3 of 3

১০৭. শান্তিচুক্তি বা হুদাইবিয়ার সন্ধি

কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুহাইল ইবনে আমরকে পাঠালো। তারা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আপোষ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠালো। এই আপোষরফার একমাত্র লক্ষ্য হবে মুহাম্মাদ যেন অবশ্যই এ বছরের মত মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যায়। আরবরা যেন কখনো বলতে না পারে যে, মুহাম্মাদ কুরাইশদের ওপর শক্তিপ্রয়োগ করে মক্কায় প্রবেশ করেছে।

সুহাইল ইবেন আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের কাছে এলো। তাকে আসতে দেখে তিনি বললেন, “ এ লোকটিকে তখনই পাঠানো হয়েছে যখন কুরাইশরা নিশ্চয়ই সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” সুহাইল এসে খুব লম্বা আলাপ জুড়ে দিল। তারপর সন্ধির ব্যাপারে উভয়পক্ষে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলো।

সন্ধি চুক্তির সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে লিখিত রুপ নিতে শুধু বাকী, এই সময় উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আবু বাকরের (রা) নিকট ছুটে গিয়ে বললেন, “ হে আবু বাক্র, তিনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” আবু বাক্র বললেন “হ্যা”। উমার বললেন, “আমরা কি মুসলমান নই?” আবু বাক্র বললেন, “অবশ্যই।” ইমার বললেন, “কুরাইশরা কি মুশরিক নয়?” আবু বাক্র বললেন, “হ্যা।” উমার আবারো বললেন, “তাহলে কিসের জন্য আমরা আমাদের দীনের ব্যাপারে এভাবে নতিস্বীকার বরতে যাচ্ছি?” আবু বাক্র বললেন “উমার, তার আনুগত্য কর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।” উমার বললেন “আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল।”

তারপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” তিনি বললেন “হ্যা।” উমার বললেন, “ওরা কি মুশরিক নয়?” তিনি বললেন, “হ্যা।” উমার আবারো বললেন “তাহলে কি কারণে আমরা আমাদের দীনের প্র¤েœ এই অবমাননা বরদাশত করতে যাচ্ছি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। তার নির্দেশ আমি কখনো লংঘন করবো না। আর তিনি আমাকে কখনো বিপথগামী করনে না।”

পরবর্তীকালে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “আমি সেদিনের সেই ভ্রান্ত আচরণের জন্য সারাজীবন সাদকা, নামায রোযা ও গোলাম আযাদ করার মাধ্যমে কাফফারা গেয়ার চেষ্টা চালিয়েছি। আমার কথাগুলোর খারাপ পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য আমি এমব করেছি। অবশেষে আমার আশার সঞ্চার হয়েছে যে, আমি ভাল ফল পাবো।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) ডেকে বললেন “লেখ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।” সুহাইল বললো, “এটা আমার অজানা কথা। তুমি বরং লেখ, বিসমিকা আল্লাহুম্মা।” ( হে আল্লাহ, মোতার নামে।) অতঃপর তিনি বললেন “লেখ, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুহাইল ইবনে আমরের সাথে নিম্নলিখিত মর্মে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন।” একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুহাইল ইবনে আমর বলে উঠলো “আমি যদি তোমাকে আল্লাহর রাসূল বলেই মানতাম তাহলে তো তোমার সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতাম না। শুধু তোমার নাম ও পিতার নাম লেখ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহ ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, তাই লেখ। আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নিম্নলিখিত মর্মে আমরের পুত্র সুহাইলের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। তারা উভয়ে একমত হয়েছে যে, দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই দশ বছর জনগণ পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সব রকমের আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। ুকরাইশদের কোন লোক তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুহাম্মাদের নিকট এলে তিনি তাকে ফেরত পাঠাবেন। আর মুহাম্মাদের সাহাবাদের কেউ কুরাইশদের কাছে আসলে কুরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাবে না। আমাদের এই চুক্তি কখনো লংঘিত হবে না। উভয় পক্খ আন্তরিকভাবে ও পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে তা মেনে চলবে। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না কেউ গোপন পাচারের কাজে লিপ্ত হবে না। মুহাম্মাদ অথবা কুরাইশ যে কোন পক্ষের সাথে যে কেউ এ চুক্তিতে অংশগ্রঞন বা নতুন চুক্তি করতে চাইলে অবাধে তা করতে পারবে।” এই ধারা ঘেষিত হওয়া মাত্র বনু খাযরা গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের সাথে এবং বনু বাক্র কুরাইশদের সাথে তদক্ষনাৎ মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করলো। সন্ধি চুক্তিতে আরো লিপিবদ্ধ করা হলো, “তুমি (মুহাম্মদ) এ বছর আমাদের শহর মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যাবে। আগামী বছর আমরা তোমার জন্য মক্কার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে অন্যত্র চলে যাবো। তুমি অবাধে প্রবেশ করবে এবং তোমার সাথীদের নিয়ে তিনদিন মক্কায় অবস্থান করবে। কোষবদ্ধ তরবারী সঙ্গে নিতে পারবে। তরবারী ছাড়া ঢুকবার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সুহাইল ইবনে আমরের তত্ত্বাবধানে যখন এই সন্ধিচুক্ িলিপিবদ্ধি করা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় সুহাইল ইবনে আমরের পুত্র আবু জানদাল শৃংখলিত অবস্থায় সেখানে এসে হাজির হলো। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি নিকট পালিয়ে এসেছেন। এ সময় ঐ স্থানে রাসূলুল্লাহ রাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন না। ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের দেখা স্বপ্নে যে বিজয়ের ইংগিত ছিল সে ব্যাপারে তারা সংশয়য়বিষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। তাই তারা সন্ধি চুক্তিতে এ বছর (উমরা ছাড়াই) ফিরে যাওয়ার ধারা সন্নিবেশিত হতে দেখে এবং রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা বরদাশত করতে ও মেনে নিতে দেখে মহা বিপাকে পড়ে যান এবং প্রায় পথভ্রষ্ট হবার উপক্রম হন। ওদিকে আবু জানদালকে দেখে সুহাইল ইবনে আমর বেসামাল হয়ে তার তুখে প্রচন্ড এক চপেটাঘাত করলো এবং তার বুকের কাপড় টেনে ধরলো। সে তখন বলছিল, “হে মুহাম্মাদ, আবু জানদাল আসার আগেই তোমার ও আমার মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে কথা সত্য।” অতঃপর সে আবু জানদালকে বুকের কাপড় ধরে প্রবল জোড়ে টানতে লাগলো মক্কায় ফেরত পাঠানোর জন্য। আর আবু জানদাল উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো “হে মুসলমানগণ, আমাকে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যারা নির্যাতন করছে সেই কুরাইশদের কাছেই কি আমাকে য়েরত পাঠানো হবে?” তার এ আর্তচিৎকারে মুসলসমানদের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন “হ আবু জানদাল, তুমি সবর কর এবং নিজের অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাক। তুমি ও তোমার মত যেসব অসহায় ও নির্যাতিত মুসলমান তোমার সাতে মক্কায় রয়েছে, আল্লাহ তাদের মুক্তির জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। আমরা কুরাইশদের সাথে একটা সন্ধি ও শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছি। এ ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী মেনে আমরা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমরা তাদেরকে দেয়া এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবো না।”

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আবু জানদালের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন “হে আবু জানদাল, সবর কর। ওরা তো মুশরিক। ওদের সবার রক্ত কুকুরের রক্তের সমতুল্য।” উমার (রা) একথা বলার পাশাপাশি আবু জানদালের কাছে নিজের তরবারী এগিয়ে গিচ্ছিলেন। তিনি বলেন আমি আশা করছিলাম যে, আবু জানদাল তরবারী নিয়ে তার পিতাকে হত্যা করে ফেলুক। কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত তার পিতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যাপারটা ওখানেই থেকে যায়।

দলীলটি লেখার কাজ শেষ হলে মুসলমান ও মুশরিক উভয় পক্ষের অনেকে এর সাক্ষী হলেন। সাক্ষীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা), উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা), আবদুল্লাহ ইবনে সুহাইল ইবনে আমর,, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, মাহমুদ ইবনে মাসলাম, মিকরায ইবনে হাফস ও আলি ইবনে আবু তালিব (রা)। মিকরায তখনো মুশরিক ছিল। আর আলী (রা) ছিলেন দলীলের লেখক।

কুরবানীর উটগুলোকে কিভাবে কুরবানী করে ইহরাম মুক্ত হওয়া যায় সে মস্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম চিন্তিত ছিলেন। তখনো তিনি ইহরাম অবস্থায় নামায আদায় করছিলেন। চুক্তি সই হয়ে গেলে তিনি নিজের কুরবানীর পশুটা কুরবানী করে মাথা মুন্ডন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সব সাহাবীও কুরবানী করে মাথা মুন্ডন করলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমেুখে যাত্রা করলেন। মক্কা ও মদীনার মাঝখানে থাকতেই সূরা আল ফাতহ্ নায়িল হলোঃ

“হে নবী, আমি তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয়ের উদ্বোধন করেছি, যেন আল্লাহ তোমার আগের ও পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন তোমার ওপর তার নিয়ামত পূর্ণ করেন এবং তোমাকে নির্ভুল পথে চালিত করেন।”

আল্লাহ আরো বলেন “আল্লাহ তাঁর রাসূলের স্বাপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি স্বাপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি শীঘ্রই নিরাপদে ও নির্ভয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে নিরাপদে মাথার চুল মুন্ডিয়ে ও ছেঁটে নির্ভিকচিত্তে প্রবেশ করবে। সে (আল্লাহর রাসূল) সেই জিনিস অবগত হয়েছে যা তোমরা অবগত হওনি। ঐ ঘটনার (হুদাইবয়ার সন্ধির) পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।”

যুহরী বলেন: পূর্বে ইসলামের যতগুলো বিজয় অর্জিত হয়েছে তার মধ্যে এটিই (হুদাইবিয়ার সন্ধি) ছিল সবচেয়ে বড় বিজয়। আগে মানুষ বিপক্ষের মুখোমুখি হলেই যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কিন্তু সন্ধি হলে যুদ্ধের অবসান ঘটলো আর তার ফলশ্রুতিতে লোকজন পরস্পরের সাথে নির্ভয়ে মেলামেশা ও আলাপ আলোচন করার সুযোগ পেল। ফলে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এ সময়ে এমন অবস্থা হলো যে সামান্য কান্ডজ্ঞান ছিলো এমন ব্যক্তির সাথে ইসলাম সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলেই সে ইসলাম গ্রহণ করতো। সন্ধি পরবর্তী দুই বছরে যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা সন্ধি পূর্ব ইসলাম গ্রহণকারীদের মোট সংখ্যার চেয়ে কম তো নয়ই বরং বেশী। [৭৯.ইবনে হিশাম বলেন, যুহরীর এ উক্তির সপক্ষে প্রমান এই যে, রাসূলুল্লাহ হুদাইবয়োতে গিয়েছিলেন ১৪০০ মুসলামানকে সঙ্গে নিয়ে। এর মাত্র দু’বছর পরে তিনি যখন মক্কা বিজয়ে যান তখন তার সাথে ছিল দশ হাজার মুসলমান।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *