3 of 3

১১৪. তায়েফ যুদ্ধ: ৮ম হিজরী সন

বনু সাকীফের পরাজিত বাহিনী তায়েফে গিয়ে নগরীর দ্বার রুদ্ধ করে দেয় এবং পুনরায় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। উরওয়া ইবনে মাসউদ ও গাইলান ইবনে সালামা হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে অংশ নেননি। তারা জুরাশে ট্যাংক, কামান ও দবুর জাতীয় যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।

হুনাইনের বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরুলেন। এই অভিযান সম্পর্কে কা’ব ইবনে মালিক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। তার অর্থ হলো- “তিহামা ও খাইবার থেকে আমরা সকল সংশয় দূর করে তরবারীকে বিশ্রাম দিয়েছিলাম। তরবারীগুলোকে আমরা দাওস অথবা সাকীফের যে কোন একটি বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছিলাম। আর সেসব তরবারী যদি কতা বলতো তবে চূড়ান্ত কথাই বলমো। সে তরবারী যদি তোমরা তোমাদের বাসস্থানের আঙ্গিনায় দেখতে না পাও, তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের কেউ (তোমাদেরকে) রক্ষা করতে চাইলেও তার প্রতি আমি মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন হয়ো না। আমরা (তোমাদের) ঘরের ছাদগুলোকে ভেঙ্গে ওয়াজ্জের প্রান্তরে নিয়ে যাবো। ফলে তোমাদের ঘরবাড়ী বিরান হয়ে যাবে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে নাখলা ইয়ামনিয়াতে, তারপর কাব্নে, তারপর মুলাইহে, তারপর সেখান থেকে লিয়া এলাকার বুহরাতুর রুগাতে গিয়ে উপনীত হলেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়ে তাতে নামায পড়লেন। এরপর দাইকা নামক রাস্তা দিয়ে নাখাবে গিয়ে বনু সাকীফের এক ব্যক্তির জমির কাছে ‘ছাদেরা’ নামক কুল গাছের নীচে যাত্রাবিরতি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই লোকটির চরমপত্র দিলেন যে, “এই জায়গা খালি করে দিয়ে সরে যাও, নচেৎ আমরা তোমার দেয়াল ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবো।” লোকটি বেরিয়ে যেতে অস্বীকার করলে তিনি তার দেয়াল ভেঙ্গে দিলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার যাত্রা শুরু করলেন। তায়েফের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করে সৈন্যদের নিয়ে তাতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। এইখানে কতিপয় সাহাবী তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের সৈন্যরা তায়েফের দেয়ালের পাশেই অবস্থান নিয়েছিলেন, তাই নগরের ভেতর থেকে তায়েফবাসীদের নিক্ষিপ্ত তীর তাঁদের ওপর এসে পড়েছিল। তায়েফবাসীরা শহরের দরজা এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে, মুসলমানগণ তার ভেতরে ঢুকতে পারলো না। তীরবিদ্ধ হয়ে কতিপয় সাহাবী শাহাদত বরণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা বাহিনীকে নিয়ে নগরীর সেই স্থানে স্থাপন করলেন যেখানে আজ তায়েফের সমজিদ অবস্থিত। তিনি তায়েফবাসীকে অবরোধ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অভিযানে উম্মে সালামা (রা) সহ দুজন স্ত্রী সহগামিনী হয়েছিলেন। তাঁদের জন্য তিনি গম্বুজ আকৃতির দু’টি ঘর নির্মাণ করে দিলেন। সেই ঘরের মাঝে তিনি নামায আদায় করেন। অতঃপর তিনি সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। বনু সাকীফ ইসলাম গ্রহণ করলে আমর ইবনে উমাইয়া (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায পড়ার জায়গাফ মসজিদ তৈরী করেন। এই মর্মে জনশ্রুতি আছে যে, ঐ মসজিদে একটি যোদ্¦া দল থাকতো। প্রতিদিনই তাদের রণহুংকার ও তর্জন গর্জন শোনা যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফবাসীকে অবরোধ করে তীর ধনুক দ্বারা তুমুল যুদ্ধ করলেন। [৮৩. ইবনে হিশাম বলেছেন,, এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামান ব্যবহার করেন। তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে তিনি যে কামান ব্যবহার করেন সেটাই ইসলামের প্রথম কামান।]

তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য যে দিনটি নির্ধারিত করা হয়েছিল সে দিন সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবী একটি ট্যাংকের নীচে ঢুকলেন, অতঃপর তা নিয়ে তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য সংঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হলেন। বনু সাকীফ গোত্রের লোকরা তাদের ওপর আগুনে পোড়ানো লোহার শেল নিক্ষেপ করতে লাগলো। এতে সাহাবীগণ ট্যাংকের নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। আর যিনিই বের হন তিনিই সাকীফের তীরে বিদ্ধ হন। এভাবে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান শহীদ হন। এই পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাকীফের বাগান কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ তা কেটে ফেলতে শুরু করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সাকীফের অবরোধ চলাকলে একদিন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) কে বললেন, “হে আবু বাক্র, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমাকে এক পেয়ালা ঘি উপহার দেয়া হয়েছে। একটা মোরগ এসে ঠোকরাতে ঠোকরাতে পেয়ালার ঘি টুকু ফেলে দিল।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “আমার মনে হয়, আজ আপনি বনু সাকীফকে পরাজিত করতে পারবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার ধারণাও তাই।”

একদিন উসমান ইবনে মাযউনের স্ত্রী খুয়াইলা বিনতে হাকীম (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ যদি আপনাকে তায়েফবাসীর ওপর বিজয় দান করেন তাহলে বনু সাকীফের সবচেয়ে অলংকার সাজ্জিতা মহিলা বাদিয়া বিনতে গীলান অথবা ফারেগা বিনতে আকীলের অলংকার আমাকে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “আমাকে যদি বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি না দেওয়া হয় তা হলেও?” খুয়াইলা একথা শুনে চলে গেলেন এবং উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) কথাটা জানালেন। উমার (রা) তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, খুয়াইলা যে কথা আমাকে জানালো তা কি আপনি বলেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হ্যা’। উমার (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি কি আপনি পাননি?” তিনি বললেন, ‘না।’ উমার বললেন, “তাহলে কি আমি এখন মুসলমানদেরকে এ স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হাঁ।’ উমার (রা) তখন মুসরিম বাহিনীকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। যাত্রা শুরু হলে সাঈদ ইবনে উবাইদ আওরাজ দিলেন, “বনু সাকীফ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেলো।” উয়াইনা ইবনে হিসন বললেন, “হাঁ, আপন মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে (রয়ে গেলা)।” জনৈক সাহাবী বললেন, “হে উয়াইনা! মুশরিকরা আল্লাহর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করলো আর তমি তাদের প্রশংসা করছো? অথচ তুমি এসছো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে লড়াই করতে। ধিক্ তোমাকে।” তিনি বললেন, “আসলে আমি তোমদের পক্ষে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো সে জন্য আসিনি। আমি এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, মুহাম্মাদ তায়েফ জয় করলে আমি বনু সাকীফের একটা মেয়েকে হস্তগত করবো যাতে সেই মেয়রে গর্ভে আমার একটা পুত্র জন্ম নেয়। কারণ বনু সাকীফ অত্যন্ত তীক্ষè মেধার অধিকারী।”

অবরোধ চলাকালে তায়েফের কিছু সংখ্যক দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট আসে এবং ইসলাম গ্রহণ কলে। তিনি তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেন। পরবর্তী সময়ে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের কেউ কেউ ঐ দাসদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন করে। আবেদনকারীদের মধ্যে হারেস ইবনে কালদা চিলেন অন্যতম। তিনি তাদের ‘না’ সূচক জবাব দেন এবং বলেন, “ওরা আল্লাহর মুক্ত বান্দা। ওদেরকে আবার আমি দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে পারি না।”

মোট বারোজন সাহাবী তায়েফে শাহাদাত বরণ করেন। তন্মধ্যে সাতজন কুরাইশ, চারজন আনসার এবং একজন বনু লাইস গোত্রের।

যুদ্ধ ও অবরোধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ ত্যাগ করলে বুজাইর ইবনে যুহাইর তায়েফ ও হুনাইনের বর্ণনা দিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যার মর্ম হলো-

“হুনাইনের প্রান্তরে সমবেত হওয়ার দিনে, আওতাসে সমবেত হওয়ার প্রভাত কালে এবং বিদ্যুত চমকানের দিন শেষেক্তটি সম্ভবতঃ তায়েফ) তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। প্রতারণার মাধ্যমে হাওয়াযিন তার জনতাকে সমবেত করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নীড়ভ্রষ্ট শতধঅ বিভক্ত পাখীর মত হলো। আমাদের কোন অবস্থান গ্রহণকেই তারা বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। পেরেছে শুধু তাদের প্রাচীর ও খন্দকের ভেতরটা ঠেকিয়ে রাখতে। তায়েফবাসী যাতে বেরিয়ে আসে সেজন্য চেষ্ট করলাম, কিন্তু দরজা বন্ধ করে তারা তাদের ঘরে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকলো। তারা অনুতপ্ত হয়ে একদিন ফিরে যাবে সেই বিশালকায় বাহিনীর কাছে- যে বাহিনী মৃত্যুর দীপ্ত গৌরবে উদ্ভাসিত-যে বাহিনীর সমাবেশে সবুজ আভা পরিস্ফুট। (নাজাদের) হাযান পর্বতে যদি তাকে চালিত করা হয় তবে সে পর্বত নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যাবে। বনের সিংহরা কাঁটাযুক্ত ঘাসের ওপর দিয়ে যেভাবে চলে আমরা সেইভাবে চলি। যেন আমরা দ্রুতগামী ঘোড়া, যা চলার পথে কখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় আবার মিলিত হয়। সব রকমের যুদ্ধবর্মই আমরা পরে থাকি। এসব বর্মই আমাদের দুর্গের কাজ করে- যেমন অগভীর কুয়ার ভেতরে পুঞ্জিভূত বাতাস বেরিয়ে গেলে তা দুর্গের মত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্মগুলো এত দীর্ঘ যে তা আমাদের জুতা স্পর্শ করে এবং তা দাউদ (আ) এবং হীরার বাদশাহ আমর ইবনে হিন্দের তৈরী বর্মের মত সুনির্মিত।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *