3 of 3

১২৬. হাতিম তাঈ-এর আদীর ঘটনা

আদী ইবনে হাতিম বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমি তাঁর প্রতি যতটা ঘৃণ্য পোষন করতাম অতটা আরবের আর কেউ করাতা না। আমি নিজে সম্ভ্রান্ত খৃষ্টান ছিলাম। আমি গোত্রপতি হিসেবে রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমার মনে তাঁর প্রতি প্রবল বিদ্বেষ জন্ম নিল। আমার এক আরব গোলাম ছিল। সে আমার উট চরাতো। তাকে বললাম, “আমার জন্য ভাল পোষমানা মোটাসেটা দেখে কয়েকটা উট প্রস্তুত রাখো এবঙ এগুলো আমার কাছে বেঁধে রাখো। তারপর যখন শুনবে, মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী এদিকে আসছে তখন আমাকে জানাবে।” সে উট এনে আমার কাছে বেঁধে রাখলো।

একদিন সকালে সে আমার কাছে এসে বললো, “হে আদী, মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী তোমার ওপর চড়াও হলে কি করতে চেয়েছিল এক্ষুণি তা কর।” আমি কতকগুলো পতাকা উড়তে দেখে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো, কিসের পতাকা?” তারা বললো, “এগুলো মুহাম্মাদের সেনাবাহিনীর পতাকা।” আমি একথা শুনে গোলামকে বললাম, “তাহলে আমার উটগুলো কাছে নিয়ে এসো।” একটি উটের পিঠে আমি চড়ে বসলাম। অপরগুলিতে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বসালাম। তারপর সিরিয়ার খৃষ্টনাদের কাচে যাওয়ার জন্য উচের কাফিলা হাঁকালাম। কাফিলা জোশিয়া পার্বত্য পথ ধরে রওনা হলো। পেছনে হাতিমের এক কন্যাকে গোত্রে রেখে গেলাম। আমি সিরিয়ায় গিয়ে অবস্থান করতে লাগলাম। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল অশ্বারোহী আমার সন্ধানে এসে হাতিমের কন্যাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে নিয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে হাজির করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সিরিয়া পালানোর খবর জেনে ফেলেছিলেন। তিনি হাতিমের কন্যাকে মসজিদে নববীর এক পার্শ্বে অবস্থান করতে দিলেন। সেখানে অণ্যান্য যুদ্ধবন্দিনী মহিলা ও আটক ছিল। হাতিমের কন্যা ছিল সুবক্তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সে বললো,“ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা মারা গেছেন এবং তত্ত্বাবধায়ক নিখোঁজ হয়েছেন। এমতাবস্থায় আমার ওপর অনুগ্রহ করুন, আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কে তোমার তত্ত্বাবধায়ক?” সে বলে, “আদী ইবনে হাতীম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে আদী আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল থেকে পালিয়েছে সে?” এ কথা বলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। হাতিম তনয়া বলেন পরদিন আবার তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি আবার আগের দিনের মত বললাম। তিনিও আগের দিনের জবাবের পুনরাবৃত্তি করলেন। তার পরের দিন আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পাশ দিয়ে যেতে লাগলেন। আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণকারী এক ব্যক্তি আমাকে বললো, “উঠে দাঁড়াও এবং রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বল।” আমি দাঁড়ালাম এবং পুনরায় বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি পিতৃহীনা এবং আমার অভিভাবকও নিখোঁজ। অতএব আমার ওপর অনুকম্পা প্রদর্শন করুন। আল্লাহ আপনাকে অনুকম্পা প্রদর্শন করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমার আবেদন আমি গ্রহণ করছি। তুমি এখান থেকে বেরুবার জন্য তাড়াহুড়া করো না। তোমার গোত্রের এমন কোন বিশ্বস্ত লোক পেলে আমাকে জানবে যে তোমাকে তোমার দেশে পৌছেয়ে দিতে পারে।” আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যে ব্যক্তি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বলতে বলেছিল তিনি আবু তালিবের পুত্র আলী (রা)। আমি সেখানে থাকতে লাগলাম। অবশেষে বালী অথবা কুজায়া গোত্রের একদল উষ্ট্রারোহী এল। আমার ইচ্ছা ছিল সিরিয়াতে ভাইয়ের কাছে যাবো। তাই ঐ কাফিলাকে উপযুক্ত সঙ্গী মনে করে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার গোত্রের একদল লোক এসেছে। তাদের ওপর আমার আস্থা আছে এবং আমার গন্তব্যে পৌছার জন্য ওরা উপযোগী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সওয়ারী দিলেন, পাথেয় দিলেন এবং পোশক-পরিচ্ছদ দিলেন। আমি দলটির সাথে রওনা হয়ে সিরিয়া পৌছে গেলাম।

আদী বলেনঃ আমি স্বীয় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসে ছিলাম। সহসা এক উষ্ট্রারোহী মহিলাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম, সম্ভবত সে হাতিমের কন্যাই হবে। দেখলাম, সত্যিই তাই। সে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে ভর্ৎসনা করতে লাগলো। বললো, “আত্মীয়তা ছিন্নকারী যলিম। তোমার পিতার পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যকে অরক্ষিত রেখে নিজের সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পলিয়ে এসেছো?” আমি বললাম, “হে বোন! আমাকে তিরষ্কার করো না। আমার বাস্তবিকই কোন ওজর নেই। তুমি যা বলছো আমি সত্যিই তাই করেছি।”

সে উটের পিঠ থেকে নামল এবং আমার কাছেই থাকতে লাগলো। সে একজন প্রখর ধীশক্তি সম্পন্না মহিলা ছিল। আমি বললাম, “মুহাম্মাদ সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?” সে বললো, “আমার ধারণা, তোমার অবিলম্বে তাঁর আন্দোলনে যোগদান করা উচিত। যদি তিনি নবী হয়ে থাকেন তাহলে যে তাঁর কাছে আগে যাবে তার প্রতি তাঁর বেশী অনুগ্রহ হবে। আর যদি তিনি রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে ইয়ামনের সম্ভ্রান্ত লোকদের সামনে তোমার গৌরব মোটেই হ্রাস পাবে না। তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে।” আমি বললাম, “তুমি যা বলছো সেটাই সঠিক।” এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করার জন্য মদীনা অভিমুখে রওনা হলাম। সেখানে পৌছে মসজিদে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে নিয়ে আপন গৃহ অভিমুখে রওনা হলেন। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা হলো। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দাঁড়াতে বললো। তিনি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তার নানান অভাব অভিযোগের কথা শুনলেন। তা দেখে আমি মনে মনে বললাম, “আল্লাহর কসম, এ লোক কোন রাজা-বাদশাহ হতে পারেন না।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিয়ে তাঁর গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাকে খেজুর ছলের তৈরী একটি গদীতে বসতে দিলেন। আমি বললাম, “আপনি বসুন।” তিনি বললেন, “না তুমি বস।” আমি তাতে বসলাম। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন মাটিতে।

আমি মনে মনে বললাম, এটা নিশ্চয়ই কোন রাজার চরিত্র হতে পারে না। অতঃপর বললেন, “হে আদী ইবনে হাতীম। তুমি কি রাকুসী নও?” [৯২. রাকুসী তৎকালীন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বলা হতো এই গোত্র খৃষ্টান ও সাবী ধর্মমতের মধ্যবর্তী একটা ধর্মমত পোষন করতো।] আমি বললা, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তুমি কি তোমার গোত্রের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক চতুর্থাংশ ভোগ করা না?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “এটা কিন্তু তোমার ধর্মে অবৈধ।” আমি বললা, “সত্যিই তাই।” আমি এই সময় নিশ্চিত হলাম যে তিনি সত্যই আল্লাহর নবী যিনি মানুষকে বিস্মৃত কথা স্মরণ করিয়ে এবং অজানা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে থাকেন। অতঃপর বললেন, “হে আদী। সম্ভবতঃ মুসলমানদের দারিদ্র দেখে তুমি ইসলামে প্রবেশ করছো না। আল্লাহর কসম, সে দিন বেশী দূরে নয় যখন মুসলমানরা এত বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হবে যে, টাকা পয়সা নেয়ার লোকই পাওয়া যাবে না। তোমার ইসলাম গ্রহণ না করার কারণ এও হতে পারে যে, মুসলমানদের সংখ্যা কম ও তাদের শত্রুসংখ্যা বেশী। আল্লাহর কসম, সেদিন নিকটবর্তী যখন তুমি শুনবে যে কাদেসিয়া থেকে এক মহিলা একাকিনী নির্ভয়ে ও নিরাপদে উষ্ট্রে আরোহণ করে পবিত্র ঘর যিয়ারত করতে এসেছে। তুমি যত রাজা-বাদশাহ দেখছো তাও অমুসলিমদের মধ্যে দেখছো বলেও হয়তো ইসলাম গ্রহণ করছো না। কিন্তু আল্লাহর কসম, সেদিন অত্যাসন্ন যখন ব্যবিলনের শ্বেত প্রাসাদগুলো মুসলমানদের দখলে চলে আসবে।”

আদী বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটো ভবিষ্যদ্বানী আমি পূর্ন হতে দেখেছি। এসটা শুদু বাকী রয়েছে এবং আল্লাহর কসম, সেটিও পূর্ণ হবেই। ব্যাবিলনের শ্বেত প্রসাদসমূহ আমি দখলে আসতে দেখেছি। কাদেসিয়া থেকে নিরাপদে একাকিনী মহিলার হজ্জ সমপনেও দেখেছি। আর সম্পদের প্রাচুর্য এত হবে যে, টাকা পয়সা নেয়ার লোক পাওয়া যাবে না- সেটিও একদিন বাস্তব হয়ে দেখা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *