসাহ পায় না।

এইসময় ভারতবর্ষ আর পাকিস্তান একটা যুগ্ধে লিপ্ত হল। সন্ধের পরই কলকাতা শহর অন্ধকারে ডুবে যায়, তড়িঘড়ি মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে। যে-কোনও মুহূর্তেই পাকিস্তানের বোমারু-বিমান কলকাতার আকাশে দু’-একটা বোমা টুক করে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে। তবে চিনের সঙ্গে যখন গোলমালটা লেগেছিল তখনকার মতো দিশেহারা অবস্থা এখন নয়। মানুষ জানে পাকিস্তান যতই গর্জাক ভারত দখল করার হিম্মত নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতবাসী কংগ্রেস সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে, বহুমুখী বিরোধীরাও মূক হয়ে আছে। তবু যুদ্ধটা ঠিক জমছে না।

এই যুদ্ধ অনেকটাই সাজানো, ফলাফল জানাই আছে— এইরকম বোধ পার্টির নেতাদের থেকে শুরু করে ক্যাডার পর্যন্ত সঞ্চারিত। সাধারণ মানুষও বেশ মজা পেয়ে গেছে। সিনেমা দেখার ভঙ্গিতে কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ে কারণ তারা সবাই জানে পাকিস্তানিরা কখনওই তাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না। কিন্তু যুদ্ধের কারণেই কংগ্রেস সম্পর্কে তিক্ততা ক্ষীণ হয়ে এল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের আঁচ গায়ে লাগল। হুহু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভারতবাসীর মতো সব সইয়ে জাত পৃথিবীতে বিরল। কোথাও কোনও প্রতিবাদ নেই, যেন যুদ্ধ হলে দাম বাড়াটাই স্বাভাবিক কথা। চোখের সামনে মানুষ মানুষকে ঠকাচ্ছে এবং সেটাকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই গ্রহণ করে সবাই। অনিমেষের মনে হয়, সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টেই এ-দেশের মানুষের মেরুদণ্ডটিকে খুলে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন-সাহেব দেশে চলে গেছেন।

যুদ্ধটা যখন থেমে গেল খুব আফশোস হচ্ছিল ওর। পাকিস্তান কেন পূর্ববঙ্গকে ব্যবহার করল না? কেন ঢাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু-বিমান উড়ে এসে কলকাতার ওপর বোমা ফেলল না? যদি কোনও জাদুমন্ত্রে পাকিস্তানি সেনা পশ্চিমবাংলায় ঢুকে পড়ত তা হলে উত্তেজনার আগুন পোয়ানোর বিলাসিতা ছাড়তে হত এ দেশের মানুষকে। নিজস্ব সুবিধের ছকে সাজানো রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা তখন হারিয়ে যেতে বাধ্য হত। প্রতিরোধ শক্তি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেই ওইসব নেতাদের ছুড়ে ফেলতে একটুও সময় লাগত না। এই দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে হলে সশস্ত্র যুদ্ধ চাই। ঘরে আগুন না-লাগলে ঘরের প্রতি ভালবাসা টের পাওয়া যায় না। স্বার্থের পৃথক খোলসগুলোকে চূর্ণ করতে যুদ্ধ চাই, নইলে এই নিরাসক্তির ভান কখনওই ঘুচবে না।

অনিমেষ এখন বিশ্বাস করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কমিউনিস্ট পার্টির নেই। শুধু প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ করলে হয়তো একটা সাময়িক সমর্থন পাওয়া যায় কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সেটিই করা হচ্ছে না। যা কিছু চটজলদি আবেগকে পরিচালিত করে সাধারণ মানুষ তাকেই গ্রহণ করে। এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির তাবড় তাবড় নেতাদের চালচলন কথাবার্তার সঙ্গে বেশিরভাগেরই ব্যক্তিগত জীবনের কোনও মিল নেই। তাঁদের দেখে কোনওরকম অনুপ্রেরণা যদি সাধারণ মানুষ না-পায় তা হলে তাঁদের আদর্শে শ্রদ্ধাশীল হবে কী করে? সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা কমিউনিস্ট পার্টির মতো সুশৃঙ্খল সংস্থা কংগ্রেস নয়। কমিউনিস্ট ক্যাডাররা নিঃস্বার্থ হয়ে নেতাদের হুকুম মেনে নেয়। এরকম শক্তিশালী একনিষ্ঠ কর্মী পেয়ে নেতারা কী করতে চান বোঝা যাচ্ছে না। দলের নীচের তলার কর্মীরা কাজ করে ভাবাবেগে, নেতাদের পদক্ষেপ হিসেব করে। তাঁরা আবেগ আনেন বক্তৃতার সময়, ব্যক্তিগত স্বার্থ হারাতে কেউ বিন্দুমাত্র রাজি নন।

মোটামুটি এই যখন দেশের রাজনৈতিক চেহারা তখন ঘোলাজলে পাক খেয়ে কী লাভ? অদ্ভুত হতাশাজনিত ক্লান্তি ক্রমশ অনিমেষকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই সময় ছাত্র ইউনিয়নগুলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিল। আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করে মনুমেন্ট পর্যন্ত গিয়ে নেতাদের বক্তৃতা শোনা— এই হল আন্দোলনের চেহারা। অনিমেষ দু’দিন কংগ্রেস সরকার নিপাত যাক, খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, দুনিয়ার ভুখা মানুষ এক হও, এক হও স্লোগান দিতে দিতে গিয়েছে মিছিলের সঙ্গে। মাধবীলতাও ছিল সঙ্গে।

মিছিল মনুমেন্টের নীচে পৌঁছালে জায়গাটা একসময় সমুদ্রের চেহারা নিল। বাঁশের খুঁটির ওপর লাল কাপড়ের মঞ্চে নেতারা বসে সেই সমুদ্র দেখছিলেন। মাধবীলতা এই প্রথম এতসব নেতাদের একসঙ্গে দেখতে পেয়ে বেশ উত্তেজিত। এঁরা বিধানসভায় প্রায়ই শোরগোল তোলেন। কিন্তু এই গাঁধীজিমার্কা আন্দোলনে কী ফলবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ এই কথাটুকু বোঝানোর জন্যই যদি এত আয়োজন তা হলে সেটা কি কংগ্রেসি নেতাদের আজ অজানা আছে? তারা যদি সেই তথ্যটিকে উপেক্ষা করতে পারে তা হলে এই মিছিলের বিক্ষোভে কী এসে যায় তাদের। জনসাধারণের প্রাণশক্তির হাস্যকর অপব্যবহার ছাড়া ব্যাপারটা অন্য কিছু মনে হচ্ছে না অনিমেষের কাছে।

পরপর দু’জন নেতা একই ভাষা এবং ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। দেশ আজ বিপন্ন, কংগ্রেসি সরকারের শোষণে দিশেহারা। এই সরকারকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো বলার সময় গলা কাঁপিয়ে, অনেকটা যাত্রার ঢঙে হাত নেড়ে একটা নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে ফেললেন ওঁরা দু’জনেই। কথা বলার সময় আবেগে মাঝে মাঝে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওঁদের চিৎকৃত ভাষণ যখন শেষ হল তখন বঙ্গে বর্গি পালার শেষে যে হাততালি পড়ে তারই অনুরণন মনুমেন্টের তলায় ছড়িয়ে পড়ল। বক্তৃতায় ক্লান্ত নেতাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তাঁরা এইমাত্র ঘরে ঘরে অন্ন বিলিয়ে ফিরে এলেন। সবশেষে যিনি উঠলেন তাঁর জন্যেই জনতা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। এর আগেও দেখেছে সে, আজও দেখল। গানের অনুষ্ঠানে ছোট বড় শিল্পীরা একে একে গেয়ে যান, কোনও চাঞ্চল্য দেখা যায় না শ্রোতাদের মধ্যে। কিন্তু শেষ নামটি যেই ঘোষিত হয় এবং বিখ্যাত শিল্পী যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ান তখন হাততালি পড়ে, যেন এতক্ষণে অনুষ্ঠানটি সার্থক হল।

এখন যিনি বলতে এলেন তাঁরও সেই ইমেজ। উনি যখন বলেন তখন যুক্তি দিয়ে বলবেন এটাই সবার ধারণা। এর আগের মিটিং-এ উনি প্রথমে বলেছিলেন বলে বাকি বক্তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কারণ তাঁদের কথা শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি।

জনতাকে নড়েচড়ে বসতে দেখে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, ‘চিনতে পারছ ওঁকে?’

মাধবীলতা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। বেশ ব্যক্তিত্ব আছে, না?’

অনিমেষ বলল, ‘অন্তত যাত্রা করবেন না এটা বলা যায়।’

মাধবীলতা বলল, ‘তুমি অমন বেঁকা বেঁকা কথা বলছ কেন? তোমাদের পার্টির নেতা না?’

অনিমেষ তর্ক বাড়াল না। শুধু মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে বক্তৃতায় মন দিল। খুব শান্ত ভঙ্গি, প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করেন। আবেগের বাড়াবাড়ি নেই। যেটা বলছেন তা কেন বলছেন তা ওঁর জানা আছে। স্বভাবতই কংগ্রেসি সরকারকে আক্রমণ করে উনি কথা বলছিলেন। কিন্তু একসময় অনিমেষের মনে হল উনি খুব ভাল কথাশিল্পী। সুন্দর সাজানো কথা বিশ্বাসযোগ্য করে বলেন কিন্তু কোনও ধরাছোঁয়ার মধ্যে যান না। তাঁর কথায় এমন একটা জাঁকজমক আছে যে লোকে সেইটে বুঝতেই পারে না। আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় কারাবরণ এবং তারপরে বাংলা বন্ধ।

ধর্মতলা থেকে ফেরার সময় অনিমেষ সিদ্ধান্ত নিল এই রাজনীতি থেকে সে কিছুদিন সরে থাকবে। দশহাজার লোককে পুলিশ এসপ্লানেড ইস্ট থেকে ধরে বাসে করে খিদিরপুরে নামিয়ে দিলে কী ধরনের রাজনৈতিক লাভ হয় তা ওর মাথায় ঢুকবে না। এই কি কারাবরণ? অথবা সারা দেশ একদিনের জন্য অচল করে মোক্ষ লাভ হবে? এতে কি মনে হবে দেশের মানুষ তাদের পাশে আছে? এখনও যখন সাধারণ মানুষ মনে করে কমিউনিস্টদের ভোট দিলে তারা দেশটাকে রাশিয়া কিংবা চিনের হাতে তুলে দেবে! পার্টির মধ্যে ইতিমধ্যেই বিরোধ শুরু হয়েছে। বেশ কিছু সক্রিয় কর্মী নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিরাগের পাত্র হয়েছেন। পার্টির মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা চলছে এ সংবাদ বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। অনিমেষ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, এম এ পরীক্ষাটা দিয়ে দেওয়া যাক মন দিয়ে কিছুদিন পড়াশুনা করে।

মৌলালির মোড়ে হেঁটে এসে মাধবীলতা বলল, ‘ভীষণ টায়ার্ড লাগছে, কোথাও বসি চলো।’

অনিমেষ দেখল মেয়েটার মুখটা কালো হয়ে গেছে, চোখের তলায় বেশ কালি। ওর হঠাৎ মনে হল মাধবীলতার এই চেহারা সে কোনওদিন দেখেনি। মুখের মধ্যে একটা খসখসে ভাব এসে গেছে, চাহনিতে ক্লান্তি বোঝা যায়।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

মাধবীলতা ভ্রূ কুঁচকে সেই চাহনিটা ব্যবহার করল, ‘আমার! কী হবে?’

অনিমেষ বুঝতে পারল মাধবীলতা যদি নিজে থেকে কিছু না-বলে তা হলে শত চেষ্টা করেও ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা জানা যাবে না।

মাধবীলতা হাসল, ‘কী থেকে কী কথা! বললাম কোথাও চলো বসি, না তোমার কী হয়েছে! বসতে চাইলেই কিছু হতে হয় বুঝি!’

অনিমেষ একটা ছোটখাটো চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে বলল, ‘চলো এখানে বসি। তবে শুধু চা খেতে হবে।’

মাধবীলতা বলল, ‘সেটা আমি বুঝব।’

দোকানটা নিচু ধরনের। অবস্থা যে ভাল নয় তা চেহারা দেখেই মালুম হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারা আড্ডা মারছিল তারা বেশ উৎসুক চোখে ওদের দিকে তাকাল। অনিমেষ সেটা দেখেও গা করল না। একটা ছোঁড়া এলে মাধবীলতা তাকে দুটো করে টোস্ট আর চা দিতে বলল। তারপর অনিমেষের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কিন্তু আজকাল সব কথা আমার কাছে বলো না!’

‘কী কথা?’

‘বিমানদের সঙ্গে তোমার ঠিক মিলছে না, না?’

‘কী করে বুঝলে?’ অনিমেষ অবাক হল। এসব কথা ও কখনও মাধবীলতার সঙ্গে আলোচনা করেনি।

‘আমি কি ঠিক বলছি?’

‘মোটামুটি।’

‘যাক। তা হলে তোমাকে বুঝতে আমার ভুল হয় না।’

অনিমেষ মাধবীলতার চোখে চোখ রাখতেই সে মুখ নামিয়ে নিল। কথাটায় এমন সুখ জড়ানো যে তা অনিমেষকেও স্পর্শ করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘আসলে আমি এই দলের কাজকর্ম মানতে পারছি না। এরা যেভাবে চলছে সেভাবে চললে এ দেশে কোনওদিনই কমিউনিজম আসবে না। বুঝেসুঝে অন্ধ হয়ে থাকতে ভাল লাগছে না।’

মাধবীলতা বলল, ‘তুমি কি অন্য কোনও দলে যাবে?’

অনিমেষ বলল, ‘অন্য দল? ধ্যুৎ! সেগুলো তো আরও খারাপ। না, কোনও দলফল নয়, ভাবছি এখন মন দিয়ে পড়ব।’

মাধবীলতা বলল, ‘আমি তোমার রাজনৈতিক ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাই না। তবে একটা অনুরোধ করব। হুট করে কিছু করে ফেলো না। তুমি যদি বিমানদের সঙ্গে সম্পর্ক না-রাখতে চাও তবে ঝগড়া করে নয়, চুপচাপ কোনও সংঘর্ষ ছাড়াই সরে দাঁড়াও। একদিনে করলে সেটা ধরা পড়ে যাবে তাই কয়েকদিন সময় নাও।’ তারপর হেসে বলল, ‘কিন্তু এম এ-র রেজাল্টটা যেন ভাল হয়।’

অনিমেষ বলল, ‘তোমার চেয়ে নিশ্চয়ই ভাল হবে না।’

মাধবীলতা দিয়ে যাওয়া টোস্টের ওপর গোলমরিচ ছড়াতে ছড়াতে বলল, ‘আমার বোধহয় পরীক্ষা দেওয়াই হবে না।’

চমকে উঠল অনিমেষ, ‘সেকী! কেন?’

মুখ না-তুলে মাধবীলতা বলল, ‘ওসব ছেড়ে দাও। বাড়িতে চিঠি দিয়েছ?’ চোয়াল শক্ত হল অনিমেষের। কিছুক্ষণ ধরেই ও বুঝতে পারছিল মাধবীলতার কিছু হয়েছে, যার জন্য ওকে চিন্তা করতে হচ্ছে খুব এবং তার ছাপ পড়েছে চোখমুখে। এতদিন ব্যাপারটা লক্ষ করেনি বলে সে নিজের ওপরই বিরক্ত হল। খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি যদি কিছু না-বলতে চাও তা হলে আমার পক্ষে এসব খাওয়া অসম্ভব।’

হেসে ফেলল মাধবীলতা, ‘ওমা! কী ছেলেমানুষ! এখন কি আর রাগ করে খাবার নষ্ট করার বয়স আছে! খোকা কোথাকার!’

‘ইয়ারকি মেরো না। তুমি যদি না-চাও তা হলে অবশ্যই তোমার ব্যাপারে আমি কথা বলব না। কিন্তু সেটাই জানা দরকার।’ অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা বলল, ‘অমনি রাগ হয়ে গেল!’

অনিমেষ বলল, ‘আমাকে কি এতই অপদার্থ ভাবো যে রাগ করবার যোগ্যতাও নেই!’ টেবিলের ওপর দুই কনুই, হাতের ওপর চিবুক, মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে সামলাতে পারল না। বুকের মেঘ কখন যে টুক করে জল হয়ে চোখে গড়ায় তা যদি বোঝা যেত আগেভাগে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘এটা চায়ের দোকান!’

দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চট করে দু’চোখ সামলে নিল মাধবীলতা। কিন্তু তার ভেতরটা ঠান্ডা হতে সময় লাগল আরও কিছুক্ষণ। ওরা নীরবে টোস্ট খেয়ে চায়ের কাপে হাত দিল। অনিমেষ কোনও কথা বলছিল না। মাঝে মাঝে তার মাধবীলতাকে এত গভীর মনে হয় যে সে হাজার চেষ্টা করেও ডুব দিয়ে তল দেখতে পাবে না। চটুল হালকা টাইপের মেয়েদের সহজেই উপেক্ষা করা যায় কিন্তু মাধবীলতাকে নয়।

চা খেয়ে দাম দিল মাধবীলতা। তারপর রাস্তায় নেমে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বাবার জন্যই বোধহয় আমার এম এ পরীক্ষা দেওয়া হবে না!’

‘মানে?’

‘উনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি ওঁকে বলেছি এসব চিন্তা ছাড়তে। আমার মুখে এরকম কথা উনি আশা করেননি। ফলে অগ্নিকাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেছে। যা ইচ্ছে তাই বলছেন! আমাকে এখান থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছেন। যে পাত্রটিকে ওঁরা নির্বাচিত করেছেন সে বোধহয় আমার কথা শুনে হাতছাড়া হয়ে গেছে, ফলে আরও দিশেহারা অবস্থা। আমি বলেছি পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করতে কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে তা করবে না।’ মাধবীলতা মাথা সোজা করে হাঁটছিল। যেন কথাগুলোর মধ্যে নিজের অবস্থাটাকে জরিপ করছিল।

অনিমেষের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। সে মাধবীলতার জন্য কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। না, যে-কোনওভাবেই ওর এম এ পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

‘কিন্তু, কেন ওঁরা এমন করছেন?’

‘ওঁরা আমার ভাবগতিক দেখে ভাল বুঝছেন না তাই।’ হাসল মাধবীলতা, ‘বোধহয় বুঝতে পেরেছেন আমি মনের দিক থেকে একা নই।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘কোনও পিতামাতাই মেয়েদের নির্বাচনের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। সবসময় ভাবে এই বুঝি বোকামি করল!’

‘তুমি আমার কথা ওঁদের বলেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী বললেন ওঁরা?’

‘নাই বা শুনলে। শোনো, আমি গত রবিবার একটা স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়েছি। আমার এক বন্ধুর দিদি ওই স্কুলে কাজ করে। যদি চাকরিটা হয়ে যায় তা হলে বেঁচে যাব।’

‘তুমি চাকরি করবে? পড়াশুনা করবে না?’

‘সে পরে দেখা যাবে। প্রাইভেটেও পরীক্ষা দেওয়া যায়। হয়তো চাকরিটার জন্যই দিতে হবে। সেসব এখনই ভাবছি না। এখন যেটা সমস্যা হল সেটা হল একটা ভাল হস্টেল। তোমার জানাশোনা কোনও হস্টেল আছে?’ মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘না। তবে হস্টেলের খোঁজ নিতে পারি। কিন্তু তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে?’

মাধবীলতা দাঁড়িয়ে পড়ল। দু’পাশে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড়, হকারের চিৎকার। তারই মধ্যে স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি চাইছ না বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে আসি?’

‘তুমি কি যথেষ্ট ভেবেছ?’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি।’

অনিমেষ একটুও ভাবল না। বলল, ‘ওঁরা তোমাকে জোর করে অন্য কোথায় পাঠিয়ে বিয়ে দেবেন এটা আমি মানতে পারি? কিন্তু এতদিনের পরিচিত পরিবেশ আর আত্মীয়স্বজন ছেড়ে তুমি একা হস্টেলে এসে উঠবে— এ ব্যাপারে তোমার কোনও দ্বিধা আছে কিনা তাই জানতে চাইছিলাম। নিজের কাছে পরিষ্কার হলে পৃথিবীতে কে কী মনে করল তাতে কিছু এসে যায় না।’

‘আমার সবকিছু পরিষ্কার যদি তুমি পাশে থাকো। আমি কোনও অন্যায় করিনি। বাবা যদি না-মানতে পারেন তা হলে সেটা দুঃখের। আমি তো হস্টেলে একা থাকছি না! তুমি তো আছ। তুমি কখনও আমায় ফেলে না-গেলেই হল।’ মাধবীলতা হাসল। আত্মবিশ্বাস এবং লজ্জা একসঙ্গে চলকে উঠল যেন।

অনিমেষ বলল, ‘বড্ড আফশোস হচ্ছে।’

মাধবীলতা ঘাড় বেঁকাল, ‘কেন?’

‘নিজেকে খুব অপদার্থ মনে হচ্ছে। তুমি যখন এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছ তখন আমার হাতে এক ফোঁটা জোর নেই। এখনও আমি বাবার পাঠানো টাকার ভরসায় থাকি। আমার উচিত তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচানো, কিন্তু দেখো, শুধু কথা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারছি না। দেখি, কী করতে পারি।’ শেষের কথাটা একটু চিন্তা-জড়ানো গলায় বলল অনিমেষ।

মাধবীলতা বলল, ‘এই, তুমি কি চাও আমি এখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদি?’

‘মানে?’

‘আর একবার ওইসব কথা বললে আমি এমন সিন করব যে মজা বুঝবে!’

‘কিন্তু—।’

‘কোনও কিন্তু নয়। আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি এম এ পাশ করে—।’ না-ভেবে কথাটা শুরু করে হঠাৎ থেমে গেল মাধবীলতা।

‘থামলে কেন?’ হাসল অনিমেষ, ‘বাংলায় এম এ পাশ করে কেউ চাকরি পায় না। আমি পরীক্ষা দেব দু’-তিন জন মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করতে। কিন্তু চাকরি যদি করতে হয় তা হলে বি এ পাশের ডিগ্রিটাই যথেষ্ট। তা ছাড়া, যদি বলি রাজনীতি করতে চাই লোকে আমাকে হাম্বাগ ভাববে। যেন ওটা করার জিনিস নয়। এককালে যারা সিরিয়াসলি কমিউনিস্ট পার্টি করত, গণনাট্য করত, এমন কয়েকজনকে আমি জানি কী দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা সারাজীবনে চাকরি পাননি। অবস্থা যদি না-পালটায় তা হলে এ দেশে যারা রাজনীতি করতে চায় তারা হয় না-খেয়ে মরবে কিংবা চোরাপথে টাকা নিয়ে বিত্তশালী হবে। দ্বিতীয়টি আমার দ্বারা হবে না। অতএব আমার সঙ্গে ভাগ্য জড়িয়ে হয়তো তুমি সারাজীবনের জন্য পাকাপাকি অশান্তি ডেকে আনলে।’

মাধবীলতা খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। শেষ হলে বলল, ‘আমি এখন কোনও কথা বলব না। যদি চাকরিটা পাই তা হলে এর জবাব পাবে। আমি যা করব তা করেই দেখাতে চাই। আগে থেকে লম্বাচওড়া কথা বলে কোনও লাভ নেই। শুধু তুমি আমার একটাই কাজ করে দাও, এ মাসের মধ্যে একটা ভদ্র হস্টেল খুঁজে দাও। চাকরিটা যেহেতু দক্ষিণেশ্বরের দিকে, নর্থে হস্টেল হলে ভাল হয়।’

ওরা হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদা স্টেশনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আজ হঠাৎ মাধবীলতাকে ওর ভীষণ আপন মনে হচ্ছে। এই মেয়েটা শুধু অনিমেষের জন্যই তার সবরকম নিরাপদ জীবনের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে এর চেয়ে বড় অহংকার আর তার কী আছে! কিন্তু এ-কথাটা ভাবলেই নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। তার সামনে কত কী করার আছে অথচ সে কিছুই পারছে না। একজন প্রেমিক হিসেবে যেমন একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তেমনি, কোনও ফারাক নেই। দুটো হাত আছে কিন্তু তাতে একটাও আঙুল নেই। ক্রমশ একটা অপদার্থ ছাড়া নিজেকে অন্য কিছু মনে হচ্ছে না।

ট্রেনে উঠে মাধবীলতা বলল, ‘শোনো, একদম মাথা গরম করবে না। সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দাও।’

‘সবকিছু মানে? আমি সুদ্ধু?’

‘আমার সব তো তুমিই।’

ট্রেন চলে গেলে অনিমেষ যখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছিল তখন তার পা ভারী, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে হঠাৎ। মাধবীলতার শেষ কথাটা অন্য সময় শুনলে নিজেকে সম্রাট মনে হত, আনন্দে বুকের ভেতরটা আশ্বিনের সকাল হয়ে যেত। কিন্তু এখন, এখন সে খুশি হতে পারছে না কেন? সেই যে দুপুরটা যার শরীরে রোদ নেই, মরা আলো ন্যাতানো, মাথায় মেঘের জলজ ছাতা, সময়টা যেন কাটতেই চায় না, ঠিক সেইরকম লাগছে।

হস্টেলে ফিরেই শুনল তাকে কে একজন ডাকতে এসেছিল। দারোয়ান নাম বলতে পারল না। বলল, সাহেব ওপরে গিয়েছিলেন। সাহেব? অনিমেষ অবাক হল। কোনও সাহেবের সঙ্গে তো তার আলাপ নেই। নিজের ঘরের তালা বন্ধ। অনিমেষ এদিক ওদিক দেখল। কে এসেছিল না-জানলে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতার বাড়ি থেকে কেউ আসেনি তো? ওর বাবা? অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল। যদি তিনি আসেন তা হলে সে কি তর্ক করবে না ভদ্রলোককে বোঝাবে যে তিনি মেয়ের ওপর ভুল করছেন!

ঠিক সেইসময় তমাল ঘর থেকে বেরিয়ে ওকে দেখে বলে উঠল, ‘কখন ফিরলে?’

‘এই তো।’

‘তোমার কাকা এসেছিলেন।’

‘কাকা?’

তমাল আবার ঘরে ফিরে গিয়ে একটা কার্ড বের করে এনে ওর হাতে দিল, ‘অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। বলেছিলেন আগামীকাল সকালে যেন তুমি অবশ্যই যাও। গ্র্যান্ড হোটেলে আছেন।’

অনিমেষ চকচকে কার্ডটায় দেখল, প্রিয়তোষ মিটার লেখা, আর কিছু নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *