3 of 3

১০৪. ৬ষ্ঠ হিজরী সনে বনু মুসতালিক অভিযানকালে অপবাদের ঘটনা

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই সফরে যেতেন, তখনই কোন স্ত্রী তাঁর সাথে যাবেন তা নিয়ে লটারী করতেন। যার নামে লটারী উঠতো তিনি তাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বনু মুসতালিক অভিযানকালেও তিনি যথারীতি লটারী করলেন এবং তাতে আমার নাম উঠলো। তাই তিনি আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন।

তৎকাল মেয়েদের মধ্যে স্বল্পহারের প্রচলন ছিল। তাই শরীরের গোশত স্ফীত হয়ে ওজন বেড়ে যেতো না। সফরকালে আমার উট যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে আমি হাওদায় বসতাম। লোকজন এসে হাওদা উঠিয়ে পিঠে স্থাপন করতো এবং তা রশি দিয়ে উটের পিঠে বেঁধে দিতো। এরপর যাত্রা শুরু হতো।

বনু মুসতালিক অভিযান শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাবর্তনকালে মদীনার নিকটে এসে এক জায়গায় একরাত কাটালেন। তারপর আবার যাত্রার ঘোষণা হলে সদলবলে যাত্রা শুরু হলো। এই সময় আমি প্রকৃতির ডাকে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার গলায় একটা ইয়ামানী মুক্তার মালা ছিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে আসার পর আমি দেখলাম যে, সেই হার আমার গলায় নেই। কখন যে তা পরে গেছে আমি মোটেই টের পাইনি। অগত্যা আমি তা খুঁজতে আবার কাফিলা থেকে বেরিয়ে যেখানে প্রকৃতির ডাকে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। ইতিমধ্যে কাফিলা যাত্রার আয়োজন করলো। আমি হারটি খুঁজে পেলাম। যারা আমার উটের হাওদা উঠায় তারা ্আমার উটের কাছে এসে যথারীতি হুদাটা উঠিয়ে দিল। ততক্ষণে তাদের যাত্রার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তারা যখন হাওদা উঠালো, তখন ভাবলো আমি যথারীতি হাওদার ভেতরেই আছি। তাই তারা হাওদা উঠিয়ে তা উটের সাথে বেঁধে দিল। আমার হাওদার অবস্থান সম্পর্কে তাদের মোটেই সন্দেহ হলো না। তারপর তারা উট হাঁকিয়ে যাত্রা করলো। আমি হার কুড়িয়ে নিয়ে যখন কাফিলায় রাত্রি যাপন স্থানে ফিরে এলাম তখন ময়দান ফাঁকা। সেখানে কেউ নেই। সমগ্র কাফিলা রওনা হয়ে গেছে। অনন্যোপায় হয়ে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ঐ স্থানেই শুয়ে রইলাম। ভাবলাম আমার অনুপস্থিতি দেখলে তারা অবশ্যই আমার খোঁজে ফিরে আসবে। আমি তখনো শুয়ে আছি। দেখলাম সাফওয়ান ইবনে মুয়াল্লাল সুলামী আমার কাছ দিয়ে যাচ্ছে। সেও কোন প্রয়োজনে কাফিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সে কাফিলার সাথে রাত যাপনও করেনি। দূর থেকে আমাকে দেখে সে এগিয়ে এলো এবং আমার আছে এসে দাঁড়ালো। পর্দার হুকুম নাযিল হবার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে আমাকে দেখেই বলে উঠলো, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এ যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী।” আমি তখনো কাপড়ে আবৃত। সে বললো, “আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনি কিভাবে পেছনে পড়লেন?” আমি তার সাথে কোন কথা বললাম না। অতঃপর সে উট এগিয়ে দিয়ে বললো, “আরোহণ করুন।” সে একটু দূরে সরে গেল। আমি উটের পিঠে সওয়ার হলাম। আর সে উটের মাথা ধরে কাফিলার দিকে দ্রুত এগিয়ে চললো। এবাবে সকাল হলো। লোকজন এক জায়গায় বিশ্রাম করছিলো। এমন সময় সে আমাকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে হাজির হলো। এই দৃশ্য দেখেই অপবাদ আরোপকারীরা অপবাদ রটালো। মুসলমানদের মধ্যে তা নিয়ে চাঞ্চল্য ও হুলস্থ’ল পড়ে গেল। কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারলাম না। মদীনায় পৌঁছেই আমি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমি তখনো ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানি না। কথাটা ক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আমার পিতা-মাতার কানেও গেল। তাঁরাও আমাকে এর বিন্দুবিসর্গ জানতে গিলেন না। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম। আমার প্রতি আগের মত সহৃদয় ব্যবহার তাঁর কমে গেল। কখনো অসুস্থ হলে তিনি আমাকে আদর সোহাগ করতেন। কিন্তু এবারের অসুস্থতায় তিনি তা করলেন না। এটা আমার কাছে খুব ভাল লাগলো না। আমার পরিচর্যার জন্য আমার মা কাছে ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে তিনি আমার কাছে এসে শুধু বলতেন, “কেমন আছ?” এর বেশি একটা কথাও তিনি বলতেন না। এতে আমি খুবই মনোকষ্ট পোহাচ্ছিলাম। তাঁর এ নিরস ও হৃদয়হীন আচরণ দেখে একদিন আমি তাঁকে বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে আমি আমার মার কাছে চলে যাই। তিনি আমার পরিচর্যা করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিয়ে বললেন, “যেতে পার, কোন বাধা নেই।”

আমি মার কাছে চলে গেলাম। তখনো আমি রটনা সম্পর্কে কিছুই জানিনা। বিশ দিনেরও বেশি রোগে ভুগে আমি জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেলাম।

আমরা ছিলাম আরব। অনারবদের মত আমাদের বাড়ীতে পায়খানা বানাতাম না। এসব আমাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। আমরা নারীরা খোলা ময়দানে গভীর রাত্রে গিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতাম। আমি কোন এক রাত্রে আবদুল মুত্তালিব তনয় আবু রেহেমার কন্যা উম্মে মিসতাহর সাথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার সাথে চলতে গিয়ে এই মহিলা হঠাৎ নিজের গায়ের কম্বলে পা জড়িয়ে হোঁচট খেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “কপাল পুড়–ক মিস্তাহর।” আমি বললাম, “ছি! ছি! এ আপনি কি বলেছেন, এমন একজন মুহাজিরের নামে এমন কথাÑ যিনি বদরের যুদ্ধে শরীক হয়েছেন?” তিনি বললেন, “ওহে আবু বাক্রের মেয়ে, তুমি কি ওর ব্যাপারে কিছু শোন নি?” আমি বললাম, “কিসের ব্যাপার?” তখন তিনি আমাকে রটিত অপবাদের কথা জানালেন। আমি বললাম, “এ রটনায় কি মিসতাহও যোগ দিয়েছিল?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, ও ছিল।”

আয়েশা বলেন: একথা শোনার পর আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। ঘরে ফিরে এলাম এবং কাঁদতে লাগলাম। কান্নার চোটে আমার কলিজা বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। মাকে বললাম, “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। লোকেরা যা বলার তাতো বলেছেই। কিন্তু আপনি যে তাঁর বিন্দুমাত্রও আমাকে জানালেন না। ব্যাপার কি?” মা বললেন, “মা, ব্যাপারটা তুমি হালকাভাবে নাও। কোন মেয়ে যদি সুন্দরী হয়ে এবং তার স্বামী যতি তাকে খুব ভালবাসে আর তার যদি সতিনও থাকে, তাহলে পুরুষ এবং স্ত্রী নির্বিশেষে সবাই তাকে পেয়ে বসে। তার বিরুদ্ধে এন্তার রটনায় লিপ্ত হয়।”

ইতিমধ্যে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। এই ভাষনের কথাও আমি জানতাম না। তিনি ভাষনের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর বললেন, “হে লোকজন! কিছু লোক আমার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিচ্ছে? তাদের ব্যাপারে অসত্য কথা বলছে. অথচ আমি আমার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে ভাল ছাড়া মন্দ কিছু জানি না। আর এমন একটি লোক সম্পর্কে অপবাদ রটানো হচ্ছে যার সম্পর্কেও আমি ভাল ধারণা পোষণ করি। আমার অনুপস্থিতিতে সে কখনো আমার ঘরে প্রবেশ করে না।”

আয়িশা বলেন: এই অপবাদ রটনার প্রধান ও নেপথ্য নায়ক ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল। খাযরাজ গোত্রের কিছু লোকও তার সহযোগী ছিল। মিসতাহ ও হামনা বিনতে জাহাশ (উম্মুল মুমিনীন যায়নাব বিনতে জাহাশের বোন) যেটুকু বলেছিল ঐ মুনাফিক দল তাকে অতিরঞ্জিত করে তুলেছে। হামনার বোন যায়নাব বিনতে জাহাশ রাসূলুল্লাহ অন্যতমা স্ত্রী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র যায়নাবকে আমার সমান মর্যাদা দিতেন। অথচ যায়নাব আমার সম্পর্কে একটিও খারাপ কথা বলেননি। আল্লাহ তাকে সততার উচ্চতম মানে বহাল রেখেছিলেন। কেমল হামনা বিনতে জাহাশই অপবাদ রটনায় অংশগ্রহণ করে। এমনকি সে তার বোনের জন্য আমার সাথে বাকবিত-াও করতো। তার এ আচরণে আমি খুবই বিব্রত ছিলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত ভাষণ দিলে উসায়েদ ইবনে হুদায়ের বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, অপবাদ আরোপকারীরা যদি আওস গোত্রের লোক হয় তাহলে আমরাই তাদের শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট। আর যদি খযরাজের লোক হয় তাহলে আমাদেরকে আপনি যে নির্দেশ দিতে চান, দিন। আল্লাহর শপথ, এ ধরনের লোকেরা হত্যার যোগ্য।” সাদ ইবনে উবাদকে ভাল লোক বলেন মনে হতো। একথা শুনে সে বললো, “মিথ্যা কথা, আমরা তাদেরকে হত্যা করবো না। তারা খাযরাজ গোত্রের লোক, তাই তুমি এ কথা বলছো। তোমার গোত্রের লোক হলে একথা বলতে না।” উসায়েদ বললেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। আসলে তুমি একজন মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো।”

আয়িশা (রা) বলেন: এরপর দুই পক্ষে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল। আওস ও খাযরাজ ্ও দুই গোত্রে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ারও আশংকা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে আলী (রা) ও উসামা ইবনে যায়িদকে (রা) ডেকে পরামর্শ করলেন। উসামা আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার স্ত্রী? তার সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। এটা একটা মিথ্যা ও অলীক অপবাদ।” আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, স্ত্রীলোকের অভাব নেই। আপনি ইচ্ছা করলে একজন স্ত্রীর হলে আর এক স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারেন। তবে দাসীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। সে প্রকৃত তথ্য জানাতে পারবে।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশার পরিচারিকা বারীরাকে জিজ্ঞসাবাদের জন্য ডাকলেন। সে এলে আলী (রা) তাকে ভীষণভাবে প্রহার করলেন। তারপর বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সত্য কথা বলবি।” বারীরা বললো. “আল্লাহর শপথ! আয়িশাকে আমি সচ্চরিত্র বলেন জানি। তার মধ্যে কোন দোষই আমি দেখতে পাইনি। তবে শুধু এতটুকুই পেয়েছি যে, আমি গম পিষে আটা বানিয়ে আয়িশাকে তা হিফাজত করতে বলি। কিন্তু কখনো কখনো সে আটার কথা ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ছাগল এসে তা খেয়ে ফেলে।”

আয়িশা (রা) বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তখন আমার পিতামাতা আমার কাছেই বসেছিলেন। আমার কাছে তখন জনৈকা আনসারী মহিলা উপবিষ্টা। আমি কাঁদছিলাম আর আমার সাথে এ মহিলাও কাঁদছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে বসে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, “আয়িশা, লোকেরা যা বলেছে সে ধরনের কোন খারাপ আজ যদি করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবাহ কবুল করে থাকেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটুকু শুনতেই আমার অশ্রু থেমে গেল। তাঁর উপস্থিতি যেন আমি আর অনুভবই করতে পারলাম না। পিতামাতা আমার পক্ষ থেকে তাঁকে জবাব দেবেন বলে আশা করছিলাম। কিন্তু তাঁরা কোন কথাই বললেন না। আল্লাহর শপথ, আমি নিজেকে কখনো এতটা মর্যাদাবান বলে ভাবিনি যে, আল্লাহ আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত নাযিল করবেন, যা মসজিদে মসজিদে তিলাওয়াত করা হবে এবং নামাযে পড়া হবে। আমি শুধু এতটুকুই আশা করছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে কিছু দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমার ওপর আরোপিত অপবাদ খ-ন করে দেবেন। কেননা আল্লাহ তো জানেন না যে আমি নির্দোষ। স্বপ্ন না হোক, মামুলীভাবে একটা খবর হয়তো আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দেবেন। কিন্তু কুরআনে অঙ্গীভূত যে ওহী, আমার হয়তো সম্পর্কে তা নাযিল হবে তা নাযিল হবে আল্লাহর কসম, আমি নিজেকে এতটা মর্যাদাবান কখনো ভাবিনি।

পিতামাতাকে নিরুত্তর দেখে আমি তাঁদেরকে বললাম, “আপনারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন জবাব দিলেন না?” তাঁরা বললেন, “আল্লাহর শপথ, জবাব দেবার মত কোন কিছু আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।” বস্তুত সেই দিনগুলোতে আবু বাকরের (রা) পরিবার যেরূপ সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, অতবড় সংকটে আর কোন পরিবার কখনো পড়েছে বলে আমার জানা নেই।

পিতামাতাকে আমার ব্যাপারে নীরব থাকতে দেখে আমার গ-দেশ পুনরায় চোখের পানিতে ভভসতে লাগলো এবং আমি কাঁদতে লাগলাম। আমি বললামি, “আল্লাহর শপথ! আপনি যে গুনাহর কথা বলছেন সেজন্য আমি কখনো তাওবাহ করবো না। আমি জানি, লোকেরা যা রটিয়ে বেড়াচ্ছে তা যদি স্বীকার করি তাহলে এমন বিষয় স্বীকার করে নেয়া হবে যা আমার দ্বারা আদৌ সংঘটিত হয়নি। স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষী যে, আমি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আর আমি যদি তা অস্বীকার করি তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না।” আয়িশা বলেন: অতঃপর আমি ইয়াকুব আলাইহিস সাল্লামের নাম স্মরণ করতে চেষ্ট করলাম। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। অগত্যা বললাম, “ইউসুফ আলাইহিস সাল্লামের পিতা যে কথা বলেছিলেন আমি সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করবোÑ ‘পূর্ণ ধৈর্য অবলম্বনই সুন্দর পন্থা।’ তোমরা যা বর্ণনা করছো সে ব্যাপারে আল্লাহই (আমার) একমাত্র সহায়।” এ কথা বলার পরই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহীর লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। তাঁকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো এবং তাঁর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে রেখে দেয়া হলো। আমি দৃশ্য দেখে সম্পূর্ণ নির্বিকার, বেপরোয়া ও নির্ভীক রইলাম। আমি জানতাম যে, আমি নির্দোষ। আল্লাহ আমার ওপর যুলুম করতে পারেন না। পক্ষান্তরে আমার পিতা মাতার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। যদি ওহীর দ্বারা রটিত অপবাদটি সত্য বলে ঘোষিত হয়, সেই ভয়ে তাঁদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো।

আয়িশা (রা) বলেন: কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। সেই প্রচ- শীতের দিনেও তাঁর গা দিয়ে মুক্তার দানার মত ঘাম পড়ছিলো। তিনি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “আয়িশা তোমার জন্য সুসংবাদ! আল্লাহ তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করে ওহী নাযিল করেছেন।” আমি বললাম, “আল্লাহর শোকর ও প্রশংসা।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে গিয়ে মুসলিম জনগণকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিলেন এবং কুরআনের যে আয়াতগুলো ঐ ব্যাপরে নাযিল হয়েছে তা তাদের পড়ে শোনালেন। তারপর মিসতাহ ইবনে উসামা, হাসসান ইবনে সাবিত ও হামনা বিনতে জাহাশের ক্ষেত্রে অপবাদ রটনার শাস্তি কার্যকর করলেন। কারণ তারা এই অপবাদের অন্যতম রটনাকারী ছিলেন।

ইবনে ইসহাক বনু নাজ্জারের কিছু লোকের উদ্ধৃতি দিযে বলেনঃ

আবু আইযুুব খালিদ ইবনে যায়িদকে তার স্ত্রী উম্মে আইয়ুব বলেছিলেন, “আয়িশা সম্পর্কে যা রটানো হচ্ছে, তুমি কি তা শুনেছো?” আবু আইয়ুব বললেন, “হ্যাঁ, শুনেছি। সে তো মিথ্যা কথা। উম্মে আইয়ুব, এ রকম কাজ কি তুমি করতে পারতে?” উম্মে আইয়ুব বললেন, “কখনো না।” আবু আইয়ুব বললেন, “আল্লাহর শপথ, আয়িশা তো নিঃসন্দেহে তোমার চেয়েও ভালো।”

আয়িশা বলেন: কুরআনে এই অপবাদ রটনাকারীদের সম্পর্কে যে কয়টি আয়াত নাযিল হয়, তার কয়েকটি এই, “যারা এই মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছে তারা তোমাদেরই একটি গোষ্ঠী। এ ঘটনাকে তোমরা নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না। আসলে এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। এই গোষ্ঠীর মধ্যে যে যেটুকু পাপ করেছে তার ফল সেই ভোগ করবে। আর তাদের মধ্যে যে এই অপকর্মের বেশীরভাগ দায়িত্ব নিয়েছে তার জন্য তো বিরাট আযাব রয়েছে।” (এ আয়াতে হাসসান ইবনে সামিত ও তাঁর সহযোগীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা অপবাদ রটনায় অংশ নিয়েছিলেন।) “তোমরা যখন কথাটা শুনেছিলে তখন মু’মিন স্ত্রী পুরুষেরা নিজেদেরই লোক সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করলো না কেন? (অর্থাৎ আবু আইয়ুব ও তার স্ত্রীর মত) যখন তোমরা মুখ থেকে মুখে কথাটা গ্রহণ করছিলো এবং যা জানো না তাই রটিয়ে বেড়াচ্ছিলে, আর এসে একটা হালকা জিনিস মনে করছিলে। অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।”

আয়িশা (রা) ও তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের সম্পর্কে এ আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর আবু বাক্র (রা) বললেন, “আল্লাহর শপথ, মিসতাহ যখন এমন জঘন্য অপবাদ আয়িশার বিরুদ্ধে রটিয়েছে তখন তার ভরণ-পোষণের ভার আমি আর বহন করবো না এবং তার বিন্দুমাত্রও উপকার করবো না। ” উল্লেখ্য যে, মিসতাহ তার একজন দরিদ্র আত্মীয় ছিল এবং তিনি তার ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহ করতেন।

আবু বাক্রের এই প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে নাযিল হলো, “তোমাদের মধ্যে যারা সচ্ছল ও অনুগ্রাহক তারা যেন আত্মীয়-স্বজন, দরিদ্র ও আল্লাহর পথে হিজরাতকারীদের প্রতি বদান্যতা না দেখানোর প্রতিজ্ঞা না করে। তারা যেন ক্ষমা ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমদেরকে ক্ষমা করুন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।” আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াত শুনে তৎক্ষণাৎ বললেন, “হ্যাঁ, আমি চাই আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।” ্অতঃপর তিনি মিসতাহর ভরণ-পোষণের ভার পুনরায় গ্রহণ করেন এবং আর কখনো এ দায়িত্ব ত্যাগ করবেন না বলে শপথ নেন।

ইবনে ইসহাক বলেন: আয়িশার (রা) প্রতি অপবাদ আরোপের জন্য হাসসান ইবনে সাবিতের যে শাস্তি হয় মুসলমানদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি সে সম্পর্কে নিম্নরূপ কবিতা আবৃত্তি করেন,

“হাসসান সমুচিত শাস্তি পেয়েছে। আর হামনা এবং মিসতাহও।

কেননা তার অশ্লীল কথা বলেছিল।

তাদের নবীর মহিষী সম্পর্কে আনুমানিক উক্তি করে এবং তাঁকে দুশ্চিন্তগ্রস্ত করে

তারা আরশ অধিপতির ক্রোধের শিকার হয়েছিল।

তারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছিল, চিরস্থায়ী গ্লানিকর অপপ্রচারণাকে গুরুত্ব

দিয়ে চারদিকে ছড়িয়েছিল এবং অপমানিত করেছিল।

(ফলে) রটনাকারীদের ওপর শাস্তির দ- মুষলধারে

বৃষ্টি বর্ষণের মত বর্ষিত হতে লাগলো।”

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *