দু’নম্বর চাবি – কর্নেল সমগ্র ৯ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
০১.
ভদ্রলোকের পরনে ফতুয়া এবং ধুতি। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। লম্বা নাক। চোখ দুটো টানা-টানা। কঁচাপাকা চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। কপালে ঘষা খাওয়া রক্ততিলক। গায়ের রং তামাটে। শক্ত-সমর্থ শরীর। ঘরে ঢুকে করজোড়ে নমস্কার করার সময় তার গিটবাঁধা ছোট্ট টিকি চোখে পড়ল। বিনীতভাবে বললেন, আমি বিজয়গড় থেকে আসছি। রানীমা আপনার কাছে একখানা পত্র পাঠিয়েছেন।
বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর হাতে একটা সচিত্র ক্যাকটাসের বই ছিল। মুখে চুরুট। সাদা দাড়িতে যথারীতি একটুকরো ছাই আটকে ছিল। চওড়া টাকে ঝলমল করছিল প্রতিফলিত সকালের রোদ। বইটা টেবিলে রেখে তিনি সহাস্যে বললেন, কী আশ্চর্য! ভটচাযমশাই না?
প্রৌঢ় ভদ্রলোককে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আজ্ঞে। আমার সৌভাগ্য কর্নেলসায়েব আমাকে এত বছর পরেও চিনতে পেরেছেন।
মোটে তো বছর আষ্টেক হবে। তাছাড়া আপনার চেহারা তেমনি আছে। তো চিঠিটা দিন।
আগন্তুক ভটচাযমশাই ফতুয়ার পকেট থেকে একটা সাদা মুখ আঁটা খাম বের করে কর্নেলের হাতে দিয়ে বললেন, রানীমা আপনাকে চিঠিটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর লিখে দিতে বলেছেন।
খামের মুখ ছিঁড়ে কর্নেল চিঠিটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, কুমার বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ গতবছর খবরের কাগজে দেখেছিলুম। ইচ্ছে ছিল আপনাদের রানীমাকে একটা চিঠি দিই। কিন্তু কেন যেন চিঠিটা আর লেখা হয়ে ওঠেনি। জয়ন্ত! আলাপ করিয়ে দিই। ইনি বর্ধমান জেলার বিজয়গড় রাজবাড়ির পুরোহিত শ্রীহরেকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ভটচাযমশাই! আমার এই তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
আমরা নমস্কার বিনিময় করলুম। ভটচাযমশাই জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আর সে রাজত্ব নেই। তবে রাজবাড়ি আছে। লোকেরা এখনও শ্রদ্ধাভক্তি করে। সিংহবাহিনী মায়ের নামে মেলাটাও বসে। ওই সময় যা ধুমধাম হয়। বছরের বাকি সময় খণ্ডহর পুরী। রানীমা একা বুকে আগলে রেখেছেন। তা বয়স প্রায় আশি বছর হতে চলল।
কর্নেল বললেন, ওঁর হাতের লেখা দেখে কিন্তু বয়স বোঝা যায় না। উনি এখন চলাফেরা করতে পারেন তো?
ভটচাযমশাই বললেন, ছড়ি হাতে সারা বাড়ি চক্কর দিয়ে বেড়ান। আর মায়ের আশীর্বাদে এখনও খালি চোখে দেখতে পান। শুধু লেখাপড়ার সময় চশমা দরকার হয়।
রাজবাড়ির সেই ফুলবাগান, ক্যাকটাস এসব টিকে আছে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সেদিকে রানীমার খুব দৃষ্টি আছে। মালী সেই কালীপদ এখনও আছে। কালীর বয়সও কম হল না। বছর পাঁচেক হল, রানীমা জোর করে তার, বিয়ে দিয়েছেন। সুরবালাকে আপনার মনে পড়বে কর্নেলসায়েব। তারই মেয়ে জবার সঙ্গে কালীর বিয়ে হয়েছিল। একটা বাচ্চা হয়েছে। মায়ের লীলা বোঝা কঠিন।
ভটচাযমশাই আবার হাসবার চেষ্টা করলেন। কর্নেল বললেন, আর আপনি?
আজ্ঞে না। বেশ আছি। মায়ের চরণে পড়ে আছি। সংসার বড় ঝামেলার জিনিস। কর্নেল চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।
আমি রানীমাকে পইপই করে নিষেধ করেছিলুম কর্নেলসায়েব। বিষয়-সম্পত্তি যা আছে, তা মেলা কমিটির নামে উইল করে রাখুন। রানীমা শুনলেন না। দত্তক নিলেন। তো নিলেন ওঁর দেওরমশাইয়ের সবচেয়ে নচ্ছার ছেলেটাকে। গত মাসে। সে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। আমার সন্দেহ, অলকেন্দু আর বেঁচে নেই। কেউ তাকে গুম করে ফেলেছে।
অলকেন্দুর বয়স কত ছিল?
কর্নেল শান্তভাবে এই প্রশ্নটা করলেন দেখে আমি অবাক।
ভটচাযমশাই বললেন, তা বছর পঁচিশ হবে। কলেজে ফেল করে নেশাভাঙ করে বেড়াচ্ছিল। আপনার কাছে রানীমা লুকোছাপা করতে পারেন। আমি করব না। মেয়েঘটিত ব্যাপার। ভটচাযমশাই চাপাস্বরে ফের বললেন, আপনার মনে পড়তে পারে। নদীর ধারে সেই টিলাটানলপাহাড়ি?
হ্যাঁ। টিলার গায়ে একটা বাংলো ছিল। টমসায়েবের বাংলো। সায়েব কি বেঁচে আছেন?
না। তার ছেলে জন চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভে অফিসার। আর মেয়ে আইভি বিজয়গড় মিশনারি স্কুলে টিচার ছিল। আইভির সঙ্গে অলকেন্দুর মেলামেশা ছিল। আইভির চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছিল। তারপর গত মাসে আইভি চাকরি ছেড়ে চিত্তরঞ্জনে চলে গেল। শুনেছি, সেখানে গিয়ে বিয়ে করেছে স্বজাতির ছেলেকে। এদিকে অলকে নিখোঁজ।
বাংলোয় এখন কে থাকে?
একজন চৌকিদার থাকে। মাঝে মাঝে জনসায়েব বউ-ছেলেদের নিয়ে ছুটি কাটিয়ে যায়। আইভিকে আর দেখতে পাই না।
কর্নেল বললেন, আপনি বলতে চাইছেন অলকেন্দু
তার কথার ওপর ভটচাযমশাই বললেন, জনসায়েব সাংঘাতিক লোক। তার অসাধ্য কিছু নেই।
আপনি রানীমাকে এ ব্যাপারে আভাসে কিছু বলেননি?
বলে ধমক খেয়েছিলুম। অলকের বাবা রাঁচি থেকে এসে পুলিশকে বলে ছেলেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। রানীমা তো যথাসাধ্য করেছেন। আপনি জানেন কি না জনি না, রানীমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় পুলিসের ডি আই জি। কিন্তু অলকের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।
ভটচাযমশাই দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দয়া করে একে যা লেখার লিখে দিন। আমি সাড়ে এগারোটার ট্রেন ধরব। বর্ধমান থেকে লি জংশন। সেখান থেকে গৌরাঙ্গডিহি। তারপর তিন মাইল সাইকেল রিকশা বা বাস, যা পাই। পৌঁছুতে রাত দুপুর। তা-ও যদি পর-পর ট্রেন পাই। নইলে কাল ভোর।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে তার প্যাড টেনে বের করলেন। তারপর চিঠি লিখে একটা খামে ঢুকিয়ে আঠা দিয়ে মুখ এঁটে নামঠিকানা লিখলেন। আমার চোখে পড়ল :
মিসেস বনশোভা সিংহ, রাজবাড়ি, বিজয়গড়, বর্ধমান…
ভটচাযমশাই চিঠিটা ফতুয়ার পকেটে ভরে নমস্কার করে উঠলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন।
বললুম, ভদ্রলোককে চা কফি কিছু খেতে বললেন না যে?
কর্নেল হাসলেন। উনি স্বপাক ছাড়া কিছু স্পর্শ করেন না। তাছাড়া চা-কফি তো বিষ গণ্য করেন। এই যে আমার ঘরে সোফায় বসেছিলেন। বাড়ি ফিরে স্নান করে পোশাক ছেড়ে তবে ঘরে ঢুকবেন।
বিজয়গড়ের রানীমা কী লিখেছেন দেখাতে আপত্তি আছে?
নাহ্। বলে কর্নেল চিঠিটা আমাকে দিলেন। পড়ে দেখলুম :
‘শ্রীযুক্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সমীপেষু…
মহাশয়,
আশা করি পরম করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদে আপনি কুশলে আছেন। আমার স্বর্গত স্বামীর কাগজপত্রের মধ্যে দৈবক্রমে আপনার নাম-ঠিকানা লেখা একখানি কার্ড পাইয়া আপনার কথা মনে পড়িল। তিনি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আমাকে বলিয়াছিলেন যে, বিপদে পড়িলে যেন আপনার সাহায্য প্রার্থনা করি। আমি বর্তমানে বিপদের মধ্যে আছি। সাক্ষাতে বলিব।
তবে সাক্ষাতের পূর্বে যদি অঘটন ঘটিয়া যায়, তাহা হইলেও আপনি যেন পশ্চাৎপদ হইবেন না।
ইতি–
বনশোভা সিংহ
রাজবাড়ি, বিজয়গড়’
চিঠিটা কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললুম, ভটচাযমশাইয়ের কথার সঙ্গে তার রানীমার কথার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না।
কর্নেল দাড়ির ছাই ঝেড়ে বললেন, মেলানো যায়। দত্তকপুত্র নিখোঁজ। তারপর এখন রানীমা সম্ভবত এমন কোনও আভাস পেয়েছেন যে, এবার তাকেও নিখোঁজ করে দেওয়া হবে। বিষয়-সম্পত্তি থাকার অনেক ঝামেলা।
তাহলে আপনার যাওয়া উচিত।
তোমারও।
আমি গিয়ে কী করব?
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য চমকপ্রদ স্টোরি পাবে। আজকাল পাঠকরা কাগজে ক্রাইম-স্টেনি খুব খাচ্ছে। সব কাগজে ক্রাইমের খবরের ছড়াছড়ি।
আপত্তি করে বললুম, ক্রাইম বেড়ে যাচ্ছে বলেই না কাগজে তার খবর বাড়ছে? খবরের কাগজ সমাজের দর্পণ। তাছাড়া মানুষকে সচেতন করার দায়িত্বও তো আছে।
এত যদি বোঝো, তাহলে তৈরি থেকো।
আপনি কবে যাচ্ছেন লিখলেন?
যত শিগগির যাওয়া যায়।
জায়গাটা ঠিক কোথায়?
বাংলা-বিহার সীমানায় একটা নদীর এপারে বিজয়গড়, ওপারে দুমকা জেলার সারংডি। ওই যে জানালার ধারে ক্যাকটাসটা দেখছ, ওটাকে অর্কিডও বলতে পারো। এপ্রিলে প্রকাণ্ড লাল ফুল ফুটবে। ওটার ফ্যামিলিনেম ফিলোক্যাকটাস। কিন্তু পার্সোনাল নেম ‘এপিফাইলাম হাইব্রিডাম’। এটা এনেছিলুম সারংডির জঙ্গল থেকে। প্রকৃতি কী রহস্যময়ী ডার্লিং! কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। ক্যাকটাস! অথচ জঙ্গলের গাছে ওর বাসা। কাজেই অর্কিড ভেবেছিলুম। কুমারবাহাদুর অমলকান্তি সিংহ আমার ভুল শুধরেছিলেন। প্রায় আট বছর ধরে ওর বংশ জিইয়ে রেখেছি। হাইব্রিড পদ্ধতিতে এপিফাইলামকে নাকি দশ বছর ধরে বংশানুক্রমিক রাখা যায়। আট বছর তো রাখতে পেরেছি।
বেগতিক দেখে হাই তুলে উঠে দাঁড়ালুম। প্রকৃতিবিদ ক্যাকটাস নিয়ে বক্তৃতা শুরু করেছেন। এরপর অর্কিড আসবে। তারপর প্রজাপতি। পাখি। ক্রমে ওঁর সামরিক জীবন। বললুম, আসি কর্নেল! একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। বাড়ি ফেরার পথে সেরে যাব।
এই সময় আবার ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী।
একটু পরে পর্দা ঠেলে সবেগে প্রবেশ করলেন প্রাইভেট ডিকেটটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই। তিনি সোফায় বসে প্রথমে একটিপ নস্যি। নিলেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন। আরে! জয়ন্তবাবুও আছেন দেখছি। খাড়াইয়া ক্যান? বয়েন! বয়েন!
বললুম, আপনাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে হালদারমশাই?
প্লিজ টেক ইয়োর সিট। বলে রুমালে নাক মুছে গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। কর্নেল স্যারের লগে কনসাল্ট করতে আইলাম।
কর্নেল বললেন, আগে কফি খেয়ে ধাতস্থ হোন। ষষ্ঠী আপনাকে যখন দেখেছে, তখন আর এক দফা কফি আসছে। জয়ন্ত! বসে পড়ো।
অগত্যা বসতে হল। কে কে হালদারের পুরো নাম কৃতান্তকুমার হালদার। এক সময় উনি পুঁদে পুলিশ অফিসার ছিলেন। রিটায়ার করার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলেন। ঢ্যাঙা শক্তসমর্থ মানুষ। ছদ্মবেশ ধরতে পটু। তাই মাথার চুলে পালোয়ানি ছট আছে। লম্বাটে মুখের গড়ন। কিন্তু চোখ দুটি তুলনায় ছোট। পাতলা গোফের ডগা সুচলো। উত্তেজনা বেশি হলে ডগাদুটো তিরতির করে কঁপে। ওঁকে কর্নেলের দেখাদেখি আমিও ‘হালদারমশাই’ বলি। এর পেছনে একটা পুরনো ঘটনা আছে। কলকাতার এক ধনী ব্যক্তির মেয়ের বিয়ের সময় ডাকাতি হওয়ার আশংকা ছিল। পুলিশের ওপর তত ভরসা না করতে পেরে ভদ্রলোক কর্নেলের শরণাপন্ন হন। অবশ্য সাদা পোশাকে পুলিশও মোতায়েন ছিল। কর্নেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারকে কনের মামা সাজিয়ে নিয়ে যান। কর্নেল কোনও সূত্রে টের পেয়েছিলেন, ডাকাতরা বরযাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবে এবং হিরে-মুক্তো-সোনার জড়োয়া গয়না পরে কনে বিয়ের আসরে এলেই। তারা হানা দেবে। তাই বিন্দুমাত্র আভাস পেলেই কর্নেল বলে উঠবেন, ‘হালদারমশাই! হালদারমশাই! আপনার ভাগনির চোখে পোকা ঢুকেছে!’ এটাই ছিল সঙ্কেত। হালদারমশাই কনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কথাটা শুনেই তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে রিভলভার বের করে চেঁচিয়ে ওঠেন, কোন কোন হালায় ডাকাত, আমারে দেখাইয়া দ্যান। গুলি করিয়্যা খুলি উড়াইয়া দিমু! অমনি হইচই শুরু হয়ে যায়। তিনজন ডাকাত ছিল বরযাত্রীদের ভিড়ে। তারা বেগতিক দেখে কেটে পড়ার তালে ছিল। তারা ধরা পড়ে যায়। তবে কে কে হালদার যে কর্নেলের সঙ্কেত বাক্য শুনে সত্যি রিভলভার বের করে ফেলবেন, কর্নেল তা কল্পনাও করেননি। প্ল্যানটা ছিল অন্যরকম। যাই হোক, সেই থেকে কে কে হালদার ‘হালদারমশাই’ হয়ে ওঠেন কর্নেলের কাছে। তবে আমি এই ঘটনা শুনেই বুঝতে পেরেছিলুম, এই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক বেজায় হঠকারী, বেপরোয়া এবং একরোখা মানুষ। ইংরেজিতে যাকে বলে সিন ক্রিয়েট করা, তা তাঁর মজ্জাগত। পরবর্তীকালে অনেক ঘটনায় তার এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। তিনি নিজেও প্রাক্তন পুলিশ জীবনের যেসব ঘটনা শুনিয়েছেন, তার মধ্যেও তার একই স্বভাব এবং প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে।
ষষ্ঠীচরণ কফি আনার পর হালদারমশাই বললেন, ভেরি ভেরি মিসটিরিয়াস কেস কর্নেল স্যার! ক্লায়েন্টের অ্যাডভান্স পাইলাম। বাট শি হ্যাজ বিন ভ্যানিশড়!
বললুম, কোনও মহিলা ক্লায়েন্ট?
হালদারমশাই কফি খেতে খেতে বললেন, মেমসায়েব। মিসেস আই জে নিউসন।
কর্নেল যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, নিউসন?
গোয়েন্দামশাই আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনি চেনেন?
নাহ্। তবে নিউসন নামটা কবে যেন শুনেছিলুম। কোথায় তা মনে নেই।
হালদারমশাই কফিতে ফুঁ দিয়ে প্লেটে ঢেলে খেতে শুরু করলেন। তারপর তিনি যে ঘটনা বললেন, তা সংক্ষেপে এই :
সম্প্রতি তিনি কলকাতার সব দৈনিকে তাঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপন দিলেই দু-একটা কেস তার হাতে আসে। গতকাল দুপুরে হোটেল এশিয়া থেকে মিসেস আই জে নিউসন নামে এক মেমসায়েব ফোন করে তার ফি জানতে চান। হালদারমশাই বলেন, কেস অনুযায়ী তিনি ফি নেন। তবে অগ্রিম পাঁচশো টাকা না দিলে তিনি কেস নেন না। মেমসায়েব তাঁকে বিকেল চারটে নাগাদ হোটেলের সাততলায় ৭০৭ নম্বর স্যুইটে দেখা করতে বলেন। হালদারমশাই গতকাল চারটেয় গিয়ে রিসেপশনিস্টকে মেমসায়েবের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানান। মহিলা রিসেপশনিস্ট তার নাম জানতে চান। নাম বলার পর মহিলা তাকে একটা মুখটা খাম দিয়ে বলেন, মিসেস নিউসন আধ ঘণ্টা আগে তাঁর স্বামীর সঙ্গে হোটেল থেকে চেক-আউট করেছেন।
হালদারমশাই হোটেলের বাইরে এসে খামের মুখ ছিঁড়ে দেখেন, তাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট এবং একটা চিঠি আছে। চিঠিতে লেখা আছে : একস্ট্রিমলি সরি। দা স্কাউন্ড্রেল হ্যাজ ট্রেসড মি। সো উই আর গোয়িং টু অ্যানাদার প্লেস। আই উইল কন্ট্যাক্ট উইদ ইউ ইন টাইম। চিঠির তলায় নামসই। সবটাই সবুজ কালিতে সিগনেচার পেনে লেখা।
যাই হোক, হালদারমশাই ধাঁধায় পড়েছেন। গণেশ অ্যাভেনিউতে তার এজেন্সি অফিসে যাওয়ার পথে তিনি কর্নেল স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছেন।
কর্নেল তাঁর কথা শোনার পর বললেন, নিউসন দম্পতি কোনও বদমাস লোকের হাত থেকে বাঁচতে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছেন না। আপনার সাহায্যে লোকটাকে জব্দ করার উদ্দেশ্য আছে বলেও মনে হচ্ছে না। কলকাতায় গুণ্ডা মস্তানের অভাব নেই। তাদের ভাড়া করলেই হত।
ঠিক। হালদারমশাই মাথা নাড়লেন। ঠিক কইছেন কর্নেল স্যার! দিস ইজ দা মিস্ট্রি।
বেশ তো। আপনি অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করুন। মেমসায়েব তো লিখেছেন, যথাসময়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
করব। কিন্তু তার হাজব্যান্ডই বা কেমন? ওয়াইফেরে বাঁচাইতে পারেন না ক্যান?
যথাসময়ে নিশ্চয় তা জানতে পারবেন। অগ্রিম ফি যখন পেয়ে গেছেন।
ঘড়ি দেখে গোয়েন্দাপ্রবর উঠলেন। তারপর অভ্যাসমতো যাই গিয়া বলৈ। সবেগে বেরিয়ে গেলেন।
দেখলুম, কর্নেল ড্রয়ার থেকে কাগজপত্র হাতড়ে একটা খুদে জীর্ণ নোটবই বের করলেন। তারপর সেটার পাতা ওলটাতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি মুখ। তুলে বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত! আশ্চর্য!
কী আশ্চর্য?
কোইনসিডেন্স। কিংবা আকস্মিকতা। নিউসন নামটা শুনেই আমার একটু চমক জেগেছিল। এখন দেখছি, আমার স্মৃতি ভুল করেনি। টমাস নিউসন! জয়ন্ত! বিজয়গড়ের কাছে নলপাহাড়ি টিলার সেই বাংলোটা টমাস নিউসনের। লোকে তাকে বলত টমসায়েব। এখন কথা হল, হালদারমশাইয়ের মক্কেলের নামের পদবি নিউসন। টমসায়েবের সঙ্গে কি এই মহিলার কোনও সম্পর্ক আছে?
নড়ে বসলুম। কর্নেল! ভটচাযমশাই আইভি নামে একটি মেয়ের কথা বলছিলেন। আইভির আদ্যক্ষর আই। অলকেন্দুবাবু নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে তার নাকি সম্পর্ক আছে।
হুঁ। টমসায়েবের মেয়ে। জয়ন্ত! এক মিনিট। হোটেল এশিয়ার ম্যানেজার আমার পরিচিত। তাঁকে রিং করা যাক। বলে কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, প্লিজ পুট মি টু ম্যানেজার মিঃ রাঘবন।… আই অ্যাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।…ইয়েস। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এন ফর নাইট..ওকে! ওকে!..মি রাঘবন। মর্নিং! প্লিজ লেট মি নো অ্যাবাউট মিসেস আই জে নিউসন। সেভেন্থ ফ্লোর। সুইট নাম্বার সেভেন ও সেভেন। শি হ্যাজ বিন চেকড আউট।..ইয়েস। দ্যাট আই নো। বাট আই ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট হার হ্যাজব্যান্ড। ওয়াজ হি এ হোয়াইটম্যান?..ইউ আর শিওর?…থ্যাঙ্কস মি রাঘবন!… ও নো নো। নাথিং টু বি ওয়ারিড। থ্যাঙ্কস এগেন।…
ফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বসলেন, মেমসায়েবের স্বামী দিশি সায়েব। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি! জয়ন্ত! রহস্য ঘনীভূত হল দেখছি। বলে তিনি চুরুট ধরালেন।…
.
০২.
সেদিন সন্ধ্যায় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে পুলিশ সূত্রে পাওয়া একটা খবর লিখছি, সেই সময় কর্নেলের ফোন এল। জয়ন্ত! তুমি কি ব্যস্ত?
বললুম, তত কিছু ব্যস্ত নই। খবর বলুন?
কর্নেলের হাসি ভেসে এল। তোমার লেখার মতো খবর নয়। হালদারমশাই কিছুক্ষণ আগে ফোনে বললেন, মেমসায়েব তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন।
তারপর?
তারপর আর কিছু জানি না। তবে আমাদের আজ রাত দশটা পনেরোর ট্রেনে রওনা হতে হবে। টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেলেছি। অতএব তুমি এখনই সল্টলেকে তোমার ফ্ল্যাটে গিয়ে তৈরি হয়ে এসো।
আমি কিন্তু তৈরি হয়েই এসেছি কর্নেল! শুধু গাড়িটা রাখার প্রবলেম।
নো প্রবলেম। আমার গ্যারাজটা তো খালি। আমার ল্যান্ডরোভার গাড়িটা বেচে দিয়ে নতুন গাড়ি কেনা হয়ে উঠল না। তো যে ভদ্রলোককে গ্যারাজে গাড়ি রাখতে দিয়েছিলুম, তিনি অন্যত্র বাড়ি করে চলে গেছেন। কাজেই হা! তুমি যত শিগগির পারো চলে এসো। ছাড়লুম।…
সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়লুম। চিফ অব দি নিউজ ব্যুরো সত্যদাকে আভাস। দিয়ে এলুম, কর্নেলের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে বেরচ্ছি। সত্যদা খুশি হয়ে বললেন, বড় মাছ ধরলে ডাবল ইনক্রিমেন্ট। পুঁটিমাছ হইলে ইনক্রিমেন্ট স্টপ। আমি যা কইলাম বুড়ারে কইয়ো।
রাস্তায় জ্যাম ছিল। নভেম্বরের সন্ধ্যা। কলকাতায় শীত পড়েনি। আবহাওয়া মনোরম। ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে পয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল। অথচ অফিস থেকে হেঁটে গেলে কুড়ি মিনিটের বেশি লাগে না।
ব্যাগেজ কাঁধে লটকে ড্রয়িং রুমে ঢুকলুম। তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে ব্যাগেজের ভারে হাঁপিয়ে উঠেছিলুম। দেখলুম, হালদারমশাই এসে গেছেন। হাতমুখ নেড়ে কথা বলছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, হেভি মিস্ট্রি জয়ন্তবাবু!
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাগে অত সব কী নিয়েছ?
বললুম, তেমন কিছু না। তবে খানকতক বই নিয়েছি। বইগুলোর ওজন এত হবে, বুঝতে পারিনি।
বই? বই কী হবে?
পড়ব। কারণ আপনি পাখি-প্রজাপতি-অর্কিডের পেছনে ছুটে বেড়াবেন, এ তো জানা কথা। তখন বই পড়ে সময় কাটাব।
কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, বইগুলো রেখে যাও। এটা না ভ্রমণ নয়, জয়ন্ত! তোমার লাইসেন্সড ফায়ার আর্মসটা নিয়েছ তো?
তা অবশ্য নিয়েছি।
তা-ই যথেষ্ট। বলে কর্নেল হালদারমশাইয়ের দিকে ঘুরলেন। তাহলে লোকটা আপনাকে লিটার্যালি ল্যাং মেরে পালিয়ে গেল?
হঃ। বলে হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিলেন। জায়গাটা স্লিপারি। জুতো স্লিপ না করলে পড়তাম না। হালার চুল না ধইরা জামার কলার ধরা উচিত ছিল। হালা যে পরচুলা পরছে, বুঝি নাই।
হালদারমশাই তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ঝাকড় মাকড় পরচুলা বের করে দেখালেন।
বললুম, কেসটা কী হালদারমশাই?
পরে আমার মুখে শুনে নিও। হালদারমশাই! আপনি তা হলে আর দেরি না করে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আবার দেখা করুন। তারপর যা করার তা আপনাকে বলেছি। হ্যাঁ, পরচুলাটা দিয়ে যান।
হঃ। যাই গিয়া। বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ পরচুলাটা দিয়ে সবেগে প্রস্থান করলেন।
ষষ্ঠীচরণ আমার জন্য কফি আনল। কর্নেল তাকে বললেন, ন’টায় ডিনার খেয়ে আমরা বেরুব। রিস্ক নেব না। বাবুঘাটে লঞ্চে চেপে হাওড়া স্টেশনে যাব। ব্রিজে জ্যাম হতে পারে।
কফি খেতে খেতে বললুম, হালদারমশাই কার কাছে ল্যাং খেয়ে পরচুলা পেলেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, নিউসন দম্পতি শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে আছে। হালদারমশাইকে সন্ধ্যা ছ’টায় ডেকেছিল মিসেস নিউসন। সেখানে গেলে মিসেস নিউসন ঘর থেকে বেরিয়ে নিচের একটা গলিতে হালদারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আসে।
ঘরে কথা না বলে রাস্তায় কেন?
জানি না। তো গলিতে ওঁরা যেই নেমেছেন, একটা লোক আচমকা মিসেস নিউসনের গলার মিহি চেন ধরে ফেলে। চেনে একটা লকেট আছে। হলদারমশাই ছিনতাইকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। লোকটা তার পায়ে লাথি মারে। উনি আছাড় খান। তবে চুলটা ছাড়েননি। লোকটা তক্ষুণি পালিয়ে যায়। চুলটা হালদারমশাইয়ের হাতে থেকে যায়। সেটা তো দেখলে!
তারপর?
হালদারমশাই লক্ষ্য করেন, মিসেস নিউসন চেনের লকেটটা মুঠোয় চেপে ধরে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। হালদারমশাই তাকে অনুসরণ করেন। তখন সে বলে, আপনি ঘণ্টা দুই পরে এসে দেখা করবেন।
ঘণ্টা দুই পরে কেন?
খুঁজে পেয়ে বললুম, তাকটার মাথায়
তা জানি না। হালদারমশাই ওখানে ঘণ্টা দুই সময় কাটাতে পারতেন। তা না করে তিনি আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন। কেন জানেন? পরচুলাটা দেখাতে। অদ্ভুত মানুষ! ওখান থেকে ফোন করে জানাতে পারতেন। তবে আপাতদৃষ্টে পরচুলাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে আমার।
বলে কর্নেল তার ভেতরটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আতস কাঁচ দিয়ে দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, হ্যাঁ। গুরুত্বপূর্ণ। হালদারমশাই এটা এনে ভুল করেননি দেখছি। আসলে তখন উনি আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ওঁকে জানিয়েছিলুম সাড়ে ন’টায় আমি বেরোচ্ছি। তাই উনি রিস্ক নেননি। ছুটে এসেছিলেন।
কী আছে ওটার ভেতর?
একটু লাল ছোপ। লোকটার মাথায় হয়তো ঘা বা ফোঁড়া আছে।
হতাশ হয়ে বললুম, তা হলে ওটা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বসুদ্ধু লোকের মাথা খুঁজে বেড়াতে হবে, কার মাথায় ঘা বা ফোঁড়া আছে।
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না! মুখের চুরুট নিভে গিয়েছিল। টেবিলে অ্যাসট্রেতে রেখে পরচুলাটা খবরের কাগজ ছিঁড়ে একটা মোড়ক বানালেন। তারপর বললেন, আমি তৈরি হয়ে নিই।
কর্নেল ভেতরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে টেলিফোন বাজল। ফোন তুলে সাড়া দিতে গিয়ে মনে পড়ল, কর্নেলের বেডরুমে এটার এক্সটেনশন লাইন আছে। তারপরই হালদারমশাই এবং কর্নেল দু’জনের কথাবার্তা আমার কানে এল। ফোন। রেখে দিলুম না। শোনা যাক না ব্যাপারটা।
কর্নেল স্যার! হালদার কইতাছি।
পাবলিক বুথ থেকে মনে হচ্ছে হালদারমশাই?
ঠিক ধরছেন। মেমসায়েব আবার ভ্যানিশড।
হোটেল থেকে চলে গেছেন?
হ্যাঁ। কী ফালতু ঝামেলায় পড়া গেল। কী করি কন তো?
হয়তো ভয় পেয়ে মেমসায়েব আবার কোথাও গিয়ে উঠেছে। আপনার কার্ডে বড়ির নাম্বার তো আছে। আপনি বাড়ি চলে যান। আমার ধারণা মেমসায়েব আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ছাড়ি?
গোয়েন্দামশাইয়ের আর কোনও সাড়া এল না। টেলিফোন রেখে দিলুম। একটু পরে কর্নেল পদার ফাঁকে উঁকি মেরে চোখ কটমটিয়ে বললেন, আড়িপাতা ব্যাড হ্যাবিট।
হেসে ফেললুম! আড়ি পেতে একটু মজা পেলুম বস্! হালদারমশাই জীবনে বোধহয় এমন মক্কেলের পাল্লায় পড়েননি।
কর্নেলও হেসে ফেললেন। এত ওঁকে বলি, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখুন। উনি বলেন, আমি একাই একশো। এখন দেখো, যদি ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকত তাকে উনি শেয়ালদার ওই হোটেলে রেখে আসতে পারতেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেমসায়েবকে ফলো করত। নাহ। আর দেরি করা ঠিক নয়।
রাত সাড়ে ন’টায় বেরিয়েছিলুম দু’জনে। কর্নেলের নির্দেশে বইগুলো রেখে আসায় আমার ব্যাগেজ হালকা হয়েছিল। কর্নেলের গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। পিঠেআটা কিট ব্যাগ। তার চেনের ফাঁকে প্রজাপতি ধরা নেটের হ্যাঁন্ডেল ছাতার বাঁটের মতো বেরিয়ে আছে। মাথায় যথারীতি টুপি পরেছেন। গায়ে জ্যাকেট চড়িয়েছেন। আমাকেও শীতের পোশাক পরতে হয়েছিল। বিজয়গড় এলাকায় নাকি এখনই প্রচণ্ড শীত। কর্নেলের হাতে আর একটা ব্যাগ দেখে বুঝতে পেরেছিলুম, ওতে জঙ্গলে যাবার পোশাক-আশাক তো আছেই, উপরন্তু ওঁর ফটোপ্রিন্টের সরঞ্জামও আছে। একটা বাথরুমকে সর্বত্র উনি ডার্করুমে পরিণত করে ফেলেন। ট্রেন ছেড়েছিল ঠিক দশটা পনেরো মিনিটে। ফার্স্ট ক্লাসে রিজার্ভড কুপে দুটো বার্থ ওপরে-নীচে। নীচে কর্নেল। ওপরে আমি। উল্টোদিকে এক মারোয়াড়ি দম্পতি। কর্নেল হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা চিত্তরঞ্জন স্টেশনে নামব। অণ্ডাল হয়ে যেতে ট্রেন বদলানোর ঝামেলা আছে। দিল্লিগামী মেল ট্রেন। তাই মধ্যে মাত্র দুটো স্টপ। বর্ধমান আর আসানসোল। তারপরের স্টপ চিত্তরঞ্জন। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছনোর কথা।
ট্রেন জার্নিতে আমার ঘুম হয় না। বার তিনেক বাথরুমে গিয়েছিলুম। একবার বাথরুম থেকে এক যুবতী মেমসায়েবকে দেখে চমকে উঠেছিলুম। পরনে জিনস, লাল শার্ট, জিনসের জ্যাকেট। আইভি নয় তো? পরে দেখি আর এক যুবতী মেমসায়েব এসে তার সঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় কিচিরমিচির জুড়ে দিল। দু’জনেই সিগারেট ধরাল। আর একবার এক ধারালো চেহারার ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা যুবককে দেখে ভেবেছিলুম, আইভির সেই সঙ্গী নয় তো? আমাকে নিরাশ করে এক বাঙালী যুবতী একটি বাচ্চাকে নিয়ে কুপ থেকে বেরিয়ে তাকে বলেছিল, বাবুইকে বাথরুমে নিয়ে যাও তো!
ট্রেন আসানসোল ছাড়িয়ে যাবার পর করিডর খাঁ খাঁ নিঝুম। সব কুপের দরজা বন্ধ। বাথরুম থেকে এসে শুয়ে পড়েছিলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। নেমে পড়ো। চিত্তরঞ্জন এসে গেল। পনেরো মিনিট লেট।
নির্জন প্ল্যাটফর্মে দু’জনে নেমে একটা চায়ের স্টলে গেলুম। কিন্তু চা এখনই মিলবে না। কর্নেল একটা খালি বেঞ্চে বসে বললেন, ফ্লাস্ক আনতে ভুলে গেছি। ষষ্ঠী বরাবর ফ্লাস্কে কফি তৈরি করে রাখে। সে-ও ভুলে গেল?
এই সময় কেটলি আর প্লেটে মাটির ভাড় সাজিয়ে প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্ত থেকে এক চাওয়ালা এসে গেল। সারাক্ষণে আঁচে বসিয়ে রাখা কেটলির তরল পদার্থের স্বাদ তীব্র হিম শেষরাতে অমৃত মনে হচ্ছিল। দেখলুম কর্নেলও তারিয়ে তারিয়ে সেই অমৃত পান করে চুরুট ধরালেন। বললেন, এক ঘণ্টা অপেক্ষা করো। স্টেশনের বাইরের রাস্তায় বিজয়গড় যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। মিনিট চল্লিশ লাগার কথা। তবে আট বছর আগে যে অবস্থা ছিল, এখন তা বদলে যেতেই পারে। তুমি সাংবাদিক। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানা দেখার আমন্ত্রণ পাওনি কখনও?
বললুম, হ্যাঁ। বছর পাঁচেক আগে এসেছিলুম। ওহ্! হরিবল অভিজ্ঞতা!
কেন?
ইঞ্জিন তৈরির কারখানায় ঢুকে কানের অবস্থা–ওহ আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এই ভয়ঙ্কর শব্দের মধ্যে যারা কাজ করে, তারা কি যন্ত্রমানুষ হয়ে আছে? কারখানার শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে একখানা ঝঝালো রিপোর্টাজ লিখেছিলুম। সত্যি কর্নেল। বিদেশেও কলকারখানা দেখে এসেছি। এ দেশের কলকারখানায় মানুষকে নিঙড়ে ছোবড়া করে দেওয়া হয়। একেবারে–যাকে বলে ডিহিউম্যানাইজেশন
কর্নেল আমার কথার ওপর সহাস্যে বললেন, বিহারি শীতের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তুমি বক্তৃতা শুরু করলে ডার্লিং! এই স্থানটি কিন্তু বিহার। তা জানো তো? কয়েক পা হেঁটে উত্তরে গেলেই পশ্চিমবঙ্গ। যাই হোক, তুমি গা গরম করতে থাকো।
বললুম, নাহ্! তত কিছু ঠাণ্ডা লাগছে না। আসলে সেই স্মৃতিটা বড্ড তেতো।
কিছুক্ষণ পরে একটা ডাউন ট্রেন এল। একদল আদিবাসী ভিড় করে নামল। তারপর তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বলতে চলে গেল। নানা বয়সের মানুষ। ওরা হাঁটতে হাঁটতেই যাবে, তা বোঝা যাচ্ছিল। ততক্ষণে চায়ের স্টলের একটি লোক কেরোসিন স্টোভ ধরিয়ে কেটলি চাপিয়েছে। কর্নেল তা লক্ষ্য করে বললেন, আর এক ভাঁড় চা খেয়ে আমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব।
চাওয়ালার কাছে খবর নিয়ে জানা গেল, বিজয়গড় যাওয়ার বাস এখন সকাল সাতটায় ছাড়ে। কারণ গত বছর জঙ্গলের রাস্তায় ভোরের বাসে ডাকাতি হয়েছিল। তারপর থেকে সময় বদলানো হয়েছে। তবে যদি আমরা আগে যেতে চাই, ট্রাক পেতে পারি। বিজয়গড়ের ওদিকে একটা পাথরখাদান আছে। কয়েকটা ট্রাক মজুরদের নিয়ে ভোরবেলা সেখানে যায়। বিকেলে ফিরে আসে পাথরকুচি বা স্টোন চিপস নিয়ে।
সৌভাগ্যক্রমে একটা ট্রাকে জায়গা পাওয়া গেল। তখনও কুয়াশা-মেশানো আঁধার চরাচর ঢেকে রেখেছে। অসমতল খোলা মাঠ, চড়াই-উতরাই, তারপর টানা জঙ্গল পেরিয়ে আবার ঢেউখেলানো মাঠ এবং আদিবাসী বসতি পেরিয়ে যাওয়ার পর দিনের আলো ফুটল বটে; কিন্তু কুয়াশা এত গাঢ় যে পরিবেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। একখানে ট্রাকটা থেমে আমাদের নামিয়ে দিল। সেখানে ছোট বাজার। ড্রাইভার বলল, ইহাসে আধা কিলোমিটার। পায়দল মাত্ যাইয়ে। রিকশা-টাঙ্গা, সব কুছ মিলেগা ইহা।
ড্রাইভারটি খুবই ভদ্র। কিছুতেই ভাড়া নিল না। বখশিস হিসেবেও না। কর্নেল বললেন, চিনতে পেরেছি। জায়গাটার নাম উরনপুর। আট বছর আগে এখানে জঙ্গল ছিল। আদিবাসীদের হাট বসত। আরে আশ্চর্য! টিলার গায়ে কত ইটের বাড়ি উঠেছে।
তিনটে ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার এবং তিনদল মজুর হই হই করে চায়ের দোকানগুলোতে গিয়ে ভিড় জমাল। কর্নেল একটা সাইকেল রিকশ ডেকে উঠে বসলেন। আমি তার প্রকাণ্ড শরীরের চাপে সেঁটে গেলুম। কর্নেল বললেন, বিজয়গড় রাজবাড়ি। কত ভাড়া নেবে?
রিকশাওয়ালা বলল, বিশ রুপৈয়া।
ঠিক হ্যায়।
ততক্ষণে কুয়াশার গায়ে রক্তিম রোদ পড়েছে। দু’ধারে গাছের সারি। তার। ফাঁকে অনাবাদি মাঠের ওপর নানা গড়নের প্রকাণ্ড সব পাথর পড়ে আছে। কিছুটা চলার পর ফসলের জমি চোখে পড়ল। রাস্তাটা পিচের এবং মসৃণ। বুঝলুম এটাই বাস রাস্তা। ট্রাকগুলো যাবে অন্যদিকে।
ক্রমে একটা শহরের অস্পষ্ট ছবি সামনে ফুটে উঠল। রিকশা বাঁদিকে সংকীর্ণ খোয়াঢাকা পথে বাঁক নিল। কর্নেল বললেন, কিছু চেনা যাচ্ছে না। মাত্র আট বছরে এত বেশি পরিবর্তন। অবশ্য সবখানেই এমনটি হয়েছে।
এবার রিকশাওয়ালা নেমে রিকশা ঠেলতে থাকল। কিছুটা চড়াই। তারপর সমতল পথ। কিন্তু দুদিকে শুধু ধ্বংসাবশেষ, পাথর আর ঝোপ-জঙ্গল। কর্নেল গাইডের ভঙ্গিতে বললেন, প্রাচীন বিজয়গড়ের স্মৃতিচিহ্ন লক্ষ্য করো জয়ন্ত! এটা একটা ঐতিহাসিক জায়গা।
মোরাম রাস্তাটা সোজা এগিয়ে গেছে। ডাইনে ঘুরেই দেখি, সামনে একটা ভেঙেপড়া তোরণ। রিকশাওয়ালা বলল, আগেয়া সাব!
ভাড়া মিটিয়ে কর্নেল পা বাড়ালেন! ভাঙা তোরণের পর কাঠের বেড়া। কর্নেল সেখানে গিয়ে ডাকলেন, কালীপদ! কালীপদ!
একজন প্রৌঢ় দৌড়ে এসে কর্নেলকে দেখে গেট খুলে সেলাম দিয়ে বলল, আসুন স্যার! রানীমা বলেছেন আপনি যে কোনও সময়ে এসে পড়বেন।
তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ দেখছি!
আপনাকে কি ভুলতে পারি স্যার?
বাঁদিকে একটা পুরনো দোতলা লম্বাটে বাড়ি। ইতালীয় ভাস্কর্যের আদলে তৈরি। ডানদিকে পোড়ো ফোয়ারা এবং ঝলমলে ফুলবাগান। সামনে পূর্বে একটা মন্দি। মন্দিরের দিক থেকে এক বৃদ্ধা ছড়ি হাতে এগিয়ে আসছিলেন। তাঁর সাদা চুল খোলা। সদ্য স্নান করে মন্দিরে হয়তো পুজো করতে গিয়েছিলেন। তার পেছনে ঘোমটাটানা একুট যুবতী মেয়ে। কালীপদ চেঁচিয়ে উঠল, রানীমা! কর্নেলসায়েব এসেছেন!
বৃদ্ধা করজোড়ে নমস্কার করে বললেন, আমি জানি। চিঠি পেয়ে আপনি না এসে পারবেন না।
কর্নেল বললেন, আপনি কেমন আছেন বলুন?
বৃদ্ধা হাসলেন। লিখেছি তো সে কথা। আমাকে আপনি যে কষ্ট করে দেখতে এলেন, তার চেয়ে বড় কথা আমি আপনাকে দেখতে পেলুম। ওরে কালী। কর্নেলসায়েবের ঘর গুছিয়ে রেখেছিস তো?
কালীপদ বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ রানীমা!
কর্নেলসায়েব! আগে গিয়ে রেস্ট নিন। জবা! তুই আমার সঙ্গে আয়। তোকে দেখিয়ে দিই কীভাবে কফি তৈরি করতে হয়। ওরে! কর্নেলসায়েব কফির খুব ভক্ত।
কর্নেল বললেন, আমার চিঠি পেয়েছেন তো?
বৃদ্ধা পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। হরেকেষ্ট ফিরলে তো চিঠি পাব।
সে কী! উনি এখনও ফেরেননি?
না। হয়তো আসানসোলে বোনের বাড়িতে গেছে। বলছিল, ফেরার পথে ওখান হয়ে আসব। বললুম, তা আসিস। কর্নেলসায়েব আমার চিঠি পেলেই হল। বলে আমার দিকে তাকালেন। এই ছেলেটিকে তো চিনতে পারলুম না?
কর্নেল বললেন, এর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক।
কে জানে কেন, তখনই বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলুম। উনি আশীর্বাদ করে বললেন, কালী! এঁদের নিয়ে যা।
কালীপদ আমাদের নিয়ে যেতে যেতে চাপাস্বরে বলল, রানীমার কাছে আবার উড়ো চিঠি এসেছে। এই নিয়ে তিনবার। উনি নিজেই বলবেন সব কথা। তবে আপনাকে দেখে আমার সাহস বেড়ে গেল স্যার …
.
০৩.
কর্নেলের সঙ্গী হয়ে এমন অনেক রাজবাড়িতে থেকেছি। কিন্তু এ যেন এক ‘যক্ষপুরী’। নীচের তলায় পশ্চিম প্রান্তে একটা বড় ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্নেলকে ‘যক্ষপুরী’ কথাটা বলায় উনি হাসলেন। বললেন হ্যাঁ। এই ফিলিংটা আমারও হচ্ছে। তবে আট বছর আগে কুমার বাহাদুর বেঁচে থাকার সময় বাড়ির অবস্থা এমন ছিল না। সারাদিন জমজমাট হয়ে থাকত। এ ধরনের ফ্যামিলিতে অনেক পরগাছা এসে জোটে। মিসেস সিংহ দেখছি সব নির্মূল করে ফেলেছেন। তারাও শত্রুতা করতে পারে। যাই হোক, আগে কফি খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক।
কালীপদ ট্রেতে কফির পট, কাপ-প্লেট আর বিস্কুট আনল। সে বলল, সেবার আপনি এর ওপরতলায় ছিলেন। ওই ঘরটা বাচ্চুবাবুর খুব পছন্দ। তাই ঘরটা উনি বেছে নিয়েছিলেন।
কর্নেল বললেন, বাচ্চুবাবু কে?
আজ্ঞে, ছোট কুমার বাহাদুরের ছেলে অলকেন্দুবাবু। ছোট কুমার বাহাদুর নিজের অংশ দাদাকে বেচে দিয়েছিলেন। উনি, রাঁচিতে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। শ্বশুরমশাইয়ের সব সম্পত্তি ভোগ করছেন। ওঁর দুই ছেলে। পুলকে আর অলকেন্দু। পুলকেন্দুবাবু ইঞ্জিনিয়ার। অলকেন্দুবাবু কলেজে ফেল করে বাউন্ডুলে হয়ে পড়েছিলেন। রানীমার কী খেয়াল হল, তাকে দত্তক নিলেন।
ভটচাযমশাইয়ের কাছে শুনলুম, বাবাবু গত মাসে নাকি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছেন?
কালীপদ গম্ভীর মুখে বলল, হ্যাঁ। কালীপুজোর রাতে পুজো দেখতে গিয়েছিলেন। তারপর আর পাত্তা নেই। তবে বলতে নেই স্যার, রানীমা মুখে যাই বলুন, তাঁর হাড় জুড়িয়েছে। হাবভাবে তো বুঝতে পারি। বাচ্চুবাবু তার ঘরে সারারাত বন্ধু বান্ধব নিয়ে মদ খেতেন আর গান বাজাতেন। কান ঝালাপালা হয়ে যেত। রানীমার সাধ্য ছিল না তাকে সামলান।
রানীমা তো তাকে খুঁজে বের করার জন্য যথাসাধ্য করেছেন শুনেছি।
তা করেছেন। একটা দায়িত্ব তো বটে। পুলিশ সায়েব–মানে ডি আই জি রানীমার পিসতুতো ভাইয়ের ছেলে। অরবিন্দ বোস নাম। বর্ধমানে তার অফিস। গত সপ্তাহে তিনি এসে বলে গেছেন, তাঁর হাতে খবর আছে বাচ্চুবাবুকে খুন করে লাশ কোথাও পুঁতে ফেলেছে খুনীরা। সেই খুনীদের তিনি শিগগির অ্যারেস্ট করবেন।
তা শুনে রানীমা নিশ্চয় খুব কান্নাকাটি করলেন?
কালীপদ চাপাস্বরে বলল, আজ্ঞে না। আপনি তো দেখেছেন। উনি খুব ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে। একেবারে পাষাণ-পাথর। বোসসায়েবের কথা শুনে শুধু একটা কথা বললেন। খুনীদের ধরার আগে আমাকে বাচ্চুর লাশটা এনে দেখাও। এ কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝিনি স্যার।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি উড়ো চিঠির কথা বলছিলে?
কালীপদ আগের মতো চাপাস্বরে বলল, গেটের ফাঁক দিয়ে কে ফেলে গিয়েছিল। আমি স্যার একটু-আধটু লেখাপড়া জানি। লাল ডটপেনে লেখা চিঠি। বাচ্চুবাবু নিখোঁজ হওয়ার পর গত তিন সপ্তায় তিনটে চিঠি। একই কথা লেখা।
এই সময় রানীমার সাড়া পাওয়া গেল। কালী। কর্নেলসায়েবদের জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করতে হবে না? তুই গিয়ে জবাকে সাহায্য কর।
কথা বলতে বলতে পর্দা তুলে ঘরে ঢুকলেন। কালী বলল, ট্রে গুছিয়ে নিচ্ছি। রানীমা! সায়েবদের কফি খাওয়া হয়ে গেছে।
সে ট্রে গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। রানীমা একটা চেয়ারে বসে ছড়িটা পাশে ঠেকা দিয়ে রাখলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, কালীটা বড় কথা বলে। আসলে ওর ব্যাপারটা বুঝতে পারি। কথা বলার লোক এ বাড়িতে আর পায় না। এক ওই হরেকেষ্ট। তবে হরেকেষ্ট ওকে পাত্তা দেয় না। কালী নিজের সঙ্গে বকবক করে।
কর্নেল বললেন, আগে আপনার দত্তক পুত্রের কথা বলুন। তারপর অন্য কথা।
রানীমা আস্তে বললেন, কালীর কাছে কী শুনেছেন জানি না। তবে
কর্নেল দ্রুত বললেন, প্রথমে শুনেছি ভটচাযমশাইয়ের কাছে।
রানীমা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আমার ডিসিশনে ভুল হয়েছিল। বাচ্চুর জন্যই আমি বিপন্ন।
বিপদটা কী?
আপনি এ বাড়ির পাতালঘর দেখেছিলেন। সেই ঘরে একটা সিন্দুক আছে।
হ্যাঁ। কুমার বাহাদুর আমাকে দেখিয়েছিলেন। সিন্দুকের তালা দুটো চাবি ছাড়া খোলা যায় না।
আমি একটা চাবি বাচ্চুকে দিয়ে রেখেছিলুম। কারণ আমার বয়স হয়েছে। হঠাৎ মৃত্যু হলেই হল। বাচ্চু নিখোঁজ হওয়ার পর ওর ঘর তন্ন তন্ন খুঁজে সেই চাবিটা পাইনি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চাবিটা বাচ্চু সব সময় তার কাছে রাখত। যদি কেউ তাকে খুন করে থাকে, তা হলে চাবিটার লোভেই করেছে। এবার। আপনাকে তিনটে চিঠি দেখাচ্ছি। গত তিন সপ্তাহে গেটের ভেতর কুড়িয়ে পেয়ে কালী আমাকে দিয়েছে। কালী চিঠিগুলো পড়েছে। কারণ ভাজকরা খোলা চিঠি।
পেটের কাছে কাপড়ের ভেতর থেকে রানীমা একটা খুদে হ্যান্ড ব্যাগ বের করলেন। হ্যান্ড ব্যাগটা চেন দিয়ে কোমরের সঙ্গে আটকানো আছে দেখলুম। সেটা খুলে কর্নেলকে তিনি ভাজকরা তিনটে চিঠি দিলেন। চিঠিগুলো ছোট্ট। কর্নেলের পাশে বসেছিলুম বলে আমারও পড়া হয়ে গেল। তিনটে চিঠিতে একই কথা লাল ডটপেনে লেখা আছে।
‘রানীমা
দু’নম্বর চাবিটা চাই। মন্দিরের পেছনে চৌকো লাল পাথরের ওপর রেখে দিলে আমরা পাব। চাবি না পেলে প্রাণ যাবে। পুলিশকে জানিয়ে লাভ হবে না।‘
কর্নেল বললেন, ভটচাযমশাইয়ের কাছে শুনেছি, এলাকার পুলিশের ডি আই জি আপনার আত্মীয়। তাকে চিঠিগুলো কি দেখিয়েছেন?
অরবিন্দের ওপর আমার ভরসা নেই। তাই ওকে জানাইনি।
কালীপদ জানিয়ে থাকতে পারে!
রানীমা শক্ত মুখে বললেন, জানিয়েছিল। অরবিন্দের কাছে আমি কথাটা গুজব বলে অস্বীকার করেছি।
কর্নেল চিঠিগুলো তাসের মতো ধরে বললেন, অরবিন্দবাবুর ওপর ভরসা না থাকার কি বিশেষ কোনও কারণ আছে?
নিশ্চয় আছে। সে তো কিছু করতে পারবে না। তার ডিপার্টমেন্টের লোকেদের সাহায্য নেবে। তাতে পাতালঘরের সিন্দুকের কথাটা অনেকে জেনে ফেলবে। তার চেয়ে বড় কথা, সরকারের উঁচু মহলে কথাটা পাচার হলে সরকার সিন্দুক বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। আমার স্বামী বলেছিলেন, সরকার এইসব জিনিস বাজেয়াপ্ত করার জন্য আইন করেছেন। সিন্দুকে কী আছে, তা তো আপনি দেখেছিলেন।
দেখেছিলুম। মোগল বাদশাহের ফরমান। বংশের প্রথম রাজা আদিত্যকান্তি সিংহের রাজমুকুট আর পোশাক। অনেক স্বর্ণমুদ্রাও দেখেছিলুম। সবই মোগল যুগের মোহর।
আমি বললুম, কালীপদ বা ভটচাযমশাই কি এ কথা জানেন?
রানীমা আস্তে বললেন, না। কালী জিজ্ঞেস করেছিল কিসের চাবি? আমি জবাব দিইনি।
কর্নেল বললেন, বাচ্চুকে কি সিন্দুক খুলে দেখিয়েছিলেন আপনি?
সিন্দুক খুলে দেখাইনি। তবে ওকে পাতালঘরে নামবার জায়গা এবং কী কৌশলে সেখানে নামা যায় তা শিখিয়ে দিয়েছিলুম। আর বলেছিলুম, আমার মৃত্যু হলে দু’নম্বর চাবি আমার এই খুদে ব্যাগে থাকবে। ব্যাগটা সব সময় তামার সঙ্গে থাকে।
কর্নেল বললেন, চাবিটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন না। কোথাও গোপনে রেখে দেবেন।
রানীমা দ্বিধার সঙ্গে বললেন, কিন্তু কোথায় রাখব?
এমন কোথাও রাখুন, যেখানে চাবি থাকার সম্ভাবনা কারও মাথায় আসবে না।
আপনি ঠিকই বলেছেন।
আচ্ছা মিসেস সিংহ। এই চিঠির হাতের লেখা আপনার চেনা মনে হয়েছে কি?
রানীমা কর্নেলের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টে তাকালেন। একটু পরে বললেন, না তো। কেন ও কথা জিজ্ঞেস করছেন?
এমনি। বলে কর্নেল চিঠি তিনটে ভাঁজ করলেন। এগুলো আমি আপাতত রাখছি।
রাখুন। আপনার ওপর আমার আস্থা আছে। আমার স্বামী মৃত্যুর আগে বলে। গেছেন, কোনও বিপদে পড়লে যেন আপনার সাহায্য নিই। আপনার কীর্তি কলাপের কথা তার মুখে তো কম শুনিনি।
এবার একটা জিনিস চাইব।
বলুন?
বাচ্চুবাবুর ঘরে নিশ্চয় তালা আটা আছে। সেই ঘরের চাবিটা আমার দরকার।
পাবেন। ওপরে আমি উঠতে পারি না। তাই দোতলার সব ঘরে তালা দেওয়া আছে।
রানীমা খুদে ব্যাগটা পেটের কাছে কাপড়ের ভেতর চালান করে দিয়ে বললেন, এখন আর কথা নয়। আপনারা রাত্রি জেগে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট করে বিশ্রাম করুন।
কর্নেল হাসলেন। বিশ্রাম করব না। আপনার ক্যাকটাসের বাগানে ঢুকব।
রানীমা উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন, আমার নয়। কালীর। কালীকে এখন বাড়ির সব কাজ করতে হয়। ওর সঙ্গে জবার বিয়ে দিয়েছি। জবার মা সুরবালা মারা গেছে। জবা আমার সব সময়ের সঙ্গিনী। ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে। আশ্চর্য! বাচ্চাটা এত শান্ত! আমার ঘরের পাশের একটা ঘরে এখন ওরা থাকে। জবার হাতের রান্না খাই বলে হরেকেষ্ট আড়ালে ছি-ঘেন্না করে। করুক! ও তো শুচিবায়ুগ্রস্ত আকাট বামুন!
কর্নেল তার প্রসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বললেন, অসাধারণ বলেছেন! আকাট বামুন।
হ্যাঁ। যাকে বলে আষ্টেপিষ্টে সাত্ত্বিক বামুন। মাঝে মাঝে আমাকে শুনিয়ে বলে, সন্ন্যাস-ধর্ম নিয়ে হিমালয়ে চলে যাব। আমি বলি, ওরে হরেকেষ্ট! তুই তো এমনিতেই সন্ন্যাসী! হিমালয়ে চড়ে ঠ্যাং ভাঙবি কেন? মা সিংহবাহিনীর পায়ের তলায় পড়ে থাক গে। তাতেই তোর মোক্ষ ঠেকায় কে?
রানীমা মোটা ছড়িটা মুঠোয় ধরে চলে গেলেন। কর্নেল পশ্চিমের জানালায় বাইনোকুলারে কিছু দেখতে থাকলেন। আমি বললুম, ভদ্রমহিলার অসাধারণ মনোবল! সত্যি কর্নেল! আপনার সঙ্গী হয়ে এ যাবৎ অনেক রানীমা বা মহারানীও দেখেছি। কিন্তু এই বয়সে এমন ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা বিরল।
কর্নেল বললেন, আমিও একটা বিরল প্রজাতির সারস দেখতে পাচ্ছি জয়ন্ত। কী অদ্ভুত! টমসায়েন্ত্রে বাংলোর উত্তরে সরকারবাহাদুর একটা ওয়াটার ড্যাম তৈরি করে ফেলেছেন দেখছি।
ক্যাকটাস ফেলে সারসের পেছনে দৌড়বেন নাকি?
দেখা যাক। মাই গুডনেস।
কী ব্যাপার?
নলপাহাড়ি টিলার মাথায় অশ্বত্থ গাছের ডালে একটা সেক্রেটারি বার্ড!
কালীপদ এসে বলল, রানীমা আপনাদের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট খেতে ডাকলেন স্যার!
কর্নেল বাইনোকুলার রেখে বললেন, কালীপদ! একিনোক্যাকটাস–মানে তুমি যেটাকে কুমড়োপটাশ বলতে, সেটার বংশ রক্ষা করেছ তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কুমড়োপটাশ বলতেন আসলে রাজবাড়ির দেওয়ানজি। তার মুখে। শুনে–তবে স্যার, হাইব্রিডিংয়ের শিক্ষা কুমার বাহাদুরের হাতে। আমি ক্যাকটির কয়েকটা জোড়কলম করেছি। আপনাকে দেখাব। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না স্যার!
কথা বলতে বলতে কালীপদ আমাদের একটা বড় হলঘরের ভিতর নিয়ে গেল। ঘরটা নানারকম স্টাফকরা বুনো জন্তু দিয়ে সাজানো। ভেতর থেকে দোতলায় জীর্ণ বিবর্ণ কার্পেটে মোড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে। তারপর দুটো ঘর পেরিয়ে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে ডাইনিং রুম। সেকেলে আসবাবে সাজানো। বিশাল ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজানো খাদ্যের প্লেট। রানীমা দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, কর্নেলের যোগ্য ব্রেকফাস্ট হল না। দিশি খাদ্যই খেতে হবে। লুচি, আলুর দম, সন্দেশ। অবশ্য এগপোচ আছে। এ বেলা একটু কষ্ট করে খান।
কর্নেল বললেন, কষ্ট কিসের? আমি তো আর বিলিতি সায়েব নই। ডালভাত পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
কুমার বাহাদুর বেঁচে থাকতে বাড়িতে গেস্ট এলে বাবুর্চি নিয়ে আসতেন। আপনার মনে পড়বে। টমসায়েবের এক ভাই ছিল চিত্তরঞ্জনে। মরিসসায়েব।
হ্যাঁ। ভদ্রলোক দুর্দান্ত শিকারি ছিলেন।
মরিসসায়েব এলে সঙ্গে মুসলমান বাবুর্চি আনতেন। তার জন্য আলাদা কিচেন তৈরি করা হত বটতলায়। আপনাকে লুকোব না। গোপনে তার রান্নাকরা খাবার খেয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কুমার বাহাদুর বলেছিলেন আমাকে। আপনি নাকি
রানীমা হাসি চেপে দ্রুত বললেন, নাকি আবার কী? বললুম তো!
মরিসসায়েব কি বেঁচে আছেন?
না। অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। কী সব দিন ছিল তখন!
টমসায়েবও তো মারা গেছেন?
হ্যাঁ। ওর ছেলে জন চিত্তরঞ্জনে চাকরি করে।
টমসায়েবের একটি মেয়ে ছিল মনে পড়ছে?
লক্ষ্য করলুম রানীমার মুখ নিমেষে গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, বাবা জয়ন্ত। তুমি কিন্তু কিছু খাচ্ছ না! লজ্জা কোরো না।
বললুম, না না। আমি অনেক বেশি করে খাচ্ছি।
কর্নেল প্রশ্নটা চেপে গেলেন। খাওয়ার পর তার সঙ্গে কালীপদর ক্যাকটাস পরিচর্যা দেখতে গেলুম। সে ক্যাকটাসের কয়েকটা জোড়কলম দেখিয়ে দিয়ে রানীমার তাড়ায় সাইকেলে চেপে বাজার চলে গেল। এতক্ষণে বাড়ির চৌহদ্দি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেলুম। বাড়ির পূর্ব ও দক্ষিণের বাউন্ডারি ওয়াল উঁচু। কিন্তু জরাজীর্ণ অবস্থা। জায়গায়-জায়গায় ফাটলের মধ্যে কাঠের বেড়া আছে। পশ্চিমের পাঁচিল কবে ধসে গেছে বলে কাঠের বেড়া দেওয়া আছে। ওদিক দিয়েই আমরা রাজবাড়িতে ঢুকেছিলুম। কর্নেল ক্যাকটাসগুলো দেখতে দেখতে কী সব নাম উচ্চারণ করছিলেন। এক সময় তিনি বললেন, এপ্রিলের শেষাশেষি এগুলোর ফুলের কুঁড়ি দেখা দেবে। গ্রীষ্মে তো রঙবেরঙের ফুলের আগুন জ্বলে উঠবে। তখন যদি আসবার সুযোগ পাই, ছবি তুলে নিয়ে যাব। চলো! এবার মন্দিরের দিকটা দেখে আসি।
মন্দিরটা বিশাল। কিন্তু এদিকে কোনও দরজা নেই। মন্দিরের পাশে পুবের পাঁচিলে একটা দরজা দেখলুম। কর্নেল দরজার হুড়কো খুলে বললেন, পুকুরটার অবস্থা শোচনীয় দেখছি। আর পদ্মফুলও ফোটে না।
জিজ্ঞেস করলুম, মন্দিরের দরজা কোনদিকে?
কর্নেল পুকুরপাড়ে গিয়ে বললেন, মন্দিরটা এক সময় ছিল পাঁচিলঘেরা। উত্তরের ওই যে জমিটা দেখছ, ওখানে মেলা বসে। দরজা পরে দেখাচ্ছি। আগে সেই চৌকো লাল পাথরটা খুঁজে দেখি, যেখানে সিন্দুকের দু’নম্বর চাবি রাখতে বলা হয়েছে।
একটু পরেই মন্দিরের পেছনে পুকুরপাড়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে অনেক পাথরের চাঙড় দেখতে পেলুম। তারপর লাল পাথরটা চোখে পড়ল। কর্নেল বললেন, উপযুক্ত জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে। এখানে চাবি রাখলে সেই চাবি হাতিয়ে নিয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ আছে।
বলে তিনি বাইনোকুলারে এলাকাটা খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। তারপর আবার রাজবাড়িতে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। রাজবাড়ির দোতলা দালান এবং মন্দিরের মধ্যে প্রায় দশ মিটার চওড়া জায়গা। পুরোটা পাথরের ইটে বাঁধানো। কয়েক পা এগিয়ে ডানদিকে মন্দিরের দরজা দেখা গেল। দরজায় তালা আঁটা। উল্টোদিকে অর্থাৎ পশ্চিমে দালানের বারান্দা। দু’দিকে দুটো প্রকাণ্ড থাম। এই অংশটা একতলা। একটা তালাআঁটা ঘর দেখিয়ে কর্নেল বললেন, এই ঘরটায় ভটচাযমশাই থাকেন।
পাথরের ইটে বাঁধানো চত্বরের উত্তরে পাঁচিলটা মেরামত করা হয়েছে। সেখানে একটা প্রকাণ্ড দরজা এবং সেই দরজার কপাট লোহার। লাল রঙ করা হয়েছে কপাটে। কর্নেল বললেন, পুজোর সময় ওটা খোলা থাকে। মেলার লোকেরা দেবীকে দর্শন করতে আসে।
পাথুরে চত্বরে একটা সিঁদুর-মাখানো হাড়িকাঠ দেখে বললুম, পাঁঠাবলির ব্যবস্থা দেখছি!
কর্নেল হঠাৎ বারান্দায় উঠে গিয়ে ভটচাযমশাইয়ের ঘরের তালাটা আতস কাঁচ দিয়ে দেখতে থাকলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, একটু লক্ষ্য রাখো জয়ন্ত! রানীমা এসে পড়তে পারেন।
হতবাক হয়ে দেখলুম, কর্নেল পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে তালাটা খোলার চেষ্টা করছেন। তালাটা সাধারণ। একটু চেষ্টার পর খুলে গেল। উনি সটান ঘরে ঢুকে গেলেন। যেটুকু চোখে পড়ল, ঘরে একটা খাঁটিয়ায় বিছানা গুটানো আছে। কর্নেলের ইশারায় সরে আসতে হল।
কিছুক্ষণ পরে দেখি, রানীমা দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছেন। অমনি চাপাস্বরে ডাকলুম, কর্নেল! রানীমা!
অমনি কর্নেল বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করলেন। তালাটা আগের মতো এঁটে দিয়ে চত্বরে নেমে এলেন। গলা চড়িয়ে বললেন, রাঢ় অঞ্চলে শাক্তদেরই প্রাধান্য। এক সময় নাকি মোষবলি হত। এখন পাঁঠাবলি হয়। আগে রাজবাড়িরই কেনা ১০৮টা পাঁঠাবলি হত। আজকাল কতগুলো বলি হয় জানি না। চত্বরটা রক্তে ভেসে যেত।
রানীমা এসে বললেন, বলিদান বন্ধ হয়নি কর্নেলসায়েব! মেলা কমিটি রাজবাড়ির প্রথা বন্ধ করেনি। তবে আমি রক্ত দেখতে পারি না। ছাদে বসে মেলা দেখি। শুধু সন্ধিপুজোর দিন মন্দিরের বারান্দায় উপস্থিত থাকতে হয়। এই চত্বরটা পেরুনোর সময় চোখ বুজে থাকি। কেউ আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। আপনারা দেবী দর্শন করতে চাইলে মন্দিরের তালা খুলে দেব।
কর্নেল বললেন, এখন থাক। আমি মন্দিরের পেছনে সেই চৌকো লাল পাথরটা দেখে এলুম।
রানীমা বললেন, আমিও দেখেছি।
আপনার পক্ষে আর ওখানে না যাওয়াই ভাল। এতদিন খুব রিস্ক নিয়ে ঘুরেছেন।
রানীমা হাসলেন। বজ্জাতরা জানে, রাজবাড়ি থেকে বেরলে আমার হাতে কী থাকে!
ফায়ার আর্মস?
রানীমার মুখে দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল। বললেন, আমার স্বামীর রিভলভারটা আমার নামে লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছি। অরবন্দিই কাজটা করে দিয়েছিল। তখন সে ছিল এস পি। আর আপনি জানেন, আমার স্বামী এক সময় আমাকে রাইফেল চালানো শিখিয়েছিলেন। চল্লিশ বছর আগের কথা। রাইফেল আর নেই। কিন্তু এ বয়সেও আমার হাতের টিপ ঠিকই আছে। সাধে কি বজ্জাতগুলো শুধু চিঠি দিয়েই চুপ করে আছে? তারা জানে, সামনে এলেই কী হবে।…
.
০৪.
একটু পরে বুঝতে পারলুম, রানীমা এসেছিলেন দোতলায় বাচ্চুর ঘরের চাবি দিতে। চাবিটা দিয়ে তিনি চলে গেলেন। বললুম, ভটচাযমশাইয়ের ঘরে গোয়েন্দাগিরির কারণ কী?
কর্নেল বললেন, নিছক কৌতূহল।
বললুম, দুঃখিত বস্! বিশ্বাস করতে পারছি না।
কর্নেল হাসলেন। তুমি বস্ বলাটা ছাড়ো তো! লালবাজারের ডিকেটটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ির দেখাদেখি এই বদ অভ্যাসটা তুমি রপ্ত করেছ। অরিজিতের বলার মধ্যে একটা মজা থাকে। জয়ন্ত। তুমি ওই টোনে শব্দটা উচ্চারণ করতে পারো না! আগে ওর কাছে ট্রেনিং নিও।
নেব খন। কিন্তু ভটচাযমশাইয়ের মতো
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, আকাট বামুনের ঘরে ঢুকে আকাট মূর্খ। বনে গেছি জয়ন্ত। আমার বোঝা উচিত ছিল, সাত্ত্বিক হলেও ঘোর শাক্ত উনি। তাই খাঁটিয়ার তলায় কারণবারির বোতল থাকতেই পারে।
অবাক হয়ে বললুম, উনি মদ খান?
কারণবারি বলো! তবে এতে দোষ নেই। শাস্ত্রে দেবতাকে উৎসর্গ করা কারণবারি পান বৈধ। ভেবে দেখ, নিঃসঙ্গ জীবনে একটু-আধটু রসকষ ছাড়া শান্তি মেলে না।
ওটা ছাড়া আর কিছু দেখলেন কি না বলুন?
একটা ধারালো খাঁড়া দেখলুম। এমন পরিবেশে ওটা আত্মরক্ষার কাজে লাগবে। অবশ্য ওই খাঁড়া দিয়ে রাজবাড়ির পক্ষ থেকে পাঁঠাবলি হয় সম্ভবত; রীতিমতো ঐতিহ্যশালী একটা খড়গ।
বলে কর্নেল বারান্দার নীচের লনে হাঁটতে থাকলেন। তারপর হঠাৎ থেমে গুঁড়ি মেরে মৃত এবং ভেঙেপড়া ফোয়ারার পাশে গিয়ে ক্যামেরা বার করলেন। ওখানে মরসুমি ফুলের সমারোহ। ক্যামেরার শাটার টিপে উনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন ‘কনিষ্ক কানাসে’ প্রজাপতি। পাঁচ সেন্টিমিটার ডানার দৈর্ঘ্য। এর বৈশিষ্ট্য ঘন নীল রঙের তলায় ফিকে নীল কারুকাজ। সাধারণ নেটিভ প্রজাতি হলেও সৌন্দর্য আসামান্য। এদের ধরা কিন্তু সহজ নয়।
বেগতিক দেখে বললুম, আমি ড্যাম টায়ার্ড। ঘুম পাচ্ছে।
চলো। এবার দোতলায় বাচ্চুবাবুর ঘরটা দেখা যাক।
হলঘরের দরজা খোলা ছিল। লক্ষ্য করলুম, এক সময় এখানে পোর্টিকো ছিল। পুরোটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বারান্দায় গেলুম। উঁচু থেকে দক্ষিণে ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গলের ওধারে বিজয়গড় গ্রামের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছিল। অলকেন্দু ওরফে বাচ্চুর ঘরের তালা খুলে কর্নেল বললেন, জানালাগুলো খুলে দাও জয়ন্ত!
জানালাগুলো খুলে ঘরটা দেখে অবাক হলুম। মেঝেয় লাল কার্পেট। সুদৃশ্য বেডকভারে ঢাকা নিচু খাট। দেয়ালে প্রায় নগ্ন ফিল্ম হিরোইনদের কাট-আউট। একটা টি ভি। টেপ রেকর্ড বাজানোর বৃহৎ ডেক। দু’ধারে মাইক্রোফোন বক্স। কাঁচের আলমারিতে কতরকমের পুতুল মেমসায়েব আর নগ্ন নারীমূর্তির ভাস্কর্য। টেবিলের ওপর সাজানো রঙিন ইংরেজি পত্রিকা। প্লে বয় নামক কুখ্যাত বা বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকাও আছে। দেয়ালে সেলার। কাঁচের ভেতর সাজানো হুইস্কি রাম জিন আর ওয়াইনের বোতল। বললুম, রানীমা এগুলো ফেলে দেননি এটাই আশ্চর্য!
কর্নেল দেয়ালে একটা ছবি দেখছিলেন। বললেন, এটাই বাচ্চুবাবুর ছবি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বোকাসোকা। কিন্তু দেখতে সুন্দর।
বললুম, ফিল্মের হিরোদের মতো বোকা-সোকা চেহারা!
হিরোরা বোকা নয়, জয়ন্ত! ওটা তোমার ঈর্ষা।
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখেই বিব্রত বোধ করলুম। অলকেন্দু সত্যি সুন্দর। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলে মেয়েদের মতো অত প্রসাধন সামগ্রী কেন? কতরকমের এসেন্সের ছোট-বড় বোতল। কর্নেল চারদিকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কখনও হাঁটু ভাঁজ, কখনও অর্ধব শরীর, কখনও জুতোর ডগায় ভর করে আলমারির ওপরটা দেখতে ব্যস্ত। একটু পরে তিনি বললেন, এই ঘরের চাবি বাচ্চু রানীমাকে দিয়ে যায়নি। এটা ডুপ্লিকেট চাবি। অথবা রানীমা নিজেই এ ঘরের তালা ভেঙে নতুন তালা এঁটেছেন। কারণ ঘরের ভেতর আলমারি, ওয়াড্রব আর সেলারের চাবি, এই চাবির সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। এক মিনিট! শুধু সেলারটা দেখার কৌতূহল হচ্ছে।
কর্নেল তার পকেট থেকে সেই চাবির গোছা বের করলেন। কোনও চাবি কাজে লাগল না। তখন তিনি জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে–ড্রাইভারের মতো দেখতে একটা সূচলো জিনিস বের করলেন। এতক্ষণে বুঝতে পারলুম তিনি তৈরি হয়েই নীচের ঘর থেকে বের হয়েছিলেন।
সেলারের তালাটা হয়তো ভেঙে গেল। তালাটা কাঠের ফ্রেমে বসানো ছিল। কাঁচের পাল্লা খুলে কর্নেল প্রথমে নীচের থাকে মদের বোতলগুলোর পেছনে হাত দিলেন। তারপর দ্বিতীয় থাকে। শেষে তৃতীয় থাকের পেছন থেকে একটা ছোট অ্যালবাম বেরিয়ে এল। অ্যালবাম খুলেই কর্নেল বললেন, বাহ। বাচ্চুর ভ্রমণের ছবি। বন্ধু বান্ধবসহ পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র তীরে তোলা ছবি। সঙ্গিনীও আছে। দিশি তরুণী। প্রেমিকা তো বটেই।
তারপর একটা পাতা খুলে তিনি বললেন, জয়ন্ত। সম্ভবত আইভির ছবি এটা।
উঁকি মেরে দেখলুম, এক তরুণী মেমসায়েবের কাঁধে হাত রেখে বাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে।
পরের পাতায় পাওয়া গেল মেমসায়েবের পোর্ট্রেট। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আইভির বটে। ছবির ওপর সই করা আছে আই জে নিউসন। অক্টোবরের তারিখ। এই ছবিটা চুরি করলুম। বলে তিনি ছবিটা বের করে নিলেন সাদা সেলোফেনের স্বচ্ছ মোড়ক থেকে। কয়েকটা পাতার পর বাচ্চুর একটা ছবি পাওয়া গেল। সেটাও তিনি বের করে নিলেন। তারপর অ্যালবামটা সেলারে যথাস্থানে রেখে পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলেন।
বললুম, আট বছর আগে আপনি তো এই ঘরে ছিলেন। তখন কি সেলার ছিল?
নাহ্। এসব আসবাব নতুন। তখন ছিল সেকেলে আসবাব। প্রকাণ্ড এবং উঁচু পালঙ্ক ছিল। এবার বাথরুমটা দেখা যাক।
বাথরুমের দরজায় তালা আঁটা নেই। কর্নেল উঁকি মেরে দেখে বললেন, নাহ্। বাথটাব। শাওয়ার। গিজার। মডান গ্যাজেটে সাজানো।
বললুম, বাচ্চুবাবু না বলে বাসায়েব বলা উচিত। আগাপাশতলা মড।
হ্যাঁ। আমাদের দেশের নিউ জেনারেশনের একটা অংশ যে-কালচারে আক্রান্ত, তার নমুনা তা হলে যক্ষপুরী-তেও পাওয়া গেল। বলে কর্নেল বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
তরপর উত্তরের জানালায় গিয়ে বাইনোকুলারে সম্ভবত বিরল প্রজাতির সারস ও সেই কানে কমগোঁজা কেরানি পাখি বা সেক্রেটারি বার্ড দেখতে থাকলেন। উত্তরের ঠাণ্ডা হিম হাওয়া ঘরের ভেতর নেচে বেড়াচ্ছিল। খাটের পাশে নিচু টেবিলে রাখা দিশি-বিদেশি পত্রিকাগুলোর মতো উড়ছিল। হঠাৎ একটা পত্রিকার ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ উড়ে খাটের ওপর পড়ল। পশ্চিমের জানালা গলিয়ে পালানোর আগেই সেটা ধরে ফেললুম। তারপর বললুম, কর্নেল! একটা চিঠি। ম্যাগাজিনের ভেতর থেকে উড়ে যাচ্ছিল।
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে উত্তরমুখী হয়ে থেকেই বললেন, পড়ো! শুনতে পাব।
পড়লুম :
‘প্লিজ মিট মি নিয়ার দা বাংলো টু নাইট অ্যাট টেন ও ক্লক। দিস ইজ আর্জেন্ট। আই জে এন’
কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললেন, আইভি সবুজ কালি পছন্দ করে। একই সিগনেচারপেনে লেখা।
বললুম, রানীমা তন্ন তন্ন খুঁজেছিলেন বলছিলেন—
উনি খুঁজেছিলেন সিন্দুকের চাবি। কোনও চিঠি খোঁজেননি।
আপনিও খোঁজেননি। দৈবাত এটা পাওয়া গেল।
কর্নেল হাসলেন। আমি একটা থিয়োরি দাঁড় করিয়ে প্রমাণ খুঁজে বেড়াই। ডিডাকটিভ মেথড। এর উল্টে ইনডাকটিভ মেথড ধরে এগোলে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার ব্যাপার হবে। আমার থিয়োরি হঠাৎ পাওয়া কোনও তথ্য নড়বড়ে করে দেয়। তখন অন্য থিয়োরি দাঁড় করাই অথবা আগের থিয়োরি বদলে ফেলি। যাই হোক, চিঠিটা আমার থিয়োরিকে দুর্বল করে দিল।
থিয়োরিটা কী ছিল?
কর্নেল মুখে হাসি রেখে বললেন, এখন থিয়োরি নিয়ে বকবক করার চেয়ে স্নান সেরে নেওয়া স্বাস্থ্যকর।
বলে তিনি জানালা বন্ধ করতে থাকলেন। আমিও জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত হলুম। তারপর বললুম, পত্রিকাগুলোর পাতা খুঁজলে আরও কিছু বেরতে পারে।
হয়তো পারে। তবে কথাটা কি জানো? ওইসব গা ঘিন ঘিন করা অশ্লীল পত্রিকার পাতা ওল্টানোর ইচ্ছা আমার ছিল না। হ্যাঁ, আমিও কিছু কিছু ব্যাপারে ভটচাযমশাইয়ের মত শুচিবায়ুগ্রস্ত।
আপনি প্রখ্যাত রহস্যভেদী। রহস্যভেদের স্বার্থে নোংরা ঘাঁটতে হতেই পারে।
কর্নেল দরজায় তালা এঁটে বললেন, ডার্লিং! তুমি আমাকে আজ বড় বাগে পেয়ে গেছ। আসলে আমার ইচ্ছে ছিল না তোমার মতো যুবকের সামনে এ ধরনের অপকর্ম করি। তোমার মনে আছে কি? কলকাতার হেস্টিংস এলাকার ক্রিকটন রোডে টয় পিস্তলের নলের ভেতর পাওয়া সেক্স-ফিল্মের প্রিন্টগুলো তোমাকে দেখাইনি। ফিল্ম স্টার চিত্রা দত্তেরও সম্মান রক্ষা করেছিলুম।
চুপচাপ ওঁকে অনুসরণ করলুম। বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলুম ফুলবাগানের ধারে একটা ঢাকা ইঁদারার পাশে একটা গুমটিঘরের মতো ঘর। দরজা খুলে কালীপদর বউ জবা দাঁড়িয়ে আছে এবং ঘরটার ভেতর পাম্পিং মেসিন চলছে।
বললুম, আমি ভেবেছিলুম বিজয়গড় থেকে জলের লাইন আনা হয়েছে রাজবাড়িতে।
কর্নেল বললেন, ফোয়ারাটা দেখেও বুঝতে পারোনি বাড়িতেই জলের ব্যবস্থা আছে?
ফোয়ারাটার অমন অবস্থা কেন? মেরামত করে চালু করলে সুন্দর দেখাত। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলের বাগান।
ভটচাযমশাই বলছিলেন না আর সে-রাজত্ব নেই? ফোয়ারা চালু রাখার অনেক ঝক্কি।
কথা বলতে বলতে আমরা হলঘরে নেমে এলুম। কর্নেল স্টাফকরা একটা বাঘের পেছনে বিশাল পেন্টিং দেখিয়ে বললেন, ওই ছবিটা রাজা আদিত্যকান্তি সিংহের। ছবিটা আঠারো শতকে একজন ডেনিশ চিত্রকর এঁকেছিলেন। ওই দেখ, পড়া যাচ্ছে তারিখটা। এইটিন্থ মার্চ, ১৭১২ এ ডি। পলাশীর যুদ্ধের পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আঁকা। কুমার বাহাদুরের একটা সংগ্রহশালা দেখেছিলুম। প্রচুর পুরনো পেন্টিং আর ভাস্কর্য ছিল। জানি না সেগুলো রানীমা কোথাও দান করেছেন কি না।
আমরা ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরে কালীপদ এসে বলল, জল গরম করা হচ্ছে স্যারেরা স্নান করে নেবেন।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা কালীপদ, রাজবাড়ির একটা ঘরে অনেক ছবি আর মূর্তি ছিল। সেগুলো এখনও আছে?
কালীপদ বলল, কিছু কিছু আছে স্যার!
বাকিগুলো কোথায় গেল?
কালীপদ চাপাস্বরে বলল, কী আর বলব স্যার? বাচ্চুবাবুর গুণের কথা বলে শেষ হবে না। একটা-দুটো করে কোথায় নিয়ে যেতেন। আমাকে শাসাতেন। তার বন্ধুরা সব বিজয়গড়ের গুণ্ডা-মস্তান। অথচ সবাই ভদ্রলোকের ছেলে। দিনকাল কী হয়েছে ভাবুন!
রানীমা তো টের পেতেন?
প্রথমে পাননি। যখন পেলেন, তখন অর্ধেক নিপাত্তা হয়ে গেছে। ডবল তালা এঁটে রেখেছেন।
রানীমার ডাক শোনা গেল, কালী! ও কালী!
কালীপদ চলে গেল।…
কর্নেল ঝটপট ছবি দুটো, চিঠিটা এবং তার গোপনে তালা খোলার চাবিগুলো কিটব্যাগে ভরে রাখলেন। জ্যাকেটের ভেতর থেকে স্ত্র-ড্রাইভার জাতীয় জিনিসটাও ঢোকালেন। বললুম, আপনি দেখছি রীতিমতো সেজেগুজেই বেরিয়েছেন। কিন্তু আপনি কি জানতেন গোপনে কোনও তালা খুলতে হবে?
এ কোনও নতুন ব্যাপার নয় জয়ন্ত! আমার কিটব্যাগে অনেক কিছু থাকে। সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা। কাটাতারের বেড়া কাটার অস্ত্র থেকে শুরু করে প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে আঙুলের ছাপ নেওয়ার সরঞ্জাম..কী নেই? পেরেক, গোঁজ, হাতুড়ি, এমন কি ফার্স্ট এডের খুদে বাক্স। যাই হোক, নিয়ম ভঙ্গ করে আজ আমি স্নান করব।
কর্নেল শীতকালে সপ্তাহে একদিন স্নান করেন। বাকি সময় তিনদিন অন্তর একদিন। অনেক সময় পনেরো-কুড়িদিন স্নান না করেও দিব্যি বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন। আবার কী? সামরিক জীবনের অভ্যাস।…
সাড়ে বারোটায় রানীমার পরিচর্যায় খাওয়া-দাওয়ার পর অভ্যাসমতো কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। কর্নেল বারান্দায় রোদে বসে চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই ঘুম ভাঙল কালীপদর ডাকে।
সে চা এনেছিল। কম্বল থেকে বেরিয়ে বললুম, কর্নেল কোথায়?
কালীপদ বলল, ড্যামের জলে হাঁস দেখতে গেছেন। এদিকে এক কাণ্ড!
কী কাণ্ড?
ঠাকুরমশাই এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। এসেই দেখেন ওঁর ঘরের তালায় চাবি ঢুকছে না।
ঠাকুরমশাই মানে ভটচাযমশাই?
আজ্ঞে। কালীপদ হাসল। খামোকা হইচই বাধালেন। ঘরে কিছু চুরি যায়নি।
উনি কোথায় এখন?
রানীমার সঙ্গে কথা বলছেন। ঝোড়ো কাক-হয়ে ফিরেছেন। আসানসোলে বোনের বাড়িতে ছিলেন। হাবভাব দেখে মনে হল বোনের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। রানীমা খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। খুলে কিছু বলছেন না।
হাসতে হাসতে কালীপদ চলে গেল। চারটে বাজে। শীতের দিনের আলোর রং এখানে একেবারে ফিকে লাল। চা খেয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে বারান্দায় গেলুম। দেখলুম, ভটচাযমশাই সেই মার্কামারা ফতুয়া গায়ে বারান্দায় সিঁড়িতে বসে আছেন। থামের গায়ে হেলান দিয়ে রানীমা তার সঙ্গে কথা বলছেন। একটু পরে রানীমা ঘরে ঢুকলেন। তখন ভটচাযমশাই নীচে নেমে আমার দিকে ঘুরলেন। তারপর গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে বললেন, নমস্কার জয়ন্তবাবু! আপনারা এসে গেছেন দেখছি।
নমস্কার করে বললুম, কালীপদ বলছিল আপনার ঘরে নাকি চোর ঢুকেছিল?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু রানীমা বিশ্বাস করছেন না।
কিছু চুরি গেছে নাকি?
চুরি কী যাবে? আছেটাই বা কী? একটা স্যুটকেসে খানকতক জামাকাপড়। কয়েকখানা তৈজস দ্রব্য। আর একটা কেরোসিন কুকার। ব্যস!
তা হলে চোর ঢুকল কেন?
ভটচাযমশাই তুম্বো মুখে বললেন, বুঝতে পারছি না। তালায় চাবি ঢোকাতে গিয়ে দেখলুম ঢুকছে না। জোরে নাড়া দিলুম। তখন খুলে গেল।
এমন হতে পারে চোর ভেবেছিল কিছু দামি জিনিস পাবে!
হাঃ। বলে হরেকৃষ্ণ ভট্টাচার্য গেটের দিকে তাকালেন। এবার মুখে হাসি ফুটল। কর্নেলসায়েব আসছেন। ওঁর যা স্বভাব। পাখি প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ানো।
কর্নেল ভেতরে এসে বললেন, আরে! এই তো আপনি এসে গেছেন। আপনার জন্য খুব ভাবছিলুম। রানীমা অবশ্য বলছিলেন, আসানসোলে বোনের বাড়ি হয়ে আসবেন। তা আপনার চেহারা অমন হয়ে গেছে কেন? অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?
ভটচাযমশাই বললেন, না। দু দুবার ট্রেন জার্নি। বোনের বাড়িতে অশান্তি। জামাইবাবু লোকটা হাড়বজ্জাত। এত সাহস? আমার সামনে আমার বোনকে যাক গে ওসব কথা। আপনি ঠিক ধরেছেন। হঠাৎ আমাশা হয়ে একেবারে দুর্বল করে ফেলেছে। গৌরাঙ্গডিহিতে এক কবরেজ আছেন। তার ওষুধ খেতে খেতে এলুম। আমি তো বিলিতি ওষুধ খাই না জানেন।
আমি বললুম, ওঁর ঘরে তালা ভেঙে নাকি চোর ঢুকেছিল!
কর্নেল বললেন, সর্বনাশ!
ভটচাযমশাই বললেন, না না। কিছু চুরি যায়নি।
আপনি গায়ে চাদর জড়ান শিগগির। শীত করছে না?
হরেকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বাঁকা হেসে বললেন, আমার গায়ের চামড়া মোটা। মায়ের ইচ্ছায় শীত-গ্রীষ্ম আমার কাছে এক।
বলে তিনি হঠাৎ পেট চেপে ধরে হন হন করে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বললুম, সারসের ছবি তুলতে পেরেছেন?
কর্নেল বললেন, নাহ। বেজায় ধূর্ত। সেক্রেটারি বার্ডের ছবি তুলতে গিয়ে দেখি বাংলোয় জনসায়েব সপরিবার এসেছে গাড়ি নিয়ে। আমাকে চিনতে পেরে কথা বলল।
আইভির কথা জিজ্ঞেস করেননি?
হু। জন একটু খাপ্পা হয়ে বলল, আইভি চিত্তরঞ্জনে একটা স্কাউড্রেলকে বিয়ে করেছে। তার নাম জেমস্ বিশ্বাস। জনের কথায় নেটিভ স্কাউন্ড্রেল। জনের সঙ্গে আর বোনের কোনও সম্পর্ক নেই। বলে কর্নেল বারান্দায় উঠে এলেন। চাপা স্বরে ফের বললেন, জেম্স্ বিশ্বাসের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে। কথায় কথায় জেনে নিলুম। আমার প্রথম থিয়োরি এবার পুরো ধসে পড়ল জয়ন্ত। নতুন থিয়োরি মাথায় এসেছে। ডি আই জি অরবিন্দ বোসের সঙ্গে আমার শিগগির যোগাযোগ করা দরকার।
আমিও চাপাস্বরে বললুম, আইভি বাচ্চুকে চিঠি দিয়ে রাত্রে ডেকেছিল। তারপর
কর্নেল বললেন, চুপ! কালীপদ! কফি না চা আনছ?
কালীপদ বারান্দায় ট্রে হাতে আসছিল। বলল, কফি স্যার! আপনি কফির ভক্ত তা কি জানি না?
.
০৫.
কালীপদ কফির সঙ্গে গরম-গরম পকৌড়া এনেছিল। সে চলে গেলে জিজ্ঞেস করলুম, জনসায়েব কি জানে তার বোন কোথায় আছে?
কর্নেল বললেন, বোনের খবর রাখে না জন। কথায় কথায় জেনে নিয়েছি, জেমস বিশ্বাস বাঙালি খ্রিস্টান। চিত্তরঞ্জনে এক কন্ট্রাক্টরের অফিসে চাকরি করত। টাকা চুরি করে পালিয়েছে।
একটু পরে সিংহবাহিনীর মন্দিরের সন্ধ্যারতির ঘণ্টা বেজে উঠল। তরপরই রাজবাড়িতে আলো জ্বলল। কালীপদ আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বারান্দায় আমাদের। কাছে এল। বারান্দার এবং আমাদের ঘরের সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিয়ে সে মুচকি হেসে বলল, ভটচাযমশাইয়ের নাকি আমাশা হয়েছে। আরতি দায়সারা হবে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, উনি থাকার সময় পুজো-আরতি এসব কী ভাবে হত?
কালীপদ বলল, আজ হল গে শনিবার। ভটচাযমশাই কলকাতা গিয়েছিলেন বুধবার বিকেলে। এই ক’দিন সকাল-সন্ধ্যা আরতি দিতে ডেকে আনতুম পাঁচু ঠাকুরকে। আজ আসার পথে ভটচাযমশাই পাঁচু ঠাকুরকে নিষেধ করে এসেছেন।
কর্নেল তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আচ্ছা কালীপদ, রানীমার পিসতুতো ভাইয়ের ছেলে অরবিন্দ বোস–মানে পুলিশের ডি আই জি সায়েবকে কীভাবে খবর দেওয়া যায় বলতে পারো?
কোনও অসুবিধে নেই স্যার! বিজয়গড় থানার বড়বাবু মেজবাবু বা ছোটবাবুকে, রানীমার নাম করে বললেই টেলিফোন করে দেবেন। শুধু রানীমার একখানা চিঠি দরকার।
রানীমা এখন কি মন্দিরে?
আজ্ঞে। মন্দির থেকে ফিরে এলেই বলব কথাটা।
ঠিক আছে কথাটা আমিই ওঁকে বলব। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
কালীপদ ট্রে গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। তারপর বললুম, হালদারমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত কর্নেল! আইভির পেছনে কে লেগেছে বা কেন লেগেছে–
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, যে কন্ট্রাক্টরের টাকা চুরি করে জেমস্ পালিয়েছে, সে ওদের পেছনে গুণ্ডা লেলিয়ে দিতেই পারে। গুণ্ডাটার ভয়েই দু’জনে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে সম্ভবত।
কিন্তু আইভি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করবে কেন?
চুরুট ধরিয়ে কর্নেল বললেন, যত ভাববে তত মাথা গুলিয়ে যাবে।
না কর্নেল! ব্যাপারটা গোলমেলে। আইভি পুলিশের কাছে জানাতে পারত।
ওহ্ জয়ন্ত! এটা কেন বুঝতে পারছ না, টাকা চুরি করলে সেই কন্ট্রাক্টার জেমসের নামে পুলিশের কাছে এফ আই আর করবে কি না? পুলিশও জেমসের নামে হুলিয়া জারি করবে কি না?
হু। তা করবে বটে।
তাছাড়া আইভি পুলিশের কাছে যাবে কোন মুখে? তার নামেও তো হুলিয়া জারি হয়েছে! গেলেই তার স্বামী ধরা পড়ে যাবে এবং সে-ও বাচ্চুর কেসে অ্যারেস্ট হয়ে যাবে।
বলে কর্নেল ঘরে ঢুকলেন। টেবিলে কিটব্যাগ, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা রেখে বাথরুম গেলেন। বারান্দায় শীত করছিল। তাই ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। কর্নেলের যুক্তিগুলো মনঃপুত হল না। আইভি প্রাইভেট ডিটেকটিভের শরণাপন্ন কেন হল এই প্রশ্নটা মাথার ভেতর মাছির মতো ভনভন করতে থাকল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে কর্নেল বললেন, বসো! আসছি।
উনি চলে যাওয়ার পর পশ্চিম ও উত্তরের লম্বাটে খড়খড়িওয়ালা জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিলুম। এ ঘরে পুরনো আমলের ভারি এবং নকশাদার পদ। কোথাও-কোথাও একটু ফেটে আছে। তবে সহজে চোখে পড়ে না। শুধু এটাই আশ্চর্য, মশার উৎপাত নেই।
কেন নেই তা অভিজ্ঞতার সূত্রে বুঝতে পারলুম। অনেকদিন এ ঘর বন্ধ ছিল। মশারা মানুষের রক্তপানের সুযোগ না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কাল নিশ্চয় ওরা ক্রমে ক্রমে জেনে যাবে মানুষ এসেছে। তখন দলে দলে বেরিয়ে পড়বে গুপ্ত স্থান থেকে। হুঁ। খাটের সঙ্গে মশারি খাটানোর ব্যবস্থা আছে। মশারি খাটালেই ওরা সবুজ সঙ্কেত পাবে।
আরতির ঘণ্টা এতক্ষণে থামল। তারপর দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক শুনতে পেলুম। সামনাসামনি দক্ষিণে বটগাছের দিকে হঠাৎ পেঁচা ডেকে উঠল ক্রাও! ক্রাও! তারপর চুপ করে গেল। আবার গাঢ় স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল। এই বাড়িটা সত্যি যক্ষপুরী। কেন যেন অস্বস্তি হতে থাকল। ফায়ার আর্মসটা বের করে বিছানায় বালিশের তলায় রেখে দিলুম।
এই সময় মনে পড়ে গেল অলকের কথা। সে যাই-ই হোক না কেন, এ বাড়িতে থাকার সময় বাড়িটাকে সে প্রাণবন্ত করে রাখত। এমন সব রাতে তার হইচই, গান-বাজনার রেকর্ড খণ্ডহর অধ্যষিত এই যক্ষপুরীকে প্রাণচাঞ্চল্যে পূর্ণ রাখত না কি? হয়তো রানীমা এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ওর প্রতি তত। কঠোর হতে পারেননি। তার ঘর এখনও যে তেমনি সাজানো আছে, তা নিশ্চয় তার ফিরে আসার প্রতীক্ষার কারণে।
কথাটা ভাবতে ভাবতে আচমকা সব আলো নিভে গেল। দ্রুত টর্চ বের করে বারান্দায় গিয়ে ডাকলুম, কালীপদ কালীপদ!
কালীপদ সাড়া দিয়ে বলল, টেবিলে লণ্ঠন আর দেশলাই আছে স্যার! লোডশেডিং। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। আলো এসে যাবে।
সে বারান্দায় টর্চ জ্বেলে উল্টোদিকে চলে গেল। ঘরের একটা টেবিলে দেখলুম, চিনা লণ্ঠন আর দেশলাই রাখা আছে। আলো জ্বেলে দিলুম। কিন্তু বাইরের অন্ধকার বড় বেশি গাঢ় দেখাল। বারান্দায় গিয়ে গেটের দিকে এবং ফোয়ারার দিকে বার বার টর্চের আলো ফেলছিলুম। দু’ব্যাটারি টর্চের আলো ফোয়ারা অব্দি গিয়েই অন্ধকারের গায়ে নেতিয়ে পড়ছে। হলঘরের সামনে বারান্দায় কালীপদ একটা লণ্ঠন জ্বেলে দিল। কে জানে কেন–হয়তো রানীমাকে লেখা উড়ো চিঠিগুলোর কথা মনে পড়েই ভয় পাচ্ছিলুম। তাই নিজেকে সাহস যোগাতে ঘরে ঢুকে ফায়ার আর্মসটা নিয়ে ডান হাতে রেখে চাদর ঢাকা দিলুম। গেটের দিকে টর্চের আলো ফেলেছি, চোখের ভুল কি না জানি না, যেন দেখলুম, ফুলবাগানের দিকে কেউ বসেছিল। এইমাত্র গুঁড়ি মেরে বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে সরে গেল।
আরও কয়েক পা এগিয়ে টর্চের আলো ফেললুম। কালীপদ চেঁচিয়ে বলল, কী দেখছেন স্যার?
চেঁচিয়ে বললুম, ফুলবাগানের ওদিকে কে যেন বসেছিল।
কালীপদ তার টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেল। তারপর টর্চ নিভিয়ে হাসতে হাসতে বলল, দেখো কাণ্ড!
রানীমার কথা শোনা গেল, কী হয়েছে রে কালী?
আজ্ঞে কিছু হয়নি। বলে কালী বারান্দার নীচের লন দিয়ে আমার কাছে চলে এল। চাপাস্বরে বলল, রানীমা শুনলে খেপে যাবেন। আমি ঠাকুর-টাকুর মানি না। ভোরবেলা নিজের হাতে নিজের আমাশা তুলে ফেলে দিয়ে আসতে বলব। জল দিয়ে ধুইয়ে তবে ছাড়ব। হুঁ! আমাশা বলে যেখানে-সেখানে বসতে হবে? খিড়কির দোর খুলে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলেই পারতেন। এদিকে ভূতের ভয়। আবার মুখে
তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, ভটচাযমশাই নাকি?
কালীপদ হাসল। আবার কে? ক্যাক্টির বাগানের ওপাশে মাটিটুকু সিডবেড় করার জন্য খুঁজে রেখেছিলুম। হয়তো সেখানেই অপকম্ম করে গেলেন। হাতে গাড়ু নিতে পেরেছেন। আর পুকুরের দিকে যাবার কী দরকার? নোংরা মানুষ। বরাবর নোংরা।
কালীপদ থুথু ফেলল। বললুম, আহা! আমাশা হলে মানুষের জ্ঞানগম্যি থাকে না।
কালীপদ হাসতে হাসতে গেটের দিকে গিয়ে গেট ঠিকমতো বন্ধ আছে কি না দেখে এল। তারপরই আলো জ্বলে উঠল। ভটচাযমশাইকে কোথাও দেখতে পেলুম না।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন, লোডশেডিং সবখানেই হচ্ছে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে?
একটু হেসে বললুম, না। ভটচাযমশাইয়ের কাণ্ড! আমি আবছা দেখে চোর ভেবেছিলুম।
কর্নেল হাসলেন। আহা! বেচারার বড্ড আমাশা! বলে তিনি ঘরে ঢুকলেন। চিনে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আমি নিজে গেলে ভাল হত। তবে এতে থানার বাবুদের মনে সন্দেহ হত। তাই কালীপদই যাক রানীমার চিঠি নিয়ে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক দেখাবে।
এই রাস্তায় কালীপদ একা যাবে? রাস্তায় তো আলো নেই।
কালীপদকে তুমি চেনো না। বলে কর্নেল বারান্দায় গেলেন।
কালীপদ এগিয়ে আসছিল সাইকেল নিয়ে। সে এসে বলল, রানীমা বললেন, বোসসায়েবকে থানায় গিয়ে ফোন করতে হবে। চিঠি দিলেন। আমি যাব আর আসব। জবাকে বলে এলুম, আপনাকে কফি দিয়ে যাবে।
থানা কতদূরে?
বিজয়গড়ে ঢোকার মুখেই বড় রাস্তার ধারে। থানার বাবুদের কাউকে চিঠিটা দিয়েই চলে আসব। ওঁরা সায়েবকে টেলিফোন করে দেবেন। স্যার! দয়া করে যদি গেটটা একটু
কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে নামে বললেন, নিশ্চয়। ভটচাযমশাইয়ের আমাশা। তোমার বউ রান্নাঘরে। গেট ভেতর থেকে বন্ধ তো রাখতেই হবে।
কালীপদ সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে গেট খুলে বেরিয়ে গেল। কর্নেল গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে এলেন। বললেন, মিসেস সিংহ–মানে, রানীমা বলছিলেন, একটু দুরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। তাই এখানে লোডশেডিং কদাচিৎ হয়। বিশেষ করে শীতকালে তো হয়ই না। আজ হঠাৎ কেন যে হল!
উনি ঘরে ঢুকলে বললুম, বাচ্চুবাবুর ঘরের কোনও কথা হয়নি ওঁর সঙ্গে?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, তুমি এ প্রশ্ন করবে তা জানতুম। বাচ্চুর সেলার দেখার পর এই শীত সন্ধ্যায় তোমার একটু ইচ্ছে-টিচ্ছে জেগেছে।
ভ্যাট! বলে হেসে ফেললুম। তবে হ্যাঁ। বাচ্চুবাবু থাকলে এবং অফার করলে অন্তত দু-তিন পেগ হুইস্কি খাওয়া যেত। আপনি তো বিয়ার বা একটু-আধটু ব্রান্ডিতে সন্তুষ্ট। আপনিও বঞ্চিত হতেন না।
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, রানীমা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা তখন বলেননি। বললেন, যে, বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। কালীপুজোর পরদিন সকালে কালীপদ বাচ্চুকে ঘুম থেকে ওঠাতে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল, অন্যান্য রাতের মতো সে কাঠের বেড়া ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকেছে। হলঘরের দরজা সে না ফেরা অব্দি ভেজানো থাকত। বাচ্চু এসে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিত। তো কালীপদ দেখেছিল, সদর দরজা ভেজানো আছে। তা থাকতেই পারে। মাতাল। বাচ্চু দরজা বন্ধ করেনি। এই ভেবে কালীপদ ওপরে তার ঘরে যায়। তার ঘরের দরজাও ভেজানো ছিল। দরজা ঠেলতেই খুলে যায়। তারপর কালীপদ অবাক হয়ে দেখে, ঘরের বিছানাপত্র তচনচ হয়ে আছে। তাছাড়া টেবিলের ড্রয়ারগুলো বেরিয়ে আছে। ম্যাগাজিনগুলো মেঝেয় পড়ে আছে। আলমারি, ওয়াড্রোব আর সেলারের তালা ভাঙা। ছুটে গিয়ে সে রানীমাকে জানায়। রানীমা অনেক কষ্টে ওপরে উঠে নিজের চোখে সব দেখতে পান। এই ব্যাপারটা তিনি পুলিশকে, এমন কি বোসসায়েবকেও জানাননি। কারণ বিলিতি মদের সেলার থাকায় দত্তকপুত্র বাচ্চুর প্রতি প্রশ্রয় দেওয়াটা প্রকট হবে। লজ্জায় পড়ে তো যাবেনই। আসলে তখনও তাঁর মনে বাচ্চু সম্পর্কে কিছুটা স্নেহ ছিল। তিনি গোপনে মিস্ত্রি ডাকিয়ে নতুন তালার ব্যবস্থা করেন। তার আগে বাচ্চুর ঘর আগেরমতো সাজানো হয়েছিল। তাছাড়া সিন্দুকের চাবিটা বাচ্চু কোথায় রেখেছে, তা তন্ন তন্ন নিজে খুঁজেছিলেন। কালীপদকে সিন্দুক রহস্য ফাঁস না করে শুধু একটা অদ্ভুত গড়নের চাবির কথা বলেছিলেন। কাপীপদও ঘরে তেমন কোনও চাবি খুঁজে পায়নি। যাই হোক, এরপর তিনি নতুন তালা এঁটে দেন ঘরে।
পুরনো তালাটা কী অবস্থায় ছিল?
তালাটা চোর ভাঙা অবস্থায় বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিল। পরদিনও যখন বাচ্চু এল না, তখন কালীপদ বিজয়গড়ে গিয়ে তার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়েছিল। তারা বলেছিল, বাচ্চুকে তারা দেখেনি। এরপর রানীমা পুলিশে খবর দেন। বোসসায়েবকে চিঠি লিখে ডেকে পাঠান।
ব্যাপারটা তা হলে বোসোয়েবের খবরের সত্যতা প্রমাণ করছে! বাচ্চুকে খুন করে পুঁতে ফেলা হয়েছে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, বাচ্চুর পচাগলা লাশ যতক্ষণ না কোথাও পাওয়া যাচ্ছে, কিংবা লাশ পাওয়া না গেলেও যে তাকে সত্যি খুন করা হয়েছে, তার প্রমাণ না পাচ্ছি, ততক্ষণ সে জীবিত ধরে নিয়েই পা বাড়াতে হবে। যাই হোক, তুমি কৌতূহলী বলেই কথাগুলো জানালুম।
এতক্ষণে চাদরের ভেতর থেকে ফায়ার আর্মসটা বের করে বালিশের তলায় রাখলুম। কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর একটু হেসে বললেন, লোডেড ফায়ার আর্মস ওভাবে রাখতে নেই। তোমার বড় ব্যাগের চেন খুলে ঢুকিয়ে রাখো। ব্যাগে সাবধানে হাত দেবে। ওহ জয়ন্ত! তুমি মাঝে মাঝে অকারণে বড্ড বেশি ভয় পাও। ভাগ্যিস, আমাশা-আক্রান্ত ভটচাযমশাইয়ের দিকে গুলি ছোড়নি। হালদারমশাই হলে সত্যি অন্তত দু’রাউন্ড ফায়ার করে বসতেন।
কিছুক্ষণ পরে কালীপদর বউ জবা মাথায় ঘোমটা টেনে কফির ট্রে রেখে চলে যাচ্ছিল। কর্নেল বললেন, জবা, রানীমা এখন কী করছেন?
জবা মৃদুস্বরে বলল, ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। ঠাকুরমশাই কিছুতেই ডাক্তারের ওষুধ খেতে চাইছেন না। রানীমার কাছে আমাশার ট্যাবলেট আছে।
তোমার বাচ্চা কি এখনই ঘুমিয়ে পড়ল?
আজ্ঞে না। দোলনায় শুইয়ে রেখেছি। রানীমা একটা চাকা লাগানো ভাল দোলনা কিনে দিয়েছেন। ওপরে লাল বল ঝুলনো আছে।
তুমি অমন করে একা বাচ্চাটাকে ঘরে রেখো না!
না। রানীমা আমার টুকুনকে খুব ভালেবাসেন। নিজের ঘরের মেঝেয় দোলনা ঠেলে নিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে খেলা করেন।
বাহ। তা রানীমা তোমার বাচ্চাকে ভালবাসবেন বৈ কি। তোমার মা সুরবালা রানীমার কত সেবাযত্ন করত। আমি নিজে দেখেছি। তখন তুমি তো ফ্ৰকপরা মেয়ে।
কন্নেলসায়েবকে আমার মনে আছে। আমাকে লজেন্স চকোলেট কত কিছু দিতেন।
কর্নেল হাসলেন। তোমার মনে আছে তা হলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ কন্নেলসায়েব! রানীমা আমাকে আপনার কত গল্প শুনিয়েছেন। তবে দেখুন, উনি জাত-বিচার করেন না। রান্নার ঠাকুর ছিল। খুব চুরি করত। তাকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, জবা। তুই রান্না কর। আমি তোর হাতে খাব। আমি তো ভয়ে সারা। রাজবাড়ির রান্না আমি পারি? শেষে উনি কী করে কী রান্না করতে হয়, সব দিনে দিনে শিখিয়ে দিলেন।
বাচ্চুবাবু তোমার রান্না খেত তো?
খেত। বাচ্চুবাবুও খুব ভালমানুষ ছিল। নেশাটেশা করত বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি।
তুমি কালীপদর মতো লেখাপড়া একটু-আধটু শিখেছ, না শেখোনি?
রানীমা দুপুরবেলা আমাকে পড়া শেখান। নাম সই করা শিখেছি।
বাচ্চুবাবুর সঙ্গে টমসায়েবের মেয়ে আইভির আলাপ ছিল তুমি জানো?
জবা এই আকস্মিক প্রশ্নে একটু বিব্রত বোধ করছিল। আস্তে বলল, ওই মেমসায়েবই তো সর্বনাশের মূলে।
জবা! তুমি আমার মেয়ের মতো। লজ্জা কোরো না। বাচ্চুবাবুকে খুঁজে বের করতে আমি তোমারও সাহায্য চাই। আমি যা জিজ্ঞেস করব, ঠিক-ঠিক উত্তর দেবে তো?
আজ্ঞে কন্নেলসায়েব! যা জানি তা বলব বৈ কি।
কালীপুজোর রাতে নাকি বাচ্চুবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই দিনের কথা জানতে চাই। বাচ্চুবাবুর কাছে সেদিন কি তার কোনও বন্ধু এসেছিল? সকালে বা দুপুরে বা বিকেলে। কিছু মনে পড়ছে?
জবা আবার একটু ইতস্তত করার পর বলল, কাকেও আসতে দেখিনি। এলে মনে থাকত।
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, মেমসায়েব কি কখনও রানীমার অজান্তে এ বাড়ি এসেছে?
জবা মাথা নেড়ে বলল, না। এলে আমার চোখে পড়ত।
আচ্ছা, সেইদিনের কথায় আসছি। বাচ্চুবাবু কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল?
সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে আরতি হল। তারপর ঠাকুরমশাই এসে বাচ্চুবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চু, কালীপুজো দেখতে যাবে না? বাচ্চুবাবু রাগ করে বলল, আপনি যাবেন তো যান না! আমি যখন ইচ্ছে যাব। বাচ্চুবাবু দোতলায় তার ঘরের বারান্দায় ছিল। ঠাকুরমশাই নীচে। ঠাকুরমশাই বাচ্চুবাবুকে রাগিয়ে দিয়ে মজা পেতেন। যখন তখন মেমসায়েবের কথা বলে ঠাট্টা করতেন। বাচ্চুবাবু আরও খেপে যেত। কথাটা মনে আছে। ঠাকুরমশাই বললেন, তোমার মেমসায়েব কালীপুজো দেখতে এসেছে। জনসায়েব কোন মুল্লুকে বেড়াতে গেছে। দুপুরবেলা বাংলোয় যেতে দেখেছি মেমসায়েবকে। অমনি বাচ্চুবাবু খেপে গিয়ে বলল, তবে রে বিটলে বামুন! দেখাচ্ছি মজা! জবা হেসে ফেলল। ঠাকুরমশাই দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে পালিয়ে গেলেন। বাচ্চুবাবুও নেমে এসে দৌডুল। রানীমা ঘর থেকে বললেন, কী হয়েছে বাচ্চু? কাকে বকাবকি করছিস? বাচ্চুবাবু গেরাহ্যি করল না। তবে এমন প্রায়ই হত। ঠাকুরমশাই ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিতেন। সে এক রগুড়ে কাণ্ড। ঠাকুরমশাই যা মজার…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, আমি জিজ্ঞেস করছি বাচ্চুবাবু কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল?
জবা বলল, হ্যাঁ। রানীমার ঘরে টিভিতে একটা বই হচ্ছিল। রাত আটটার পরে। বাচ্চুবাবু বলে গেল কালীপুজো দেখতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে জবা। তুমি নিজের কাজ করো গে।
.
০৬.
সেই সন্ধ্যায় প্রায় এক ঘণ্টা পরে কালীপদ ফিরে এসে বলেছিল, বড়বাবুকে চিঠি দিলুম। উনি ফোন করে বললেন, ডি আই জি সায়েবকে এখন অফিসে পাওয়া গেল না। রানীমার খবর দিয়ে রাখছেন। অফিসের লোক খবর পৌঁছে দেবে।
রাত্রে খাওয়ার সময় রানীমা বললেন, অরবিন্দ খবর পেলে ঠিকই এসে যাবে। কিন্তু চাবির ব্যাপারে কোনও কথা যেন ওকে বলবেন না।
কর্নেল বললেন, না। আমি শুধু ওঁর কাছে বাচ্চুবাবুর ব্যাপারে পুলিশের হাতে কী ইনফরমেশন আছে, সেগুলোই জানতে চাইব। অবশ্য অরবিন্দবাবু আমার নাম শুনে থাকতেও পারেন। কারণ এখানে আসবার আগে আমি পুলিশের ওপরমহলে ঠিক জায়গায় জানিয়ে এসেছি, যাতে প্রয়োজনে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য পাই। অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে পুলিশের সাহায্য নিতে হয়।
কথায় কথায় ভটচাযমশাইয়ের আমাশার কথা এসে গেল। রানীমা বললেন, হরেকেষ্টর সব ভাল। শুধু নানান শুচিবায়ুতে ভোগে।
বললুম, ওঁর অসুখটা আন্ত্রিক নয় তো? তা হলে কিন্তু ভয়ের কথা।
না। আমাশা ওর বারোমাসের ব্যাধি। রানীমা হাসতে হাসতে বললেন, কবরেজি মতে, আমাশা হলেই নাকি জোলাপ খেতে হয়। ওর জোলাপ ইসবগুলের ভুষি। সব সময় কিনে এনে রাখে।
এই সময় বাইরে কালীপদর হাঁকডাক শোনা গেল। ঠাকুরমশাই! ওদিকে নয়। সিডবেড নষ্ট করলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। পুকুরপাড়ে যান। চলুন আমি ঘাটে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।
রানীমা মুখে কাপড়চাপা দিয়ে বললেন, বড় নোংরা হরেকেষ্ট! এদিকে বেজায় ভীতু। দিনদুপুরে ভূত দেখতে পায়।
খাওয়ার পর রানীমার কাছে বিদায় নিয়ে আমরা আমাদের ঘরে এলুম। রাত প্রায় দশটা। কর্নেল বললেন, শুয়ে পড়ো জয়ন্ত! ভোরে তোমাকে নিয়ে বেরবো।
বললুম সর্বনাশ! এই প্রচণ্ড শীতের ভোরে?
জগিং করতে করতে যাব। দেখবে, শীত কেমন জব্দ হয়ে যাচ্ছে।
আপনার মিলিটারি বডি।
কর্নেল হাসলেন। সারেংডির জঙ্গলের মুখে একটা টিলা আছে। সেই টিলায়, উঠে সূর্যোদয় দেখব। দেখে এসেছি, নদীর ওপর পুরনো কাঠের ব্রিজটা কংক্রিটের ব্রিজ হয়েছে। বিহারের আদিবাসীরা ব্রিজ পেরিয়ে বিজয়গড়ের বাজারে বেচাকেনা করতে আসে। নদীটা ওয়াটার ড্যামের জন্য ওখানে নেহাত ঝরনার রূপ নিয়েছে। জলের সেই স্বচ্ছতাও নেই। তবে দু’ধারে পাথরের ফাঁকে বুনো ফুল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
এবং প্রজাপতি!
হ্যাঁ। প্রজাপতি। তবে শিশির না শুকোলে প্রজাপতিরা বেরোয় না।
সেই টিলাটা এখান থেকে কত দূরে?
মাত্র তিন-সওয়া তিন কিলোমিটার।
আর কিছু বললুম না। মশারি খাটিয়ে ভেতরে ঢুকে কম্বল মুড়ি দিলুম। কর্নেল চেয়ারে বসে চুরুট টানতে থাকলেন। মনে মনে ঠিক করলুম, কর্নেল যতই টানাটানি করুন। ভোরে আমি কিছুতেই বিছানা ছেড়ে বেরুব না। ভোরে এই এলাকায় যা বিচ্ছিরি কুয়াশা দেখেছি!
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত!
সাড়া দিলুম না। ঘুমের ভান করে পড়ে রইলুম।
কর্নেল বললেন, তুমি ঘুমোওনি জয়ন্ত! বুঝতে পারছি ভোরে আমার সঙ্গে বেরুতে তোমার বেজায় অনিচ্ছা। ডার্লিং! টিলায় উঠে সূর্যোদয় দেখার কথা তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। একটু চিন্তা করলেই তুমি বুঝতে পারতে, ঘন কুয়াশার মধ্যে সূর্যোদয় দেখা সম্ভব নয়।
অগত্যা মুখ খুলতে হল। তা হলে সারেংডির টিলার মাথায় কষ্ট করে চড়ার দরকারটা কী?
কর্নেল হাসলেন। চাপাস্বরে বললেন, টিলাটার মাথায় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ছোট্ট একটা বাংলো আছে। বাংলোতে এক ভদ্রলোক আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।
কে তিনি?
সাসপেন্সটা ভাঙছি না। তুমি গিয়েই দেখবে। বলে কর্নেল উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর পোশাক বদলাতে গেলেন বাথরুমে। মশারির ভেতর থেকে দেখলুম, নাইট ড্রেস পরে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বড় আলোটা নিভিয়ে দিলেন। কিটব্যাগ থেকে কী সব বের করে টেবিলে ঝুঁকে বসে রইলেন। হাতে আতস কাঁচ। ওঁর পিঠের দিকটা চোখে পড়ছিল। তাই বুঝতে পারলুম না আতস কাঁচ দিয়ে কী দেখছেন।…
.
শীতকালের ভোর ছ’টায় বিছানা ছেড়ে ওঠা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিন্তু কর্নেল একটা সাসপেন্সের টোপ ঝুলিয়ে রেখেছেন সামনে। কর্নেল পোশাক পরে তৈরি ছিলেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলুম। বেরিয়ে গিয়ে দেখলুম কাল ভোরের মতোই গাঢ় কুয়াশা সব কিছু ঢেকে রেখেছে। বারান্দায় কালীপদকে দেখে বুঝলুম, তাকে কর্নেল বলে রেখেছেন। কারণ গেটে রাত্রে তালা দেওয়া থাকে। সে তালা খুলে দিয়ে বলল, সারারাত ঠাকুরমশাই জ্বালাতন করেছেন। একা বেরুনোর সাহস নেই। শেষ রাত্তিরে অসুখ কমেছে হয়তো। আর ডাকাডাকি করেননি।
মোরাম রাস্তায় কর্নেল জগিংয়ের ভঙ্গি করে বললেন, নাহ। বড় বাজে রাস্তা। পাথর উঁচিয়ে আছে। এ বয়সে ঠ্যাং ভাঙতে রাজি নই।
প্রায় দু’কিলোমিটার এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে ব্রিজ পাওয়া গেল। ডাইনের সংকীর্ণ রাস্তাটা গেছে টমসায়েবের বাংলোর দিকে। সেই টিলাটা কালো হয়ে আছে। কুয়াশার ভেতর আবছা দেখা যাচ্ছিল সেটা। ব্রিজ পেরিয়ে কর্নেল বললেন, এবার ধীরে-সুস্থে যাওয়া যেতে পারে।
কিছু দূর হাঁটার পর পিচ রাস্তা পাওয়া গেল। কর্নেল বললেন, যে রাস্তায় এলুম সেটাও পিচ হয়ে যাবে। কবে হবে বলা অবশ্য কঠিন। দুই রাজ্যের সরকারের মধ্যে বোঝাঁপড়া হয়ে গেছে। জনসায়েব বলছিল, দুই রাজ্যের পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়াররা মাপজোক করে ফেলেছেন। সারেংডি ফরেস্টে ট্যুরিস্টদের জন্য বাংলো তৈরি হচ্ছে। আট বছর আগে সারেংডিতে প্রচুর জন্তু-জানোয়ার দেখে গেছি। এখন নাকি কদাচিৎ তাদের দেখা যায়। চোরাশিকারিদের যা উৎপাত।
পিচ রাস্তা থেকে সংকীর্ণ একটা রাস্তা বাঁক নিতে নিতে টিলায় উঠেছে। এতক্ষণে টিলার মাথায় গাছপালার ফাঁকে ছোট্ট একটা বাংলো চোখে পড়ল। মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ছাত্র জীবনেই ট্রেনিং নিয়েছিলুম। কর্নেলের সঙ্গী হয়ে তা মাঝে মাঝে কাজে লাগে। কর্নেলের তো সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা আছে। রাস্তাটা ছেড়ে ঝোপ-জঙ্গল আর পাথরের ভেতর দিয়ে বাংলো লক্ষ করে দু’জনে সোজা উঠে গেলুম।
তারপর কাঠের বেড়ার ধারে ধারে সাবধানে এগিয়ে গেটের সামনে গেলুম। পুবদুয়ারি টালিতে ছাওয়া বাংলোর বারান্দায় চেয়ারে বসে কেউ দু’হাতে কাপ ধরে চা খাচ্ছিলেন। মাথায় হনুমান টুপি। পরনে সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট। আমাদের দেখতে পেয়ে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। অমনি তাকে চিনতে পারলুম। প্রাইভেট ডিকেটটিভ কে কে হালদার।
বললুম, কী আশ্চর্য! হালদারমশাই, আপনি এখানে?
হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আর কইবেন না। ক্লায়েন্ট আমারে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইতেছে। কী ঠাণ্ডা জায়গা! দুইখান কম্বলেও শীত যায় না। হোল নাইট ঘুম হয় নাই।
কর্নেল বললেন জয়ন্তকে, কেমন একখানা সাসপেন্স দিলুম।
বললুম, তা দিলেন বটে! আমি কল্পনাও করিনি হালদারমশাইকে এখানে দেখতে পাব।
হালদারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চৌকিদার কানে কালা। বয়সে বুড়া। চা করতে বলে আসি। কফি নাই কর্নেল স্যার! চা-ই খান। আমার মাথার ঠিক ছিল না। ক্লায়েন্টের লগে-লগে আইয়া পড়ছি।
কর্নেল বললেন, ব্যস্ত হবেন না। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
নাহ্। কাইল রাত্রে মিট করবে কইছিল। আর পাত্তা নাই।
বলে হালদারমশাই বাংলোর পেছন দিকে চলে গেলেন। টালি-চাপানো বাংলোয় পাশাপাশি মাত্র দুটো ঘর। বারান্দায় কাঠের যেমন-তেমন একটা টেবিল আর দুটো নড়বড়ে চেয়ার। দেয়াল ঘেঁষে সিমেন্টের বেঞ্চ। ভীষণ ঠাণ্ডা। ক্লান্তির জন্য সেখানে বসতে যাচ্ছিলুম, কর্নেল বললেন, এই চেয়ারে বসো জয়ন্ত। এটা আমার ভার সহ্য করতে পারবে না। আমি বেঞ্চে বসি।
বললুম, এই সাসপেন্সের অর্থ হয় না। কাল বিকেলে রাজবাড়িতে ফিরে বললেই পারতেন যে
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, শীতের ভোরে হাঁটার কষ্টটা কেমন পুষিয়ে গেল বলো!
বুঝতে পারছি, কাল বেড়াতে গিয়ে হালদারমশাইয়ের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল।
কর্নেল হাসলেন। হয়েছিল মানে, ওয়াটার ড্যামের ধারে জঙ্গল থেকে একটা নীল সারস উড়ে এদিকে আসছিল। তাকে বাইনোকুলারে ফলো করে দেখি এই বাংলোর সামনে হালদারমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। তক্ষুণি এসে হাজির হয়েছিলুম। উনিও তোমার মতো আমাকে এখানে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। আমরা তো ওঁকে বলে আসিনি কোথায় যাচ্ছি।
হালদারমশাই এসে গেলেন। চেয়ারে বসে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কাইল রাত্রে ক্লায়েন্টের এখানে আমার লগে মিট করার কথা ছিল। আসে নাই। কী করি। কন কর্নেল স্যার?
ওয়েট করুন। আমি কাল বিকেলে আপনাকে বলেছিলুম, নলপাহাড়ির বাংলোতে আপনার ক্লায়েন্টের দাদা ফ্যামিলি নিয়ে ছুটি কাটাতে এসেছে। আজ রবিবার। বিকেলে জনসায়েব চিত্তরঞ্জন ফিরে যাবেন। সে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আইভি এ তল্লাটে আসার রিস্ক নেবে না।
হালদারমশাই রুমালে নাক মুছে বললেন, মেমসায়েব কইছিল, রাত্রে কে তারে নাকি মোটর সাইকেলে লইয়া আইবে।
বলেছে যখন, তখন আইভি আসবে। জনসায়েব চলে যাওয়ার পর অন্ধকার নামলেই সে আসতে পারবে। বিজয়গড়েও যেখানে আইভি আছে, সেখান থেকে দিনের বেলায় বাইরে বেরুনো তার পক্ষে নিরাপদ নয়। অলকে নিখোঁজ হওয়ার কেসে পুলিশ তাকেও যে খুঁজছে। আপনাকে তো সবই বলেছি। বলে আমার দিকে তাকালেন। জয়ন্ত ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানার জন্য উৎসুক। হালদারমশাই বলবেন, নাকি আমি বলব?
গোয়েন্দামশাই একটু হেসে বললেন, আপনি কন। আমার মুড নাই।
কর্নেল আমাকে যে ঘটনা শোনালেন, তার বিবরণ এই :
শুক্রবার রাত দশটায় আমরা যখন হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলুম, তখন হালদারমশাইও তার বাড়িতে ক্লায়েন্ট মেমসায়েবের ফোনের প্রতীক্ষা করছিলেন। সওয়া দশটা নাগাদ মেমসায়েব তাকে ফোন করে জানায়, তারা স্বামী-স্ত্রী শেয়ালদার হোটেল ছেড়ে রিপন স্ট্রিটে আসছিল। সেখানে মেমসায়েব অর্থাৎ আইভির স্বামী জেমস বিশ্বাসের এক আত্মীয় থাকে। কিন্তু ট্যাক্সি না পেয়ে দু’জনে রিকশাতে চেপে আসছিল। মৌলালিতে ট্রাফিক সিগনাল না পেয়ে রিকশা বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ আইভির গলায় হ্যাঁচকা টান পড়ে। সেই পরচুলাপরা লোকটাই হবে, যদিও রিকশার হুড তোলা ছিল বলে তাকে আইভি দেখতে পায়নি লকেটশুদ্ধ চেনটা ছিনতাই করে ভিড়ে উধাও হয়ে যায়। আইভি হালদারমশাইকে বলে, এই লকেটটা খুব দামী। যে ‘স্কাউড্রেল’ ওটা হাতানোর জন্য তাদের অনুসরণ করে কলকাতা এসেছিল, সে বিজয়গড়ের লোক। কারণ আইভি যখন বিজয়গড়ে খ্রিস্টান মিশন স্কুলে শিক্ষিকা ছিল, তখন তাকে সে বহুবার দেখেছে। কিন্তু তার পরিচয় জানে না। তার পরিচয় জানবার জন্যই আইভি প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য চেয়েছিল। এখন লকেটটাও সে উদ্ধার করতে চায়। তাই হালদারমশাই যদি তার সঙ্গে বিজয়গড়ে যান, তার পুরো ফি সে দেবে। পুরো ফি কত, তা-ও সে জানতে চায়। হালদারমশাই রহস্যের গন্ধ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই তিনি তাকে বলেন, কাজ সফল হলে ম্যাডাম যা খুশি তাই দেবেন। তারপর কথামতো শনিবার ভোর ছটায় হালদারমশাই হাওড়া স্টেশনে যান। ‘মেমসায়েব’ বলেছিল সে একা যাবে। তার পরনে থাকবে। জিনসের প্যান্ট-জ্যাকেট, লাল শার্ট আর চুলে লাল স্কার্ফ জড়ানো। সেখানে গিয়েই মুখোমুখি পরিচয় হয় ক্লায়েন্টের সঙ্গে। তার বয়স বাইশ-তেইশের মধ্যে বলে। মনে হয়েছিল হালদারমশাইয়ের। ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে চেপে পৌনে দশটায়। আসানসোল পৌঁছেছিলেন দু’জনে। তারপর ট্রেন বদলে অণ্ডাল জংশন হয়ে। গৌরাঙ্গডিহিতে পৌঁছান বেলা দেড়টা নাগাদ। তারপর মেমসায়েব তাঁকে বলে, বিজয়গড়ে থাকার মতো তেমন হোটেল নেই। তিনি বাসে চেপে বিজয়গড় গিয়ে সেখান থেকে এক্কাগাড়ি ভাড়া করে যেন সারেংডি বনবাংলোয় চলে যান। চৌকিদারকে টাকা দিলেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওখানে সচরাচর কেউ থাকে না। খালি ঘর পাওয়া যাবে। আর আইভি তার সঙ্গে রাত দশটা নাগাদ গিয়ে দেখা করে আসবে। বিজয়গড়ে সে একা সন্ধ্যার বাসে যাবে। ওখানে তার এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে। সেই বন্ধুর স্বামীর নাম যোশেফ। যোশেফের মোটর সাইকেল আছে। কাজেই তার অসুবিধে নেই। তারপর হালদারমশাইকে কী করতে হবে, সে রাত দশটা নাগাদ এই বাংলোতে এসে জানাবে….
ইতিমধ্যে চা এসে গিয়েছিল। চা খেতে খেতে মনে পড়ল, শেয়ালদার হোটেলে থাকার সময় সন্ধ্যাবেলায় পরচুলাপরা লোকটা আইভির চেন ধরে টান দিয়েছিল এবং আইভি হোটেলের সিঁড়িতে ওঠার সময় লকেটটা মুঠোয় চেপে ধরেছিল। এটা হালদারমশাইয়ের মুখে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে বসে শুনেছিলুম। তাই বললুম, হিরে বসানো লকেট নাকি?
হালদারমশাই বললেন, ক্লায়েন্ট সে সম্পর্কে কিছু বলে নাই। শুধু কইছিল, দ্যাট ওয়াজ এ ভেরি ভ্যালুয়েবল অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল অর্নামেন্ট।
বললুম, হিস্টোরিক্যাল–ঐতিহাসিক? কর্নেল!
কর্নেল আমার বক্তব্য আঁচ করে শুধু বললেন, হাঃ! তুমি ঠিকই ধরেছ।
তা হলে তা গলায় ঝুলিয়ে বেড়াত কেন আইভি?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, যে-কারণে রানীমা সিন্দুকের চাবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন।
হালদারমশাই বললেন, সিন্দুকের চাবি? সিন্দুক ক্যান?
হালদারমশাই! সেকেলে অভিজাত বা রাজ-জমিদারদের বাড়িতে সিন্দুক থাকে। এ কোনও নতুন কথা নয়।
বললুম, কর্নেল! বাচ্চুর উপহার। তাই না?
কর্নেল বললেন, তাছাড়া আর কী?
হালদারমশাই বললেন, ক্লায়েন্টের লগে কথা কইয়া বুঝছি, সে এই এরিয়ায় গোপনে থাকতে চায়।
হ্যাঁ। সে এলে তাকে সতর্ক করে দেবেন, পুলিশ তাকে খুঁজছে। কথাটি আবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলুম।
হালদারমশাই একটু অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু অরে দেখলে বুঝবেন মুখোন খুব ইনোসেন্ট। এক্কেরে ইয়ং এজ। শি ইজ নট এ ক্রিমিন্যাল। চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। মুখ দেইখ্যাই কইয়া দিতে পারি ইনোসেন্ট, না ক্রিমিন্যাল।
বুঝলেন না? সব পুলিশ তো আপনার মতো নয়। বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলি। আপনি বিশ্রাম করুন। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে সম্ভবত আজ সন্ধ্যার পরই আপনার দেখা হবে। লকেটের ব্যাপারটাতে গুরুত্ব। দেবেন। তাকে বলবেন, এই লকেট সে কোথায় কার কাছে কীভাবে পেয়েছিল, সে সব খুলে না বললে আপনি ওটা উদ্ধার করে দিতে পারবেন না।
আশা করি, আগামীকাল আপনি রাজবাড়িতে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন। এই চব্বিশটা ঘণ্টা আপনি কষ্ট করে একা থাকুন। একা থাকা আপনার দরকার। তবে সাবধানে থাকবেন। খুব সাবধানে। বিশেষ করে বিকেলের পর থেকে কাল সকাল পর্যন্ত। কুয়াশা আর অন্ধকার শত্রুপক্ষকে সুযোগ দেবে।
গোয়েন্দাপ্রবর শ্বাস ছেড়ে শুধু বললেন, হঃ…
আমরা দুজনে এবার ঘোরালো পথ দিয়ে নেমে এলুম।’কর্নেল বললেন, জনসায়েব গাড়ি নিয়ে সারেংডি ফরেস্টে বেড়াতে গেল। চলো! এই সুযোগে বাংলোর চৌকিদার শিউপুজনের সঙ্গে একটু গল্প করা যাবে।
ততক্ষণে সূর্য উঠেছে এবং কুয়াশা পাতলা হয়ে গেছে। নদীর ব্রিজে গিয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে নলপাহাড়িতে টমসায়েবের বাংলোটা দেখে নিলেন।
এই বাংলোটা টিলার গায়ে। তাই রাস্তাটা সোজা উঠে গেছে গেটে। কর্নেলকে দেখে চৌকিদার এগিয়ে এসে সেলাম দিল। বলল, ছোটসাব তো আভি জঙ্গল চলিয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা শিউপুজন; একটা কথা জানতে চাইছি। ঠিক ঠিক বললে বখশিস পাবে।
শিউপুজন হাসল। কর্নিলসাব! আপনি বড়াসাবের দোস্ত। বড়াসাব জিন্দা থাকলে কেত্ত খুশি হতেন। উনহি না আছে তো কী হয়েছে? কী পুছ করবেন, করুন। আমি ঠিক ঠিক জবাব দিবে।
শিউপুজন! গত কালীপুজোর রাতে তুমি কি বাংলোয় ছিলে?
সামতক ছিল হামি। বিকেলে আইভি মেমসাব এক্কাগাড়ি চেপে আসল। ছোটাসাব আসলেন না। তো হামি উনহির কাছে ছুট্টি লিয়ে বিজয়গড় চলিয়ে গেল। বহু বালবাচ্চা আছে। কালীপূজা দেখবে।
কখন ফিরে এসেছিলে?
এই টাইমে। আইভি মেমসাবকে খুব পেরেসান মালুম হল। হামি ঠিক সমঝালাম! রাতমে উনহির সাথে রাজবাড়ির হারামি লড়কা বাচ্চুবাবু জরুর ছিল। কাহে কী, আইভি মেমসাব একেলা আসলে বাচ্চুবাবু ভি আসবে। হামি ছোটা আদমি কর্নিলসাব! হামি নোকর আছি, আইভি মেমসাব ঔর বাচ্চুবাবু ভি হামাকে বকশিস দিত। ছোটসাবকে হামি কুছু বলিনি। পুলশকে ভি বলিনি। আপনি বড়াসাবের দোস্ত কর্নিলসাব। আপনাকে সব বললাম।…
.
০৭.
কর্নেল টিলার মাথায় অশ্বত্থাগাছে সেক্রেটারি বার্ড বা কেরানি পাখিটাকে দেখতে না পেয়ে নিরাশ হয়েছিলেন। বাংলোর উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে নেমে একটু দূরে ওয়াটার ড্যাম চোখে পড়ল। ঢালে জঙ্গল থাকায় তখন চোখে পড়েনি। কর্নেল বললেন, থাক্। এ বেলা আর ওদিকে নয়। ফেরা যাক।
হাঁটতে হাঁটতে বললুম, শিউপুজন লোকটিকে সরল আর ভিতু মনে হল।
কর্নেল বললেন, তুমি ওকে চেনেন না। ও সরলও নয়, ভিতুও নয়। মাসে এ বাজারে পাঁচশো টাকা মাইনেতে সংসার চালানো কঠিন। তাই রোজগারের নানা ফিকিরে থাকে। বখশিসের লোভে আমাকে যা বলল, অন্য লোককেও তা-ই বলতে ওর দ্বিধা হবে না। তাছাড়া শিউপুজন গোপনে বাংলো ভাড়া দেয়–শনিবার ও রবিবার এই দু’দিন বাদে। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। একটা লোক এই জনহীন বাংলোয় একা রাত কাটায়। কাজেই সে সাহসী। টমসায়েবের কবর আছে। বাংলোর লনের কোণে। ব্যাপারটা এবার চিন্তা করো! ভূতের ভয়ও তার নেই।
তা হলে টাকা দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করাও যায়?
নিশ্চয় যায়। তবে ওসব কথা আপাতত থাক। কফির জন্য মন ছটফট করছে।
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
রাজবাড়ির গেটের বাইরে কালীপদ একা দাঁড়িয়েছিল। কর্নেল বললেন, কী কালীপদ? এখানে কী করছ?
কালীপদ চাপাস্বরে বলল, আজ আবার সেই উড়ো চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছি। আপনারা চলে গেলেন। তারপর আমি ফুলবাগানে কাজ করে জল-টল দিয়ে বাজার করতে বেরুচ্ছি, দেখি চিঠিটা পড়ে আছে।
রানীমাকে দিয়েছ তো?
আজ্ঞে। বলে সে ভেতরে ঢুকল। রানীমা বলছিলেন, কর্নেলসায়েবকে এ বাড়িতে দেখেও কার এত সাহস যে এখনও উড়ো চিঠিতে হুমকি দিচ্ছে?
কর্নেল হাসলেন। উড়ো চিঠি দেওয়া তো আমি আটকাতে পারব না। তুমি শিগগির কফির ব্যবস্থা করো কালীপদ! আর ভটচাযমশাই কেমন আছেন?
খুব কাহিল অবস্থা। পুজো করতে পারেননি। খাঁটিয়ায় মড়ার মত শুয়ে আছেন।
আমাদের ঘরে তালা দেওয়া ছিল না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলুম, সব জানালা খোলা আছে। উত্তরের জানালা দিয়ে তীব্র ঠাণ্ডা আসছিল। তাই উত্তরের দুটো জানালা বন্ধ করে দিলুম। তারপরই চোখে পড়ল, কর্নেলের বিছানার পাশের টেবিলে এক টুকরো ছোট্ট পাথরের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা কাগজ পড়ে আছে। বললুম, কর্নেল! এটা কী?
কর্নেল হাসলেন। আবার কী? আমাকেও উড়ো চিঠিতে হুমকি দিয়েছে। দেখি!
পাথরে বাঁধা চিরকুটটা খুলে উনি পড়লেন। তারপর আমাকে দিলেন। দেখি, একই লাল ডটপেনে লেখা চিঠি :
‘পত্রপাঠ চলে যাও। নতুবা নরবলি হবে। দেবীর রক্ততৃষ্ণা জেগেছে। বাঁচতে চাও তো শীঘ্র পালিয়ে যাও।‘
কর্নেল চিঠিটা নিয়ে রানীমাকে লেখা আগের তিনটে চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে বললেন, একই হাতের লেখা। মনে হচ্ছে, একটু ভয় পেয়েছে। তাই দেবীর। নাম করে হুমকি দিয়েছে।
উনি চিঠিগুলো কিটব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন। বললুম, উত্তরের জানালা তো বন্ধ ছিল। কে খুলল?
কর্নেল বললেন, বিছানা পরিপাটি গুছোনো আছে দেখতে পাচ্ছ না? কালীপদ বা তার বউ হয়তো জানালা খুলে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে কালীপদ কফির ট্রে নিয়ে এল। তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ওই জানালা কি তুমি খুলে দিয়েছিলে?
কালীপদ বলল, আজ্ঞে না। বউ আপনাদের ঘর পরিষ্কার করছিল। সে-ই খুলেছে। কেন স্যার?
বললুম, বড্ড ঠাণ্ডা আসছিল।
আজ্ঞে, রানীমার এই হুকুম আছে। সে শীত হোক কি বর্ষা হোক। ঘরের বাতাস বের করে না দিলে নাকি অসুখ হবে। আপনারা গিয়ে দেখে আসুন। রানীমা উত্তরের জানালা খুলে বসে আছেন। কালীপদ একটু হাসল। উনি মোটাসোটা মানুষ তো! শীতে ওঁর আরাম। গরমে শুধু হাঁসফাঁস করে বেড়ান। দু’বেলা চান করেন। এই শীতে ভোরবেলা চান করে মন্দিরে যান। ভাবুন!
কালীপদ চলে গেল। কর্নেলের কফি পান দেখে মনে হল, সত্যি ওঁর কফির জন্য মন ছটফট করছিল। কফি শেষ করে উনি বললেন, তুমি বসো জয়ন্ত! আমি একবার ভটচাযমশাইকে দেখে আসি। বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ভাববেন, একবারও ওঁকে দেখে এলুম না। কার রাত্রেও একবার গিয়ে খবর নেওয়া উচিত ছিল।
কর্নেল চলে গেলেন। আমি ধীরেসুস্থে কফি খাচ্ছিলুম। সেই সঙ্গে বিস্কুট, পটাটোচিপস আর চানাচুর সাবাড় করছিলুম। আমার খিদে পেয়েছিল খুব।
খাওয়ার পর নীচের লনে গিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে রইলুম। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম, কর্নেল মন্দিরের চত্বর থেকে বেরিয়ে ফুলবাগানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ফোয়ারা এবং ইঁদারার পাশে পাম্প-ঘরের আড়ালে তিনি অদৃশ্য হলেন। কালীপদ হাসিমুখে ডাইনিং রুমের বারান্দা থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। তারপর সে-ও ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল।
তারপর প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গেল। বুঝলুম, কর্নেল এবং কালীপদ ক্যাকটাস নিয়ে আলাপ করছেন। জবা বারান্দা থেকে বলল, রানীমা খেতে বলছেন সায়েবদের। ন’টা বেজে গেছে।
রানীমাকেও দেখলুম মোটা ছড়ি হাতে বারান্দার একটা থামের কাছে এসে দাঁড়ালেন। ডাকলেন, কালী। কথা শুনতে পাচ্ছিস না?
কর্নেলকে এতক্ষণে দেখতে পেলুম। পেছনে কালীপদ। কর্নেল কালীপদকে কিছু বললেন। সে লন হয়ে আমার কাছে চলে এল। বলল, ব্রেকফাস্ট করে আসুন স্যার। আমি দরজা বন্ধ করে এখানে থাকছি।
ডাইনিং রুমে খেতে বসে কর্নেল বললেন, ভটচাযমশাইয়ের শেষ রাত্রে জ্বর এসেছিল। ছেড়ে গেছে। কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। বরং ওঁর কবরেজমশাইকে ডেকে আনা উচিত ছিল।
রানীমা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। মুখটা আজ খুবই গম্ভীর। তিনি বললেন, কালী বাজারে গিয়ে ভবেশ কবরেজকে খবর দিয়ে এসেছে। এতক্ষণে তার আসা উচিত ছিল। ভবেশের এত গরজ কেন বুঝি না। ওদিকে অরবিন্দকে খবর দেওয়া হল। এখনও তার পাত্তা নেই। আগে খবর পেলেই চলে আসত। গাড়ি আছে। ড্রাইভার আছে। বর্ধমান থেকে আসতে কতক্ষণই পা লাগে?
কর্নেল বললেন, মিসেস সিংহ বড় বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি এবার ঠিক পথে বা বাড়িয়েছি।
রানীমা ঘরে ঢুকে বললেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না কর্নেলসায়েব! আমার রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। আপনি পাশে আছেন। এখন আমার আর কোনও চিন্তা নেই। চিন্তা শুধু নিজের রং ডিসিশন নিয়ে। বাচ্চুকে এ বাড়ি ঢোকাব, না এসব ঝামেলা হবে। তার বাবা-মায়ের কাছে আমি চিরকালের জন্য অপরাধী থেকে গেলুম।
রানীমার চোখে জল এসেছিল। চোখ মুছে বেরিয়ে গেলেন।
যাওয়ার পর কর্নেল ও আমি নিজেদের ঘরে ফিরে এলুম। কালীপদ একটু হেসে বলল, কুমড়োপটাশটা দেখলেন তো! কী পেল্লায় হয়ে গেছে। ওটার টব বদলাতে হবে।
কর্নেল বললেন, রানীমা বলছিলেন ভবেশ কবরেজমশাই এখনও কেন আসছেন না!
দশটার আগে আসতে পারবেন না। খুব নামকরা কবরেজ। দূর-দূরান্ত থেকে বিলিতি পাস ডাক্তারদের কাছে সর্বস্বান্ত হয়ে কত রোগী ওঁর কাছে এসে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকছে। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী!
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আচ্ছা কালীপদ, বিজয়গড়ে তো বেশ কিছু খ্রিস্টান আছে?
কালীপদ বলল, তা আছে। ওরা আলাদা পাড়ায় থাকে। ক’ঘর অ্যাংলো সায়েব মেমও আছে। আদিবাসী খ্রিস্টানের সংখ্যাই বেশি।
তুমি যোশেফ নামে কাকেও চেনো?
আজ্ঞে খুব চিনি। কালীপদ একটু হাসল। বাচ্চুবাবুর সঙ্গে তার ভাব ছিল। মাঝে মাঝে বাচ্চুবাবুর সঙ্গে রাজবাড়িতে আসত। একের নম্বর ফাটকাবাজ। বউয়ের রোজগার খায়। বউ হল গে মিশন ইস্কুলের মাস্টারনী। বাচ্চুবাবু নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করেছিল। কিন্তু যোশেফের পেছনে নারায়ণবাবুর পার্টি আছে। নারাণবাবু ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন। তবু হাল ছাড়েননি।
এই সময় গেটের দিকে কেউ ডাকল, কালী! ও কালীপদ!
কালীপদ দেখে বলল, কবরেজমশাই এসেছেন।
শোনো। আমরা একটু বেরচ্ছি। তুমি দরজায় তালা এঁটে দিয়ো। কেমন?
আজ্ঞে। বলে কালীপদ দৌড়ে গিয়ে গেট খুলতে গেল।
দেখলুম, রোগাটে চেহারার এক ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। কেরিয়ারে একটা মোটাসোটা ব্যাগ। কালীপদ তাকে বলল, সোজা ঠাকুরমশাইয়ের ঘরে চলে যান কবরেজমশাই।…
একটু পরে আমরা বেরলুম। ধ্বংসস্তূপের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে মোরাম রাস্তায়, তারপর বড় রাস্তায় গেলুম। একটা খালি সাইকেল রিকশা দাঁড় করিয়ে কর্নেল বললেন, খ্রিস্টানপাড়া যাব।
বাঙালি রিকশাওয়ালা বলল, দশ টাকা লাগবে স্যার!
ঠিক আছে। তুমি যোশেফ নামে কাকেও চেনো?
রিকশাওয়ালা হাসল। তাকে বিজয়গড়ে কে চেনে না স্যার? মার্কামারা লোক।
বিজয়গড়ের বাজার পেরিয়ে রিকশা ডানদিকে ঘুরে অলিগলি রাস্তায় চলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে একটা গির্জা বাড়ি দেখতে পেলুম। খ্রিস্টানপাড়া বেশ সাজানো-গোছানো মনে হল। একটা করে ছিমছাম বাড়ি আর সামনে ফুলবাগান। একটা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়াল। একতলা বাড়িটার গেটে নেমপ্লেট আছে। ‘জে ডি’সুজা’। তার তলায় ‘এম ডি’সুজা’। কর্নেল বললেন, পর্তুগিজ বংশধর মনে হচ্ছে।
গেটে কলিং বেলের স্যুইচ টিপলেন। একটু পরে একজন ফ্ৰকপরা আদিবাসী কিশোরী বারান্দায় বেরিয়ে বলল, সাবলোক বাহার গেয়া।
কর্নেল বললেন, মেমসাবকো বোলাও।
কর্নেলের চেহারা দেখে সে সম্ভবত খ্রিস্টান এবং পাদ্রিসায়েব ভেবেছিল।
কারণ কথাটা শুনে সে বুকে ক্রশ এঁকে মাথা একটু ঝাঁকিয়ে বলল, কঁহাসে আয়া আপলোগ?
দুমকা মিশনসে।
তামাটে রঙের একজন মেমসায়েব পর্দা তুলে দরজায় উঁকি দিচ্ছিল। তার পরনে সোয়েটার এবং স্কার্ট। হাঁটু থেকে মোজা পরা। কর্নেল বললেন, মর্নিং মিসেস ডিসুজা! আই হ্যাভ কাম টু মিট ইয়োর হাজব্যান্ড মিঃ যোশেফ। আই অ্যাম কর্নেল এন সরকার।
আর ইউ কামিং ফ্রম ডুমকা মিশন?
ইয়া।
মিসেস ডিসুজা সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, যোশেফ হ্যাজ নাথিং টু ডু উইদ এনি খ্রিস্টায়ান মিশন।
হি হ্যাজ অ্যাপ্লায়েড ফর এ জব।
ইজ ইট ও মাই গড! হোয়াই শুড হি ডু দ্যাট? ইউ হ্যাভ কাম টু এ রং ম্যান আই থিংক্।
প্লিজ টেল হিম দ্যাট–
হি ইজ নট অ্যাট হোম নাও। ইউ মে ফাইন্ড আউট হিম ইন দ মার্কেট এরিয়া। বলে মিসেস ডিসুজা ভেতরে ঢুকে গেলেন।
আদিবাসী কিশোরীটি ঝাঁটা হাতে নীচের ফুলবাগানে নেমে এল। তারপর বলল, ডাব্বকা চায় দুকানমে দেখিয়ে।
কর্নেল চুপচাপ পা বাড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে বললুম, আইভির এ বাড়িতে থাকার কথা।
কর্নেল বললেন, আছে। ডানদিকের ঘরের জানালার পর্দার ফাঁকে তার নাক দেখলুম!
নাকটা যে আইভির, তা কী করে বুঝলেন?
কর্নেল হাসলেন। নাকের আমি নাকের তুমি নাক দিয়ে যায় চেনা। সুকুমার রায়ের পদ্যে অবশ্য গোঁফ আছে। আসলে পোর্তুগিজ নাক আর ইংলিশ নাকের তফাত আছে। যাই হোক, সেটা অ্যানথ্রোপোলজির আওতায় পড়ে।…
বাজার এলাকায় গিয়ে একে-তাকে জিজ্ঞেস করে ডাব্বর চায়ের দোকানের খোঁজ পাওয়া গেল। সেখানে একটা মোটর সাইকেলও দেখলুম। ব্যাগি সোয়েটার আর জিনস পরা এক যুবক মোটর সাইকেলটার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। মাথায় একরাশ বিশৃঙ্খল চুল। কানে রিং। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তো বটেই, আমার ধারণামতে পর্তুগিজ বংশধর। কর্নেল গিয়ে তাকে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং মিঃ যোশেফ।
সে কড়া চোখে তাকাল। ইয়া?
কর্নেল তাকে তার নেমকার্ড দিলেন। সে কার্ডটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
আই হ্যাভ সামথিং টু নো ফ্রম ইউ।
হোয়াট্টাবাউট দ্যাট?
কর্নেল আস্তে বললেন, অ্যাবাউট ইয়োর ফ্রেন্ড বাচ্চু।
যোশেফ চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে বলল, ইউ আর আ ন্যাচারালজিস্ট।
আ রিটায়ার্ড কলোনেল। হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট বাচ্চু?
প্লিজ লেট আস টক সামহোয়্যার প্রাইভেটলি।
যোশেফ সন্দিগ্ধ দৃষ্টে একটুখানি তাকিয়ে থাকার পর বলল, ও কে! কাম উইদ মি।
কর্নেল আমাকে বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো জয়ন্ত!
যোশেফ কয়েক পা এগিয়ে একটা ঝাকড়া গাছের তলায় দাঁড়াল। তারপর দু’জনের মধ্যে প্রায় মিনিট দশেক কথাবার্তা হল। লক্ষ্য করলুম, যোশেফকে প্রথমে যতটা উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, তা ক্রমশ কমে গেল এবং সে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
কালের সঙ্গে ফিরে এসে সে বলল, ও কে কর্নেল সরকার দ্য ন্যাস্টি ডগস নো হাউ টু বার্ক। বাট দে ডু নট নো হাউ ট বাইট।
থ্যাঙ্কস যোশেফ! গুড বাই।
বাই!
কর্নেল একটা সাইকেল রিকশা ডেকে বললেন, রাজবাড়ি।
রিকশাতে চেপে বললুম, কী কথা হল?
যথাসময়ে জানতে পারবে। মুখটি বুজে থাকো।…
রাজবাড়িতে ঢুকে দেখি, একটা মোটরগাড়ি বটতলায় দাঁড়িয়ে আছে। কালীপদ বলল, বোসসায়েব এসে গেছেন। রানীমার ঘরে আছেন এখন।
কর্নেল বললেন, দরজা খুলে দাও। ঘরে ঢুকে একটু রেস্ট নিই।
কালীপদ দরজায় তালা এঁটে রেখেছিল। খুলে দিয়ে বলল, বোসসায়েব রানীমাকে বলছিলেন, আপনার নাম ওঁর জানা। উনি বিকেলেই চলে যাবেন। আপনার সঙ্গে আলাপের জন্য ব্যস্ত। তা স্যার, যোশেফের দেখা পেলেন?
হ্যাঁ। কবরেজমশাই কী বলে গেলেন?
ওষুধ দিয়ে গেলেন। ঠাকুরমশাইকে হাঁটাচলা করতে বারণ করলেন।…
একটু পরে কর্নেলের মতো তাগড়াই চেহারার গুঁফো এক ভদ্রলোক এসে নমস্কার করে বললেন, আমার সৌভাগ্য! লেজেন্ডারি ফিগার কর্নেলসায়েবকে চর্মচক্ষে দর্শন করলুম। আমি অরবিন্দ বোস। বর্ধমান রেঞ্জের ডি আই জি।
কর্নেল তাঁকে অভ্যর্থনা করে বসিয়ে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আপনাদের সোর্স থেকে জেনেছেন, বাচ্চুবাবু নাকি আর বেঁচে নেই। সেই সোর্স কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
অরবিন্দ বোস বললেন, বিশ্বাসযোগ্য। সে কালীপুজোর পরদিন ভোরবেলায় সাইকেলে চেপে নদীর ওপারে একটা আদিবাসী বস্তিতে মজুর ডাকতে যাচ্ছিল। টমসায়েবের বাংলোর নীচে গিয়ে সে রাস্তার ওপর অনেকটা রক্ত দেখতে পায়। একটা রক্তমাখা চপ্পলও পড়েছিল। কিন্তু সে পুলিশকে ভয়ে কিছু জানায়নি। বুঝতেই পারছেন, সাধারণ মানুষেরা পুলিশকে এমনিতে এড়িয়ে চলে। ফেরার সময় সে রক্ত দেখেছিল। কিন্তু চপ্পলটা ছিল না। সেদিন রাত্রি থেকে আকাশ মেঘলা ছিল। দুপুর নাগাদ বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে রক্তটা ধুয়ে যায়। আমরা টমসায়েবের বাংলোর চৌকিদারকে জেরা করেছিলুম। সে কিছু বলতে পারেনি। সে কালীপুজোর রাত্রে বিজয়গড়ে তার বাড়িতে ছিল। তার প্রমাণ পেয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাচ্চুর বন্ধুদেরও অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাদের কাছে কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
কর্নেল বললেন, আপনি নাকি বিকেলে চলে যাচ্ছেন?
আমাকে আসানসোল যেতে হবে। একটা বড় হাঙ্গামা হয়েছে গত রাত্রে। তবে আমি লোকাল পুলিশকে আপনার কথা বলে যাব। সবরকমের সাহায্য আপনি পাবেন।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আপনি আজ রাত্রে থাকলে একটা নাটক দেখতে পেতেন।
.
০৮.
কর্নেলের কথা শুনে ডি আই জি অরবিন্দ বোস একটু হেসে বললেন, আপনি শিওর যে আজ রাতে একটা নাটক হবে?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, খানিকটা শিওর। আসলে আজ রাতে আমি একটা ফাঁদ পেতে রাখব ঠিক করেছি। অন্তত নাইনটি নাইন পারসেন্ট চান্স আছে যে, ফঁদে লোকটা পা দেবে।
লোকটা! বোসসায়েব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। কর্নেলসায়েব! আমি হেঁয়ালি পছন্দ করি না।
আপনার থাকার সুযোগ যখন নেই, তখন কথাটা হেঁয়ালি হয়েই থাক। পরে যথাসময়ে জানতে পারবেন।
বোসসায়েব কিছুক্ষণ গোঁফে তা দেওয়ার পর বললেন, আমি দিদার কাছে শুধু এটুকু শুনেছি যে তার জীবন নাকি বিপন্ন। দিদাও খুলে কিছু বলেননি। আমি রাজবাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প বসাতে চাইলুম। তাতেও তার আপত্তি। যাই হোক। এটা স্পষ্ট, দিদাকে কেউ মার্ডার করতে পারে। হা–তাকে মার্ডার করলে সিংহবাহিনী মেলা কমিটির হাতে রাজবাড়িটা চলে যাবে। বাচ্চুর বাবা তার শেয়ার দাদামশাইয়ের জীবদ্দশায় বেচে টাকা নিয়েছিলেন। এদিকে বাচ্চু বেঁচে নেই। তা হলে আপনার সোকলড ‘লোকটা’ মেলা কমিটির প্রভাবশালী চাঁইদের ভাড়া করা কিলার। এই তো?
কর্নেল হাসলেন। আপনার অঙ্কটা ঠিক হতেই পারে। তবে আপনাকে খবর দিয়ে এখানে আপনার উপস্থিতি চেয়েছিলুম একটা মাত্র কারণে। তা হল, বাচ্চু যে সত্যি খুন হয়েছে, তার সলিড প্রমাণ আপনার হাতে কতটা আছে তা জানা। কিন্তু শুধু জানতে পারলুম, আপনাদের সোর্স টমসায়েবের বাংলোর কাছে রাস্তায় খানিকটা রক্ত আর একপাটি জুতো দেখেছিল। অথচ বাচ্চুর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দূরে কোথাও জঙ্গলের মধ্যে বা পাহাড়ে পুঁতে ফেললে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এই এরিয়ায় ভূ-প্রকৃতির যা অবস্থা, তা তো আপনি নিজেও দেখছেন। দিদা বলছিলেন, আপনি আগেও এসেছেন। অবস্থা তত কিছু বদলায়নি। তবু পুলিশের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হয়নি।
আচ্ছা মিঃ বোস, টমসায়েবের মেয়ে আইভির সঙ্গে বাচ্চুর নাকি মেলামেশা ছিল। আইভিকে নিশ্চয় পুলিশ জেরা করেছে?
অরবিন্দ বোস গম্ভীর মুখে বললেন, সেই মেয়েটাই তো বাচ্চুর সর্বনাশের কারণ। তার দাদা জন তাকে চিত্তরঞ্জন টাউনশিপে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দাদার অমতে মেয়েটা একজন দেশি খ্রিস্টানকে বিয়ে করেছিল। সেই লোকটা আবার চোর-জোচ্চোর টাইপ। অফিসের টাকা চুরি করে ফেরার হয়েছে। ওদের দুজনের নামেই হুলিয়া জারি করা হয়েছে।
তা হলে আইভিকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া যায়নি?
নাহ্। আইভিকে পেলে কিছু ক্লু বেরিয়ে আসত। এমনকি আমার সন্দেহ, আইভিকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে বাচ্চুকে মারা হয়েছে। আপনাকে খুলেই বলছি, কালীপুজোর দিন বিকেলে আইভি তার বাবার বাংলোয় এসেছিল। একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে সে এসেছিল। সেই গাড়ির মালিক লামিয়া নিজেই পুলিশকে কথাটা জানিয়েছিল। তারপর আইভির নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়।
বিজয়গড়ে মুসলিম মহল্লা আছে। আপনার কথা শুনে মনে পড়ল।
আছে। এখান থেকে কাছেই। বিজয়গড়ে ঢোকার মুখে বাঁদিকে দেখতে পাবেন।
কর্নেল বললেন, শর্টকাটে রাজবাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে যাওয়া যায়। তাই না মিঃ বোস?
হ্যাঁ। তবে ওদিকে গেলে মুসলিম গোরস্তান পড়বে।
কর্নেলকে উত্তেজিত দেখাল। বললেন, গোরস্তানটা আমি দেখেছি। আট বছর আগের কথা। ওখানে এক ঝাক লাল ঘুঘু দেখেছিলুম।
এতক্ষণে ডি আই জি সায়েবের মুখে হাসি ফুটল। বললেন, আপনার কিছু হবির কথা শুনেছি।
হ্যাঁ। লাল ঘুঘু এখন প্রায় বিরল প্রজাতির পাখি বলা চলে। ওরা দল বেঁধে থাকে। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।
ভাবলুম, হয়তো এখনই বাইনোকুলার নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। কিন্তু তারপর উনি বসলেন। চাপাস্বরে বললেন, মিঃ বোস! আপনি একটা ইনফরমেশন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে যেতে পারবেন?
বলুন!
কালীপুজোর দিন মুসলিম মহল্লার কেউ মারা গিয়েছিল কি না। মারা গিয়ে থাকলে তার কবর কোনটা। আপনি লোক্যাল থানার কোনও অফিসার পাঠিয়ে কথাটা জেনে নিতে পারেন।
অরবিন্দ বোস আবার কর্নেলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর একটু হেসে সোয়েটারের ভেতর হাত ভরে একটা সেলুলার ফোন বের করলেন। অ্যান্টেনা টেনে উনি পশ্চিমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফোনের বোতাম টিপে একটু পরে চাপা গলায় কথা বলতে থাকলেন। তারপর হাতের ঘড়ি দেখে একটু জোরে বললেন, আই অ্যাম স্টার্টিং অ্যাট টু ও’ক্লক শার্প।… ও কে। থ্যাঙ্কস।…
অ্যান্টেনা ফোনে ঢুকিয়ে ফোনটা আবার সোয়েটারের ভেতর চালান করে বোসসায়েব বললেন, আমার গাড়িতে রেডিও ট্রান্সমিশনের ব্যবস্থা আছে। তবে এই কর্ডলেস ফোনটা তিন কিলোমিটারের মধ্যে ব্যবহার করা যায়। দেশটা তো এখনও আমেরিকা হয়ে ওঠেনি। এনিওয়ে, আপনার উদ্দেশটা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয় কর্নেলসায়েব।
কর্নেল বললেন, একটা চান্স নিচ্ছি মাত্র।
অরবিন্দ বোস হঠাৎ নড়ে বসলেন। মাই গড! আপনি কি ভাবছেন–
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিলেন। জাস্ট এ চান্স! শুধু ইনফরমেশনটা পেলেই যথেষ্ট।
মে বি ইউ আর রাইট।
যদি আমার অঙ্কটা মিলে যায়, তা হলে অগত্যা আমাকে আজ রাত্রে নয়, আগামীকাল রাত্রে ফাঁদটা পাততে হবে।
ডি আই জি সায়েব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, দিদার কাছে যাই। তো যদি আপনি আমাকে আগামীকাল রাত্রে পেতে চান, কালীকে থানায় পাঠিয়ে আমার বাড়িতে মেসেজ দিতে বলবেন। মেসেজ না পেলে আমি কিন্তু আসছি না। আই। হ্যাভ লট অব থিংস টু ডু ইউ নো!
উনি বেরিয়ে যাওয়ার পর বললুম, ভদ্রলোক একটু গোঁয়ার টাইপ। এমন টোনে আপনার সঙ্গে আজ পর্যন্ত কোনও মহারথীকে কথা বলতে শুনিনি। সি বি আইয়ের ডিরেক্টর পর্যন্ত আপনাকে সম্মান করেন।
কর্নেল হাসলেন। না, না! উনি আমাকে অসম্মান করেননি। আসলে উনি চাইছিলেন, তুরুপের তাসটা যেন ওঁকে দেখাই। এটা মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল জয়ন্ত!
কিন্তু হঠাৎ কবর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন?
চেপে যাও। স্পিকটি নট।
কিছুক্ষণ পরে কালীপদ এসে বলল, স্নানের জল গরম করা হয়েছে স্যার!
কর্নেল বললেন, আজ আমি স্নান করছি না। জয়ন্ত করবে।
বললুম নাহ্। ইচ্ছে করছে না।
কালীপদ হাসতে হাসতে বলল, তা হলে জলটা আমার ভোগে লাগুক। বোসসায়েবও স্নান করবেন না। ওঁর ড্রাইভার চান করতে চায় তো ঠাণ্ডা জলেই করুক।…
আজ খেতে একটা বেজে গেল। বোসসায়েব রানীমার সঙ্গেই বেশি কথা বললেন। মেলা কমিটিতে যত প্রভাবশালী লোকই থাক, রাজবাড়ি উনি তাদের হাত থেকে বাঁচাবেন। বরং বাড়িটা ওঁর দিদা যদি উইল করে সরকারকে দানের ব্যবস্থা করেন, এটা একটা কলেজ হতে পারে। রানীমা সকৌতুকে বললেন, সবাই আমার মৃত্যুর দিন গুনছে। দেখলেন তো কর্নেলসায়েব!
খাওয়ার পর বেসিনে হাত ধুয়ে বোসসায়েব বারান্দায় গেছেন, সেই সময় পি পিঁ শব্দ কানে এল। উনি সোয়েটারের ভেতর হাত ভরে সেলুলার ফোন বের করে অ্যান্টেনা টেনে সাড়া দিলেন। দেখলুম, রানীমা তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
কর্নেল বললেন, চলো জয়ন্ত! চুরুট টানার আগে কোনও কথা নয়।
আমরা ঘরে ঢুকেছি, এমন সময় ফোন কানের কাছে রেখেই বোসসায়েব এলেন। ক্রমাগত উনি হু, ও কে ইত্যাদি বলে যাচ্ছিলেন। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন। বোসসায়েব ফোনটা সোয়েটারের ভেতর ঢুকিয়ে কর্নেলের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, ইউ আর রাইট কর্নেলসায়েব। এস আই রামশরণ শর্মাকে ওরা কবরটা দেখিয়ে দিয়েছে। ওরা ভিড় করে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিল। শর্মা ওদের প্রশ্নের জবাব দেয়নি। বাট দে উইল নট অ্যালাউ এনিবডি টু–
কর্নেল দ্রুত বললেন, দ্যাট আই নো মিঃ বোস!
দেখবেন মশাই, যেন হাঙ্গামা না বাধে! বলে ডি আই জি বেরিয়ে গেলেন।…
অভ্যাসমতো ভাতঘুম দিতে গিয়ে কালকের মতোই পুরো ঘুমের কবলে পড়েছিলুম। কালীপদর ডাকে চারটেয় উঠে বসতে হল। কালীপদ চা দিয়ে বলল, কর্নেলসায়েব বেরিয়েছেন।
বোসসায়েব?
উনি দুটোর সময় চলে গেছেন। রানীমা এত করে বললেন, থাকলেন না। আসানসোলে কী কাজ আছে। বোসসায়েব বড় একগুঁয়ে মানুষ।
পাঁচটা বাজতে না বাজতে রাজবাড়িতে আলো জ্বলে উঠল। তার একটু পরে কর্নেল ফিরে এলেন। কালীপদ ওঁর জন্য কফির ব্যবস্থা করতে গেল। বললুম, কোথায় গিয়েছিলেন আজ?
লাল ঘুঘুর ঝাঁক দেখতে।
মুসলিম কবরখানায় নাকি?
হ্যাঁ।
তারপর?
তারপর আবার কী?
সেই কবরটা দেখে এসেছেন কি না বলুন?
কর্নেল হাসলেন। এস আই রামশরণ শর্মা বুদ্ধিমান! মাটির কটার কাছে খেলার ছলে গাছের পাতা ছিঁড়ে ছড়িয়ে রেখেছিলেন। যাই হোক, কাছাকাছি একটা ঝোঁপের ভেতর একপাটি চপ্পল পেয়েছি। সেটা কিটব্যাগে প্লাস্টিকের মোড়কে আছে। মজাটা হল, চপ্পলটার পেছনের স্ট্র্যাপ মজবুত। তাই পা থেকে খুলে যায়নি অন্য পাটির মতো।
হাঁ করে তাকিয়ে ছিলুম। এবার বললুম, বুঝে গেছি। বাচ্চুবাবুর ডেডবডি
চুপ!
কালীপদ এসে বলল, কফি রেডি ছিল। জয়ন্তবাবু চা খেয়েছেন। এবার কফি খান। পাঁপরভাজা এনেছি।
জিজ্ঞেস করলুম, ভটচাযমশাইয়ের কী অবস্থা?
দুপুরে দেখলুম, কাঁচকলা সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। লেবু চাইলেন। গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে এলুম। তবে চেহারা দেখে মনে হল, একটু সুস্থ হয়েছেন। এ বেলা উপোস করবেন বলছিলেন।
কালীপদ চলে যাচ্ছিল। কর্নেল তাকে ডাকলেন। কালীপদ! শোনো।
বলুন স্যার?
তোমার কি মনে আছে বাচ্চুবাবু কেমন জুতো পছন্দ করত?
কালীপদ অবাক হয়ে বলল, কেন স্যার?
এমনি জিজ্ঞেস করছি।
স্যান্ডেল বা চপ্পল পরতেন। কখনও পামসু বা বুট পরতে দেখিনি।
পেছনে স্ট্রাপ দেওয়া চপ্পল?
আজ্ঞে। ওঁর ঘরেই তো কত নমুনা আছে। লক্ষ্য করেননি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। লক্ষ্য করেছিলুম। ঠিক আছে।
কালীপদ সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে চলে গেল। বললুম, ছ্যা ছ্যা! ওই জুতো আপনি কিটব্যাগে ভরে রেখেছেন?
রক্তের ছিটে কোথাও আছে কি না পরীক্ষা করতে হবে। হয়তো বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। রক্তের ছিটে কালো হয়ে গেছে। তবু চেষ্টা করব। তারপর ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম, টমসায়েবের বাংলো থেকে কবরখানা তো বেশ দূরে। বাচ্চুর লাশ বয়ে আনা এবং টাটকা কবরে ঢোকানো কষ্টসাধ্য কাজ। একজনের পক্ষে কি সম্ভব?
কর্নেল দাড়ি থেকে কী একটা ফেলে দিয়ে বললেন, নাহ্। অন্তত দু’জন লোক দরকার। খুনীর সঙ্গী ছিল। একজন হতে পারে। দু’জনও হতে পারে।
এই সময় বাইরে দূরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। কর্নেল উঠে গিয়ে উত্তরের একটা জানালা খুললেন। তারপর জানালাটা বন্ধ করে বললেন, মোটর সাইকেলের শব্দ। সম্ভবত যোশেফ আইভিকে নিয়ে সারেংডির বাংলোয় গেল।
বললুম, আপনি যাবেন না?
নাহ। যোশেফকে বলা আছে, হালদারমশাইকেও মোটর সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে রাজবাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ওর মোটর সাইকেলে ডাবল কেরিয়ার আছে। একাধিক সঙ্গী নিয়ে ঘোরে কি না।
রানীমাকে তা হলে বলে রাখা উচিত।
ব্যস্ততার কিছু নেই। সময়মতো বলব, আমার একজন গেস্ট আসার কথা। তবে রাতের খাওয়া হালদারমশাই ওখানেই খেয়ে নেবেন। যোশেফকে বলে দিয়েছি।…
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো। রানীমাকে কথাটা এবার বলে আসি। কালীপদ দেখছি এ ঘরের তালাচাবি টেবিলে রেখেছে। তালা এঁটেই বেরুব।
বললুম, আমি গিয়ে কী করব? নড়তে ইচ্ছে করছে না।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, একা থাকলে কাল সন্ধ্যার মতো ভয় পেয়ে ফায়ার আর্মস বের করবে। কী দেখতে কী দেখে হয়তো গুলি ছুঁড়ে বসবে। আমি রিস্ক নিতে চাই না। তুমি মিথ্যে একটা সিন ক্রিয়েট করো।
ওঁর কথায় একটু চটে গিয়ে বললুম, কাল সন্ধ্যায় আমি ভূত না দেখলেও মানুষ দেখেছিলুম, সেটা তো সত্যি। মানুষটা যে ভটচাযমশাই, তা-ও সত্যি। উনি না হয়ে রানীমার শত্রুপক্ষের কেউ ওভাবে চুপি চুপি ফুলবাগানে ঘাপটি পেতে থাকতেও পারত। কাজেই আমি সিন ক্রিয়েট করতে বাধ্য হয়েছিলুম।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, নাহ। রানীমার কাছে একটা গুরুত্বপুর্ণ কথা জানতে যাচ্ছি। তুমিও স্বকর্ণে শুনলে মাথা পরিষ্কার হবে। রহস্যের একটা জট খুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
তালা এঁটে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ফুলবাগানের ওদিকটা দেখতে দেখতে গেলুম। আলোর সীমানা শেষে বাউন্ডারি ওয়াল অব্দি আবছা আঁধার। কর্নেল যা-ই বলুন, আমার মনে হচ্ছিল কেউ বা কারা ওখানে ঘাপটি পেতে বসে গোপন চক্রান্ত করছে।
ডাইনিং রুমের সামনে কালীপদ দাঁড়িয়েছিল। কর্নেল তাকে বললেন, কালীপদ! রানীমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
কালীপদ বলল, রানীমা আপনাকে ডেকেছেন। আপনাদের দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। যান। উনি অপেক্ষা করছেন।
রানীমার ঘরের পর্দা সরানো। উনি ইজিচেয়ারে শাল মুড়ি দিয়ে বসেছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, বসুন।
আমরা বসলুম। তারপর কর্নেল বললেন, আগে আমার কথাটা বলে নিই। আমার এক বন্ধু সারেংডি ফরেস্টে বেড়াতে এসেছেন। ফরেস্ট বাংলোয়, তিনি উঠেছিলেন। কিন্তু বাংলোর অবস্থা খুব খারাপ। তাই উনি আজ রাত্রেই চলে আসতে চান। আমাদের ঘরে অন্তত একটা খাঁটিয়া হলেই ওঁর থাকার ব্যবস্থা করা যায়। আপনার অনুমতি পেলে
রানীমা দ্রুত বললেন, কোনও অসুবিধে নেই। পাশের ঘরেও উনি থাকতে পারেন।
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, তা হলে খুলেই বলি। তিনি একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। এখন প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন কলকাতায়। নাম মিঃ কে কে হালদার। ওঁকে আমার কাজের সুবিধার জন্যই আসতে বলেছিলুম।
রানীমা সোজা হয়ে বসলেন। তা হলে ওঁকে জঙ্গলে ফেলে রেখেছেন কেন? এটা উচিত হয়নি।
ওঁকে বাইরে রাখার উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আপনার শত্রুপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে উনি কাজ করতে পারেন।
রানীমা একটু হেসে বললেন, কথাটা শুনে ভাল লাগল। আমি জানতুম, আপনি একটা হেস্তনেস্ত না করে যাবেন না। তো কালীকে ওঁর জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলি।
না। উনি খেয়ে আসবেন। বলে কর্নেল উঠে দরজার উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে নিলেন। তারপর বললেন, আপনার বলার কথা পরে শুনছি। আগে আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিন। প্রশ্নটা এখানে এসেই করা উচিত ছিল। কিন্তু তখন আমি একটু বিভ্রান্ত ছিলুম। যাই হোক, আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি বাচ্চুবাবুকে সিন্দুকের এক নম্বর চাবি কী ভাবে দিয়েছিলেন? শুধুই কি চাবিটা দিয়েছিলেন? নাকি চাবিটা কোনও জিনিসের ভেতর লুকনো ছিল?
রানীমা বললেন, ঠিক এই কথাটা বলার জন্যই আপনাকে ডেকেছি। স্যাকরা ডেকে একটা সোনার চেন এবং একটা মোটা লকেট তৈরি করিয়েছিলুম। লকেটের ভেতরটা ছিল খালি। একটু অড সাইজ। একটা দিকে জোরে চাপ দিলে ভোলা যায়। তার ভেতর সিন্দুকের এক নম্বর চাবি ছিল। চাবিটা এক ইঞ্চি লম্বা। পেতলের চাবি। দেখাচ্ছি।
বলে তিনি পেটের কাছ থেকে খুদে ব্যাগ বের করে দ্বিতীয় চাবিটা দেখালেন।
কর্নেল বললেন, এবার আমার কাছে সব রহস্য ফাঁস হয়ে গেল। এরপর কী করণীয়, কাল আপনার সঙ্গে আলোচনা করব।…
.
০৯.
হালদারমশাই এসে পৌঁছেছিলেন রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। আমাদের ঘরেই একটা ক্যাম্প খাটে ওঁর বিছানার ব্যবস্থা করে রেখেছিল কালীপদ। তিনি খেয়ে এসেছিলেন। শুধু এক কাপ কফি খেতে চাইলেন। কালীপদ শিগগির কফি দিয়ে গেল।
কফি খেতে খেতে উনি যা বললেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই…
আইভি চিত্তরঞ্জন টাউনশিপে গিয়ে জেমস বিশ্বাসকে বিয়ে করার পর গোপনে বাছুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখেছিল। সে সুযোগ পেলেই বাবার বাংলোতে চলে আসত। বাচ্চু সেখানে যেত। আইভির বন্ধু যোশেফ ছিল বাঙুরও বন্ধু। আইভি গেলে যোশেফকে দিয়ে খবর পাঠাত। কালীপুজোর রাতেও তা-ই করেছিল সে। বাচ্চু রাত দশটা নাগাদ বাংলোতে গিয়েছিল। সে সঙ্গে হুইস্কি আর ওয়াইন নিয়ে গিয়েছিল অন্য রাতের মত! বাচ্চু সে রাত্রে খুব মাতাল হয়ে পড়েছিল। তার গলার লকেটটা অনেকে বরাবর দেখেছে। বাচ্চুকে উপহার হিসেবে চেয়েছে। বাচ্চু দেয়নি। সে রাত্রে আইভি লোভ সামলাতে পারেনি। মাতাল বাচ্চুর গলা থেকে খুলে নিয়ে নিজের গলায় পরেছিল। রাত একটা নাগাদ হঠাৎ সেখানে কেউ বাচ্চুকে ডাকাডাকি করে। বাংলোতে বিদ্যুৎ নেই। আইভি বাচ্চুকে ঘুম থেকে জোর করে ওঠায়। লোকটা গেটের কাছে ক্রমাগত ডাকছিল। বাচ্চু শোনামাত্র কেন কে জানে রেগে যায় এবং গাল দিতে দিতে বেরিয়ে লোকটাকে তাড়া করে। স্বভাবত আইভি ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাচ্চু আর ফিরে আসেনি। আইভি পরদিন বেলা ন’টা অব্দি অপেক্ষা করে শর্টকাটে হাঁটতে হাঁটতে বিজয়গড়ের মোড়ে যায়। তারপর বাসে চেপে ফিরে যায় চিত্তরঞ্জন টাউনশিপে। কয়েকদিন পরে সন্ধ্যাবেলায় সে একটা বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে আসছে, আচমকা একটা লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে বলে, কথা আছে। বলেই সে তার গলার দিকে হাত বাড়ায়। আইভি চেঁচিয়ে ওঠে এবং ছুটে পালায়। লোকটাকে সে বিজয়গড়ে থাকার সময় দেখেছিল। তার পরিচয় জানে না। এ ঘটনা শুধু একবার নয়, পরপর তিনবার ঘটেছিল। ভয়ে সে লকেটটা লুকিয়ে ফেলেছিল। ইতিমধ্যে একদিন যোশেফ গিয়ে তাকে খবর দেয়, বাচ্চু নিখোঁজ হয়েছে। পুলিশ আইভিকেও অ্যারেস্ট করতে পারে। আইভি দাদার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তার কিছুদিন পরে জেমস অফিসের ক্যাশ হাতিয়েছিল। সে আইভিকে গোপনে ডেকে কলকাতা পালানোর প্ল্যান করে। তারপর যা ঘটেছে, আমাদের জানা। লোকটা—’দ্যাট স্কাউন্ট্রেল’ কী করে যে আইভি আর জেমসের কলকাতা পালানো টের পেয়েছিল, এটাই আশ্চর্য!
সব কথার শোনার পর কর্নেল বললেন, এমন হতে পারে লোকটাও কলকাতা যাচ্ছিল একই ট্রেনে। দৈবাৎ আইভিদের দেখতে পেয়ে ফলো করেছিল।
বললুম, দৈবাৎ, নাকি সে চরের সাহায্যে নজর রেখেছিল ওদের ওপর?
হালদারমশাই নস্যি নিয়ে বললেন, বুঝি না।
কর্নেল বললেন, আমার অঙ্ক কষা হয়ে গেছে। লোকটা নিজেই চিত্তরঞ্জনে গিয়ে ওত পেতে ছিল। পরেরটুকু দৈবাৎ।
বললুম, দৈবাৎ ব্যাপারটা আকস্মিকতা। অঙ্কে আকস্মিকতার প্রশ্ন ওঠে না।
কর্নেল হাসলেন। আকস্মিকতার পেছনেও গণিতের সূত্র কাজ করে জয়ন্ত! ধরো, গাছ থেকে একটা ফল পড়ল তোমার সামনে। আপাতদৃষ্টে এটা আকস্মিক। কিন্তু ফলটা খসে পড়ার পেছনে প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করছে। ফলটার বোঁটা সেই নিয়মে একটু একটু করে শুকিয়েছে। ওদিকে তুমিও সেখানে উপস্থিত হয়েছ জীবনেরই অলঙঘনীয় নিয়মে। তুমি কোথাও কোনও কাজে যাচ্ছিলে। অথবা সেখানে গিয়ে কোনও উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছিলে। তোমার কোথাও উপস্থিতির পেছনে জীবনেরই নিয়ম কাজ করে। আকস্মিকতার হাত থেকে ত্রাণ নেই।
এতক্ষণে কালীপদ এসে বলল, চলুন স্যার। খাওয়া রেডি। রানীমা আজ সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। রান্না হয়ে গেছে কখন। আমারই আসতে একটু দেরি হল। কর্নেল বললেন, রানীমার শরীর খারাপ নাকি?
আজ্ঞে না। কোনও-কোনওদিন দশটার আগেই শুয়ে পড়েন।
তোমার আসতে দেরি হল কেন?
আর বলবেন না। ঠাকুরমশাইয়ের আবার পেটের গণ্ডগোল। খিড়কির দরজা খুলে পাহারা দিতে হল। তা না হলে আবার আমার সিডবেড নষ্ট করে দিতেন।
খেয়ে আসার পর কর্নেল বলেছিলেন, আজ রাত্রে আর কোনও আলোচনা নয়। হালদারমশাইয়ের খুব ধকল গেছে। শুয়ে পড়ুন। আমিও শুয়ে পড়তে চাই।….
পরদিন ঘুম ভাঙার পর দেখলুম, হালদারমশাই লনে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে রাজবাড়ি দর্শন করছেন। কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। সাড়ে সাতটা বাজে। কিন্তু তখনও কুয়াশার পর্দা দুলছে ইতস্তত। কালীপদর স্ত্রী জবা আমার। জন্য চা আনল। সে মৃদুস্বরে বলল, টুকুনের বাবা বাজারে গেছে। গত রাত্তিরে এক কাণ্ড। রানীমা আপনাদের জাগাতে বারণ করেছিলেন!
জিজ্ঞেস করলুম কী কাণ্ড?
জবা ঘোমটার ভেতর বলল, কে রানীমার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। উনি সুইচ টিপে বেল বাজিয়েছিলেন। টুকুনের বাবা জেগে গিয়েছিল। বল্লম আর টর্চ নিয়ে সারা বাড়ি খুঁজে কাউকে সে দেখতে পায়নি। শত্রুরদের সাহস কত বেড়ে গেছে দেখুন। আপনারা থাকতেও গেরাহ্যি করছে না।
হালদারমশাই কান খাড়া করে শুনছিলেন। মাথায় হনুমান টুপিটি নেই। বললেন, আমাগো ডাকলেন না ক্যান? খুলি উড়াইয়া দিতাম হালার!
জবা চুপচাপ চলে গেল। বললুম, রানীমাকে দেখেছেন হালদারমশাই?
দেখছি। মন্দিরে পূজারতি হয়। ঘণ্টা শুনছিলাম। তারপর দেখলাম এক বৃদ্ধা ছড়ি হাতে, আইতাছেন। কালীপদ কইল, উনি রানীমা। বয়স নাকি আশি বৎসর। বিশ্বাস হয় না।
কালীপদ এল ঘণ্টাখানেক পরে। আমাকে দেখে সে বলল, কাল রাত্তিরে এক কাণ্ড।
তার কথার ওপর বললুম, শুনেছি। জবা বলছিল।
কালীপদ চাপাস্বরে বলল, আজও উড়ো চিঠি। এটাই শেষ চিঠি বলে লিখেছে।
বলেই সে ফুলবাগানের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এই! এই ঠাকুরমশাই! আবার?
দেখলুম, ভটচাযমশাই গাড়ু হাতে বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে হন্তদন্ত চলে যাচ্ছেন। কালীপদ চ্যাঁচামেচি করছিল। রানীমার ধমকে সে থেমে গেল।
হালদারমশাই জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
তাঁকে ভটচাযমশাইয়ের আমাশার কথা সবিস্তারে বলতে হল। তিনি নস্যি নিয়ে খিক খিক করে হেসে অস্থির হলেন।
কর্নেল ফিরে এলেন এতক্ষণে। কিন্তু উনি ঘরে না ঢুকে সোজা এগিয়ে গেলেন। বুঝলুম রানীমার কাছে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরে কালীপদ আমাদের ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকে নিয়ে গেল। ডাইনিং রুমে রানীমা ও কর্নেল বসেছিলেন। হালদারমশাইয়ের সঙ্গে তিনি রানীমার আলাপ করিয়ে দিলেন। হালদারমশাই ঢ্যাঙা মানুষ। কুঁজো হয়ে নমস্কার করে বললেন, আমার বড় সৌভাইগ্য! যদি আপনার কাজে লাগতে পারি, আরও সৌভাইগ্য!
ব্রেকফাস্টের পর রানীমা একটু দ্বিধার সঙ্গে কর্নেলকে বললেন, আপনার কথামতো কাজ করতে আপত্তি নেই। কিন্তু শেষরক্ষা হবে তো?
কর্নেল বললেন, হবে। জানোয়ার ফাঁদে পা দিতে বাধ্য। সে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তা হলে আপনি আমার ঘরে আসুন। জয়ন্ত আর মিঃ হালদার তাদের ঘরে গিয়ে গল্প করুন ততক্ষণ।
আমি ও হালদারমশাই কর্নেলের ইঙ্গিতে চলে এলুম। আমাদের ঘরের সামনে এসে গোয়েন্দাপ্রবর চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল স্যার ফান্দ কইলেন ক্যান?
বললুম, আমি এ বিষয়ে একেবারে অন্ধকারে আছি হালদারমশাই!
হালদারমশাই গম্ভীর মুখে বসে নস্যি নিলেন।..
এদিন দুপুরে খাওয়ার পর কর্নেল বেরিয়েছিলেন। হালদারমশাই কালীপদকে ডেকে রাজবাড়ি পরিদর্শনে বেরুলেন। আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। চারটে নাগাদ কালীপদ যথারীতি চায়ের কাপ এনে আমার ঘুম ভাঙল। বললুম, হালদারমশাই কোথায় গেলেন?
কালীপদ হাসল। ওঁকে রাজবাড়ির সব ঘর দেখালুম। শুধু নীচের তলার একটা ঘর দেখানো হল না। ওই ঘরে অনেক ছবি আর নানারকম মূর্তি আছে। ঘরটার চাবি রানীমার কাছে আছে। হালদারসায়েব ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে মন্দিরে সিংহবাহিনী দর্শন করলেন। এখন রোধ করি রাজবাড়ির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কথা বলতে বলতে হালদারমশাই এসে গেলেন। কালীপদ তার জন্য চা আনতে গেল। গোয়েন্দামশাই বললেন, ভাবা যায় না কী ঐশ্বর্য ছিল এই বাড়িতে। এখনও যেটুকু দ্যাখলাম, তাতেই মনে হইল জাদুঘরে ঢুকছিলাম।
কথাটা বলে উনি হঠাৎ ফিস ফিস করলেন, কালীপদ ট্যার পায় নাই। একখান ঘরের চাবি রানীমার কাছে থাকে। সেই ঘরের তালা ভাঙা। একটু টান দিছি আর বুঝছি। কালীপদরে কই নাই। কর্নেল স্যারেরে জানানো দরকার। আমার চোখ জয়ন্তবাবু। চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি।
চমকে উঠে বললুম, হয়তো ওটাই কর্নেলের ফাঁদ।
গোয়েন্দাপ্রবর গম্ভীর মুখে বললেন, হঃ। ফান্দ হইতেও পারে।
কর্নেল ফিরলেন সন্ধ্যার পর। হালদারমশাইয়ের মুখে কথাটা শুনে তিনি শুধু বললেন, জানি।
কালীপদ একটু পরে তিনজনের জন্য ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স রেখে চলে গেল। কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলুম, বোসসায়েব তো এলেন না?
কর্নেল বললেন, এসে গেছেন। যথাসময়ে দিদার বাড়ি আসবেন।
এ রাতে আমরা খেতে গিয়ে রানীমাকে দেখতে পেলুম না। উনি আজ রাতেও সকাল-সকাল শুয়ে পড়েছেন। বাড়িটা আজ যেন বড় বেশি স্তব্ধ। খেয়ে আসার পর কর্নেল বললেন, শুয়ে পড়া যাক।
বললুম, ফাঁদের কথা বলছিলেন। কী হল?
ওয়েট অ্যান্ড সি। বলে কর্নেল বিছানায় শুয়ে মশারির বাইরে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলেন।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে টেবিল ল্যাম্পটা নিভে গেল। অমনি কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, জয়ন্ত! হালদারমশাই! সময় হয়েছে। উঠে পড়ুন। আর্মস সঙ্গে রাখতে। হবে। টর্চ নিন। কিন্তু জ্বালবেন না।
কর্নেল বারান্দার দিকের দরজা খুললেন না। পাশের ঘরের দরজা নিঃশব্দে খুলে সেই ঘরে ঢুকলেন। উনি পায়ের কাছে টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলেন। তার পরের ঘরের ছিটকিনিও খুলে সন্তর্পণে এগোলেন। বুঝতে পারলুম, বাইরে বারান্দার দিকে তালা আঁটা থাকলেও এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে অসুবিধে নেই। আর একটা ঘরের পর সেই হলঘরে গেলুম। হলঘরের পরের ঘর পেরিয়ে আসবাবপত্র ভরা একটা ঘর। সেখানে ঢুকেই সামনে কোথাও চাপা ঘষ ঘষ শব্দ শুনতে পেলুম। কর্নেলের চর্ট নিভে গেল। একটু পরে কর্নেল ফিস ফিস করে বললেন, আমাকে ছুঁয়ে আসুন আপনারা। ওয়ান বাই ওয়ান।
কর্নেলকে ছুঁয়ে হালদারমশাই এবং তাকে ছুঁয়ে আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলুম। আশ্চর্য! সামনের ঘরের দরজা খোলা। বারান্দার দিকের দরজাও খোলা। অন্ধকার গাঢ় হলেও ক্রমশ দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ একটা জায়গায় আলোর আভাস দেখলুম। ঘরের কোণে মেঝের একটা অংশ থেকে আলোর ছটা কাঁপছে। একটু এগিয়ে বুঝতে পারলুম, বেসমেন্ট বা পাতালঘরে নামবার মুখ ওটা। পাতালঘরে কেউ আলো জ্বেলেছে। তিনজনে গুঁড়ি মেরে উঁকি দিলুম। নীচে একটা মোমবাতি জ্বলছে। অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। কর্নেল ফিস ফিস করে বললেন, ফলো মি।
তারপর উনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েই টর্চ জ্বেলে চেঁচিয়ে উঠলেন, গুলি করতে বাধ্য হব। ওটা ফেলে দাও।
হালদারমশাই কর্নেলের পাশ দিয়ে ঝাঁপ দিলেন। ততক্ষণে আমিও নেমে গেছি। এক জটাজুটধারী দাড়িগোঁফওয়ালা লাল কাপড় পরা সাধুর হাতে একটা ধারালো খাঁড়া এবং একটা কারুকার্যখচিত কালো সিন্দুকের ডালা খোলা। নীচে একটা বস্তা পড়ে আছে। হালদারমশাই খাঁড়ার কোপ এড়িয়ে যেভাবে সাধুকে পেছন থেকে জাপটে ধরলেন, তা শুধু সিনেমায় দেখা যায়। সাধু মুখ থুবড়ে পড়ল। খাঁড়াটা সিন্দুকের ওপর সশব্দে ছিটকে গেল। হালদারমশাই সাধুর পিঠে হাঁটুর চাপ দিতেই ককিয়ে উঠল। কর্নেল গিয়ে তার জটাজুট সমেত দাড়িগোঁফে টান দিলেন। সেগুলো উপড়ে গেল। অমনি হতবাক হয়ে দেখলুম, সাধু আর কেউ নয়, স্বয়ং ভটচাযমশাই!
কর্নেল বললেন, হরেকেষ্টকে দাঁড় করান হালদারমশাই।
সিঁড়ির ওপর থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে কেউ বলল, ওকে ওই অবস্থায় রাখুন আপনারা। দিদাকে ডেকে আনি।
বুঝলুম, ডি আই জি অরবিন্দ বোস এসে গেছেন।
ইত্যবসরে দু’জন পুলিশ অফিসার নেমে এলেন। কর্নেল সিন্দুকের ডালা দ্রুত এঁটে দিয়েছেন ততক্ষণে। দুটো চাবি একটা গোল রুপোলি চাকার দু’দিকে ঢোকানো ছিল। পরপর ঘুরিয়ে প্রথমে একটা এবং পরে আর একটা চাবি টেনে বের করে পকেটে রাখলেন কর্নেল। খাড়াটা আমি কুড়িয়ে নিলুম। সাংঘাতিক ধারালো খাড়া।
তারপর রানীমার কান্নাজড়ানো কণ্ঠস্বর ওপরে শোনা গেল। ওরে হরেকেষ্ট! তোর পেটে এত ছিল? দুধ দিয়ে কালসাপ পুষেছিলুম রে!
অরবিন্দ বোস তাঁর হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নিয়ে এলেন। কর্নেল চাবি দুটো রানীমার হাতে দিয়ে বললেন, আমার দায়িত্ব শেষ মিঃ বোস! বাচ্চুর খুনীকে এবার যথাস্থানে পাঠান। তারপর আপনার দিদার ঘরে বসে কফি খেতে খেতে সব কথা বলব। জয়ন্ত! তুমি খাঁড়াটা অফিসারদের দাও। ওই খাঁড়া দিয়ে বাচ্চুকে খুন করেছিল হরেকেষ্ট।…
.
বারান্দায় কালীপদ আর তার বউ জবা দাঁড়িয়েছিল। তারা দুজনেই হতবাক। এখন রাজবাড়িতে আবার আলো জ্বলছে। মেন সুইচ অফ করা ছিল। কর্নেল অন করে দিয়েছেন। পাতালঘর আগের মতো বন্ধ করা হয়েছে। রানীমার ঘরে বসে কফি খেতে খেতে কর্নেল তার রহস্য উন্মোচনের বিবরণ দিচ্ছিলেন। আমি আগাগোড়া সবটাই জানি বলে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে কিছু যুক্ত করতে চাইনে।
কর্নেল বললেন, কালীপদর একটা কথা প্রথমে হরেকেষ্টর দিকে আমার দৃষ্টি ফেরায়। কালীপদ বলেছিল, বুধবার বিকেলে হরেকেষ্ট কলকাতা রওনা হয়। অথচ সে আমার কাছে যায় শুক্রবার সকালে। তারপর সে আমাশা নিয়ে ফিরল শনিবার বিকেলে। আমাশা মিথ্যা, তার প্রমাণ পেলুম রবিবার সকালে। শনিবার রাত্রে মেন সুইচ অফ করে সে ফুলবাগানের ওখানে আসলে কী করছিল, তা রবিবার সকালে ক্যাকটাস দেখার ছলে গিয়ে জানতে পারলুম। একিনো-ক্যাকটাস গ্রুসোনাই কালীপদর ভাষায় ‘কুমড়োপটাশ’-এর টবের তলায় কী ঝিকমিক করছিল। টব সরিয়ে দেখি, চেনছেঁড়া একটা মোটা চৌকো লকেট। আইভির গলা থেকে সে কলকাতায় এটা ছিনতাই করে এনে এখানে লুকিয়ে রেখেছিল। কারণ শনিবার সকালে তার ঘরের তালা ভেঙে তার হাতের লেখা খুঁজেছিলুম। একটা পঞ্জিকাতে লাল ডটপেনে তার নামসই ছিল। মিলিয়ে দেখেছিলুম, রানীমাকে লেখা উড়ো চিঠির হস্তাক্ষরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তালা ভাঙা লক্ষ করেই হরেকেষ্ট লকেটটা আর ঘরে রাখতে সাহস পায়নি। আঁচ করেছিল, আমি তাকে সন্দেহ করছি। তাই ক্রমশ সে মরিয়া হয়ে উঠছিল।
রানীমা জিজ্ঞেস করলেন, লকেট টমসায়েবের মেয়ের গলায় গেল কীভাবে?
কর্নেল বলেন, সেটা হালদারমশাই বলবেন। তবে লকেটে সিন্দুকের এক নম্বর চাবি লুকনো আছে কি না তখনও জানতুম না। আপনার কাছে পরে জানতে পারলুম। অমনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই চিঠির নির্দেশমতো মন্দিরের পেছনে লালপাথরের ওপর আমি আপনার দ্বিতীয় চাবিটা রেখে এসেছিলুম। আমার তো ছলের অভাব হয় না। পাখি বা প্রজাপতি দেখতে ওদিকে যেতেই পারি। এবার স্মরণ করুন, হরেকেষ্ট সকালে আবার আমাশার ছলে লকেটটা আনতে ফুলবাগানের দিকে গিয়েছিল। কালীপদ বাজার থেকে এসে দেখতে পেয়ে চাচামেচি করছিল। আর একটা কথা। এই পরচুলটা। হালদারমশাই বলবেন এটা কীভাবে আমার হাতে এল। কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে পরচুলাটা বের করে ভেতরটা দেখালেন। লক্ষ করুন এখানে লাল ছোপ। কিসের ছোপ? শুক্রবার সকালে যখন হরেকেষ্ট আমার কাছে যায়, তখন তার কপালে সিঁদুরের তিলক ঘষে একাকার হয়ে গিয়েছিল। পরচুলা পরার সময় কপালে ঘষা খেয়ে ওই অবস্থা হয়েছিল। যাই হোক, হরেকেষ্ট ক্রমে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এবার হালদারমশাই বলুন। তার কথার সঙ্গে আমার কথা মিলিয়ে দেখলে সব স্পষ্ট হবে।
হালদারমশাই স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় ইংরেজি মিশিয়ে তার বিবরণ দিলেন।
অরবিন্দ বোস বললেন, হরেকেষ্ট বাংলোর কাছে সম্ভবত খাঁড়ার আঘাতে বাচ্চুকে লকেটের লোভেই খুন করেছিল। কিন্তু লকেট পায়নি। এখন কথা হল, বাচ্চুর বডি সে মুসলমানদের কবরখানা পর্যন্ত একা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল এটা বিশ্বাস হয় না। জেরার চোটে তার পেট থেকে কথা বের করে নেব।
কর্নেল বললেন, তবে হরেকেষ্টর শরীর শক্ত-সমর্থ। বাচ্চুর রোগা ছিপছিপে। সেই কবরটা খুঁড়লে অন্তত এটুকু বোঝা যাবে, পথে কোথাও রক্ত পড়েনি কেন? আমি বাজারে কয়েকটা দোকানে খবর নিয়ে জেনেছি, হরেকেষ্ট একটা দোকান থেকে কালীপুজোর দিন পাঁচ মিটার পলিথিন কিনেছিল। নাইলনের দড়িও কিনেছিল। এবার বুঝতে চেষ্টা করুন, কী অসাধারণ তার বুদ্ধি! হ্যাঁ বলা দরকার। খ্রিস্টান পাড়ার যোশেফ আইভির চিঠি দিতে আসছিল বাচ্চুকে। পথেই হরেকেষ্টকে দেখতে পেয়ে সে চিঠিটা তাকে দিয়েছিল। বাচ্চু কালীপদকে বিশ্বাস করত না সম্ভবত। কারণ কালীপদ রানীমার কাছের লোক। তাই আইভির চিঠি সে তার বন্ধু যোশেফকে হরেকেষ্টর হাত দিয়ে পাঠাতে বলত। হরেকেষ্ট এই অবৈধ প্রণয়ের কথা জানত বলেই বাচ্চুর সঙ্গে রসিকতা করত। বাচ্চু বাড়াবাড়ি দেখলে রেগে যেত তার ওপর। জবা কালীপুজোর বিকেলে এই ঘটনা দেখেছিল। তাই না জবা?
জবা বাইরে থেকে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমি বললুম, কবরের কাছে বাচ্চুর একপাটি চপ্পল কুড়িয়ে পাওয়ার কথাটা বলুন কর্নেল!
কর্নেল বললেন, এত রাত্রে আমি কাকেও জুতো দেখাতে রাজি নই।
ডি আই জি বোসসায়েব গম্ভীর মুখে বললেন, যে কবরের কাছে জুতোটা পেয়েছেন, সেই কবরে বাচ্চুর ডেডবডি যদি না থাকে?
আছে। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, টাটকা কবরটার একটা দিক যে আবার খোঁড়া হয়েছিল, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। এমন কি, নাইলনের দড়ির একটুখানি মাটির ফাঁকে বেরিয়ে আছে, তা আমার চোখে পড়েছে।
এবার রানীমা বলে উঠলেন, কালীপুজোর দিন বিকেলে মেলাকমিটির সেক্রেটারি চাঁদুবাবু এসেছিলেন হরেকেষ্টর কাছে। এতক্ষণে মনে হল কথাটা। আমি মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ কানে এল, মুসলমানপাড়ায় কে মারা গেছে আর তার কবর হচ্ছে। সেই নিয়ে দু’জনে কথা হচ্ছে। আমার অবাক লেগেছিল।
বোসসায়েব কথাটা শোনামাত্র সেলুলার ফোন বের করে বললেন, চাঁদতারণ মুখুয্যেরই চক্রান্ত। তাকে এখনই অ্যারেস্ট করতে বলছি। তার উদ্দেশ্য ছিল একঢিলে দুই পাখি বধ। পিসিমার এই রাজবাড়ি দখল আর পিসেমশাইয়ের অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ আত্মসাৎ। হরেকেষ্টকে সে-ই লোভ দেখিয়েছিল।
কর্নেল সায় দিলেন, ঠিক ধরেছেন মিঃ বোস….
Leave a Reply