বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – কর্নেল সমগ্র ৯ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
প্রস্তাবনা
আজ রাতেও আবার সেই উপদ্রব।
“ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়?
সে ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।”–তারপর বিকট সেই অট্টহাসি। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
একেবারে জানালার বাইরে এই বদমাইসি এবং ঠিক এই সময়টাতে কে জানে। কেন লোডশেডিং হচ্ছে কদিন থেকে। জুন মাসের অসহ্য গরম। হাতপাখ নাড়তে নাড়তে সবে একটু তন্দ্রামতো এসেছে, হঠাৎ কাল রাতের মতোই ছিঁড়ে গেল। তারপর জানালায় একটা ছায়া মুখ। চাপাস্বরে কেউ বলে উঠল-বরকধঝ-কচতটপ বরকধঝ-কচতটপ।
–তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে! পাগলামির নিকুচি করেছে। বলে অমরেশ উঠে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি আবার হা-হা করে হাসছে কাল রাতের মতোই।
কাল রাতে ধমক দিয়েছিলেন অমরেশ। পাগলাটা কেটে পড়েছিল। কিন্তু আজ রাতে ধমক, শাসানি তর্জন-গর্জনেও কাজ হল না। বিছানায় মাথার কাছে টর্চ ছিল। টর্চ জ্বেলে ছড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
পাশের ঘরে নন্দিনী চীনা লণ্ঠনের আলোয় একটা প্রেমের উপন্যাস পড়ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। এখন যাকে বলে রিল্যান্সিং মুড। তা ছাড়া রগরগে প্রেমের কাহিনী এই উৎকট গরমকে ভুলিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট।
বাবার চ্যাঁচামেচি এবং দরজা খুলে বেরুনোর শব্দ আবছা তার কানে এসেছিল। বিরক্ত হয়ে বলল–কোনও মানে হয়?
সেকেলে বিশাল খাটে সুধাময়ীর বুকে হাতপাখাটা চুপচাপ পড়ে আছে। ঘুমের ওযুধ খান ৰাময়ী। নন্দিনী আবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে, তার বাবার মতো জোরে না হলেও মায়ের নাক ডাকে। নন্দিনীর কথায় নাক ডাকা থেমে গেল। ঘুমজড়ানো গলায় বললেন–বংকার মাকে বলিস খবর দেবে।
নন্দিনী হেসে ফেলল। কী বংকার মা বংকার মা করছ! বাবার কীর্তি দ্যাখ গিয়ে।
–হুঁ। বলে সুধাময়ী পাশ ফিরলেন।
শহরতলির এই পাড়াটা নিঝুম সুনসান এখন। শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। পিছনের বস্তিতে অনেক রাত অব্দি কী সব হই-হুঁল্লোড় চলে। তারপর সম্ভবত লোকেরা ক্লান্ত হয়েই ঘরে-বাইরে যে যেখানে পারে, শুয়ে পড়ে। পাশের রাস্তার ওধারে সম্প্রতি কয়েকটা নতুন বাড়ি হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে-ওখানে খানাখন্দ, ডোবা ঝোপজঙ্গল এবং পোপাড়ো ঘাসজমি। তার ওধারে কী একটা কারখানা হবে নাকি। বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি হয়ে গেছে। শুওরের খোঁয়াড়, গোরু মোষের খাটাল, তারপর একটা খাল পেরিয়ে গেলে রেলকলোনি এবং রেলইয়ার্ড।
নন্দিনী বইয়ের পাতায় চোখ রাখল বটে, কিন্তু মন বাবার দিকে। কাল রাতে এক পাগলা নাকি বাবাকে খুব জ্বালিয়েছে। এ ঘর থেকে পাগলার পদ্য আওড়ানো শোনা গিয়েছিল। এ রাতে নন্দিনী অতটা খেয়াল করেনি। পাগলার কণ্ঠস্বর বেশ নাটকীয় ধরনের। যাত্রাদলের অভিনেতা ছিল হয়তো। ভাবতে মজা লাগে, রাত বিরেতে একটা লোক মৃত্যুকে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে! পদ্যটা পরিচিত মনে হয় নন্দিনীর। কোথায় যেন পড়েছে, মনে করতে পারেনি।
নন্দিনী টেবিল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত একটা পনের বাজে। বাবা ফিরছে না। পাগলাটাকে এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে নাকি। বাবারও অবশ্য একধরনের পাগলামি আছে। রাতদুপুরে বাড়ির পাশে কুকুরেরা ঝগড়া বাধালে ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়ে। পাড়াছাড়া করে ফেরে।
পুরনো আমলের একতলা বাড়ি। একটুকরো উঠোন আছে। উঠোনের কোনায় টিউবেল আছে। শিউলি জবা চাঁপাফুলের গাছ আছে। লণ্ঠনটা হাতে করে নন্দিনী দরজা খুলে বারান্দায় বেরুল। আস্তে ডাকল–বাবা!
তার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। বস্তিটা নাকি রাজ্যের চোর-ডাকাত-ছিনতাইবাজের ডেরা। আশে-পাশে ভদ্রলোকদের বাড়িতে একসময় নাকি রাতবিরেতে খুব চোর পড়ত। নন্দিনীর ছোটবেলায় তাদের বাড়িতেও চোর ঢুকেছিল, মায়ের কাছে গল্পটা অনেকবার শুনেছে। কিন্তু তার মনে পড়ে না কিছু। বরং তার ধারণা, বস্তির লোকগুলো বেশ ভদ্রই। কখনও ওখানকার কোনও ছেলে-ছোকরা তার পিছনে লাগেনি। বরং ভদ্রলোকদের বাড়ির রকবাজরা তার পিছনে শিস দিয়েছে। অশালীন কথা আওড়েছে।
তা হলেও নন্দিনীর অবচেতনায় বস্তিবাসীদের সম্পর্কে গোপন একটা আতঙ্ক আছে। এই মুহূর্তে জবাগাছের আড়াল থেকে যদি চোর-ডাকাত বেরিয়ে আসে?
নন্দিনী লক্ষ্য করল, উঠোনের সদর দরজা বন্ধ। তার মানে, বাবা বসার ঘর খুলেই বেরিয়েছে। তার বাবা প্রাক্তন স্কুলটিচার। শোবার ঘরের সবখানে বই ঠাসা। বাইরের বসার ঘরেও তিনটে আলমারি ভর্তি বই। ওই ঘরে বাবা একসময় একদঙ্গল ছাত্র পড়াত। নিজের বয়সের ক্লান্তি আর নন্দিনীর মায়ের অসুখ-বিসুখ এইসব নানা কারণে টিউশনি ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল আর বাবাকে আগের মতো বই পড়তেও দেখে না নন্দিনী। চুপচাপ গুম হয়ে বসে থাকেন অমরেশ।
বারান্দায় রাখা একটা নড়বড়ে টেবিলে চীনা লণ্ঠনটা রেখে নন্দিনী দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। পাগলাটার পাল্লায় পড়ে বাবাও কি পাগল হয়ে গেল? সে একবার ভাবল, বসার ঘর দিয়ে গিয়ে বাইরের রাস্তাটা দেখবে। কিন্তু এবার তার রাগ এসে গেল। চোর-ডাকাত ঢুকে পড়ুক। তার কী?
রাগের বশেই সে লণ্ঠনটা তুলে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, এতক্ষণে বিদ্যুৎ এসে গেল। বারান্দায় চল্লিশ ওয়াটের বাতিটা সারারাত জ্বলে। ঘরে টেবিলবাতিটা জ্বলে উঠল। ঘড় ঘড় শব্দে পুরনো সিলিং ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। এবার আর মাকে ওঠানো দূরের কথা, একটুও জাগানো যাবে না।
আলো আসার পর এতক্ষণে এলাকার নিঝুম ঘোরটাও কেটে গেছে। কাছাকাছি কোথাও কুকুর ডাকল। নন্দিনী বসার ঘরে চলে গেল। বাইরের দরজা হাট করে খোলা। রাস্তার আলো দেখা যাচ্ছে। সে সুইচ টিপে এ ঘরের আলো জ্বালল। তারপর দরজায় উঁকি দিল। এক চিলতে বারান্দা ছিল একসময়। কিন্তু রকবাজদের জন্য ভেঙে দিতে হয়েছিল। জায়গাটা ঢালু করে বাঁধানো। কাঁচ আর অজস্র পেরেকের ডগা উঁচিয়ে আছে। কয়েক ধাপ সংকীর্ণ সিঁড়ি করা হয়েছে দরজার নীচে। সিঁড়িতে নেমে রাস্তার দুধারে তাকিয়ে কাকেও দেখতে পেল না নন্দিনী।
শুধু একটা ঘেয়ো কুকুর আস্তেসুস্থে হেঁটে চলছে। বাঁদিকে বস্তির গলির মোড়ে কুকুরটা গিয়ে তাড়া খেল। একদঙ্গল কুকুর চ্যাঁচামেচি করে তাকে তাড়িয়ে পাড়াছাড়া করতে গেল।
কিন্তু বাবা কোথায় গেল? নন্দিনীর অস্বস্তি হচ্ছিল। পাশের বাড়ির তারাজেঠুকে ডাকবে ভাবল। কিন্তু অমরেশ এক পাগলের পিছনে তাড়া করেছেন, এই ব্যাপারটা বড় হাস্যকর। তারাজেঠু যা লোক, রঙ চড়িয়ে গল্প রটিয়ে বেড়াবেন সবখানে। বাবার প্রেসটিজ থাকবে না। এমনিতেই তো অনেকে আজকাল তার বাবাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে।
বিরক্ত আর খাপ্পা নন্দিনী উঠে এসে দরজা বন্ধ করল। কিন্তু ঘরের আলোটা নেভাল না। সে তার বাবার শোবার ঘরে গিয়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলে দিল। ফ্যানটার সুইচ টেপা ছিল। সেটা ঘুরছে। শূন্য বিছানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নন্দিনী নিজের ঘরে ফিরল। দরজা এঁটে দিল।
চীনা লণ্ঠন নিভিয়ে টেবিলবাতির সুইচ অফ করে সে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বাবা এলে ডাকাডাকি করবে। করুক। এই পাগলামির কোনও মানে হয়?
কিন্তু নন্দিনীর ঘুম আসছিল না। টেবিলঘড়ির আবছা টিকটিক শব্দ কানে আসছিল। অমরেশের ডাক শোনার জন্য সে কান খাড়া করে আছে। অমরেশের ফেরার নাম নেই।…
.
০১.
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ খি-খি করে হেসে বললেন–খাইছে। যত্ত সব পাগলের কারবার!
জিজ্ঞেস করলাম–পাগল কী করেছে হালদারমশাই?
–পলাইয়া গেছে। বলে হালদারমশাই পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করলেন। একটিপ নস্যি নাকে খুঁজে স্বগতোক্তি করলেন বুঝি না। একজন পাগল পাগলাগারদ থেক্যা পালাইয়া গেছে। তো তার ছবি ছাপাইয়া বিজ্ঞাপন দিয়া লিখছে, খোঁজ দিলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার। ক্যান?
হাসি চেপে বললাম–পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলে নিশ্চয় এর পেছনে কোনও রহস্য আছে। আপনি এই রহস্য ভেদ করুন হালদারমশাই!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ আমার রসিকতা গ্রাহ্য করলেন না। তেতো মুখে বললেন–কে পাগল? যে পালাইয়া গেছে, না যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে সে? কর্নেল স্যার কী কন?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটা বই খুলে কী একটা ছবি দেখছিলেন। চওড়া টাকে জানালার পর্দার ফাঁক গলিয়ে আসা সকালের রোদ এসে প্রজাপতির মতো নাচানাচি করছে। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুট থেকে ছাই খসে পড়েছে তার ঋষিসুলভ সাদা দাড়িতে। বললেন–হালদারমশাই, পাগলের বিজ্ঞাপন তো পড়লেন। কিন্তু পাগলের খবরটা মিস করলেন?
প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং বর্তমানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার সোজা হয়ে বসলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন মিস করলাম?
কর্নেল বই বুজিয়ে রেখে দাড়ির ছাই ঝেড়ে বললেন–হ্যাঁ। তিনের পাতায় ডানদিকের কলম দেখুন।
হালদারমশাই কাগজ খুলে খবরটা বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন। গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে কাঁপতে থাকল–পাগলের হাতে প্রাক্তন শিক্ষকের মৃত্যু! অ্যাঁ! কি কাণ্ড!…
পড়া শেষ হলে হালদারমশাই আবার একটিপ নস্যি নিলেন। গুলি-গুলি চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাগজটা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা, আমি যার স্পেশাল রিপোর্টার। কিন্তু খবরের কাগজে যা কিছু বেরোয়, আমার কাছে তার। সবটাই পাঠযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন যেদিন কম থাকে, সেদিন অনেক হাবি-জাবি খবর দিয়ে জায়গা ভর্তি করতে হয়। কিন্তু একইদিনের কাগজে পাগল পালানোর বিজ্ঞাপন আর পাগলের হাতে কারও মারা পড়ার ঘটনা একটু অদ্ভুত লাগল। কাগজ টেনে নিয়ে খবরে চোখ বুলিয়ে রেখে দিলাম। বললাম-বোগাস! পুলিশসোর্স থেকে টেলিফোনে পাওয়া। সন্ধ্যার পর লালবাজারে ফোন করে জেনে নেওয়া হয়–দাদা, আজ কিছু আছে নাকি? তেমন কিছু নেই? নানা। প্লিজ দাদা, যা হয় একটা কিছু দিন। হাসতে হাসতে বললাম–রোজ সন্ধ্যার পর আমাদের এক রিপোর্টারের এই ডায়লগ শুনি।
আমার কথা হালদারমশাইয়ের মনঃপুত হলো না। মাথা নেড়ে বললেন– দুপুর রাত্রে লোডশেডিংয়ের সময় এক পাগল আইয়া শিক্ষকেরে জালাতন করছিল। উনি তারে তাড়া করলেন। তারপর আর বাড়ি ফিরলেন না। পরদিন সকালে শিক্ষকের বডি পাওয়া গেল খালের ধারে। স্কালে ক্র্যাক।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–প্রাক্তন শিক্ষক অমরেশ রায়ের বাড়ি থেকে সেই খালের দূরত্ব প্রায় আধ কিলোমিটারের বেশি।
–অ্যাঁ? হালদারমশাই চমকে ওঠার ভঙ্গি করলেন। কিন্তু খবরে তা তো লেখে নাই। অত্তোদূরে পাগলেরে তাড়াইয়া লইয়া গেছিলেন শিক্ষক ভদ্রলোক? ক্যান? উনিও দেখি এক পাগল।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন–পাগলের পাল্লায় পড়লে কোনও সুস্থ লোক পাগল হয়ে যান সম্ভবত। কারণ আগের রাতেও একই সময়ে ওই পাগল ওঁকে জালাতে এসেছিল। ওঁর জানালার বাইরে একটা পদ্য আওড়াচ্ছিল।
কন কী? পইদ্য। কিন্তু খবরে তা-ও তো লেখে নাই।
–পদ্যটা সুপরিচিত। ওহে মৃত্যু তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। পাগল একসময় যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করত কিনা বলা যায় না।
হালদারমশাই খুব অবাক হয়ে বললেন–খবরে তো এসব কিছুই নাই।
বললাম–ব্যাকগ্রাউন্ডটা কর্নেলের যখন জানা, তখন বোঝা যাচ্ছে আমার কথাই ঠিক। এই কেসে রহস্য আছে। বিজ্ঞাপন এবং খবরের ঘটনার মধ্যেও লিংক আছে। তার চেয়ে বড় কথা, অলরেডি কোনও পক্ষ কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সম্ভবত খবরটা কাগজে বেরুনোর আগেই। তাই না কর্নেল?
কর্নেল হাসলেন।–দ্যাটস রাইট, ডার্লিং! তবে বিজ্ঞাপনের পাগল এবং পদ্য আওড়ানো পাগল এক কি-না আমি জানি না। দুটোর মধ্যে লিংকের কথা বলছ। সে-বিষয়ে আমি এখনও সিওর নই। এমন-কি, অমরেশ রায়ের মাথায় সেই পাগলই আঘাত করেছে কিনা তা-ও এ মুহূর্তে বলা কঠিন। অবশ্য ওঁর বডির পাশে রক্তমাখা একটা ছড়ি পাওয়া গেছে। ছড়িটা কিন্তু অমরেশবাবুরই। ওঁর মেয়ে এবং স্ত্রী ওটা শনাক্ত করেছেন।
হালদারমশাই ব্যস্তভাবে বললেন–পাগল ছড়ি কাইড়্যা লইয়া ওনারে মারছে।
–ছড়ির ঘায়ে মাথার খুলিতে এক ইঞ্চি ডিপ ক্র্যাক হতে পারে না হালদারমশাই।
প্রাইভেট গোয়েন্দা চিন্তিত মুখে বললেন–পাগলের হাতে লোহার রড ছিল। তাড়া খাইয়া কোনও খানে পিক আপ করছিল। পাগলের কারবার!
কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিয়ে বললেন–অমরেশ বাবুর ছড়িতে রক্ত মাখানো ছিল। কেন? এটা একটা ভাইটাল প্রশ্ন, জয়ন্ত! ওঁর মাথায় যে-ই আঘাত করুক, সে সম্ভবত বোকামি করে ফেলেছে। রক্ত ছড়িতে কেন মাখাতে গেল?
হালদারমশাই মাথা নেড়ে বললেন–সেয়ানা পাগল! তারই কাজ। আমার মতে, কোনও পাগলই পুরা পাগল না, কর্নেল স্যার! আপনি কখনও কোন পাগলেরে গাড়িচাপা পড়তে দ্যাখছেন?
কর্নেল অট্টহাসি হেসে সোজা হয়ে বসলেন।দারুণ বলেছেন তো। সত্যি কোনও পাগল কখনও রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে মরেছে বলে শুনিনি। অথচ দেখা যায়, কত পাগল রাস্তায় চলন্ত গাড়ির মধ্যে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তা পার হচ্ছে অকুতোভয়ে। তবে হ্যাঁ হালদারমশাই, পাগলেরও মৃত্যুভয় আছে। ভূতের ভয় আছে কিনা অবশ্য জানি না। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
–যাই গিয়া! বলে হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন।
বললাম–আপনি কি পাগলের ভূতের ভয় আছে কিনা পরীক্ষা করতে যাচ্ছেন?
হালদারমশাই খি খি করে হেসে বললেন–কী যে কন! চলি কর্নেল স্যার।
উনি বেরিয়ে গেলে বললাম–মনে হচ্ছে, হালদারমশাই এই রহস্যের পেছনে। দৌড়লেন। ওঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির অবস্থা নাকি শোচনীয়। কেস-টেসের খুব আকাল পড়েছে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ, বলো ডার্লিং..কী?…কোথায়? গড়িয়া? বলো কী! পাগলা এবং সেই পদ্য?..আশ্চর্য! তুমি এসো। আমি আছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ? এসো।
কর্নেল ফোন রেখে বললেন–আবার একটা ডেডবডি। হুবহু একই ঘটনা। রাতদুপুরে এক পাগলের জালাতন এবং তাকে তাড়া করে যাওয়া। তারপর সকালে একটা ডোবার পাড়ে ডেডবডি। তবে প্রথম ঘটনায় মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী ও কন্যা আছেন। দ্বিতীয় ঘটনায় মৃতের কেউ নেই। ভদ্রলোকের নাম পরিতোষ লাহিড়ি। আমার মতোই বুড়ো ব্যাচেলার।
কর্নেল আবার সেই বইটা খুলে বসলেন। এবার মলাটে আমার চোখ পড়ল। বাংলার আগস্ট বিপ্লব। আমি ভেবেছিলাম অর্কিড, ক্যাকটাস কিংবা পাখি-প্রজাপতি সংক্রান্ত কোনও বই। আমার বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বন্ধু এসব ছেড়ে ১৯৪২ সালের ‘আগস্ট বিপ্লবে’ হঠাৎ আগ্রহী হয়ে পড়লেন কেন, চিন্তাযযাগ্য বিষয় বটে। বার দুই প্রশ্নটা তুললাম। কিন্তু কোনও জবাব পেলাম না। অগত্যা সেই পাগলের বিজ্ঞাপনে মন দিলাম।
না, হালদারমশাই বর্ণিত পাগলাগারদ থেকে নয়, এক পাগল পালিয়েছে কুমারচক উন্মাদ আশ্রম থেকে। বয়স প্রায় ৬৪-৬৫ বছর। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট। বিশেষ লক্ষণ : নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, বরকধঝ কচতটপ। সাংঘাতিক বিপজ্জনক, পাগল নাকি।
ছবিটা দেখে কিন্তু কিছু বোঝা যায় না। আপাতদৃষ্টে চমৎকার সভ্যভব্য চেহারা। সিঁথিকরা চুল। গায়ে হাফশার্ট। পকেটে কলম। শুধু চোখ দুটি কেমন যেন ক্রুর। নাকি আমারই চেখের ভুল?
একটু পরে বললাম–আচ্ছা কর্নেল, কোনও পাগল সাংঘাতিক বিপজ্জনক হলে তো তার হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরানো হয়। বিজ্ঞাপনে তেমন কিছু বলা হয়নি।
হুঁ।
কুমারচক কোথায় জানেন?
কর্নেল বই থেকে মুখ তুলে একটু হেসে বললেন তুমি কুমারচকে গেলে তোমাদের কাগজের জন্য একটা স্টোরি পেতেও পারো। যাবে নাকি?
নাহ। জায়গাটা কোথায়?
–ঠিকানা তো লেখাই আছে বিজ্ঞাপনে।
বিরক্ত হয়ে বললাম–কুমারচক, জেলা নদীয়া লেখা আছে। কিন্তু লোকেশনটা। কোথায়?
কর্নেল আঙুল তুলে বইয়ের একটা র্যাক দেখালেন–ওখানে ওমালি সায়েবের জেলা-গেজেটিয়ার আছে কয়েক ভল্যুম। আগ্রহ থাকলে খুঁজে বের করো। ঐতিহাসিক তথ্যও পেয়ে যাবে।
দ্রুত বললাম–থাক্। ওসব পোকায় কাটা সেকেলে বই দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়।
ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন-ষষ্ঠী।
ডিটেকটিভ দফতরের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ী এসে আমাকে দেখে কপট ভঙ্গি করলেন। সর্বনাশ। গাছে না চড়তেই এক কাঁদি আপনারা কাগজের লোকেরা কি বাতাসে খবরের গন্ধ পান মশাই?
আমিও কপট গাম্ভীর্যে বললাম–মিঃ লাহিড়ী! আজ রোববার। আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার-গাইডের কাছে আড্ডা দেওয়ার দিন।
অরিজিৎ হাসতে হাসতে বললেন– সরি! ভুলে গিয়েছিলাম।
কর্নেল বই রেখে ঘুরে বসলেন–যাই হোক, গড়িয়ায় কোনও ডোবার ধারে পাওয়া আবার একটা ডেডবডির ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামানোর নিশ্চয় কোনও কারণ আছে অরিজিৎ? এবারেও পুলিশের টপ র্যাংকের টনক নড়াল কে? কাল তুমি খুলে কিছু বলেনি। আমিও বিশেষ মাথা ঘামাইনি। আজ আমার খটকা লাগছে।
অরিজিৎ একটু গম্ভীর হয়ে বললেন–প্রথম ভিকটিম অমরেশ রায় ছিলেন। এক মন্ত্রীর পলিটিক্যাল লাইফের সহকর্মী। সেকেন্ড ভিকটিম পরিতোষ লাহিড়ি– না, আমার কোনও আত্মীয় নন, কিংবা বারেন্দ্র বামুন-ফ্যাক্টরও কোনও ব্যাপার নয়–একই মন্ত্রীর বন্ধু। মানে, দুজনেই একসময় মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে ইংরেজতাড়ানো রাজনীতি করেছেন এবং জেল খেটেছেন।
না বলে পারলাম না–কী আশ্চর্য! সেইজন্য কর্নেল ওই বইটা নিয়ে মেতে আছেন?
–মেতে আছি মানে? কর্নেল সকৌতুকে বললেন–মত্ততা পাগলেরও লক্ষণ। জয়ন্ত মাঝে মাঝে আমাকে পাগল সাব্যস্ত করার তালে থাকে। এবং ষষ্ঠীও।
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে নিয়ে ঢুকছিল। থমকে দাঁড়াল। তারপর কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালে সে গম্ভীর মুখে ট্রে রেখে চলে গেল। কফি খেতে খেতে অরিজিৎ ঘটনার বিবরণ দিলেন। পরিতোষ লাহিড়ির বয়স আটষট্টি বছর। একটা দোতলা বাড়ির নিচের তলায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। স্বপাক খেতেন। পাশের ঘরের ভাড়াটে এক নার্স মহিলা। গতরাতে তার নাইট ডিউটি ছিল হাসপাতালে। ওপরতলায় থাকেন বাড়ির মালিক সপরিবারে। তার নাম হরিপদ সেনগুপ্ত। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। অনিদ্রার রোগী। কিন্তু ঘুমের ওষুধ খেতে ভয় পান। শেষ রাতে ঘুম আসে। অনেক বেলা অব্দি বিছানায় থাকেন। তিনিই শুনেছিলেন, নিচে কে বিকট চেঁচিয়ে পদ্য আওড়াচ্ছে। একটু পরে পরিতোষবাবুর ধমক শুনে হরিপদবাবু জানালায় উঁকি মারেন। এরিয়ায় তখন লোডশেডিং ছিল। উনি টর্চের আলো ফেলে দেখেন, পরিতোষবাবু ছড়ি উঁচিয়ে এক পাগলকে তাড়া করে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবে ও নিয়ে আর মাথা ঘামাননি হরিপদবাবু। ভোরবেলা খানিকটা দূরে রেললাইনের কাছে ডোবার ধারে পরিতোষবাবুকে পড়ে থাকতে দেখে এক অবাঙালি ধোপা। সে ওঁকে চিনত। সে হরিপদবাবুর বাড়িতে খবর দেয়।
অরিজিৎ বললেন–এরিয়ার কয়েকজন পাগলকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হরিপদবাবু শনাক্ত করতে পারেননি। তাদের পদ্য বলতে বলেন ওসি। কেউ কিছু বলেনি। এমন কি, বিচক্ষণ ওসি নিজেই সেই পদ্যটা আওড়ে রিঅ্যাকশন যাচাই করেছেন। ওরা কেউ সাড়া দেয়নি। কাজেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–হরিপদবাবু কি জানতেন মন্ত্রীর সঙ্গে পরিতোষবাবুর চেনাজানা আছে।
নাহ পরিতোষবাবুর একটা ডায়েরিতে নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা ছিল। মন্ত্রীমশাইয়ের কয়েকটা চিঠিও পাওয়া গেছে। বাই দা বাই, পরিতোষবাবু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশন পেতেন। এসব কারণে ওসি মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে ফোন করেন। তারপর কী হয়েছে, বুঝতেই পারছেন। মন্ত্রীমশাই আবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পরপর ওঁর দুজন সহযোদ্ধা খুন। সহযোদ্ধা কথাটা ওঁর।
আমি খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বিজ্ঞাপনটার কথা বলতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল আমার হাত থেকে কাগজটা প্রায় কেড়ে নিয়ে তিন নম্বর পাতা খুললেন। বললেন–প্রথম খুন শুক্রবার রাতে। প্রথমটা উত্তরে, দ্বিতীয়টা দক্ষিণে। তো অরিজিৎ, কাল তোমাকে বলেছিলাম। উত্তরের সন্দেহভাজন পাগলদের ধরে জেরা করা দরকার। আজ অবশ্য দক্ষিণের সন্দেহভাজন পাগলদের পেছনে দৌড়ুতে বলব না।
অরিজিৎ হাসলেন–গ্রেটার কলকাতায় পাগলের সংখ্যা লাখখানেক হতেই পারে। মানে ছাড়া-পাগলদের কথা বলছি। আবার দেখুন প্রতিদিনই কত পাগল মেন্টাল হসপিটাল বা লুনাটিক অ্যাসাইলামে ভর্তি হচ্ছে। তবে আমাদের লোকেরা বসে নেই জানবেন। সেই পদ্যপাগলকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হবে না। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যত্র। আপনাকে কালই বলেছি, আমার সন্দেহ কেউ রাত্রিবেলা লোডশেডিংয়ের সুযোগে ওই পদ্যপাগলকে লেলিয়ে দিয়ে ভিকটিমকে বাড়ির বাইরে এনেছে এবং খুন করেছে। তাছাড়া একটা ভাইটাল প্রশ্ন : ওই পদ্যটা শুনেই বা কেন ভিকটিম তাকে তাড়া করছে?
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। তুমি বুদ্ধিমানের মতো একটা পয়েন্ট খুঁজে বের করেছ ডার্লিং। ওই পদ্যে কি কোনও পুরনো গোপন ঘটনার সূত্র লুকিয়ে আছে? কর্নেল খবরের কাগজটা ভাজ করে ড্রয়ারে ঢোকালেন। তারপর বললেন–মন্ত্রীমশাই ব্যাপারটা জেনেছেন কি?
–হ্যাঁ। ডিটেলস জেনে নিয়েছেন।
–পদ্যটা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি?
নাহ্। তবে কথাটা শোনার পর ওঁকে ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আমার ঘাড়ে কটা মুণ্ডু যে ওঁকে জেরা করি? অরিজিৎ দ্রুত কফি শেষ করে আস্তে বললেন এখানেই সমস্যা। এজন্যই আপনার হেল্প চেয়েছি।
বললাম–মন্ত্রী ভদ্রলোক কে?
–প্রতাপকুমার সিংহ।
–তাই বলুন! উনি সঙ্গে একদঙ্গল আর্মড গার্ড নিয়ে ঘোরেন বলে কাগজে খুব ঠাট্টাতামাসা করা হয়। ওঁর বাড়িও নাকি সারাক্ষণ পাহারা দেয় আপনাদের লোকেরা। এ নিয়ে বহুবার কার্টুন আঁকাও হয়েছে কাগজে। এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা ওঁর ক্ষমতার দম্ভ নয়–সম্ভবত আত্মরক্ষার ব্যুহ।
অরিজিৎ সায় দিয়ে বললেন–দ্যাটস রাইট। গত বছর দিল্লিতে ওঁকে মাডারের অ্যাটেম্পট হয়েছিল। গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল কেউ। তাকে ধরা যায়নি। কর্নেল, পদ্যের রহস্যভেদ করুন আপনি। আমি উঠি।
ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি উঠে দাঁড়ালে কর্নেল বললেন–তোমাদের লোকেরা সর্বত্র সন্দেহভাজন পাগলদের দিকে নজর রেখেছে। নিশ্চয় সেই পদ্যটা আওড়ে পাগলদের রিঅ্যাকশন যাচাই করাও হচ্ছে। তো আমি বলি, রিঅ্যাকশন যাচাই করতে বরং মরণরে উঁহু মম শ্যাম সুমান আওড়ানোর নির্দেশ দাও।
অরিজিৎ হাসতে হাসতে পা বাড়ালেন দরজার দিকে।
কর্নেল বললেন–জাস্ট আ মিনিট। এই পদ্যেও কোনও সাড়া না পেলে তোমাদের লোককে ‘বরকধঝ-কচতটপ’ আওড়াতে বলল। দেখ কি হয়!
অরিজিৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
–হোয়াটস দ্যাট, কর্নেল?
দ্যাটস দ্যাট, ডার্লিং! বরকধঝ কচতটপ। ভুলো না!
-ওঃ কর্নেল! আমার জোকের মুড নেই! বলে পুলিশের গোয়েন্দাকতা বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–বিজ্ঞাপনটার দিকে পুলিশের চোখ পড়েনি। তুমি মাঝে মাঝে বড় অত্যুৎসাহী হয়ে পড়ো জয়ন্ত! তুমি অরিজিৎকে ওটা দেখালে রেডিও মেসেজ চলে যেত কুমারচকে। সেখানকার উন্মাদ আশ্রমে পুলিশ গিয়ে জেরায় জেরবার করত। এই হত্যারহস্যের সঙ্গে যদি দৈবাৎ ওখানে কোনও যোগসূত্র থাকে, তা ছিঁড়ে যেত। কারণ সংশ্লিষ্ট পক্ষ সাবধান হয়ে যেত।
কিন্তু পুলিশের ওটা চোখে পড়া উচিত ছিল।
ভুলে যেও না, পুলিশেও ব্যুরোক্রেসি অর্থাৎ আমলাতন্ত্র আছে। এক দফতরের সঙ্গে অন্য দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। এ সবই তোমার জানা কথা। তুমি নিউজম্যান।
কর্নেল সেই বইটা আবার হাতে নিলে বললাম–চলি।
-নাহ। একমিনিট বসো। এই পাতাটা শেষ করে নিয়েই বেরুব।
–কোথায়?
কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না। হঠাৎ নড়ে উঠলেন। কী আশ্চর্য! বলে বইটার পাতা ওল্টাতে থাকলেন। ব্যস্তভাবে।নাহ্! ফর্মার গণ্ডগোল নয়। কর্নেল দুই পাতার মাঝখানে সেলাইয়ের জায়গা আতস কাঁচে পরীক্ষা করলেন। তারপর শ্বাস ছেড়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে আবার বললেন–কী আশ্চর্য!
–আশ্চর্যটা কী, খুলে বলবেন?
–একটা পাতা নেই। ১৩৩ পৃষ্ঠা আর ১৩৪ পষ্ঠা।
কী ছিল ওতে?
-একটা রোমাঞ্চকর বিবরণ। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একটা মিলিটারি ট্রেন আসছে। কজন বিপ্লবী নদীর ব্রিজে লাইনের ফিসপ্লেট সরিয়ে একটু দূরে ঝোপঝাড়ের ভেতর ওত পেতে আছেন। যথাসময়ে ট্রেনটা এসেই ব্রিজ ভেঙে গড়িয়ে পড়ল নদীতে। ঝড়-বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বিকট শব্দ, ইঞ্জিনের আগুনের ঝলকানি, আর্তনাদ। এর পর লেখক লিখেছেন আমরা তৎকালে যে এক অন্ধ শক্তির বশীভূত ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল গার্ডের কামরার সংলগ্ন মালবাহী ভ্যান। টর্চের আলোয় সেই ভ্যান অন্বেষণে ছুটিয়াব্যস! এখানেই ১৩২ পৃষ্ঠা শেষ। ১৩৫ পৃষ্ঠায় দশম পরিচ্ছেদ।
বইটা কোথায় পেলেন।
–অনেকদিন আগে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে কিনেছিলাম। তুমি তো জানো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমি একজন তরুণ আর্মি অফিসার ছিলাম। বর্মা থেকে গিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় থাকার সময় বেঙ্গলে আগস্ট বিপ্লবের খবর পেয়েছিলাম। এ বয়স অব্দি ঘটনাটা আমাকে হন্ট করে। কারণ বাঙালি বিপ্লবীরা কোথাও কোথাও ব্রিটিশ আর্মির সঙ্গেও লড়তে নেমেছিলেন। মেদিনীপুর জেলার একটা বিশাল অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। দীঘা যাওয়ার পথে কাঁথি পেরিয়ে সম্ভবত রামনগরের কাছাকাছি একটা ক্যানেলের ধারে ব্রিটিশ সৈনিকদের একটা স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছিলাম। জানি না সেটা এখন আছে কিনা। ওরা আগস্ট বিপ্লব দমনে গিয়ে মারা পড়েছিল। সম্ভবত সমুদ্রের বন্যায়। সেটা ১৯৪২ সাল। সেবার ওই অঞ্চলে প্রচণ্ড ঝড়ের সময় সমুদ্র ২২ মাইল ছুটে এসেছিল।
কর্নেলের মুখে উত্তেজনার ছাপ পড়েছিল। বললাম বুঝলাম কিন্তু এতদিন বুঝি বইটা পড়েননি?
জাস্ট পাতা উল্টেছিলাম বলতে পারো। বড্ড বেশি ভাবোচ্ছ্বাস আর বাগাড়ম্বর।
–হঠাৎ আজ সকাল থেকে এটা খুঁটিয়ে পড়ার কারণ অনুমান করতে পারছি। দুই আগস্ট বিপ্লবীর হত্যাকাণ্ড। বইটা কার লেখা?
–অমরেশ রায়ের।
–অ্যাঁ?
–হ্যাঁঃ। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়লেন।–পরিতোষ লাহিড়ির ডেরায় যাব ভেবেছিলাম। বাড়ির মালিক হরিপদবাবুকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। কিন্তু বইয়ের একটা পাতা হারানো কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে। কাজেই চলো, অমরেশবাবুর বাড়িই যাওয়া যাক। নিশ্চয় ওঁর বাড়িতে বইটার কপি পাওয়া যবে। নিজের লেখা এবং নিজের পয়সায় ছাপানো বই। এক মিনিট। পোশাক বদলে নিই।
ঘড়ি দেখলাম। সওয়া দশটা বাজে। কোনও পাগলের পাল্লায় পড়লে নিষ্কৃতি মিলতে পারে। কিন্তু এই বৃদ্ধ রহস্যভেদীর পাল্লায় পড়লে কী অবস্থা হয়, হাড়ে হাড়ে জানি।…
.
০২.
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার ধারে একটা জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি। এলাকায় প্রমোটারদের নজর পড়েছে, তার লক্ষণ এখানে-ওখানে দেখতে পাচ্ছিলাম। ডোবা, খানাখন্দ, ঝোপঝাড়ের ফাঁকে নির্মীয়মান বাড়ি এবং চাপা যান্ত্রিক কলরব। পেছনে একটা বস্তি। কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল একটি মেয়ে। মুখ থেকে এখনও কিশোরীর আদল মুছে যায়নি। ছিপছিপে গড়ন। লাবণ্য আছে। কিন্তু দেখামাত্র বোঝা যায় ওই লাবণ্যে ঘন বিষাদের ছায়া পড়েছে। অনুমান করলাম, আঠারোর মধ্যে বয়স।
সে আস্তে বললকাকে চাই?
কর্নেল বললেন–এটা কি অমরেশ রায়ের বাড়ি?
মেয়েটি শুধু মাথা দোলাল। বিষণ্ণ চোখে কৌতূহলের চাঞ্চল্য ফুটে উঠল। সম্ভবত কর্নেলের পাদ্রীসুলভ চেহারাই তার কারণ।
–আজকের কাগজে খবরটা পড়ে খুব মর্মাহত হলাম। তুমি কি ওঁর মেয়ে?
–হ্যাঁ। আপনি কোত্থেকে আসছেন?
–আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তোমার বাবার সঙ্গে একসময় আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমাকে বহুবার বলেছেন আসতে। সময় করে উঠতে পারিনি। তবে উনি প্রায়ই যেতেন আমার কাছে। তো হঠাৎ আজ কাগজে সাংঘাতিক খবরটা পড়ে চমকে উঠেছিলাম। তাই ভাবলাম একবার যাওয়া উচিত। তোমার নাম কী মা?
নন্দিনী।
–নন্দিনী, তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করে দুটো কথা বলে যেতে চাই।
নন্দিনী আস্তে বলল–মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন।
–ও! তাহলে তো তুমি এতটুকু মেয়ে বড় বিপদে পড়ে গেছ। বাড়িতে আর কে আছে?
পাশের বাড়ির জেঠিমারা আছেন। অসুবিধা হচ্ছে না।
–আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। ওকে সঙ্গে নিয়ে এলাম, তোমাদের কাছে ডিটেলস জেনে নিয়ে কাগজে ফ্ল্যাশ করবে। তাহলে পুলিশের ওপরতলার টনক নড়বে। বোঝো তো, আজকাল যা অবস্থা। চাপে না পড়লে পুলিশ কিছু করে না।
নন্দিনী একটু ইতস্তত করে বলল–মিনিস্টার প্রতাপ সিনহা বাবাকে চেনেন। কাল দুপুরে ওঁকে ফোন করেছিলাম পাশের বাড়ি থেকে। পুলিশ থেকে ডি সি, এসি–সবাই এসেছিলেন। একটু আগেও
বাহ্। তাহলে তো ভালই। মিনিস্টারের ফোন নম্বর তুমি জানতে ভাগ্যিস।
–বাবার নোটবইয়ে লেখা ছিল।
–তুমি বুদ্ধিমতী নন্দিনী। কর্নেল টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন– মনে পড়ছে, অমরেশবাবু বলেছিলেন, উনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। আগস্ট বিপ্লব নিয়ে একটা বইও নাকি লিখেছিলেন। আমাকে দেবেন বলেছিলেন।
পেছন থেকে এক প্রবীণ মহিলা উঁকি দিলেন–আপনারা কি লালবাজার থেকে আসছেন?
নন্দিনী কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন–না। অমরেশবাবু আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন। আজ কাগজে ওর মৃত্যুর খবর পড়ে ছুটে এসেছি। আমার নাম। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আর এ হলো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। জয়ন্ত চৌধুরি। একে সঙ্গে এনেছিলাম, কাগজে আরও লিখে যদি এই সাংঘাতিক মাডারের তদন্ত ভালভাবে হয়।
ভদ্রমহিলা গম্ভীর মুখে বললেন, খুকু। বসার ঘরের দরজা খুলে দাও। কাগজে ভাল করে ছাপা হলে সত্যিকার কাজ হবে। পারুর বাবা বলছিলেন, মিনিস্টার হাজারটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পুলিশ দায়সারা কাজ করে কেটে পড়বে। পাগলের কাজই যদি হয়, এখনও ধরতে পারল না কেন? এই তো বঙ্কার মা বলল, ওদের বস্তিতে একজন পাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা ও ঘরে গিয়ে বসুন। একটু কড়া করে লিখবেন যেন।
নন্দিনী ভেতরে চলে গিয়েছিল। পাশের একটা ঘরের দরজা খুলে সে ডাকল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি রাস্তা থেকে উঠে গেছে। ঘরে ঢুকে দেখি, আলমারি ভর্তি বই। একপাশে সাধারণ সোফাসেট। কোনার দিকে একটা টেবিল আর তিনটে চেয়ার। দেয়ালে প্রখ্যাত দেশনেতাদের ছবি টাঙানো।
ভদ্রমহিলা পর্দা তুলে উঁকি মেরে বললেন–খুকু। যা যা হয়েছে, সব বলবে। আমি চা পাঠাচ্ছি। আর শোনো। প্রথমে পুলিশ গা করেনি, তাও বলবে। পারুর বাবা মিনিস্টারের কথা না তুললে তুমিও তো কিছু জানতে না। হোমরা-চোমরা। অফিসাররাও ছুটে আসতেন না।
উনি অদৃশ্য হলে কর্নেল বললেন বসো নন্দিনী।
নন্দিনী কুণ্ঠিতভাবে একটু তফাতে বসল। বলল বাবাকে আগের রাতেও পাগলটা খুব জ্বালিয়েছিল।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত। তুমি নোট করে যাও। নন্দিনীর সব কথা ডিটেলস নোট করো।
আমার সঙ্গে রিপোর্টারস্ নোটবুক সবসময় থাকে। বিরক্তি চেপে সেটা বের করে ডটপেন বাগিয়ে ধরে বললাম–বলো। সরি! বলুন।
নন্দিনী বলল–আমাকে তুমি বলতে পারেন।
-ওক্কে। বলো।
নন্দিনীর কণ্ঠস্বর শান্ত ও বিষণ্ণ। কিন্তু প্রথম যৌবনের উত্তাপ হয়তো মেয়েদের কী এক স্পর্ধিত সাহসও দেয়। সে একটু পরে খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।
ততক্ষণে কর্নেল আলমারির বই দেখতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনটে পুরনো আলমারি ইংরেজি বাংলা বই আর বাঁধানো পত্রিকায় ঠাসা। কর্নেল তন্নতন্ন করে দেখছে। ঝুঁকে পড়ছেন। কখনও হাঁটু দুমড়ে বসছেন। নন্দিনী ইনিয়ে-বিনিয়ে সে রাতের কথা বলে যাচ্ছে। সে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরে ঘুম ভেঙে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখে, তখনও তার বাবা ফেরেনি। সে সদর দরজা খুলে রাস্তায় যায়। সেইসময় তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে বংকার মা ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেয়, এইমাত্র বস্তির কে তার বাবাকে খালের ধারে পড়ে থাকতে দেখেছে। মাথায় চাপ-চাপ রক্ত।
নন্দিনীর কণ্ঠস্বর এতক্ষণে কেঁপে গেল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল! কর্নেল বললেন–দ্যাটস এনাফ। মন শক্ত করো নন্দিনী।
কর্নেল এসে সোফায় বসলেন–তোমার বাবার কালেকশন মূল্যবান। বহু দুষ্প্রাপ্য বই আছে। কিন্তু ওঁর লেখা বাংলার আগস্ট বিপ্লব তো দেখলাম না।
নন্দিনী চোখ বড় করে তাকাল। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–কদিন আগে বাবা বইটা খুঁজছিল। একটামাত্র কপি ছিল। নেই। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, কাকেও পড়তে দিয়েছি নাকি। আমি বাবার বইটা দেখিনি। মাকে জিজ্ঞেস করছিল। মা-ও জানে না কিছু। বাবা তন্নতন্ন খুঁজে বইটা পায়নি। শেষে স্কুলের লাইব্রেরিতে গেল। লাইব্রেরিতে নাকি একটা কপি ছিল। পাওয়া যায়নি। বাবা বলছিল, ভারি অদ্ভুত ব্যাপার!
–তোমার বাবার কাছে নিশ্চয় অনেকে দেখা করতে বা আড্ডা দিতে আসতেন?
-হ্যাঁ। বাবা ফ্রিডম-ফাইটার ছিল। ফ্রিডম-ফাইটারস অ্যাসোসিয়েশন গতবার সভা করে বাবাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। তারা আসতেন। আমি কাকেও চিনি না। অ্যাড্রেসও জানি না। বাবার নোটবইয়ে থাকতে পারে।
কর্নেল গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন-জয়ন্ত! এই বইহারানো পয়েন্টটাও নোট করে নাও। নন্দিনী, তোমার বাবার নোটবইটি নিয়ে এসো। অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে যোগাযোগ করবে জয়ন্ত।
নন্দিনী উঠে গেল। আমি কথা বলতে যাচ্ছি, কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে নিষেধ করলেন। চায়ের ট্রে নিয়ে সম্ভবত বংকার মা ঢুকল। সেই প্রবীণ মহিলা উঁকি মেরে দেখে বললেন–খুকু কোথায় গেল?
কর্নেল বললেন–পাশের ঘরে।
মহিলা অদৃশ্য হলেন। বংকার মাও চলে গেল। চা খেতে খেতে নন্দিনী একটা কালো মোটা নোটবই নিয়ে ফিরে এল। কর্নেল নোটবইটা তার হাত থেকে টেনে নিলেন। পাতা ওল্টাতে থাকলেন। একটু পরে বললেন-জয়ন্ত। লেখো, ১১৭ বি নকুল মিস্ত্রি লেন, কলকাতা-৫।
আমি লিখলাম। কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়েই বললেন-সর্বনাশ আমি তো চায়ে চিনি খাই না। থাক্।
নন্দিনী উঠে দাঁড়িয়ে বলল–চিনিছাড়া চা এনে দিচ্ছি। একটু বসুন!
সে চলে গেলে কর্নেল একটা কাণ্ড করে বসলেন। নোটবই থেকে একটা পাতা সাবধানে ছিঁড়ে দ্রুত ভাজ করে পকেটে ঢোকালেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
নন্দিনী ফিরে এসে বসলে কর্নেল পাতা উল্টে বললেন–পরিতোষ লাহিড়ির ঠিকানা আছে দেখছি। আমি ভদ্রলোককে চিনি। অমরেশবাবুর সঙ্গে একবার আমার কাছে গিয়েছিলেন। নন্দিনী কি পরিতোষবাবুকে চেনো?
নন্দিনী একটু ভেবে নিয়ে বললনামটা চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। গত সোমবার–না, মঙ্গলবার এসেছিলেন। কোথায় একটা মিটিং হবে। বাবাকে বলতে এসেছিলেন। বাবার যাওয়ার কথা ছিল। আজই তো ডেট ছিল। আজ রোববার।
–কোথায় মিটিং হওয়ার কথা মনে পড়ছে? জয়ন্ত, নোট করে।
নন্দিনী স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। বলল কলকাতার বাইরে কোথায় যেন। নোট বইয়ে টোকা থাকতে পারে। বাবা সব লিখে রাখত।
কর্নেল পাতা উল্টে খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। বংকার মা চিনিছাড়া চা দিয়ে গেল। কর্নেল সেই চায়ে দিব্যি চুমুক দিলেন। সত্যি বলতে কি, চা আমি অনেক কষ্টে গিলেছি। নন্দিনীদের চা নন্দিনীর মতো নয়। ঠিক বংকার মায়ের মতোই। কথাটা আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে ফেরার সময় বলতে হবে।
নন্দিনী বলল–পেলেন না? আমাকে দিন তো।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। নোটবইটা ওর হাতে দিয়ে বললেন–থ্যাংকস নন্দিনী। অ্যাসোসিয়েশন অফিস থেকে জেনে নেবে জয়ন্ত। চলি! আর শোনো, মাকে আমার কথা বোলো। ভেঙে পড়ো না। শক্ত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াও। আমার নামটা মনে থাকবে তো? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বলে পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে দিলেন। কিছু ঘটলে মিনিস্টারকে ফোন করার আগে আমাকে ফোন করে জানাবে।
নন্দিনী কার্ডে চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। মনে হলো, মেয়েটি বড় সরল আর নিষ্পাপ। কর্নেল ওর সঙ্গে ছলনা না করে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলেই পারতেন। হয়তো ও তাতে সাহস পেত মনে। হয়তো কোনও গোপন কথা বলার ছিল, বলল নাকর্নেলের পরিচয় পেলে তা খুলে বলত। কর্নেলের নোটবইয়ের পাতা চুরির দরকারই হতো না। কিন্তু কর্নেল কেন সে-পথে গেলেন না?
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘোরানোর সময় দেখলাম, কালো নোটবই হাতে নিয়ে নন্দিনী বিষাদের প্রতিমূর্তির মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
ভি আই পি রোডে পৌঁছুনো অব্দি কর্নেল চোখ বুজে ধ্যানস্থ ছিলেন। এতক্ষণে চোখ খুলে বললেন–ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। দ্যাটস দ্য পয়েন্ট, ডার্লিং!
–কিসের?
–এই রহস্যের। কল্পনা করো জয়ন্ত! এই জুন মাসের রাতদুপুরে লোডশেডিংয়ের সময় তোমার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কেউ পদ্যটা জোর গলায় আওড়াচ্ছে। তুমি। কী করবে?
–কিছুই করব না। কারণ ধরেই নেব, লোকটা পাগল। পাগলের কথায় কান দিলে তার পাগলামি বেড়ে যাবে। কমন সেন্স!
নাহ। এখন তুমি ঘটনাটা জানো বলেই এ কথা বলছ। আচমকা ওই পাগলামি শুরু হলে অবশ্যই তুমি রেগে যাবে। তাকে ধমকাবে। তাড়া করতেও বেরুতে। পারো। ভেবে বলো।
–হ্যাঁ। তবে তাই বলে তার পিছনে বেশিদূর দৌডুব না।
কর্নেল হাসলেন এবার তুমি ঠিক বলেছ। বেশিদূর তাড়া করে তুমি যাবে না। এটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত। অথচ লক্ষ্য করার মতো ঘটনা : পাগল প্রথম রাতে আসে। অমরেশ ধমক দেন। পাগল চলে যায়। দ্বিতীয় রাতে আসে। ধমক দেন। শেষে বেরিয়ে তাড়া করেন। প্রায় হাফ কিলোমিটার। এবার পরিতোষের প্রতিক্রিয়া দেখ। উনি শোনামাত্র বেরিয়ে পড়েন। তাড়া করে যান–সেও প্রায় একই দূরত্ব। পদ্যটার মধ্যে কি কোনও পুরনো তিক্ত স্মৃতি লুকিয়ে ছিল? কোনও সাংঘাতিক ঘটনার গোপন স্মৃতি? তবে অমরেশ পরিতোষের চেয়ে সহিষ্ণু। এটুকুই যা তফাত। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার আছে। দুজনকেই পাগল নিয়ে গেছে নির্জন জায়গার দিকে। খুনী সম্ভবত সেখানে ওত পেতে বসেছিল। পাগল তার ফাঁদ।
অবাক হয়ে বললাম–আগে তো কখনও এমন ঝটপট আপনাকে থিওরি দাঁড় করাতে দেখিনি। নোটবইটার চুরি করা পাতায় নিশ্চয় কোনও তথ্য পেয়ে গেছেন।
কর্নেল জিভ কেটে মাথা নেড়ে বললেন-ছিঃ ডার্লিং। আমাকে প্রকারান্তরে চোর বোলোলা না। কাজটা যে-কোনও রহস্যে তথ্য সংগ্রহের মধ্যে পড়ে।
— কী আছে তথ্যে?
–কুমারচক উন্মাদ আশ্রমের ঠিকানা এবং একটি নাম–শচীন্দ্র মজুমদার। আরও কিছু কথা।
চমকে উঠে বললাম–বলেন কী! কিন্তু সেই পলাতক পাগলের সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক! আমার মাথা ঘুরছে, বস্!
সাবধান জয়ন্ত! অ্যাকসিডেন্ট করে বসবে। বলে কর্নেল আবার চোখ বুজে হেলান দিলেন।
ইলিয়ট রোডের বাড়িতে কর্নেলকে পৌঁছে দিয়ে ইস্টার্ন বাইপাস হয়ে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে যখন ফিরলাম, তখন প্রায় একটা বাজে। সারাপথ পাগল খুঁজেছি। আশ্চর্য ব্যাপার, রোজই রাস্তাঘাটে কত পাগল দেখি, এদিন একটাও দেখলাম না। পুলিশ কি রাজ্যের সব পাগলকে থানায় নিয়ে গেছে? বলা যায় না। মিনিস্টারের কেস।
সেদিনই রাত দশটায় কর্নেলের ফোন পেলাম। বললেন–তুমি আসবে ভেবেছিলাম। এলে না। ভয় পাওনি তো?
অবাক হয়ে বললাম–ভয়? কিসের ভয়?
-পাগলের। হাসি পেল।
–পাগল কি আর কলকাতায় আছে? সবাইকেই সম্ভবত পুলিশে ধরেছে।
‘বরকধঝ-কচতটপ’কে ধরতে পারেনি। কিছুক্ষণ আগে শ্যামবাজারের একটা গলিতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তার হাতে একটা ছোট্ট কিন্তু মোটাসোটা লোহার ডাণ্ডা ছিল।
–সর্বনাশ!
–নাহ। খুব ভদ্র পাগল। শিক্ষিতও।
–কিন্তু হাতে লোহার ডাণ্ডা…
–ওর পেছনে কুকুর লাগে। তাই সে ওটা মেট্রোরেলের আবর্জনা থেকে সংগ্রহ করেছে। যাই হোক, ওকে ডিনারের নেমন্তন্ন করলাম। রাজিও হল। কিন্তু আমার গাড়িতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মত বদলাল। ফেলুবাবুর বাড়ি এ রাতে তার নাকি ডিনারের নেমতন্ন। ভুলে গিয়েছিল। ফেলুবাবুর আসল নাম সে বলতে পারল না। শুধু বলল, মিনিস্টার।
ইন্টারেস্টিং! তারপর?
–দৌড়ে পালিয়ে গেল। ডার্লিং! এ বয়সে ছোটাছুটি, বিশেষ করে পাগলের পিছনে–আমাকে মানায় না।
–শ্যামবাজারের গলিতে কেন গিয়েছিলেন?
–সেই নকুল মিস্ত্রি লেন। ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিস।
তাই বলুন! বইটা পেলেন?
–নাহ্। বইটা ছিল। কিন্তু খুঁজে পেলেন না ওঁরা। ইস্যুরেজিস্টার খুঁজেও হদিস মিলল না। দোতলায় অফিস। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেই এক পাগলের মুখোমুখি হলাম! জিজ্ঞেস করলাম-বরকধঝ-কচতটপ? সবিনয়ে হেসে বলল–আজ্ঞে। তো আমার ডিনারের নেমন্তন্ন নাকচ করে সে পালিয়ে গেল। তখন আবার সেই অফিসে উঠে গেলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম, একজল পাগল কদিন থেকে ওঁদের অফিসে এসে জ্বালাতন করছে। সন্ধ্যার দিকে অফিস খোলে। তখন সে আসে। তাড়া খেয়ে নীচে সিঁড়ির ধাপে চুপচাপ বসে থাকে। ওঁরা কেউ তাকে চেনেন না। অথচ সে বলে, আমিও একজন ফ্রিডম-ফাইটার।
–লাহিড়িসায়েবকে জানিয়ে দিন।
–দিয়েছি। কিন্তু এর চেয়ে ইন্টারেস্টিং খবর আছে, জয়ন্ত! তুমি এলে না। এলে খুব এনজয় করতে। সকালে এসো। বলবখন। রাখছি।
–হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
বলল।
–জাস্ট একটু হিন্ট দিন প্লিজ।
–হালদারমশাই সত্যিই কুমারচকে গিয়েছিলেন। রোমাঞ্চকর অভিযান বলা চলে। রাখছি।…
লাইন কেটে গেল। এ একটা বিচ্ছিরি রাত। তালগোল পাকানো রহস্যের মতো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি আবার। কতবার মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার বৃদ্ধ বন্ধুর সংসর্গ যত আনন্দদায়ক হোক, ওঁর ওইসব বাতিকের সঙ্গে নিজেকে জড়াব না। শেষাবধি উনিই রহস্যের জট ছাড়াবেন এবং দৈনিক সত্যসেবকের জন্য চমৎকার একটা স্টোরি এমনি-এমনি তো পেয়ে যাব। কাজেই অকারণ আমার হন্যে হওয়ার মানে হয় না। অথচ রহস্য জিনিসটাই এমন এক চুম্বক, যা কাকেও নিরপেক্ষ থাকতে দেয় না। নিজের দিকে টেনে নেয়। নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়ে।
তা হলে প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক কুমারচকে পাড়ি জমিয়েছিলেন? অনেক প্রাক্তন এবং বর্তমান পুলিশ অফিসার দেখেছি, এমন ছিটগ্রস্ত কাকেও দেখিনি। ওঁর অভিযান কী অর্থে রোমাঞ্চকর ভেবেই পেলাম না। অবশ্য উনি বড় হঠকারী এবং দুর্দান্ত বেপরোয়া এবং জেদি মানুষও বটে।
ঘুম না এলে শক্ত বিষয়ের বই পড়ে দেখতে পারো। আমার এক অভিজাত সাংবাদিক বন্ধুর উপদেশটা মনে পড়ল। ছাত্রজীবনে আঁতলামির নেশায় বাইশ টাকা দামে কেনা জাঁ পল সাত্রে’র ‘বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস’ গাব্দা বইটা চমৎকার কাজে দিয়েছে, সেটা সকালে বোঝা গেল অবশ্য। বইয়ের কথাগুলো চোখে ধাক্কা মেরেছে। মাথায় ঢোকেনি। কাজেই চোখ বেচারা কাহিল হয়ে বুজে গেছে।…
.
কর্নেলের তিনতলার ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, বৃদ্ধ রহস্যভেদী এখন প্রকৃতিরহস্যে কুঁদ হয়ে আছেন। একগোছা অর্কিড একটুকরো কাটা ডালে সাঁটা এবং সেটা টেবিলে রেখে উনি আতস কাঁচে কী সব দেখছেন। ইশারায় বসতে বললেন আমাকে।
একটু পরে উজ্জ্বল মুখে হাসলেন। হালদারমশাইয়ের উপহার। সচরাচর এত সরু ডালে অর্কিড বাঁচে না। তবে বরাবর বলে আসছি ডার্লিং; প্রকৃতির রহস্য অন্তহীন। হালদারমশাই ডালটা মুচড়ে ভেঙে কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন অত দূর থেকে। উনি জানেন, আমি অর্কিড ভালবাসি। তুমি একটু বসো। এটার সঙ্গতি করে আসি।
কর্নেল তার ছাদের শূন্যোদ্যানে চলে গেলেন। ষষ্ঠী ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স এনে দিয়ে চাপাস্বরে বলল–হালদারমশাই কোথায় পাগলাগারদে ঢুকেছিলেন। কপালে হাতে-পায়ে পট্টি বাঁধা। আমার সন্দ, পাগলারা ওনাকে মেরেছে। মার খেয়ে গাছের ডগায় উঠে লুকিয়ে ছিলেন। ইংরিজিতে বলছিলেন তো। সব কথা বুঝতে পারিনি।
বললাম কাল রাতে এসেছিলেন উনি?
আজ্ঞে। বলছিলেন, কোনওরকমে পাইলে এসেছেন। বলেই ষষ্ঠী চলে গেল।
.
ড্রয়িংরুমের কোনা থেকে ছাদে সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়িতে কর্নেলের পা দেখা যাচ্ছিল। নেমে এসে বাথরুমে ঢুকলেন। একটু পরে বেরিয়ে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরিয়ে প্রসন্নমুখে বললেন-কৃত্রিম পদ্ধতিতে অর্কিড চাষ সহজ নয়। এসব পরজীবী উদ্ভিদকে জ্যান্ত গাছের ডাল ছাড়া বাঁচানো কঠিন। তবে কাটা ডালে অর্কিডের খাদ্য যোগান দিলে কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। সারারাত ডালটা জারে ঠাণ্ডা জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। দেখা যাক।
বললাম হালদারমশাই কুমারচকের উন্মাদ আশ্রমে ঢুকে পড়েছিলেন। তারপর পাগলাদের ভোলাই খেয়ে গাছে চড়েছিলেন। সেই গাছের ডালে অর্কিডটা ছিল। ইজ ইট?
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন।–যষ্ঠীর বর্ণনা। হুকতকটা তাই। তবে পাগলারা তো বন্দী। ওঁকে চার্জ করেছিল গার্ডরা। দিনদুপুরে একটা লোক আশ্রমের দেয়ালের ওপর গাছে চড়ে বসে আছে, এটা সন্দেহজনক। এই অবস্থায় ওই অর্কিডটা ওঁকে বাঁচিয়ে দেয়। উনি নিজেকে বটানিস্ট বলে পরিচয় দেন। অর্কিড সংগ্রহের হবির কথাও বলেন।
ষষ্ঠী বলছিল, কপালে হাতে-পায়ে পট্টি বাঁধা।
গাছের ডালের খোঁচায় ছড়ে গেছে। তাড়াহুড়ো নামতে গিয়ে পড়েও গিয়েছিলেন। তবে গার্ডরা প্রথমে ওঁকে পাগল ভেবেছিল। ভাবতেই পারে।
হালদারমশাই বরাবর এ ধরনের অদ্ভুত বিভ্রাট বাধান দেখেছি। হাসতে হাসতে বললাম-সত্যিই রোমাঞ্চকর অভিযান বলা চলে। কিন্তু এতে লাভটা কী হলো?
কিছুটা হয়েছে। উন্মাদ আশ্রমটা বেসরকারি, এটা জানা গেছে। তার সেক্রেটারির নাম শচীন্দ্র মজুমদার, তা-ও জানা গেছে। মিনিস্টার প্রতাপ সিংহমশাই আশ্রমের পৃষ্ঠপোষক এবং সরকারি সাহায্য পাইয়ে দেন। এমন কি, আন্তর্জাতিক সাহায্যও ওঁর চেষ্টায় পাওয়া যায়। হালদারমশাই কতগুলো তথ্য সংগ্রহ করে এনেছেন।
একটু অবাক হয়ে বললাম–শচীন্দ্র মজুমদারের নাম অমরেশবাবুর নোটবইয়ে লেখা ছিল না?
–হ্যাঁ। যে মিটিংয়ের কথা শুনেছিল নন্দিনী, সেটা ওখানেই হওয়ার কথা ছিল। অনিবার্য কারণে পিছিয়ে গেছে।
অনিবার্য কারণ কি অমরেশবাবু এবং পরিতোষবাবুর মৃত্যু?
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন শচীনবাবু বলেছেন, ম্যানেজিং কমিটির দুজন সদস্যের মৃত্যু। খুন-খারাপির কথা বলেননি। বুদ্ধিমান হালদারমশাই ও-কথা তোলেন-ও নি।
পাগল সম্পর্কে বিজ্ঞাপনটার কথা তোলেননি হালদারমশাই?
নাহ্। তবে শচীনবাবু নিজে থেকেই বলেছেন, আশ্রম থেকে একজন পাগল পালিয়ে গেছে। সে নাকি খুনে প্রকৃতির পাগল। একজনকে সাংঘাতিকভাবে জখম করেছিল। তখন তাকে নির্জন সেলে আটক রাখা হয়। হাতে-পায়ে ডাণ্ডাবেড়ির কথা ভাবা হয়েছিল। ডাণ্ডাবেড়ির অর্ডারও দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় কামারশালায়। কিন্তু কী করে সে গরাদ বেঁকিয়ে পালিয়ে গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, তাকে কড়াডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। দুজন সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার ভলান্টারি সার্ভিস দেন। তাঁরাও কমিটির মেম্বার। কর্নেল চুরুট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্রচার-পুস্তিকা বের করলেন। পড়ে দেখ। ইন্টারেস্টিং।
চার পাতার চটি বইটায় চোখ বুলিয়ে জানতে পারলাম, ১৯৪২ সালে আগস্ট বিপ্লবের সময় অনেক বিপ্লবী ধরা পড়েন। অনেকের ফাঁসি হয়। অনেকের দীর্ঘমেয়াদী জেল হয়। স্বাধীনতার পরও অনেকে মুক্তি পাননি। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ছিল। আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতে এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের জটিলতায় তাদের মুক্তি পেতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে শারীরিক নির্যাতন আর মানসিক পীড়নে তাঁদের কেউ-কেউ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। ছয়ের দশকের শেষাশেষি ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনগুলো গড়ে ওঠে নানা জায়গায়। কুমারচকেও গড়ে ওঠে। উন্মাদ হয়ে যাওয়া বিপ্লবীদের চিকিৎসা এবং আশ্রয়ের জন্য একটা আশ্রম গড়া হয়। জনা-সাতেক বিপ্লবীকে আশ্রমে আনা হয়েছিল। এখন তারা বেঁচে নেই। কিন্তু আশ্রমটি তুলে দেওয়া হয়নি। সমাজসেবার স্বার্থে সাধারণ উন্মাদদের জন্য কাজ চলতে থাকে। এদিকে মন্ত্রী প্রতাপ সিংহের পৈতৃক বাড়ি কুমারচকে। প্রধানত তারই উদ্যোগে স্বাধীনতাসংগ্রামী সেবাশ্রম নামটা বদলে ‘কুমারচক উন্মাদ আশ্রম’ নাম রাখা হয়।
বইটা ফেরত দিয়ে বললাম–তা হলে গত রাতে আপনি ‘বরকধঝ-কচতটপ’ এর দেখা পেয়েছিলেন এবং সে একটা ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে গিয়ে জ্বালাতন করে। কাজেই কুমারচক উন্মাদ আশ্রমের পলাতক পাগল একজন প্রাক্তন বিপ্লবী। রাইট?
কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন–পসিলি!
শচীনবাবুও কি প্রাক্তন বিপ্লবী?
–অবশ্যই।
কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম। আজকাল সিগারেট কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু যা বুঝছি রহস্যটা অতীব জটিল। তাই সিগারেট জরুরি ছিল। বললাম– সেই হারানো বইটা আপনি ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিতে খুঁজে দেখতে পারেন। ১৩৩ ১৩৪ পৃষ্ঠায় কী ছিল যে–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন–হয়তো বইটার আর দরকার হবে না। আমার কাছে ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মিলিটারি সিক্রেট রেকর্ডস-সংক্রান্ত একটা বই আছে। ওতে দেখলাম, সেই বছর নদীয়া জেলায় অক্টোবর মাসের এক ঝড়বৃষ্টির রাত্রে একটা স্পেশাল মিলিটারি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছিল। নাশকতামূলক কাজ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, বর্মা রণাঙ্গণ থেকে পালিয়ে আসার সময় রেঙ্গুন ব্রাঞ্চ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে অনেক নগদ টাকা আর সোনাদানা এনে যশোর বিমানঘাঁটিতে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে সামরিক প্লেনে সেগুলো। পানাগড়ে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বড্ড বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে গিয়ে খামখেয়ালী লেঃ কর্নেল ট্রেডি স্যামসন সিন্দুকটা পাঠিয়ে দেন বহরমপুরে। তারপর ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মত করে ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে চাপিয়ে কলকাতা পাঠানো হয়। মৌরী নদীর ব্রিজে দুর্ঘটনা ঘটে। সিন্দুকটা আর পাওয়া যায়নি। পরে স্যামসনকে কোর্ট মার্শাল করা হয়। তদন্তকারী ব্রিটিশ অফিসারের মতে, স্যামসন নেটিভদের খুব বিশ্বাস করতেন।
হাসতে হাসতে বললাম–এ তো দেখছি গুপ্তধনরহস্যে পৌঁছুল! বোগাস!
-হুঁ, বরকধঝ-কচতটপ।
তার মানে?
–পুরনো বাংলা বর্ণপরিচয় দেখে নিও। অক্ষর চেনবার জন্য বরকধঝ লেখা থাকত। আর কচতটপ মাস্টারমশাইরা মুখস্থ করাতেন। ক বর্গ, চবর্গ, তবর্গ, টবর্গ, প-বর্গ। তো তুমি গুপ্তধন রহস্য বললে। তুমি লক্ষ্য করে থাকবে, সব গুপ্তধনের গল্পে হেঁয়ালি বা ধাঁধাঁ অনিবার্য। ওটা গুপ্তধন আবিষ্কারের সূত্র। কে বলতে পারে ‘বরকধঝ-কচতটপ’ সেই সূত্র নয়?
–আর ইউ সিরিয়াস, কর্নেল?
–একটা বিষয়ে অন্তত আমি সিরিয়াস। অমরেশ রায় এবং তাঁর সঙ্গীদের সেই সিন্দুক হাতানোই উদ্দেশ্য ছিল। সমস্যা হলো, অমরেশ শুধু আমরা লিখেছেন। সঙ্গীদের নাম লেখেননি। হারানো পাতা দুটোতে ছিল কিনা জানি না।
কর্নেল! কাল রাতে যে পাগলকে দেখেছেন, আমার ধারণা, সে অমরেশবাবুর সঙ্গী ছিল।
কর্নেল একটু পরে আস্তে বললেন-মৌরী নদীর ধারেই কিন্তু কুমারচক উন্মাদ আশ্রম। রেললাইন থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ, বলো!..বাহ। ওয়েল ডান ডার্লিং!..হ্যাঁ। ওঁর নিরাপত্তা দরকার। খুব সাবধান!..ওটা ফরেন্সিক টেস্টের জন্য পাঠিয়ে দাও।
কর্নেল ফোন রেখে বললেন-বরকধঝ-কচতটপ-কে পুলিশ পেয়ে গেছে।
–মিঃ লাহিড়ির ফোন নাকি?
-হ্যাঁ। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে নেতাজীর স্ট্যাচুর নীচে দাঁড়িয়ে সেই পদ্যটা আওড়াচ্ছিল। সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে, বরকধঝ-কচতটপ। হাতের ডাণ্ডাটা ফরেন্সিক টেস্ট করতে বললাম। দেখা যাক।
আজকের কাগজে পরিতোষ লাহিড়ির খুনের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। গতকাল আমার অল ডে ছিল। দৈনিক সত্যসেবকের আজকের খবরটার ভাষা পড়ে বুঝলাম অন্য কেউ লিখেছে। সম্ভবত সিনিয়র রিপোটার কার্তিকা। পরিতোষবাবুর সংক্ষিপ্ত জীবনীও দেওয়া হয়েছে।
কাগজ ভাঁজ করে রেখে বললাম-একটা খটকা লাগছে। গতকাল ভোরে পরিতোষবাবুর বডি পাওয়া যায়। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর খবর কুমারচকের শচীনবাবু কালই পেয়েছিলেন। হালদারমশাইকে বলেছেন উনি। আশ্চর্য।
কর্নেল বললেন–আশ্চর্য ঠিকই। তবে কুমারচক এখন প্রায় শহর হয়ে উঠেছে। টেলিফোন আছে। ট্রাংককলে খবর পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই প্রশ্ন, কে ট্রাংককল করল? বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–চলো। কাল গড়িয়ায় হরিপদবাবুর বাড়ি যাব ঠিক করেছিলাম। যাওয়া হয়নি। আজ যাওয়া যাক।…
.
০৩.
হরিপদবাবুর দোতলা বাড়িটা ঘিঞ্জি গলির শেষ দিকটায় একটা পুকুরের ধারে একাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা দেখে বোঝা যায়, টায়ে-টোয়ে খরচা করে কোনক্রমে তৈরি করা হয়েছিল। পুকুরের ওপারে কলোনি এলাকা। ঘন গাছপালার ভেতর ছোট আকারের ঘরবাড়ি।
দোতলার জানালা থেকে আমাদের গাড়ি দাঁড় করানো দেখে থাকবেন হরিপদবাবু। আমরা নামার সঙ্গে সঙ্গে উনিও এসে গেলেন। কর্নেল নমস্কার করলেন। উনিও নমস্কার করে নার্ভাস মুখে বললেন–আপনারা কি সি আই ডি থেকে আসছেন স্যার?
কর্নেল অম্লানবদনে বললেন–হ্যাঁ। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
বেশ তো। আসুন। ওপরে আসুন।
না, হরিপদবাবু! এখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করে চলে যাব।
বলুন স্যার!
–আপনি কি বাংলায় আগস্ট বিপ্লব নামে কোনও বই পড়েছেন?
হরিপদবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন—না তো। কেন স্যার?
–আপনার ভাড়াটে পরিতোষবাবুর ঘরে বইটা কখনও দেখেছেন?
পরিতোষদার ঘরে আমি বিশেষ ঢুকিনি। উনি বদরাগী টাইপ লোক ছিলেন। পাড়ায় বাস্তুহারা সমিতি ছিল তখন। সে অনেক বছর আগের কথা স্যার। সমিতির লোকেরা আমাকে এসে ধরলেন। তাদের কথায় ভাড়া দিয়েছিলাম।
আর একটা কথা হরিপদবাবু! আপনার তো টেলিফোন আছে?
–আছে স্যার।
–টেলিফোনে পরিতোষবাবুকে কেউ ডেকে দিতে বলত?
হ্যাঁ, স্যার! মাঝে মাঝে টেলিফোন আসত। বাড়িতে যে-যখন থাকত, ওঁকে ডেকে দিত। ওঁর সঙ্গে আমার এবং আমার ফ্যামিলির গুড রিলেশন ছিল।
–গতকাল বা তার আগের দিন কেউ ওকে ফোন করেছিল?
হরিপদবাবু মাথা নাড়লেন।-হ্যাঁ, হ্যাঁ। গতকাল সকালেই তো। আমি মিসূহ্যাপটার কথা জানিয়ে দিলাম।
–ট্রাংককল কি?
–অ্যাঁ? হ্যাঁ! ট্রাংককল। তাই জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে বলছেন? কী একটা জায়গার নাম বলল, বোঝা গেল না। তো স্যার আমি বললাম, পরিতোষবাবুর খবর খারাপ। মাডারড়।
কুমারচক থেকে ট্রাংককল?
হরিপদবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন–হতেও পারে। বুঝতে পারিনি স্যার। আসলে তখন মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন।
–আর একটা প্রশ্ন। আপনি, যখন পরিতোষবাবুর মাডারের খবর পান, তখন ওঁর ঘরের দরজা খোলা ছিল, লক্ষ্য করেছিলেন কি?
–হ্যাঁ। খোলা ছিল। আসলে আমি অনিদ্রার রুগী স্যার। বেলা অব্দি ঘুমোই। নীচে ডাকাডাকি শুনে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আমার ছেলে বাণীব্রত বলল, সাংঘাতিক ব্যাপার। পরিতোষজেঠু মাডার হয়েছেন। বডি পড়ে আছে রেললাইনের কাছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। রাত তিনটে নাগাদ নীচের ঘরে সাড়াশব্দ পেয়েছি। ভেবেছিলাম, পাগলাকে তাড়া করে পরিতোষদা ফিরে এলেন।
নীচের ঘরে শব্দ শুনেছিলেন? কী শব্দ?
দরজা বন্ধ হওয়ার। আরও কী সব শব্দ য়েন।
–অথচ পরে দেখলেন দরজা খোলা?
হ্যাঁ, স্যার!
–পুলিশকে জানিয়েছেন এসব কথা?
পরিতোষবাবু বিব্রতভাবে বললেন–সব কথা গুছিয়ে বলার মতো অবস্থা ছিল না। ওনারাও জিজ্ঞেস করেননি। ওই দেখুন, ঘরে সিলকরা তালা এঁটে দিয়েছে পুলিশ।
থ্যাংকস। চলি…।
দু-একজন করে কৌতূহলীদের ভিড় জমছিল। কর্নেল গাড়িতে উঠেই বললেন কুইক জয়ন্ত। বলা যায় না, ভিড় থেকে হয়তো শ্লোগান উঠবে এক্ষুনি জবাব চাই জবাব দাও!
কর্নেল হাসছিলেন। ঘিঞ্জি গলিতে সাইকেল রিকশার ভিড়। বড় রাস্তায় পৌঁছে বললাম–অমরেশবাবুকে খুন করে এসে খুনী হয়তো একইভাবে ওঁর ঘরে ঢুকেছিল। নন্দিনী সাড়াশব্দ পায়নি। কারণ সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরিতোষবাবুর ঘরে খুনী এসে ঢুকেছিল। ওপরতলা থেকে হরিপদবাবু সেটা টের পান। কিন্তু উনি ভেবেছিলেন, পরিতোষবাবু ফিরে এলেন। ঠিক বলছি বস্?
হুঁ।
কী খুঁজতে এসেছিল খুনী? গুপ্তধনের সূত্র?
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাবে শুধু হাসলেন। গোলপার্কে পৌঁছনোর পর বললেন–আমার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়ে তোমাকে বেরুতে হবে। অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেবে, ক্যাজুয়াল লিভ নিচ্ছ। তিনটে নাগাদ শেয়ালদায় আপ কৃষ্ণনগর লোকাল ধরব। কৃষ্ণনগর থেকে বাসেই যাব। বাসে ঘণ্টাখানেকের জার্নি। আসলে আমরা ঘুরপথে যেতে চাই। সোজা ট্রেনে গেলে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্ব। কিন্তু রিস্ক না নেওয়াই ভাল।
কুমারচক যাবেন নাকি?
–আমি যাব অর্কিডের খোঁজে। তুমি যাবে তোমার কাগজের পক্ষ থেকে। উন্মাদ আশ্রম সম্পর্কে রিপোর্টাজ লিখবে। মিনিস্টার যখন পৃষ্ঠপোষক, তখন কাগজের ইন্টারেস্ট থাকতেই পারে। মিনিস্টারেরও পাবলিসিটি হবে। পরবর্তী ভোটে কাজে লাগবে সেটা। পয়েন্টটা বুঝলে তো?
বুঝলাম। কিন্তু পাগলাগারদ ব্যাপারটা বড্ড অস্বস্তিকর।
উন্মাদ আশ্রম ডার্লিং!
–একই কথা। বরং হালদারমশাইকে সঙ্গে নিয়ে যান না কেন?
–হালদারমশাই সকালের ট্রেনে আবার গেছেন। তবে এবার গিয়ে সম্ভবত ছদ্মবেশ ধরেছেন।
–কী সর্বনাশ! আবার কী বিভ্রাট বাধাবেন তা হলে।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–তুমি তো জানো, উনি ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ। বলা যায় না, হয়তো পাগল সেজে আশ্রমে ভর্তি হয়েই গেছেন এতক্ষণে…।
ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে নন্দিনীকে দেখে অবাক হলাম। সে কর্নেলকে বলল–তারাজেঠুদের টেলিফোন হঠাৎ ডেড হয়ে গেছে। তাই চলে এলাম।
কর্নেল বললেন-কতক্ষণ এসেছ?
মিনিট দশেক আগে। নন্দিনী চাপাস্বরে বলল–মা বলল, কাউকে না জানিয়ে চুপচাপ আসতে। তাই একা এলাম। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন–কিছু কি ঘটেছে?
নন্দিনী তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ভাজ করা নীল ইনল্যান্ড লেটার বের করে কর্নেলকে দিল।–আজ বাবার টেবিলের ড্রয়ার গোছাতে গিয়ে এই চিঠিটা পেয়েছি। চিঠিটা দেখুন, মায়ের নামে এসেছিল। বাবা মাকে না দিয়ে কেন লুকিয়ে রেখেছিল বুঝতে পারছি না। মাকে আপনার কথা বলেছিলাম। মা এখন অনেকটা সুস্থ। আপনাকে জানাতে বলল।
কর্নেল চিঠিটা পড়ছিলেন। পড়ার পর আতসকাঁচে ডাকঘরের ছাপ পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন–গত ২৫ মে লোকাল পোস্ট অফিসে এসে পৌঁছেছিল। তো তোমার মা চিঠিটা পড়ে কী বললেন?
নন্দিনী বলল–মা বরাবর একটু হিস্টেরিক টাইপ। প্রথমে ভেবেছিলাম চিঠিটা দেখাব না। কিন্তু পরে ভাবলাম দেখানো উচিত। দেখালাম। বলল, বুঝতে পারছি না। তোর তারাজেঠুকে ডাক। তখন আপনার কথা বললাম।
কর্নেল চিঠিটা আমাকে দিলেন। কারণ আমি উসখুস করছিলাম চিঠিটা দেখার জন্য। চিঠিতে শুধু লেখা আছে :
আপনার স্বামীকে বলে ব্যর্থ হয়েছি। এবার আপনাকে বলছি। যদি বিধবা না হতে চান, তাকে বলুন অবিলম্বে দেখা করুক। এই শেষ চিঠি।
ইতি
বরকধঝ-কচটপ
কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললাম–লাহিড়ি সায়েবকে জানিয়ে দিন। থার্ড ডিগ্রিতে চড়ালে পাগলামি ঘুচে যাবে। হাতের লেখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পাগলের কীর্তি! কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং!
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–চিঠিটা বাগবাজার পোস্ট অফিসে ডাকে দেওয়া হয়েছিল। নকুল মিস্ত্রি লেনের কাছাকাছি।
তা হলেই বুঝুন!
নন্দিনী ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল–আমি চলি। পুলিশ এলে কি, চিঠির কথা বলব?
না চেপে যাও। আমি দেখছি। তবে আজ আড়াইটের পর আমি বাইরে যাব। যদি কিছু জানাবার মতো ঘটে, এই নাম্বারে ফোন করে জানাবে। আমার নাম করবে। তোমার তারাজেঠুর ফোন খারাপ বললে। অন্য কোথাও ফোন পাবে না?
–মোড়ে ওষুধের দোকানে পেয়ে যাব।
কর্নেল একটা চিরকুটে ফোননম্বর এবং নাম লিখে দিলেন। বললেন–মিঃ লাহিড়িকে চাই বলবে। আমার নাম করে বলবে, উনি কথা বলতে চান। তা হলে যদি অন্য কেউ ফোন ধরে, সে ওঁকে দেবে। আর উনি নিজেই ফোন ধরলে তো কথা নেই। এটা ওঁর পার্সোনাল ফোন নম্বর। আর তলারটা বাড়ির ফোন নম্বর। রাত আটটা-নটার পর হলে বাড়িতে পাবে ওঁকে।
নন্দিনী জিজ্ঞেস করল–কে ইনি?
কর্নেল হাসলেন–আমার এক স্নেহভাজন বন্ধু। তবে তোমার বাবাকে ইনিও। বিশেষ চিনতেন।
নন্দিনী চলে যাওয়ার পর কর্নেল টেলিফোন ডায়াল করতে ব্যস্ত হলেন। একটু পরে লাইন পেলেন।–অরিজিৎ? বরকধঝ…হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্রকৃত পাগল তো বটেই। তো শোনো! তোমাকে নন্দিনীর কথা বলেছিলাম। আমি নদীয়ার কুমারচক যাচ্ছি। কবে ফিরব ঠিক নেই।…না, না। অর্কিডের খোঁজে। হালদারমশাই আমাকে কুমারচক থেকে একটা অর্কিড এনে দিয়েছেন। যাই হোক, নন্দিনীর মায়ের নামে একটা চিঠি এসেছিল। অমরেশবাবু স্ত্রীকে না দিয়ে সেটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। চিঠিটা ষষ্ঠীর কাছে রেখে যাচ্ছি। তোমাকে দেবে।…হ্যাঁ, ইন্টারেস্টিং চিঠি। বরকধঝ-কে চিঠির কথাগুলো লেখানোর চেষ্টা করবে।…নাহ্। ওকে চিঠি দেখাবে না।…দ্যাটস রাইট। আর নন্দিনীকে তোমার নাম্বার দিয়েছি। পরিচয় দিইনি। কিছু ঘটলে তোমাকে রিং করে জানাবে সে। আর একটা কথা। ওদের বাড়ির কাছে তোমাদের লোক রাখা দরকার মনে হচ্ছে। প্লিজ অরিজিৎ! দিস ইজ ইমপর্ট্যান্ট।…ও কে ছাড়ছি।…
ফোন ছেড়ে কর্নেল হাঁকলেন–ষষ্ঠী!
ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুখ বের করে বলল–লাঞ্চো রেডি বাবামাশাই।
–লাঞ্চো পরে খাচ্ছি। তুই কাগজের দাদাবাবুকে নিয়ে যা। নীচে গিয়ে গোমসূবে বল্, বেসমেন্টের গ্যারাজে জয়ন্তের গাড়ি থাকবে। আমার গাড়ির পাশে পেয়ে যাবে, জয়ন্ত! যাও। ভয় নেই। গাড়ি চুরি যাবে না।
কৃষ্ণনগর থেকে ভিড়ে বোঝাই বাসটা যখন আমাদের কুমারচক পৌঁছে দিল, তখন চারদিকে সন্ধ্যার ঘোর লেগেছে। কিন্তু এ কোথায় এলাম? পিচরাস্তার ধারে কয়েকটা ঘুপচি দোকানপাট। কাছাকাছি আর কোনও ঘরবাড়ি নেই। উঁচু-নিচু গাছপালা আর আবাদী-অনাবাদী মাঠ। বললাম–কোথায় কুমারচক?
কর্নেল বললেন–আছে। গাছপালার আড়ালে ওই দেখ আলো ঝিকমিক করছে। মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্ব।
তা হলে এখানে নামলাম কেন?
–এটাই বাসস্টপ। কুমারচক ডাকবাংলোর স্টপ বলে লোকে। দাঁড়াও। একটা সাইকেল-রিকশা ডাকি।
বাস থেকে জনাকতক যাত্রী নেমেছিল। তারা কেউ সাইকেল রিকশায়, কেউ পায়ে হেঁটে চলে গেল। আমাদের দেখে একজন রিকশাওলা এগিয়ে এসেছিল। কর্নেলের চেহারা দেখেই তার শ্রদ্ধাভাব কিংবা বড় দাও মারার মতলব যেন। আসুন স্যার! লিয়ে যাই। ডাকবাংলোয় যাবেন তো স্যার? দশ টাকা রেট। ফরেস্টবাংলো কুড়ি টাকা। ট্যুরিস্ট লজ হলে পঁচিশ লাগবে স্যার! রাস্তা খারাপ।
কর্নেল রিকশায় উঠে বললেন–ফরেস্ট বাংলো।
বাসরাস্তাটা ধরে এগিয়ে রিকশাওলা বলল–আমি বলেই যাচ্ছি স্যার! অন্য কেউ আসত না। সন্ধেবেলা আজকাল বড় ছিনতাইয়ের ভয়।
–পাগলেরও ভয়।
রিকশাওলা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।–আজ্ঞে?
-বলছি পাগলের পাল্লায় পড়ার ভয়ও আছে। কারণ কুমারচকে নাকি পাগলাগারদ আছে শুনেছি।
রিকশাওলা আমোদে খিকখিক করে হাসতে লাগল। পিচরাস্তা থেকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া খোয়াঢাকা সংকীর্ণ রাস্তায় রিকশা জোরে গড়াচ্ছিল এবার। সমতলে পৌঁছে সে বলল–কথাটা স্যার মিথ্যে বলেননি। শুনলাম, গারদ ভেঙে দেবুবাবু পালিয়ে গেছে। আগের দিন কাকে কামড়ে দিয়েছিল। পাগলাদের দাঁতে বিষ আছে। স্যার। তার নাকি মরো-মরো অবস্থা।
–পাগলের নাম দেবুবাবু?
–আজ্ঞে। অনেক বছর ধরে পাগলা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওনার এক ভাই চণ্ডীবাবু সুবরেজেটিরি আপিসের মুহুরি। গত মাসে দাদাকে কোত্থেকে ধরে এনে শচীনবাবুদের পাগলাগারদে ভর্তি করেছিল। কিন্তু দেবুবাবুকে ধরে রাখতে পারে। শুনেছি, গরমেন্টের জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছিল। গরমেন্টই ধরতে পারেনি।
সে রিকশা থামিয়ে নামল। রিকশার মাথার ল্যাম্পটা জ্বেলে নিল। দুধারে উঁচু গাছ। অন্ধকার এখন গাঢ় হয়েছে। কর্নেল টর্চের আলো জ্বেলে সামনে ও পাশটা। দেখছিলেন। রিকশাওলা তার রিকশায় উঠে প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলল–টর্চ জ্বালবেন না স্যার। তাহলে আর দেখতেই পাব না কিছু।
-তুমি ঠিক বলেছ। তোমার নাম কী হে?
–আজ্ঞে স্যার, নেয়ামত আলি।
কুমারচকেই বাড়ি?
–আজ্ঞে, ছিল। এখন ডাকবাংলোর বাসটপে থাকি।
কুমারচক ছেড়ে চলে এলে কেন?
–ভাইদের সঙ্গে বনিবনা হলো না। জমিজিরেত তো নেই। তাই চলে এলাম। বাসটপ থেকে প্যাসেঞ্জার পাই। দুটো পয়সা বেশি রোজগার হয়।
রিকশাওলাটি খুব কথা-বলিয়ে লোক। দেশের হালচাল রাজনীতি, পার্টিবাজি, ভোট-এ সবই তার নখদর্পণে এবং তার এসব বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। কর্নেল দিব্যি ওই বিরক্তিকর প্রসঙ্গ নিয়ে কথার যোগান দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে বাঁদিকে রিকশা মোড় নিল। এতক্ষণে সামনে দূরে গাছপালার ভেতর বিদ্যুতের আলোর ছটা চোখে পড়ল। এবার সামান্য চড়াই। রিকশাওয়ালা সিট থেকে নামলে কর্নেল বললেন–ঠিক আছে নেয়ামত। আমরা এটুকু হেঁটে চলে যাব। এই নাও তোমার ভাড়া।
রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে চলে গেল। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন–তুমি একবার বলেছিলে রিকশায় চাপা অন্যায় এবং আমি কেন রিকশায় চাপি? জয়ন্ত, আমি শ্রমের বিনিময়ে মহুরি দিচ্ছি বলে তৃপ্তি পাই, এমন কিন্তু নয়। তুমি লক্ষ্য করে থাকবে, বিশেষ বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে আমি রিকশায় চাপি। এটুকু রাস্তা অনায়াসে হেঁটে আসতে পারতাম। কিন্তু বরকধঝ-কচতটপ-র নাম যে দেবীবাবু এবং সাবরেজেস্ট্রি অফিসের মুহুরি চণ্ডীবাবু যে তার ভাই, এই তথ্যটা এত শিগগির কি জানতে পারতাম? আমি দেখেছি, মফস্বলের রিকশাওলারা অনেক বিষয়ে খোঁজখবর রাখে। এরা একেকজন একেকটি তথ্যকেন্দ্র।
ফরেস্টবাংলোটা একটা উঁচু জায়গায়। গেটের সামনে যেতেই এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকলেন।আসুন কর্নেলসায়েব! ডি এফ ও সায়েবের লোক বিকেলে আমার কোয়ার্টারে মেসেজ দিয়ে গেল। তখনই চলে এলাম বাংলোয়। কিন্তু ট্রেন চলে গেল। আপনার দেখা নেই। তাই ভাবলাম আজ আর আসছেন না।
কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের নাম অনন্ত বিশ্বাস। একসময় ডিফেন্সে ছিলেন। পরে ওড়িশার একটা জঙ্গলে রেঞ্জার ছিলেন। চোরাশিকারিদের সঙ্গে ঝামেলায় চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর আবার সেই জঙ্গলের চাকরি জুটিয়েছেন। তবে এ জঙ্গল ওঁর ভাষায় নিরিমিষ জঙ্গল। মৌরী নদীর দুধারে একসময় বাঘ-ভালুকের জঙ্গল ছিল। পরে জঙ্গল প্রায় উজাড় হয়ে যাচ্ছিল। পরিবেশ রক্ষার কারণে সরকার গত তিরিশ বছর ধরে গাছ লাগিয়ে জঙ্গলটার ভোল ফিরিয়েছেন। তবে বাঘ-ভালুক নেই। বছর তিনেক আগে একটা ডিয়ার পার্ক হয়েছে। এই পর্যন্ত।
বাংলোয় কেয়ারটেকার-কাম-চৌকিদার ভোলা কর্নেলকে চেনে। মালী নবও চেনে। কুমারচকে কর্নেল দুবছর আগে এসেছিলেন। অথচ আমাকে বলেননি।
অনন্তবাবু সাইকেলে চেপে চলে গেলেন। আমরা বাংলোর উত্তরের বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিলাম। আলোর শেষ প্রান্তে ছোট্ট গেট। গেট থেকে পায়েচলা পথ জঙ্গলের ভেতর নেমে গেছে। কর্নেল বললেন–শ’দুই মিটার হেঁটে গেলে মৌরী নদী। এদিকটায় দিনে একটা পুকুর দেখতে পাবে। তারই মাটি টিলার মতো উঁচু করে এই বাংলো তৈরি হয়েছিল। নদীতে যত বন্যাই হোক, বাংলো ডোবে না। পুকুরটা নদীর জল পাম্প করে এনে গ্রীষ্মে ভর্তি রাখা হয়। পুকুরে প্রচুর মাছ আছে।
নব মালী বারান্দার শেষ দিকটায় বসেছিল। বলল–আর তত মাছ নেই স্যার! চোরের খুব উপদ্রব বাড়ছে। এই তো সেদিন রাতে জাল ফেলে ধরে নিয়ে গেল। আমরা ভয়ে বেরুতে পারিনি।
ফরেস্টগার্ড ছিল দেখেছিলাম। তারা কী করে?
নব হাসল।–গার্ড স্যার নামেই। নাইট ডিউটির সময় বাড়ি গিয়ে ঘুমোয়। সবই খাতা-কলমে। যত ঝামেলা আমার আর ভোলাদার। আজ রাতে রঘু আর কাশেমের ডিউটি নদীর ওপারে। এপারে ডিউটি শ্যামা আর লালুর। খাতায় সই করে বেরিয়ে গেছে। মাঝরাতে কান করলে শুনবেন গাছ কাটার শব্দ। ট্রাক কি নৌকোয় চাপিয়ে নিয়ে যায়। ধরবে কে? তবে হ্যাঁ, বন্দুকের ফটাস্ ফটু শুনতে পাবেন। কৈফৎ দিতে হবে তো?
ভোলা কিচেন থেকে বলল–কী ফালতু বকবক করিস নব? সায়েবদের ডিসটাব হচ্ছে না?
কর্নেল বললেন–না, না! নবর গল্প শুনতে ভালই লাগছে। আচ্ছা নব, আসার পথে শুনলাম, কুমারচকের পাগলাগারদ থেকে এক খুনে পাগল পালিয়ে গেছে।
–ও। হ্যাঁ। আমিও শুনেছি স্যার! বলে সে ডাকল–ভোলাদা! কিচেন থেকে ভোলা সাড়া দিল শুধু।
-ভোলাদা তার পাল্লায় পড়েছিল স্যার। নব বলল। সে হেসে অস্থির হচ্ছিল।–সেদিন কলকাতা থেকে এক অফিসার এসেছিলেন। সঙ্গে ফেমিলি ছিল। ভোলাদা সাইকেলে বাজার করে ফিরছে। ফরেস্টের এরিয়ায় স্যার, পড়বি তো পড় একেবারে তার মুখে। তারপর কী হলো সায়েবদের বলো ভোলাদা।
কর্নেল ডাকলেন–ভোলা। রান্না পরে হবে। এসো, গল্প করা যাক।
ভোলা বেরিয়ে এল একটু পরে। গামছায় হাত মুছে হাসতে হাসতে বলল আমি প্রথমে চিনতে পারিনি। সাইকেলে জঙ্গল ভেঙে সোজা আসছি। তখন বেলা প্রায় দশটা-এগারোটা হবে স্যার! ভাবলাম লুকিয়ে কেউ ডাল কাটতে এসেছে। হাতে কী একটা আছেও বটে। যেই বলেছি, কে রে? অমনি কী যেন বলে তেড়ে এল।
বরকধঝ-কচতটপ?
–তা-ই হবে। তবে স্যার, হাতে একটা শাবল ছিল। আমি পালিয়ে এলাম। কুমারচকে এক চণ্ডীবাবু আছে। তারই দাদা। কিন্তু তখনও জানি না, সে পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। শাবল ছুঁড়েছিল স্যার! জোর বেঁচে গেছি।
কর্নেল আস্তে বললেন–শাবল?
ভোলা হাসতে লাগল। লালুকে বলেছিলাম। আমাদের গার্ড স্যার। লালু শাবলখানা কুড়িয়ে এনেছিল। পাগলাবাবুকে দেখতে পায়নি।…
.
০৪.
নতুন জায়গায় গেলে আমার যা হয়। ঘুম আসতে চায় না। মশার উপদ্রব নেই। গরমও নেই। কারণ ঘরটা এয়ারকন্ডিশন্ড! রহস্যভেদী টেবিলবাতির আলোয় কী সব লেখালেখি করছিলেন, বোঝা গেল না। একবার দেখলাম, আস্তেসুস্থে উঠে বাথরুমে ঢুকলেন। সেই সময় বাইরে খুব চাপা যান্ত্রিক গরগর শব্দ শুনতে পেলাম। বাথরুমের দরজা বন্ধ বলে শব্দটা আর শোনা গেল না। পাশ ফিরে ঘুমুনোর চেষ্টা করলাম। বাথরুম খুলে উনি যখন বেরুচ্ছেন তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবার সেই শব্দ। ঘুরে বললাম-বাইরে যেন গাড়ির শব্দ শুনলাম?
কর্নেল শুধু বললেন–হুঁ।
কোনও অফিসার এলেন নাকি?
–আসতেই পারেন। কর্নেল টেবিলে ঝুঁকে পড়লেন। ফের বললেন–তেমন হোমরা-চোমরা কেউ এলেও এ ঘর ছাড়তে হবে না আমাদের। কারণ বাকি ঘরটাও এয়ারকন্ডিশন্ড।
এই বাংলোর এয়ারকন্ডিশনার যন্ত্র নতুন মনে হচ্ছে।
—কেন?
–তেমন শব্দ করছে না। আপনার মনে পড়ছে? দরিয়াগঞ্জ বাংলোয় সারারাত কী শব্দ! শেষে বন্ধ করে জানালা খুলে দিতে হলো। চিন্তা করুন, তখন অক্টোবর মাস। কী মশা! কী মশা!
–কথা বললে আর ঘুমই আসবে না ডার্লিং।
–এমনিতেই ঘুম আসছে না।
বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করে এসো। বাঘ-ভালুক নেই। কৃষ্ণপক্ষ হলেও এতক্ষণে চাঁদ ওঠার কথা। বরং নদীর ধারে চলে যাও। মুগ্ধ হবে।
–আপনিও চলুন না!
–আমার হাতে জরুরি একটা কাজ। ছেড়ে গেলে খেই হারিয়ে যাবে।
একটু ইতস্তত করে উঠে পড়লাম। বেরুতে যাচ্ছি, কর্নেল বললেন–সঙ্গে টর্চ নিয়ে যাও। আর–তোমার ফায়ারআর্মসটা কি এনেছ?
–হ্যাঁ। ফায়ারআর্মস কী হবে?
-পাগলের পাল্লায় পড়লে তাকে ভয় দেখাবে। বলা যায় না, আবার কোনও পাগল পালিয়ে আসতে পারে। সাবধান! কর্নেল হাসছিলেন। কিংবা ধরো, বিষাক্ত সাপের পাল্লায় পড়লে অস্ত্রটা কাজ দেবে। গ্রীষ্মে সাপ বেরুনো স্বাভাবিক।
সাপের কথা ভেবেই রিভলভার আর টর্চ নিলাম। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি, ভোলা পাশের ঘরের দরজা থেকে সবে বেরুচ্ছে। আমাকে দেখে সে সেলাম। দিয়ে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল–কোথায় যাবেন স্যার?
–ঘুম আসছে না। নদীর ধার থেকে একটু ঘুরে আসি।
–এত রাতে নদীর ধারে যাবেন?
–কেন? বাঘ-ভালুক তো নেই।
ভোলা কাচুমাচু মুখে হাসল।সাড়ে এগারোটা বাজে স্যার! জঙ্গল জায়গা। ওদিকটায় একসময় শ্মশান ছিল শুনেছি। রাতবিরেতে একা বেরুবেন? সঙ্গে যেতাম। বরং। কিন্তু কলকাতা থেকে এক সায়েব-মেমসায়েব এলেন এখুনি। ওই দেখুন ওনাদের জিপগাড়ি। চা-কফি খাবেন-টাবেন। আমার স্যার এই এক জ্বালা!
বারান্দা ঘুরে উত্তরে যাচ্ছি, ভোলা ফের বলল–গেটে তালা আছে স্যার! খুলে দিচ্ছি চলুন।
ছোট্ট গেটের তালা খুলে দিল ভোলা। দুধারে ঝোপঝাড়। ঢালু হয়ে একফালি পায়ে-চলা পথ নেমে গেছে। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গেলাম। সামনে ফাঁকা ঘাসে-ঢাকা জমি। তারপর নদী। নদীটা ছোট। বালির চড়া পড়েছে। কিন্তু জল আছে। খুব ধীরে স্রোত বইছে। টর্চ নিভিয়ে আধখানা চাঁদের আলোয় আদিম প্রকৃতির রূপ দেখছিলাম।
সাপের ভয়ে অবশ্য মাঝে মাঝে পায়ের চারদিকে টর্চের আলো ফেলছিলাম। একটু পরে ঘাসজমি থেকে নদীর শুকনো ঢালু খাড়ি দিয়ে নেমে বালির চড়ায় চলে গেলাম। হালকা এলোমেলো বাতাস বইছিল। বালিও শুকনো। বসে পড়লাম। ভোলা শ্মশানের কথা বলায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ভূতে না বিশ্বাস করলেও ভূতের ভয় আছে। তা ছাড়া এই আদিম প্রকৃতিতে নিশুতি রাতে আবছা জ্যোৎস্নায়– সবকিছুই কেমন রহস্যময় মনে হয়। কোথাও রাতপাখি ডেকে উঠল। একটু পরে মাথার ওপর দিয়ে ক্রাও ক্রাঁও করে উড়ে গেল পাচা। সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, নদীর ওপারে গাছপালার ভেতর লালচে আলোর বিন্দু জুগজুগ করছে।
কেউ সিগারেট টানছে। কিন্তু এত রাতে জঙ্গলে এমে কেউ সিগারেট টানছে, এটা অস্বাভাবিক মনে হলো। ওপারে তো কোনও বসতি নেই। কোনও বাংলোও নেই যে আমার মতো কোনও বাইরের লোক অনিদ্রার কারণে বেড়াতে বেরুবে। চোরাই কাঠচালানকারী নয় তো?
একবার ভাবলাম, গিয়ে চার্জ করব। কিন্তু বালির চড়ার নীচে আন্দাজ পনের কুড়ি মিটার চওড়া জল। জলটা কত গভীর জানি না। এখান থেকে টর্চের আলোও অতদূর পৌঁছুবে না। খামোকা লোকটা সতর্ক হবে এবং পালিয়ে যাবে।
গুড়ি মেরে এপারে চলে এলাম। পাড়ে উঠে ঘাসজমি পেরিয়ে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখলাম। একটা ছায়ামূর্তি সিগারেট টানতে টানতে জলের ধারে এল। সিগারেটটা জলে ছুঁড়ে ফেলল। জলের গভীরতা নিশ্চয় কম। কারণ সে জল পেরিয়ে বালির চড়ায় উঠল।
জ্যোৎস্নায় তাকে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। কোনও গ্রাম্য লোক নয়। পরনে প্যান্ট-শার্ট এবং হাতে লাঠির মতো কী একটা আছে। নদীর ঢালে এগিয়ে এসে সে ওটা কাঁধে তুললে বুঝতে পারলাম, ওটা বন্দুক।
পা টিপে টিপে বাংলোয় ওঠার রাস্তায় একটা ঝোঁপের পাশে গুঁড়ি মেরে বসে পড়লাম। বন্দুকধারী লোকটার গতিবিধি সন্দেহজনক! সে এসে আমার নাকের উগা দিয়ে বাংলোর গেটে চলে গেল। একটু থমকে দাঁড়াল গেটের কাছে। তারপর টর্চ জ্বালল এতক্ষণে। সম্ভবত গেট খোলা দেখে সে অবাক হয়েছে।
তারপর সে গেট খুলে ঢুকে গেল এবং এবার আমাকে অবাক করে চেঁচিয়ে ডাকল–ভোলা! অ্যাই ভোলা।
ভোলার সাড়া পাওয়া গেল–কে? কাশেমবাবু নাকি?
কাশেমবাবু! তার মানে ফরেস্টগার্ড কাশেম, যার কথা ভোলা বলছিল। এ ও বলছিল, কাশেমের ডিউটি আছে নদীর ওপারে। সব রহস্য মাঠে মারা গেল। এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে।
ভোলা বলছে–নদীর ধারে কলকাতার এক সায়েবের সঙ্গে দেখা হয়নি? উনি তো কিছুক্ষণ আগে বেড়াতে বেরুলেন।
বনরক্ষী বলছে–কাকেও তো দেখলাম না।
–সে কী! সর্বনাশ! উনি গেলেন কোথায়? কর্নেল সায়েবকে খবর দিই।
–সেই কর্নেলসায়েব এসেছেন নাকি?
–হ্যা! ওনার সঙ্গেই এসেছেন আরেক সায়েব।
বনরক্ষী চাপা গলায় বলে উঠল–টিকটিকি পাঠিয়েছে নাকি ওপর থেকে? সর্বনাশ হয়েছে। ভোলা। সেনসায়েবের আসার কথা! আসেননি?
–এসেছেন। এবার সঙ্গে মেমসায়েবও এসেছেন।
ওরা কথা বলতে বলতে ফুলবাগান পেরিয়ে বাংলোর বারান্দার দিকে যাচ্ছিল। বনরক্ষীর মুখে ‘টিকটিকি’ এবং ‘সর্বনাশ হয়েছে’ এই দুটো কথা শুনেই আমি সাড়া দিতে গিয়ে চুপ করেছিলাম। প্রথমে রহস্য নেই ভেবেছিলাম। কিন্তু রহস্য একটা আছে দেখা যাচ্ছে।
বারন্দা ঘুরে গিয়ে আমাদের রুমের দরজায় আস্তে নক করলাম। ভেতর থেকে কর্নেল বললেন–খোলা আছে।
ভেতরে ঢুকে চাপা গলায় বললাম–একটা অদ্ভুত ব্যাপার।
-পাগল, নাকি ভূত?
-নাহ্। বলে কর্নেলকে সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ দিলাম।
শোনার পর কর্নেল হাসলেন।-কাঠপাচার হবে ডার্লিং। কোনও এক সেনসায়েব সম্ভবত কাঠপাচার চক্রের চাঁই। বনরক্ষী কাশেমের সঙ্গে তার যোগসাজশ আছে বোঝা যাচ্ছে। সেনসায়েব চতুর লোক বলেই সঙ্গে মেমসায়েবকে এনেছে। সেই মেমসায়েব যে তার বউ, এ কথা হলফ করে বলা কঠিন।
-ভোলাও এর সঙ্গে যুক্ত।
জয়ন্ত, প্রাণের দায়ে বা চাকরির দায়ে আজকাল অনেক মানুষকে সব জেনেও মুখ বুজে থাকতে হয়।
-পুলিশে এখনই গিয়ে খবর দিয়ে আসা উচিত। হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে ওরা।
কর্নেল টেবিলের কাগজগুলো গুছিয়ে বললেন–কাঠপাচারের চেয়ে আমি এখন একটা মন্দিরের রহস্য দামী মনে করছি।
মন্দির। মন্দির কোথা থেকে এল?
বরকধঝ কচতটপ থেকে!
–অ্যাঁ?
–হ্যাঁঃ।
দরজায় নক করল কেউ। কর্নেল বললেন–খোলা আছে।
ভোলা ঢুকেই আমকে দেখে হাসল।–এসে গেছেন! ওঃ খুব ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম স্যার! গার্ড কাশেম এইমাত্র নদীর ওপার থেকে এল। জিজ্ঞেস করলে বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি।
কর্নেল বললেন–গার্ডরা রাতবিরেতে তোমাকে জ্বালাতে আসে দেখছি!
ভোলা বিব্রতমুখে বলল–হ্যাঁ, স্যার! ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, চা খাব।
কাশেম চা খেতে এসেছে?
–আজ্ঞে! বলে ভোলা বেরুনোর জন্য ঘুরল।
–পাশের ঘরে কে এসেছেন ভোলা?
–সেনসায়েব স্যার! মিনিস্টারের সঙ্গে ওনার খাতির আছে। মিনিস্টার আমাদের কুমারচকের রাজবাড়ির লোক স্যার। তা তো জানেন! মাঝে মাঝে আসেন সেনসায়েব। এবার সঙ্গে মেমসায়েবও এসেছে।
-ঠিক আছে! তুমি এসো। এবার আমরা শুয়ে পড়ব।
দরজা লক করে কর্নেল শুয়ে পড়লেন। তারপরই ওঁর নাক ডাকা শুরু হলো! বরকধঝ-কচতটপ-এর সঙ্গে একটা মন্দিরের কী সম্পর্ক বুঝতে পারছিলাম না। একসময় হাল ছেড়ে দিলাম।…।
ঘুম ভাঙতে বেলা হয়েছিল। কর্নেল যথারীতি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ভোলাকে বলে চা-বিস্কুট খাওয়া গেল। তারপর উত্তরের বারান্দায় গিয়ে বেতের চেয়ারে বসে কর্নেলের প্রতীক্ষা করছিলাম। নব ফুলবাগানে খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। কাজ শেষ করে সে উঠে দাঁড়াল। আমাকে দেখে সেলাম দিয়ে বলল– কর্নেল-সায়েব নদীর ওপারের জঙ্গলে পাখি দেখতে গেছেন। দেখুন, কখন ফেরেন। সেবার এসে সারাটা দিন জঙ্গলে ঘুরেই কাটালেন। এদিকে আমরা ভেবে সারা।
কথা বলতে বলতে সে সিঁড়িতে এসে বসল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে চাপাস্বরে বলল–কাল অনেক রাতে কলকাতা থেকে সেনসায়েব নামে এক সায়েব এসেছেন। মাঝে মাঝে আসেন বেড়াতে। এবার সঙ্গে ওনার মেমসায়েবও এসেছেন। ভোরবেলা দেখলাম, সেনসায়েব জিপগাড়ি নিয়ে একা বেরিয়ে গেলেন। আবার একটু আগে দেখলাম, কুমারচকের ঝন্টুবাবুর ছেলে এসে মেমসায়েবকে। নিয়ে নদীর ধারে গেল। কী যে চলছে সব, বুঝি না!
নব সকৌতুকে নিঃশব্দে হাসছিল। লোকটি আমুদে প্রকৃতির। বললাম কী চলছে বলে মনে হচ্ছে তোমার?
–ঝন্টুবাবু সেবার সেনসায়েবকে ফাঁসিয়েছিল। নব ফিসফিস করে বলল– জঙ্গল থেকে গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। শুনেছি, সেনসায়েব নানা জায়গায় কাঠগোলার মালিকদের কাছে টাকা খায়। মিনিস্টারের পেয়ারের লোক স্যার। যতবার আসে, কয়েক ট্রাক করে কাঠ চালান যায়। থানা-পুলিশ চুপ করে থাকে। সেবার ডি এফ ও ছিলেন কড়া লোক। ঝন্টুবাবুদের গিয়ে ধরলেন। ওনারা মিটিং করলেন। তারপর বংশীতলার মোড়ে ঝন্টুবাবুরা লোক জুটিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাক ধরলেন। পুলিশ গেল। সেনসায়েব গতিক বুঝে সটকানোর তালে ছিলেন। পুলিশ এসে ধরল। পরে অবিশ্যি ছেড়ে দিয়েছিল। সায়েবসুবোলোক স্যার! তাতে মিনিস্টারের চেনাজানা। কিন্তু পরে বোধকরি ঝন্টুবাবুর সঙ্গে মিটমাট করে নিয়েছে। তা না হলে সেনসায়েব যখন তখন আর আসছেন কী করে? এদিকে দেখুন ঝন্টুবাবুর ছেলের সঙ্গে মেমসায়েবের চেনাজানা।
ঝন্টুবাবু কে?
–ওই যে পাগলাগারদ করেছেন। কী যেন নামটা…..
–শচীন মজুমদার?
–নব হাসল–হ্যাঁ, স্যার! চেনেন নাকি?
নাম শুনেছি। ওর ছেলের নাম কী?
–বিলুবাবু। এ তল্লাটের ডাকসাইটে গুণ্ডা স্যার! বি এ পাশ। মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে বেড়ায়। কিন্তু যত খুনে মস্তান, সব ওর চেলা। মোটর সাইকেলে চেপে এল। সেনসায়েবের রুমে ঢুকল। একটু পরে মেমসায়েবকে নিয়ে এই গেট দিয়ে বেরুল। আপনি তখন বোধকরি ঘুমিয়ে ছিলেন।
নব হঠাৎ উঠে গেল। বাংলোর পশ্চিমে গাছপালার আড়ালে একটা পুকুর দেখা যাচ্ছিল। সে সেই দিকে চলে গেল।
একটু ইতস্তত করে উঠে পড়লাম। এই কৌতূহল অশালীন স্বীকার করছি। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা বোঝার নেশা পেয়ে বসেছিল। একটা রোমান্টিক ঘটনার আড়ালে কিছু নেই তো?
ঘরে গিয়ে ফায়ারআর্মসটা নিয়ে এলাম। উত্তরে নদীর দিকের গেটে যাচ্ছি, ভোলা দৌড়ে এল।–ব্রেকফাস্ট রেডি স্যার! কর্নেল সয়েব কখন ফিরবেন ঠিক নেই। আমি বাজার করতে যাব।
বললাম–এখনই আসছি। তুমি বাজারে গেলে নবকে বলে যেও। বেড়ালের হাত থেকে ব্রেকফাস্ট পাহারা দেবে।
বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, ভোলা আমাকে এখন ওদিকে যেতে দিতে চাইছে না। একবার ঘুরে দেখলম, ভোলা কেমন চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নদীর ধারে কেউ কোথাও নেই। বালির চড়া পেরিয়ে গেলাম। কাল রাতে টের পেয়েছিলাম, নদীর জলের গভীরতা কম। দিনের আলোয় দেখলাম, কালো স্বচ্ছ জল কোনওক্রমে বালি ছুঁয়ে ছটফট করে বয়ে যাচ্ছে। পায়ে স্লিপার ছিল। খুলে হাতে নিয়ে প্যান্ট একটু গুটিয়ে ওপারে গেলাম। এ পাড় খুবই ঢালু। ঝোপঝাড় চিরে একফালি পায়ে-চলা পথ এগিয়ে গেছে ঘন এবং উঁচু জঙ্গলের ভেতরে।
সতর্ক দৃষ্টি ফেলে হাঁটছিলাম। কিছুটা চলার পর আবছা কথাবার্তা কানে এল। ডানদিক থেকে। বিশাল একটা বটগাছ অজস্র ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তলায় প্রকাণ্ড সব ইট-কংক্রিটের চাঙড়। কোনও আমলে বাড়ি বা মন্দির ছিল নিশ্চয়। কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল, একটা প্রকাণ্ড চাঙড়ের ওপর বসে কথা বলছে, নিশ্চয় সেই মেমসায়েব এবং একজন শক্তসমর্থ গড়নের যুবক। মেমসায়েবের পরনে জংলি ছাপের শাড়ি, হাতকাটা ব্লাউস। যুবকটির পরনে জিনসের প্যান্ট, লাল গেঞ্জি। বটের ঝুরির আড়ালে গুঁড়ি মেরে সাবধানে তাদের প্রায় কাছাকাছি চলে গেলাম। একটা ঝোঁপের আড়ালে বসলাম। মিটার দশেক দূরত্বে ওরা বসে আছে। ওদের পিঠ দেখতে পাচ্ছি। সামনের ঝুরিটা একটা বাধা সৃষ্টি করছে। কিছু আর তেমন লুকোবার জায়গা নেই।
দৃশ্যটা সিনেমায় দেখেছি। বাস্তব জীবনেও এমন ঘটতে পারে ভাবিনি। তবে নাহ, ওরা গান গাইছে না। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে।
ঠিক এই সময় আমার ডানদিকে কোথাও চাপা শব্দ হলো। শুকনো পাতায় হাঁটাচলার মতো। হঠাৎ দেখি, লতাপাতা ঢাকা জুপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ। যুবক-যুবতী এমনই প্রেমোন্মত্ত যে কিছু টের পাচ্ছে না। লতাপাতার ভেতর থেকে এবার একটা মাথা দেখা গেল। সে খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল। তারপর সাংঘাতিক চমকে উঠলাম। লোকটার হাতে একটা ভোজালি।
সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার বের করে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম–এক পা নড়লে গুলি করব।
খুনে লোকটা এক লাফে স্কুপের আড়ালে লুকিয়ে গেল। বেঁকের মাথায় একটা গুলি ছুড়লাম। দু-তিন সেকেন্ডের ঘটনা। যুবক-যুবতী ছিটকে সরে গিয়েছিল। এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সামনে গেলাম বীরের ভঙ্গিতে।
যুবকটি ভুরু কুঁচকে বলল–থ্যাংকস।
—আপনি কি বিলুবাবু?
হ্যাঁ। আপনি কে?
–আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি। একজন সাংবাদিক। এখানে বেড়াতে এসেছি।
–আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন আপনি। আমি বোকার মতো একটা ফাঁদে ধরা দিতে এসেছিলাম। বলে সে ‘মেমসায়েবের’ দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল।
‘মেমসায়েব’ কঁদো-কঁদো মুখে বলে উঠল–বিশ্বাস করো বিলু! আমি জানতাম না
-শাট আপ! আর একটা কথা বললে শেষ করে দেব। আমার নাম বিলু! বলে সে জিনসের পেছন পকেট থেকে একটা খুদে রিভলবার বের করল। আমার দিকে ঘুরে বলল–আমারও ‘মেশিন’ আছে দাদা! কিন্তু আমি ভাবিনি, গোপন কথা আছে বলে এখানে ডেকে এনেও। দাঁড়াও। দেখছি তোমার হাজব্যান্ড শালাকে। শুওরের বাচ্চার বডি যদি আজই না ফেলে দিই তো ঝন্টু মজুমদারের ঔরসে আমার জন্ম হয়নি।
সে প্রায় দৌড়ে চলে গেল হিংস্র প্রাণীর মতো। মেমসায়েব দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। বললাম-কে আপনি?
কান্না থামছে না দেখে খাপ্পা হয়ে বললাম-ন্যাকামি ছাড়ুন। কে আপনি? ঠিক ঠিক জবাব না পেলে আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। শুনলেন তো আমি সাংবাদিক। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে এই জঙ্গলে চোরা কাঠপাচারের তদন্তে এসেছি। আপনিও দেখছি এর সঙ্গে জড়িত। আপনি সত্যি কথা না বললে আপনার ছবিও ছেপে দেব কাগজে। বুঝতে পারছেন কী বলছি?
‘মেমসায়েব’ এবার রুমালে চোখ মুছে মাথা নাড়লেন। করুণ মুখে বললেন বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না।
–আপনার নাম কী?
নীতা সেন। আমি কুমারচকেরই মেয়ে।
–আপনার স্বামীর নাম?
সুকমল সেন। আপনি আমার সব কথা শুনলে বুঝতে পারবেন, সত্যি আমি কিছু জানি না। বিলু আমাকে অকারণে ভুল বুঝে গেল। আমার ভয় করছে। আপনি আমাকে বাংলোয় পৌঁছে দিন প্লিজ!
চারদিক দেখে নিয়ে বললাম–চলুন।
বটগাছটা পেরিয়ে গিয়ে নীতা কান্নাজড়ানো গলায় বলল–আমি জানি, আমার স্বামী তোক ভালো নয়। আমার জীবনটাকে নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু আমার যাবার কোনও জায়গা নেই। মরতে ভয় করে। নইলে কবে মরে যেতাম।
আপনি বললেন কুমারচকের মেয়ে। ওখানে কেউ নেই আপনার?
–দূর সম্পর্কের এক কাকা আছেন। কিন্তু তিনি গরিব মানুষ। আমার দায়-দায়িত্ব নেননি। কলকাতায় আমার মামা ছিলেন। সেখানে পাঠিয়ে দেন। মামা মরার আগে আমার এই সর্বনাশ করে গেছেন।
কুমারচকে আপনার সেই কাকার নাম কী?
–চণ্ডিপ্রসাদ দাশগুপ্ত।
একটু অবাক হয়ে বললাম–চণ্ডীবাবু? মানে যিনি সাবরেজেস্ট্রি অফিসে কাজ করেন?
-হ্যাঁ। আপনি চেনেন?
–সাংবাদিকদের অনেক খোঁজ রাখতে হয়। তো আপনার বাবার নাম?
বাবা..নীতা ঢোক গিলে কান্না সামলে বলল–বাবা বেঁচে থেকেও ডেডম্যান। মা তো আমার ছেলেবেলায় মারা যান। আমার বাবা ফ্রিডম-ফাইটার ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে মাকে বিয়ে করেন। বেশ ছিলেন। বছর পনের আগে একটু করে পাগলামির লক্ষণ দেখা গেল। তারপর একেবারে পাগল হয়ে গেলেন।
উত্তেজনা চেপে বললাম–আপনার বাবার নাম দেবীবাবু?
নীতা আবাক হয়ে বলল–আপনি চেনেন? কোথায় দেখেছেন বাবাকে?
–দেখিনি। নাম শুনেছি। ফ্রিডম ফাইটারদের বইয়ে সম্ভবত।
নদীর ধারে এসে পৌঁছেছি ততক্ষণে। নীতা ব্যাকুলভাবে বলল–আপনি বিলুর কথা বিশ্বাস করলেন?
–বিলু সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব আছে। বিলু কেন বিয়ে করেনি আপনাকে?
হঠাৎ আমার বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমি কলকাতায় মামার বাড়িতে আছি। বিলু জানত না। পরে জানতে পেরে রেগে গিয়েছিল। কিন্তু আমার তো কিছু করার ছিল না। বিয়ের পর এই প্রথম এতদিনে কুমারচকে আসা হলো আমার। জানতাম না হঠাৎ আমার স্বামী এখানে নিয়ে আসবে।
–বিলু কী করে খবর পেল আপনি এসেছেন?
ভোরে আমার স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি ভোলাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। ভোলা আমাকে ছেলেবালায় দেখে থাকবে। তবে চিনতে পারেনি। তাই ওকে টাকা দিয়ে গোপনে পাঠিয়েছিলাম।
–আপনার গোপন কথাটা বলতে আপত্তি থাকলে শুনব না। তো
–আপত্তি নেই জয়ন্তবাবু। আমি স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওকে ডেকেছিলাম। বিলু দুর্ধর্ষ ছেলে। আমার বিশ্বাস ছিল, ও আমাকে ওই বাস্টার্ডটার হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যে শয়তানের হাতে আমি পড়েছি, সে যে কত ধূর্ত, তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। এখন আমার ভীষণ ভয় করছে। আপনি আমাকে বাঁচান জয়ন্তবাবু।
নীতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বললাম–সিনক্রিয়েট করবেন না। চলুন দেখি, আমার বৃদ্ধ সঙ্গী ভদ্রলোক ফিরেছেন কিনা। উনি একজন মস্তবড় ট্রাবলশুটার। মুশকিল আসানও বলতে পারেন।
ঢালু পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। পেছনের দিকে আচমকা হাসির শব্দ শুনে ঘুরে দেখি, স্বয়ং দাড়িওয়ালা মুশকিল আসান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বাইনোকুলার তখনও ধরা এবং বুকে ক্যামেরা ঝুলছে। পিঠের কিটব্যাগে প্রজাপতি ধরা নেটের স্টক বেরিয়ে আছে। মাথার টুপিতে শুকনো পাতা, মাকড়সার জাল আটকানো।
কাছে এসে বললেন–পুরো ঘটনাটি বাইনোকুলারে দেখেছি। হ্যাঁ– ভোজালিওয়ালা আততায়ীর ছবিও ক্যামেরায় ধরেছি। চিন্তা করো না ডার্লিং। ক্রুপের মাথায় ঘাপটি পেতে বসে একটা ধূর্ত প্রজাপতির ছবি তুলবার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দুই যুবক-যুবতীর কথাবার্তার শব্দ। তারপর হ্যাঁ, আততায়ী আমার মাত্র কয়েক গজ নীচে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। ক্যামেরা তো রেডি ছিল। ক্লিক করল। তবে একটা কথা জয়ন্ত। খামোকা গুলি খরচ করো না কখনো। লাইসেন্স রিভলভারের গুলি খরচ করলে কৈফিয়ত দিতে হয় আইনত। পুলিশকে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হয় এমন কী ঘটেছিল যে তোমাকে গুলি ছুঁড়তে হয়েছে।
ব্যস্তভাবে বললাম–কর্নেল ইনিই মিসেস সেন এবং সেই দেবীবাবুর মেয়ে।
কর্নেল হাসলেন।–বরকধঝ কচতটপ।
নীতা চমকে উঠল–আপনি জানেন?
কর্নেল আস্তে বললেন–হুঁ।…
.
০৫.
বাংলোয় গিয়ে সুকমল সেনের জিপগাড়ি দেখতে পেলাম না। ভোলা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল। নীতাকে বলল–মেমসায়েব! বিলুবাবু শাসিয়ে গেল, আপনারা এখানে থাকলে বাংলো জ্বালিয়ে দেবে। বিশ্বাসবাবু এসেছিলেন। উনি থানায় খবর দিতে গেছেন। গার্ডরা এখন বাড়িতে গিয়ে ঘুমুচ্ছে। একটা কিছু হলে কে আটকাবে বুঝতে পারছি না।
কর্নেল নীতাকে বললেন তুমি আমাদের রুমে গিয়ে বসো। বেরিও না। আর ভোলা! আমাদের ব্রেকফাস্ট দক্ষিণের বারান্দায় দিয়ে যাও। জয়ন্ত, কুইক! আমাদের রুমের দরজা খুলে দাও গে।
নীতাকে দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসলাম। ভোলা ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। কর্নেল আস্তেসুস্থে টুপি সাফ করলেন। একটা ব্রাশ ওঁর কিটব্যাগেই থাকে। তারপর তেমনি ধীরেসুস্থে খেতে শুরু করলেন। কাঠপাচার নিয়ে সেনসায়েবের সঙ্গে ঝন্টুবাবু, মানে শচীন মজুমদারের বিরোধ এবং পরে মিটমাটের যে ঘটনা নব মালীর কাছে শুনেছি, কর্নেলকে তা জানিয়ে দিলাম। কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। তখন বললাম বাবার সঙ্গে মিটমাট। অথচ ছেলের সঙ্গে বিবাদ। ছেলেকে খুন করতে লোক পাঠিয়েছিল। এদিকে নীতা বলছিল, সে কিছুই জানে না। তার কথাবার্তায় অবিশ্বাস করার কিছু পেলাম না।
বলে নীতার কাছে তার জীবনকাহিনী যেটুকু শুনেছি, তার বিবরণ দিলাম। কর্নেল তবু কোনও মন্তব্য করলেন না।
বিরক্ত হয়ে বললাম–কী মনে হচ্ছে বলবেন তো? আপনি তো মাঝে মাঝে দেয়ালের ওপারে কী ঘটছে, তাও নাকি দেখতে পান। এখন পাচ্ছেন না?
কর্নেল ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছে দাড়ি ঝেড়ে কফির পট থেকে কফি ঢাললেন। তারপর বললেন–তুমি তো জানো জয়ন্ত, খাওয়ার সময় আমি কথা বলা পছন্দ করি না। বহুবার তোমাকে বলেছি এ কথা। এর তিনটে কারণ আছে, ও বলেছি। এক, গলায় খাবার আটকে যেতে পারে। দুই, অমনোযোগীর পেটে খাদ্য হজম হয় না। তিন, খাদ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
হেসে ফেললাম।– সরি! ভুলে গিয়েছিলাম। তো এবার বলুন, কেন বিলুবাবুকে সেনসায়েব খতম করতে চান। অর্থাৎ আপনার এ সম্পর্কে থিওরিটা কী?
কর্নেল প্রায় আগুনে জল ঢেলে নিভানোর মতো বললেন–সেনসায়েবই যে ওই লোকটাকে ভোজালির কোপ বসাতে পাঠিয়েছিলেন, তার মূল লক্ষ্য যে নীতাই ছিল না, তা-ই বা কী করে বলা যাবে? তবে এটা ঠিক, লক্ষ্য যতি নীতা হয়, তাহলে বিলুকেও তার হাতে মরতে হতো।
সায় দিতে বাধ্য হলাম।-ঠিক। কিন্তু বিলু কেন ভাবল সেনসায়েবই তাকে খুন করার জন্য বউকে টোপ করেছিলেন?
–এ থেকে শুধু এটুকুই বলা চলে, সেনসায়েব কেমন লোক, বিলু ভালোই জানে। তাছাড়া তার বাবার সঙ্গে সেনসায়েবের বিরোধ ছিল–তুমিই বললে! তাই ঘিরে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, সেনসায়েব বাবার ওপর রাগ ছেলের ওপর ঝাড়তে চেয়েছে। আরও একটা কথা। তার প্রেমিকাকে সেনসায়েবের মতো বয়স্ক লোক বিয়ে করেছেন। জয়ন্ত, যার ওপর রাগ থাকে, আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে তার ওপরই সন্দেহটা গিয়ে পড়ে।
–তাহলে আপনি বলতে চান বিলুর সন্দেহ ভুল?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–আমি কিছুই বলতে চাই না। এই ঘটনা সম্পর্কে নিছক কিছু যুক্তিসম্মত প্রশ্ন তুলেছি। দ্যাটস্ মাচ।
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন। আমার দৃষ্টি গেটের দিকে। বিলু দলবল নিয়ে এসে হামলা করতে পারে। আমি তার প্রাণ বাঁচিয়েছি। কাজেই আমার বিশ্বাস, তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠাতে পারব। আর তার আগে অনন্ত বিশ্বাস পুলিশ নিয়ে হাজির হলে তো ভালই। নীতা বেচারার জন্য আমার খারাপ লাগছে। ও জানে না ওর বদ্ধ পাগল বাবা এখন কলকাতায় পুলিশের হাজতে বন্দী।
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। হাঁক দিলেন–ভোলা।
ভোলা এসে সেলাম দিল।
–এগুলো নিয়ে যাও। আর শোনো, মেমসায়েব যে আমাদের রুমে আছেন, কাকেও বলো না। বললে তুমিই বিপদে পড়বে। বুঝতে পেরেছ?
ভোলা ব্যস্তভাবে বলল-হ্যাঁ, স্যার। হ্যাঁ, স্যার।
-সেনসায়েব এসে জিজ্ঞেস করলে বলবে, বিলুবাবুর সঙ্গে নদীর ওপারে যেতে দেখেছিলে ফিরতে দেখনি মেমসায়েবকে, কেমন?
–আজ্ঞে। তবে দেখবেন স্যার, আমি গরিব মানুষ। কোনও সাতে-পাঁচে থাকি না।
–মনে রেখো, যা বললাম। এসো জয়ন্ত।
কর্নেল ঘরে ঢুকলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম। কর্নেল দরজা ভেতর থেকে লক-আপ করে এয়ারকন্ডিশনার চালিয়ে দিলেন। চেয়ারে বসে আছে নীতা। মাথা টেবিলে এবং খোঁপা খুলে চুল এলিয়ে পড়েছে। নিঃশব্দে কাঁদছে।
কর্নেল পাশের চেয়ারে বসে চাপাস্বরে বললেন-মনকে শক্ত করো নীতা। হাতে সময় কম। তোমার সেফটির দায়িত্ব আমার। ওঠো। সোজা হয়ে বসো। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাইছি তোমার কাছে।
নীতা আত্মসম্বরণ করে বলল–আপনি আমার বাবার মতো। আমাকে বাঁচান আপনি।
–তুমি দেবীবাবুর মেয়ে। তোমার বাবা বদ্ধ পাগল। নাম জিজ্ঞেস করলে বলেন, বরকধঝ কচতটপ। তাই না?
নীতা মাথা দোলাল শুধু।
তোমার বাবা কোথায় আছেন জানো?
–চণ্ডীকাকা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, বাবা এখানে শচীনজেঠুদের উন্মাদ আশ্রমে আছেন। আমার স্বামী হঠাৎ গতকাল সকালে বলল, চলো। তোমার বাবাকে দেখে আসবে। তারপর এখানে এনে তুলল। আমি ভয় পেয়েছিলাম। হয়তো আমাকে এখানে পার্টি দিতে এনেছে। এবং আমাকে কাকেও অবলাইজ করতে হবে। বিলুকে চিঠি লিখে পাঠানোর এ-ও একটা কারণ। সুযোগটা ছাড়তে চাইনি।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন–গতরাতে তোমার স্বামী বাইরে বেরিয়ে ছিলেন কি?
–হ্যাঁ। কে দরজা নক করল। তখন বেরিয়েছিল। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
বাই দা বাই, তোমার স্বামী বিয়ের আগে তোমার বাবার অবস্থা জানতেন?
–হ্যাঁ। সবই জানত। আমার মামা ছিলেন কন্ট্রাক্টার। আমার স্বামী ছিল মামার উড সাপ্লায়ার।
আমি বলে উঠলাম–কাঠ সাপ্লাই করতেন ভদ্রলোক? এখনও তো তাই করেন। তাই না?
নীতা বলল–এখন কী করে, আমি বুঝতে পারি না। এখানে-ওখানে পার্টি দেয়। বলে, বিজনেস করছি। কী বিজনেস আমি জানি না। হি ইজ আ স্কাউন্ডেল। আই হেট হিম্।
কর্নেল বললেন–বাই দা বাই, তুমি অমরেশ রায় নামে কাকেও চেনো?
নীতা একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল–নামটা চেনা মনে হচ্ছে।
–পরিতোষ লাহিড়ি নামে কাকেও চিনতে?
নীতা তাকাল। একটু পরে বলল–শুনেছি নামটা। মনে পড়ছে না।
কলকাতায় তোমার মামার বাড়ি কোথায়?
–বাগবাজারে।
–নকুল মিস্ত্রি লেনে নয় তো?
নীতা একটু অবাক হয়ে বলল–হ্যাঁ।
–ওখানে একটা ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন আছে, জানো?
লক্ষ্য করিনি।
–বিয়ের সময় তোমার স্বামী কোথায় থাকতেন?
–ওই পাড়াতেই। বিয়ের পর আমরা লেকটাউনে নতুন ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিলাম। এখন সেখানেই থাকি।
–তোমার স্বামী কি একা থাকতেন বিয়ের আগে?
-না। ওর মা ছিলেন। অসুস্থ মহিলা। লেকটাউনে গিয়ে মারা যান। ভদ্রমহিলা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ওঁর কাছেই জানতে পেরেছিলাম, আমার স্বামীর একটা বউ ছিল। সেই মহিলা স্যুইসাইড করেছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছি, কেন সুইসাইড করেছিলেন। আর কিছুদিন পরে আমাকেও হয়তো তাই করতে হবে।
নীতা সেন আবার কেঁদে ফেলল। কর্নেল বললেন–তুমি ভালোভাবে যাতে বেঁচে থাকো, আমি তার চেষ্টা করব। তোমার মামা বেঁচে আছেন?
না। গত মাসে স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন। মামার মৃত্যুর পর ওঁদের ফ্যামিলি নানা জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমার আর আশ্রয় নেই কর্নেল সরকার।
বাই দা বাই, কোনও মিনিস্টারের সঙ্গে মিঃ সেনের খাতির আছে জানো?
-হ্যাঁ। এখানকার লোক। প্রতাপ সিংহ নাম। কলকাতায় একটা পার্টিতে এসেছিলেন। ও আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। মিনিস্টার আমার বাবাকে চেনেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন বাবার কথা।
আর একটা প্রশ্ন। তোমাদের ফ্ল্যাটে অমরেশ রায়ের লেখা বাংলার আগস্ট বিপ্লব নামে কোনও বই দেখেছ কখনও?
নীতা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওতে বাবার কথাও লেখা আছে। আমি পড়েছিলাম কিছুটা। পুরনো বই। ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থায় ছিল। আমার স্বামীই আমাকে দিয়েছিল বইটা। লেখকের নামের পাতা ছেঁড়া ছিল। কিন্তু প্রত্যেক পাতায় বইয়ের নাম লেখা ছিল।
–একসময় বইয়ের নাম প্রত্যেক পাতায় ছাপানো থাকত। আজকাল এই রীতি। প্রায় উঠে গেছে। বলে কর্নেল ঘুরলেন আমার দিকে–জয়ন্ত বাইরে গাড়ির শব্দ শুনছি। সাবধানে বেরিয়ে গিয়ে দেখে এসো।
দরজা খুলে দেখি, গেটের ওধারে একটা পুলিশভ্যান থেকে চারজন বন্দুকধারী কনস্টেবল নামছে। তারপর নামলেন এক পুলিশ অফিসার এবং ফরেস্ট ডিপার্টের অনন্ত বিশ্বাস। আমি তখনই ঘরে ঢুকে পড়লাম। বললাম–পুলিশ! অনন্তবাবু বাংলো পাহারা দিতে এনেছেন মনে হলো।
নীতা কী বলতে যাচ্ছিল, কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন–চুপ!
কিছুক্ষণ পরে দরজায় নক হলো। কর্নেল ইশারায় নীতাকে বাথরুমে ঢুকতে বললেন। তারপর গিয়ে দরজা খুললেন। কী ব্যাপার অনন্তবাবু? ভোলা বলল, কে নাকি বাংলোয় আগুন ধরিয়ে দেবে বলে শাসিয়ে গেছে।
অনন্তবাবুর কথা শোনা গেল–হ্যাঁ, স্যার! সেনসায়েব যতবার আসবেন, একটা না একটা ঝামেলা হবে। অথচ কিছু করার নেই। ওপর থেকে ইনস্ট্রাকশন আছে।
কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। আমিও বেরিয়ে গেলাম। বারান্দায় বেতের চেয়ারে ঠ্যাং তুলে বসে তরুণ বয়সী পুলিশের দারোগাবাবু জুতোয় বেটন ঠুকছিলেন। অনন্তবাবু বললেন–ছোটবাবু! ইনিই কর্নেলসায়েব। এঁর কথা বলছিলাম আপনাকে। আর ইনি জানালিস্ট।
ছোটবাবু ঠ্যাং নামিয়ে ভদ্রতা দেখালেন। বললেন–বসুন কর্নেলসায়েব! গল্প করা যাক। বিশ্বাস ক’কাপ চা পাঠিয়ে দিন। ওদেরও দেবেন।
কনস্টেবলরা বারান্দা দিয়ে বাংলো পরিক্রমা করছে। তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়ে ছোটবাবু আবার বললেন–আসুন কর্নেলসায়েব। বিশ্বাস বলছিল, আপনি নাকি পাখিটাখি দেখতে ভালোবাসেন। পাখিটাখিতে কী আছে বলুন তো?
কর্নেল একটু হেসে বললেন-সদ্য জয়েন করেছেন?
-অ্যাঁ হ্যাঁ।
–ট্রেনিংয়ের পরই এই সাংঘাতিক জায়গায় পোস্টিং?
সাংঘাতিক কিছু তো দেখছি না। আপনি দেখেছেন নাকি?
–দেখেছি।
–দেখেছেন? কী দেখেছেন? কোথায় দেখেছেন?
বরকধঝ-কচতটপ।
ছোটবাবু সোজা হয়ে বসলেন।–আর ইউ জোকিং উইদ মি? মাইন্ড দ্যাট, আই অ্যাম অন ডিউটি।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন।–সে কী! আপনি এখানকার পাগলাগারদ-সরি! উন্মাদ আশ্রম দেখেননি?
–হোয়াট ডু ইউ মিন টু স্যে?
–এখানকার পাগলরা সাংঘাতিক। কাগজে বিজ্ঞাপন পড়েছি একজন খুনে পাগল পালিয়ে গেছে গরাদ ভেঙে! এটা তো আগে লোকাল পুলিশের জানার কথা। নাম জিজ্ঞেস করলে সে নাকি বলে বরকধঝ-কচতটপ।
তরুণ ছোটবাবু বাঁকা হাসলেন।–দেন ইউ আর দ্যাট ম্যান, আই থিংক!
কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন–ঠিক ধরেছেন। আমিই সে।
ছোটবাবু তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন কর্নেল হোন আর যাই হোন। মশাই, বাড়াবাড়ি করলে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হব।
অনন্তবাবু বিব্রতভাবে বললেন–প্লিজ ছোটবাবু! ইনি খুব বিখ্যাত মানুষ। এঁকে—
ছোটবাবু রাগী মুখে বললেন বিখ্যাত হোন আর যা-ই হোন, ডিউটির সময় আমি জোক পছন্দ করি না।
বলে তিনি আগের মতোই বসলেন এবং টেবিলে ঠ্যাং তুলে দিলেন। কর্নেল ও আমি ঘরে ফিরে এলাম। বললাম–অদ্ভুত লোক তো! মফস্বলে অনেক জাঁদরেল দারোগাবাবু দেখেছি, এরকম কখনও দেখিনি।
কর্নেল হাসছিলেন। বললেন–একজন যথার্থ অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান টাইপ বলা চলে। আসলে আজকাল ইয়ংম্যানরা লেখাপড়া শিখে চাকরি জোটাতে পারছে না। দৈবাত জুটে গেলে কাজটা যদি ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, বেকার জীবনের ফ্রাস্ট্রেশন অবচেতনায় থেকে এক ধরনের ভায়োলেন্ট রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করে।
–প্লিজ বস্, সাইকোলজি আওড়ালে আমার মাথা ধরে।
কর্নেল বাথরুমের দরজায় নক করে আস্তে বললেন নীতা! বেরিয়ে এসো।
কোনও সাড়া এল না। চমকে উঠেছিলাম। ঝোঁকের বশে বাথরুমে আত্মহত্যা করে বসেনি তো নীতা? সাংঘাতিক কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে তা হলে।
কর্নেল দরজা টেনে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমি দুরুদুরু বুকে উঁকি দিলাম ভেতরে। নীতা নেই। বাথরুমের একটা বাইরের দরজা আছে। সব বাংলোতে থাকে ওটা। সুইপার ঢোকার দরজা। কর্নেল সেদিকে আঙুল তুলে বললেন নীতা ওই দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে।
সেই দরজার বাইরে ছাইগাদা, আবর্জনার ভঁই আর আগাছার ঝোপ। এদিক দিয়ে কেউ গেলে কারও নজরে পড়ার কথা নয়। ঝাউ, ক্যাকটাস, লতাগুল্মের জঙ্গল। বোগানভিলিয়ার প্রকাণ্ড ঝোপ, ফুলে লাল হয়ে আছে। কর্নেল শ্বাস ফেলে বললেন-দরজাটা বন্ধ করে দাও।
দরজা এঁটে বললাম–পালিয়ে গেছে নীতা। ভারী অদ্ভুত তো! পাকা অভিনেত্রী বোঝা যাচ্ছে।
কর্নেল আস্তে বললেন–হুঁ। পালিয়ে গেছে। তবে এ পালানো কি ওর বর্তমান জীবন থেকে, নাকি…
কর্নেল কথা শেষ করলেন না। মেঝে থেকে এক টুকরো কাগজ কুড়িয়ে নিলেন। কাগজটার ওপর আমারই দাড়িকাটা ব্রাশ চাপানো। ব্রাশটা কর্নেল আমাকে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ব্রাশটা ঝটপট বেসিনে রগড়ে ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছে ঘরে গেলাম। দেখলাম, কর্নেল কাগজের টুকরোটা খুঁটিয়ে পড়ছেন।
আমাকে দিয়ে বললেন–-পড়ে দেখ।
কাগজের টুকরোতে লেখা আছে : ক্ষমা করবেন। এরপর আর আমার এখানে থাকা চলে না। আমাকে চলে যেতেই হতো। এই সুযোগ ছাড়তে পারলাম না।
ইতি
হতভাগিনী নীতা
টেবিলে কর্নেলের সেই ছোট্ট প্যাডটা পড়ে আছে। সেটা ছিঁড়ে কর্নেলেরই কলমে লেখা চিঠি। আঁকাবাঁকা বড়-বড় হরফে লেখা। কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললাম–ওদের ঘরের চাবি নিশ্চয় ওর কাছে ছিল। নিজের জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারত। এভাবে নাটক করে ব্যাকডোর দিয়ে পালাল কেন সেনসায়েবের মেমসায়েব? নিজের ঘরে ঢুকতে অসুবিধা কী ছিল?
কর্নেল মাথা দোলালেন।–রিস্ক নিতে চায়নি। যে কোনও মুহূর্তে সেনসায়েব এসে পড়তে পারেন ভেবেছিল। কিংবা ধরো যা বলছিলাম একটু আগে–নিজের বর্তমান জীবনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে চলে গেছে।
বাপস্! এই বয়সেও আপনি তুখোড় রোমান্টিক।
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–হ্যাঁ। আমি প্রচণ্ড রোমান্টিক। রোমান্টিক বলেই প্রকৃতি এবং মানুষের কাজে রহস্য টের পেলে মেতে উঠি। যাই হোক, ভোলাকে খবর দাও। বারোটায় লাঞ্চ খাব। শোনো! ভোলাকে নীতা সম্পর্কে কোনও কথা বলবে না।….
বাংলো থেকে বেরুনোর সময় দেখলাম, সেই ছোটবাবু নেই। বন্দুকধারী চার কনস্টেবল লনের ওদিকে গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে গল্প করছে! কেউ খৈনি ডলছে। কেউ সিগারেট টানছে। সেনসায়েবের জিপটা নেই। পুলিশভ্যানও নেই।
কর্নেলের সঙ্গে যাওয়া মানেই আফ্রিকান সাফারি। বনবাদাড় ভেঙে আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছেন কে জানে। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে পাখি-টাখি খুঁজছেন। কখনও প্রজাপতি দেখেই থমকে দাঁড়াচ্ছেন। অবশেষে একটা পিচরাস্তায় পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম–আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?
কুমারচক।
আর কতদূর?
বাঁক ঘুরেই দেখতে পাবে। এটা স্টেশনরোড।
অবশ্য রাস্তায় বাস-ট্রাক-টেম্পো সাইকেল রিকশা আর মানুষজনের আনাগোনা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কাছাকাছি জনবসতি আছে। বাঁকে পৌঁছে সাইকেল রিকশা নিলেন কর্নেল। রিকশাওলাকে বললেন–মিনিস্টার প্রতাপ সিংহের বাড়ি চেনো?
–মিনিস্টার তো রোববারে মিটিং করে কলকাতা চলে গেলেন স্যার। বিকেলে এসেছিলেন। সন্ধ্যার ট্রেনে চলে গেলেন। এখানে উনি তো থাকেন না!
–আহা, ওর বাড়িটা চেনো কি?
রিকশাওলার সামনের একটা দাঁত ভাঙা। পানে ঠোঁট রাঙা। অমায়িক হাবভাব। বলল–বাড়ি মানে রাজবাড়ির কথা বলছেন? ওনারা এখানকার রাজা ছিলেন শুনেছি। বাড়িটা আছে। তবে কলেজ হয়েছে। আপনি কলেজে যাবেন তো?
–মিনিস্টার এসে ওঠেন কোথায়?
নদীর ধারে ডাকবাংলোয় ওঠেন। আমাদের রিকশাচালক সমিতি থেকে একবার পিটিশন নিয়ে গিয়েছিলাম। খুব উপকারী মানুষ স্যার! রাজাদের জন্যেই কুমারচকের এত উন্নতি। ইস্কুল কলেজ হাসপাতাল।
কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন–সাবরেজেস্ট্রি অফিস চলো। চেনো তো? দলিল রেজেস্ট্রি হয় যেখানে?
–খুব চিনি।
মফস্বল শহর যেমন হয়। ঘিঞ্জি রাস্তা। ভিড়। দোকানপাট। কিছুক্ষণ পরে সরকারি অফিস এলাকায় পৌঁছুলাম। সাবরেজেস্ট্রি অফিসটা দোতলা! প্রাঙ্গণে একটা বটগাছ। দুধারে চালাঘরে ডিড-রাইটারদের ঘিরে ভিড়। প্রাঙ্গণেও জনারণ্য বলা চলে।
কর্নেল বললেন–ওহে রিকশাওলা। ডিড-রাইটার চণ্ডীবাবুকে চেনো?
রিকশাওলা বলল–খুব চিনি। ডেকে দেব স্যার?
বখশিসের লোভ নিশ্চয় তার এই উৎসাহের কারণ। সে ভিড় ঠেলে প্রাঙ্গণে এগিয়ে গেল একটা চালাঘরের দিকে। একটু পরে ফিরে এসে বলল আধঘণ্টা আগে চণ্ডীবাবু বাড়ি চলে গেছেন স্যার! বাড়ি থেকে অসুখের খবর এসেছিল।
-ওঁর বাড়ি চেনো?
–হুঁউ। চলুন। নিয়ে যাচ্ছি। তবে বাড়ি অব্দি রিকশা যাবে না। একটুখানি হাঁটতে হবে।
রিকশাওলা আমাদের আরও ঘিঞ্জি একটা গলির মুখে নামিয়ে দিল। হাত দু তিন চওড়া একটা গলি দেখিয়ে বলল সে–চলুন।
তার সঙ্গে সেই দম আটকে-যাওয়া গলির ভেতর ঢুকলাম আমরা। সামনে একটা পুরনো শিবমন্দিরে গিয়ে গলিটা শেষ হয়েছে। বাঁদিকে একটা একতলা জীর্ণ বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে রিশাওলা ডাকাডাকি শুরু করল। দরজা খুলে বেরুলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। খালি গা, পরনে নীল লুঙ্গি। মুখে যেমন লম্বা কঁচাপাকা গোঁফদাড়ি, মাথায় তেমনি লম্বা সন্ন্যাসীচুল। কর্নেলকে দেখে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন–আপনি চণ্ডীবাবু?
আজ্ঞে। আপনারা কোথা থেকে আসছেন স্যার?
কলকাতা। বলে কর্নেল রিকশাওলার দিকে ঘুরলেন।–তুমি অপেক্ষা করো। আমরা এখনই ফিরে যাব।
রিকশাওলা চলে গেলে চণ্ডীবাবু বললেনবলুন স্যার!
–সাবরেজেস্ট্রি অফিসে গিয়ে শুনলাম আপনি বাড়ি চলে এসেছেন। কেউ অসুস্থ নাকি?
-আজ্ঞে আমার ওয়াইফ। প্রেশারের রুগী।
–এখন কেমন আছেন?
–ভাল। তা…
–দেবীবাবু আপনার দাদা?
–আজ্ঞে? চণ্ডীবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন প্রথমে। তারপর সামলে নিয়ে বললেন–দূর সম্পর্কের দাদা। পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। শেষে এখানে উন্মাদ আশ্রমে ভর্তি করলাম। শুনেছি কী করে সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন। কোনও মানে, খারাপ খবর আছে নাকি স্যার?
-খারাপ বলতেও পারেন। কলকাতায় দুজন লোককে খুনের দায়ে পুলিশ। ওঁকে ধরেছে।
— চণ্ডীবাবু হাত নেড়ে বললেন–মিথ্যা! একেবারে মিথ্যা। হতেই পারে না। দেবীদা মানুষ খুন করতে পারেন? গায়ে একফোঁটা জোর নেই।
–ওঁর মেয়ে নীতার খবর জানেন?
চণ্ডীবাবু স্পষ্টত চমকে উঠলেন। নীতা? আজ্ঞে সে তো কলকাতায় থাকে। বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে শুনেছি। আমার সঙ্গে বহু বছর আর তার দেখাসাক্ষাৎ যোগাযোগ নেই। নীতার কী হয়েছে স্যার?
–কিছু না। দেবীবাবুর নিজের বাড়ি ছিল তো এখানে?
চণ্ডীবাবুর মুখ সাদা দেখাচ্ছিল। বললেন–এই বাড়ির একটা অংশ ছিল দেবীদার। বউদি মরার পর আমাকে বেচে দিয়েছিল। তখন সুস্থ মানুষ। বেচে, দিয়ে কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। নীতার মামা বড়লোক। তার কাছে মেয়েকে রেখেছিল। তারপর এখানে ফিরে এল। তখন দেখি পাগল। শচীন মজুমদার ওনার বন্ধু। তার বাড়িতে থাকত। কখনও আমার কাছে এসেও থাকত। ভবঘুরে বাউণ্ডুলে লোক। ব্রিটিশ আমলে জেল খেটেছিল। কোথায়-কোথায় ঘুরত সবসময়।
কর্নেল আস্তে বললেন–চণ্ডীবাবু। নীতা যদি আপনার কাছে এসে থাকে, তাকে লুকিয়ে রাখবেন। কেউ যেন জানতে না পারে। শচীনবাবুর ছেলে বিলু ওকে মার্ডার করতে পারে। আবার নীতার স্বামীও হয়তো
–আপনারা কি পুলিশ থেকে আসছেন স্যার?
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন–আপনার সঙ্গে যদি নীতার স্বামীর কোনও সম্পর্ক থাকে, তবে সাবধান। তার ছায়া মাড়াবেন না।
চণ্ডীবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার।
–পারছেন। বলেই কর্নেল হাঁটতে শুরু করলেন।
গলির শেষ প্রান্তে গিয়ে ঘুরে দেখি, তখনও চণ্ডীবাবু তেমনি দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল রিকশায় উঠে বললেন–এবার আমরা উন্মাদ আশ্রমে যাব। চেনো তো হে?
রিকশাওয়ালা একই সুরে বলল–খুব চিনি। চলুন না স্যাব, যেখানে যাবেন।…
.
০৬.
রিকশায় আসতে আসতে কর্নেল আমাকে খবরের কাগজে উন্মাদ আশ্রম সম্পর্কে লেখার পূর্ব-পরিকল্পনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। বসতি এলাকা ছাড়িয়ে গিয়ে নদীর ধারে কুমারচক উন্মাদ আশ্রম। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। ভেতরে-বাইরে উঁচু-নিচু গাছপালা। প্রকাণ্ড গেট। তার দুধারে কয়েকটা একতলা সারবন্দি ঘর। রিকশাওলাকে তার দাবিমতো ভাড়াসহ বখশিস মিটিয়ে কর্নেল বললেন–আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কখন ফিরব, ঠিক নেই।
রিকশাওলাকে এই কথাটা বলার কারণ, সে সারাপথ ঘ্যানঘ্যান করছিল, স্টেশনে সন্ধ্যার ট্রেন ধরিয়ে দিতে পারবে এবং স্টেশনে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা তার জানা।
বেজার মুখে সে চলে গেল। এলাকাটা নিরিবিলি সুনসান। গেটে বাইরে থেকে তালাবন্ধ। বাঁদিকে বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক সিগারেট টানছিলেন। দৃষ্টি আমাদের দিকে। আমরা তাঁর কাছে গেলে গম্ভীর মুখে বললেন– আলুমটর চটরপটর কাঁচকলা কানমলা…ইটকেল বিটকেল পাটকেল থুঃ!
অমনি ঘর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। তার হাতে ছুরি। বলল–এখনও তুমি যাওনি?
ছুরি উঁচিয়ে আসতেই ভদ্রলোক নীচে লাফ দিয়ে পড়লেন। বাঁচাও! বাঁচাও! খুন করলে বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে উধাও হয়ে গেলেন। লোকটা হাসতে হাসতে ঘুরেই আমাদের দেখতে পেল। বলল–আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
কর্নেলের পরামর্শমতো বললাম–আমরা আসছি কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে। আশ্রমের সেক্রেটারি শচীনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
–একটু বসতে হবে তা হলে। উনি চারটে নাগাদ আসেন।
পাশের ঘরটা ওয়েটিং রুম গোছের। পরিচ্ছন্ন এবং সোফাসেটে সাজানো। কয়েকটা বুককেস আছে। দেয়ালে বিখ্যাত নেতাদের ছবির সঙ্গে সম্ভবত স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি। লোকটি আমাদের বসিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল ঘুরে-ঘুরে ছবিগুলো দেখছিলেন। তারপর দেখি, উনি ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করেছেন।
এই সময় ধুতি পাঞ্জাবিপরা এক প্রবীণ ভদ্রলোক এলেন–আপনারা নিউজপেপার থেকে আসছেন?
বললাম–আজ্ঞে হ্যাঁ।
বলে আমার আইডেন্টিটি কার্ডটা ঝটপট বের করে ওঁকে দেখালাম। উনি বললেন–হ্যাঁ। প্রতাপ বলছিল, কাগজের লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। আমাদের পাবলিসিটি দরকার। এ যুগে পাবলিসিটি ছাড়া কোনও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে না।
–আপনিই কি সেক্রেটারি শচীনবাবু?
ভদ্রলোক হাসলেন।না। আমার নাম গণেশ দেবনাথ। আমি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। শচীনের আসার সময় হয়ে এল। বলে উনি কর্নেলের দিকে তাকালেন।উনি আপনাদের ফটোগ্রাফার?
কর্নেল নমস্কার করে সহাস্যে বললেন বলতে পারেন। তবে ফ্রিল্যান্স করি। সত্যসেবক দয়া করে আমার দু-একটা ছবি ছাপে-টাপে। আসলে ছবি তোলা আমার হবি।
গণেশবাবু ওঁর কথার ভঙ্গিতে হেসে আকুল হলেন। তারপর বললেন–বিখ্যাত নেতাদের ছবি তো সর্বত্র ফলাও করে ছাপা হয়। অথচ যারা সত্যিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছেন, তাদের ছবি কেউ ছাপে না।
কর্নেল বললেন–এই ছবিগুলো কাদের, কাইন্ডলি যদি পরিচয় করিয়ে দেন। জয়ন্ত, তুমি নোট করা! হা–এই যে দেখছি প্রদোষ অধিকারী, অমরেশ রায়, সত্যসাধন কুণ্ডু, পরিতোষ লাহিড়ি, দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্ত, শচীন্দ্র মজুমদার-হা, এই তো আপনারও ছবি আছে। আর এঁকে চিনতে পারছি। প্রতাপ সিংহ মিনিস্টার।
গণেশবাবু সগর্বে বললেন–আসলে কুমারচক এলাকায় ১৯৪২ সালের আগস্ট বিপ্লবের বিপ্লবী আমরা। আমি, প্রতাপ আর শচীন্দ্র বেঁচেবর্তে আছি। আমরা তিনজন মাত্র সুস্থ শরীরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম। বাকি যারা ছিল, কেউ জেলেই মারা পড়েছিল, কেউ ছাড়া পেল পাগল অবস্থায়, কেউ পরে পাগল হয়ে গেল। সে এক বিশাল ইতিহাস। স্বাধীনতাযুদ্ধের অলিখিত অজ্ঞাত অধ্যায়।
বললাম–অমরেশ রায়ের বাংলায় আগস্ট বিপ্লব বইটা পড়েছি।
–পড়েছেন? কোথায় পেলেন? গণেশবাবু নড়ে বসলেন।–বইটার কথা শুনেছিলাম। অমরেশ কলকাতায় গিয়ে বাড়ি-টাড়ি কিনেছিল। কোত্থেকে অত পয়সা পেয়েছিল কে জানে? নিজের পয়সায় বই ছেপেছিল। প্রথমে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য এই আশ্রম খুললাম আমরা, ও মাঝে মাঝে আসত। তারপর আশ্রম উঠে গেল। এই উন্মাদ আশ্রম করলাম।
বললাম আপনাদের আশ্রমের প্রচারপুস্তিকা পড়েছি।
–পড়েছেন? তা তো পড়বেন। আপনারা জানালিস্ট। তো যা বলছিলাম, উন্মাদ আশ্রম করার পর অমরেশ এখানে আসা ছেড়ে দিল। কেন তা জানি না। তবে আশ্চর্য ব্যাপার! গত রোববার কাগজে পড়লাম, কোন পাগলের হাতে খুন হয়ে গেছে। সেদিনই এখানে সংবর্ধনা সভায় ওর আসার কথা ছিল। তারপর আরও আশ্চর্য ব্যাপার, পরিতোষেরও আসার কথা ছিল। সে-ও নাকি পাগলের হাতে খুন হয়ে গেছে। সেই পাগল কে জানেন? ওই যে ছবি দেখছেন। দেবীপ্রসাদ। বদ্ধ পাগল অবস্থায় এখানে ভর্তি হয়েছিল। হঠাৎ গরাদ বেঁকিয়ে কী করে বের হয়ে গেল কে জানে! তারপর তার কাণ্ড দেখুন। দু-দুজন সহযোদ্ধাকে খুন করে ফেলল। তবে পালানোর পর ভেবেচিন্তে আমরা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম কাগজে। কারণ দেবী একজন গার্ডকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সেলে ঢোকানো হয়েছিল। ডাণ্ডাবেড়িরও
কর্নেল ওঁর কথার ওপর বললেন–দেবীবাবু কি না জানি না, একজন পাগলকে পুলিশ শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে আ্যারেস্ট করেছে গতকাল। নাম জিজ্ঞেস করলে বলেবরকধঝ-কচতটপ।
গণেশবাবু লাফিয়ে উঠলেন।–দেবী! দেবী! ওকে তাহলে ধরেছে পুলিশ! কাগজে তো দেখলাম না আজ।
বললাম–আমরা কাগজের লোক। পুলিশসোর্সে খবর পেয়েছি। পরে বেরুবে খবর।
গণেশবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন বাঁচা গেল। শচীন আসুক। জেনে খুশি হবে।
কর্নেল বললেন–দেবীবাবু একটা পদ্য আওড়ান শুনেছি আমরা। ওহে মৃত্যু– তুমি মোরে কি
–হ্যাঁ পদ্যটা দেবীর খুব প্রিয় ছিল। বুঝলেন না? আসলে একজন বিপ্লবী তো। ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারের ধকল সামলাতে পারেনি। সুস্থ অবস্থায় জেল থেকে বেরুল। বিয়ে করল। আশ্রম থেকে আমরা ওর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল।
এই সময় চায়ের কেটলি এবং কয়েকটা কাপ নিয়ে সেই লোকটি ঢুকল। বলল–বড়বাবু খবর পাঠিয়েছেন আজ আসতে পারবেন না আপিসে।
গণেশবাবু বললেন–ঝন্টু আসবে না?
–আজ্ঞে। কেতো খবর দিয়ে গেল। লোকটি চাপাস্বরে বলল–বিলুবাবু কী ঝামেলা করেছে। পুলিশ তাকে ধরেছিল। থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। কেতো বলছিল। বলে লোকটি চলে গেল।
ওই ছেলেই ঝন্টুকে ডোবাবে। বলে গণেশবাবু আমাদের দিকে ঘুরলেন। শচীন আসবে না। চা খান আপনারা। তারপর আমিই আশ্রমের কাজকর্ম সম্পর্কে কথা বলব। একটু ভালভাবে লিখবেন যেন।
কর্নেল বললেন–আশ্রমের ভেতরটা দেখতে চাই আমরা। ছবি তুলতে চাই। আজকাল তো জানেন রঙিন ফটোফিচারের যুগ।
চায়ে চুমুক দিয়ে গণেশবাবু বললেন–সব দেখাচ্ছি। যত ইচ্ছে ছবি তুলুন।
–দিনের আলো থাকতে থাকতে ছবি তুলতে হবে কিন্তু। আশ্রমের ভেতর গাছপালা আছে। ছায়া ঘন হলে কালার্ড ছবি ভাল আসবে না।
দ্রুত চা শেষ করে গণেশবাবু উঠলেন। হাঁকলেন–নিবারণ!
সেই লোকটি এল। গণেশবাবু বললেন–হসপিটালগেটের তালা খুলে দে। আমরা ওই গেট দিয়ে ঢুকব। আমরা ঢুকলে পরে আবার তালা আটকে দিবি। ওখানেই ওয়েট করবি বাবা। আমাদের যেন গারদে বন্দী করে রাখবি না। আসুন আমার সঙ্গে।
গণেশবাবু হাসতে হাসতে বেরুলেন। বড় গেটের ডানদিকের ঘরগুলো ডিসপেনসারি। এ-ঘর থেকে ও-ঘর করে গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে একটা করিডরে পৌঁছুলাম। সামনে ছোট গেট। মোটা লোহার গরাদ আঁটা। নিবারণ তালা খুলে দিল। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে খোলা জায়গায় গেলাম। নিবারণ তালা এঁটে দিল। একটু অস্বস্তি হল আমার।
আশ্রমেরই পরিবেশ। ফুলবাগান। বড়বড় গাছের গোড়ায় বেদি। কোনও কোনও বেদিতে কেউ শুয়ে আছে একটা ঠ্যাং তুলে। কেউ ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে। ঘাসের ওপর একজন গড়াগড়ি খাচ্ছে আর হেসে অস্থির হচ্ছে। গণেশবাবু বললেন–মেন্টাল পেশ্যান্ট। তবে পাগল বলা চলে না। ওই দেখুন, এদের ওপর নজর রাখার জন্য গার্ড আছে।
কর্নেল ছবি তুলছিলেন। গণেশবাবু সমানে বকবক করছিলেন। আমি ‘নোট’ নিচ্ছিলাম। একটা প্রতিমূর্তির কাছে গিয়ে গণেশবাবু বললেন–আমাদের পৃষ্ঠপোষক প্রতাপ সিংহের ঠাকুঁদা কুমার বাহাদুর মণীন্দ্র সিংহ। এঁর বাবা ছিলেন রাজা বিজয়েন্দ্র নারায়ণ সিংহ। ভেবে দেখুন। ব্রিটিশের অনুগত রাজপরিবারের বংশধররা পরে হয়ে উঠলেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী! আশ্চর্য না? : সায় দিলাম। কর্নেল ছবি তুলতে তুলতে প্রতিমূর্তির পেছনে বোগানভিলিয়ার আড়ালে অদৃশ্য হলেন। গণেশবাবু খেয়াল করেননি। আবার বকবকানি শুরু হলো। বোগানভিলিয়ার ঝোপ পেরিয়ে গিয়ে কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বললাম আপনাদের গারদ কোথায়? মানে–যেখানে বিপজ্জনক উন্মাদদের রাখা হয়?
–ওই তো। গণেশবাবু বাঁদিকে কয়েকটা সারবন্দি একতলা ঘর দেখিয়ে দিলেন। বারান্দা আছে সামনে। তারপর গরাদের সারি। ভেতরটা আঁধার দেখাচ্ছে। দূর থেকে।
কর্নেলকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে গণেশবাবু হাসলেন। আপনাদের ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক অলরেডি হাজির। আচ্ছা, ভদ্রলোকের বয়স কত বলুন তো? একেবারে সায়েবদের মতো চেহারা। সাদা দাড়ি। অথচ দিব্যি শক্তসমর্থ মানুষ। শরীরচর্চা করতেন নাকি? আমিও একসময়–মানে, আমাদের সহযোদ্ধারা সকলেই একসময় শরীরচর্চা করতাম। বিপ্লব করতে হলে সুস্বাস্থ্য চাই। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন–গীতা পাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা উত্তম। নাকি মিসকোট করলাম? বয়স স্মৃতি নষ্ট করে। হা–গীতার চেয়ে ফুটবল শ্রেষ্ঠ।
হাসি চেপে বললাম–ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক সাকাসের খেলোয়াড় ছিলেন একসময়।
–তা-ই! হাসতে হাসতে গণেশবাবু পা বাড়ালেন।–তো তিনজনকে গারদে রাখা হয়েছিল। একজনের কথা তো বলেছি–দেবীপ্রসাদ। আরেকজন গদাধর পাল। স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমাদের প্রিয় গদাইদা। বড় কষ্ট হয় মনে জয়ন্তবাবু! কিন্তু উপায় নেই। ইটপাটকেল ছুঁড়ে কেলেঙ্কারি করে। অগত্যা ওকে আটকাতে হলো।
–আরেকজন?
গণেশবাবু থমকে দাঁড়ালেন।–ঝন্টু, মানে শচীন আজ সকালে বলছিল, কাল রাতে নাকি একজনকে গারদে ঢোকানো হয়েছে। আমি তাকে দেখিনি। নিশ্চয় ডেঞ্জারাস হয়ে উঠেছিল কোনও রুগী। চলুন, গিয়ে দেখি।
কর্নেল বারান্দা থেকে নেমে এলেন। গম্ভীর মুখে বললেন–ছবি তোলা শেষ আপাতত। আমি ওই গাছতলায় গিয়ে বসি। জয়ন্ত গিয়ে দেখ, ইন্টারভিউ নিতে পার নাকি!
বারান্দায় উঠেই আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। সামনেকার সেলের ভেতর কালিঝুলিমাখা ছেঁড়া শার্ট আর হাফপেন্টুল পরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই।
আমি কিছু বলার আগেই হালদারমশাই খি-খি করে হেসে বললেন–বরকধঝ কচতটপ! তারপর লম্ফঝম্ফ নেচে আওড়ালেন–ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়! বরকধঝ-কচতটপ…বরকধঝ কচতটপ…
সর্বনাশ! গোয়েন্দা ভদ্রলোক কি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন? আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
গণেশবাবু খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন–এ যে দেখছি দেবীপ্রসাদের এক জুড়ি! ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো? অ্যাই! কে তুমি? নাম কী? দেবীকে চেনো তুমি?
পাশের সেলের পাগল গদাইবাবু গরাদ আঁকড়ে হুঙ্কার দিলেন–চো-ও-প শালা। কড়মড় করে মুণ্ডু চিবিয়ে খাব। চিনি না? ন্যাকামি হচ্ছে? দেবীশালাকে আমি চিনি না?
গণেশবাবু হালদারমশাইয়ের সামনে থেকে সরে গদাইবাবুর সামনে গেলেন। কী গদাইদা? কেমন আছ? চিনতে পারছ তো আমাকে?
–চো-ও-প শালা! একবার কাছে আয়। তোর মুণ্ডু কড়মড় করে চিবিয়ে খাই! আয়, আয়!
হালদারমশাই এই সুযোগে চোখ টিপে আমাকে ইশারায় কিছু বললেন। বুঝতে পারলাম না। গণেশবাবু তখন গদাইবাবুকে নিয়ে পড়েছেন।–গদাইদা! আমি গণেশ। তোমার ভালর জন্যই তোমাকে এভাবে রাখা হয়েছে।
গদাইবাবু গর্জন করলেন–চো-ও-প! তারপর দাঁত কিড়মিড় করে ভয় দেখাতে থাকলেন।
গণেশবাবু দুঃখিত মুখে বললেন–বুঝলেন জয়ন্তবাবু? এই গদাইদার নামে ব্রিটিশ সরকার হুলিয়া জারি করেছিল। জ্যান্ত বা মরা অবস্থায় ধরে দিলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার। মৌরী নদীর ব্রিজে মিলিটারি ট্রেন উল্টে দিয়েছিল যারা, গদাইদা তাদেরই একজন। আজ তার কী অবস্থা দেখুন!
বললাম–আপনি ছিলেন না সেই দলে?
–পরিকল্পনার সময় সঙ্গে ছিলাম। তবে ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ছিলাম না। আমাদের হাতে খবর ছিল বার্মা ট্রেজারির সোনাদানা টাকাকড়ি থাকবে ট্রেনে। কিন্তু ট্রেনের সেই কামরাটা নাকি নদীতে পড়েছিল। খুঁজে পাওয়া যায়নি।
–দেবীবাবু ঘটনাস্থলে ছিলেন?
-হ্যাঁ। দেবী, পরিতোষ, অমরেশ গদাইদা আর ঝন্টু ছিল। চলুন, যেতে যেতে বলছি। ঝন্টুর কাছে শোনা কথা। ট্রেজারির মাল নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রতিমূর্তিটার কাছে গিয়ে কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বেলা পড়ে এসেছে। হালদারমশাইয়ের ব্যাপার দেখে ভড়কে গেছি। গণেশবাবুর কথায় কান নেই। হালদারমশাই পাগলাগারদে তা হলে সত্যি ঢুকলেন বা জোর করে তাকে ঢোকানো হলো! মারধর অত্যাচার ইলেকট্রিক শক–কত কী চলে শুনেছি পাগলদের ওপরে। কিন্তু ওঁকে দেখে মনে হলো না তেমন কিছু ঘটেছে।
গণেশবাবু বললেন–ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?
বেগতিক দেখে বললাম–পাখির ছবি তোলার ভীষণ বাতিক। আপনাদের আশ্রম এরিয়ায় প্রচুর পাখি আছে। কোথাও কোনও পাখির ছবি তুলেছেন হয়তো।
–গার্ডদের কারও পাল্লায় পড়লে খামোখা অপমানিত হবেন। ভুল হয়ে গেছে। গার্ডদের জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। বলে গণেশবাবু হাঁক দিলেন–মধু! হারাধন! পরেশ! কেউ আছ নাকি এখানে?
কোনও সাড়া না পেয়ে গণেশবাবু হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দেখি, খাকি হাফপ্যান্ট-গেঞ্জিপরা কজন লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এবং কর্নেল তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করে আছেন এবং ঘাসের ওপর তাস ছড়িয়ে পড়ে আছে। বোঝা যায়, গার্ডরা তাস খেলতে বসেছিল।
গণেশবাবু থমকে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন।
–দেখছেন কাণ্ড! এবার চলুন, হসপিটালের অবস্থা দেখবেন। পনেরটা বেড। দুজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান আছেন। কেউ বেতন নেন না। প্রতাপ ব্যবস্থা করে দিয়েছে লোকাল গভর্মেন্ট হসপিট্যাল থেকে এসে ওঁরা ভলান্টারি সার্ভিস দেন। ‘
–আশ্রমের রোগীরা কি সবাই ফ্রিডম-ফাইটার?
–হ্যাঁ। গভর্মেন্ট হসপিট্যালে মেন্টাল ওয়ার্ড আছে। কিন্তু আমরা শুধু ফ্রিডম ফাইটার বা তাদের আত্মীয়স্বজনেরই চিকিৎসা করি।
–আগে তো দুঃস্থ ফ্রিডম-ফাইটারদের আশ্রমদান, সেবাযত্ন এসব করতেন শুনেছি। কিন্তু তারপর শুধু মানসিক রুগীদের জন্য আশ্রম করলেন কেন?
গণেশবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন–শচীনের আইডিয়া। কেন? কাজটা কি ঠিক হয়নি?
না, না। একটা মহৎ কাজ।
ফটোগ্রাফার ভদ্রলোককে ডাকুন এবার। অভ্যাসবশে ডেকে ফেললাম– কর্নেল!
গণেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন–ওঁর নাম কর্নেল নাকি?
-না মানে, আমরা ওঁকে ঠাট্টা করে ওই নামে ডাকি। ওঁর নাম এন সরকার।
কর্নেল এসে বললেন-জয়ন্ত, তোমার হয়েছে? এখনই না বেরুলে ট্রেন ফেল করব।
গণেশবাবু বললেন-কর্নেলবাবু! মেন্টাল ওয়ার্ডের ছবি নেবেন চলুন।
–এই যাঃ! ফিল্ম তো শেষ। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন সওয়া পাঁচটা বাজে। বাজার হয়ে কুমারচকের বিখ্যাত সরপুরিয়া নিয়ে যাব। সওয়া ছটায় ট্রেন। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
গণেশবাবু নিরাশ হয়ে বললেন–আচ্ছা।..
বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় পৌঁছে বললাম–হালদারমশাইয়ের কীর্তি দেখলেন? বরাবর দেখছি, একটা-না একটা কেলেঙ্কারি বাধাবেনই। ওঁকে উদ্ধার করা দরকার ছিল।
কর্নেল হাসলেন–উদ্ধারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।
–কিন্তু উনি পাগল সাজতে গেলেন কেন?
–আমারই পরামর্শে।
–খুব বিপজ্জনক পরামর্শ।
একটু রিস্ক ছিল। কিন্তু আমি আসলে শচীনবাবুর রিঅ্যাকশন বুঝতে চেয়েছিলাম। এটা আমার পরীক্ষা। পরীক্ষায় পাস করেছি।
–কী পরীক্ষা?
–বরকধঝ-কচতটপ কোনও পুরনো রহস্যের চাবিকাঠি কিনা জানতে চেয়েছিলাম। এবার জানলাম ঠিক তা-ই। আরও জানলাম শচীনবাবু রহস্যের জট ছাড়াতে পারেননি। পারলে দেবীবাবুকে আটকে রেখে চাপ দিতেন না। দেবীবাবু ছিলেন শেষদিকের সেলে। সেলটা দেখে নিয়েছি। গরাদ বাঁকিয়ে পালানো অসম্ভব। কেউ গার্ডদের কাউকে কিংবা ওই নিবারণকে ঘুষ খাইয়ে ওঁকে নিয়ে পালিয়েছিল কলকাতায়। তারপর ওঁর সাহায্যে অমরেশ এবং পরিতোষ দুজনকেই খুন করেছে।
–খুনের মোটিভ কী?
বরকধঝ-কচতটপ রহস্যের চাবিকাঠি সম্ভবত ওই দুজনই জানতেন। অমরেশবাবুর স্ত্রীকে লেখা চিঠির কথা মনে পড়ছে? দেখা করতে বলার উদ্দেশ্য ছিল সাংঘাতিক। অত্যাচার চালিয়ে গোপন কথাটি আদায় করা। দেবীবাবু, শচীনবাবু এবং খুনী যে ভাবে হোক, রহস্যটা জানত। কিন্তু জট ছাড়াতে পারেনি। দেবীবাবু বদ্ধ পাগল। তার কাছে গোপন কথাটি আদায় করা সম্ভব নয়। দেবীবাবুর গায়ে অত্যাচারের চিহ্ন আছে। অরিজিৎ বলছিল। কিন্তু অত্যাচার চালিয়েছিলেন আসলে শচীনবাবু। এরপর তো দেবীবাবু হাতছাড়া হয়ে গেলেন। তখন মিনিস্টারকে দিয়ে এখানে অমরেশ ও পরিতোষকে সভায় আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছিলেন শচীনবাবু। স্বয়ং মিনিস্টার ওঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ায় ওঁরা আসতে রাজি হন। তখন খুনী দেখল, অবস্থা অন্যদিকে গড়াচ্ছে। শচীনবাবুর সঙ্গে ওদের রফা হওয়ার চান্স আছে। অতএব দেবীবাবুকে দিয়ে উত্ত্যক্ত করে বাইরে এনে পরপর দুজনকে খুন করল খুনী।
শিউরে উঠে বললাম–তা হলে শচীনবাবু হালদারমশাইয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছেন। আরও চালাবেন।
নাহ। হালদারমশাইয়ের সেলে গতরাতে শচীনবাবু ঢুকেছিলেন। হাতে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার যন্ত্র ছিল। আমার পরামর্শমতো হালদারমশাই সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে বলেন, ‘Break the Jaw. Catch the Top.’ বরকধঝ-কচতটপ।
–অ্যাঁ? বলেন কী!
–হ্যাঁ। ওটাই বরকধঝ-কচতটপ। ব্রেক দা জ, ক্যাচ দা টপ। জ মানে চোয়াল। কিন্তু এর অন্য মানেও আছে ন্যারো এন্ট্রান্স ভোর। সংকীর্ণ প্রবেশপথ। তা হলে দাঁড়াচ্ছে সংকীর্ণ প্রবেশপথ অর্থাৎ দরজা ভেঙে ওপরের জিনিসটা ধরো। বার্মা ট্রেজারির সেই সিন্দুকরহস্য।
অবাক হয়ে বললাম–আমিও তো বলেছিলাম এটা গুপ্তধন রহস্য।
–যাই হোক। হালদারমশাই বললেন, কথাটা শুনে শচীনবাবু খুশি হন। হালদারমশাই তাকে পাগলামির ভঙ্গিতে বলেছেন, আজ রাত বারোটায় ওঁকে সেখানে নিয়ে যাবেন। ব্যস, ডিটেকটিভদ্রলোক খুব আদরে আছেন এবং খুশিমতো পাগলামির অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি ফাঁদটা ভালই পেতেছি।
একটা খালি সাইকেল রিকশা পাওয়া গেল রাস্তার মোড়ে। কর্নেল বললেন শচীন মজুমদারের বাড়ি চেনো?
রিকশাওয়ালা বলল–হ্যাঁ। কাছেই। ওই তো দেখা যাচ্ছে।
কর্নেল বললেন–আচ্ছা, ওখান দিয়ে গেলে থানা দূরে পড়বে কি?
তা একটু পড়বে।
–ঠিক আছে। চলো।
দশ টাকা লাগবে স্যার!
ঠিক আছে।
রিকশা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কর্নেল বললেন–থাক পরে দেখা করব’খন। থানার কাজটা সেরে নিই আগে।
রিকশা চলতে থাকল। বললাম–হঠাৎ মত বদলালেন যে?
কর্নেল বললেন–তোমাকে বরাবর বলেছি ডার্লিং, ভাল রিপোর্টার হতে চাইলে ভাল অবজার্ভার হওয়া দরকার। সেনসায়েবের জিপ দাঁড়িয়ে আছে শচীনবাবুর বাড়ির সামনে। নাম্বার ভোরবেলা টুকে রেখেছিলাম।
–সে কী! বিলু তো ওঁর ওপর খেপে আছে। হামলা করতে গিয়েছিল ফরেস্টবাংলায়।
–বিলুর বাবার জিগরি দোস্ত। ব্যাপারটার রফা করতে এসে থাকবেন। বাবা যার রক্ষাকর্তা, ছেলে আর তার গায়ে হাত ওঠাবে না। নেহাত একটা ভুল বোঝাবুঝি, বলে মিটে যাবে। বিলুর মতো ছেলের অনেক শত্রু থাকা সম্ভব নয় কি?
–যাই বলুন, ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না।
–আমারও। কিন্তু কী আর করা যাবে? বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন।
একটু পরে বললাম-থানায় গিয়ে আবার সেই ছোটবাবুর পাল্লায় পড়লেই কেলেঙ্কারি। থানায় না গেলে নয়?
চলো তো!
সরকারি এলাকায় পৌঁছে রিকশাওলা বলল–এটুকু হেঁটে যান স্যার! থানার সামনে আমি যাব না।
–কেন হে? থানাকে এত ভয় কিসের?
আজ্ঞে স্যার! খামাকো ঝামেলা করে।
নাকি তোমার লাইসেন্স নেই?
লাইসেন আছে বৈকি স্যার! মালিকের নামে লাইসেন আছে। আমরা মালিকের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে প্যাসেঞ্জার খাটাই। পুলিশ সব জেনেও হাঙ্গামা করে।
–প্যাসেঞ্জার খাটিয়ে এই নাও দশ টাকা।
কর্নেল হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলেন–মফস্বলে এসে আজকাল কতরকম অভিজ্ঞতা হয়। বলে বাইনোকুলারে কী দেখতে থাকলেন। বেলা পড়ে গেছে। আলো জ্বলে উঠেছে। এখন কী দেখছেন কে জানে!
বললাম কী হলো? চলুন।
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–একটা শামুকখোল পাখি। ওদিকে একটা ঝিল আছে। এতদূরে চলে এসেছে পাখিটা। সাহস আছে বটে। চলো।
থানার উঁচু বারান্দা থেকে একজন অফিসার হন্তদন্ত নেমে এলেন। হ্যান্ডশেক করে বললেন–ডি আই জি সায়েবের মেসেজ পেয়েছি বেলা দুটোয়। ফরেস্টবাংলোয় গিয়ে শুনি, আপনি বেরিয়েছেন। এদিকে এক মস্তানকে নিয়ে আজ হাঙ্গামা। ফরেস্টবাংলোয় গিয়েছিল হামলা করতেজাস্ট আমি চলে আসার পর। ওখানে আর্মড কনস্টেবল অলরেডি ছিল। তবু খবর পেয়ে আবার অফিসার আর ফোর্স পাঠালাম। আর বলবেন না কর্নেলসায়েব। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে!
কথা বলতে বলতে আমাদের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন উনি। কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন।–অফিসার-ইন-চার্জ রমেন পালিত। জয়ন্তর কথা কি তোমাকে বলেছিলাম কখনও? বলেছিলাম নিশ্চয়। ভুলে গেছ। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক। যাই হোক, তুমি যে এখনও বদলি হওনি, এটাই আশ্চর্য! মিনিস্টারের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলেছ নাকি? কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন।
–আপনার আশীর্বাদ! এক মিনিট। আপনি তো কফির ভক্ত। বাসা থেকে আনাচ্ছি।
কফির হুকুম দিয়ে রমেনবাবু একটা খাম বের করলেন।রেডিও মেসেজ। আপনার জন্য। এটা নিয়েই গিয়েছিলাম বাংলোয়।
সেই ছোটবাবুর কথাটা বলতে ইচ্ছে করছিল। বললাম না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশকে কিছু বলতে নেই। কর্নেলেরই পরামর্শ এটা।…
.
০৭.
পুলিশের জিপ কর্নেলের কথা মতো ফরেস্টবাংলোর কাছাকাছি আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল। শ’দুয়েক মিটার আমরা হেঁটে এলাম। কর্নেলকে এতক্ষণে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম–রেডিও মেসেজে কী আছে?
কর্নেল টর্চের আলোয় চারদিক দেখতে দেখতে হাঁটছিলেন। বললেন– দেবীবাবুর লোহার ডাণ্ডায় রক্তের চিহ্ন লেগে আছে। ওটাই মার্ডার উইপন।
চমকে উঠলাম। তা হলে উনিই মার্ডারার? আপনার থিওরি যে উল্টে গেল।
নাহ। দেবীবাবুর অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে আভাস পাওয়া গেছে, কেউ গত পরশু রোববার বিকেলে ডাণ্ডাটা ওঁকে প্রেজেন্ট করেছিল। সে খুব ভাল লোক। তা ছাড়া সে-ই নাকি ওঁকে পাগলাগারদ থেকে উদ্ধার করেছিল। কলকাতা নিয়ে গিয়েছিল গাড়ি চাপিয়ে। কাজেই আমার থিওরি পাকা।…
.
বাংলো কাল সন্ধ্যার মতো নিরিবিলি নিঝুম। পুলিশপাহারা নেই দেখে বুঝলাম, বিলুকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়ার পর সবকিছু মিটমাট হয়ে গেছে। আমাদের দেখে ভোলা হন্তদন্ত ছুটে এল। সে কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন–সব শুনেছি। তুমি কফি নিয়ে এসো।
কর্নেল ঘরে ঢুকে গেলেন। আমার বদ্ধ ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল না। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে পড়লাম। আজ সন্ধ্যায় বাতাস উঠেছে জোরালো। চারদিকে রহস্যময় শনশন শব্দ। নব মালী এসে সেলাম দিল। তার দিকে তাকালে, সে মুচকি হাসল। বললাম–কী নব? হাসছ কেন?
–একটু আগে সেনসায়েব এসেছিলেন। মেমসায়েব কখন নাকি হাওয়া হয়ে গেছে। আমাদের খুব তম্বি করে চলে গেলেন। নব চাপাস্বরে বলল ফের– বিলুবাবুর সঙ্গেই বোধকরি কেটে পড়েছে কখন। ভোলাদা দেখে থাকবে। বলছে না। সেনসায়েব থানায় খবর দিতে গেলেন হয়তো। কিন্তু আর কি ফেরত পাবেন? বিলুবাবুর হাতে যা যায়, আর তা ফেরত আসে না। বিলুবাবুর বাবার হাতে থানা পুলিশ। শুনলাম, ছেলেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েই ছেড়ে দিয়েছে। ও! আপনারা যাওয়ার পর কী সাংঘাতিক ঝামেলা হলো, বলিনি।
কর্নেলের মতোই বললাম–সব শুনেছি।
–শুনেছেন? তা হলে তো আর কথাই নেই। বলে নব চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। বললেন–জয়ন্ত, আপাতত ঘণ্টা দুয়েক বাথরুমে ঢোকা নিষিদ্ধ। এটা এখন ডার্করুম। ফিল্ম রোলটা ওয়াশ করতে দিয়ে এলাম। শিগগির প্রিন্ট দরকার। বাথরুমে যেতে চাইলে ভোলাকে বলো। স্টাফদের জন্য ওদিকে একটা বাথরুম আছে। যাবে নাকি?
দরকার নেই। কিন্তু এখনই ছবির প্রিন্ট জরুরি হয়ে উঠল কেন বস্?
কর্নেল জবাব দিলেন না। টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। ভোলা কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল। বেতের টেবিলে রেখে কাচুমাচু মুখে বলল–একটু আগে সেনসাহেব এসেছিলেন। মেমসায়েব কোথায় গেলেন জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি বলিনি কিছু। আপনি বারণ করেছিলেন। সেনসায়েব আমাদের বকাবকি করে চলে গেলেন আবার। পুলিশে খবর দিতে গেলেন। পুলিশ এসে আমাকে জেরা করলে বিপদ। কী বলব স্যার?
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–পুলিশ আসবে না, তোমাকে জেরা করতে।
ভোলা গাল চুলকে বলল–আমি শুধু ভাবছি মেমসায়েবের খাওয়া-দাওয়া হয়নি।
–মেমসায়েব আমার ঘর থেকে পালিয়ে গেছে।
–সে কী স্যার! কী করে পালালেন?
বাথরুমের ভেতরকার দরজা খুলে চলে গেছে। যাই হোক, এ নিয়ে তোমার চিন্তার কারণ নেই।
ভোলা চাপাস্বরে বলল–আমারই ভুল। মেমসায়েব আমাকে সকালে একটা চিঠি দিয়ে আসতে বলেছিল বিলুবাবুকে। আপনাকে না বলে অন্যায় করেছি স্যার।
জানি। তুমি তোমার কাজ করো। রাত সাড়ে নটার মধ্যে ডিনার খাব।
ভোলা অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেল কিচেনের দিকে। কর্নেল কফি খেতে খেতে চুরুট ধরালেন। বললাম–’ব্রেক দা জ, ক্যাচ দা টপ’ যে ‘বরকধঝ কচতটপ’, কী করে বুঝলেন তা আমাকে বলেননি। অথচ কলকাতায় বসেই ওই জট ছাড়িয়ে হালদারমশাইকে এখানে পাঠিয়েছিলেন। আমাকে বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো কর্নেল?
কর্নেল হাসলেন–তোমাকে চমকটা সময়মতো দিতে চেয়েছিলাম। সেই গোপন মিলিটারি রেকর্ডসংক্রান্ত বইয়ে পড়েছিলাম, ওই কথা দুটো রেঙ্গুনের ট্রেজারির সিন্দুক খোলার সূত্র। পড়তে পড়তে মাথায় এসে গেল, কথা দুটোর ‘বরকধঝ-কচতটপ’ হয়ে ওঠার চান্স আছে। কিন্তু ভেবে দেখ, নদীর জলে আছড়ে পড়া লাগেজ ভ্যান বা পার্শেল ভ্যান থেকে সিন্দুকটা খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া দরজা লক করা ছিল। জলের ভেতর ভ্যান কেটে বের করা : সে মুহূর্তে অসম্ভব। লেফটন্যান্ট কর্নেল টেডি স্যামসন কোর্টমাশালের সময় স্বীকার করেছিলেন, ব্রিজ থেকে এক মাইল দুরে ট্রেনের গতি মন্থর হয়েছিল। আধমাইল আসার পর ট্রেন থেমে যায়। তখন উনি এবং গার্ড নেমে গিয়ে দেখেন, লাইনের ওপর গাছের ডালপালা পড়ে আছে। ড্রাইভার দূর থেকে তা দেখতে পেয়েছিল। সে ভেবেছিল, ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গাছ ভেঙে পড়েছে লাইনের ওপর। তখনই সোলজারদের ডেকে সেগুলো সরানো হয়।…কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–অমরেশবাবুর বইয়ে লেখা আছে, ব্রিজের ওপর ফিসপ্লেট সরানোর জন্য সময় নিতে তাদেরই আরেকটা দল লাইনে ওই অবরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। এবার চিন্তা করে দেখ জয়ন্ত। গার্ডের লাগোয়া কামরার ভ্যানের মধ্যে ট্রেজারির সিন্দুক। এদিকে কিছুক্ষণের জন্য গার্ড বা টেডি স্যামসন সেখানে নেই। গার্ডের কামরায় সেন্ট্রী থাকলে সে-ও কৌতূহলবশে দেখতে যেতে পারে কী হয়েছে। সেই সুযোগে ভ্যানের লক ভেঙে সিন্দুক নামিয়ে নেওয়া কি অসম্ভব ছিল? অমরেশবাবুর বইয়ে ‘সেই ভ্যান অন্বেষণে ছুটিয়া’ কথাটা অসম্পূর্ণ। পরের পাতা নেই। আমার ধারণা, তখন ছুটে ওরা গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারপর খবর পান সিন্দুক ইতিমধ্যে হস্তগত হয়েছে। ওই পাতাটা খুবই দরকার ছিল।
বললাম–আপনি বলছিলেন বরকধঝকচতটপ-এর সঙ্গে মন্দিরের সম্পর্ক আছে।
অমরেশবাবুর বইয়ে নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতর একটা মন্দিরের উল্লেখ আছে। ওটা ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। আজ সকালে নদীর ওপারে বটতলার কাছে যে পটায় আমি চেপেছিলাম ওটাই সেই মন্দির। হালদারমশাইকে বলেছি, শচীনবাবুকে ওখানে আজ রাত বারোটায় নিয়ে যাবেন। শচীনবাবু জানেন ওটাই ছিল তাদের আস্তানা। কাজেই তিনি দাঁও মারার জন্য খুব উদগ্রীব।
একটু চুপ করে থেকে বললাম–’ব্রেক দা জ’। জ মানে আপনি বলছিলেন সংকীর্ণ প্রবেশপথ বা দরজা। একটা সিন্দুকের আবার দরজা হয় নাকি? ডালা থাকে সিন্দুকের।
কর্নেল বললেন–আক্ষরিক বাংলা অর্থ ধরছ কেন? ইংরেজি ‘জ’র অর্থব্যঞ্জনা হলো অন্যরকম। সিন্দুকের ক্ষেত্রে ‘জ’ বলতে বোঝায় ওপরে ও নীচের জুড়ে থাকা একটা ছোট্ট অংশ। মানুষের মুখের ওপরকার এবং নীচের চোয়াল যেমন জুড়ে থাকে এবং হাঁ করলে খুলে যায়। জ’র আক্ষরিক অর্থ চোয়াল। এবার সিন্দুকের সেইরকম চোয়াল কল্পনা করো–যা ন্যারো এন্ট্রান্স’ও বলা চলে। বোঝা যাচ্ছে, এই সিন্দুকের ডালা অন্য ধরনের। জ ভাঙার পর ‘টপ’ ধরতে হবে। বড়জোর বলা যায়, ‘টপ’ ধরলে সিন্দুকটা পুরো ভোলা যাবে। টপ জিনিসটা কী, এখনও অবশ্য জানি না।
এই সময় বাঁদিকে জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ির আলো দেখা গেল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–এসো, ঘরে ঢুকে পড়ি। সেনসায়েব আসছেন মনে হচ্ছে।
ঘরে ঢুকে ঠাণ্ডায় আরাম পেলাম। এয়ারকন্ডিশনার চালু ছিল। কর্নেল বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। আমি ঘামে ভেজা পোশাক বদলে নিলাম।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে। বললেন–চমৎকার ডেভলাপ হয়েছে। দেখা যাক প্রিন্টগুলো কেমন হয়। পোর্টেবল ফটো ওয়াশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সরঞ্জাম সঙ্গে থাকলে কত সুবিধে হয়। পেপালারয়েড ক্যামেরা বেরিয়েছে আজকাল। সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট বেরিয়ে আসে। কিন্তু ছবি শিগগির নষ্ট হয়ে যায়।
বললাম–সত্যি সেনসায়েবের গাড়ি এল কিনা বেরিয়ে দেখব নাকি?
নাহ। ওঁর মুড খারাপ। চুপচাপ বসে থাকো। বরং বিছানায় লম্বা হও। খুব ঘোরাঘুরি হয়েছে। বিশ্রাম করে তৈরি হয়ে নাও। আজ রাতদুপুরে সাংঘাতিক অ্যাডভেঞ্চার……
.
রাত এগারোটা নাগাদ আমাদের ঘরের দরজায় কেউ নক করল। কর্নেল গিয়ে দরজা খুললেন। ভোলার সাড়া পেলাম। গতরাতে বনরক্ষী কাশেমের সঙ্গে ভোলার গোপন সম্পর্ক আঁচ করার ফলে ভোলাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই কর্নেলের বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে আমিও বেরিয়ে গেলাম।
ভোলা চাপাস্বরে বলছিল–কিছুক্ষণ আগে সেনসায়েব নদীর ঘাটের দিকের গেট খুলে দিতে বললেন। ওনার সঙ্গে কাশেম ছিল। দুজনে চলে যাওয়ার পর মেমসায়েব এসেছেন।
কর্নেল পাশের ঘরের দরজার দিকে এগোচ্ছেন, দরজা খুলে নীতা বেরুল। ওর হাতে একটা স্যুটকেস। কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। কর্নেল বললেন–তোমার জিনিসপত্র নিতে এসেছ। হুঁ আমি জানতাম তুমি আসবে। তাই ভোলাকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলাম। তোমার চণ্ডীকাকা কোথায়?
নীতা ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। নতমুখে বলল রাস্তায় অপেক্ষা করছেন।
কর্নেল হাসলেন।–আড়ালে দাঁড়িয়ে তোমাদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। রাত্রে সেনসায়েব বেরুবেন, তোমার চণ্ডীকাকা জানতেন।
–আমি চলি।
–এক মিনিট। অমরেশ রায়ের লেখা বইটা তুমি আমাকে দিয়ে যাও। আমি জানি, সেনসায়েবের কাছে বইটা ছিল। তোমার চণ্ডীকাকা সেই বইটা খুঁজে নিয়ে যেতে বলেছেন। তুমি সেটাও নিয়ে যাচ্ছ।
নীতা ফুঁসে উঠল।–বইটা চণ্ডীকাকারই। কাকা বলেছেন। বইটার পাতায় নাকি কাকার নামও লেখা আছে।
না। চণ্ডীবাবুই টাকার লোভে বইটা তোমার বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে সেনসায়েবকে দিয়েছিলেন। কর্নেল এক পা এগিয়ে ফের বললেন–এতদিনে চণ্ডীবাবু আঁচ করেছেন বইয়ে কী আছে। কিন্তু বইটা না দিয়ে গেলে তোমার যাওয়া হবে না, নীতা! তোমার ভালর জন্য বলছি। সিন ক্রিয়েট কোরো না। তোমার চণ্ডীকাকা একটা সাংঘাতিক রিস্ক নিচ্ছেন। ওঁকে সাবধান করে দিও।
নীতা একটু ইতস্তত করে কাঁধে ঝোলানো তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা বই বের করল। কর্নেলের পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর হনহন করে নেমে গেল লনে। একটু পরে তাকে ছায়ার আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখলাম।
কর্নেল বইটা কুড়িয়ে নিলেন। বইটা বাঁধানো। কিন্তু জরাজীর্ণ বাঁধাই। ভোলা বলে উঠল–ওই যাঃ! চাবি দিয়ে গেলেন না মেমসায়েব।
কর্নেল বললেন–ওই দেখ, রুমালের গিটে বাঁধা চাবি ঝুলছে লকে। হকচকিয়ে গিয়ে রুমালটাও ফেলে গেল নীতা। জয়ন্ত, রুমালটা তুমি রাখো। ফেরার সময় সুযোগ পেলে উপহার দিয়ে যাবে নীতাকে। ভোলা! তোমার ছুটি। গিয়ে শুয়ে পড়ো।
কর্নেল হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন। ভোলা চাবিটা খুলে সত্যি সত্যি রুমালটা আমাকে দিতে এল। বললাম–তুমি রাখো!
ভোলা মুচকি হেসে বলল-রুমের ডুবলিকেট চাবি আমাদের কাছেই থাকে স্যার! কিন্তু সেনসায়েব কাল রাত্তিরে সেটাও চেয়ে নিয়েছিলেন। মেমসায়েবের কাছে নাকি একটা চাবি থাকা দরকার। ওনার কথা অমান্য করতে পারি? তবে ব্যাপারটা কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কর্নেল দরজার ফাঁকে মুখ বের করে বললেন–ভোলা! শুয়ে পড়ো গে। জয়ন্ত! চলে এসো। রুমালটা কৈ? রুমালটা নিয়ে এসো জয়ন্ত!
অগত্যা রুমালটা ভোলার কাছ থেকে নিতে হলো। ভোলা চলে গেল বাংলোর পিছনে তার কোয়াটারের দিকে। ঘরে ঢুকে দেখি, বৃদ্ধ রহস্যভেদী বইটা খুলে ঝুঁকে পড়েছেন। বললেন–হ্যারানো ১৩৩-১৩৪ পাতা এই বইয়ে বহাল তবিয়তে আছে। তবে হাতে সময় কম। কিছুক্ষণের মধ্যে বেরুতে হবে।
–কী আছে ওই দুটো পাতায়?
সংক্ষেপে বলছি। কর্নেল বইটা ওর কিটব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখে বললেন–অমরেশবাবুরা জলে নামতে যাচ্ছিলেন, সেইসময় দেবীপ্রসাদ এসে ওদের খবর দেন, সিন্দুক হস্তগত হয়েছে। একজন গোরা সেন্ট্রি গার্ডের কামরায় ছিল। সে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরাশায়ী করেছেন ওঁরা। তার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে। গার্ডের কামরায় টেডি স্যামসনের ফোলিও ব্যাগের সন্ধান পান। ব্যাগে চাবি ছিল। ভ্যান খুলে ছোট্ট সিন্দুকটা খুঁজে বের করতে সময় লাগেনি। সিন্দুক নিয়ে বিপ্লবীরা জঙ্গলে ঢোকেন। দেবীপ্রসাদ সেন্ট্রির পিঠে তখনও বসে আছেন। হাতে ছুরি। তাকে উনি তখনও জেরা করছেন, সিন্দুকের চাবি ভ্যানের চাবির সঙ্গে আছে কিনা! সেন্ট্রি বারবার বলছে, বরকধঝ-কচতটপ। দেবীবাবু বরাবর ওইরকম গোঁয়ার এবং অপ্রকৃতিস্থচিত্ত মানুষ ছিলেন। পরিতোষ লাহিড়ি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে দৌড়ে এসে দেবীপ্রসাদকে টেনে নিয়ে যান। যাবার আগে দেবীপ্রসাদ সেন্ট্রিকে খুন করেছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, টেডি স্যামসন কিন্তু কোর্টমাশালের সময় সেন্ট্রির হত্যাকাণ্ড বেমালুম চেপে যান। সম্ভবত নিজেকে শাস্তি থেকে বাঁচাতেই। কারণ ওঁর গার্ডের কামরা ছেড়ে ছুটে যাওয়া উচিত ছিল না। যাই হোক, অমরেশের তথ্য অনুসারে গার্ড ছিলেন বাঙালি এবং তিনিই ছিলেন বিপ্লবীদের ইনফরমার।
–সিন্দুক সম্পর্কে আর কী লিখেছেন অমরেশবাবু?
ইস্পাতের চাদরে মোড়া সিন্দুক অনেক চেষ্টা করেও খোলা যায়নি। তখন ওটা মন্দিরের কাছে পুঁতে রাখা হয়। পরদিন তো এলাকা জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় এবং মিলিটারি নামিয়ে কম্বিং অপারেশন শুরু হয়। সবাই নানা জায়গায় ধরা পড়েন। এদিকে পরদিন থেকে মৌরী নদীতে প্রবল বন্যা। যাই হোক, বহু বছর পরে জেল থেকে বেরিয়ে আর কেউ জায়গাটি খুঁজে বের করতে পারেননি। কারণ বছরের পর বছর বন্যা হয়েছে। জঙ্গল ঘন হয়েছে। ভাঙা মন্দির আরও ভেঙে বন্যার স্রোতে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। এবার অমরেশের বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশটা বলি। একদিন পরিতোষ ওঁকে বলেন, সেন্ট্রির কথাটা বরকধঝ কচতটপ নয়। সম্ভবত Break the Jaw, Catch the Top! কিন্তু বহুবার গিয়ে গোপনে খোঁড়াখুঁড়ি করে সিন্দুক খুঁজে পাননি ওঁরা। শেষবার গিয়েছিলেন গভীর রাতে। দুজনে একটা জায়গা পালাক্রমে খুঁড়ছেন। হঠাৎ সেখানে হাজির হন তাদের এক সহযোদ্ধা। তাঁর হাতে বন্দুক ছিল। গুলি ছুঁড়ে তাড়া করেন দুজনকে। অমরেশ চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু বইয়ে তার নাম লেখেননি। এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই সহযোদ্ধার নাম শচীন মজুমদার। চলো! এবার বেরুনো যাক…
বাংলোর দক্ষিণের সদর গেট দিয়ে আমরা বেরুলাম। ততক্ষণে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে মোড় নিলেন কর্নেল। একটু পরে নদীর ধারে পৌঁছলাম। এখানে বালির চড়া সমতল। তাই জলটা ছড়িয়ে গেছে। জুতোর তলা। ভেজানো ঝিরঝিরে স্রোত মাত্র। ওপারে গিয়ে ঝোপঝাড় ঠেলে কর্নেল গুঁড়ি মেরে এগোলেন। ওঁকে অনুসরণ করছিলাম। হঠাৎ কানে এল, সামনে কোথাও কারা। কথা বলছে।
আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হালদারমশাইয়ের কণ্ঠস্বর কানে এল।Break the Jaw. Catch the Top! বরকধঝ-কচতটপ।
কেউ বলল–সাট আপ! জায়গাটা দেখাও। নইলে দেখছ তো হাতে কী আছে?
–ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।
–অ্যাই ব্যাটা! শুধু জায়গাটা দেখিয়ে দে। ছাড়া পাবি। নইলে পাগলামি ঘুচিয়ে দেব।
–দেবীদা জানে……দেবীদা জানে….দেবীদা জানে…
–তবে যে বলছিলি তুই জানিস?
–আমিও চিনি…আমিও চিনি…আমিও চিনি…
–চুপ! চিনিয়ে দে এক্ষুণি।
–খি খি খি! আগে সরপুরিয়া খাওয়াও! সরপুরিয়া খাব। চাঁদের আলোয় বসে খাব। সিন্দুকের পিঠে বসে খাব। খি খি খি। সরপুরিয়া খেতে ভাল। চাঁদের আলো দেখতে ভাল।
ঠিক আছে। ফিরে গিয়ে খাওয়াব। আগে সিন্দুক বের করি। তবে তো।
ততক্ষণে আমরা আরও এগিয়ে গেছি। সেই ভাঙা মন্দিরের স্কুপের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় ‘পাগল’ হালদারমশাই নাচানাচি করছেন। তার সামনে একজন তাগড়াই চেহারার লোক। পরনে প্যান্টশার্ট। একহাতে টর্চ আছে। জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে টর্চটা। অন্য হাতে সম্ভবত কোনও অস্ত্র। সেটা হালদারমশাইয়ের দিকে বারবার তাক করছে সে। হালদারমশাই নির্বিকার নৃত্য করছেন। দৃশ্যটা হাস্যকর বটে, কিন্তু ভয়ঙ্করও।
–এই শেষবার বলছি। দশ গোনার মধ্যে চিনিয়ে না দিলে জবাই করে ফেলব। রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…ফোর..ফাইভ…
হালদারমশাই মাটিতে পা ঠুকে বললেন-হেইখানে…হেইখানে…হেইখানে। দেবীদা কইছিল হেইখানে।
লোকটা হাসল–যাচ্চলে! তুই কোন জেলার লোক রে? বরিশালে জন্ম নাকি?
–হঃ! দেবীদা কইছিল হেইখানে। Break the Jaw. Catch the Top! বরকধঝ-কচতটপ।
–ঠিক আছে। এখানে যদি পোঁতা না থাকে, বুঝতে পারছিস কী হবে?
–হঃ কতা! বুঝছি।
–চল্। ফেরা যাক।
সরপুরিয়া খাওয়াইবেন কতা!
খাওয়াব চল।
হঠাৎ স্তূপের কাছ থেকে একটা ছায়ামূর্তি গুঁড়ি মেরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। তার হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল। হালদারমশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর গর্জে উঠলেন–তবে রে হালার পো! ঘুঘু দেহিছ, ফান্দ দ্যাহো নাই।
হালদারমশাই দুহাতে দ্বিতীয় লোকটাকে জাপটে ধরলেন। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। আমি উসখুস করছিলাম। কর্নেল চিমটি কেটে চুপ করে থাকতে ইসারা করলেন। প্রথম লোকটা টর্চ কুড়িয়ে নিতে ঝুঁকেছে, কাছাকাছি একটা গাছের আড়াল থেকে আরেকটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। প্রথম লোকটা টের পেয়েই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল–কে?
–ইউ ট্রেচারার্স! আমাকে বসিয়ে রেখে তুমি স্পটে চলে এসেছ? তবে মরো!
সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল টর্চ জ্বেলে চিৎকার করে বললেন–তার আগে তোমার খুলি উড়ে যাবে। ফায়ারআর্মসটা ফেলে দাও বলছি।
তারপর এদিক-ওদিক থেকে অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠল। আশ-পাশের গাছ থেকে ধুপধাপ শব্দে কারা নামল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন–হালদারমশাই! কাশেমকে পুলিশের জিম্মায় দিয়ে উঠে পড়ুন।
–হঃ। বলে উঠে দাঁড়ালেন হালদারমশাই।
দেখলাম, পুলিশের অফিসার ইনচার্জ রমেন পালিত এগিয়ে গিয়ে একটা ফায়ারআর্মস কুড়িয়ে নিলেন। বললেন–সুকমল সেন! আপনাকে দুটো মার্ডার এবং একটা অ্যাটেম্পট ফর মার্ডারের চার্জে অ্যারেস্ট করা হলো। তাছাড়া আপনার নামে এই রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে কাঠপাচারের সঙ্গে ইনভলভড় থাকার জন্যও অনেক অভিযোগ আছে। আর শচীনবাবু! দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্তের উপর অত্যাচার এবং ষড়যন্ত্রমূলক কাজের জন্য আপনার নামেও অভিযোগ আছে। দুঃখিত আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
শচীনবাবু বললেন–ভুল করবেন না মিঃ পালিত। আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।
–আছে। দেবীবাবুর মেয়ে নীতাদেবী আজ থানায় গিয়ে আপনার নামে অভিযোগ করে এসেছেন। দেবীবাবুর ওপর আপনি যথেষ্ট অত্যাচার করেছেন। কলকাতা-পুলিশও আমাদের মেসেজ পাঠিয়েছে।
শচীনবাবু হুমকি দিলেন–প্রতাপকে জানালে আপনার বিপদ হবে মিঃ পালিত।
কর্নেল বললেন–হয়তো প্রতাপবাবু খুশিই হবেন এতে। তিনি স্থানীয় এম এল এ এবং মন্ত্রী। আপনাদের কাজকর্মে তার পলিটিক্যাল ইমেজ নষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। চিন্তা করে দেখুন শচীনবাবু! একসময় আপনিই কাঠপাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তারপর সুকমল সেনের সঙ্গে আপনার রফা হয়েছিল। কিসের রফা তাও বলছি। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনে লুঠকরা রেঙ্গুন ট্রেজারির সিন্দুকের খোঁজ দিতে চেয়েছিলেন এই সুকমল সেন। দেবীবাবুর জামাই হয়েছেন সেনসায়েব। অতএব আপনার পক্ষে ওঁর ফাঁদে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেনসায়েবও জানেন না কোথায় সেটা পোঁতা আছে। তবে কাঠপাচারের সঙ্গে এই ভদ্রলোকের জড়িত থাকার আসল কারণ এই জঙ্গলে রাখা সিন্দুক অনুসন্ধান। ইতিমধ্যে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইকে পাগল সাজিয়ে এখানে পাঠিয়ে আমি অমরেশ রায় এবং পরিতোষ লাহিড়ির হত্যারহস্যের সূত্র খুঁজতে চেয়েছিলাম। দৈবাৎ নীতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। তখন জানলাম, আসল খুনী কে। পাগল শ্বশুরকে টোপ করেছিলেন জামাই। কিন্তু নিছক সন্দেহের বশে অত্যন্ত অকারণ দু-দুটো নরহত্যা করে ফেললেন এই জামাই ভদ্রলোক। মিঃ সেন! অমরেশবাবু বা পরিতোষবাবু কেন, কেউই জানতেন না কোথায় সিন্দুক পোঁতা আছে।
সেনসায়েব বাঁকা হাসলেন।–আপনি জানেন তাহলে।
-হ্যাঁ। জেনেছি। আজ সকালেই আবিষ্কার করেছি। মিঃ পালিত! আসামীদের থানায় নিয়ে যান।…
বাংলোয় ফিরে হালদারমশাই দুঃখিতভাবে বললেন–অহম্ ড্রেস চেঞ্জ করব ক্যামনে? পূর্ণিমা হোটেলে আমার ড্রেস আছে। আনবে কেডা?
কর্নেল হাসলেন।–আপাতত জয়ন্তের পাঞ্জাবি-পাজামা পেয়ে যাবেন। স্নান করেও নিতে পারেন। বাথরুমে যান। ধুলোময়লায় নোংরা হয়ে আছেন।
হালদারমশাই বললেন–হঃ। ঠিক কইছেন। গা ঘিনঘিন করতাছে।
উনি বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। বললাম–সব বোঝা গেল। কিন্তু বিলুকে খুন করতে গিয়েছিল কে?
কর্নেল বললেন–আমার কথাটা ভুলে গেছ ডার্লিং। বলেছিলাম সেই খুনির আসল টার্গেট নীতাও হতে পারে। হা–নীতাই বটে। তবে নীতাকে মেরে সে নিশ্চয় বিলুকেও রেহাই দিত না। বিলু গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পেত বলে মনে হয় না। দুজনকেই মরতে হতো।
–কিন্তু লোকটা কে?
কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে দিলেন। বললেন–লোকটাকে কিছুক্ষণ আগে টর্চের আলোয় দেখেছ। এবার দেখ তো, চিনতে পারো কি না?
ছবিটা দেখেই বললাম–ফরেস্টগার্ড কাশেম না?
-হ্যাঁ। সেনসায়েবের চেনা কাশেম। সেনসায়েব এবার নীতাকে নিয়ে এসে খতম করতে চেয়েছিলেন। কারণ নীতা তার অনেক অপরাধের সাক্ষী। বিশেষ করে অমরেশ এবং পরিতোষকে হুমকি দেওয়া চিঠিগুলো নীতার হাতের লেখা। নীতাকে চিঠি লিখতে বাধ্য করতেন সুকমল সেন। অমরেশবাবুর স্ত্রীকে লেখা চিঠির হস্তাক্ষর এবং আমাকে আজ লিখে-যাওয়া চিঠির হস্তাক্ষর হুবহু এক।
চমকে উঠে বললাম-তা-ই বটে। চিঠির হস্তাক্ষর দেখে চেনা লাগছিল।
কর্নেল কিটব্যাগের চেন খুলে বললেন–তুমি তো জানো, আমার বাড়িতে জেরক্স মেশিন আছে। নন্দিনীর দিয়ে-যাওয়া ইনল্যান্ড লেটারের জেরক্স কপির সঙ্গে বাথরুমে রেখে যাওয়া নীতার চিঠির হস্তাক্ষর মিলিয়ে দেখ।
কর্নেল চিঠি দুটো বের করে দিলেন। মিলিয়ে দেখে বললাম–হ্যাঁ। একই হস্তাক্ষর।
হালদারমশাই বাথরুম থেকে উঁকি দিয়ে বললেন–জয়ন্তবাবু! পাজামা পাঞ্জাবি!
কিছুক্ষণ পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ সেজেগুজে বেরুলেন। কর্নেল বললেন ভোলাকে ডেকে আনো জয়ন্ত! হালদারমশাইয়ের শোবার ব্যবস্থা করা দরকার। ডিনারের ব্যবস্থা করা যাবে না। তবে ভোলার ভাঁড়ারে পাঁউরুটি সন্দেশ মিলতেও পারে।
হালদারমশাই জোরে হাত নেড়ে বললেন–নাহ্। যাই গিয়া।
–সে কী। এত রাত্রে কোথায় যাবেন?
–পুর্ণিমা হোটেলে। ওনারের লগে মামা-ভাগনা সম্বন্ধ করছি। ভাগ্না চিন্তায় আছে।
–কিন্তু এখন কি ওখানে মিলের ব্যবস্থা হবে?
হালদারমশাই সহাস্যে বললেন–শচীনবাবু জামাই আদরে ডিনার সার্ভ করছেন। খিচুড়ি, ডিমসেদ্ধ, পাঁপড়ভাজা, চাটনি। যাই গিয়া! মর্নিংয়ে আসব।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে বেরিয়ে গেলেন!…
ভোরে কর্নেলের তাড়ায় ঘুম থেকে উঠতে হলো। ভোলা আমার জন্য বেড টি এবং কর্নেলের জন্য কফি দিয়ে গেল। তারপর কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরুলেন। গ্রীষ্মের প্রত্যূষে বনভূমির অপার্থিব সৌন্দর্য আছে। এই প্রথম সেই সৌন্দর্য দেখলাম। সদ্য ঘুম ভেঙে পাখিরা ডাকাডাকি করছে। গাছপালার মধ্যে যেন জেগে ওঠার স্পন্দন। হালকা বাতাসে অজানা ফুলের সৌরভ! সেই স্কুপের মাথায় উঠে কর্নেল বললেন–দেখে যাও!
ঝোপঝাড় ঠেলে ওঁর কাছে গিয়ে দেখি, কর্নেল নুয়ে-পড়া ঝোপ-লতাপাতা সরাচ্ছেন। একহাত চওড়া একটা ফাটলের ভেতর অন্ধকার ছমছম করছে। কর্নেল টর্চ জ্বাললেন। গভীর ফাটলের তলায় কী একটা কালো জিনিসের কোণের অংশ দেখা যাচ্ছে। বাকিটা মাটির ভেতর ঢাকা পড়েছে। বললাম–ওটাই কি সেই সিন্দুক?
কর্নেল বললেন–সিন্দুকের একটা কোণ দেখা যাচ্ছে। ওটা আইনত সরকারি সম্পত্তি। ওটার হদিস পুলিশকে এবার দেওয়া দরকার। এক মিনিট!
বলে কর্নেল স্তূপের মাথা থেকে কয়েকটা চাঙড় ফাটলে গড়িয়ে ফেললেন। ঢাকা পড়ল গুপ্তধন। তারপর ঝোপ-লতাপাতাগুলো আগের মতোই টেনে ফাটলটা ঢেকে দিলেন।
বাংলোয় ফিরে এসে কর্নেল বললেন–নীতার সেই রুমালটা সঙ্গে নাও ডার্লিং!
–ভ্যাট! কী যে বলেন?
–বা রে! রুমালটা ওকে ফেরত দিতে হবে না? এই বৃদ্ধের হাতে কোনও যুবতীর রুমাল শোভা পায় না! চলো! ফেরার পথে হালদারমশাইকে পূর্ণিমা হোটেল থেকে নিয়ে আসব। সাড়ে দশটার ট্রেনে কলকাতা ফিরব একসঙ্গে।
নাক বরাবর জঙ্গলের ভেতর হেঁটে স্টেশন রোডে পৌঁছুলাম। বললাম– সেনসায়েব নীতাকে খুনের জন্য কাশেমকে পাঠিয়েছিলেন! পুলিশকে এটা বলবেন না? এটা ওঁর সেকেন্ড মাডার-অ্যাটেম্পট।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। ছবিটা তো নিয়ে যাচ্ছি সেজন্যই।
একটা খালি রিকশা দাঁড় করিয়ে আমরা উঠে বসলাম। কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার। একখানে হঠাৎ বললেন–রোখো! রোখো!
সাইকেল-রিকশা থেমে গেল। কর্নেল চোখ টিপে হেসে বললেন–সকালের আলোয় যুবক-যুবতীদের নিভৃত প্রেমালাপ এই কদর্য পৃথিবীকে স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপহার দেয়, ডার্লিং! ওই দেখ। উঁহু, ওদিকে নয়। পার্কের দিকে তাকাও।
পাশেই একটা পার্ক। কোনার দিকে বেঞ্চে ফুলের ঝোপের আড়ালে দুটিতে বসে আছে। পাশে দাঁড় করানো মোটর সাইকেল। বললাম–কী আশ্চর্য!
–নাহ্। এটাই স্বাভাবিক! যৌবন যৌবনকে এমনি করে টানে। তবে দার্শনিকরা বলেছেন, প্রেম এসে মানুষের ভেতরকার হিংস্র পশুকে তাড়িয়ে দেয়–প্রেম এত শক্তিমান!
–কিন্তু নীতা তো পরস্ত্রী!
–হুঁ। আপাতত পরকীয়া প্রেম বলা চলে। তবে সরকার ডিভোর্স আইন চালু করেছেন। কাজেই ডার্লিং! তোমার চিন্তার কারণ নেই। যাও, রুমাল ফেরত দিয়ে এসো।
কী বলছেন? ওই মস্তানটার কাছে আমি যাব?
–হ্যাঁ। বিলু মস্তান-টস্তান বটে। তবে আশা করি, নীতা ওকে জব্দ করতে পারবে। মেয়েরা এটা পারে, জয়ন্ত! যাও! রুমালটা দিয়ে এসো।
নাহ। আপনি যান।
কর্নেল রিকশাওলাকে বললেন–এক মিনিট। আসছি।
বলে বৃদ্ধ রহস্যভেদী আমার হাত থেকে রুমাল নিয়ে পার্কে ঢুকে পড়লেন। রিকশাওলা অবাক হয়ে বলল–কী হলো স্যার? বুড়োসায়েব কোথায় যাচ্ছেন? আমার যে লেট হয়ে যাচ্ছে।
বললাম–ভেবো না। বুড়োসায়েব পুষিয়ে দেবেন। তবে উনি কার কাছে যাচ্ছেন জানো তো? শচীনবাবুর ছেলে বিলুবাবুর কাছে। চেনো না বিলুবাবুকে?
রিকশাওলা অমনি ভড়কে গিয়ে শুধু উচ্চারণ করল–অ।
–অ নয়। বরকধঝ কচতটপ।
আজ্ঞে?
হাসতে হাসতে বললাম–কিছু না।…
Leave a Reply