জাতীয় জীবনে লোকসাহিত্যের মূল্য

জাতীয় জীবনে লোকসাহিত্যের মূল্য

সুর মানুষের আদিম সৃষ্টি। যা কিছু মহৎ, সুন্দর, শোভন ও কাম্য–তাকেই মানুষ সুরের বন্ধনে সুন্দর করেছে। বিলাপে, ভ্যাংচিতে, গানে, কথায়–এক কথায় সর্বপ্রকার হৃদয়ানুভূতির অভিব্যক্তিতে মানুষ তাই সুরের আশ্রয় নেয়।

ফলে আবহমান কাল থেকে মানুষের সুখ-হর্ষ, ভয়-ভাবনা, সখ-শঙ্কা প্রভৃতি আবেগময় সবকিছুই সুরে বিধৃত।

কিন্তু চিরকাল মানুষের মন আদর্শপ্রবণ ও আদর্শানুগ। নীতি ও আদর্শের প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ রয়েছে। সেকালে ধর্মই ছিল লোকজীবন ও সমাজের ভিত্তি আর দিশারী। যে-যুগে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মত ও আদর্শ গড়ে উঠত ধর্ম ভিত্তি করে। তাই ধর্মকথা বা নীতিবার্তাই ছিল সাহিত্যের প্রাণস্বরূপ। এ না হলে রচনার সামাজিক মূল্য থাকত না।

এ-যুগে এ ব্যাপারে ধর্মবিশ্বাস কার্যকর নয় বটে, তবে এ-যুগেও নীতি আর আদর্শ ছাড়া কোনো মত গড়ে ওঠে না। সমাজে, সাহিত্যে বা রাজনীতিতে মতাদর্শ লোক-যাত্রার অবলম্বন,–তা সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনীতিক বা মানবতার আদর্শের যে-কোনোটিই হোক না কেন।

সে-যুগের ধর্মের স্থান দখল করেছে এ-যুগে মতবাদ। সে-যুগে জীবন ছিল ধর্মকেন্দ্রী ও সংস্কার-প্রবণ। এ-যুগে জীবন মত-ভিত্তিক। অতএব নামান্তরে বা কেন্দ্রান্তরে আমাদের অদৃশ্য নিয়ন্তা রয়েইছে।

বলছিলাম, সে-যুগে জীবন ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। ফলে যা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সহায়ক নয়, তা ছিল একান্তই অবহেলিত। এ কারণেই সে-যুগের ধর্ম ও নীতি-নিরপেক্ষ রচনা বর্ণে-বিধৃত হয়ে কালজয়ী রূপে এ-যুগে আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। এখানে আমাদের উপাখ্যান-সাহিত্যের প্রশ্ন উঠতে পারে। এর উত্তরে বলা যায়, প্রথমত, রোমান্স বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুবাদ। দ্বিতীয়ত, এগুলো পনেরো-ষোলো শতকের পূর্বের নয়। তৃতীয়ত, এগুলো অপেক্ষাকৃত সংস্কারমুক্ত মুসলিম-মনেরই অভিব্যক্তি। তবু রোমান্স-সাহিত্যে ধর্ম না থাকলেও ধর্মবোধ ছিল; ছিল আদর্শানুগত্য। তাই ওগুলো টিকে রয়েছ।

সে-যুগে মানুষ ছিল, অথচ মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ রস-চেতনা ছিল না–এমন হতেই পারে না। তার প্রমাণও পাচ্ছি ছড়ায়, রূপকথায়, গানে-গাথায়, প্রবাদে-প্রবচনে, হেঁয়ালিতে। যে-যুগে লাখে একজন শিক্ষিত ছিল না, সে-যুগে প্রাকৃতজন-সৃষ্ট এসবই মানুষের রস-পিপাসা চরিতার্থ করেছে শত শত বছর ধরে। শিক্ষার প্রসারের ফলে, আজ এদের রস-মূল্য কমে গেছে। সাহিত্যমূল্যও হয়তো নেই। তাই এসব লোক-সৃষ্ট সাহিত্য লোকস্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে। তবু লোকশ্রুতিতে কতকটা বেঁচে আছে। কিন্তু এ-যুগে এসব আর বুঝি টিকে থাকতে পারছে না। লোকমুখের আশ্রয় হারিয়ে ওগুলো নদীর চরের মতো আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে ঠাই করে নিচ্ছে। যদি সবগুলো সযত্নে সংগৃহীত হয়, তাহলে আমাদের ক্ষোভের কারণ থাকে না।

শিক্ষা-সভ্যতার বিকাশ ও প্রসারের ফলে আজ আমাদের কাছে এসব অবহেলিত রচনার মূল্য অপরিমেয়। কেননা, এর থেকেই আমরা আমাদের সর্বপ্রকার ঐতিহ্যের সন্ধান পাব–পাব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনীতিক এমনকি নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের উপাদান। আরো একদিক দিয়ে এসবের মূল্য অপরিসীম, কেননা সে-যুগে বিদ্বান লোকেরা দরবারি ভাষা সংস্কৃতের (মুসলমান আমলে ফারসিও) চর্চা করতেন। প্রাকৃত ভাষার প্রতি তাদের অবজ্ঞার অন্ত ছিল না। কাজেই আমাদের ছড়া, প্রবাদ প্রবচন, গান, গাথা ও রূপকথা নিশ্চিতই প্রাকৃতজনের সৃষ্টি। তাই আমাদের অতীত জীবনধারার স্বরূপ উপলব্ধি ও উঘাটনের পক্ষে এগুলো আরো মূল্যবান, কারণ এতে আর যা-ই থাক, সাহিত্যিক বা নৈতিক কৃত্রিমতা নেই।

ভাষার ভিত্তি শব্দ। কাজেই জাতির পরিচয়ে শব্দের মুল্য কম নয়। এর থেকেই জাতির আচার-আচরণের বাহ্যরূপ চিত্রিত হতে পারে। এ শব্দ দিয়েও জাতির ইতিহাসের কাঠামো খাড়া করা যায়। যেমন ধরুন স্বতন্ত্র শব্দটি। এ প্রাচীন শব্দটিই বলে দেয়–এককালে এদেশে কাপড় বুনবার জন্যে আলাদা সম্প্রদায় ছিল না, প্রত্যেক পরিবারেই কাপড় বোনা হত। যাদের নিজস্ব তত থাকত, তারাই সমাজে ধনী ও মানী বলে মর্যাদা পেত। প্রতিপত্তি ছিল তাদেরই। যেমন ধরুন, প্রাচীনকালের কথা বলতেই আমরা যতই গদগদ কণ্ঠে, গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গানের বর্ণনা দিই না কেন, দুর্ভিক্ষ শব্দটিই বলে দিচ্ছে–আমরা যেমন কল্পনা করছি, অবস্থাটা নিতান্ত তেমনি ছিল না। সে-সোনার যুগেও ভিক্ষা দিতে হত, কাঙালি-বিদায় পার্বণও ছিল, ছিল ডাল-ভাতের চোরও।

তারপর আমাদের বাগ্বিধির বিচার করলে দেখা যাবে তাতেও বিচিত্রভাবে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান। যেমন পান দান। এটা সম্মতি, খাতির, মিত্রতা ও প্রীতির স্বীকৃতি সূচক।

যেমন কলকে পাওয়া–গাঁজা, চরশ তামাক প্রভৃতির দেশে সমাজে মর্যাদা বা খাতির পাওয়ার কথা এর থেকে উৎকৃষ্ট ভাবে বলা যায় না। আর একটি উদাহরণ নিন তেলা মাথায় তেল-এককালে যে আমাদের দেশে তেলাভিষিক্ত করে অভিনন্দিত বা বরণ করা হত–এ তারই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। উৎসবাদিতে তেলোয়াই দেয়ার প্রথা আজো উঠে যায়নি।

ছড়াতেও রয়েছে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস। আপাত দৃষ্টিতে এগুলো যতই অস্পষ্ট ও অসংলগ্ন বলে মনে হোক না কেন, এগুলোতেও রয়েছে আমাদের নানা আচার-আচরণের ছিটেফোঁটা, মন-মননের নানা ইঙ্গিত। যেমন–

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঝাঁঝর কাঁসর মৃদঙ্গ বাজে ॥

আগডুম-অগ্রগামী ডোম, বাগডুম–পার্শ্বগামী ডোম আর অশ্বারোহী ডোম সেনার কথা বলা হয়েছে এখানে। রাঢ় অঞ্চলে একসময় রাজা ও জমিদারদের ডোম-সৈন্য থাকত। ডোম-সেনার চতুরঙ্গ বাহিনীর রূপটিই এ প্রাচীন ছড়ায় বিধৃত হয়েছে।

হেঁয়ালির মধ্যে আমাদের মনোভঙ্গি ধরা দিয়েছে বিচিত্ররূপে। বুদ্ধির দীপ্তি, সৌন্দর্যবোধ, রসচেতনা ও রসিকতা, মননশীলতা, প্রতীকপ্রিয়তা, তত্ত্বপ্রবণতা প্রভৃতিই হেঁয়ালি বা ধাঁধার মৌলিক লক্ষণ। এ ধাঁধা যে কেবল ছেলে-হাসানো বা ইয়ার-ঠকানো রচনা, তা নয়–বঙ্গ-ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মরমীয়া বাণী বা অধ্যাত্মতত্ত্বও এর মারফতে পরিব্যক্ত। যেমন চর্যাপদে আছে :

দুলি দুহি পিঠা ধরণ ণ জাই।
রুক্ষের তেলি কুম্ভীরে খাই।

তেমনি বাউল-মারফতি গানে রয়েছে :

সোল হত্যা বাঁশের ঘর না কুলাইল জনম ভর।
পাঁচপো হত্যা পিজরা কলে থাকবি কিরে মরণ পর ॥

অথবা–

দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।

অথবা–

খাঁচার মাঝে অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতাম পাখির পায়।

সাধারণ ধাঁধা—

 তরু নয় বনে রয় নাহি ধরে ফুল
ডাল পল্লব তার অতি সে বিপুল।
পবনে করিয়া ভর করয়ে ভ্রমণ।
বনেতে থাকিয়া করে বনের পীড়ন।

প্রবাদ আর প্রবচনে ধরা পড়েছে আমাদের চিরকালীন বিশ্বাস, সংস্কার, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, চিন্তা ও মনন-লব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব। প্রবাদ ও প্রবচনে একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। প্রবাদে মনুষ্য চরিত্রের বৈচিত্র্য, মানুষের বাহ্যাচরণের সঙ্গে মনের সংযোগের স্বরূপ; ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সম্বন্ধীয় ভূয়োদর্শনজাত অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি–এক কথায় জগৎ, জীবন, লোক-চরিত্র ও সমাজমনের তথ্য ও তত্ত্ব প্রবাদে বিধৃত থাকে। আর প্রবচনে থাকে নীতি, আদর্শ, কৃষি, জ্যোতিষ, সামাজিক সংস্কার, আচার, অনুষ্ঠান ও আচরণীয় বিষয় সম্বন্ধে উপদেশমূলক হিতকথা। আর একটি স্থূল পার্থক্য আছে। প্রবাদ সংক্ষিপ্ত, প্রায়ই বাক্যে বা পদে সমাপ্ত। প্রবচন ছন্দোবদ্ধ ছড়া-জাতীয় রচনা প্রায়শ একাধিক পদে সমন্বিত।

প্রবাদ যেমন,

পিরীত আর গীত–জোরের কাজ নয়

বা, নারীর বল, চোখের জল।

বা, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।

এবার প্রবচন দেখুন : কানে কচু চোখে তেল।
তার বাড়ি না বৈদ্য গেল ॥

অথবা, খায় না খায় সকালে নায়,
হয় না হয় তিনবার যায়।
তার কড়ি কী বৈদ্যে খায়?

অথবা। তাল, তেঁতুল, কুল–তিনে বাস্তু নির্মূল।

 এসব প্রবচনে প্রাচীন স্বাস্থ্যতত্ত্ব ও চিকিৎসা বিদ্যার কথা বিধৃত। আমাদের মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাকের বুলিগুলোতেও রয়েছে আমাদের সংস্কারপুষ্ট মন ও অজ্ঞতাদুষ্ট মননের পরিচয়। এছাড়া প্রণয়গীতি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকগীতি; বাউল-মুর্শিদী-মারফতি প্রভৃতি অধ্যাত্মসঙ্গীত; ঝুমুর, সামা, কীর্তন প্রভৃতি নৃত্যসঙ্গীত এবং গাথা, রূপকথা, উপকথা, ইতিকথা প্রভৃতির সাহিত্যিক মূল্য আজো নেহাত কম নয়।

আধুনিক অর্থে আমরা জাতি হিসেবে আজো গড়ে ওঠার মুখে। এজন্যেই আমাদের কাছে এসব লোকশ্রুতি ও লোকসাহিত্যের মূল্য অপরিমেয়। এর থেকেই জাগবে আমাদের ঐতিহ্যবোধ। এখানেই দেখতে পাব আমরা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ। আমাদের জাতীয় মন-মননের গতি-প্রকৃতির ও ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিশ্চিত পরিচয় ঘটবে এসবেরই মাধ্যমে। জাতীয় সাহিত্য যদি জাতীয় জাগরণের অবলম্বন হয়, সাহিত্যকে যদি জাতির প্রাণরসের উৎস বলে মনে করি, তবে এগুলোর মূল্য অবশ্যস্বীকার্য।

ছড়ায়-প্রবাদে-প্রবচনে যেমন; তেমনি এসব গান, গাথা, রূপকথা, উপকথা ও ইতিকথায় আমাদের জগৎ-জীবন, ঘর-ঘাট, মাঠ-বাট, মন-মনন, আচার-আচরণ প্রভৃতির স্বরূপ কোথাও চিত্রে, কোথাও ইঙ্গিতে বিধৃত আছে। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রিক ও অর্থনীতিক ইতিহাস লিখিত হবে এসব উপাদান সম্বল করেই। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি হিন্দু বৌদ্ধ যুগের বিরাট ইতিহাস রচিত হয়েছে এভাবে। ডা. নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস নামক বিরাট গ্রন্থটি এরূপ আপাত নগণ্য উপাদান ভিত্তিক।

অতএব আমাদের জাতীয় গরজে এসব লোকসাহিত্যের সন্ধান, সংগ্রহ, সরক্ষণ ও গবেষণাকার্য অবিলম্বে শুরু হওয়া প্রয়োজন। নতুবা আজো যা-কিছু পল্লী-মানুষের মুখে ও স্মৃতিতে টিকে আছে, তাও আমরা হারাব। সাময়িক পত্র-পত্রিকায় যৎসামান্য বিধৃত হয়েছে, কিন্তু প্রাচুর্য ও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্ত নগণ্য। এদিক দিয়ে ডক্টর সুশীল কুমার দের প্রবাদ সংগ্রহ ও ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্যের লোকসাহিত্যর বিশেষ অবদান।