তেইশ
উপ-নির্বাচনটি নিয়ে উত্তরবাংলায় কোনও উত্তাপ নেই।
কংগ্রেসের কাছে আসনটির সঙ্গে অনেক মর্যাদা জড়িয়ে আছে। মন্ত্রীরা ঘনঘন এসে জনসাধারণকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। এসবের দরকার ছিল না আগের নির্বাচনে। যিনি এই আসনে দাঁড়াতেন তাঁর নামটাই একটা মন্ত্র ছিল। ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে দাঁড়িয়েছেন এবার। পারিবারিক অধিকারে আসনটি তাঁর হবেই জানা সত্ত্বেও কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি তিনি, তাই মন্ত্রীদের যাওয়া-আসা। বিরোধীরা কখনওই নিজেদের বিরোধের দূরত্ব কমিয়ে ফেলতে পারে না। এসব অঞ্চলে ফরোয়ার্ড ব্লকের পরিচিতি আছে সুভাষ বোসের কল্যাণে। গ্রামের চাষাভুষো মানুষ এখনও তাদের নেতাজির পার্টি বলে মনে করে। সি পি আই, সমাজতন্ত্র দলগুলোও কাজকর্ম করছে। পার্টি ভাগ হবার পর সি পি আই এম অধিকতর সক্রিয়। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করার অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। নির্বাচনে যোগদান না-করলে জনসাধারণের কাছে পার্টির নাম বাঁচিয়ে রাখা যায় না— এরকম একটা বোধ এঁদের প্রত্যেকের। ফলে বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের পক্ষে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মতো নির্বাচনে জেতা সহজ হয়।
কিন্তু এবার উপ-নির্বাচন বলেই হোক কিংবা অন্য কোনও কারণেই হোক বিরোধীরা মোটামুটি একটা সমঝোতায় এসে প্রার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। মুশকিল হল যারা নমিনেশন পায় না তারা দল ছেড়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। সেটাও এবার এড়ানো গেছে। মোটামুটি দ্বিমুখী লড়াই বলা যেতে পারে। উপ-নির্বাচনটি ঘিরে তাই কর্মীদের মধ্যে বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কলকাতা থেকে এসে অনিমেষ সেটা প্রথম দিনেই টের পেয়ে গেল। কিন্তু যাঁরা নির্বাচন করবেন তাঁরাই নিরুত্তাপ।
দাসপাড়ার পার্টি অফিসে বসে ওরা পরিকল্পনা করছিল। কলকাতা থেকে অনিমেষের সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁরা নির্বাচনের কাজে অত্যন্ত অভিজ্ঞ। লোকাল কমিটির সঙ্গে যৌথ দায়িত্ব নিয়ে প্রচারের কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে। বিভিন্ন পরিকল্পনা হচ্ছিল। সৌমেন সেন বলে একজন প্রৌঢ় অনিমেষদের নেতা। তিনি বললেন, ডোর টু ডোর ক্যাম্পেনেই ভাল ফল দেয়। যা সময় আছে তাতে এলাকাটা চষে ফেলা যাবে। কতগুলো গ্রুপে ভাগ হয়ে গিয়ে আমরা কাজে লাগতে পারি। মনে রাখতে হবে এখানকার সাধারণ মানুষের একমাত্র জীবিকা চাষবাস। তাই আমাদের কথাবার্তা জমি এবং চাষ দিয়েই শুরু করাই ভাল। আমি বলতে চাইছি ওদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে ওরা আমাদের নিজেদের লোক বলে চিন্তা করে।
লোকাল কমিটির একজন সদস্য কথাগুলো শুনে হাসলেন, ‘আপনি যা বললেন তা শুনতে ভাল লাগল। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় এটা একদমই কাজ দেবে না। কারণ দরজায় দরজায় ঘুরলে কেউ আপনার সঙ্গে কথাই বলবে না। মোড়ল যা বলে দেবে তাই এদের কাছে শেষ কথা। মোড়ল দেখবে তাকে কোন দল কীরকম সুবিধে দিচ্ছে, তার ওপর সে নির্দেশ দেবে। সবচেয়ে মুশকিল হল এই মোড়লগুলোর বেশির ভাগই কংগ্রেসি।’
সৌমেনবাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা হয়তো ঠিক কিন্তু পুরোটা নয়। কারণ গত নির্বাচনের ফল দেখে বোঝা যায় মোট ভোটের আটচল্লিশ শতাংশ পেয়েছে কংগ্রেস। তা হলে বাহান্ন শতাংশ বিরোধী ভোট গতবার ভাগ হয়েছিল। এই ভোট যারা দিয়েছিল তাদের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করতে হবে।’
লোকাল কমিটির ভদ্রলোকটি বললেন, ‘অঙ্কের হিসেব যে এখানে মিলবে না সেটা কাজ শেষ হলে বুঝতে পারবেন।’
অনিমেষ সেটা প্রত্যক্ষ করল। নির্বাচনের কোনও অভিজ্ঞতা তার ছিল না। এখনও সে নিজে ভোট দেয়নি। স্কটিশের হস্টেলে থাকতে ভোটার লিস্টে তার নাম ওঠেনি। ভোটের দিনে ছেলেদের একটা মজার খেলা ছিল, কে কত জাল ভোট দিতে পারে তার ওপর বাজি ধরা হত। অনিমেষ এখনও পোলিং বুথে ঢোকেনি। কিন্তু কলকাতা থেকে এখানে নির্বাচনের কাজে আসার সময় যে উৎসাহটা ওকে উত্তপ্ত করেছিল তা হল সাধারণ গ্রামের মানুষকে দেখা, জানা। কলকাতা শহরে নির্বাচনী প্রচার সে দেখেছে। পার্কে পার্কে গরম গরম বক্তৃতা, মাঝে মাঝে প্রার্থীরা দল নিয়ে গলিতে গলিতে হাতজোড় করে ঘুরে যান। লোকে ঠিক করেই রাখে কাকে ভোট দেবে এবং তাই দিয়ে চলে আসে। গ্রামে নিশ্চয়ই তা হবে না। এখানে মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে যদি ভারতবর্ষের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা, মানুষের বাঁচার অধিকার কোন পথে আসবে তার একটা স্পষ্ট ছবি যদি লাঙল থেকে হাত নামানো চাষিদের বোঝানো যায় তা হলে সত্যিই কাজের কাজ হবে— এইরকম বিশ্বাস নিয়ে সে এসেছে। শহর দিয়ে গ্রাম নয়, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে হবে। এবং তা করতে গেলে গ্রামের মানুষকে সচেতন করা অবশ্যই প্রয়োজন। এইসব থিয়োরিগুলোর বাস্তব রূপায়ণের এত সুন্দর সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হল অনিমেষ। সৌমেনবাবু বুঝিয়ে দিলেন ঠিক কী কী কথা বললে কমিউনিস্ট প্রার্থীর সমর্থনে ভোট পড়বে। প্রথমে অভুক্ত কঙ্কালসার মানুষের ছবিতে রাস্তাঘাট ছেয়ে ফেলা হল। ছবির তলায় বড় করে লেখা, ‘আজকের ভারতবর্ষ— কে দায়ী?’ কিন্তু দু’দিন বাদেই সেই পোস্টারগুলো উড়ে গিয়ে জুড়ে বসল ক্যালেন্ডারের মতো গান্ধী নেহরু রবীন্দ্রনাথের ছবি; পাশে জোড়া বলদ। কলকাতায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো পরস্পরের পোস্টারগুলো বাঁচিয়ে রাখে সৌজন্যবশত, বোঝা গেল এরা তার ধার ধারে না। রেষারেষি শুরু হয়ে গেলে সেটা কিছুতেই থামতে চায় না, খুন-খারাপি অত্যন্ত সামান্য কথা।
পাকিস্তান সীমান্ত খুব কাছেই; আবার শিলিগুড়ির সঙ্গে দূরত্ব বেশি নয়। একটা বাস যাতায়াত করে দাসপাড়া— শিলিগুড়ির মধ্যে। পশ্চিমবাংলায় কলকাতার পর আধুনিক শহর বলতে শিলিগুড়িকেই বোঝায়। ব্যাবসাকেন্দ্র এবং স্মাগলিং-এর কল্যাণে শহরটা কসমোপলিটান চেহারা নিয়ে ফেলেছে। অথচ তার চৌহদ্দি ছাড়ালেই যে গ্রামগুলো সেখানে এখনও প্রাগৈতিহাসিক চেহারা বর্তমান। একশো বছর আগেও যেভাবে জমি চাষ হত, খাদ্যাভাবে ভুগত এবং সন্তান উৎপাদন করত, আজও তার হেরফের হয়নি। এদের কাছে শিলিগুড়ির সঙ্গে নিউইয়র্কের কোনও ফারাক নেই। উত্তরবাংলার পাঁচটা জেলায় পাঁচটা সদর শহরেই যা কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ— তার আঁচ এদের গায়ে লাগে না। মানুষগুলোর চেহারা কুচবিহার জলপাইগুড়িতে মোটামুটি এক। রাজবংশী সম্প্রদায় মাটি থেকে ফসল তোলেন, চিরকালের অবহেলিত হয়ে আছেন ওঁরা। শহরের মানুষেরা এই সুযোগ নিয়ে ওঁদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। সরলতার শিকার হয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে নিজেদের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই এখন। রাজবংশীরাই এখানকার মাটির মানুষ, এঁদের ভোটেই জেতা হারা নির্ভর করে। জোড়াবলদের ওপর একটা আত্মিক টান আছে এঁদের। মোড়লদের নির্দেশ সেই টানকে আরও জোরালো করে।
শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে ইসলামপুরের দিকে এলেই দু’পাশের যে গ্রামগুলো তার চরিত্র আলাদা। পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা একটু একটু করে শিকড় গাড়ছে মাটিতে কিন্তু যারা সংখ্যায় ভারী এবং মাটির কর্তৃত্ব যাদের হাতে তাদের মেজাজটাও সবসময় টানটান। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই আধিক্যই গ্রামগুলোর চরিত্র একটু অন্যরকম করেছে। এঁরা যা বোঝেন তার বেশি বুঝতে চান না কিছুতেই। কংগ্রেসের বিকল্প কিছু এঁদের ভাবনাতে আসে না। পাশেই সীমান্ত ছাড়িয়ে পাকিস্তান। কিন্তু সে ব্যাপারে এঁদের কোনও ভাবপ্রবণতা নেই। অনিমেষের কাজ এঁদের সঙ্গেই, এই এলাকার মানুষদের প্রভাবিত করতে হবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিতে।
অনিমেষদের পার্টির থেকে যে ভদ্রলোক প্রার্থী হয়েছেন তিনি মুসলমান। জনসংখ্যার হিসেবে ত্রিশ শতাংশ হিন্দু হলেও উভয়পক্ষই হিন্দু প্রার্থী দিতে সাহস করেনি। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ওঠে না। মালদার একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলমান দীর্ঘকাল পশ্চিম দিনাজপুরের এই প্রান্তদেশ থেকে সম্মানের সঙ্গে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এবার তাঁর ছেলে দাঁড়িয়েছেন। গতবার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি হিন্দু ছিলেন বলেই কম ভোট পেয়েছিলেন— এমন কথা শোনা যায়। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই ধাক্কা খেল অনিমেষ। তার মানে কোনও মতবাদ বা আদর্শ এখানে কাজ করছে না? মানুষগুলোর ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করা হচ্ছে! তা হলে কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কী পার্থক্য থাকল? কথাটা সৌমেনবাবুকে বলতেই তিনি কিছুক্ষণ অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, ‘মাও সে তুং-এর একটা থিয়োরি হল, দু’পা এগিয়ে যেতে মাঝে মাঝে এক পা পিছিয়েও যেতে হয়।’
এখন বর্ষার চলে যাওয়ার সময়। তবু উত্তরবাংলায় বর্ষা কি সহজে যেতে চায়। হুড়মুড় করে কিছুক্ষণ জল ঝরিয়ে আকাশ বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ভোর হতেই দাসপাড়া থেকে ওরা বেরিয়ে পড়ে গ্রামগুলোতে চলে যেত। তখন মাঠের কাজ ছিল না। গ্রামগুলোতে সকাল হত দেরিতে, অদ্ভুত ঢিমে চালে ওরা দিন শুরু করে। এভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় গ্রামের মানুষ দেখা অনিমেষের একটা নেশার মতো হয়ে গেল। এক-একটা গ্রাম যেন একটি বাড়িকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে। জমিদাররা আর বাংলাদেশে নেই, কথাটা কলকাতায় বসে শোনা ছিল। কিন্তু এখানে এসে মনে হল কথাটা একদম মিথ্যে। জমিদারের চেহারা পালটে গেছে কিন্তু চরিত্র একই রকম আছে। জোতদারের সঙ্গে তার মৌলিক পার্থক্য নেই। সেই জোতদারের বাড়িতে আগে যেতে হত ওদের।
মোটামুটি পাকা বাড়ি, টিনের চাল। জোতদার ওদের দেখলে ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে আসতেন, ‘আসেন আসেন বাবুরা, কী সৌভাগ্য, এ-গ্রামের কী সৌভাগ্য যে আপনাদের পদধূলি পড়ল। বসতে আজ্ঞা হোক, বসতে আজ্ঞা হোক।’
তিন-চারটে মাদুর পাতাই থাকে বোধহয় সবসময় তাঁর দাওয়ায়। অনিমেষরা বসতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘বলুন, কী সেবা করতে পারি?’
অনিমেষরা তিনজন এই দলে ছিল। সৌমেনবাবুরা অন্য গ্রামে গেছেন। ভদ্রলোকের মুখের ভাবভঙ্গি অনিমেষের ভাল লাগছিল না। এর একটা কারণ এখানে আসতে যে ঘরগুলো ওর চোখে পড়েছিল তার জরাজীর্ণ দশার তুলনায় এই গৃহটি প্রাসাদ বলে মনে হচ্ছে। শোষক এবং শোষিতের পার্থক্যটা বড্ড স্পষ্ট। গ্রামে এসে বক্তৃতা করার আগে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব জমালে অধিকতর কাজ হবে বলা হয়েছিল।
অনিমেষ বলল, ‘আপনি তো জানেন, নির্বাচন এসে পড়েছে। আমরা নির্বাচনের কাজেই এই গ্রামে এসেছি।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘শহরে গিয়ে শুনেছিলাম বটে। তা কোন পার্টির মানুষ আপনারা? আগে তো কখনও দেখিনি!’
অনিমেষ বলল, ‘আমরা মহম্মদ চৌধুরীর পক্ষে প্রচার করতে এসেছি।’
‘চৌধুরী? অ! তা হলে আপনারা গিয়ে হলেন কমিউনিস্ট। হুম্। এবার কমিউনিস্টরা খুব চাল দিয়েছে, ভাল ভাল। চৌধুরীকে দাঁড় করিয়ে নবাব সাহেবের ছেলেকে বিপদে ফেলেছে জব্বর। তা আপনাদের পরিচয় জানলাম না তো। শহরেও মনে হয় দেখিনি।’
অনিমেষের সঙ্গী বলল, ‘আমরা কলকাতা থেকে নির্বাচনের কাজে এখানে এসেছি। এখন যদি আপনি সহযোগিতা করেন তা হলে খুশি হব।’
হাঁ হয়ে গেলেন ভদ্রলোক, ‘কলকাতা থেকে এসেছেন? অতদূর থেকে এই গ্রামে! তা হলে তো বলতে হবে খুব জব্বর ব্যাপার হবে এবার। একদম রাজধানীতেও সাড়া পড়ে গেছে আমাদের নিয়ে। কী আশ্চর্য!’
অনিমেষ বলল, ‘এতদিন আপনাদের এলাকা থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না কিন্তু কংগ্রেসের এতদিনের শাসন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এটা ভাববার সময় এসেছে। এবং সেটা ভেবেই যেন গ্রামের ভাইরা ভোট দেন।’
ভদ্রলোক পিটপিট করে অনিমেষকে দেখলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, ‘বুঝলাম না। গ্রামের মানুষ ভোট দেবে তা আমার কী করার আছে। আপনি আমাকে নিজের কথা বলতে পারেন, অন্যের কথা আমাকে বলে লাভ কী!’
অনিমেষ বলল, ‘শুনলাম, আপনার অনুমতি ছাড়া—।’
‘মিথ্যে কথা, অপপ্রচার। আপনার যেমন খুশি তেমন বোঝান, আমি এর মধ্যে আসি কী করে।’ লোকটি প্রতিবাদ করে উঠল।
ভদ্রলোককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। চাষ-নির্ভর গ্রাম। মানুষগুলো এত দরিদ্র যে সোজা হয়ে দাঁড়াবার কথাও অনেকে ভুলে গেছে। এই মানুষগুলোকে সচেতন করতে হবে, শ্রেণিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মইদুল শেখের উঠোনে বসে কথা বলছিল অনিমেষ। রোগা, পাঁজর বের করা চেহারা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনের লুঙ্গি শতছিদ্র। মইদুল উবু হয়ে বসে অনিমেষের কথা শুনছিল। মাটির দাওয়ায় অনিমেষ বসে, মাথার ওপর জলো মেঘ অনেকটা নেমে এসেছে। উঠোনময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতগুলো ন্যাংটো বাচ্চা। মইদুলের বউ দাওয়ার খুঁটি ধরে একমাথা ঘোমটায় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। মাংস-মেদ-হীন লিকলিকে শরীরটা ঘিরে কাপড়টায় অনেক সেলাই।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা মইদুলভাই, তোমার জমিতে বছরে ফসল হয় ক’টা?’
‘জমি? জমি তো আমার নয় বাবু।’
‘যে জমিটা তুমি চাষ করো সেটা তোমার নয়? তবে কার ওটা?’
‘বড়কত্তার।’
‘সে আবার কে?’
‘যাঁর ঘরে বসে এতক্ষণ কথা বলছিলে তাঁর!’
অনিমেষ লোকটার মুখ স্মরণ করল, কেমন তেল-চকচকে চেহারা। এই গ্রামে ঢুকতে গেলে ওঁর সঙ্গে কথা বললে সহজ হবে এ-কথা শুনেছিল অনিমেষ। যেন এই গ্রামের মানুষেরা সব ওঁর তাঁবেদার। দু’পা এগোতে হলে এক পা পিছোতে হবে— তাই বুঝি এই লোকটির সঙ্গে সমঝোতা করতে হল।
‘তার মানে তুমি ভাগচাষি?’
মাথা নাড়ল মইদুল, ‘ফসল হয় তিনবার। জমি যার তার, পরিশ্রম আমার— দু’ভাগ তিনি নেবেন একভাগ আমি।’
অনিমেষ বলল, ‘ওতে চলে সারাবছর?’
সাদা চোখে অনিমেষের দিকে তাকাল মইদুল। এমন ফ্যাকাশে চোখ কখনও দেখেনি অনিমেষ। ওই দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটা নড়বড়ে করে দেয়। কোনও শব্দ দিয়ে বোধহয় এমন উত্তরটা দেওয়া যেত না।
অনিমেষ উসখূস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘এর আগে কখনও ভোট দিয়েছ?’
ঘাড় নাড়ল মইদুল, ‘তা দেব না কেন না-দিলে চলে!’
‘কাকে ভোট দিয়েছ?’
‘বড়কত্তার পার্টিকে।’
‘সেটা কী?’
‘ওই যে বাবু, জোড়া বলদ, তাতে ছাপ দিয়েছি আমরা।’
‘কিন্তু কেন দিলে তাতে?’
‘ভারী মজার কথা! দেব না কেন? বড়কত্তা বলল তাই দিলাম।’
‘যাদের দিলে তারা ভাল লোক না মন্দ তা না-জেনেই দিলে?’
‘সে খবরে আমাদের দরকার কী! আর যে সব ছবি ছিল এই যেমন কাস্তে ধানের শিষ, সিংহ, ওদের দিয়েই বা কী লাভ হত? এ তবু চেনা ছবিতে ছাপ দেওয়া। বড়কত্তা বোঁদে খাওয়ালেন সেদিন, সেটাই লাভ।’ মইদুল হাসল, এবার বউয়ের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সেখানে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না।
অনিমেষ অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করল, ‘শোনো ভাই মইদুল, তুমি যেমন একজন মানুষ, যে দেশের জন্য খাবার উৎপাদন করে ঘাম ঝরিয়ে—’ এই অবধি বলেই অনিমেষের মনে হল যে সে ঠিক ভাষায় কথা বলছে না। এইভাবে কথা বললে মইদুলের কাছে পৌঁছানোই যাবে না। সে আবার শুরু করল, ‘শোনো ভাই মইদুল, তুমি নিশ্চয়ই চাও তোমার নিজের জমি হোক, ছেলেমেয়েরা ভরপেট খাক, ভাল জামাকাপড় পরুক, যে ফসল তুমি তৈরি করবে তার ন্যায্য দাম পাও, ঠিক কিনা!’
মইদুল কথা না-বলে তার সাদা চোখে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে।
অনিমেষ আবার বোঝাতে লাগল, ‘কিন্তু এতদিন তুমি কী পেয়েছ! জমিটাও নিজের নয়, অন্যের দয়ায় কোনওরকমে বেঁচে আছ। কেন এই অবস্থা? তুমি ভেবেছ কখনও?’
আঙুলটা কপালে ঠুকল মইদুল, ঠুকে হাসল।
অনিমেষ বলল, ‘মিথ্যে কথা! ভাগ্যে কিছু লেখা থাকে না। মানুষ নিজেই তার ভাগ্য তৈরি করে। দেশের মানুষকে সুস্থ সবল রাখার দায়িত্ব হল তার সরকারের। আমাদের এই দেশ একদিন ইংরেজের অধীনে ছিল। তারা ছিল বিদেশি। এখান থেকে শোষণ করে নিয়ে যাওয়াই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। সেটা বোঝা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্ষমতা হাতে নিল যারা তারা এতগুলো বছর ধরে কী করল? তারা গরিবের রক্তে নিজেদের সম্পদ আরও বাড়িয়েছে। কিন্তু দেশের কথা ভাবেনি, দেশের মানুষের জন্য কোনও চিন্তা করেনি। যার জন্য আজ তোমার জমি নেই, খাবার নেই। তুমি এদের সঙ্গে একা লড়তে পারবে না। এদের শক্তি অনেক। আর এদের মদত দিচ্ছে তোমার বড়কত্তার মতো ছারপোকারা। কিন্তু এদের শাস্তি দেওয়ার আর-একটা উপায় আছে। এই হল সুযোগ। তুমি এবং তোমরা ইচ্ছে করলে এদের ছুড়ে ফেলে দিতে পারো রাস্তায়। কী করে? তোমরা যদি সামনের নির্বাচনে ভোট না-দাও ওদের তা হলে ওরা নির্বাচিত হতে পারবে না। মন্ত্রী না-হতে পারলে দেখবে ওরা সব কেঁচো হয়ে যাবে।’
অনিমেষ একটু থেমে মইদুলকে জরিপ করল। চোখের দৃষ্টি একটুও পালটায়নি। সেই একইভাবে উবু হয়ে বসে আছে সে। অনিমেষ আবার শুরু করল, ‘বলদ চিহ্নে নয়, তোমাদের উচিত কাস্তে হাতুড়িতে ছাপ দেওয়া। আমরা চাই সমস্ত সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। আমরা চাই যার জমি নেই সে নিজের চাষের জমি পাবে, যে ফসল সে উৎপাদন করবে তার উপযুক্ত দাম পাবে, যে-কোনও কৃষকের সন্তান শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে। দেশের মানুষ না-খেয়ে মরবে না। এইসব সম্ভব হবে যদি তুমি আমাদের নির্বাচিত করো।’
‘বড় ভাল লাগে বাবু এসব কথা শুনতে।’ মইদুল দুলছিল।
‘তা হলে বোঝো, জীবনটা তোমার স্বচ্ছন্দে এরকম করে ফেলতে পারো।’
‘কিন্তু সেবার ওনারাও তো এসব কথা শুনিয়েছিলেন, কিন্তু—।’
ভ্রূ কুঁচকে গেল অনিমেষের, ‘কারা?’
‘বড়কত্তার দল, জোড়াবলদ যাদের ছাপ দিলাম সবাই, তাঁরা। আপনি যে সব কথা শোনালেন তারাও এইসব খোয়াব আমাদের দেখালেন। আর তাই শুনে শুনে বড়কত্তা আমাদের কত উৎসাহ দিলেন। কিন্তু কী হল, আমাদের কোনও উন্নতি হল?’ মইদুল ঘাড় নাড়ল।
অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না কংগ্রেসিরা কী করে এইসব কথা এদের বুঝিয়েছে। ওরাও সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাইছে নাকি! এই মানুষটি যদি একই কথা ওদের মুখে শুনে থাকে তা হলে কোনওরকমেই অনিমেষের কথায় আস্থা রাখতে পারে না। খানিকটা চিন্তা করে সে আবার বোঝাতে চাইল, ‘তা হলে ওরা মিথ্যে বলেছে এটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ। তোমার বড়কত্তা নিজের সম্পত্তি বাড়িয়ে যাচ্ছেন তোমাদের শোষণ করে।’
মইদুল হেসে উঠল আচমকা, যেন অনিমেষ খুব মজার কথা বলেছে, ‘এ কী কথা বললেন, সবাই তো চায় নিজের অবস্থা ভাল হোক, নতুন কী!’
অনিমেষ বলল, ‘কিন্তু দশজনের সম্পত্তি একজনের ঘরে গিয়ে জমা হবে কেন? আমরা চাই সবাই সমান অবস্থায় থাকুক। লাঙল যার জমি তার। তোমরা আমাদের সঙ্গে হাত মেলাও দেখবে দিন পালটাবেই।’
মইদুল বলল, ‘এসব একদম বাসি কথা। ভোটের আগে আপনি গাঁয়ে এসে আমাকে শোনালেন, আর পাঁচ বছর আপনার মুখই দেখতে পাব না। তখন আমাকে কে বাঁচাবে? না ওই বড়কত্তাই। তাই খামোকা তাঁকে চটিয়ে লাভ কিছু নেই।’
অনিমেষ হতাশ হচ্ছিল। এই লোকগুলোকে কীভাবে বোঝানো যায়? নিজেদের স্থবির পরিবেশ থেকে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষাটাই যেন মরে গেছে। আচ্ছা, লোকটাকে আহত করলে কেমন হয়? ওর মনে ঘা দিলে যদি নড়েচড়ে বসে।
অনিমেষ বলল, ‘দেখো কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না যদি সে নিজে বাঁচতে না-চায়। তোমরা, এই গ্রামের মানুষরা যদি এক হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে না-দাঁড়াও তা হলে চিরকাল এভাবেই পড়ে পড়ে মার খাবে। বড়লোকের সেবা করে তোমার কী লাভ হচ্ছে? তোমরা এত ভীরু কেন?’
খুব আস্তে মইদুল বলল, ‘কী করতে বলেন!’
উৎসাহিত অনিমেষ জানাল, ‘তোমরা নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করো। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমাদের একমাত্র অস্ত্র হল নির্বাচন। ভোটের মাধ্যমে আমরা একটা সরকারকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জনদরদি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যারা সাধারণ মানুষের কথা ভাবছে। ভোট হল ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রধান অস্ত্র।’
হঠাৎ মইদুল খেপে গেল। তার কপালে ভাঁজ পড়ল, গলার স্বর উঁচুতে উঠল, ‘তখন থেকে এক কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না তো। ভোট ফোট সব বুজরুকি। ও দিলেও যা না-দিলেও তা। যে জেতার সে ঠিক জিতবেই। আর জিতে গেলে নীচের দিকে তাকাবে না। যতক্ষণ সবার পা খালি ততক্ষণ কাদা লাগুক কেউ কিছু ভাবি না। কিন্তু যেই জুতো দিলাম পায়ে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা চলা টিপুস টিপুস হয়ে গেল, হবেই। কী সব কথা বলছিলেন, সবাই সমান হবে, পেট ভরে খেতে পাবে, বলছিলেন না! ছাই হবে, যত্ত বুকুনি। ভোট ফোট না, যদি সবাই জোট করে গিয়ে কেড়েকুড়ে নিতে পারি তবেই ফিরবে। ফালতু খোয়াব দেখাবেন না।’
শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। এই জীর্ণ শরীর থেকে এরকম কথা বেরিয়ে আসবে কল্পনাও করেনি সে। কোনওরকমে বলল, ‘তবে সেটাই করছ না কেন?’
মাথা নাড়ল মইদুল, ‘করলে কি আর আপনাকে এত কথা বলতে দিতাম! ওটা একটা মুখের কথা, সাহস নেই, শক্তিও নেই, আল্লাই বা মানবেন কেন!’
মইদুল তবু মুখ ফুটে এত কথা বলেছিল। গ্রামের অন্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। কেউ মুখ খোলে না। সবাই মরা মাছের মতো চোখ চেয়ে থাকে। সারাদিন গ্রাম ঘুরে বিকেলে একটা জমায়েত করল ওরা। কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীর পক্ষে জোরালো বক্তৃতা করে আবেদন জানাল ভোটের জন্য। কিন্তু অনিমেষ অনুভব করছিল এসব কথা কাউকেই স্পর্শ করছে না। যাত্রা দেখার মতো ওরা ওদের দেখছে। প্রতি মুহূর্তেই সে মনে করছিল তাদের এই বলার ধরন ও বিষয়ের সঙ্গে কংগ্রেসের বক্তব্যের বোধহয় কোনও গরমিল নেই। কমিউনিজম কি এভাবে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায়?
মিটিং-এর শেষে ওরা যখন ফিরে আসছে তখন গ্রামের বড়কত্তা ওদের সাদরে আমন্ত্রণ করলেন জলপানের জন্য। সারাদিন ঘুরে ঘুরে খাওয়া দাওয়া হয়নি। খিদেও পেয়েছিল খুব। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধ এড়াতে পারল না ওরা।
মুড়ি নারকোল আর বাতাসা খেতে খেতে ভদ্রলোকের কথা শুনল অনিমেষরা, ‘আজ সারাদিন তো ঘুরলেন আপনারা। দেখলেন কেমন?’
অনিমেষ বলল, ‘এভাবে মানুষ বেঁচে থাকে কল্পনাও করা যায় না।’
ভদ্রলোক বলল, ‘এভাবে মানুষ বেঁচে আছে। আপনারা যাঁরা শহরে থাকেন তাঁরা তো এদের চেনেন না। এই গ্রামে, ধরেন, আটশো ভোট আছে। প্রতিবার জোড়ালবলদ পায় সেগুলো। আগে যিনি দাঁড়াতেন তিনি আমাকে অতীব স্নেহ করতেন। তাঁর ছেলেটা শুনেছি লোক ভাল নয়। তাই আমারও পছন্দ নয়। এখন কী করবেন ঠিক করুন।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কথাটা বুঝতে পারলাম না।’
‘সরল কথা। আটশো ভোটের যারা ন্যায্য দাম দেবে তারাই এগুলো পাবে। যিনি এম. এল. এ. হবেন তিনি পাঁচ বছর ধরে কত পাবেন ভাবুন তো। হাজার রাস্তায় তাঁর পকেটে টাকা ঢুকবে। তাই হবার আগে আমাদের একটু মূল্য দিলে ক্ষতিটা কী, বরং নিশ্চিন্ত। একশো গুণ হয়ে টাকাটা ঘুরে আসবে তাঁর ঘরে।’ হাসলেন বড়কত্তা।
‘অসম্ভব। কী যা-তা কথা বলছেন? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আপনি ভোট বিক্রি করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। আপনাকে তো জেলে পোরা উচিত।’ অনিমেষের এক সঙ্গী চিৎকার করে উঠল।
‘গণতন্ত্র!’ হা হা করে হাসলেন বড়কত্তা, ‘মজার কথা বললেন। ওসব তো বইয়ে থাকে। আরে মশাই কংগ্রেস আর কমিউনিস্ট, যারা ভোটে দাঁড়ায় তারা একই টাকার এ-পিঠ ও-পিঠ। ক্ষমতা পাবে বলে, পার্টির ফান্ড বাড়বে বলে, ক্যাডারদের চাকরি দেবে বলে তার নিজের পকেট ভারী করতে বলে— এই তো মতলব। তা যারা তাদের ভোট দিয়ে এসব পেতে সাহায্য করবে তারা আঙুল চুষবে?’
অনিমেষরা আর কথা না-বলে বেরিয়ে এল। মাঠ ভেঙে দাসপাড়ায় ফেরার সময় অনিমেষের খুব ক্লান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল সারাদিনের পরিশ্রম কোনও কাজেই লাগল না। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে যেভাবে নির্বাচন করা হয়ে থাকে তাতে দেশের মানুষের মানসিকতার প্রতিফলন কতটা ঘটেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মইদুলের মতো মানুষেরা তাই ভোটের ওপর কোনও আস্থা রাখে না। কেড়ে নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু সেটা তো স্রেফ ডাকাতি, অরাজকতা।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে অনিমেষ আর-একটি কথা ভাবছিল। নির্বাচনী প্রচার করতে এসে তারা জনসাধারণকে বোঝাচ্ছে আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের সুখের রাজ্যে নিয়ে যাব। কংগ্রেসিরাও নিশ্চয়ই একই কথা বলছে। এ যেন তিন-চারটে সাবানের কোম্পানি দরজায় দরজায় নিজের প্রোডাক্টের গুণাগুণ বলে বেড়াচ্ছে বিক্রি বাড়াবার জন্য। যেসব প্রার্থী দলের হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের সঙ্গে জনসাধারণের যোগ নেই। তারা, কর্মীরা, কয়েকদিনের জন্য মধ্যস্থতা করছে মাত্র। কোনওরকম বিশ্বাস থেকে এরা ভোট দেবে না। যদি দেয় তা হলে কথার চটকে ভুলে কিংবা কোনও প্রাপ্তির আশায়। দেশে নতুন সরকার গঠিত হলে তার সঙ্গে মইদুলদের কী সম্পর্ক থাকবে? তা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি যদি একটি সংগঠিত আদর্শের ধারক হয় তা হলে এই নির্বাচনের ব্যবস্থায় তার সঙ্গে কংগ্রেসের পার্থক্যটা কী থাকছে? এ-দেশের মানুষকে যে বিষাক্ত রাস্তায় হাঁটানো হয়েছে এতদিন তাতে কিছু না-পেলে বা পাইয়ে না-দিলে তাদের সমর্থন পাওয়া যাবে না। এই দেওয়া-নেওয়া পদ্ধতিতে কি কখনও কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা সম্ভব?
এই ক’দিন নির্বাচনী প্রচার অনিমেষকে আর একটি জিনিস শেখাল। কমিউনিস্ট নেতাদের বিখ্যাত উক্তিগুলো মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রয়োগ করতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন হল একমাত্র অস্ত্র। এবং তার ব্যবহার করতে গেলে কোনওরকম কুণ্ঠা রাখা বোকামি। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন যুদ্ধে কোনও কাজই অসংগত নয়। নির্বাচনে জিততে হলে সবসময় থিয়োরি আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে না। বড় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে গেলে ছোট শত্রুর সঙ্গেও সাময়িক বন্ধুত্ব করতে বাধা নেই। নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে গৃহীত পথ যদি কংগ্রেসের থেকে ভিন্ন না-হয় তো ক্ষতি কী। কারণ, দু’পা এগোতে হলে এক পা পিছিয়ে যেতে আপত্তি নেই। অস্থির অনিমেষ দাসপাড়া থেকে এক সকালে জলপাইগুড়ি রওনা হয়ে গেল, কাউকে কিছু না-বলেই।