চৌত্রিশ
খুব দ্রুত কাজ শুরু হয়ে গেল। শুধু পশ্চিমবাংলা নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের কিছু মানুষ যারা এতকাল টুকরো টুকরো ভাবনা চিন্তা করছিল তারা ক্রমশ পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে ব্যগ্র হয়ে উঠল। তলায় তলায় যে উত্তাপ জন্ম নিচ্ছে তার খবর চাপা থাকল না। কিন্তু ব্যাপারটার বাস্তবতা সম্পর্কে শাসকদল এবং কমিউনিস্ট পার্টির যথেষ্ট সন্দেহ থাকায় ওরা তেমন আমল দিচ্ছিল না। কিন্তু ক্রমশ বাতাস ভারী হয়ে আসছিল।
অনিমেষের ওপর নির্দেশ ছিল যে-কোনও মুহূর্তে অ্যারেস্ট এড়ানোর জন্যে তৈরি থাকতে এবং বিকল্প থাকার ব্যবস্থা করে রাখতে। এখন পর্যন্ত পুলিশ তাকে সন্দেহ করছে এমন ভাবার কোনও কারণ দেখে না অনিমেষ। এম. এ. পরীক্ষা এসে গেল বলে। অথচ পড়াশুনা হচ্ছে না বললেই হয়। পার্টির কাজে অনেক সময় কুড়ি ঘণ্টাই কেটে যাচ্ছে আজকাল। মাঝে মাঝে রাত্রে হস্টেলে ফেরাই হয় না। এ ব্যাপারে কাউকে কৈফিয়ত দেবার নেই বলেই বাঁচোয়া। বিভিন্ন গ্রুপ মিটিং-এ তাকে থাকতে হচ্ছে। মহাদেববাবুর ইচ্ছে অনিমেষ উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলোর দায়িত্ব নিক। এ ব্যাপারে অবশ্য অনিমেষেরও আপত্তি নেই। কিন্তু এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। শিলিগুড়ি ইউনিট এখন বেশ জোরদার হয়েছে। মোটামুটি ভাবে একই চিন্তাভাবনার শরিক মানুষগুলোর সঙ্গে অনিমেষের আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছে।
শিলিগুড়ির কিছু দূরে একটি স্থান নির্বাচন করা হয়েছে মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। একদিকে ভারতবর্ষ, অন্যদিকে পাকিস্তান আর এক পাশে নেপাল। ভৌগোলিক বিচারে গেরিলা বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স হবার পক্ষে অতি উপযুক্ত জায়গা। দুটি বিদেশি রাষ্ট্র থাকায় কতগুলো বিশেষ সুবিধে পাওয়া যাবে। এলাকার চতুর্দিকে জঙ্গল এবং নদী, পার হলেই নেপাল। মোটামুটিভাবে ওখানকার অধিবাসীরা কৃষিজীবী, বাঙালি বর্ণহিন্দু সংখ্যায় অল্প। এক ধরনের তেজি ভাব আছে মানুষের আচার ব্যবহারে। এলাকাটির নাম নকশালবাড়ি।
নকশালবাড়ি ফাঁসিদেওয়া খড়িবাড়ি অঞ্চলে কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। কৃষকদের সশস্ত্র করে ওই এলাকাকে মুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার কাজ গোপনে চলেছে। চিনের মতো কেবলমাত্র গ্রামেই মুক্তাঞ্চল গঠন এবং তারপর গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও-এর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশের কোনও একটি জায়গা যদি লাল অঞ্চল বলে চিহ্নিত হয় তখন অন্যান্য অংশের নিষ্পেষিত কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবেই। ওদিকে অন্ধ্রের ওয়ারাঙ্গেলের জঙ্গল এলাকায় ঠিক একই উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লবী বাহিনী সংগঠিত হয়েছে। এসব সত্ত্বেও একটা বিশেষ অভাব অনুভূত হচ্ছিল। আসন্ন বিপ্লবের কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য একজন সর্বভারতীয় বিশ্বাসযোগ্য নেতা এগিয়ে আসছিলেন না। একজন লেনিন বা মাও সে তুং, হো চি মিন কিংবা ফিডেল কাস্ত্রো দূরের কথা, চোখের সামনে চে গুয়েভারার মতো সংগ্রামী পুরুষের অভাব চোখে ঠেকছিল। অনিমেষরা মনে করে নেতা বিপ্লব তৈরি করে না, বিপ্লবই নেতার জন্ম দেয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কর্মী বিভিন্ন রাস্তার কথা ঘোষণা করতে লাগলেন। মতবাদের নানারকম ব্যাখ্যায় দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মীরা কিছুটা থমকে পড়ছিল যার পরিণতিতে দলের মধ্যে বিভিন্ন উপদল গড়ে উঠল। অবশ্য এ-কথা ঠিক তখন কোনও দল হিসেবে সংগঠন পূর্ণতা পায়নি। তবু শাখাগুলো চোখে পড়তে লাগল। একজন সর্বভারতীয় অবিসংবাদিত নেতার অভাব সবাই এক মুহূর্তে অনুভব করছিল।
কীভাবে বিপ্লব শুরু হবে, বিপ্লব চলাকালীন দলের ক্রিয়াকলাপ কী স্তরে থাকবে? যেহেতু নকশালবাড়ি আন্দোলন কৃষিভিত্তিক আন্দোলন তাই শ্রমিকদের সঙ্গে এর সংযোগ কীভাবে সাধিত হবে? এ ধরনের তত্ত্বগত প্রশ্ন অনেকের মনে জাগছিল। কিন্তু অনিমেষরা এ নিয়ে বেশি ভাবছিল না। শ্রেণিশত্রু যে সে যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে বিনা দুর্বলতায়। কোনওরকম আপস করা চলবে না। বিদেশে নির্বাচিত গেরিলাদের পাঠিয়ে সমরশিক্ষায় শিক্ষিত করে নিয়ে এসে গেরিলাবাহিনী সংগঠিত করতে হবে। একটা যুদ্ধ জয় করতে হলে বিরাট বাহিনী নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায় যদি তার উপযুক্ত রণকৌশল না-থাকে। ইতিহাসে এর প্রমাণ ভূরি ভূরি মেলে। সঠিক রণনীতি থাকা সত্ত্বেও রণকৌশলের অক্ষমতার কারণে বিপ্লব মাথা থুবড়ে পড়েছে। ১৯১৭ সালের রাশিয়া বা মাও সে তুং-এর চিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের মূল কারণ সঠিক রণকৌশলের পরিকল্পনা। এই রণকৌশল যে সবসময় তাত্ত্বিক পথেই চলবে তা মনে করার কোনও কারণ নেই। বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বিপ্লবের প্রয়োজনেই তার রূপ নির্ধারিত হবে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে লেনিনের অভ্যুত্থানের আহ্বান কিংবা মাও সে তুং ১৯১৭-১৮ সালে দলের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মার্ক্সবাদী প্রথাগত রণকৌশলের পরিবর্তে গ্রামে গ্রামে মুক্তাঞ্চল গঠন করার যে ডাক দিয়েছেন তা এই সত্যতাই প্রমাণ করে। অনিমেষরা এই রণকৌশলের ব্যাপারে তত্ত্বের সঙ্গে কোনওরকম আপস করবে না বলে ঠিক করল, যদি তা বিপ্লবকে থিতিয়ে দেয়। ফলে পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে অন্য মতবাদের সঙ্গে চাপা রেষারেষি সে অনুভব করছিল। কিন্তু যাই হোক না কেন, একটা বিশ্বাস প্রত্যেকের মধ্যে ছিল, একবার যখন চাকা গড়াবে তখন সমস্ত হাত এক হয়ে তাকে মদত দেবে। মতবাদ যাই হোক না কেন, এ-কথা তো ঠিক সবার মূল লক্ষ্য হল ভারতবর্ষে সর্বাত্মক বিপ্লব যা রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পালটে দেয়।
কলকাতা শহরের আশেপাশে ছোট ছোট দল তৈরি হয়ে গেল। একদিকে দমদম সিঁথি বরাহনগর বেলঘরিয়ায়, অন্যদিকে বেলেঘাটা যাদবপুর টালিগঞ্জ এলাকায় কাজকর্ম জোরদার হতে লাগল। সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ এখন অস্থির। সরকারের চাপানো লেভির চাপে বড় বড় জোতদাররা কংগ্রেস সম্পর্কে বিমুখ হচ্ছে। একজন বর্ষীয়ান কংগ্রেসি নেতাকে দল থেকে বিতাড়িত করায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওই নামে পালটা দল গঠন করেছেন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসিদের নিয়ে। সারা দেশের জোতদাররা তাঁকে সমর্থন করছে। সাধারণ জনসাধারণ জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, আইনশৃঙ্খলার অভাবে বিপর্যন্ত। অনিমেষরা বুঝতে পারছিল, এই সময়েই কাজ শুরু করা উচিত। এখন এগিয়ে গেলে সাধারণ মানুষকে সহজেই সঙ্গে পাওয়া যাবে।
বেলঘরিয়াতে আজ গ্রুপ মিটিং ছিল। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই সভাগুলো করতে হয়। এতদিন পুলিশের ভয় ছিল, এখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও ভয়ের কারণ হয়েছে। একটা গোপন ষড়যন্ত্র চলছে। এ খবর তারাও টের পেয়েছে। হয়তো এখনও বিশ্বাসযোগ্য নয় কিন্তু স্বস্তিও হচ্ছে না। আজকের মিটিং-এ অনিমেষরা স্থির করল এলাকা দখল করতে হবে। একটা রাস্তা থেকে একটা পাড়া এবং সবশেষে সমগ্র এলাকা দখলে নিয়ে আসতে হবে। পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যাওয়া হবে না। তবে পুলিশি অত্যাচার শুরু হলে গেরিলা কায়দায় তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এখন বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর বোমা তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি দমদমে একটা গোপন ডেরায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ হয়ে দুটি ছেলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। সেখানে হানা দিয়ে পুলিশ প্রচুর বোমা ও মশলা বাজেয়াপ্ত করার পর তাদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। কলকাতার পাঁচটি গোপন কেন্দ্রে পাইপগান তৈরি হচ্ছে অনবরত। পাকিস্তান যুদ্ধের কিছু মালপত্র ব্ল্যাকমার্কেটে রয়ে গেছে। সেগুলো কিনতে হলে ভাল টাকাপয়সা দরকার। প্রতি এলাকায় যথেষ্ট সম্পন্ন পরিবারগুলোর কাছ থেকে চাঁদা চাওয়া হবে। তবে কোনও অবস্থাতেই দরিদ্র সাধারণ মানুষকে যাতে বিরক্ত করা না-হয় এই বলে সতর্ক করে দিল অনিমেষ। কিন্তু এলাকা দখল করতে গেলে প্রথম প্রতিরোধ করবে রাজনৈতিক দল। এখন শহরতলির এইসব এলাকা তথাকথিত কমিউনিস্টদের দখলে। পাকিস্তান থেকে আসা বাঙালিরা কলকাতার এইসব অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন স্বাধীনতার পর থেকেই। তাঁরা নিঃস্ব অবস্থা থেকে আবার যখন মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছেন তখন কংগ্রেস সরকার সম্পর্কে অনেক ক্ষোভ জমছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাঁদের সমর্থন গেছে। বিধান রায়ের আমলে কংগ্রেস নির্বাচনের সময় এই আসনগুলোকে বাদ দিয়েই তাদের জয়ের হিসেব করত। অতএব এইসব এলাকার কমিউনিস্ট সংগঠন কখনও স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব হস্তান্তর করবে না। এ ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ এড়ানো যাবে না। মিটিং-এ একটি ছেলে প্রশ্ন তুলল, ‘অনিমেষদা, বোমা ছোড়া কিংবা পাইপগান চালানো অভ্যেসের ওপর নির্ভর করে। আমরা খবর পাচ্ছি অ্যাকশন শুরু হলে কিছু ছেলে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইবে। এই ছেলেরা এতকাল সমাজবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এককালে এরা অনেকেই কংগ্রেসের পোষা গুন্ডা বলে চিহ্নিত কিন্তু নিজেদের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে যাওয়ায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এদের কি নেওয়া ঠিক হবে?’
কয়েকদিন আগে মহাদেবদার সঙ্গে এ-ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে অনিমেষের। যারা সমাজবিরোধী হিসেবে পরিচিত তাদের আন্দোলনে নিলে সাধারণ মানুষ ভুল বুঝতে পারে। উত্তরে মহাদেববাবু দলের একজন তাত্ত্বিক নেতার বক্তব্য জানিয়েছিলেন, ‘আন্দোলন শুরু হলে কে ভাল কে মন্দ বিচার করা যথেষ্ট বোকামি হবে। মূল লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে যে-কোনও হাতের সাহায্য নিতে হবে। যারা সমাজবিরোধী বলে পরিচিত তাদের মধ্যে এক ধরনের বন্য-শক্তি কাজ করে, যেটাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করলে কল্পনাতীত ফল পাওয়া যায়। কোনও একটা মহৎ কাজে অংশ নিচ্ছি এই বোধ একবার ওদের মনে সঞ্চারিত হলে ওরা আমাদের গর্ব হয়ে দাঁড়াবে।’ কথাটা অনিমেষ মিটিং-এ বুঝিয়ে বলল। যদিও এ-ব্যাপারে তার নিজেরই কিছু দ্বিধা আছে তবু এখানে সে প্রকাশ করল না। ছেলেটি এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু কোনওরকম রাজনীতি-সচেতনতা ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা মুনাফা লুটবার জন্য ব্যগ্র এই ছেলেগুলো যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তা হলে আমাদের পক্ষে বিরাট ক্ষতি হয়ে দাঁড়াবে না?’
অনিমেষ হাসল, ‘সারা ভারতবর্ষের মানুষ যদি আজ বিপ্লবে অংশ নেয় তা হলে কি আমরা তাদের পরীক্ষা করব যে তারা রাজনীতি-সচেতন কিনা? মার্ক্সবাদ না-বুঝলে বিপ্লবে অংশ নেবার কোনও অধিকার নেই এইরকম শর্ত রাখব কি? আর বিশ্বাসঘাতকতার কথা উঠলে তার সম্ভাবনা তো সব ক্ষেত্রেই হতে পারে। অত্যন্ত শিক্ষিত, মার্ক্সবাদে দীক্ষিত নেতারা কি ঠিক সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি? সে ঝুঁকি তো আমাদের নিতে হবেই। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি অশিক্ষিত মানুষ এবং আপাত চোখে যাদের সমাজবিরোধী বলা হয় তাদের থেকে মুখোশ পরা শিক্ষিত মানুষের চরিত্র অনেক বেশি তরল হয়।’
শেষ প্রশ্ন হল, ‘প্রতিরোধ যদি মার্ক্সবাদী দলগুলো থেকেই আসে তবে তাদের মোকাবিলা করতে হলে বলপ্রয়োগ করতেই হবে। এই ঘটনা কি বিপ্লবের ক্ষতি করবে না?’
উত্তর দিতে অনিমেষ একটুও ভাবল না। নিজের বুড়ো আঙুলটা ওপরে তুলে ধরে বলল, ‘যদি কোনও বিষাক্ত ঘায়ে এটিতে পচন ধরে তা হলে তাকে কেটে ফেলতে আমি একটুই দ্বিধা করব না। নিজের আঙুল বলে মায়া দেখালে কয়েকদিন পরে সমস্ত শরীরটায় পচন ধরবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের চাইতে সংশোধনবাদীরা আমাদের কাছে বেশি ক্ষতিকর।’
এলাকা দখল করতে হলে কী কী করতে হবে তার বিশদ পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়া হল। কোনওমতেই হঠকারিতা করা চলবে না। এবং দলের সংকেত না-পেলে কেউ এমন কাজ করবে না যা অন্যের সন্দেহ উদ্রেক করবে।
মিটিং শেষ করে বাইরে বেরিয়েই অনিমেষের মাধবীলতার কথা মনে পড়ল। এই জায়গাটা থেকে ওর বাবার বাড়ি এমন কিছু দূরে নয়। অথচ সেই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা আর একবারও এখানে ফিরে আসেনি। মাধবীলতা অনিমেষের সঙ্গে কথা বলার সময় ভুলেও এইসব প্রসঙ্গ তোলে না। এসব ব্যাপারে অত্যন্ত শীতল হয়ে গেছে সে।
এখন প্রত্যহ দেখা করার সুযোগ বা সময় হয় না। মাধবীলতার দৈনিক রুটিন অনিমেষের জানা। সময় পেলেই সে সেখানে হাজির হয়। অনিমেষ লক্ষ করেছে তাকে দেখামাত্র মাধবীলতার মুখ কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ওই মুখটির জন্যে পৃথিবীতে অনেক কাজ করে যাওয়া যায়। অনিমেষের নতুন চিন্তাধারার কথা মাধবীলতা জানে। যে মেয়ে এককালে বলত, আমার বড় ভয় করে, সে এখন খুব বদলে গেছে। এখন সে চুপচাপ ওদের কাজকর্মের কথা শোনে।
বেলঘরিয়া থেকে বেরিয়ে মানিকতলায় আসার কথা ছিল। মহাদেবদা রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের একটা বাড়িতে থাকবেন। খুব জরুরি দরকার। যাদের সঙ্গে মিটিং করছিল এতক্ষণ তাদের একটি ছেলে ওকে সাইকেলে করে বি. টি. রোডে পৌঁছে দিয়ে গেল গলিপথে। চারধারে এখন নির্বাচনের হাওয়া লেগে গেছে। সাধারণ মানুষের ধারণা এবারও কংগ্রেস জিতবে। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অবশ্য কেউ এখন ভালমন্দ ধারণা করতে পারছে না, তবু নেহরু পরিবারের ওপর সারাদেশের একটা অন্ধ ভরসাবোধ আছে। সেই সুবাদেই জয় সম্পর্কে ওরা নিশ্চিন্ত। সাইকেলে আসতে আসতে অনিমেষ নির্বাচনের পোস্টার দেখছিল। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট প্রার্থী তাঁর প্রচারের সমর্থনে লেনিনের বাণী ব্যবহার করেছেন। এই ব্যাপারটাই অনিমেষের কাছে বিস্ময়ের মনে হয়। যা বিশ্বাস করি না, যে সব কথা জীবনে কখনও প্রয়োগ করব না তাই দেওয়ালে, পোস্টারে লিখে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করব নির্বাচিত হবার বাসনায়। এইসব লেখার পাশে নতুন লেখা এখন কারও চোখে না-পড়ে থাকছে না। অনিমেষও দেখল নির্বাচনী পোস্টারের পাশে প্রায়ই জ্বলজ্বল করছে— পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়। নির্বাচন বয়কট করুন। সাধারণ মানুষ এখনও মুখ না-খুললেও বাতাসে একটা চাপা উত্তেজনা ক্রমশ জমছে এটা টের পাওয়া যায়।
মানিকতলার মোড়ে নেমে রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে হেঁটে এল অনিমেষ। এটা ওর পুরনো পাড়া। কলকাতায় এসে এখানকার হস্টেলে উঠেছিল স্কটিশে পড়ার সময়। অনেকগুলো বছর কেটেছে এখানে। এই পাড়াটা সেইরকমই রয়ে গেছে, শুধু হস্টেলের সেই ছেলেরা আর নেই। লাহাবাড়ি ছাড়িয়ে বাঁদিকের দোতলা বাড়ির দরজায় টোকা দিল সে। রাস্তাটা এখন খালি। সবে সন্ধে হয়েছে কিন্তু কোনও কারণে পথের আলো জ্বলেনি। অনিমেষ দেখল দরজার ডান দিকে একটা কলিং বেলের বোতাম রয়েছে। কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। বর্ণনা অনুযায়ী যে সে ঠিক বাড়িতেই এসেছে তাতে কোনও ভুল নেই। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করেই সে আবার শব্দ করতে ওপরের ব্যালকনি থেকে একজন ঝাঁজিয়ে উঠল, ‘কাকে চাই?’
‘আমি অনিমেষ।’
ওপরে তাকিয়ে পরিচয় দিতেই ভদ্রলোক মিলিয়ে গেলেন। তার কয়ের মুহূর্ত বাদেই সেই মানুষটি দরজা খুলে ওকে ভেতরে আসতে ইঙ্গিত করলেন। একতলার পেছন দিকের ঘরে মহাদেবদারা বসে আছেন। সুবাসদাও রয়েছে। সেই পোস্টার মারার রাতের ঘটনার পর সুবাসদার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অনিমেষ সে প্রসঙ্গ তুলবে ভাবতেই মহাদেবদা চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একা এলে?’
‘একাই তো! কেন বলুন তো?’
‘কাউকে দেখোনি পেছনে আসতে?’
অনিমেষ অন্যমনস্ক ছিল কিন্তু পেছন পেছন কেউ এলে নিশ্চয়ই টের পেত সে। একটু চিন্তা করে সে বলল, ‘চোখে পড়েনি।’
‘কিন্তু এই গলিতে একজন আছে; তোমাকে যে এখানে আসতে নিষেধ করব তারও তো কোনও উপায় ছিল না। ঠিক আছে, বেলঘরিয়াতে কেমন কাজ হল আজ?’ মহাদেবদা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ভাল। খুব সিরিয়াস ছেলে সব। হুলিগানদের দলে নেবে কিনা প্রশ্ন করেছিল।’ অনিমেষ জানাল।
‘নিতেই হবে। রিস্ক থাকছে বটে, এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। আর হুলিগান কারা? যারা বোম মারছে, ছিনতাই করছে, তারাই আবার কোনও গরিব বৃদ্ধার জন্য প্রাণ দিয়ে লড়ে যাচ্ছে। তাই এখন আর ওসব নিয়ে কিছু চিন্তা করা উচিত নয়।’
মহাদেবদা কথা শেষ করে সুবাসদার দিকে তাকালেন। সুবাসদা একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘অনিমেষ, আমাদের কাছে খবর এসেছে তুমি ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছ। সামহাউ পুলিশ তোমার খবর জেনে গিয়েছে। তোমার আর ওই হস্টেলে থাকা উচিত নয়। যে-কোনও মুহূর্তেই তোমাকে অ্যারেস্ট করতে পারে।’
‘আপনাদের খবর ঠিক আছে?’
মহাদেবদা বললেন, ‘আমাদের খবর যেমন পেয়ে যাচ্ছে ঠিক ওদের কিছু কিছু খবরও আমরা পাচ্ছি।’
খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এ-কথা সত্যি। দেশজুড়ে যে একটা আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে এ খবর এখন সরকারের জানা। সাধারণ মানুষও যে এ ব্যাপারে অজ্ঞ তা বলা চেল না। যেহেতু কংগ্রেসি সরকার নানান ঝামেলায় বিব্রত তাই অনিমেষদের সুবিধে হচ্ছে। একজন বিখ্যাত গান্ধীবাদী নেতাকে দল থেকে বিতাড়িত করেছে প্রদেশ কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রীর খাদ্যনীতি অনুযায়ী সারা দেশের জোতদাররা এখন কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছেন। তাঁরা ভিড় করেছেন দলচ্যুত গাঁধীবাদী নেতার চারপাশে। নতুন দল গড়ে উঠেছে তাঁর নেতৃত্বে। তবু পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে এ-কথা বলা যাবে না। খবরের কাগজে পুলিশ কর্তৃক উগ্রপন্থীদের ডেরা আবিষ্কার— এসব খবর প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। পরিস্থিতি অবশ্যই নিশ্চিন্তের নয়।
অনিমেষ হাসল, ‘আপনাদের সাজেশন কী?’
সুবাসদা বলল, ‘তোমার থাকার বিকল্প ব্যবস্থা আছে?’
‘না। দু’-একজন বন্ধুর মুখ মনে পড়ছে অবশ্য।’
‘তাদের কারও কাছে আজ রাত্রে থেকে যাও। হস্টেলে ফিরো না।’
‘কিন্তু আমার জিনিসপত্র তো ওখানে পড়ে আছে।’
‘ওগুলোর কথা পরে চিন্তা করা যাবে।’
মহাদেবদা বললেন, ‘অনিমেষ, তোমার এখন কলকাতা থেকে চলে যাওয়া দরকার। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আগে থেকেই চিন্তা করছিলাম। এটাই মনে হয় উপযুক্ত সময়। তুমি উত্তরবাংলায় চলে যাও। ওখানে টেনশন কম থাকবে, মনের মতো কাজ করতে পারবে আর পুলিশের ঝামেলা থেকে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘ সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেছে?’
মহাদেবদা বললেন, ‘হ্যাঁ।’
‘কবে যাবে?’
‘আজ নয় কাল। শিলিগুড়ির স্টেশনপাড়ায় একজনের সঙ্গে দেখা করবে। তাকে সব খবর দেওয়া হয়ে গেছে। হি উইল টেল ইউ এভরিথিং।’
‘আজ রাত্রে রওনা হওয়ার একটু অসুবিধে আছে।’ কথাটা বলার সময় মাধবীলতার মুখ মনে পড়ল অনিমেষের। ওকে একটুও না-জানিয়ে হুট করে চলে যাওয়াটা অত্যন্ত অন্যায় হবে।
‘কালই যেয়ো। এই সময়টা বাইরে বেশি ঘুরে বেড়িয়ো না। উত্তরবাংলায় তোমার চেনা এলাকায় কাজ করতে নিশ্চয়ই সুবিধে হবে। তা ছাড়া কলকাতা ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।’
‘আমাদের যোগাযোগ থাকবে কী করে?’
‘সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সুবাস যাচ্ছে বীরভূমে, আগামী মাসে বোলপুরে একটা গোপন মিটিং আছে। খবর পাবে, তখন দেখা হবে। আচ্ছা, আজ আর রাত কোরো না।’ মহাদেবদা ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে রাস্তাটা দেখতে বললেন।
অনিমেষ বলল, ‘সুবাসদা, আমায় যদি কালই চলে যেতে হয় তা হলে হস্টেলের জিনিসপত্রগুলোর কী হবে? আমি তো আজ—।’
‘একটা ঠিকানা দাও, পৌঁছে দেওয়া হবে।’
অনিমেষ এক মুহূর্ত চিন্তা করে মাধবীলতার ঠিকানাটা দিল। সুবাসদা বলল, ‘ওটা তো গার্লস হস্টেল, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ অনিমেষ সুবাসদার মুখে চোখ রাখল, কোনও ভাবান্তর দেখতে পেল না।
রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিট এখন ফাঁকা। কোথাও রেডিয়ো বাজছে তারস্বের। অনিমেষ ওর পুরনো হস্টেলের সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। সামনে পেছনে তাকিয়ে সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেল না। মহাদেবদার খবর কতটা সত্যি কে জানে। নাকি তাড়াতাড়ি যাতে সে উত্তরবাংলায় যায় তাই এসব কথা বললেন? সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, না, এরকম ছেলেমানুষি মহাদেবদা করবেন না। আজ রাত্রে কোথায় থাকবে ভাবতে লাগল অনিমেষ। পরমহংসের মুখ মনে পড়ল। ওর বাড়িতে গিয়ে পড়লে নিশ্চয়ই না বলবে না। কিন্তু হস্টেলে ফেরা যে দরকার ছিল। খাটে তোশকের তলায় কিছু টাকা রয়েছে, ওগুলোর প্রয়োজন। অনিমেষ ঠিক করল পরমহংসকে রাজি করাবে তার হস্টেলে গিয়ে সেগুলো নিয়ে আসতে। তমালকে একটা চিঠি লিখে দিলে সে-ই ব্যবস্থা করে দেবে। হস্টেলের সামনে পুলিশ থাকতে পারে কিন্তু তার ঘরের সামনে নিশ্চয়ই কেউ পাহারা দিচ্ছে না। এখন ঘটনা কী দ্রুত মোড় নিচ্ছে অথচ আজ হস্টেল থেকে বেরুবার সময় এসব সে টেরই পায়নি।
আমহার্স্ট স্ট্রিটে এসে অনিমেষ ডান দিকে মোড় নিল। বিবেকানন্দ রোড ধরে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে গিয়ে ট্রাম ধরে পরমহংসের বাড়িতে যাবে। রাত হয়েছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওর টিউশনি শেষ হয়েছে।
অনিমেষ সাবধানে পথ হাঁটছিল। হঠাৎ ওর অস্বস্তি শুরু হল। মনে হল কেউ ওর পেছন পেছন হাঁটছে। ঘাড় ঘুরিয়ে কোনও সন্দেহজনক মুখ দেখতে পেল না সে। হাসল অনিমেষ, মানসিক প্রতিক্রিয়া থেকে এইরকম গোলমেলে চিন্তা আসে। তবু নিশ্চিন্ত হতে সে ফুটপাত পালটাল। একটা পানের দোকানের সামনে গিয়ে পয়সা দিয়ে সিগারেট কিনল। কিনেই চট করে ঘুরে দাঁড়াল। খুব দ্রুত উলটো ফুটপাতের মানুষগুলোকে লক্ষ করতে গিয়ে অনিমেষের চোখ একটি মুখের ওপর স্থির হল। লোকটা চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনিমেষ দৃষ্টি সরাচ্ছিল না। লম্বা, রোগা লোকটা যে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এমনিতে খুব নিরীহ দেখাচ্ছিল তাকে, শুধু কিছুতেই আর এদিকে চোখ ফেরাচ্ছিল না। অনিমেষের তবু সন্দেহ ছিল যে মহাদেবদার কথামতন এই লোকই সেই লোক কিনা। সে হঠাৎ এগিয়ে পাশের কালোয়ারের গলিতে ঢুকে পড়ল। এখানকার হস্টেলে থাকার সময় এই গলি দিয়ে ওরা শর্টকাট করত কলেজে যেতে। দু’পাশে লোহালক্কড়ের দোকান, গলিটাও সরু। দ্রুত পায়ে বেশ কিছুটা গিয়ে ডান দিকে মোড় ঘুরতেই অনিমেষ পেছেন তাকাল। লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ফুটপাত পেরিয়ে গলিতে পৌঁছে গেছে। ওর একটা হাত কোমরের কাছে সতর্ক ভঙ্গিতে রাখা।
অনিমেষ পা চালাল। আর সন্দেহ করার কিছু বাকি থাকল না। পুলিশ তার পেছনে লেগে গেছে। এখন এই লোকটাকে কোনওভাবে না-কাটাতে পারলে পরমহংসের বাড়িতে যাওয়া যাবে না। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সে বিবেকানন্দ রোডে এসে পড়ল। রাস্তাটা পার হয়ে স্কটিশের গলিতে ঢুকে পেছনে ফিরতেই সে লোকটাকে দেখতে পেল। কালোয়ারের গলি থেকে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে। অনিমেষ একটা থামের পাশে নিজেকে গুটিয়ে লক্ষ করতে লাগল। লোকটা দু’দিকের ফুটপাত ভাল করে যাচাই করে রাস্তা পার হচ্ছে। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। অনিমেষ থামটা ছেড়ে পা বাড়াবার আগেই দেখতে পেল রাস্তার এধারে দাঁড়ানো একটা জিপের পাশে গিয়ে লোকটা হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। ওটা যে পুলিশের গাড়ি তা বুঝতে সময় লাগল না। কারণ চার-পাঁচটা পুলিশ গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল। অনিমেষ আর অপেক্ষা করল না। ফুটপাত ধরে সোজা ছুটতে লাগল স্কটিশের দিকে আর তখনই পেছনে হইচই শুরু হল। পুলিশগুলো ছুটছে এবার।
রাস্তাটা বাঁক নিতেই চোখের সামনে লাল বাড়িটা যেন ছিটকে চলে এল। অনিমেষের মনে পড়ল সেই সেন্ধর কথা। স্কটিশ হস্টেলের সেই আফ্রিকান ছেলেটির সঙ্গে ট্যাক্সিতে ওরা একজন মহিলাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছিল। এই মুহূর্তে মহিলার নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। কিন্তু পঁয়ত্রিশ আর চারটে শূন্য — টেলিফোনের এই নম্বরটা মনে করতে একটুও অসুবিধে হল না। একটুও ইতস্তত করল না অনিমেষ। চিৎকার চেঁচামেচিটা এগিয়ে আসছে। এখনই রাস্তায় ভিড় জমে যাবে। সামনে এগুলে লুকোবার কোনও জায়গা নেই। অনিমেষ গম্ভীর মুখে খোলা জায়গাটা পেরিয়ে লাল বাড়িটার ভেতরে ঢুকে আড়ালে দাঁড়াল। পুলিশগুলো সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল খানিক, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে চারপাশে তাকাতে লাগল। ঠিক এমন সময় পেছনে একটা গলা আচমকা কথা বলে ওঠায় অনিমেষ চমকে উঠল। ‘কাকে চাই?’
অনিমেষ দেখল একজন বৃদ্ধ ধুতি ফতুয়া পরে তার দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছুতেই নামটা মনে করতে পারল না অনিমেষ। থম্বোটোর নাম পড়ে পড়ছে, এমনকী ভদ্রমহিলার হাসিও, কিন্তু—। অথচ আর বেশি ইতস্তত করলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। বাইরে বেরুলে আর রক্ষে থাকবে না এ তো স্পষ্ট।
কুলকুল করে ঘামতে লাগল সে। তারপর কোনওরকমে নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ বাড়িতে থ্রি ফাইভ ফোর জিরো ফোন কোন ফ্ল্যাটে জানেন?’
‘টেলিফোন? কী দরকার?’ বুড়োর গলায় সন্দেহ।
‘আমি টেলিফোন অফিস থেকে আসছি।’
মিথ্যে কথাটা খুব দ্রুত অনিমেষের জিভে এসে গেল।
‘অ। দোতলায় বাঁ দিকে। ওই একটিই টেলিফোন আছে এ-বাড়িতে। নাম্বার ফাম্বার জানি না।’ ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন।
অনিমেষ আর দাঁড়াল না। সামনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এল। বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। কলিং বেলে হাত রাখল সে। জলতরঙ্গ বাজল। অনিমেষের মনে হল বুড়োটা যদি এখন বাইরে বের হয় আর পুলিশ যদি জিজ্ঞাসাবাদ করে তা হলে তো আর উপায় থাকবে না। ব্যস্ত হয়ে আবার সে কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে একজন বৃদ্ধা উঁকি মারল, ‘কী চাই?’
আর কী আশ্চর্য ব্যাপার, মুখ খুলতেই নামটা জিভে এসে গেল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘শীলা সেন আছেন?’
‘আপনার নাম?’
‘অনিমেষ মিত্র।’ পরিচয় দিয়েই অনিমেষের মনে হল শীলা সেন হয়তো বুঝতেই পারবেন না সে কে। এত বছরের অদর্শন সেই সামান্য পরিচয়কে ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তাই সে আর একটু জুড়ে দিল, ‘স্কটিশ কলেজের হস্টেলে আমি থাকতাম।’
মিনিট তিনেক অপেক্ষা করতে হল অনিমেষকে। এখন এক সেকেন্ড এক ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। পুলিশগুলো যদি নীচের সেই বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে তা হলে এখানে চলে আসতে পারে। আর শীলা সেন এত দেরিই বা করছেন কেন? যদি ভদ্রমহিলা তাকে চিনতে না-পারেন তো হয়ে গেল। তখন রাস্তায় এমন অবস্থা যে এগিয়ে গিয়ে লুকোবার উপায় নেই আর মাথায় শীলা সেনের কথাও আচমকা এসে গেল।
আধখোলা দরজার সামনে অনিমেষ যখন প্রায় অসহিষ্ণু তখনই আহ্বান এল। মহিলা তাকে ভেতরে আসতে বলল। সাজানো টেবিল-চেয়ার দেখে বোঝা যায় এটাই বসবার ঘর। অনিমেষ তার একটায় বসতে গিয়ে দেখল সেখানে ধুলো পুরু হয়ে আছে। অনেক দিন কারও হাত পড়েনি এখানে। বৃদ্ধা বলল, ‘দিদিমণি এখানে আসতে পারবে না।’ তারপর একটু উদাসী গলায় জানাল, ‘তেনার শরীর খারাপ।’
অনিমেষের নজর বাইরের দরজার দিকে ছিল, শেষ কথাটা শুনে খুব হতাশ হল সে। শীলা যেন যদি অসুস্থ হন তা হলে ভেতরে আসতে অনুমতি দিলেন কেন? এই বাড়িতে কি আর লোকজন নেই? কেমন চুপচাপ চারধার। অনিমেষ বলল, ‘আমি কি ওঁকে দেখতে যেতে পারি?’
‘সে-কথাই তো বলল। আমার সঙ্গে আসুন।’
মাঝখানে একটা অবিন্যস্ত ঘর। কিছু পুরনো দিনের আসবাব। ঘরটা পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অনিমেষের মনে হল কেউ যেন কোনার ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। কিন্তু তার শরীর এত ক্ষীণ যে অস্তিত্ব বোঝার আগে সে তৃতীয় ঘরে প্রবেশ করল।
এমন ঝকঝকে তকতকে ঘর অনিমেষ কখনও দেখেনি। এই বাড়ির চরিত্রের সঙ্গে এই ঘর একদম মানায় না। বৃদ্ধা একটা সোফা দেখিয়ে বসতে বলে অন্য ঘরে চলে গেল। ঘরে কেউ নেই। কোনার দিকে সুন্দর সাজানো বিছানা। বিছানার পাশে একটা স্ট্যান্ডে টেলিফোন। ঘরের সমস্ত দেওয়াল এবং ছাদ প্লাস্টিক রং করা। দেওয়ালের গায়ে লম্বা রঙিন কাবার্ড। এমনকী ঘরের মেঝেতেও রঙিন টাইল সাজানো। এই ঘরের মালিকের শৌখিন মেজাজ এক পলকেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। অনিমেষ সোফায় বসতে যাচ্ছিল এমন সময় পাশের একটা দরজা খুলে গেল। হাউসকোট পরে যিনি ঢুকলেন তাঁকে দেখে চমকে উঠল অনিমেষ। সামান্য কয়েকটা বছরের ব্যবধানে একটি মানুষের চেহারা কি এত দ্রুত পালটে যেতে পারে? অনিমেষ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।
‘কী খবর! এতদিনে মনে পড়ল? ওমা! এ যে দেখছি সোমত্থ পুরুষ হয়ে গেছ!’ শীলা সেন হাসলেন।
অনিমেষ খুব কষ্টে চোখ খোলা রাখছিল। এ কাকে দেখছে সে! হাউসকোটের আড়ালে যে বিশাল শরীরটা পায়ে পায়ে হেঁটে খাটের দিকে এগোচ্ছে তার সঙ্গে থম্বোটোর বন্ধু শীলা সেনের কোনও মিল নেই। মাথায় একটা কালো রুমাল বাঁধা, চোখে গগল্স্। মুখে যেন থোকা থোকা মাংস কেউ ছুড়ে মেরেছে। বীভৎস একটা মাংসের পিণ্ড হয়ে শীলা সেন খাটে বসলেন। বসে আবার হাসলেন, ‘আমাকে দেখে নিশ্চয়ই চমকে উঠেছ?’ মুখের ওপর বাড়তি মাংসের মাঝে পোড়া ভাঁজ হাসিটাকে করুণ করে তুলছিল।
এই সামান্য বয়সে অনিমেষ মানুষের অনেক রকম মুখ দেখেছে। তিস্তার বুকে নৌকোয় বসে অথবা সেই বন্যার সময় রিলিফ দিতে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে গিয়ে অনেক গলিত বিকৃত মুখ তাকে দেখতে হয়েছে। সে সব স্মৃতি এখন আর বুকের মধ্যে কোনও ভয়ংকর ছাপ নিয়ে বেঁচে নেই। কিন্তু এই মুখ তাকে এমন নাড়া দিল যে অনিমেষ চোখ বন্ধ করতে পারলে বড় আরাম পেত।
‘কী হয়েছে আপনার?’ নিজের কণ্ঠস্বর অচেনা ঠেকল অনিমেষের।
‘ও কিছু না। তুমি কেমন আছ?’
‘আমি ভালই! কিন্তু—।’
‘হঠাৎ কী মনে করে?’
‘এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম—।’
‘কী করছ এখন? পড়াশুনা শেষ হয়েছে?’
‘না। বোধহয় শেষ হবে না।’
‘সেকী! কেন?’
‘সে অনেক কথা। কিন্তু আপনার এ অবস্থা কেন?’
‘সেও অনেক কথা।’ বলে হাসলেন শীলা সেন। ঠিক সেই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হতেই অনিমেষ চমকে উঠল। শীলা সেন বললেন, ‘আবার কে এল!’
কয়েক মুহূর্ত বাদেই সেই মহিলা দরজায় এল। ঘরে ঢুকে সোজা শীলা সেনের কানের কাছে মুখ রেখে কিছু বলল। ওই বিকট শরীর নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন শীলা সেন, ‘সেকী! এখন পুলিশ কেন? দরজা খুলেছিস?’
‘না, ফুটো দিয়ে দেখলাম।’ বৃদ্ধার কথা শেষ না-হতেই বাইরে শব্দ হল। এক মুহূর্ত চিন্তা করে আবার উঠে দাঁড়ালেন শীলা সেন। অনিমেষ তখন মাথা নামিয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। সেদিকে তাকিয়ে শীলা সেন বললেন, ‘আমাকে নিয়ে চল, আমি কথা বলব।’
‘তুমি আবার যাবে কেন-!’
‘আঃ, যা বলছি তাই কর।’ শীলা সেন ধমক দিলেন। মহিলা ওঁর হাত ধরলে শীলা সেন পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলেন বাইরের ঘরের উদ্দেশে। কিন্তু হাঁটতে যে ওঁর কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ওঁরা ঘরের বাইরে যাওয়ামাত্র অনিমেষ চট করে উঠে দাঁড়াল।
এখান থেকে অবিলম্বে পালানো দরকার। পুলিশ নিশ্চয়ই এই ফ্ল্যাট সার্চ করবে এখন। সে সাজানো ঘরটার চারপাশে চোখ বোলাল। এই ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বের হবার আর কোনও দরজা আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। বাথরুমের দরজা খুলে সে তার ভেতরে একটা ছোট জানলা দেখতে পেল। জানলাতে কোনও গরাদ নেই কিন্তু এখান থেকে লাফিয়ে নীচে নামা তার পক্ষে অসম্ভব। ফাঁদে-পড়া ইঁদুরের মতো অসহায় লাগছিল অনিমেষের। এরকম বোকার মতো ধরা দেওয়ার চেয়ে ওই জানলা দিয়ে একবার চেষ্টা করলে কেমন হয়! সে জানলা দিয়ে ঝুঁকে নীচের দিকটা জরিপ করল। জানলার অনেক নীচে একটা পাইপ দেওয়াল বেয়ে নেমে গেছে। সেটা হাতের নাগালে পেলে একটা চেষ্টা করা যায়। তবে তার আগে বাথরুমের ছিটকিনি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে হবে কিছুটা সময় পাওয়ার জন্যে।
দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে ভেতরে গলা পেল অনিমেষ। শীলা সেন বেশ যন্ত্রণার গলায় কথা বলছেন। সামান্য অপেক্ষা করেই সে বুঝতে পারল পুলিশ এই ঘরে আসেনি এখনও। বাড়ি সার্চ করলে তারা শীলা সেনকে এভাবে ছেড়ে দিত না। খুব সন্তর্পণে দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ল বিছানায় বসে শীলা সেন হাঁপাচ্ছেন। তাঁর মুখ অনিমেষের দিকে ফেরানো।
‘খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি! এলে তো একেবারে পুলিশ পেছনে নিয়ে এলে!’ শীলা সেনের কণ্ঠস্বরে তারল্য নেই।
‘উপায় ছিল না। তাঁরা আছেন?!
‘না, ভয় নেই। নিশ্চিন্তে বসো।’
অনিমেষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। শীলা সেন কীভাবে পুলিশকে কাটালেন সে জানে না, কিন্তু বীভৎস চেহারার মানুষটির কাছে সে ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে রইল। সোফায় বসলে শীলা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে বলো তো? তোমার পেছনে পুলিশ কেন?’
‘সে অনেক কথা।’ অনিমেষ ঠিক কী বলা উচিত ভাবছিল।
‘তা তো বুঝলাম। তুমি চুরি ডাকাতি করেছ এটা তো আর ভাবতে পারছি না। কিন্তু ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম তুমি খুব ভয়ংকর লোক। শুনে আমি হেসে বাঁচি না। নাক টিপলে দুধ বের হবে যার তাকে ভয়ংকর বলা হচ্ছে!’ শীলা সেন হাসতে চেষ্টা করতেই মুখটা আরও বীভৎস হয়ে গেল। এতক্ষণে এই দৃশ্য অনিমেষের সয়ে গেছে। অনিমেষ বলল, ‘আমার কিন্তু যথেষ্ট বয়স হয়েছে।’
‘তাই নাকি? সত্যি?’
ওঁর বলার ধরনে অনিমেষ এবার মজা পেল। আগের শীলা সেনের সুন্দর মুখে এই ধরনের রসিকতা চমৎকার মানিয়ে যেত। এখন কণ্ঠস্বর একই থাকলেও মুখ বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এই মুহূর্তে শীলা সেন নিশ্চয়ই সেই কথা ভুলে গেছেন। অনিমেষ এমন ভাব করল যেন মুখের এই বিকৃতি তারও খেয়ালে নেই।
‘সত্যি কথাটা বলো তো এবার। পুলিশ খুঁজছে কেন?’
‘বলছি। কিন্তু কী বলে ওদের বিদায় করলেন?’
‘বললাম আমার বাড়িতে কেউ আসেনি। আমি অসুস্থ, বিছানায় শুয়ে থাকি। খামোকা আমার কাছে কেউ আসতেই বা যাবে কেন? যে অফিসার এসেছিলেন তিনি বোধহয় এককালে আমার খবর রাখতেন। তাই তোমার সম্পর্কে অনেক সতর্ক করে দিয়ে বিদায় হলেন। কী হয়েছে?’
শীলা সেনের শরীর থেকে চোখ সরিয়ে নিল অনিমেষ। কীভাবে এই মহিলাকে ওসব কথা বলা যায়। বললেও ইনি কিছু বুঝবেন বলে তার ভরসা হচ্ছে না। অথচ না-বলে বসে থাকা শোভনীয় নয়। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল একজন সাধারণ মানুষকে যদি তাদের উদ্দেশ্যের কথা সে না বোঝাতে পারে না হলে—।
‘আমরা এ দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থাটা মানতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে আমরা প্রস্তুত হচ্ছি দেশ জুড়ে বিপ্লবের জন্যে। বুঝতেই পারছেন যারা এখন ক্ষমতায় আছে তারা আমাদের যেমন শত্রু আমরাও তাদের। আমাদের থামিয়ে দেওয়ার জন্যেই পুলিশ পেছন নিয়েছে।’ অনিমেষ কথাগুলো বলার সময় মহিলার মুখের দিকে সতর্ক নজর রেখেছিল। মুখের বিকৃতির জন্যে সেখানে কী প্রতিক্রিয়া হল বোঝা গেল না।
‘কাগজে তা হলে তোমাদের কথাই লিখেছে?’
‘কী লিখেছে?’
‘আমি তো পড়ি না, আমাকে পড়ে শোনায়। কী যেন কথাটা, হ্যাঁ, উগ্রপন্থী, তোমরা তাই?’
‘উগ্রপন্থী!’ অনিমেষ হেলে ফেলল, ‘না। কথাটা হওয়া উচিত সঠিক পন্থী।’
‘কিন্তু কীভাবে তোমরা দেশটাকে পালটাবে?’
‘এদের হাত থেকে অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে।’
‘কী যে হাসির কথা বলছ!’
‘কেন?’
‘এদের কত পুলিশ, মিলিটারি। কত বন্দুক কামান। তোমরা যতই দল গড়ো এদের সঙ্গে কখনও পারো! অসম্ভব! এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আর আত্মহত্যা করতে যাওয়া একই ব্যাপার।’
‘যে-কোনও বিপ্লবের আগে এ কথাই মনে হয়। কিন্তু মানুষের মনের ভেতরে যদি আগুন থাকে তা হলে বাইরের কোনও শক্তিই তাকে নিভিয়ে দিতে পারে না। জনসাধারণ পরিবর্তন চাইলে তা হতে বাধ্য।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন শীলা সেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘তার মানে তোমরা একটা ভাল কাজ করতে চাইছ। বেশ, করো।’
‘আপনি আমার খুব উপকার করলেন আজ।’
‘না-জেনে করেছি। আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। ওমা, দেখো, তখন থেকে শুধু বকবক করছি অথচ—।’ খাটের পাশে রাখা একটা বোতামে চাপ দিতেই ভেতরে কোথাও আওয়াজ উঠল। অনিমেষ দেখল সেই মহিলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন, ‘হ্যাঁরে, তোরও কি বোধবুদ্ধি লোপ পেল! চা খাবার নিয়ে আয়।’
অনিমেষ বাধা দিল, ‘না না, এখন কিছু খাব না। অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার চলি।’
‘যাবে, কোথায় যাবে?’
‘মানে?’
‘আজ রাত্রে তোমার এখান থেকে বের হওয়া উচিত নয়। পুলিশ যে সামনের রাস্তায় নেই তা কে বলতে পারে।’
‘কিন্তু—।’
‘কিন্তু আবার কী। এখন তো আর হস্টেলেও ফিরে যাওয়া চলবে না। কোথায় আছ এখন?’
‘এতদিন হস্টেলেই ছিলাম, আজ রাত থেকে অনিশ্চিত।’
‘তোমার বাড়ির লোক জানে?’
‘জানি না।’
‘তোমাদের তো চা-বাগান ছিল।’
‘কস্মিনকালেও নয়। আমার বাবা চা-বাগানে কাজ করেন।’
‘ওঁরা তো কেউ কলকাতায় নেই!’
‘না।’
‘তা হলে আর ওঠার জন্যে ছটফট করছ কেন? কাউকে যদি খবর দেবার থাকে কিছু তা হলে টেলিফোনে দিয়ে দাও।’ খাটের উলটো দিকটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন শীলা সেন।
টেলিফোনটা এতক্ষণ নির্জীব ছিল কিংবা কাঠের বাক্স-বন্দি থাকায় অনিমেষের চোখে পড়েনি। এখন সেটা নজরে আসতেই হুড়মুড় করে নানা চিন্তা মাথায় ঢুকে পড়ল। কাল যদি উত্তরবাংলায় চলে যেতেই হয় তা হলে আজই মাধবীলতার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু এত রাত্রে ওর হস্টেলে গিয়ে দেখা পাওয়ার বোধহয় সম্ভাবনা নেই। হয়তো জরুরি বললে টেলিফোনে ডেকে দিতে পারে। অনিমেষ উঠে শীলা সেনের খাটটা ঘুরে টেলিফোনের পাশে এসে দাঁড়াল।
ওপাশে রিং হচ্ছিল। অনিমেষ রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে শীলা সেনের দিকে আড়চোখে তাকাল। একটা সাদা পাথর কেটেকুটে মানুষের আদল আনা হয়েছে মাত্র, এখনও মুখ নাক চোখ স্পষ্ট হয়নি এরকম একটা ছবি মনে পড়ল। এতক্ষণে সে নিশ্চিত, মহিলা চোখে দেখতে পান না বা পেলেও তা অতি সামান্য।
‘হ্যালো!’ ওপাশে গলা শুনতে পেল সে। মনে হয় সেই সুপারের গলা, ঈষৎ চিন্তিত এবং কিছুটা বিরক্ত।
‘হ্যালো!’ নিজেকে জানান দিয়ে নম্বরটা মিলিয়ে নিল অনিমেষ।
‘কে বলছেন?’
‘আমি অনিমেষ মিত্র। আপনার একজন বোর্ডার মাধবীলতার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।’ অনিমেষ নামটা বলবার সময় শীলা সেনের দিকে তাকাল। না, সেখানে কোনওরকম কৌতূহলের প্রকাশ নেই।
‘মাপ করবেন, এত রাত্রে কাউকে ডেকে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি কাল সকাল সাতটার পর টেলিফোন করবেন। আচ্ছা—।’ ভদ্রমহিলার কাঠ কাঠ গলা শেষের দিকে নীচে নেমে এল। উনি বোধহয় রিসিভার নামিয়ে রাখছেন ভেবে অনিমেষ তড়িঘড়ি অনুনয় করল, ‘শুনুন, প্লিজ, আমি জানি এত রাত্রে টেলিফোন করা উচিত নয় কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে করতে হচ্ছে। বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি। এখন না-জানালে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।’
কয়েক পলক নীরবতা, তারপর মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার নাম আর একবার বলুন।’
‘অনিমেষ মিত্র।’
‘একটু ধরুন!’ ওপাশে রিসিভার টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখার শব্দ হল। মিনিট দুয়েক অপেক্ষার যন্ত্রণায় কাটল অনিমেষের। এ ঘরেও কোনও শব্দ নেই। শীলা সেনের শরীর একই ভঙ্গিমায় খাটের ওপর বসে রয়েছে।
ওপাশে গলা বাজল, ‘দেখুন, এত রাত্রে আমরা টেলিফোন অ্যাটেন্ড করতে চাই না। তবে আপনার নাম ওর ফর্মে আছে বলে, আর একটু ধরুন আমি খবর পাঠাচ্ছি।’
স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল অনিমেষের। যাক, ফাঁড়া তা হলে কাটল। আজব মহিলা বটে। ফর্ম ভেরিফিকেশন করে তবে কথা বলার অনুমতি দিলেন।
একটু বাদেই মাধবীলতার গলা শুনল সে। গলায় প্রচণ্ড উদ্বেগ, ‘হ্যালো!’
‘আমি বলছি।’ অনিমেষ মৃদু হাসল।
‘কী ব্যাপার?’ মাধবীলতা আরও অবাক।
‘খুব জরুরি বলে করতে হল। তোমার অসুবিধে হল না তো?’
‘সে ঠিক আছে। কী হয়েছে?’
‘আমাকে নর্থ বেঙ্গলে চলে যেতে হচ্ছে।’
‘নর্থ বেঙ্গল?’
‘তোমাকে সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম।’
‘ও। কিন্তু এখনই-!’
‘কলকাতায় থাকা আমার পক্ষে আর নিরাপদ নয়।’
‘কোত্থেকে বলছ?’
অনিমেষ আর একবার শীলা সেনের দিকে তাকাল। প্রতিক্রিয়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অনিমেষ জবাব দিল, ‘একজনের বাড়ি থেকে। আজ এখানে থাকতে হবে, বাইরে পুলিশ ঘুরছে।’
‘কখন যাবে?’
‘কালই।’
‘যাওয়ার আগে দেখা হবে না!’
‘জানি না, হয়তো নয়। তোমার কাছে আমার জিনিসপত্র কেউ পৌঁছে দিয়ে আসবে, সেগুলো রেখে দিয়ো।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শোনো, পুলিশ যদি তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্রেফ অস্বীকার করবে। ওরা যে যাবেই তা বলছি না, তবে যদি যায়—।’
‘ওসব চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী করে হয়ে গেল-?’
‘হয়ে গেল, কেন হল জানি না।’
‘আমি কি তোমার কাছে যাব?’
‘কখন?’
‘এখন।’
‘এত রাত্রে?’
‘এমন কিছু রাত হয়নি। তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘উঁহু। এখন এলে পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করবে। তা ছাড়া হস্টেলে তোমাকে থাকতে হবে।’
হঠাৎ শীলা সেনের গলা কানে ভেসে এল, ‘ওকে কাল ভোরে আসতে বলো। তা হলে তোমার পক্ষে এখান থেকে বেরুনো সহজ হবে।’
অনিমেষ চমকে ওঁর দিকে তাকাল। উনি যে এতক্ষণ তার কথা শুনছিলেন বোঝা যায়নি। কার সঙ্গে সে টেলিফোনে কথা বলছে অনিমেষ না-জানানো সত্ত্বেও কী করে অনুমান করলেন?
ওপাশে মাধবীলতা চুপ করে ছিল। অনিমেষ বলল, ‘অবশ্য তুমি যদি ঝুঁকি নিতে পারো তা হলে কাল যত তাড়াতাড়ি পারো ভোরেই চলে এসো।’
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল মাধবীলতা। অনিমেষ তাকে শীলা সেনের বাড়ির ঠিকানা এমন করে বুঝিয়ে দিল যাতে পথে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে না-হয়। টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে সামনে আসতেই শীলা সেন বললেন, ‘এখানে উঠে বসো আরাম করে।’ হাত দিয়ে খাটের একটা ধার দেখিয়ে দিলেন।
সেই সময় পেছনে পায়ের শব্দ হল। অনিমেষ তাকিয়ে দেখল একটা ট্রে-তে ওমলেট আর চা নিয়ে এসেছে সেই মহিলাটি। ছোট একটা টেবিলের ওপর সেগুলো নামিয়ে রাখতেই শীলা সেন বললেন, ‘খাবার এনেছিস? কী দিলি?’
‘ওমলেট।’
‘শুধু ওমলেট? একটু মিষ্টি আনতে পারলি না?’
‘আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?’ অনিমেষ প্রতিবাদ করল।
‘ওগুলো খেয়ে নাও।’
খিদে পেয়েছিল খুব। অনিমেষ ইতস্তত করল না।
খাওয়া হয়ে গেলে শীলা সেন হাসলেন, ‘মেয়েটি কে?’
‘আমার সহপাঠিনী।’
‘উঁহু।’
‘তা হলে?’
‘আরও বেশি, অনেক বেশি। তা না-হলে এই রাত্রে সে আসতে চাইত না।’
অনিমেষ কথা বলল না। অবাক হয়ে মহিলার বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। এমন করে দেখতে বোধহয় একমাত্র মেয়েরাই পারে।
শীলা সেন আবার বললেন, ‘তোমার এসব কথা সে পরিষ্কার জানে?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘তবু সে ভালবেসেছে, না?’ দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট টের পেল অনিমেষ। শীলা সেনের মুখ এখন সামান্য ঝুলে পড়েছে। কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ আর পারল না। খুব নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার এরকম অবস্থা কী করে হল?’
দ্রুত মাথা তুললেন শীলা সেন, ‘কীরকম অবস্থা! খুব খারাপ লাগছে দেখতে, তাই না? শুনেছি আমাকে একবার দেখলে অনেকে রাত্রে ঘুমুতে পারে না। তোমারও সেরকম হতে পারে।’
‘আপনি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।’
হঠাৎ খুব ক্লান্ত দেখাল শীলা সেনকে। ধীরে ধীরে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। তারপর কেমন অসাড় গলায় বললেন, ‘পাশের ঘরে যে লোকটা রয়েছে তাকে দেখেছ?’
অনিমেষ স্মরণ করতে পারল। অত্যন্ত রোগা একটি মানুষকে এক পলকের জন্যে দেখেছিল সে। মুখ মনে নেই, লক্ষও করেনি।
‘হ্যাঁ, একজন ছিলেন। কে উনি?’
‘আমার স্বামী, পতিদেবতা।’
‘ও।’
‘আমার শরীরের এই কারুকার্য ওঁরই কীর্তি।’
‘সে কী!’ আঁতকে উঠল অনিমেষ।
‘অবাক হচ্ছ কেন? উনি স্বচ্ছন্দে এক বোতল অ্যাসিড আমার ওপর ঢেলে দিয়েছিলেন, একটুও হাত কাঁপেনি। এখনও স্বচ্ছন্দে ওই ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটান।’
‘কিন্তু কেন?’
‘পুরুষ মানুষ তাই।’
‘এ কী বলছেন?’
‘কিছু মনে কোরো না, তোমরা চাও মেয়েরা তোমাদের জন্যে প্রাণ ঢেলে সবকিছু করবে কিন্তু তাদের যদি সামান্য বিচ্যুতি ঘটে তোমরা সহ্য করবে না।’
‘তাই বলে সবাইকে একরকম ভাবা ঠিক নয়।’
‘আমি তো দেখলাম না। যারা আমাকে পয়সা দিত, জানত শুধু পয়সার সম্পর্ক, তারাও দেখতাম অধিকারের থাবা বসাত। ঘেন্না ধরে গেছে।’
‘তা হলে আমাকে আশ্রয় দিলেন কেন?’
চমকে উঠলেন শীলা সেন, ‘তুমি? কী বলছ?’
‘আমিও তো পুরুষ মানুষ!’
‘হয়তো, কিন্তু আমার কাছে তুমি ছোটভাই। যেদিন তোমাকে প্রথম ট্যাক্সিতে দেখি সেদিনই মনটা কেমন করে উঠেছিল। তোমাকে আমি পুরুষ মানুষ বলে ভাবব কী করে! যে ভাববে— যাকে ফোন করলে দেখছ না তার দুরবস্থা!’
‘আপনি যার কথা বলছেন সে আমাকে ভালবাসে!’
‘তাই তো মরে! মেয়েদের কাছে ভালবাসার চেয়ে বড় মরণ আর কিছু নেই ভাই। সব চলে যাচ্ছে জেনেও অন্ধ হয়ে থাকতে হয়।’
কথাগুলো অনিমেষের ভাল লাগছিল না। এসব শরৎচন্দ্রীয় কথাবার্তা এ যুগে অচল হয়ে গেছে। এখন মেয়েরা অনেক স্বাবলম্বী। কিন্তু এ নিয়ে শীলা সেনের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। সে প্রসঙ্গে ফিরে এল, ‘ওঁর আক্রোশের কারণ কী?’
‘জলে নামো ক্ষতি নেই, খবরদার চুল ভিজিয়ো না। আচ্ছা, আমাকে যখন প্রথম দেখলে তোমার খারাপ লাগেনি তখন?’
‘ঠিক খারাপ নয়—।’
‘লজ্জা করছ কেন? সত্যি কথা বলো। একটা বাঙালি মেয়ে অচেনা নিগ্রো ছেলের সঙ্গে এক ট্যাক্সিতে ফিরছে, আমাদের সমাজে তা কখনও সম্ভব? হ্যাঁ, অভাবে পড়ে আমি ঘরের বাইরে গিয়েছিলাম। ওঁরই বন্ধু ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিজে কোনওদিন চাকরি বাকরি করেননি, ব্যাবসা ছিল, সেটা ডুবে গেলে আমাকে পাঠালেন বন্ধুর সঙ্গে। চেহারা ছাড়া আমার কোনও গুণ ছিল না। তা লোকেই বা ছাড়বে কেন? এই চেহারাটাকে ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে পয়সা পাচ্ছিলাম। একটু ছোঁয়া একটু হাসিতেই কাজ হত প্রথম প্রথম। কিন্তু সবকিছুর তো সীমা আছে। লোভ বড় খারাপ জিনিস। একবার মাথা তুললে আকাশছোঁয়া হয়। আমার এই পাশ কাটানো লোকে শুনবে কেন? শরীর দিতে হল। উনি সব জেনেশুনে ন্যাকা সেজে বসে ছিলেন। টাকায় ভেসে যেতে লাগল। কোনওদিন জিজ্ঞাসা করেননি, নিষেধ করেননি। কিন্তু এসব করতে করতে আমি ডুবলাম। প্রেমে পড়ে গেলাম একজনের। সে সব জেনেশুনে আমায় নিল। প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা আমার তখন। আর একবার যখন প্রেমে পড়েছি তখন আর অন্য পাঁক ঘাঁটতে ইচ্ছে করে?’
হাসলেন শীলা সেন, ‘তোমার জাতভাই এতদিন কিন্তু কিছু বলেননি। যেই দেখলেন আমার মন অন্যরকম হয়েছে তখনই শাসন শুরু করলেন। কিন্তু তখন আমি নিষেধ শুনব কেন? পরিণতি তো চোখের ওপর দেখছ।’
‘এ তো খুন করার চেষ্টা!’
‘তাই তো।’
‘পুলিশ কিছু বলেনি?’
‘বলতে চেয়েছিল, আমি দিইনি।’
‘কেন?’
‘আমার জীবনে এত নোংরা ছড়ানো যে পুলিশ আমাকে খারাপ মেয়ে বলে প্রচার করতেই পারত। জ্ঞান হলে, এই চেহারায় ফিরলে যখন কেস উঠল তখন মাথাটাকে ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলাম। কোর্টে গেলে সত্যি কথাটা বলে লোকটাকে জেলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আমার কী হত? এই অবস্থায় যখন সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে তখন একটা আশ্রয় চাই। নিজের হাতে কেউ নিজের সর্বনাশ করে?’
‘কিন্তু এত বড় অন্যায় করে উনি শাস্তি পাবেন না?’
‘কে বলল পাবে না। কেঁচোর মতো কুঁকড়ে আছে সারাক্ষণ। হাসপাতালে আমার পা ধরে প্রাণ ভিক্ষে চেয়েছে। এ বাড়ি থেকে ওর বেরুনো নিষেধ। মজা কী জানো, আমার শরীরের পোড়া ঘা যত শুকিয়ে এল তত ওর শরীর ভয়ে ভাবনায় শুকিয়ে যেতে লাগল। এখন ওই ইজিচেয়ার আর বাথরুম এইটুকু হাঁটতেই ওর প্রাণ বেরিয়ে যায়।’
‘আপনার দৃষ্টিশক্তি-’
‘একটায় নেই, অন্যটায় এত কম যে দেখতে ইচ্ছে করে না। চোখ বুজেই থাকি।’
‘অপারেশন করার কথা ভাবছেন না?’
‘শিশির জানে সেসব। আমাকে নাকি অনেকবার অপারেশন টেবিলে গিয়ে শুতে হবে। প্লাস্টিক সার্জারি না কী যেন বলে—। তারপর চোখ।’
‘শিশির কে?’
হাসলেন শীলা সেন, ‘তুমি এখনও ছেলেমানুষ। রূপ চলে যাওয়া সে একরকম, কিন্তু এরকম বীভৎস চেহারার মেয়ের কাছে যে পুরুষ আসে, চিন্তা করো, সে আমার কে হতে পারে? শিশিরের জন্যেই তো উনি অ্যাসিড ঢেলেছিলেন। আমি অনেক আপত্তি করেছি কিন্তু কিছুতেই শুনছে না শিশির। আবার আমাকে কেটেছেঁটে সুন্দর করতে চায়। কী জ্বালা বলো!’
কথা বলার ভঙ্গিতে এমন আদুরেপনা ছিল যে অনিমেষ হেসে ফেলল শব্দ করে। শীলা সেন বললেন, ‘কী হল?’
‘একটু আগে মেয়েদের কথা বলছিলেন না, ভালবাসার চেয়ে বড় মরণ তাদের আর কিছুতেই নেই, কিন্তু এখন দেখছি কোনও কোনও ছেলেও-’
মাংসপিণ্ড বিকৃত হয়ে সারা মুখে ছড়ানো, তবু শীলা সেনের লজ্জা অনিমেষের চোখ এড়াল না। নিচু গলায় বললেন, ‘তাই তো মরণে এত সুখ অনিমেষ।’