ঊনচল্লিশ
সন্ধে পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সেটা পেরোলেই শান্তিনিকেতন শীতের কোলে মুখ লুকোয়। আজ মেলার মাঠে সারা রাতের উৎসব। কিন্তু এই শ্রীনিকেতেনর পথে অথই ঘুম। এরকম একটা কাণ্ড এই শহরে হচ্ছে তা বোঝা যাবে না এ-পথে হাঁটলে। রাস্তায় একটাও মানুষ নেই, আশেপাশের বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ। অনিমেষের হাঁটতে খুব ক্লান্তিবোধ হচ্ছিল।
পকেটে যা পয়সা আছে তাতে একটা রিকশা অনায়াসেই করা যেতে পারে। কিন্তু সন্ধেবেলাতেই বোঝা গেছে শীতের রাতে রিকশায় চাপা কী বোকামি হবে। ঠান্ডাটা জোরে জোরে হাঁটলে কমে যায়। কিন্তু জোরে হাঁটার মতো মেজাজই আসছে না আজ। বারবার ঘুরে ফিরে মাধবীলতার মুখ ওর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্ফীত অধর, মুদিত চোখ— এ অন্য মাধবীলতা। সমস্ত শরীর এখন সেই মাধবীলতার স্পর্শে আচ্ছন্ন। জীবনে এই প্রথমবার একটি নারী শরীরের রহস্যে আচমকা ঢুকে পড়ল। এখন বেরিয়ে এসেও মনে হচ্ছে কিছুই জানা হল না কিন্তু প্রথম অভিযানের রহস্যটুকু আর রইল না।
শান্তিনিকেতনের রাস্তায় এই নির্জন রাতে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের মনে হল, আজ একটু আগে কোথায় যেন গিঁট পড়ল। দাদু পিসিমা বাবা কিংবা ছোটমা যে গিঁট দিতে পারেনি, রক্তের সম্পর্কে যে টান তাকে জড়াতে পারেনি এখন যেন সেই অনুভব তাকে আচ্ছন্ন করছে। মনে হচ্ছে সে আর একা নয়। মাধবীলতা যতই বলুক এ ব্যাপারে অনিমেষের কোনও দায়িত্ব নেই কিন্তু অনিমেষ সে-কথা কিছুতেই মানতে পারবে না। না, কোনও অপরাধবোধ নয়, পেছনে ছায়া রেখে হেঁটে যেতে ইচ্ছে হয় না, ছায়া থাকবে পায়ের তলায়।
বোলপুর কোঅপারেটিভ স্টোর্সের সামনে গিয়ে সে যখন পৌঁছাল তখন কুয়াশারা হিম হয়ে ঝরছে। অনুমানে বোঝা যায় গোয়ালপাড়ার রাস্তাটা বাঁ দিকে। তবু কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া দরকার। সে দেখল একটা খালি রিকশা বেশ কুঁড়েমি করে বাঁদিক থেকেই আসছে। ওকে দেখে লোকটা থামল, ‘মেলায় যাবেন বাবু?’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ‘না। গোয়ালপাড়ায় যাবার রাস্তা এদিকে?’
লোকটা নীরবে ঘাড় নাড়ল, তারপর প্যাডেল ঘুরিয়ে মেলার দিকে চলে গেল। বোধহয় এত রাতে সে গোয়ালপাড়ায় যেতে রাজি নয়। দু’পাশের বাড়িগুলো ঘুমুচ্ছে। সুন্দর রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে অনিমেষের মনে হল এখন যদি কেউ ওকে প্রশ্ন করে কী কারণে সে গোয়ালপাড়া যাচ্ছে, তা হলে উত্তর দেবার কিছু থাকবে না। সুবাসদার কথামতো যদি পুলিশ সতর্ক থাকে তা হলে এই পথেই তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। কারণ সে ছাড়া যখন আর কোনও মানুষকে দেখা যাচ্ছে না তখন…। অনিমেষ দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ চোখের সামনে অন্য কোনও পথও দেখা যাচ্ছে না। সরাসরি হেঁটে যাওয়ার মধ্যে বেহিসেবি ঝুঁকি আছে, অন্তত রাতের এই সময়ে। আরও আগে, লোকজন পথে থাকতে বেরিয়ে আসা উচিত ছিল। অনিমেষ রাস্তার এক ধার দিয়ে হাঁটতে লাগল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দু’পাশের ঘরবাড়ি কমে এসে খোলা মাঠ দেখা দিল। পিচ ফুরিয়ে গিয়ে কাঁচা মাটির পথ এখন পায়ের তলায়। বাঁ দিকে দূরে কালো জঙ্গলের রেখা। একটা সাঁকো মতো পেরিয়ে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। এবার পথটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে সোজা অন্যটা ডান দিকে নালার পাশ ধরে এঁকে বেঁকে ওপরে উঠে গেছে। তালগাছের মতো লম্বা লম্বা লম্বা একহারা গাছ ঝাপসা আকাশের পটভূমিকায় চোখে পড়ছে। এতক্ষণ আকাশে এক ধরনের ঘোলাটে আলো ছিল কিন্তু এখন কুয়াশারা যত ঘন হচ্ছে তত সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। এবং, এই ফাঁকা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল অনিমেষের। নিজের দাঁতের ওপর কর্তৃত্ব হারিয়ে গেল হঠাৎ।
দুটো পথের কোনটি গোয়ালপাড়ায় গেছে? নিজের ওপর তার খুব রাগ হচ্ছিল। বিকেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে রাখা উচিত ছিল। চারপাশে ফাঁকা, শীতের কামড় খুব, অনিমেষ একটা গলা শুনতে পেল। কেউ গান গাইতে গাইতে আসছে। চমৎকার গলায় শ্যামাসংগীত গাইছে কেউ। অনিমেষ নিজেকে আড়াল করার কোনও উপায় না-দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। একটু বাদেই লোকটা সামনে এসে ওকে দেখে গান থামাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘মানুষ মনে হচ্ছে?’
অনিমেষ ওকে দেখে আশ্বস্ত হল। লোকটি ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত বারংবার দেখছে দেখে সে হেসে বলল, ‘গোয়ালপাড়া কোন দিকে?’
‘উদ্দেশ্যটা কী?’
অনিমেষ বুঝল লোকটি মাতাল। পুলিশের চরও হতে পারে। কিন্তু এখন তো কিছু করার উপায় নেই। তবু রহস্য করে সে বলল, ‘দুটো রাস্তা তো, কোনটা কোন দিকে তাই জানতে চাইছি।’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে উঠল লোকটা, ‘উঁহু বাবা, ফাঁকি দিয়ে পথ জেনে নেওয়া হচ্ছে! ঠিক রাস্তা জানতে পারে না বলেই তো মানুষ মরে। মেলা থেকে?’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল।
‘খবর কে দিল?’
‘কীসের খবর?’
‘জ্ঞান দেখি টনটেন। মচকায় কিন্তু ভাঙে না। আরে বাবা মায়েদের কাছে পোয়াতিদের লজ্জা করার কিছু নেই। চলুন, আমিও যাচ্ছি।’
‘গোয়ালপাড়ায়?’
‘আবার কথা! কিন্তু রাত হল কত? বেশি মাল না-নিলে তো আর শুঁড়ির ছেলে দোকান খুলবে না। দশটায় বন্ধ করে, আজ মেলা বলে যদি…। তা আপনি নতুন লোক, আপনাকে দেখিয়ে মন ভজানো যাবে।’
লোকটা হাঁটা শুরু করল। পেছনে অনিমেষ। তবু সন্দেহ, তাই জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি গোয়ালপাড়ায় যাচ্ছেন?’
‘আর কোথায় যাব বাবা। আমার মক্কা বলো আর কাশী বলো তা হল ওই গোয়ালপাড়া। এত বড় দিশি মালের কারখানা বীরভূমে ক’টা আছে? না, ভেজাল পাবে না, কেউ মাল খেয়ে মরেনি আজ পর্যন্ত, না-খেয়ে মরেছে।’
‘না-খেয়ে?’
‘আমার বন্ধুরা কেউ মাল খায় না। বাপ মা ভাই কাকা কেউ না। কিন্তু আর্ধেক লোক টেঁসে গেছে এর মধ্যে। আমি শালা মাল খেয়ে চরে বেড়াচ্ছি।’
‘আপনার বাড়ি ওখানেই?’ অনিমেষ এতক্ষণে লোকটাকে বুঝে নিয়েছে। সে ভাব জমাবার চেষ্টা করল।
লোকটা প্রথমে কোনও উত্তর দিল না। গুম হয়ে জোরে জোরে হাঁটতে আরম্ভ করল। পরিবর্তনের কারণ অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। দরকার নেই বেশি কথা বলে। একবার গ্রামটা চোখে পড়লেই সঙ্গ ছাড়বে সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে লোকটা নিজের মনেই বলল, ‘এ শালা আমার চেয়ে বড় মাতাল। মেলা থেকে ঠিক গন্ধে গন্ধে ছিটকে এসেছে। আবার বলে কিনা ওটা আমার বাড়ি কিনা! মালখানাকে যে বাড়ি বানায় সে শালার সংগত করতে নেই!’
অনিমেষের হাসি পাচ্ছিল কথাগুলো শুনে। সে চট করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
‘বড় মাতাল ছোট মাতালের মাথায় হাত বোলায়। আমার পয়সায় মাল খাওয়ার মতলব?’ লোকটা আরও জোরে পা চালাল।
অনিমেষ ইচ্ছে করে দূরত্বটা বাড়িয়ে দিল। লোকটা পড়ি মরি করে ছুটছে। ক্রমশ একটা গ্রামের আদল নজরে এল। অন্ধকারে আবছা ঘর বাড়ি। গ্রামের গায়ে এসে অনিমেষের খেয়াল হল, সেই মাতাল লোকটা উধাও হয়ে গেছে। কাছাকাছি তার অস্তিত্ব নেই। মাতালরা নাকি নেশার সময় খুব উদার হয়, এই লোকটি সেরেফ খাওয়াতে হবে ভেবে এমন করল! কাঁচা লাল মাটির পথ, মাঠির ঘরদোর, গ্রামে ঢুকে অনিমেষ চমক খেল। সেই ছেলেবেলা থেকে বাংলাদেশের যে গ্রামের ছবি বইয়ে দেখে আসছে তাই এখন চোখের সামনে। এই ছবির সঙ্গে উত্তরবাংলার গ্রামের কোনও মিল নেই। অবশ্য এখন এই রাতে ঘরের বাইরে কোনও মানুষ নেই। যেন একটা পরিত্যক্ত গ্রামে সে একা হাঁটছে। নির্দেশ মিলিয়ে মিলিয়ে সে সঠিক বাড়ির সামনে গিয়ে উপস্থিত হতেই সিটি শুনতে পেল। অনিমেষ এই গোপন ইশারার হদিশ জানে; এ সময় যা করা উচিত তাই করল সে।
ভোর রাতে সভা ভাঙল। নির্বাচন সামনে। সেটা বয়কট করার জন্য সামগ্রিক প্রচার করতে হবে। দলনেতারা আশঙ্কা করছেন কংগ্রেস নয়, সি পি এম থেকেই তাদের উৎখাত করার চেষ্টা করা হবে। অর্থাৎ এখন ঘরে বাইরে যুদ্ধ। যতটা সম্ভব বেশি ক্যাডার বাড়াতে হবে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হল। জনসাধারণের ক্ষতিকর মানুষ, যেমন জোতদার, সুদখোর ইত্যাদিদের প্রয়োজনে শেষ করে দেওয়া হবে। সাধারণত এরা পুলিশ এবং সরকারের সমর্থনপুষ্ট। এইসব মানুষের হাত থেকে সাধারণ মানুষ রেহাই পেলে দলের প্রতি সমর্থন বাড়বে। সারা দেশ জুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই শাসনব্যবস্থার ঠুনকো কাঠামোটা ভেঙে পড়বে এবং বিপ্লবের প্রসন্ন সময় উপস্থিত হবে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, কতগুলো পুরনো বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট যা কিনা বুর্জোয়া মানসিকতাপ্রসূত, সেগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে মোহমুক্ত করতে হবে। রেনেসাঁর কাল যাকে বলা হয় সেইসময় এবং তার পর থেকে যাঁদের মহান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, দেশের নানা জায়গায় ঘটা করে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই সেই সম্মানের যোগ্য ছিলেন না। বুর্জোয়া শক্তিগুলো দেশের মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রাখার জন্যে তাঁদের ব্যবহার করেছে। তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা রাজনৈতিক বিপ্লবের পাশাপাশি শুরু করা দরকার।
বাঙালির ইতিহাস বড়জোর দেড়শো বছরের। খুব বেশি দূর নয়, পলাশির যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি বাঙালিও উপস্থিত ছিলেন না। এমনকী সিপাহিযুদ্ধের সময় সারা দেশ যখন আলোড়িত তখন কোনও বাঙালির নাম শোনা যায়নি। প্রথম বাঙালি যিনি আমাদের সামনে নিজের কৃতিত্বে উঠে এসেছেন তিনি কি রামমোহন রায়! ইতিহাস প্রতাপাদিত্যের কথা বলে। কিন্তু ভদ্রলোক একজন লেঠেল সর্দার ছাড়া অন্য কিছু ছিলেন না। এবং তাঁর বাঙালিত্ব নিয়েও সন্দেহ আছে। এদেশের রাজারা, কুচবিহার বা বর্ধমান— এঁরা কেউ বাঙালি নন। কৃষ্ণচন্দ্র রায় একজন বড় জমিদার ছাড়া কিছু নন। অর্থাৎ দেড়শো বছর আগে আমাদের চতুর্থ পূর্বপুরুষ মাথায় গামছা বেঁধে হয় চাষ করতেন কিংবা সেই চাষ তদারক করতেন। আমাদের যা কিছু বোলবোলা শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে। অর্থাৎ বাঙালির কোনও ধারাবাহিক ইতিহাস নেই। একশো-দেড়শো বছরের হঠাৎ উঠতি জাতির ফুটুনি তাই চোখে পড়ার মতো। স্রেফ একদল নিরক্ষর চাষি, জেলে কিংবা কুচুটে ব্রাহ্মণ এতকাল নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করছিল। ইংরেজ আসার পর অব্রাহ্মণরা তাদের চাটুকারিতা করার জন্যে ইংরেজ শিখে নিলেন চটপট। এই বিদ্যা চাকরি পেতে সুবিধে দিল। ব্রাহ্মণরা নিজেদের গোঁড়ামিতে কিছুদিন ইংরেজদের থেকে দূরে সের থাকার পর দেখল এতকাল যাদের তারা ধর্মের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রেখেছিল তারা অবস্থাপন্ন হয়ে যাচ্ছে চটপট ইংরেজি শিখে। শেষ পর্যন্ত তারাও লাইন ধরল। ফলে এতকালের মরে থাকা একটি জাত রাতারাতি চাকর হয়ে গেল। তা এইরকম একটা জাত থেকে যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কিংবা বিদ্যাসাগর উঠে আসেন তখন তাঁদের অস্বীকার করা কি যায়! হয়তো মাত্র দেড়শো বছর আমরা মানুষ হয়েছি কিন্তু এই সময়ের মধ্যে শিল্প সংস্কৃতিতে আমরা অনেকের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো উপযুক্ত হতে পেরেছি। এখন প্রশ্ন, যে শিল্প সংস্কৃতির কথা এতকাল আমরা জানি তার সম্যক চেহারাটা সাধারণ মানুষের কতটা উপকারে লাগছে। অনিমেষ এ ব্যাপারে একমত যে বড়মানুষদের তৈরি এই সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনও যোগ নেই। আকাদেমিতে যেসব কৃষিবিপ্লবের নাটক হয় তা যদি গ্রামে দেখানো হয়, সত্যিকারের কৃষকরা ক্যারিকেচার দেখছে বলে হেসে গড়িয়ে পড়বে। তাই এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। হয়তো তার মন সবকিছুতেই সায় দিচ্ছে না কিন্তু বৃহৎ কিছু ফললাভের জন্যে সামান্য ভুলগুলো সম্পর্কে অন্ধ হয়ে থাকা ভাল।
ইতিহাস একটু অন্যরকম করে লেখা দরকার। ইংরেজরা আমাদের মানুষ করেছে এটা সূর্যের মতো সত্য। ওরা আসার পর আমরা জীবনধারণ ও যৌন কাজের বাইরে অন্য কিছু জগতের কথা ভাবতে শিখলাম। কিন্তু তার বদলে গোলামিটাও রক্তে ঢুকে গেল। প্রিন্স দ্বারকানাথ পাল্লা দিয়েছেন ওদের সঙ্গে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি খুলেছেন, ব্যাঙ্ক স্থাপন করেছেন ইংরেজদের কাছে জেনে। এবং মদ খেয়েছেন ও মেমসাহেবের কাছে প্রণয় জেনেছেন। ফলত তিনি প্রিন্স। বিদ্যাসাগর কিংবা রামমোহন, যতই বাঙালিয়ানা চাপাই না কেন, তাঁদের চরিত্রে ইংরেজি শিক্ষা মেরুদণ্ডের মতো কাজ করেছে। ফলে ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর আমরা পিতৃমাতৃহীন হয়ে গেলাম। ভারতবর্ষের মানচিত্রে কোনও স্থান রইল না বাঙালির। ওদিকে ঊষর মরুভূমির মানুষ রাজস্থানি কিংবা পারসি সিন্ধিরা ইংরেজের চাকর না-হয়ে তাঁদের মন জুগিয়ে ব্যাবসা শুরু করেছিল। ইংরেজ চলে যাওয়ার পর দেশটা তাই ওদের হাতেই চলে গেল।
রবীন্দ্রনাথ যদি এদেশে না-জন্মাতেন তা হলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হত। এই মানুষটি নিজে বীজ সৃষ্টি করে তা থেকে বিরাট মহীরূহ দাঁড় করিয়ে গেলেন একা। অবশ্যই বিবেকানন্দের নাম তাঁর পাশে উচ্চারণ করা যায়। এবং এই দু’জন ব্যতিরেকে বাকিটা সব অন্ধকার। শ্রীহট্টের মানুষ চৈতন্যদেব যে ধর্মবিশ্বাসে বাঙালিকে উদ্বেলিত করেছিলেন তার ব্যবহারিক মূল্য কতটুকু? নদিয়া থেকে উড়িষ্যায় চলে যেতে হয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উন্মাদনায়। তা হলে? তবে ওই ঈশ্বরমুখী মানুষটিকে নবজাগরণের প্রতীক বলে ঐতিহাসিকরা আমাদের আফিং খাইয়ে যাচ্ছেন।
অনিমেষ সভার শেষে সরাসরি কিছু নির্দেশ জেনে নিল। এখন আর কোনও কুণ্ঠার সময় নয়। খুব শিগগির একটা স্কোয়াড যাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গেরিলা ট্রেনিং-এর জন্যে। কিছু কিছু অস্ত্র যাতে ঠিক সময়ে পৌঁছে যায় তার আয়োজন হচ্ছে। এসবের জন্যে যে অর্থ প্রয়োজন তার ব্যবস্থা অনিমেষদেরই করতে হবে।
মিটিং-এর পর সুবাসদার সঙ্গে যখন কথা বলার জন্য অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ঠিক তখনই লোকটার দিকে তার নজর পড়ল। এতক্ষণ এই বড় ঘরটায় এত লোকের মধ্যে সে খেয়াল করেনি। দেখে হতবাক হল সে। লোকটারও প্রায় সেই অবস্থা। তারপর চট করে নিজেকে সামলে লোকটা বলল, ‘মাল ফাল খাইনি বুঝতেই পারছেন!’
‘আমিও সেটার সন্ধানে এখানে আসিনি তাও দেখছেন!’
‘আরে বাপ, আমি তো মশাই আপনাকে দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম এ শালা নিশ্চয়ই খোঁচড়। কী করে কাটানো যায় তাই ছিল আমার ধান্দা।’ অনিমেষ হাসল, ‘আপনি না-এলে আমার এখানে আসতে একটু অসুবিধে হত। খুব চমকে দিয়েছেন কিন্তু।’
এই সময় সুবাসদা ওদের কাছে এল, ‘অনিমেষ, তুমি কি আজই ফিরে যাচ্ছ?’
‘তাই তো ইচ্ছে আছে।’
‘হ্যাঁ, তোমার কলকাতায় না-যাওয়াই ভাল। কীভাবে ফিরবে ঠিক করেছ?’
‘দুপুরের ট্রেন ধরব।’
এই সময় লোকটা বলল, ‘যাবেন কোন দিকে?’
সুবাসদা বলল, ‘আপনিও তো নর্থবেঙ্গলে যাবেন। একসঙ্গে যেতে পারেন আপনারা।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি নর্থবেঙ্গলে কোথায় যাবেন?’
‘রায়গঞ্জ। আপনি?’
‘শিলিগুড়ি।’
‘বাঃ গুড।’ লোকটা হাসল, ‘কিন্তু ট্রেনে না-যাওয়াই ভাল।’
‘তা হলে কীসে ফিরবেন?’
‘সে ব্যবস্থা করেছি। বোলপুরে একটা লরি এসেছে কুচবিহার থেকে। সেটা আজ সকালেই ফিরবে। ওটাতেই এলাম ওটাতেই যাব।’
‘আপনাদের সঙ্গে গেলে জায়গা হবে?’
‘সারা ভারতবর্ষকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছি আর আপনি তো মশাই মোটে পঞ্চাশ কেজির লোক হবেন?’ লোকটা অনিমেষের সঙ্গে হাত মেলাল।
এখন বাইরে প্রচণ্ড কুয়াশা। চারধার সাদা হয়ে গেছে। মাথার ওপর আকাশটা তাই ঘোলাটে, এমনকী শুকতারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ওরা ছোট ছোট দলে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সুবাস, অনিমেষ এবং সদ্য পরিচিত মানুষটি চুপচাপ গ্রামের বাকি পথটুকু পার হয়ে একটা ছোট্ট নদীর কাছে এল। এটা ওরা যেদিক দিয়ে গ্রামে ঢুকেছিল তার বিপরীত দিক। এ গ্রামে শীতকাল বলেই হয়তো কোনও কুকুর এই ভোর রাতে ডাকছে না, কোনও মানুষ পথে হাঁটছে না। লোকটা বলল, ‘আমি কিন্তু গুল মারিনি। এখানকার দিশি মদের দোকান খুব বিখ্যাত।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’ অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
‘জেনে নিয়েছি। এই যে নদী, এটা ডিঙিয়ে আলপথ দিয়ে কিছুটা গেলে যে গ্রামটা পড়বে তার নাম তালতোড়। ওটা ছাড়িয়ে আর-একটু হাঁটলেই কোপাই।’
লোকটার পেছন পেছন নদী পার হল ওরা। প্রচণ্ড ঠান্ডা জল। সুবাস বলল, ‘আপনি যখন সব জানেন তখন গাইড হয়ে আগে আগে হাঁটুন, আমরা পেছনে আসছি।’
লোকটা মাথা নাড়ল, ‘তা কেন, একসঙ্গে পা ফেলি আসুন।’
সুবাস বিরক্ত হল, ‘দূর মশাই, এতদিন পর এর সঙ্গে দেখা হল, দুটো ব্যক্তিগত কথাও থাকতে পারে। বুঝছেন না কেন?’
লোকটা বলল, ‘তা তো বটে।’ বলে একটু এগিয়ে হাঁটা শুরু করল। অনিমেষ অনেক দূরে গ্রাম দেখতে পাচ্ছিল। এদিকটায় শুধু মাঠ আর মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। শীতের সময় বলেই বোধহয় এখনও অন্ধকার হালকা হয়নি। সুবাস কিন্তু অনিমেষের সঙ্গে কথা বলছিল না। ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে অনিমেষ বলল, ‘সেই প্যাকেটটা নিতে আমার সঙ্গে যেতে হবে তো?’
সুবাস মাথা নাড়ল, ‘না। ওটা ফিরিয়ে দিতে হবে না।’
‘কী আছে ওতে?’ অনিমেষ বুঝতে পারছিল না।’
‘রিভলবার।’ বলে সুবাস কাঁধের ঝুলি থেকে একটা ছোট অস্ত্র বের করে অনিমেষকে দেখাল, ‘ঠিক এইরকম।’ তারপরই অনিমেষকে একদম পাথর করে দিয়ে সামনে গুলি ছুড়ল। অনিমেষ দেখল চলতে চলতে সেই মুহূর্তে লোকটা ওদের দিকে মুখ ঘুরিয়েছিল এবং গুলিটা সরাসরি তার বুকে বিদ্ধ হতেই সে যেন কিছুটা শূন্যে উঠে গিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরের কাছে ছুটে গেল সুবাস। লোকটার ডান পকেটে একটা ছোট অস্ত্র ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। তখনও গুলির শব্দ সেই নির্জন রাতের ফাঁকা মাঠে গড়িয়ে গড়িয়ে আকাশের দিকে যেন এগিয়েই যাচ্ছে। অনিমেষ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে ধাতস্থ হবার আগেই সুবাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দৌড়ে চলো।’
ঠিক খেয়াল নেই কতটা পথ কীভাবে ওরা পেরিয়ে এসেছে। শান্তিনিকেতনে ঢোকার মুখে সুবাস পা থামাল। অনিমেষের চোখের সামনে তখনও যেন সেই শরীরটা মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। এভাবে আচমকা হত্যা করার কোনও কারণ সে খুঁজে পাচ্ছিল না। লোকটি তাদের দলের না-হলে এই গোপন মিটিং-এ প্রবেশ করার সুযোগ পেল কী করে? তা হলে?
সুবাস বলল, ‘ভোর হয়ে আসছে। তুমি ফিরে যাও।’
অনিমেষ সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘লোকটা কী অন্যায় করেছিল?’
সুবাস বলল, ‘কথা বলার বেশি সময় নেই। ও পুলিশের চর। আমাদের সঙ্গে কাজ করার ভান করে এসেছে। আমি জানি ও ট্রেনেই এসেছে ট্রেনে যাবে। লরির ব্যাপারটা স্রেফ বানানো। তোমাকে কিংবা আমাকে আজ শ্রীঘরে ঢুকতে হত।’
অনিমেষ বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না—।’
সুবাস বলল, ‘চোখ কান খোলা রাখো অনিমেষ। যখনই বুঝবে কেউ পথের বাধা হচ্ছে তখনই তাকে সরিয়ে দেবে। সেন্টিমেন্ট মানুষকে সবসময় দাম দিতে বাধ্য করে। লোকটার সম্পর্কে আজ বিকেলেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যা হোক, আমি এখান থেকেই চলে যাচ্ছি। তুমি পুল পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরো।’
‘কিন্তু প্যাকেটটা—।’
‘বললাম তো, ওটা তোমার জন্যে। গুলি লোড করাই আছে। সঙ্গে একটা কাগজে ডেমনস্ট্রেশন দেওয়া আছে। আবার দেখা হবে।’
সেই ফিকে চাঁদের আলোয় অনিমেষ সুবাসকে উলটো পথে হাঁটতে দেখল। তারপর দ্রুত পা চালাল শ্রীনিকেতনের দিকে। কনকনে ঠান্ডাতেও এখন আর অনিমেষের শীতবোধ ছিল না।
হিমে স্নান করা বাড়িগুলোর কাছে এসে অনিমেষ একবার দাঁড়াল। হঠাৎ প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নাক মুখ বরফের মতো ঠান্ডা। সমস্ত এনার্জি যেন শরীর থেকে নিংড়ে নিয়েছে রাতটা। পুবের আকাশ এখন ঈষৎ লালচে। বাগান পেরিয়ে সে খিড়কি দরজার কাছে এসে দেখল সেটা বন্ধ। কয়েকবার আস্তে শব্দ করলেও ভেতরে কারও সাড়া পাওয়া গেল না। বাড়িটা যেন নিঝুম হয়ে আছে। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল সে মাধবীলতার কাছে আর কখনওই পৌঁছাতে পারবে না। অন্যের গড়া দুর্গে মাধবীলতাকে রেখে বেরিয়ে গেলে ফিরে এসে কখনওই আর দরজাটা খোলা পাবে না। ব্যাপারটা ভাবতেই হিম যেন বুকে ছড়াল। সে খুব জোরে আঘাত করতে লাগল দরজায়। এখন এই কাকভোরে এই শব্দ চতুর্গুণ হলেও তার কোনও প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। হতাশ অনিমেষ ভেতরে পায়ের আওয়াজ পেল এবার। দরজা খুলল মাধবীলতা। তার চোখে মুখে উদ্বেগ। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’
অিনমেষ উত্তর না-দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মাধবীলতার হাত নিজের দু’হাতে টেনে নিল। মাধবীলতা বলল, ‘ওমা, তুমি একদম জমে গেছ, এসো, তাড়াতাড়ি ভেতরে এসো।’
চাতালের পাশে সবকটা দরজা বন্ধ। দারোয়ানটার ঘুম ভাঙার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বন্ধ ঘরের উত্তাপ বড় আরামের। অনিমেষ সরাসরি খাটে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ঘুমোওনি?’
মাধবীলতা ঠোঁট টিপে মাথা নাড়ল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’ অনিমেষ সহজ হবার চেষ্টা করছিল।
‘তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। শুয়ে পড়ো।’
‘শুয়ে আর কী হবে। একটু বাদেই তো বের হতে হবে।’
‘তুমি কি আজই ফিরে যাবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ট্রেন কখন?’
‘বোধহয় বারোটা।’
‘তা হলে তো অনেক দেরি আছে।’
অনিমেষ মাধবীলতাকে পূর্ণ চোখে দেখল। তারপর বলল, ‘তোমার কিছু বলার নেই?’
‘না। তুমি ভাল থেকো শুধু এইটুকু।’
বালিশে মাথা রেখে অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। মাধবীলতা এসে ওর পাশে বসল। বসে বলল, ‘তোমাকে কিন্তু আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে।’
‘একটা লোককে চোখের ওপর মরে যেতে দেখলাম।’
‘সেকী! কেন?’
‘লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। লতা, জানি না তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে কি না। বোধহয় না-হওয়াই ভাল।’
‘কেন?’
‘তোমায় দেখলে আমি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি।’
‘জানতাম না তো।’
‘আজ ফিরে এসে দরজা বন্ধ দেখে সেটা অনুভব করলাম। আমি দূরে থাকলে মনে হয় তুমি আমার জন্যে আছ। কিন্তু কাছে এলেই ভয় হয় যদি হারিয়ে যাও।’
মাধবীলতা ধীরে ধীরে ওর মুখ অনিমেষের গালের ওপর রাখল। দু’হাতে অনিমেষের মাথা আঁকড়ে ধরে নিজের শরীরের তাপে অনিমেষের শীতলতা ঢেকে দিয়ে বলল, ‘আমি আছি, আমি থাকব।’
দশটা নাগাদ ওরা টাকাপয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে এল। রিকশা নিল না ওরা। জিনিসগুলো দু’হাতে বয়ে বড় রাস্তায় চলে এল। বেরুবার আগে মাধবীলতা প্যাকেটটা বের করে জিজ্ঞাসা করল, ‘সেই ভদ্রলোক তো এলেন না?’ অনিমেষ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল, ‘ওটা আমার জন্যে। কী আছে জানো এতে?’
মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল।
‘রিভলবার।’ অনিমেষ সযত্নে জিনিসটাকে লুকিয়ে রাখল। আর রাখতে গিয়ে ওর মনে পড়ে গেল। বড় রাস্তায় এসে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার জিনিসপত্র ওরা হস্টেল থেকে এনে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল না?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেগুলো ঠিক আছে?’
‘কেন?’
‘আমি একটা জিনিস একদম ভুলে গিয়েছিলাম। দুটো প্যাকেট আমার কাকা আমাকে দিয়েছিলেন দু’জনকে দেবার জন্যে। মনেই পড়ছে না ওগুলো নিয়ে আমি কী করেছি। তুমি কি ছোট দুটো প্যাকেট ওগুলোর মধ্যে পেয়েছ?’
‘না তো।’
‘কী আশ্চর্য! তা হলে গেল কোথায় ওগুলো!’
‘খুব দরকারি কিছু!’
‘জানি না। আমাকে পৌঁছে দিতে দেওয়া হয়েছিল। যাঃ, খুব খারাপ লাগছে।’
‘তা হলে আমি ভাল করে খুঁজে দেখব।’
‘দেখো তো।’
ওরা খানিকটা এগোবার পর মাধবীলতা বলল, ‘শোনো, আমার মনে হচ্ছে তোমার একা ট্রেনে ওঠা উচিত হবে না।’
‘কিছু হবে না।’
‘হলে কিছু করার থাকবে না। আজ কাকে মেরে ফেলা হয়েছে তার খবর পুলিশ পেলে নিশ্চয়ই হাওয়া খুব গরম হবে।’
অনিমেষ দাঁড়াল, ‘ঠিক বলেছ। তা হলে কী করা যায়?’
‘আমি তোমার সঙ্গে যাব।’
‘পাগল! তোমার স্কুল আছে না?’
‘থাক।’
‘কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে কী লাভ হবে?’
‘স্বামী-স্ত্রী দেখলে পুলিশ সন্দেহ করবে না।’
অনিমেষ মাধবীলতাকে দেখল। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে মাধবীলতা ততক্ষণে সেটাকে থামিয়েছে। ওটায় চেপে মাধবীলতা আঁচলটা মাথায় তুলে দিল। সামান্য একটু কাপড়ের আড়াল কিন্তু অনিমেষের মনে হল পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এর কাছে মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। মাধবীলতা নিঃশব্দে অনিমেষের হাতে চিমটি কাটল, ‘এই, কী দেখছ?’
অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল, কোনও কথা বলল না। মাধবীলতা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। অনিমেষের বুকের ভেতরে একটা লোহার বল গড়াচ্ছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছিল সে।
বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল। ঠিক সামনেই একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। ওপরে লেখা সাঁইথিয়া। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে সময়টা জেনে নিল অনিমেষ। সাঁইথিয়া যেতে যে সময় লাগবে তাতে নিশ্চিতভাবেই সেখান থেকে ট্রেনটা ধরা যাবে। সাঁইথিয়া স্টেশনে নিশ্চয়ই কোনও বিপদের ঝুঁকি নেই।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’
‘বাসে সাঁইথিয়া যাব। তুমি ঠিকই বলেছ, রিস্ক নিয়ে কোনও লাভ নেই।’
‘তুমি কি চাইছ আমি তোমার সঙ্গে না-যাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘তুমি জানো লতা।’
অনিমেষ আর কথা বাড়াল না। চট করে সাঁইথিয়ার বাসটায় উঠে জায়গা খুঁজতে লাগল। একদম পেছনের দিকে একটা সিট পাওয়া গেল। ব্যাগটা সেখানে রেখে নেমে এসে দেখল মাধবীলতা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাটা তখনও চলে যায়নি। ঠিক সেই সময় আর-একটা প্রাইভেট বাস এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াল। ওপরে সাদা কাগজে ‘স্পেশাল’ শব্দটা লেখা। তার নীচে শান্তিনিকেতন-কলকাতা। কনডাক্টর তার দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। ‘বর্ধমান, কলকাতা।’
অনিমেষ বলল, ‘চমৎকার। কী সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে গেল। তোমার আর ট্রেনে করে ফিরে দরকার নেই। নিশ্চয়ই স্টেশনে লোক পিলপিল করছে। এই বাসটার খবর পেলে আর দেখতে হবে না। উঠে এসো চটপট।’ মাধবীলতার জিনিস নিয়ে অনিমেষ ভরতি হতে যাওয়া বাসটায় উঠে পড়ল। প্রথমদিকের লেডিস সিটে সেটা রেখে জানলা দিয়ে ডাকতে মাধবীলতা ভারী পায়ে উঠে এল।
অনিমেষ বলল, ‘একদম টানা চলে যাবে। কষ্ট পাবে না।’
‘কষ্ট!’ মাধবীলতা হাসল।
ওদিকে সাঁইথিয়ার বাস হর্ন দিচ্ছে। অনিমেষ বাস থেকে নেমে পড়তেই মাধবীলতা পেছনে ডাকল। জানলার নীচে গিয়ে দাঁড়াল অনিমেষ। মাধবীলতা চট করে ব্যাগ খুলে একটা খাম বের করে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
‘কী এটা?’
‘তোমার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। দরকার হবে।’
অনিমেষ খামটা খুলতে যাবে, এমন সময় বাসটা আবার সজোরে হর্ন বাজাল। দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠল সে। ততক্ষণে প্রায় ভরতি হয়ে গেছে॥ লোকেরা এখন দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। ভিড় সাঁতরে কোনওরকমে নিজের সিটে গিয়ে বসতেই সে মাধবীলতাকে দেখতে পেল। কলকাতার বাসের জানলায় ওর মুখ।
মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করছে, ‘কবে দেখা হবে বললে না!’
‘লিখব।’ চেঁচিয়ে বলল অনিমেষ।
মাধবীলতা কী বলল শুনতে পেল না অনিমেষ। কারণ, তখন সশব্দে বাসটা চলতে শুরু করেছে। একপলকেই মাধবীলতার উদগ্রীব মুখটা মুছে গেল সামনে থেকে। মাধবীলতার বিপরীতমুখী বাসে বসে খামটা খুলে শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। পাঁচটা একশো টাকার নতুন নোট খামের ভেতরে। সঙ্গে একটা সাদা কাগজে দুটো অক্ষর লেখা, ‘ভাল থেকো।’