সুচেতা তখন

যখন সহসা চোখ মেলে দেখি, কোরবানি-দেওয়া
ছাগলের ভেজা চামড়ার মতো আকাশকে দেখি
একলা কে পাখি উড়ে উড়ে ঘুরে ডানা ঝাপটায়,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন ঘরের পর্দায় লাগে হাওয়ার ঝাপটা,
দোলে দেয়ালের ক্যালেন্ডারের মদির-তন্বী
এবং ক্যাসেটে বিলায়েত খান নিজেই সেতার,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার।

যখন আমার গলির ধুলায় জ্যোৎস্নামরাল
নিথর ঘুমায়, উড়ে যায় দূরে পুরনো কাগজ,
ঝরা পাতা আর কাঁপে মাঝে মাঝে ছায়ার নকশা,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন মধ্যরাত্রে গহননিদ্রার জাল
ছিঁড়ে যায় আর মগজের রাঙা উদ্যানে জ্বলে,
পূর্ণিমা-চাঁদ, বন্দনাময় রক্তগোলাপ,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন আমার ভাবনা মরণ বেলা-অবেলায়
ছন্দ মিলের চুমো খেয়ে হয় সংগীতময়,
যখন হৃদয়ে গীতবিতানের পাতা নেচে ওঠে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন ব্যাপক আঁধারে হাওয়ায় দোল খায় খাঁচা
অন্ধ বাউল চা-খানায় বসে দোতারা বাজায়,
অচিন পাখির উদ্দেশে গায় নভর্চারী গান,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখে।

যখন রাতের বুক চিরে দূরে চলে যায় ট্রেন
বাজিয়ে বিরাগী হুইসেল তার, যখন ঘুমের
গহীন ভিতরে দুঃখ আমাকে নাম ধরে ডাকে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন গভীর রাত্রির বুক বৃষ্টি-নখের
আঁচড়ে-আঁচড়ে বিক্ষত হয়, তৃতীয় প্রহরে
একা ভেজা পাখি এদিক-ওদিক আশ্রয় খোঁজে,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন একাকী বসে থাকি আমি আপন বিবরে,
প্রেতায়িত ঘরে, অতীতের সাথে খেলি কানামাছি,
যখন হঠাৎ ভেসে আসে ধ্বনি শবযাত্রার,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন আমিও ক্রোশ ক্রোশ পথ পেরিয়ে ক্লান্ত
আবার আমার উঠোনে দাঁড়াই, যখন চকিতে
চরাচর বিসমিল্লা খানের সান্দ্র সানাই,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন অমল সুবে সাদেকের জাগরণী ধ্বনি
ভেসে আসে কানে, যখন প্রভাত পুণ্য আয়াত,
কাজল মাটির দুর্বার টানে ঝরে শত ফুল,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন নদীতে গ্রাম্যরমণী প্রদীপ ভাসায়
কারো কথা ভেবে সন্ধ্যাবেলায়, যখন বিপুল
বেড়াজালে দেখি ছটফট করে বন্দিনী মাছ
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।

যখন ভগ্নসেতুর অপারে ডাক দেয় কেউ,
ব্যাকুল সে-সুর বৈরী বাতাসে হারায় নিয়ত,
যখন স্রোতের ক্রূর চোরা টানে নৌকো লুপ্ত,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।