3 of 3

১১৭. তায়েফ ত্যাগের পর কা’ব ইবনে যুহাইরের ইসলাম গ্রহণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর বুজাইর ইবনে যুহাইর তার ভাই স্বনির্বাচিত বিশিষ্ট কবি কা’ব ইবনে যুহাইরকে চিঠি মারফত জানায় যে, “মক্কায় যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করতো তাদের অনেককে তিনি হত্যা করেছেন। কুরাইশ কবিদের মধ্যে ইবনে যাবয়ারী ও হুবাইরা প্রমুখ পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। তুমি যদি বাঁচতে চাও তবে কালবিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হও। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে ও তাওবাহ করে তাঁর কাছে আসে তিনি তাঁকে হত্যা করেন না। আর যদি তা না কর তবে দুনিয়ার যেখানে নিরাপদ মনে কর সেখানে গিয়ে আশ্রয় নাও।”

ইতিপূর্বে কা’ব এক কবিতায় বলেছিল,

“বুজাইয়ের কাছে আমার এই বার্তা পৌছিয়ে দাও, আমি যা বলেছি তা গ্রহণ করতে কি তোমার প্রবৃত্তি হয়. আর যদি তা গ্রহণ না কর তাহলে আমাকে আনাও, অন্য কোন্ জিনিসের প্রতি তুমি আগ্রহী? তুমি সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা আমি তাঁর পিতামাতার মধ্যে দেখিনি (অর্থাৎ মুহাম্মাদের) এবং তুমি তোমার পিতামাতার মধ্যেও দেখনি? আমার কথা যদি ুতমি গ্রহণ না করা তাহলে আমি দুঃখ করবো না এবং তুমি ভুল করে ক্ষতিপ্রস্ত হলেও আর শুধরে দেব না। বিশ্বস্ত মানুষটি তোমকে সেই বিশেষ স্বভাব চরিত্র গড়ার উদ্দেশ্যে নতুন পানীয় পান করিয়েছে।”

কা’ব এই কবিতাটি বুজাইরের নিকট পাঠায় এবং বুজাইর তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে পড়ে শোনায়। তিনি যখন শুনলেন, “বিশ্বস্ত মানুষটি তোমাকে নতুন পানীয় পান করিয়েছে” তখন বলনে, “কা’ব মিথ্যাবাদী হলেও এ কথাটা সত্য বলেছে। আমিই সেই বিশ্বস্ত মানুষ।”

পুনরায় যখন আবৃত্তি করা হলো, “(তুমি কি) সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা তার মাতাপিতার মধ্যে তুমি দেখনি” তখন রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হাঁ, সে তার পিতামাতার মধ্যে এ চরিত্র দেখেনি।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ বুজাইরের চিঠি পেয়ে কা’ব চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। প্রাণের ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। তার আশেপাশে তার শত্রুভাবাপন্ন যারা ছিল তারা তাকে আরো ভীত এবং সন্ত্রস্ত করার জন্য বলতে লাগলো,!“কা’বের মরণ আসন্ন।” অনন্যোপায় হয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের প্রশংসা করে একটা কবিতা লিখলো। এই কবিতায় সে তার নিজের ভীতি এবং তার শত্রুদের কর্তৃক তাকে সন্ত্রস্ত করার কথা উল্লেখ করলো। অতঃপর সে মদীনায় চলে গেল। সেখানে তার পূর্ব পরিচিত জুহাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে গিয়ে উঠলো। অতঃপর সে ব্যক্তি কা’বকে নিয়ে ফজরের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের নিকট চলে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাতে নামায পড়লো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ইংগিত করে কা’বকে বললো,, “তিনিই রাসূলুল্লাহ। তুমি তাছর কাছে গিয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনা কর।” কা’ব তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ্অলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁকে চিনতেন না। কা’ব বললো, “ ইয়া রাসূলুল্লাহ, কা’ব ইবনে যুহাইর তাওবাহ করে মুসলমান হয়ে আপনার কাছে হাজির করি তাহলে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হঁ^া।” তখন সে বললে “ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমিই কা’ব ইবনে যুহাইর।” এই সময় জনৈক আনসার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমাকে অনুমতি দিন, আল্লাহর এই দুশমনকে হত্যা করি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে ছেড়ে দাও। সে তাওবাহ করে এবং শিরক ত্যাগ করে এসেছে।” ঐ আনসারীর ব্যবহারে কা’ব সমগ্র আনসারদের প্রতি রাগান্বিত হয়। অবশ্য মুহাজিরগণ তাকে কোন অপ্রীতিকর কথা বলেননি। সে একটি কবিতা লেভে। কবিতাটি এরূপ –

“ (আমার স্ত্রী) সুয়াদ আমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে আমার মন ভেঙ্গে গেছে। আমি আজ অপমানিত এবং শৃংখলিত। তার পদানুসরণ করায় আমার কোন ণাল হয়নি। …. শুনেছি, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। তথাপি, আমি আল্লাহর রাসূলের ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি। একটু সবুর করুন! যে আল্লাহ আপনাকে উপদেশ সমৃদ্ধ কুরআনের ঐশ্বর্য দান করেছেন তিনি যেন আপনাকে ন্যায়পথে পরিচালনা করেন। কুচক্রীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন না। যদিও আমি বেফাঁস কথা অনেক বলে থাকি, কিন্তু আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি আজ এমন (নাজুক) অবস্থানে আছি সেখানে বসে যা যা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি তা শুনলে হাতিও আতংকে অস্থির হয়ে যেত। অবশ্য তাকে আল্লাহর রাসূল যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে নিরাপত্তা দেন তাহলে আলাদা কথা। এ যাবত আমি রাতের আঁধারে ঊষর মরুপ্রান্তর দিয়ে ঘুড়ে বিড়িয়েছি। অবশেষে আমি আমার হাত দিয়েছি সেই ব্যক্তির হাতে যিনি প্রতিশোধ নিতে সক্ষম এবং যার কথা একমাত্র হক কথা। সে হাত আমি আর ফিরিয়ে আনবো না। বস্তুতঃ আমি যখন তাঁর সাথে কথা বলি এবং যখন আমাকে বলা হলো, ‘তুমি অভিযুক্ত ও (বহু অঘটনের জন্য) দায়ী’, তখন তিনি আামার কাছে ‘ইশরে’র নিবিড় অরণ্যের সিংহের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন- যে সিংহ অন্য দুটি সিংহকে মানুষের গোশত খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে, একটি পর্বতের চূড়ায় দিকে যখন সে লাফ দেয় তখন সেই চূড়া জয় না করে সে ছাড়ে না, ‘জাও’ অঞ্চলের বন্য হিং¯্র জন্তুগুলো তার ভয়ে পালায় এবং মানুষেরা দল বেঁধেও তার এলাকায় চলাফেরা করার সাহস পায় না। তার এলাকায় শুধু এমন লোকই যেতে পারে যে নির্ভরযোগ্য এবং সে রক্তাক্ত অস্ত্র ও পুরনো ছেড়া পোশাকে চলতে পারে। নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য পথের দিশারী এক উজ্জ্বল জ্যোতি এবং আল্লাহর এক অপরাজেয় তরবারী। কুরাইশদের একদল লোক যখন মক্কায় তার প্রতি ঈমান আনলো, তখন তাদের কেউ কেউ মু’মিনদের বললো, ‘দূর হয়ে যাও।’ তারা দুল হয়ে গেল বটে। তবে তারা (কুরাইশরা) সেই সমস্ত বীরদের মুকাবিলায় নিরস্ত্র ও অসহায় গয়ে গেল-যারা যুদ্ধের সময় অটুট সুদীর্ঘ সাদা বর্ম পরিধান করে থঅকে- যারা বিজয়ী হলেও উল্লঅসে ফেটে পড়ে না। (কেননা সেটা তাদের অভ্যঅসগত) আর পরাজিত হলেও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে না। (কেননা তারা জানে জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে এবং পরবর্তীতে তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী) তারা শ্বেতকায় উটের মত স্থির শান্ত পদক্ষেপে চলে, কালেঅ খাটো লোকগুলো যখন তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যায় তখন তারা যুদ্ধ করেই আত্মরক্ষা কলে। আঘাত পড়লে তাদের বুকেই পড়ে। (পিঠে পড়ে না) কেননা তারা মৃত্যুর ভয়ে পালায় না। (বরং সামনে এগিয়ে যায় এবং শত্রুর আঘাতকে বুক পেতে গ্রহণ করে ও প্রতিরোধ করে)।”

আসেম বিন উমার ইবনে কাতাহাদ থেকে বর্ণিত। কা’ব যখন বললো, “কালো খাটো লোকগুলো যখন পালিয়ে যায়” তখন তার ওপর আসসারগণ রেগে যান। কেননা এ কথঅটা সে আমাদের আনসারদের উদ্দেশ্যেই বলেছিল। কারণ আমাদের একজন তার সাথে দুর্ব্যহার করেছিল। পরে আনসারদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সে আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও কুরবানী এবং তাঁর দক্ষিণ হস্তের ভুমিকা পালনের প্রশংসা করে।

সে কবিতাটি এই-

“যে ব্যক্তি জীবনকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করতে চায় সে যেন পুণ্যবান আনসারদের সঙ্গ ত্যাগ না করে। মহত্ত্ব ও মহানুভবতা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার। তাই তারা হলেন শ্রেষ্ঠ মানবদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কেবল বর্ম দিয়ে তীর বর্শাকে বলে আনেন। তাদের বর্মগুলো বর্শার মতই- কোন অংশে তা থেকে কম নয়। আগুনের অংগারের মত লাল ও তীক্ষèদৃষ্টি চোখ দিয়ে তারা তাকান। যুদ্ধের সম্মুখীন হলে মৃত্যুর জন্য তারা আপন প্রাণ নবীর হাতে সঁপে দেন। মু’মিনদের ধর্মকে তারা উত্তোলিত তরবারী ও বর্শা দিয়ে রক্ষা করেন। কাফিরদের রক্ত দিয়ে তারা পবিত্রতা লাভ করেন এবং একে তারা পুণ্যব্রত বলে বিবেচনা করেন। খিফয়ার গভীর অরণ্যে ঘাড়মোটা শিকারী সিংহেরা যেমন যুদ্ধের অনুশীলন করে তারাও তেমনি রণদক্ষতা রপ্ত করেন। তারা যখন হামলাকরীর প্রতিরোধ করেন তখন তাকে সম্পূর্নরুপে থামিয়ে দেন। আলী ইবনে মাসউদ মাজেন গাছছানীকে তারা বদরের যুদ্ধে এমন আঘাত করেন যে, সমগ্র বনু নিযার তাতে শায়েস্ত হয় ও বশ্যতা স্বীকার কলে। সকল গোত্র যদি আনসারদের সম্পর্কে আমার যা জানা আছে তা জানতো তাহলে আমার চরম বিরোধী যারা তারাও ব্যাপারটা স্বীকার করতো। তারা এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা চরম দুর্ভিক্ষের সময়ও রাত্রিকালে আগত অীতথিদের প্রতি বদান্যতা প্রদর্শন করে। তারা গাছছানের এমন এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক, যাদের আভিজাত্যে কোন ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না।”

নিজের স্ত্রী সুরাদ সম্পর্কিত কবিতাটি আবৃত্তি করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ কবিতায় তোমার আনসারদের প্রশংসা করা উচিত ছিল। কেননা তারা তার উপযুক্ত বটে।” তখন কা’ব এই শেষোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন। ইবনে হিশাম আরো বলেছেন যে, কা’ব তার স্ত্রী সায়াদকে নিয়ে শুরু করা কবিতাটি মসজিদে নববীতে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়ে শুনিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *