3 of 3

১১৮. তাবুক যুদ্ধ

এরপর যুলহাজ্জ থেকে রযব মাস পযন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করেন এবং পরে মুসলমানগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুত হতে বলেন। যুহরী, ইয়াযীদ ইবনে রোমান, আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র, আসেম ইবনে জামর প্রমুখ ঐতিহাসিক তাবুক অভিযানের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। সে সময় মুসলমানদের জন্য সময় ছিল অত্যন্ত কঠিন। একদিকে ছিল গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপ। অন্যদিকে দেশে চলছিল দুর্ভিক্ষ। যাদের কিছু ফল জন্মেছে তা একেবারে পেকে গিয়েছিল। লোকেরা তাদের ফল সংগ্রহ করা এবং ছায়াশীতল জায়গায় অবস্থান করার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করছিল। ঠিক এমন সময় বাইরে যাওয়া কারো মনঃপূত ছিল না। অধিকাংশ অীভযানে যাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সামান্য কছিু আভাস ইংগিত দিতেন। জানিয়ে দিতেন যে, যেদিকে রওয়ানা হচ্ছি আসল গন্তব্য তা থেকে আলাদ। কিন্তু তাবুক অভিযানের বেলায় সর্ম্পূর্ণ ভিন্ন রকম ব্যাপার ঘটলো। এক্ষেত্রে গন্তব্যস্থলের কথা সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিলেন। কেননা গন্তব্যস্থান ছিল অনেক দূরের, সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক এবং শত্রুর সংখ্যাধিক্যও ছিল গুরুতর পর্যায়ের। তাই লোকেরা যাতে অভিযানের জন্য যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে সেজন্য আগেভাগে তিনি সবকিছুই জানিয়ে দিলেন। তিনি মুসলমানগণকে প্রস্তুত হতে বললেন এবং জানালেন যে, এবার মুকাবিলা রোম সম্রাটের সাতে। এই প্রস্তুতি চলাকালে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সালামা গোত্রের জাদ্দ ইবনে কায়েসকে বললেন, “হে জাদ্দ, এ বছর রোমানদের সাথে লড়তে তুমি কি প্রস্তুত?” সে বললো, “হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে (পাপের) ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করার চাইতে আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দেবেন কি? আল্লাহর কসম, আমার গোত্রের লোকেরা জানে যে, আমি নারীদের প্রতি যতখানি দুর্বল, অতটা খুব কম লোকই আছে। রোমান মেয়েদের দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না বলে আমার আশংকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে আর মাথা ঘামালেন না। তিনি বললেন, “তোমাকে অনুমতি দিলাম।” জাদ্দ ইবনে কায়েস সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল হয়-

[আরবী ********]

“তাদের মধ্যে কেই কেউ বলে, ‘আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দিন, ফিতনার মধ্যে ফেবেন না।’ জেনে রেখো, তারা ফিতানার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েই আছে। জাহান্নাম নাফরমানদের ঘেরাও করেই রেখেছে।” অর্থাৎ সে রোমান নারীদের প্রতি আসক্ত হবার আশংকা বোধ করেছিল। আসলে সে আশংকা তার ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে না গিয়ে এবং নিজের স্বার্থকে অগ্রধিকার দিয়ে সে বরং আরো বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে। তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম।

মুনাফিকরা একে অপরকে বললো, “এত প্রচন্ড গরমে তোরা সফরে যেও না।” তারা এভাবে জিহাদ থেকে ফিরে থাকতে সচেষ্ট ছিল ও সত্যের পথে দ্বিধা-সংশয়ে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সম্পর্কে নাযিল করলেন-

“তারা বললো, গরমের মধ্যে সফরে যেও না। (হে নবী) তুমি বলে দাও, দোযখের আগুন সর্বাধিক গরম। তারা যদি তা বুঝতো (তাহলে এমন কথা বলতো না) অতএব তারা যেন কম হাসে এবং বেশী কাদে। তাদের অপকর্মের শাস্তি তাদের পেতেই হবে।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের আয়েঅজন চালাতে লাগলেন এবং মুসলিম জনগণকে দ্রুত গ্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বললেন। বিত্তবান মুসলমানগণকে তিনি সওয়ারীর পশু, টাকা-পয়সা ও রসদপত্র ইত্যাদি দিয়ে আল্লাহর পথে সাহায্য করতে উৎসাহিত করতে লাগলেন। ধনী মুসলমানগণ অনেক সাহায্য দিলেন এবং আল্লঅহর সুন্তুষ্টিকেই তারা যথেষ্ট মনে করতে লাগলেন। উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আন্হু এই সময় সকলের চাইতে বেশী দান করেন। [৮৬. ইবনে হিশাম বলেছেন, তাবুক অভিযাত্রী অভাব পীড়িত মুসলিম জন্য তিনি এক হাজার দিনার দান করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত খুশী হন যে, তিনি দোয়া করেন, “হে আল্লাহ! তুমি উসমানের ওপর সন্তুষ্ট হও। আমি তার ওপর সন্তুষ্ট।”]

আনসার ও অন্যান্যদের মধ্য থেকে সাতজন মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে সওয়ারী জানোয়ার চাইলেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সওয়ারীর বাহন সরবরাহ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ফলে তারা জিহাদে যেতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যান। ইতিহাসে এরা ‘বাকাউন’ অর্থাৎ ক্রন্দনকারী নামে পরিচিত। এরা হলেন: বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সালেম ইবনে উমাইর, বনু হারেসার উলবা ইবনে যায়িদ, বনু মাজেনের আবু লায়লা আবদুর রহমান, বনু সালমার আমর ইবনে হুমাম ও আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল মুযানী। কেউ কেউ বলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর, বনু ওয়াফেকের হারমী ইবনে আবদুল্লাহ এবং বুন ফাজারার ইরবাদ ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহ আনহুম।

বর্ণিত আছে যে, এদের মধ্যে দু’জন আবু লায়লা আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহ বিন মুগাফফালকে কাঁদতে দেখে ইবনে ইয়ামীন ইবনে উমাইর জিজ্ঞেস করেন, “ তোমরা কাঁদছ কেন?” তারা বললেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েছিলাম তাবুক অভিযানে যাওয়ার জন্য সওয়ারী চাইতে। কিন্তু তিনি দিতে পারেননি। আমাদের কাছেও এমন কিছু নেই যা দ্বারা তাঁর সাথে অভিযানে যেতে পারি।” তখন ইবনে ইয়ামীন তাদেরকে একটা উট এবং কিছু খোরমা দিলেন। তাঁরা ঐ সওয়ারীতে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অভিযানে চলে গেলেন। বেদুইন মুসলমানদের একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে নানা রকম ওপর পেশ করে এবং অভিযানে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাদেরকে অনুমতি দেননি। কারো কারো মতে তারা ছিল বনু গিফার গোত্রের লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সফর শুরু হলো। কিছুসংখ্যক নিষ্ঠাবান ও খালিছ মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অীভযানে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। তাদের ঈমান সম্পর্কে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। কেবল সংকল্পের দৃঢ়তা দেখাতে না পারাই ছিল তাদের পিছিয়ে থাকার কারণ। মদীনার উপকণ্ঠে অবস্থিত পার্বত্য পথ সানিয়াতুল ওয়াদাতে তিনি সেনাবাহিনী চালিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার অধীনস্থ লোকদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে সানিয়াতুল ওয়াদা’র নীচ দিয়ে যে পথ জুবাব পর্বতের দিকে গিয়েছে সেই পথে চালিত করলো। অনেকের মতে, এই বাহিনেিত বিপুল সংখ্যক লোক ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার সহযাত্রী মুনাফিক ও সংশয়বাদীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর পরিবার-পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্য রেখে গেলেন। তাঁকে তিনি পরিবার-পরিজনের সাথে থাকতে বললেন। মুনাফিকরা তাঁকে কেন্দ্র করে নানা রকমের অপবাদ রটনা করলো। তারা বলতে লাগলো যে, আলীকে অলস মনে করে তার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে রেখে গিয়েছেন। মুনাফিকদের এইসব কথা শুনে আলী (রা) অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলেন। তিনি তখন মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে জুরফ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন- যেখানে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও মদীনার আরো অনেকের জমিজমা ছিল। আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, মুনাফিকরা মনে করেছে যে, আপনি আমাকে অলস মনে করে আমার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য রেখে এসেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, “তারা মিথ্যা বলেছে। আমি তোমাকে আমার ও তোমার পরিবা-পরিজনের দেখাশুনার জন্য রেখে এসেছি। হে আলী! মূসা (আ) হারুন (আ) কে যে পর্যায়ে রেখেছিলেন তোমাকে যদি আমি সেই পর্যায়ে রাখি তাহলে তুমি কি খুশী নও? কেননা আমার পরে আর কেউ নবী হবে না।” একথা শোনার পর আলী (রা) মদীনায় ফিরে গেলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানেব রওনা হয়ে গেলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী তাবুক অভিযানে রওনা হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর আবু খাইসামা (রা) তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে এলেন। দেখলেন, তাঁর দুই স্ত্রী বাগানের ভেতরে নিজ নিজ তাঁবুতে অবস্থান করছে। উভয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা করে রেখেছে। তিনি এসে তাঁবুর দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তার দুই স্ত্রীর প্রতি নজর দিলেন এবং তাঁর আরাম-আয়েশের জন্য তারা যে ব্যবস্থা করে রেখেছে তাও দেখলেন। তখন সংগতভাবে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোদ, বাতাস ও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন আর আবু খাইসামা কিনা ঠান্ডা ছায়ার সুন্দরী নারীর সাহচর্যে নিজ ভুমি ও সহায়-সম্পদের ভেতরে বসে তৈরী খাদ্য খাবে? এটা কখনো ঠিক হবে না। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের কারো তাঁবুতে ঢুকবো না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে জিহাদী সাজে সজ্জিত করে দাও।” তারা তাঁর সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁর উট এগিয়ে দেয়া হলো। আবু খাইসামা রওয়ানা হলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে দ্রুত ছুটলেন। তিনি তাঁবুতে অবস্থান নেওয়ার পর আবু খাইসামা সেখানে উপনীত হলেন। পথিমধ্যে অপর এক সাহাবা উমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহী আবু খাইসামার সঙ্গী হলেন। তিনিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানে অংশগ্রহন করতে যাচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়ে যখন তাবুকের কাছাকাছি হয়েছেন তখন আবু খাইসামা উমাইরকে বললেন, “আমি একটা গুনাহ করে ফেলেছি। কাজেই তুমি একটু আমার পেছনে পড়লে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। আমাকে আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে পৌছতে দাও।”

তাবুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছাকাছি পৌছলে সাহাবীগণ তাঁকে দেখে বললেন, “একজন উষ্ট্রচালক এদিকে এগিয়ে আসছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সম্ভবতঃ আবু খাইসামা।” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু খাইসামাই তো।” কাছে এসে উট থেকে নেমে আবু খাইসামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানিয়ে তাঁর কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু খাইসামা, তুমি উপযুক্ত কাজই করেছো।” [৮৭. মূল শব্দটি হলো [আরবী ***] (আওলা লাকা) পবিত্র কুরআনে কয়েক জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে তাফসীরকারগণের কেউ কেউ এর এরূপ অর্থও করেছেন, ‘তুমি ধ্বংসের নিকটবর্তী হয়েছিলে।’ তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ প্রথম অর্থটাই প্রযোজ্য। অর্থাৎ ‘তুমি তোমার উপযুক্ত কাজই করেছ।’] অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মোবারকবাদ দিলেন ও তাঁর জন্য দোয়া করলেন।

তাবুক যাওয়ার পথে সমৃদ্ধ জাতির বাসস্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম সেখানে স্বল্প যাত্রাবিরতি করেন। কোন কোন সাহাবী সেখানকার কূয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাবধান করে দেন যে, এখানকার পানি কেউ পান করো না এবং তা দিয়ে অযু করো না। এখঅনকার পানি দিয়ে কেউ আটা বানিয়ে থাকলে তা ঘোড়াকে খেতে দাও তোমরা খেয়ো না। রাতে এখঅনে কেউ একাকী বের হয়ো না। প্রায় সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মেনে চললেন। কেবল বনু সায়েদা গোত্রের দুইজন একাকী রাতে বের হয়েছিলেন। একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এবং অপরজন তার হারানো উটের সন্ধানে। যিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন তিনি যে স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন সেখানেই বেহুঁশ হয়ে গেলেন। আর যিনি উটের সন্ধানে বেরুলেন তিনি প্রবল বাতাসে উড়ে গিয়ে ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যাপারটা জানানো হলে তিনি বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে একাকী বেরুতে নিষেধ করিনি?” অতঃপর যে ব্যক্তি পায়খানা করতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দোয়া করলেন এতে তিনি সুস্থ হয়ে উছলেন। আর যিনি ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তাকে তাই গোত্রের লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা ফিরে যাওয়ার পর তাঁর কাছে পৌছিয়ে দেন।

পরদিন সকালে দেখা গেল, কাফিলায় কারো কাছে এক ফোটা পানিও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ একখন্ড মেঘ পাঠিয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন এবং তাতে সকলের প্রয়েঅজন পূর্ণ হলো। সবাই পরবর্তী সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করেও রাখলেন।

তাবুক যাওয়ার পথে আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উট হারিয়ে গেল। সাহাবীগণ উট খুঁজতে বেরুলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উমার ইবনে হাযম নামে আকাবার বাইয়াতে ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী জনৈক সাবাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন বনু আমরের বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তি। তাঁর দলে ভেতরে যায়িদ ইবনে লুছাইত নামক বনু কাইনুকা গোত্রের জনৈক মুনাফিক ছিল।

উমারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত থাকাবাস্থায় তাঁর দলবলের কাছে বসে উক্ত যায়িদ ইবনে লুছাইত বললো, “আচ্ছা, মুহাম্মাদ তো দাবী করেন যে, তিনি নবী এবং তিনি তোমাদেরকে আকাশের খবর জানা। তিনি এতটুকু জানেন না যে, তাঁর উট কোথায়? ঠিক সেই মুর্হুতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারার (রা) উপস্থিতিতেই বললেন, “একজন লোক বলছে যে, মুহাম্মাদ নিজেকে নবী বলে দাবী করে থাকেন এবং তোমাদেরকে আসমানের খবরাদি জানা, তিনি কেন তাঁর উট কোথায় তা জানেন না? আল্লাহর কসম, আল্লাহ যেটুকু আমাকে জানিয়েছেন সেইটুকু ছাড়া আমি কিছুই জানি না। আল্লাহ আমাকে উটের সন্ধান দিয়েছেন। এই উপত্যকার ভেতরেই তা অমুক জায়গায় রয়েছে। একটি গাছের সাথে তার লাগাম আটকে গেছে। তোমরা গিয়ে উটটাকে নিয়ে এস।” সাহাবীগণ গিয়ে উট ধরে আনলেন। অতঃপর উমারা (রা) তাঁর দলবলের কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইমাত্র আমাদের কাছে এক বিস্ময়কর খবর জানালেন। আমাদের বাহিনীর মধ্যে কে নাকি এরূপ কথা বলেছে এবং আল্লা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন।” এই বলে তিনি যায়িদ ইবনে লুছাইতের কথঅ বলেছে ব্যক্ত করলেন। তখন উমারার (রা) দলের একজন যিনি দলের অভ্যন্তরেই ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট যাননি- বললেন, “আল্লাহর কসম, যায়িদই এ কথা বলেছে।” তখন উমারা (রা) যায়িদের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ঘাড়ে আঘঅত করে বললেন, “হে আল্লাহর বান্দারা, আমার কাছে এস। আমার কাফিলায় একটা সাপ লুকিয়ে আছে, আমি তা জানতেও পারিনি। হে আল্লাহর দুশমন, বেরিয়ে যা আমার কাফিলা থেকে। আমার সাথে আর থাকিস না।”

বর্ণিত আছে যে, এরপর যায়িদ তাওবাহ করেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মৃত্যুকাল পর্যন্তই যায়িদ মুনাফেকী অব্যাহত রাখঅর দায়ে অভিযুক্ত ছিল।

যাত্রাপথে মাঝে মাঝে দুই একজন মুসরিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যাচ্ছিল। মুসলমানগণ এ ধরনের কোন লোকের ফিরে যাওয়ার কথা জানালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, “যেতে দাও। যদি তার মধ্যে সত্যপ্রীতি থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ আবার তাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। অন্যথায় আল্লাহ তার সাহচর্য থেকে তোমাদেরকে অব্যাহতি দিলেন। ভালই হলো।” এক সময় বলা হলো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু যারও পিছিয়ে গেছে। তাঁর উট তাকে পিছিয়ে দিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পিছিয়ে যায় তো যাক। যদি তার মধ্যে কল্যাণ থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে তোমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে মনে করবে আল্লাহ তোমাদেরকে তার হাত থেকে রেহাই গিয়েছেন।: আবু যার (রা) তাঁর উটকে দ্রুত চালানের অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হলো না। অগত্যা তিনি নিজের সাজ-সরঞ্জাম ও রসদপত্র ঘাড়ে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদানুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় এসে যাত্রাবিরতি করলে তিনি তাঁর সাথে এসে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে একাকী হেঁটে আসতে দেখে বললেন, “আল্লাহ আবু যারের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। সে একাই চলে, একাই মরবে এবং পুনরায় একাই আল্লাহর সামনে হাজির হবে।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, উসমান (রা) তাঁর খিলাফাতকালে যখন আবু যারকে (রা) রাবয়াতে নির্বাসিত করেন তখন সেখানে তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রী ও ভৃত্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি তাঁদেরকে এই বলে অছীয়ত করেন যে “আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে গোসল ও কাফন দিয়ে রাস্তার ওপর রেখে দিও। অতঃপর সর্বপ্রথম যে কাফিলা তোমাদের কাছ দিয়ে যাবে, তাকে বলবে, এই লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার। তাঁকে দাফন করতে তোমরা আমাদের সাহায্য কর।” মৃত্যুর পরে স্ত্রী ও ভৃত্য অছীয়ত মুতাবিক কাজ কররেন এবং তাঁর লাশ রাস্তার ওপর রেখে দিলেন। এই সময় ইরাক থেকে একদল উমরাহ যাত্রীর সাথে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যাচ্ছিলেন। দলটি রাস্তার ওপর পড়ে থাকা লাশটি দেখে থমকে দাঁড়ালো। অল্পের জন্য তা দলের উটের পাদতলে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। ভৃত্যটি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার (রা)। তাঁকে দাফন করতে আমাদেরকে সাহায্য করুন।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন, তুমি একই চল, একাই মরবে এবং একাই পুররুজ্জীবিত হবে।” অতঃপর তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা নেমে তাঁকে দাফন করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক পৌছলে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রোবা তাঁর কাছে হাজির হয়ে জিযিয়া দিয়ে সন্ধি করলো। অনুরুপভাবে জাবরা আজরুহর অধিবাসীরাও এসে জিযিা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিম্নরুপ সন্ধিপত্র লিখে দিলেনঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের তারফ থেকে ইউহান্না ইবনে রোবা ও আয়ালাবাসীর জন্য এবং তাদের সকল নৌ ও স্থল যানসমূহের জন্য নিরাপত্তা ঘোষনা করা যাচ্ছে। তাদের জন এবং তাদের সহযোগী সিরিয়া, ইয়ামান ও সাগররবাসীর নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর রাসূল পূর্ণ দয়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যদি কেউ এই সন্থির বরখেলাফ কিছু করে তবে সে তার অর্থবিত্ত বলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারবে না। যে যার ক্ষতি সাধন করবে, তার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। তারা যে কোন জলাশয়ের পানি ব্যবহার করতে পারবে এবং যে কোন নৌ ও স্থল পথে চলাচল করতে পারবে। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *