ছয়
তিনটের ক্লাসটা শেষ হলে অনিমেষ পরমহংসকে বলল, ‘চলো একবার নীচের লনে যাই।’
পরমহংস বলল, ‘ধ্যুৎ, ওখানে গিয়ে কী হবে! রোজ এক কথা, এস এফ বলবে তাদের মতো ভাল দল আর কেউ নেই, ছাত্র পরিষদ বলবে ওরাই ধোয়া তুলসীপাতা। এসব শুনে আমার কী লাভ হবে? ওসব ছেঁড়াছেঁড়ি খাওয়া-খাওয়ির মধ্যে আমি নেই।’
অনিমেষ হেসে ফেলল বলার ধরনে, ‘তুমি দেশের কথা ভাবো না?’
‘দেশের কথা?’ হাঁ করে তাকাল পরমহংস, ‘তুমি তো হেভি খ্যাপা! দেশের কথা কেউ ভাবে নাকি! সবাই নিজের ধান্দা হাসিল করার জন্য দেশের নামটা ব্যবহার করে। যে যত দেশের কথা বলবে সে তত মাল গোটাবে।’
অনিমেষ বলল, ‘ঠিক আছে, তবু মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে যাই চলো। তা ছাড়া, স্টুডেন্টস লিডাররা নিশ্চয়ই আমাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবে, দেশের ব্যাপারটা তো এখানে জড়িত নয়।’ অনিমেষের একা যেতে ভাল লাগছিল না। স্কটিশে সে অনেককে বক্তৃতা করতে দেখেছে কিন্তু সেগুলো কেমন ছেলেমানুষি ব্যাপার। শোনার ইচ্ছে হত না তেমন। আজ বিমানের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর একটা কৌতূহল ওর মনে জেগেছে, ওরকম ধীর স্থির এবং সুবাসদার কথামতো পলিটিক্যলি কনশাস একট ছেলে কেন একবারও দলের ছেলেদের বলল না কেউ ওর গায়ে হাত তোলেনি। নিশ্চয়ই হঠাৎ-ডাকা আজকের মিটিং-এ এ ব্যাপারে কিছু জানা যাবে।
পরমহংস বললে, ‘আচ্ছা, প্রথম দিন, তোমার কথা ফেলব না। কিন্তু ম্যাক্সিমান পাঁচ মিনিট, তারপর কেটে পড়ব।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি এখন বাড়ি ফিরে পড়াশুনা করো?’
পরমহংস ঘাড় বেঁকিয়ে ওর মুখের দিকে পিটপিট করে তাকাল, ‘তুমি মাইরি হয় ডুপ্লিকেট, নয় মেড ইন মফস্সল। কোনটা?’
অনিমেষ হেসে বলল, ‘প্রথমটা কী আমি বুঝতে পারছি না, তবে আমার বাড়ি ডুয়ার্সে।’
‘তাই বলো! নইলে এসব ফর্মা বেরোয় মুখ থেকে! বাংলা নিয়ে এম এ বেশিরভাগ ছেলে পড়ে কেন জানো না? পড়ে যাতে ক্লাসের বাকি সময়টা আড্ডা মারা যায়। যারা ফার্স্ট ক্লাসের ধান্দায় থাকে তাদের কথা আলাদা, সেকেন্ড ক্লাস এম এ-র জন্য পরীক্ষার আগে ছাড়া বাংলা পড়তে হয় না। আমি এখান থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে যাব, তারপর হেঁটে চিৎপুর গিয়ে টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরব।’ পরমহংস জিভে একটা তিক্কুটে শব্দ করল।
এতক্ষণে সব ছেলেমেয়েরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছে। আজ ওটাই শেষ পিরিয়ড ছিল। অনিমেষ দেখল তিনটি মেয়ে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। তাদের একজনের মুখ নীচে নামানো, কিন্তু অনিমেষের বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না এই সেই মেয়ে। ওরা তিনজনই কিন্তু একবারও এদিকে ফিরে তাকাল না। মুখ না-দেখতে পেলেও অনিমেষ শরীরটাকে পিছন থেকে দেখে সম্পূর্ণ চেহারাটা অনুমান করে ফেলল। অত সুন্দর চেহারার মেয়ে অমন করে ওর দিকে চেয়েছিল কেন? শুধুই কৌতূহল? তার উত্তর শুনে অন্য ছেলেমেয়েরা খুশি হয়েছিল যেমন, তেমনই ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল এইমাত্র? কিন্তু ওই চোখ দুটোর মধ্যে কেন অত কথা জমা থাকে?
পরমহংস ব্যাপারটা লক্ষ করছিল, চাপা গলায় বলল, ‘পিচ খুব খারাপ গুরু। ডিফেনসিভ না-খেললেই আউট হয়ে যাবে।’
থতমত হয়ে অনিমেষ বলল, ‘মানে’?
পরমহংস পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘ওনারা বেথুনের জিনিস। তিনদিনেই বুঝে গেছি নাকের ডগা আকাশে বেঁধে রেখে এসেছেন।’
ওরা লনে এসে দেখল তেমন কিছু ভিড় হয়নি। বড়জোর শ’খানেক ছেলে এবং কিছু মেয়ে একটা উঁচু চাতালের সামনে জমা হয়েছে। মাইকের কথা তখন নিষেধ করেছিল বিমান কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে একটা পোর্টেবল মাইক এসে গেছে। তাতে একজন ছাত্রবন্ধুদের কাছে সমানে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে সভায় দলে দলে যোগদানের জন্য। চাতালের পিছনে লাল কাপড়ে ছাত্র ফেডারেশনের ফেস্টুন টাঙানো। অনিমেষ আর পরমহংস সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। হঠাৎ পরমহংস ওকে মনে করিয়ে দিল, ‘এই, তোমাকে লিডার আদেশ করে গেল বাঁদিকের থামের নীচে দাঁড়াতে, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো ওপাশে গিয়ে দাঁড়াই!’
কথাটা তখন খেয়াল করেনি, এখন মনে পড়তে অনিমেষ দ্বিধায় পড়ল। সুদীপ তাকে ওই জায়গাটায় দাঁড়াতে বলেছিল যাতে মঞ্চ থেকে ওকে ওরা দেখতে পায়। মঞ্চ যদি এই চাতালটা হয় তা হলে সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার কী দরকার? নাকি ওরা দেখতে চায় সে সভায় হাজিরা দিয়েছে, মন দিয়ে বক্তৃতা শুনছে? রাগ হয়ে গেল অনিমেষের, সে এমন কিছু কথা দিয়ে আসেনি যে বিমানরা ওর ওপর এখন থেকেই কর্তৃত্ব করবে! মিটিং-এর বক্তব্য সে শুনতে চায়, কেউ দেখুক বা না-দেখুক তার বয়ে গেল। সে পরমহংসকে বলল, ‘এখান থেকেই বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই।’
একটু বাদেই চাতালের পাশে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ের সমবেত স্লোগানের পর বিমান এসে মাঝখানে দাঁড়াল। ওর হাতে কিন্তু মাইক নেই। সবাই চুপ করতে ওর গলা শোনা গেল, ‘বন্ধুগণ, আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আজকের এই সভার পিছনে কোনও প্রস্তুতি নেই, বিশেষ কারণে আমাদের মিলিত হবার প্রয়োজন হয়েছে।’ একটু থামল বিমান, অনিমেষ লক্ষ করল বিমানের বলার ভঙ্গি খুব স্বচ্ছন্দ, যেন এক টেবিলে বসে কথা বলছে। তা ছাড়া ওর গলার স্বর যে ওইরকম পরদায় পৌঁছাতে পারে, না-শুনলে অনুমান করা যায় না। ওরা যে এত দূরে আছে কিন্তু শুনতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। বিমান তখন কেন মাইক প্রয়োজন হবে না বলেছিল এখন বোঝা গেল।
‘বন্ধুগণ! আপনারা জানেন ছাত্র ফেডারেশন কখনওই হিংসায় বিশ্বাসী নয়। আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ এবং ছাত্রবন্ধুদের কাজ করতে চাই। মিথ্যে কুৎসা এবং ভণ্ডামিকে আমরা ঘৃণা করি। কিন্তু আমাদের ওপর সেইসব জঞ্জাল চাপিয়ে দেবার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের কমরেডদের দিন-রাত প্ররোচনা করা হচ্ছে উত্তেজিত হতে। একবার যদি উত্তেজিত করতে পারে আমাদের কর্মীদের তা হলে যে ভুল তারা করবে তার ফসল তুলতে ওরা মুখিয়ে আছে। আমি আমার বন্ধুদের কাছে আবেদন করছি কোনও অবস্থাতেই আপনারা উত্তেজিত হবেন না। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে আমরা নাকি ওদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছি এবং নবাগত বন্ধুরা সেইসব মহামূল্য পোস্টার দর্শনে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভাল কথা। কিন্তু কে কখন কী পোস্টার ছিঁড়ছে তার কোনও প্রমাণ ওঁরা আমাকে দেননি। আমরা হাওয়ার ওপর বাস করতে পারি না। আর তাদের পোস্টারে কী লেখা থাকে? না, তাদের উদ্দেশ্য বা কর্মপন্থার খবর সেখানে পাবেন না। নবাগত ছাত্রদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন আমাদের গালাগালি দিয়ে। একটা পোস্টারে যদি আশিভাগ আমাদের কথা লেখা থাকে তা হলে সেটা ওদের পোস্টার কী করে হল! আমি ওদের কাছে সামান্য ভদ্রতা আশা করেছিলাম, কিন্তু উলটে ওরা আমাকে চোখ রাঙিয়ে গেল।
‘নতুন বন্ধুরা নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি কাদের কথা বলছি। না, দক্ষিণপন্থী ছাত্র ফেডারেশন সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। মানুষ যখন ধর্মচ্যুত হয় তখন তার মস্তিষ্ক স্থির থাকে না, না-হলে আজ ওরা প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে হাত মেলাবে কেন? আমি ছাত্র পরিষদের কথা বলছি। ওরা বলে এই দেশে স্বাধীনতা ওরাই এনেছে, এই দেশকে সোনায় মুড়ে দেবার জন্য ওরা সংগ্রাম করছে। আমরা নাকি চিনের দালাল, দেশের শত্রু। এই কথা নিয়ে আমি অনেকবার সভায় বলেছি, আমাদের বক্তব্য আপনারা জানেন। চিন না আমেরিকা, সে প্রশ্নে আমি যেতে চাই না। কিন্তু সোনায় মুড়ে দেবার ব্যাপারটা কার ক্ষেত্রে খাটে! দশটা পরিবারকে সোনায় মুড়ে দেবার জন্য ওরা এই দেশের মানুষকে ছিবড়ে করে দিয়েছে সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে? আমাদের গালাগাল না-দিয়ে ওরা ভেবে দেখুক তারা কার দালাল। ওদের হাতে সরকার আছে, পুলিশ আছে, শুধু গায়ের জোর আর ভাঁওতা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ক’দিন দমন করে রাখা যায়?’ বিমান সামান্য থামল, শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বোধহয় বুঝতে চাইল। পরমহংস চাপা গলায় বলল, ‘এবার নির্ঘাত হাততালি পড়বে।’ কিন্তু কথাটা ঠিক হল না, বিমানের বক্তৃতায় শ্রোতাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হল বোঝা গেল না। কারণ, সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, বিমান আবার গলা তুলল, ‘যারা আমাদের চিনের দালাল বলে জনসাধারণকে ধোঁকা দিচ্ছে তাদের জেনে রাখা উচিত আমরা জনসাধারণের সুখ-দুঃখে তাদের সঙ্গেই আছি, কারণ আমরাই তাদের লোক, কয়েকজন শিল্পপতির দালাল নই। বন্ধুগণ, বর্তমান কংগ্রেস সরকার দেশের অর্থনীতি থেকে শিক্ষাব্যবস্থা, সব জায়গায় অরাজকতা সৃষ্টি করতে চান যাতে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। ছাত্র পরিষদের বন্ধুরা সেই কাজই করছে। আমি আপনার সামনে এরকম একটি জঘন্য কাজের নমুনা উপস্থিত করতে পারি। এই সরকারের পুলিশ, ছাত্র পরিষদের পুলিশ যে কত নির্মম তার শিকার আমাদের এক ছাত্রবন্ধু, যিনি তাঁর জীবনের অমূল্য একটি বছর হারিয়েছেন। কমরেড অনিমেষ, আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি দয়া করে এগিয়ে আসুন।’
সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে একটা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। পরমহংস ওর বাহু ধরে বলে উঠল, ‘এই, তোমার নাম করছে!’ ওর কথা যাদের কানে গিয়েছিল তারা অবাক চোখে অনিমেষকে দেখতে লাগল। বিমানের ইচ্ছেটা বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। সমস্ত ব্যাপারটাই একটা ধাঁধার মতন। ছাত্র পরিষদের ছেলেরা তাকে মেরেছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে সভা ডেকেছে বিমান। এখনও সে প্রসঙ্গে না-গিয়ে হঠাৎ তার নাম ধরে ডাকাডাকি কেন? তার একটা বছর নষ্ট হয়েছে এটা একান্তই নিজস্ব ব্যাপার, বিমানের এ ব্যাপারে কী বলার আছে! পুলিশ তো তাকে ছাত্র ধারণা করে গুলি করেনি।
বিমান আবার ডাকল, ‘অনিমেষ, কমরেড, আপনি এগিয়ে আসুন। এটা দ্বিধা করার সময় নয়, সমবেত ছাত্রবন্ধুদের ব্যাপারটা জানানো দরকার।’ বিমানের চোখ বাঁদিকের থামের কাছে, সেখানে সুদীপকে ব্যস্ত হয়ে কাউকে খুঁজতে দেখা গেল। এবার অনিমেষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল কেন সুদীপ তাকে ক্লাসে এসে ওখানে থাকতে বলে গেছে। কিন্তু বিমান তো মিটিং ডাকার কথা বলেছে তার ব্যাপারটা জানবার আগেই, তা হলে আসল প্রসঙ্গে না-গিয়ে ওকে নিয়ে পড়ল কেন?
উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা এখন উসখুস করছে। ব্যাপারটা যেন খুব মজার, জেনারেল সেক্রেটারি যার নাম ধরে ডাকছে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিমানের মুখ লাল হয়ে উঠেছে এর মধ্যে, পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে সে চারপাশে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ছাত্র অনিমেষকে বলল, ‘আপনার নাম কি অনিমেষ?’ ওর বদলে পরমহংস ঘাড় নাড়তে ছেলেটি বলল, ‘আপনাকে বিমান ডাকছে শুনতে পাচ্ছেন না?’
এবার অনিমেষের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তাকে ডাকলেই যেতে হবে? আর এই পরমহংসটা যদি তার নাম উচ্চারণ না-করত তা হলে এতক্ষণে ও পাশ দিয়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এখন আরও অনেকের চোখ এদিকে পড়েছে। কী করা যায়? পরমহংস চাপা গলায় বলল, ‘ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের ভয় পেলে চলে না। সোজা ক্রিজে দাঁড়িয়ে ব্লক করতে শুরু করে দাও।’
এর মধ্যে সুদীপ ওখানে পৌঁছে গেছে। অনিমেষের এক হাত ধরে সে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে লাগল সামনে। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল অনিমেষ, ‘আমি কী করব, আমাকে ডাকছেন কেন?’ সুদীপ কোনও জবাব দিচ্ছিল না। বিমান ওদের দেখতে পেয়ে আবার গলায় জোর পেল, ‘এই যে, আমাদের বন্ধু কমরেড অনিমেষ এসে গেছেন। কোনও কোনও মানুষ প্রচার চান না, নীরবে কাজ করে যেতে ভালবাসেন, অনিমেষ সেইরকম একজন। অত্যন্ত লাজুক এই ছেলেটি তাই আমার ডাকে একটু বিব্রত হয়ে পড়েছেন। যা হোক, আমি যে মিথ্যে বলিনি সেটা একটু বাদেই আপনারা বুঝতে পারবেন।’
ততক্ষণে অনিমেষ চাতালের কাছে পৌঁছে গেছে। বিমান এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে চাতালে তুলে দিল। অনিমেষ এমন নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে ওর গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। বিমান চাপা গলায় বলল, ‘ডোন্ট গেট নার্ভাস। এটা খুব ইমপর্টেন্ট সময়।’ কোনওরকমে অনিমেষ বলতে পারল, ‘আমি কী করব বিমানদা?’ বিমান কোনও উত্তর না-দিয়ে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে হাত মাথার ওপর তুলে সবাইকে চুপ করতে বলল। গোলমাল একটু শান্ত হয়ে এলে বিমান আবার কথা শুরু করল, ‘বন্ধুগণ, কমরেড অনিমেষ এখন আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। উনি এ বছর বাংলা নিয়ে এম এ পড়া শুরু করেছেন। কিন্তু এই বছর ওঁর সিক্সথ ইয়ার হওয়ার কথা ছিল। কে তার এই সর্বনাশ করল, না আমাদের উপকারী বন্ধু পুলিশ। বিনা প্ররোচনায় সম্পূর্ণ অকারণে অনিমেষকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারা। যখন অনিমেষ মাটিতে পড়ে একটু নিশ্বাসের জন্য ছটফট করছেন তখনও তারা অত্যাচার থামায়নি। আমাদের সৌভাগ্য যে তবু তিনি বেঁচে গেছেন। আপনারা দেখুন, নিজের চোখে সেই বীভৎস অত্যাচারের নমুনা দেখুন। গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে, সময় থেমে থাকেনি, কিন্তু সেই রক্তাক্ত অত্যাচার ওঁর শরীরে চিরকালের জন্য ছাপ রেখে গেছে। কোনও ভাঁওতা সেটা মুছে ফেলতে পারবে না। অনিমেষ, আপনি সংকোচ করবেন না, আমাদের ছাত্রবন্ধুদের ওই দাগটি দেখান।’
কুলকুল করে ঘামতে লাগল অনিমেষ। ওর মাথায় আর কিছু ঢুকছিল না। কেন তাকে ওই দাগ দেখাতে হবে এবং সেটা করতে তার ইচ্ছে আছে কিনা এসব কথা তাকে আলোড়িত করছে না। এখন যে-কোনওভাবে সে নেমে যেতে পারলেই বাঁচে। সামনে সারি সারি মুখ উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। পাশে বিমান ছাড়া সুদীপ এবং আরও কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে। বিমান আবার চাপা গলায় কিছু বলল কিন্তু সেটা আর কানে ঢুকছে না অনিমেষের। কিন্তু তার পরনে প্যান্ট আর দাগটা হাঁটুর ওপরে, কী করে সহজ ভঙ্গিতে সেটা এত মানুষকে দেখানো যায়!
সুদীপ বলল, ‘বৃষ্টিতে আমরা যেভাবে প্যান্ট গুটিয়ে রাস্তায় জল ভাঙি সেভাবেই না-হয় প্যান্টটাকে গুটিয়ে নিন কমরেড।’
বক্তৃতা নয়, যেন নাটক দেখছে একটা, ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহ হাজার গুণ বেড়ে গেল। ঠেলেঠুলে চাতালের কাছে আসবার চেষ্টা করতে লাগল সবাই, যেন কাছাকাছি হলে ভাল করে দেখা যাবে এবং সে সুযোগ কেউ হারাতে চাইছে না। প্রথমে যত শ্রোতা ছিল এখন তার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
সম্মোহিতের মতো নিচু হয়ে ও প্যান্টের তলায় হাত দিল। একটা একটা ভাঁজ ফেলতে ফেলতে প্যান্টটা হাঁটুর ওপরে উঠে এল। ততক্ষণে ভাঁজগুলো মোটা হয়ে গেছে বেশ, পরের ভাঁজটা করতেই একটা অস্ফুট আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল সামনের মানুষগুলোর মুখ থেকে। তেলতেলে বীভৎস চামড়াটাকে পরমুহূর্তেই আড়াল করে প্যান্টটাকে নামিয়ে আনল অনিমেষ। বিমান ততক্ষণে কথার সুতো ধরেছে, ‘বন্ধুগণ, আপনারা নিজের চোখে আজ দেখলেন। কিন্তু যারা গুলি করেছিল তারা জানে না ওই বীভৎস চিহ্নটা আগামীকালের একজন সৈনিক তৈরি করে দিয়েছে।’
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত লন কাঁপিয়ে হাততালি উঠল। বিমান চিৎকার করল, ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি উঠল, ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।’ ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক-নিপাত যাক নিপাত যাক।’ ‘দালালদের চিনে নিন-এই মাটিতে কবর দিন।’
এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে রক্ত অনিমেষের শরীরে যেন ফিরে আসছিল। ক্রমশ অন্ধ রাগ এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া কান্না ওর দুটো চোখ ঝাপসা করে দিল। আজ প্রকাশ্যে যে কাজটা সে করল সেটা করার জন্য কোনওরকম মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না। মাঝে মাঝে স্নান করার সময় গোপনে ওই দাগটাকে সে দেখেছে, আঙুল বুলিয়ে সেই যন্ত্রণাকে সে স্পর্শ করেছে, কিন্তু সেটা ছিল তার একদম নিজস্ব ব্যাপার। সেটাকে এমন প্রকাশ্যে হাজির করে সবার করুণা কুড়োতে যাওয়ার মধ্যে এমন একটা অপমান আছে যেটা এতক্ষণে তার ভিতর বাইরে জ্বলুনি ছড়াচ্ছে। নিজেকে সঙের মতো মনে হচ্ছে এখন। ছাত্র ফেডারেশনের জয়ধ্বনি দিয়ে জমায়েতটা তখনই শেষ হল।
ওরা চাতাল থেকে নেমে এলেও কিছু উৎসুক ছাত্র অনিমেষের চার পাশে ঘিরে ধরল। সবাই জানতে চাইছে কী অবস্থায় পুলিশ গুলি করেছিল, তখন অনিমেষ কী করছিল এবং ব্যাপারটা কতদিন আগে ঘটেছিল— এইসব। বিব্রত অনিমেষকে সরিয়ে আনল সুদীপ। সে ছেলেদের বলল, ‘আপনাদের আগ্রহ স্বাভাবিক, কিন্তু অনিমেষ একটু আপসেট হয়ে আছে, প্লিজ এ নিয়ে এখন আলোচনা করবেন না।’ সুদীপ যখন ওকে নিয়ে এগোচ্ছে তখনও ছেলেরা পিছন পিছন আসছিল। তা দেখে সে অনিমেষকে বলল, ‘ভিনি ভিডি ভিসি। একদিনেই তুমি হিরো হয়ে গেলে। বাংলাদেশে ফিল্ম স্টারদেরই এইভাবে ক্রাউড ফলো করে। কনগ্রাচুলেশনস।’ সত্যি বলতে কী, অনিমেষের এখন একা হাঁটতে ভয় করছিল। এত লোক যদি তাকে নানানরকম প্রশ্ন শুরু করে তা হলে সে পাগল হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিমানের সঙ্গে কথা বলা দরকার। এইরকম একটা ব্যাপার করার আগে বিমান কেন তার সঙ্গে পরামর্শ করেনি? সুবাসদা তার সঙ্গে বিমানের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মাত্র, তার মানে এই নয় যে বিমান ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেবে। সুদীপ তাকে যেখানে নিয়ে এল সেটাই যে ইউনিয়ন রুম সেটা বুঝতে সময় লাগল। চতুর্দিকে নানারকম ফেস্টুন, পোস্টার স্তূপ করে রাখা আছে। বেঞ্চিতে বেশ কিছু ছেলে সরবে আলোচনা করছে। গলার স্বরে বোঝা যায় তারা এখন খুব খুশি। ও পাশের একটা টেবিলে বিমান কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিল, ওদের দেখে হাসল, ‘এসো অনিমেষ, প্রথমবার ইউনিয়ন অফিসে আসাটা একটু সেলিব্রেট করি। এই, ক্যান্টিনে চা বলে এসো তো।’ পাশের একটি ছেলেকে কথাটা বলতেই সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেল।
ওদের দেখে দুটো চেয়ার খালি হয়ে গিয়েছিল। তার একটাতে সুদীপ বসে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে চুরুটটা ঠিক করতে লাগল। অনিমেষ বসতেই বিমান বলল, ‘তোমাকে অ্যাডভান্স কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে রাখি, নেক্সট ইউনিয়ন ইলেকশনে তোমাকে হারাতে পারে এমন কোনও ক্যান্ডিডেট নেই।’
অনিমেষ হাঁ হয়ে গেল। ইলেকশন? মানে ইউনিয়নের নির্বাচনের কথা বলছে বিমান? সে ইলেকশনে দাঁড়াবে? সে দাঁড়ালে ছাত্ররা তাকে ভোট দেবে? চট করে বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল ওর। কোনওরকম রাজনীতি কিংবা ইউনিয়নের মধ্যে যেতে তিনি পইপই করে নিষেধ করে গেছেন। এতদিন, স্কটিশে পড়ার এই সময়ে সে কখনওই সেই আদেশ অমান্য করেনি। করেনি তার কারণ শুধু বাবা নন, সে নিজে ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছিল না, পরবর্তী সময়ে দেশের কাজ করার যে ইচ্ছে শৈশবে ওর মনে জন্ম নিয়েছিল পনেরোই আগস্টের সকালে, নিশীথবাবু কংগ্রেসের পতাকার তলায় সেই ইচ্ছেটাকে নিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত সুনীলদা বামপন্থী রাজনীতিতে তাকে আকৃষ্ট করেন। এখন সেই কলকাতায় বিগত কয়েক বছরের অরাজনৈতিক জীবনে সে নিজে মনে মনে অনেক কিছু ভাবত এবং সেই ভাবনাগুলো কংগ্রেস সমর্থনপুষ্ট ছিল না। তাই বলে কমিউনিস্ট পার্টিতে সরাসরি কাজ করবে কি না এ ব্যাপারটা কখনও স্পষ্ট ছিল না। ছাত্র ফেডারেশন করা মানে কমিউনিস্ট পার্টি করা নয়। কিন্তু এতদিনে সে জেনে গেছে যে-কোনও ছাত্র সংগঠনের কর্মপদ্ধতি এক-একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শে নিয়ন্ত্রিত হয়। অনিমেষ বিমানকে সরাসরি বলে ফেলল, ‘আপনি আজ যে কাজ করলেন সেটা আগে জানলে আমি উপস্থিত থাকতাম না।’
চা এসে গিয়েছিল, কাপটা এগিয়ে দিয়ে ভ্রূ কোঁচকাল বিমান, ‘মানে?’
‘এইভাবে নিজেকে এক্সপোজ করে সিমপ্যাথি পাওয়া খুব লজ্জার। তা ছাড়া ওই বুলেটের দাগটা পুলিশ আমাকে ছাত্র হিসেবে দেয়নি। ট্রাম পুড়ছিল, ওরা ফায়ার করেছে, আমি আহত হয়েছি মাঝখানে পড়ে গিয়ে। এর সঙ্গে আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই।’ অনিমেষ সোজা চোখে বিমানের দিকে তাকাল।
হেসে ফেলল বিমান, ‘তুমি নেহাতই ভালমানুষ। ঠিক আছে, তুমি তো শিশু নও, যখন আমি তোমাকে ডেকে দাগটা দেখাতে বললাম তখন প্রতিবাদ করলে না কেন?’
মুখ নামাল অনিমেষ, ‘তখন কেমন হয়ে গেলাম, আর তা করলে আপনাকে অপমান করা হত—।’
কথাটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল বিমান। ঘরের সবাই এবার ওদের দিকে তাকিয়ে দেখছে। বিমান হাসি শেষ করে বলল, ‘তা হলে বোঝা যাচ্ছে তোমার কোনও মানসিক সুস্থিতি নেই। দেখো, মহাভারতেই তো আছে ভালবাসা এবং যুদ্ধে কোনওরকম অন্যায় নেই। শঠতা সেখানে একটা জয়ের কৌশল মাত্র। আমরা চাই সমস্ত ছাত্রছাত্রী এই সংগঠনের সঙ্গে আসুক যাতে আমরা আরও সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারি। সব মানুষ যদি আজ কমিউনিস্ট পার্টির পাশে দাঁড়ায় তা হলে রাতারাতি দেশের চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং বুর্জোয়া দল তা হতে দেবে না। তারা বাধা দেবে কায়েমি স্বার্থের দুর্গ আগলে রাখতে। তাই এখন লড়াই শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধে আনফেয়ার শব্দ অচল। তা ছাড়া পুলিশ যে তোমাকে গুলি করেছে এতে কোনও মিথ্যে নেই, তাই না?’
ঠান্ডা চা মুখে দিতে ইচ্ছে করছিল না। বিমানের কথাগুলোর ঠিক কীভাবে প্রতিবাদ করা যায় বুঝতে না-পেরে সে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকল। হঠাৎ বিমান কেমন অন্যরকম গলায় ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কি ইলেকশনে দাঁড়াতে ইচ্ছে নেই?’
অনিমেষ সরল হয়ে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না।’
‘কেন? সুবাসদা বলে গেলেন তুমি আমাদের মত এবং আদর্শকে সমর্থন করো। তা হলে এটাই তো একমাত্র রাস্তা।’ বিমান অবাক হল।
‘দেশের কাজের সঙ্গে ইউনিয়নের কী সম্পর্ক?’
‘বাঃ, কোনও শিশু কি এক দিনেই হাঁটতে শেখে? তাকে একটা নিয়মের মধ্যে বড় হতে হয়। ছাত্র ফেডারেশনে সক্রিয় কাজ করতে করতে তুমি ছাত্রদের প্রবলেম নিয়ে কিছু করতে চেষ্টা করবে। এটাকেই একটা মিনি দেশ ভাবো না কেন! সেই সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের দেশের রাজনৈতিক ফোকরগুলো যদি চিনিয়ে দাও, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতি যদি সহানুভূতি আনতে সাহায্য করো তা হলে এরাই যখন পরবর্তীকালে দেশের নাগরিক হবে তখন আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেকটা সহজ হয়ে যাবে, তাই না?’
এই সময় আরও কিছু ছেলে এসে বিমানের কাছে দাঁড়াল। ওদের দেখে বিমান অনিমেষকে বলল, ‘কমরেড, আজ এই পর্যন্ত, আর-একদিন না-হয় আমরা বসব। তুমি মন ঠিক করে নাও। দুর্বলতা থেকে কখনওই কোনও ভাল সৃষ্টি হয় না।’
অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল বিকেল শেষ হতে চলেছে। সামনের লন একদম ফাঁকা। কোনও ছাত্রছাত্রী ধারে-কাছে নেই। সাধারণত সে কলেজ স্ট্রিটের দরজা দিয়ে আসা-যাওয়া করে, আজ হেয়ার স্কুলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে বেরুল। দরজার সামনেই বিরাট পোস্টার, ‘সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ভিয়েতনাম থেকে হাত ওঠাও।’ পাশের ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা আমেরিকান বেয়নেটের ডগায় ভিয়েতনামি শিশুকে গেঁথে রাক্ষুসে হাসি হাসছে। ছবিটা অনেকক্ষণ দেখল অনিমেষ। ভিয়েতনামের ঘটনা এতদিনে তার জানা হয়ে গেছে। হো চি মিন নামের একজন মানুষের নেতৃত্বে নিরক্ষর অসহায় ভিয়েতনামিরা আজ এক হয়ে আমেরিকান মিলিটারির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কোথায় আমেরিকা আর কোথায় ভিয়েতনাম, তবু সেখানে সাম্রাজ্য অটুট রাখার বাসনায় আমেরিকা পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করে একটা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চাইছে। কেন? শুধু ক্ষমতার অহংকার মানুষকে কতটা উন্মত্ত করতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ছবিটা মাথায় নিয়ে অনিমেষ হেঁটে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে চলে এল। ততক্ষণে ওর পরমহংসের কথা মনে পড়ল। সেই সুদীপ যখন ওকে চাতালের দিকে ধরে নিয়ে গেল তারপর আর ওর দেখা মেলেনি। তখন ওর ওপর খুব খেপে গিয়েছিল অনিমেষ কিন্তু এখন আর রাগটা নেই। পরমহংস তো ইচ্ছে করে তাকে বিপাকে ফেলবে বলে নাম ধরে ডাকেনি। ছেলেটার সঙ্গে আজই আলাপ কিন্তু বেশ ভাল লেগেছে অনিমেষের। খুব সহজ হয়ে ফটাফট কথা বলতে পারে। মনে পড়ল পরমহংস বলেছিল মিটিং থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে যাবে, সেখান থেকে টিউশনি। ওর পোশাক দেখে অবস্থা খারাপ বলে মনে হয় না, তবু টিউশনি করে কেন? অনিমেষের মনে হল বাবার পাঠানো গোনাগুনতি টাকায় তাকে যখন খুব কষ্ট করে চালাতে হয় তখন সেও তো পরমহংসের মতো টিউশনি করতে পারে। কিন্তু তাকে কে টিউশনি দেবে? কলকাতায় এসে কোনও পরিবারের সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠ হয়নি এক দেবব্রতবাবু ছাড়া। পরমহংসকে বললে হয়। অবশ্য জীবনে সে কখনও কাউকে পড়ায়নি, কিন্তু একটু দেখে নিলে স্কুলের যে-কোনও ছাত্রকে না-পড়াতে পারার কোনও কারণ নেই।
প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনিমেষ দেখল ট্রাম-বাসে বেজায় ভিড়। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। সাধারণত ও যখন ফেরে তখন ভিড় থাকে না। এখন এখান থেকে ট্রামে ওঠা অসম্ভব। ঠিক উলটো দিকে ইন্ডিয়ান কফি হাউসের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল ওর। পরমহংসকে ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ছেলেটা যখন দেখল সে একটা বিপদে পড়েছে, তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন সে মিটিং শেষ না-হওয়া অবধি ওর জন্য অপেক্ষা করল না কেন? কলকাতায় বোধহয় কেউ কারও বন্ধু হতে পারে না। পরমহংসের ওপর একটু অভিমান জমতে না-জমতেই হেসে ফেলল অনিমেষ। ছেলেটার সঙ্গে আজ দুপুরেই প্রথম আলাপ হল আর সে অনেক কিছু ভেবে বসছে। চট করে নিজের পছন্দমতো ভাবার এই স্বভাবটা যে সে কবে ছাড়তে পারবে!
ট্রামরাস্তা পেরিয়ে সে গলিটার মধ্যে চলে এল। কফি হাউসের দরজার পাশেই এক মাঝবয়সি মানুষ সিগারেট বিক্রি করছে। অনিমেষকে দেখে সে খুব পরিচিত হাসি হাসল। অবাক হল অনিমেষ, লোকটা তাকে চেনে নাকি, এমন ভঙ্গি করছে যেন আগেও দেখা হয়েছে। অনিমেষ মুখ নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ও অবাক হয়ে গেল। পরপর অনেকগুলো লিটল ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন, প্রত্যেকেই এক-একটা দারুণ বিস্ফোরক সংখ্যা বের করছে বলে দাবি করছে। দোতলায় উঠতে মনে হল একটা বাজার কাছাকাছি রয়েছে। খুব চেঁচামেচি করে কেনা-বেচা চলছে সেখানে। দরজায় দাঁড়িয়ে হকচকিয়ে গেল অনিমেষ। বিরাট হলঘর জুড়ে টেবিল-চেয়ার আর তাতে ভরতি মানুষ। এত বড় রেস্টুরেন্ট সে কখনও দেখেনি। সবাই একসঙ্গে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, আর সেই শব্দরাশি অনেক উঁচু ছাদের তলায় পাক খেয়ে অদ্ভুত আওয়াজ তুলছে। অনিমেষ এই ভিড়ের মধ্যে পরমহংসকে দেখতে পেল না। চট করে কাউকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ফিরে যাবে বলে ভাবছে, তখন লক্ষ করল কয়েকজন ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছে। সে মুখ ঘোরাতেই একজন উঠে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘বসবেন’? নিজেদের টেবিল দেখাল সে। একটু ঘাবড়ে গিয়ে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।
‘আপনাকে আজ মিটিং-এ দেখলাম।’ হাসল ছেলেটি। ‘আপনার কোনও অসুবিধা হয় না?’ সে তার পায়ের দিকে ইঙ্গিত করল। অনিমেষ এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চায় না, সে দ্রুত ঘাড় নেড়ে দরজার দিকে ফিরে গেল। খুব বিরক্তি লাগছিল তার, এখন থেকে কত লোককে যে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে! নিজের কোনও গোপন দুঃখ বা যন্ত্রণা যদ্দিন নিজের থাকে সে একরকম, কিন্তু সেটা জানাজানি হয়ে গেলেই তার ধার কমে যায়।
দরজার বাইরে এসে অনিমেষ দেখল ওপরের সিঁড়ি দিয়ে কিছু ছেলেমেয়ে হইহই করে নীচে নামছে। তার মানে তেতলাতেও বসার জায়গা আছে! কৌতূহল নিয়ে অনিমেষ পায়ে পায়ে ওপরে উঠে এল। দু’দিকে দুটো দরজা। ডান দিকেরটা দিয়ে ঢুকতেই লবি মতন একটা জায়গা, দু’পাশে দুটো ব্যালকনি, অনেকটা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আদলে। তেতলায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি, কারণ প্রতিটি টেবিলে শাড়ি চোখে পড়ছে। ঠিক এই সময় নিজের নাম শুনতে পেল অনিমেষ। চিৎকার করে যে ডাকছে সে পরমহংস তাতে সন্দেহ নেই। অনিমেষ দেখল বাঁদিকের ব্যালকনির একদম কোনায় একটা বিরাট ফ্যানের সামনের টেবিলে ওরা বসে আছে। পরমহংস আর তিনটে মেয়ে। ও ইতস্তত করে ঘাড় নেড়ে পরমহংসকে উঠে আসতে বললে পরমহংস তেমনি চেঁচিয়ে বলল, ‘এখানে একটা চেয়ার আছে, চলে এসো।’
অপরিচিত মেয়েদের মধ্যে গিয়ে বসতে অনিমেষের সংকোচ হচ্ছিল, কিন্তু এরপরে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তিনটি মেয়েই এবার তাকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে। অগত্যা পায়ে পায়ে সে ওদের টেবিলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খালি চেয়ারটায় কতগুলো বই রাখা ছিল, মেয়েরা সেগুলো তুলে নিতে পরমহংস বলল, ‘তুমি তো গুরু বর্ণচোরা আম। প্রথম আলাপে আমাকে এমন ভড়কি দিলে যে আমি ভাবলাম—। যাক, মাঠে নেমেই তা হলে সেঞ্চুরি করে ফেললে! বসো বসো।’
পরমহংস সবসময় হাসে কি না বোঝা যায় না দাঁত উঁচু থাকার জন্য। কিন্তু অনিমেষ বুঝল কথাটার মধ্যে একটু ঠাট্টা মেশানো আছে। চেয়ারে বসে সে বলল, ‘তুমি না-বলে চলে এলে কেন?’
‘যাচ্চলে। তোমাকে ভি আই পি রিসেপশন দেওয়া হচ্ছে আর আমি ফেকলুর মতো দাঁড়িয়ে থাকব। আমি ভাই জনতার লোক, রাজনীতি বুঝি না। তা হঠাৎ এখানে?’
‘তোমাকে খুঁজতে এলাম।’
‘সত্যি?’
‘বাঃ, মিথ্যে বলতে যাব কেন? তখন বললে না কফিহাউসে আসবে।’
‘নাঃ, তোমার দ্বারা রাজনীতি হবে না। আজকের ওসব ব্যাপারের পর তো তোমার আমার কথা খেয়ালই করা উচিত নয়। যাক, ওসব ব্যাপারে পরে কথা বলব। তুমি তো এদের কাউকে চেনো না!’ পরমহংস মেয়েদের দিকে হাত দেখাল।
এক পলক মুখগুলো দেখে নিয়ে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। পরমহংস বলল, ‘আমিও চিনতাম না, এরা সবাই বাংলা নিয়ে এম এ পড়ে, অন্য সেকশনে।’
ওদের মধ্যে যার চেহারা খুব রোগা সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনিও কি বাংলা?’
অনিমেষ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। মেয়েটি বলল, ‘বাংলায় এম এ যেসব ছেলেরা পড়ে তাদের নিয়ে দারুণ দারুণ গল্প আছে।’
পরমহংস বলল, ‘সেই চিড়িয়াখানার বাঘের গল্প তো! ও পুরনো হয়ে গিয়েছে।’
বাকি দু’জন একসঙ্গে হেসে উঠল পরমহংসের বলার ধরনে। অনিমেষ গল্পটা শুনেছে কিন্তু ও পরমহংসের দিকে প্রশংসার চোখে তাকাল। গল্পটা শুনলেই নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অন্ধকারটা ভারী হয়ে আসে, কিন্তু ওর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা মজা আছে যে মনটা খারাপ হওয়ার সুযোগ পেল না।
রোগা মেয়েটা পরমহংসকে বলল, ‘আপনি পরিচয় করিয়ে দিলেন না তো ওর সঙ্গে!’
পরমহংস হাত উলটে বলল, ‘আমাকে কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? আমি তো নিজে থেকে আপনাদের টেবিলে এসে জুড়ে বসলাম।’
এবার আর-একটি মেয়ে জবাব দিল, ‘আপনি পরমহংস, চোখ-কানগুলো বন্ধ করে রেখেছেন, সবাই তো তা নয়।’
পরমহংস বলল, ‘অ। ইনি হচ্ছেন নবনীতা, আত্রেয়ী এবং অনন্যা। আর এর নাম অনিমেষ, স্কটিশ থেকে পাশ করেছে। আর খুব বড় নেতা হবার সুযোগ ওর সামনে অপেক্ষা করছে।’
রোগা মেয়েটি, যার নাম আত্রেয়ী, বলল, ‘বুঝলাম না।’
পরমহংস বলল, ‘যারা ব্রিটিশ আমলে একদিন জেল খেটেছিল তারাই মন্ত্রী হবার সুযোগ আগে পেয়েছে স্বাধীনতার পর। আর এখন যারা পুলিশের হাতে ধোলাই খাবে তারা মন্ত্রী হবে আগামীকালে। অনিমেষের পায়ে বিরাট দাগ আছে পুলিশের বুলেটের। ওকে কে মারে!’
তিনজনই অবাক চোখে অনিমেষকে দেখল। অনিমেষ পরমহংসের ওপর রাগতে পারছে না কিন্তু এখানে কিছু বলাও যায় না। আত্রেয়ী বলল, ‘আপনাকে পুলিশ গুলি করেছিল কেন? আপনি কি অ্যাকশন করেছেন কখনও?’
অ্যাকশন! অনিমেষ ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, ‘না, না, ওটা একদম নিছক দুর্ঘটনা। পরমহংস বাড়িয়ে বলছে।’ তারপর কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কোন কলেজে পড়তেন?’
অনন্যা জবাব দিল, ‘বেথুন’।
শব্দটা শুনেই অনিমেষের সেই চোখ দুটো মনে পড়ল। পরমহংস বলছিল সেও নাকি বেথুন থেকে এসেছে। অনিমেষ নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাদের কলেজে কি বাংলার ছাত্রী বেশি?’
আত্রেয়ী জবাব দিল, ‘না, আমরা পাঁচজন এক সেকশনে আছি। অন্য সেকশনে আরও ন’জন আছে। সবসুদ্ধু চোদ্দো, কেন?’
প্রশ্নটা অনিমেষকে একটু বিপাকে ফেলে দিল। সে একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, ‘না মানে, আরও কয়েকজন বেথুন থেকে এসেছেন শুনে মনে হল ওখানে বাংলার ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি।’
আত্রেয়ী বলল, ‘কী বোকা বোকা কথা বলছেন, চোদ্দোজন মোটেই বেশি নয়।’
নবনীতা বলল, ‘আর কাদের কথা শুনেছেন?’
অনিমেষ পরমহংসের দিকে তাকালে সে চোখ টিপে বলে উঠল, ‘ছাড়ো তো যত আজেবাজে কথা। অনিমেষ, মেয়েদের কাছে মেয়েদের সম্পর্কে কখনও কৌতূহল দেখাবে না।’
আত্রেয়ী বলল, ‘আপনার খুব অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে?’
পরমহংস মাথা নেড়ে বলল, ‘শরৎচন্দ্র থেকে বিমল মিত্তির আমি গুলে খেয়েছি।’
কথা বলার ধরনে সবাই হেসে উঠলে অনিমেষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
হঠাৎ পরমহংস অনিমেষকে চটজলদি বলে উঠল, ‘এই, চোখ বন্ধ করো তো।’
‘কেন?’ অনিমেষ অবাক হল।
‘করো না! একটা মজার জিনিস বলব। এই কফিহাউসটা এককালে বক্তৃতার জায়গা ছিল। বড় বড় নেতারা এখানে বক্তৃতা দিতেন। এর নাম ছিল অ্যালবার্ট হল। সেইসব বক্তৃতা নাকি সারা দেশে সমুদ্রের ঢেউ তুলত। এখনও এতদিন বাদে এই কফিহাউসে বসে সেই সমুদ্র গর্জন শুনতে পাবে।’ পরমহংস বলল।
সবাই একসঙ্গে অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘কীরকম?’
পরমহংস ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে বলল, ‘প্রথমে দুটো কান হাতের চেটোয় চেপে ধরো, ধরেছ, হ্যাঁ, এবার চোখ বন্ধ করো। এক মিনিট বাদে চোখ না-খুলে কান থেকে হাত সরিয়ে নাও।’
ওর কথামতো ওরা ঠিকঠাক করে গেল। চারজনই একসঙ্গে এরকম ব্যাপার করছে— দৃশ্যটা ভেবে হাসি পাচ্ছিল অনিমেষের। কিন্তু সে যখন কান থেকে হাত সরিয়ে নিল চারপাশে কেমন গুমগুম শব্দ শুনতে পেল। যেন কিছু গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে আর আসছে। এটা যে বিভিন্ন টেবিল থেকে ওঠা কথার আওয়াজ সেটা বুঝে বেশ মজা লাগছিল ওর। এমনি আচমকা টের পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ কান বন্ধ থাকায় ব্যাপারটা এই চেহারা নিয়েছে।
পরমহংস বলল, ‘কী, সমুদ্রগর্জন শোনা যাচ্ছে?’
চোখ খুলে অনিমেষ হেসে বলল, ‘আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি, তাই ঠিক—।’
অনিমেষের কথা আটকে গেল। ও দেখল একটি ছেলের সঙ্গে নীলা ওপাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। এই কয় বছরে নীলার স্বাস্থ্য ভরাট হয়ে অন্যরকম আদল এনেছে। ওর সঙ্গের ছেলেটিকে সে কখনও দেখেনি। খালি টেবিল না-পেয়ে নীলা চারপাশে চোখ বোলাতে অনিমেষকে দেখতে পেল। যেন নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না নীলার চোখমুখের অভিব্যক্তি এইরকম।