3 of 3

১০৮. খাইবার বিজয়: ৭ম হিজরীর মুহাররাম মাস

হুদাইবিয়া থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাসের কিছু অংশ অতিবাহিত করেন। মুশরিকরা এ বছর হজ্জ করেনি। মুহাররামের শেষাংশে তিনি খাইবার অভিযানে বের হন।

আবু মুয়াত্তাব ইবনে আমর (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবার পৌছে সাহাবীদের বললেন “থামো।” তাদের মদ্যে আমিও ছিলাম। এরপর বললেন “হ আল্লাহ, আসমান যমীন ও তার মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর অদিপতি, সব শয়তান এবং তারা যত লোককে গুমরাহ করেছে তাদেরও সর্বময় মালিক এবং বাতাস ও তার চালিত, বাহিত ও উৎক্ষিপ্ত জিনিসসমূহের নিরংকুশ প্রভু, আমরা আপনার কাছে এই জনপদ তার, অধিবাসীদের পক্ষ থেকে সব রকমের অকল্যাণ থেকে আনার আশ্রয় প্রার্থনা কির। আল্লাহর নামে তোমরা এগিয়ে যাও।” তিনি প্রতিটি জনপদে প্রবেশকালেই এ কথা গুলো বলতেন।

আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম সকাল বেলা ছাড়া কোন জনগোষ্ঠির ওপর আক্রমণ করতেন না। সেখানে আযান শুনলে থেমে যেতেন। আযান না শুনলে আক্রমণ চালাতেন। আমরা রাতের বেলা খাইবারে পৌছে যাত্রাবিরতি করলাম। কিন্তু কোন আযান শুনতে পেলেন না। অতঃপর তিনি আমাদের নিয়ে যাত্রা করলেন। আমি আবু তালহার পেছনে সওয়অর হয়েছিলাম। আমার পা রাষূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের পা স্পর্শ করছিল। সকাল বেলা খাইবারের শ্রমিকরা কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে দিনের কাজে বেরুচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনিকে দেখে তারা সবিস্ময়ে বলে উঠলো, “সর্বনাশ! মুহাম্মাদ তার বাহিনীসহ হাজির হয়েছে দেখছি”- বলেই তারা পালিয়ে পেছনে ফিরে যেতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার! খাইবারের পতন ঘটেছে। আমরা কোন জনপদে আগমন করলেই তার অধিবাসীর সকাল বেলাটা দুর্ভাগ্যময় হয়ে ওঠে।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাম মদীনা থেকে খাইবার যাওয়ার সময় ই’স্র পাহাড়ের ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। এজন্য সেখানে একটা মসজিদ তৈরী করা হয়। এরপর যান ‘সাহাবা’র মথ্য দিয়ে। তারপর তাঁর সমগ্র বাহিনী নিয়ে রাজী উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করেন। এখানে তিনি খাইবারবাসী ও গাতফানীদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন াতে গাতফানীরা খাইবারবাসীদের সাহায্য করতে না পারে। তারা সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খাইবারের ইয়াহুদীদের সাহায্য করতো।

গাতফানীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কথা শুনে একদল যোদ্ধা সংগ্রহ করে খাইবারের ইয়াহুদীদের শক্তিবৃদ্ধি করতে অগ্রসর হলো। কিছুদুর গেলেই পেছনে ফেলে আসা তাদের পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের ওপর আপতিত একটা বিপদের শেঅরগোল শুনতে পেল। তারা ভাবলো, মুসলমানরা হয়তো তাদের পরিবার পরিজনের ওপর ভিন্ন দিক থেকে গিয়ে চড়াাও হয়েছে। তাই ফিরে গিয়ে তারা নিজ নিজ পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত হলো এবং খাইবারবাসী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুকাবিলার জন্য ছেড়ে দিল। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমান্বয়ে খাইবারের ইয়াহুদীদের ধন সম্পদ ও দুর্গসমূহ এক এক করে দখল করতে লাগলেন। তিনি সর্বপ্রথম তাদের ‘নায়েম’ দুর্গ জয় করেন। এখানে সাহাবী মাহমুদ ইবনে মাসলামা শহীদ হন। তাঁর ওপর গম পিষা যাঝতার পাট ছুড়ে মারা হলে তিনি শহীদ হন। এরপর আবুল হুকাইকের দুর্গ ‘কামূস’ বিজিত হয়। সেখানে থেকে তিনি কিছুসংখ্যক ইয়াহুদীকে আটক করেন। তাদের মধ্যে হুয়াই ইবেন আখতাবের কন্যা সাফিয়া অন্যতম। সে কিনানা ইবনে রাবীর স্ত্রী ছিল। তার দু’জন চাচাতো বোনও গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়াকে নিজের জন্য মনোনীত করেন। দাহইয়া ইবন খালীফা কালবী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সাফিয়াকে চেয়েছিলেন। তিনি সাফিয়অকে নিজের জন্য গ্রহণ করে নিয়েছিলেন বলে দাহইয়াকে তার চাচাতো বোনকে দিয়ে দেন। ক্রমে খাইবারের গ্রেফতারকৃত লোকদেরকে সাহাবীদের সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

এক এক করে খাইবারের কিল্লাগুলো এবং তাদের ধনসম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হস্তগত হচ্ছিল। কেবল ওয়াতীহ ও সুলালিম নামক কিল্লা দুটি দখল করা তখনও বাকী ছিল। সবশেষে তিনি এ দুটি কিল্লা জয় করেন। এ দুটিকে তিনি দশদিনের অধিক সময় ধরে অবরোধ করে রাখেন।

ইয়াহুদ নেতা মরারহাব অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুকাবিলায় এগিয়ে এস একটি রণোদ্দীপক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো। কবিতাটি হলোঃ

“সমগ্র খাইবার জানে যে, আমি মারহাব। (অর্থাৎ খুব প্রতাপশালী)

অস্ত্র দিয়ে আঘঅত করতে পারদর্শী, অভিজ্ঞ ও বহুদর্শী বীর।

কখনো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিই আবার কখনো শক্ত আঘাত করি।

শার্দুলেরা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে দেয়ৈ আসে তখন আমার ধারে কাছেও

কেউ ঘেঁষতে পারে না।”

সে চ্যালেঞ্জ করলো,, “এসো আমার সাথে দ্বান্ধ যুদ্দ করতে কে প্রস্তুত আছ?” কা’ব ইবনে

মালিক (রা) রণসংগীত আবুত্তি করেই তার জবাবে বললেন,

“খইবার জানে যে আমি কা’ব। আমি দুঃখ দুর্দশা ঘুচাই, সাহসী ও অনমনীয়।

যখন যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন যুদ্ধের পর যুদ্ধই চলতে থাকে।

আমার আছে বিজলীর আলোকচ্ছটার মত ধারালো তরবারীটা।

আমরা তোমাদেরকে পদদলিত করবো যাতে সব জটিলতার অবসান ঘটে।

এতে আমরা পুরস্কৃত হবো অথবা আমাদের কাছে

প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ চলে আসবে! (সে সম্পদ আসবে) বজ্রমুষ্ঠির আঘাতে

এবং তাতে কোন তিরস্কারের অবকাশ থাকবে না।”

রাসূলুল্লাহ বললেন, “এই লোকটির সাথে কে লড়তে প্রস্তুত আছে?” মুহাম্মাাদ ইবনে

মাসলামা (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তার সাথে লড়তে প্রস্তুত আছি। আল্লাহর কসম, আমি ভীষণ লড়াকু। আমি ওর থেকে স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই। গতকাল সে আমার ভাইকে (মাহমুদ ইবনে মাসলামা) হত্যা করেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “যাও। হে আল্লাহ, মারহাবকে পর্যুদস্ত করতে ওকে সাহায্য কর।” অতঃপর মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ও মারহাবকে মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। একটি পুরনো বৃক্ষ তাদের মাঝখানে আড় হয়ে দঁড়ালো। উভয়ে পালাক্রমে ঐ গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে লাগলো। এক সময় মারহাবের তরবারী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ঢালে আটকে গেল। তৎক্ষণাৎ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলাম তরবারীর আঘাতে মরহাবকে হ্যা করলেন।

মারহাব নিহত হলে তার ভাই ইয়াসার হুংকার দিয়ে এগিয়ে এলা। হিশাম ইবনে উরওয়অর মতানুসারে যুবাইর ইবনুল আওয়াম তার সাথে বুঝতে গেলেন। একথা শুনে তাঁর মাতা সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞেস করলেন,, হে আল্লাহর রাসুল আমার পুত্র কি নিহত হবে?” তিনি বললেন “না, তোমার পুত্র ইনশায়াল্লাহ ইয়াসারকে হত্যা করবে।” যুবাই্র সিত্যি সত্যিই ইয়াসারকে হতা করলেন।

সালামা ইবনে আমর ইবনে আকওয়অ বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারে কোন একটি দুর্গ অধিকার করার জন্য আবু বাক্র সিদ্দীককে (রা) পতাকা দিয়ে পাঠালেন। তিনি যুদ্ধ কররেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি করেও তিবি দুর্গ জয় করতে না পেরে ফিরে এলেন। পরদিন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) পাঠালেন। তিনিও তুমুল যুদ্ধ করলেন। কিন্তু অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কাল সকালে আমি এমন একজনকে পতাকা দেবো যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তার হাতেই দুর্গ জয় করাবেন। তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে কখনো পালাবার মত লোক না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লাম আলীকে (রা) ডাকলেন। তিনি তখন চক্ষুরোগে ভুগছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চোখে থু থু দিলেন এবং বললেন, “এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও। আল্লাহ যতক্ষণ তোমার হাতে বিজয় না দেন ততক্ষণ লড়াই করে যাও।”

সালামা বলেনঃ তিনি এগিয়ে গেলেন। শত্রুকে কাবু করার মত প্রচন্ড বলবীর্য ও পরাক্রম ছিল তাঁর। তিনি শুধু হেলেদুলে পায়তারা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। আমরা তাঁর পেছনে তাঁর অনুসরণ করছিলাম। তিনি কিল্লার নীচে একটা পাথর স্ত’পের মধ্যে পতাকা স্থাপন করলেন। ওপর থেকে একজন ইয়াহুদী তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে?” তিনি বললেন, “আমি আবু তালিবের পুত্র আলী।” ইয়াহুদী বললো “তাওরাতের শপথ! তোমরা বিজয়ী হয়েছো।” অবশেষে আলীর হাতইে বিজয় দান করেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারবাসীকে তাদের দুই দুর্গ ওয়াতীহ ও সুলালিমে অবরোধ করলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝলো যে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই তখন তারা তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল এবং খাইবার থেকে তাদেরকে বহিস্কার করার প্রস্তাব দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ প্রস্তাব মেনে নিলেন ও প্রাণভিক্ষঅ দিলেন। ইতিপূর্বেই তিনি তাদের আশঙ্কা আন্ নাতাহাহ ও আল কুতাইবার ভূমিসহ সমস্ত স্থাবর অস্থঅবর সম্পদ এবং ঐ দুটি দুর্গ ছাড়া সকল দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন। ফদাকবাসী সমস্ত খবর জানতে পারলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের প্রাণভিক্ষা দিয়ে বিতাড়িত করণ এবং জমিজমা ও ধনসম্পদ হস্তগত করার অনুরোধ জানালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে যারা এই অনুরোধ নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়েছিল তাদের মধ্যে মুহাইসা ইবনে মাসউদ ছিলো অন্যতম। সে ছিল বনু হারেসার লোক। খাইবারবসী এই ব্যবস্থা প্রথমে মেনে নেয়। কিন্তু পরে অনুরোধ করে যে আমাদেরকে বহিস্কার না করে অর্ধেক বর্গাভাগের ভিত্তিতে জমি চাষের কাজে নিয়োজিত করুন। তারা যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলে যে এখানকার জমিজমা আমরাই ভাল আবাদ করতে সক্শস এবং এ কাজে আমরাই সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ প্রস্তাব মঞ্জুর করে তাদের সাথে আপোষরফা করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার আমাদের থাকবে। ফাদাকবাসীও এই শর্তে তাঁর সাথে আপোষ করলো। এভাবে খাইবার মুসলামানদের যৌথ সম্পদ এবং ফাদাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হলো। কেননা ফাদাক জয় করতে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন পড়েনি।

এসব আপোষরফার পর রাসূলুল্লাহ সাল্ল াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ঠিক তখনই সাল্লাম ইবনে মুসকামের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারেস তাঁকে একটি ভুনা বকরী উপহার দিল। ভুনা ছাগলটি পাঠানোর আগে সে জিজ্ঞেস করে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামা বকরীর কোন্ অংশ খেতে বেশী পছন্দ করেন?” তাকে জানানো হলো যে, তিনি উরু বা রানের গোশত বেশী পছন্দ করেন। তখন সে উরুতে বেশী করে বিষ মিশিয়ে দেয়। অতঃপর পুরো ছাগলটিকে সে বিষাক্ত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে আসে। তা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এক টুকরো গোশত চিবালেন কিন্তু গিললেন না। সাহাবী বিশর ইবনে বারা ইবনে মা’রুরও তাঁর সাথে বসে খাচ্ছিলেন। বিশরও এক টুকরো গোশত মুখে নিয়ে চিবালেন। তিনি গেলে ফেললেন। কিন্তু সরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উগরিয়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, “এই হড্ডিটা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তা বিষাক্ত।” অতঃপর তিনি মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। সে স্বীকারোক্তি করলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এমন কাজ কেন করলে?” সে বললো, “আপনি আমার কওমের সাথে কি আচরণ করেছেন তা আপনার জানা আছে। আমি ভাবলাম আপনাকে এভাবে বিষ খাওয়াবো। আপনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে আপনার হাত থেকে উদ্দার পাবো আর যদি নবী হয়ে থাকেন হাহলে তো আপনাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) সাবধান করে দেয় হবে।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাফ করে দিলেন। কিন্তু বিশর যে টুকরাটি খেয়েছিলেন তাতেই তিনি মারা গেলেন। খাইবার বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াদিউল কুরাতে চলে গেলেন। সেখানকার অধিবাসীদের কয়েকদিন অবরোধ করে রাখেলেন, অতঃপর মদীনা চলে গেলেন।

খাইবার কিংবা পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়ার সাথে বাসর রাত কাটান। আনাস ইবনে মালিকের (রা) মা উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান সাফিয়াকে বধূর বেশে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গম্বুজ সর্দশ একটি তাঁবুতে তাকে নিয়ে বাসর রাত যাপন করলেন। এদিকে আবু ইয়ুর খালিদ ইবনে যায়িদ (রা) উন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে সারারাত জেগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লামাকে পাহারা দিলেন। সারারাত তিনি তাঁবু গ্রহের চারপাশে টহল দেন। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপার কি আবু আইয়ূব। তিনি জবাব দিলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই মহিলার পক্ষ থেকে আপনা রওপর কোন বিপদ আস এই আশংকায় আমি পাহারা দিচ্ছিলাম। কেননা তার পিতা, স্বামী ও গোত্রের অন্যান্য লোকজনকে আপনি হত্যা করিয়েছেন। তাছাড়া সে সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই তার দিক থেকে আপনার ওপর বিপদের আশংকা করেছিলাম।” অনেকে বলেন: একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, আবু আইয়ূব যেভাবে সারারাত আমারহিফাজতে নিয়োজিত ছিল তেমনি আপনিও তাকে হিফাজত করুন।”

খাইবার থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রাবিরতি করেন। শেষ রাতে তিনি বললেন, “আমরা যাতে এখন ঘুমাতে পারি সেজন্য ফজরের সময় আমাদের ডেকে দেয়ার দায়িত্ব কে নিতে পারে?” বিলাল (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এ দায়িত্ব নিতে পারি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহগামী মুসলমানগণ যাত্রাবিরতি করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন্ রাতে বিলাল (রা) নামায পড়তে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ নামায পড়ার পর তিনি উটের গায়ে হেলান দিয়ে প্রভাত হবার প্রতীক্ষায় বসে রইলেন। এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম ও মুসলিম মুজাহিদগন যথাসময়ে ঘুম থেকে জাগতে সক্ষম হলেন না। তপ্ত রোদের পরশ লাগার সাথে সাথেই তাদের ঘুম ভাংলো। প্রথমেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম জেগে উঠলেন। উঠেই তিনি বিলালকে (রা) বললেন, “বিলাল, মুমি আজ এ কি করলে?” তিনি বললেন “হে আল্লাহর রাসূল, যে ঘুমে আপনাকে ধরেছিল সেই ঘুমের কাছে আমিও পরাভূত হয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো।” এরপর তিনি নিজের উট নিয়ে অল্প কিছুদুর এগিয়ে গেলেন। অতঃপর উট থামিয়ে তিনি অযু করলেন। সাহাবাগণও অযু করলেন। তারপর বিলালকে নামায শুরু করার জন্য ইকামাত দিতে বললেন। তিনি ইকামাত বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি সাহাবীদের দিকে ফিরে বললেন, “তোমরা কখনো নামায পড়েতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্রই পড়ে নেবে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, “আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম কর।”

খাইবার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম ইবনে লুকাইম আবাসীকে (রা) খাইবারের যাবতীয় মুরগী ও গ্রহপালিত প্রাণী পুষতে দিয়েছিলেন। সফর মাসে খাইবার বিজয় সম্পন্ন হয়। ইবনে লুকাইম খাইবার সম্পর্কে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যা নিম্নরুপঃ

“এক দুরুন্ত দুঃসাহসী সাদা বেশধারী সেনাদল পরিবেষ্টিত নবী কর্তৃক

নাতা আক্রান্ত হলো,

নাতাবাসী যখন ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো

এবং আসলাম ও গিফার গোত্রদ্বয়ও তার মাঝে বিছিন্ন হলো

তখন তারা নিশ্চিত হলো পরাজয় সম্পর্কে।

বনু আমর ইবনে জুরআর লোকেরা প্রভাতকালেই দেখতে পেল,

আশ্ শ্কা এর অধিবাসী দিনের বেলাতেই ঘোর অন্ধকারে পতিত হয়েছে।

তার সমগ্র সমভ’মি জুড়ে দৌড়ে গেছে ধ্বংস ও মৃত্যু।

প্রত্যুষে চিৎকারকারী মোরগগুলো ছাড়া কোন কিছুকেই তা অবশিষ্ট রাখেনি।

আর প্রতিটি দুর্গকে অধিকার করেছে আবদ্ আশহাল

কিংবা বনু নাজ্জারের আশ্বারোহীগণ।

[আশ আলহাল ও বনু নাজ্জার আনসারদের দুটো গোত্রের নাম।]

আর মুহাজির যারা শিরস্ত্রাণের ওপর দিয়ে তাদের কপালকে উন্মুক্ত করেছে-

যারা পালানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না।

আমি জানতাম, মুহাম্মদ অবশ্যই জয়লাভ করবে এবং

যুগ যুগ ধরে সেখানে অবস্থান করবে।

সেই দিনের চিৎকারে হুংকারে ইহুদীদের চোখে খুলে গেছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *