3 of 3

১২২. বনু তামীমের প্রতিনিধিদলের আগমন ও সূরা হুজুরাত নাযিল

আরব গোত্রসমূহ থেকে প্রতিনিধিদল আগমন শুরু হলে সর্বাগ্রে উতারিদ বিন হাকেব তামিমীর নেতৃত্বে বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই দলে বনু তামীমের নেতৃস্থানীয় লোকজনও ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আকরা ইবনে হারেস, বনু মা’দের যাবারকান ইবনে বদর ও আমর ইবনে আহতাম এবং হাবহাব ইবনে ইয়াযীদ। এছাড়া নুয়াইম ইবনে ইয়াযীদ, কায়েস ইবনে হারেস, কায়েস ইবনে আসেম ও উযাইনা ইবনে হিসনও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইতিপূর্বে মক্কা বিজয় এবং হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে আকরা ইবনে হারেস ও উয়াইরা ইবনে হিসন অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা দু’জন বনু তামীমের প্রতিনিধিদলেও যোগ দেন। বনু তামীমের এই প্রতিনিধিদল মসজিদে নববীর কাছে এসে বাড়ীর বাইরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উচ্চস্বরে এই বলে ডকতে শুরু করে, “হে মুহাম্মাদ! বেরিয়ে আসুন এবং আমাদের সাতে দেখা করুন।” তাদের এই চিৎকার ও হাঁকডাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কষ্টকর হলো। তারা বললো, “আমরা এসেছি আপনার কাচে আমাদের গৌরবোজ্জল বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে। তাই আমাদের প্রধান বক্তা ও কবিকে কথা বলার অনুমতি দিন।” তিনি অনুমতি দিলেন। তখন উতারিদ ইবনে হাজ্জেব বলতে লাগলো, “সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি আমাদের ওপর অশেষ অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং একমাত্র তিনিই এর ক্ষমতা রাখেন। যিনি আমাদেরকে বাদশাহ বানিয়েছেন এবং আমাদেরকে বিপুল ধন সম্পদে ও ঐশ্বর্য্যে সমৃদ্ধ করেছেন। যার দ্বারা আমরা বদান্যতার পরিচয় দিয়ে থাকি। যিনি আমাদেরকে সমগ্র প্রাচ্যবাসীর মধ্যে সর্বাধিক জনবল ও ধনবলের অধিকারী করেছেন। আমাদের সমকক্ষ আর কেউ আছে কি? আমরাই কি তাদের নেতা এবং সবচেযে অভিজাত নই? আভিজাত্য ও কৌলিন্যে যে আমাদের সমকক্ষতার দাবী করে সে নিজ শেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিক। আমরা ইচ্ছা করলে আরো অনেক কিছু বলতে পারি কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত নিয়ে বেশী বাগাড়ম্বর করতে আমরা লজ্জাবোধ কলি। আমাদের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা সুপরিচিত। আপনাদেরকে আমাদের মত আত্মপরিচয়মূলক বক্তব্য পেশ করা এবং আরো ভালো বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দানের জন্যই এসব কথা বললাম।”

এ পর্যন্ত বলেই উতারিদ বসলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবিত ইবনে সায়েসকে (রা) বললেন, “ওঠো এবং তার ভাষনের জবাব দাও।”

সাবিত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

“সেই মহান আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা, আসমান ও যমীনে তাঁর ইচ্ছা কার্যকর করেছেন, তাঁর জ্ঞানের পরিধি তাঁর কর্তৃত্বের পরিমন্ডল জুড়ে পরিব্যাপ্ত। তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া কখনো কোন জিনিষের উদ্ভব ও আবির্ভাব ঘটে না, আমাদের মধ্যে রাজা বাদশাহর আবির্ভাব তাঁরই অনুগ্রহের ফল। আপন অনুগ্রহের বশেই তিনি আপন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠতম বংশীয়, আভিজাত্যে ও অতুলনীয় সাত্যবাদিতার গুণে ভূষিত ব্যক্তিকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। অতঃপর তাঁর ওপর স্বীয় গ্রন্থ নাযিল করেছেন, তাঁকে সমগ্র মানব জাতির তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেছেন, একমাত্র তিনিই সমগ্র বিশ্বজগতের মধ্যে আল্লাহ মনোনীত ব্যক্তিরূপে গণ্য হয়েছেন। অতঃপর মানুষকে তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছেন, ফলে তাঁর স্বগোত্র ও আপনজনের মধ্র থেকে মুহাজিরগণ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেছেন- যারা সবার চাইতে কুলীন, সবার চাইতে সম্ভ্রান্ত ও মর্যাাদাশীল, সবার চাইতে সৎকর্মশীল। যারা সর্বপ্রথম রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ করেছিল তারা আমরাই। সুতরাং আমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ সাহায্যকারী এবং তাঁর রাসূলের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী। যারা ঈমান আনে না তাদের সাথে আমরা যুদ্ধ করি; যারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে তাদের জানমাল আমাদের হাত থেকে নিরাপদ, আর যে কুফরী করে তাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের ভিত্তিতেই আমরা সংগ্রামে লিপ্ত হই। সে সংগ্রামের কোন শেষ নেই। তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য বৈধ। একথা বলেই আমি নিজের জন্য এবং সকল মুসলমান নারী পুরুষের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। আস্সালামু আলাইকুম।”

অতঃপর যাবারকান ইবনে বদর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি একটি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন। কবিতাটির মর্ম এইঃ

“আমরাই সম্মানিত। কোন গোত্র আমাদের সমকক্ষ নয়। রাজা বাদশাহ আমাদের মধ্যেই বিরাজমান এবং আমাদের উদ্যোগেই তাবত উপাসনালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কত গোত্রকে আমরা বলপূর্বক লুণ্ঠন করেছি তার শেষ নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের মান মর্যাদা অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে। দুর্ভিক্ষের সময়ও আমাদের লোকের ভূনা গোশত আহার করায়। মেঘ যখন মানুষের আকাঙ্খা মুতাবিক বৃষ্টি বর্ষন করে না তখন রাত্রিকালে পথিকেরা সব জায়গা থেকেই আমাদের কাছে ছুটে আসে আর আমরা তাদের খাবারের আয়োজন করি। তখন আমরা বড় বড় উট জবাই করি এবং মেহমানদের পেট ভরে খাওয়অই। এটাই আমাদের মজ্জাগত রীতি। যখনই তুমি দেখবে যে, আমরা কোন গোত্রের কাছে গিয়ে নিজেদের আভিজাত্যের গর্ব প্রকাশ করছি, তখনই দেখতে পারেব যে, তারা আমাদের অনুসারী হয়ে যাচ্ছে আর তাদের মাথা অবনমিত হয়ে আসছে। সুতরাং আজ যে ব্যক্তি আমাদের সামনে তার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরবে, তার বর্ণনায় আমরা নতুন জ্ঞান লাভ করবো এবং আমাদের প্রতিনিধিদল ফিরে গেলে সে তথ্য প্রচারিত হবে। আমরা কারো শ্রেষ্ঠত্বের মানতে রাজী নই। তবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কেউ অস্বীকার করবে না। এভাবেই আমরা গৌরব ও গর্বে অজেয়।”

হাসসান এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু তামীমের কবির জবাব দেওয়ার জন্য তলব করলেন। তিনি এসে কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন। সে কবিতায় মর্ম নিম্নরুপঃ

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন তখন আমাদের মধ্যে তাঁকে পছন্দকারী ও অপছন্দকারী উভয় রকমের লোক থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রক্ষা করেছি। আমাদের বসতিতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে আমরা তাঁকে তরবারী সজ্জিত হয়ে সকল জালিম ও আগ্রাসীর হাত থেকে রক্ষা করেছি। তিনি এক সম্মাানিত গৃহে আবির্ভূত হয়েছিলেন- যা (সিরিয়ার) জারিয়াতুল জাওলানের সন্নিহিত অপরিচিত লোকদের মধ্যে অবস্থিত। প্রাচীন মহত্ত্ব, আভিজাত্য এবং রাজকীয় সম্মান ও কঠিন মুসিবত সহ্য করার মত গৌরব আর কিছুতে নেই।”

হাসসান বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছেই আমি প্রতিনিধিদ দলের কবি যে কবিতা আবৃত্তি করেছিল হুবহু তার ছন্দ অনুকরন করে পাল্টা কবিতা আবৃত্তি করলাম। যাবারকান তার কবিতা আবৃত্তি সম্পন্ন করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসানকে বললেন, “হে হাসসান! যাবারকানের কবিতার জবাব দাও।” হাসসান দাঁড়িয়ে জবাবী কবিতা আবৃত্তি করলেন। কবিতার মর্ম নিম্নরুপ:

“কুরাইশ বংশের নেতৃবৃন্দমানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপিত করেছেন। খোদাভীতি যাদের জীবনের গোপন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং যারা ন্যায় ও সততাকে অনুকরণ করে তারা সকলেই তাদের ওপর খুশী। তারা কুরাইশী নেতৃবৃন্দ। এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা যুদ্ধরত হলে শত্রুকে পর্যুদস্ত করে দেন অথবা (নিদেনপক্ষে) নিজের গোষ্ঠীর (মু’মিনদের)কল্যাণ সাধনের চেষ্ট করেন এবং কল্যাণ সাধন করেন। এটা তাদের কোন নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, বস্তুতঃ চরিত্রের যা কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য তাই খারাপ। তাদের পরে জনগণের মধ্যে আর যদি কোন বিজয়ীর আগমন ঘটে তা’হলে এ রকম প্রত্যেক বিজয়ী তাদের নগন্যতম বিজয়ীদের চেয়েও নগণ্যতর। তারা যদি কোথাও দুর্বলতা দেখিয়ে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ সেখানে কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম নয়। আর সকল মানুষ যেখানে কৃতিত্ব দেখায় সেখানে তারা কোন দুর্বলতা দেখায় না। তারা যদি সাধারণ মাুনষের সাথে প্রতিযোগিতা করে কিংবা অভিজাত ও মর্যাদাশীলদের সাথে প্রতিদ্বন্দীতা করে তাবে তারাই অগ্রগামী হয়ে থাকে। তারা এমন নিস্কলুষতার উল্লোখ করা হয়। তারা কোনম অপবিত্রতায় জড়িত হয় না এবং কোন লোভ লালসা তাদেরকে হীনতায় পতিত করে না। প্রতিবেশীর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনে তারা কার্পন্য করে না এবং কোন তুচ্ছ জিনিসের প্রতি তারা মোহাবিষ্ট হয় না। আমরা যখন কো গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করি তখন তা গোপন রাখি না এবং বুনো গরুর তম গোপনে হিং¯্রতায় মত্ত হই না। যুদ্ধ যখন আমাদের ওপর আগ্রাসী মুষ্ঠি উত্তোলন করে এবং নিরীহ মানুষ যখন তার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় তখন আমরা তাকে বাগে আনি ও বশীভূত করি। তারা (কুরাইশ নেতৃবৃন্দ) শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে পারলে গর্বিত হয় না এবং নিজেরা পরাজিত হলেও হতাশ ও ভীত হয় না। তারা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে লড়াইতে লিপ্ত থাকে তখন তাদের অবস্থা হিলয়ার জঙ্গলের সেই সিংহের মত যার পায়ের কবজিতে শিকল পরানো সম্ভব নয়। তারা স্বোচ্ছায় যা দেয় তাই গ্রহণ কর। আর ক্রোধবশে যা দিতে চায় না তা নিতে চেয়ো না। তাদের সাথে যুদ্ধ করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও তিক্ত। অতএব তাদের শত্রুতা পরিত্যাগ কর। যখন অন্যান্য লোকেরা দলে দলে বিক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের প্রকৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে তখনও আল্লাহর রাসূলকে তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধা করে। আমার একাত্মতা বোধকারী মন তাদের প্রতি আমার প্রশংসা উৎসর্গ করেছে, যে কোন মানুষের জিহ্বাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ লোকগণ গুরুত্ব সহকারে অথবা ঠাট্রাচ্ছলে যাই বলুক না কেন- তারাই [মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীরা] সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী।”

কবিতা ও পাল্টা কবিতা পাঠের এই পালা শেষ হওয়ার পর আগন্তুক প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শুভেচ্ছামূলক প্রচুর উপঢৌকন দিলেন। প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসার সময় আমর ইবনে আহতাম নামক এক অল্পবয়স্ক যুবককে উটের কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছিল। কায়েস ইবনে আসেম তার প্রতি কিছুটা ক্রুব্ধ ছিল। সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের এক ব্যক্তিকে সওয়ারী কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। তবে সে অল্পবস্ক তরুণ।” সে তার ব্যাপারটা একটু হালকা করে দিতে চাচ্ছিল এবং তাকে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই- এ কথাই বুঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও অন্যান্যদের মত উপঢৌকন দিলেন। কায়েসের এ কথা জানতে পেরে আমর ইবনে আহতাম তাকে তিরস্কার করে কবিতা আবৃত্তি করলো-

“তুই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার নিন্দা করেছিস, কিন্তু মিথ্যা বলেছিস আর আমার ক্ষতিও করতে পারিসনি।

আমরা তোদের ওপর সর্বাত্মকভাবে প্রভুত্ব করেছি। অথচ তোদের প্রভুত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পথে।”

ইবনে ইসহাক বলেন, এই প্রতিনিধিদল সম্পর্কেই সূরা হুজুরাতের এই আয়াত নাযিল হয়-

[আরবী *******]

“হে রাসূল! যারা আপনাকে বাড়ীর বাইরে পর্দার আড়ালে থেকে হাঁকডাক করে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।” (হুজুরাহ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *