আত্মজ

আত্মজ

ভাইস প্রেসিডেন্ট শুভব্রত গ্লাসে টুং টুং শব্দ করে বললেন, ”লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান অফ ম্যানহাটন আসোসিয়েটস! ফরম্যালিটিজ অনেক হল, এবার আজকের পার্টির যে মূল আকর্ষণ, সে আপনাদের কিছু বলবে। আমাদের কোম্পানির ইয়ং ব্রিগেডের মেন অ্যাসেট মি. রাজাধিরাজ দত্ত ওরফে আমাদের সবার প্রিয় ধীরাজকে কিছু বলতে রিকোয়েস্ট করছি।”

প্রবল করতালির মধ্যে ধীরাজ ধীর পায়ে এগিয়ে এল। পরনে মোটা লেদারের জ্যাকেট আর জিন্স। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত পোর্টল্যান্ডের ছোট্ট বিভারটন শহর। এমনিই এখানে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, তার মধ্যে খোলা টেরেসে এই অফিস পার্টিতে অদূরের প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হিমেল হাওয়া এসে সবাইকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ধীরাজ শুভব্রতর কাছে এসে মাইক্রোফোনটা নিয়ে মৃদু হেসে বলতে শুরু করল, ”আমি মাত্র একবছর হল ম্যানহাটন আসোসিয়েটস জয়েন করেছি এখানে এসে, এর মধ্যেই আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি তাতে আমি আপ্লুত। আজ যে এমপ্লয়ি অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডটা আমি পেলাম তা কিছুই সম্ভব হত না যদি না শুভব্রত স্যার আমার পাশে থাকতেন। আমি প্রথম যখন আমেরিকায় আসি, আমার এই দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না, এখানকার ওয়েদার, কালচার সবকিছুই অজানা ছিল। ভালো করে ইংলিশও বলতে পারতাম না। শুভব্রত স্যার আমার বড়দাদার মতো পাশে থেকে……।”

শুভব্রত পাশ থেকে বাধা দিলেন, যদিও এই ক-মাসে ধীরাজ তার নিজের ছোটভাইয়ের মতোই হয়ে গেছে তবু নিজের সম্পর্কে প্রশংসা শুনতে কেমন যেন লাগে, বললেন, ”আহা ওসব থাক, তোমার এই অ্যাচিভমেন্ট, ভবিষ্যতের গোল সম্পর্কে কিছু বল ধীরু।”

ধীরাজ বলল, ”আমার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে যাঁদের অবদান তাঁরা আমার বাবা-মা। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত তাঁরা নিজেদের আনন্দ, খুশি স্যাক্রিফাইস করে আমাকে বড় করেছেন। বাবার ইচ্ছেতেই আমি যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। আমার বাবা-মা……।”

শুভব্রতর পাশ থেকে আরেকজন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল ফুট কাটল, ”ওই শুরু হয়ে গেল। শুভ তুমি যাই বল ছেলেটার সব ভালো, আমাদের কোম্পানিকে ও একাই অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ওর এই এক বাবামায়ের প্রশস্তি শুনতে শুনতে কান পচে গেল! ছেলেটার কোনো গার্লফ্রেন্ডের কথাও তো কোনোদিনও বলতে পারে! কি বুড়োদের মতো সবসময়!”

শুভব্রত কিছু না বলে হাসলেন। এটা ঠিক যে ধীরুর সব ভালো, কিন্তু দশটা কথার মধ্যে অন্তত পাঁচবার বাবামায়ের কথা তোলাটা একটু বিরক্তির উৎপাদন করে বইকি! তবে এই আমেরিকানরা জানবে কি করে বাবা-মায়ের টান কি হয়? এদের সেই অনুভূতিটাই নেই। আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে বাবামায়ের সঙ্গে একসাথে থাকাটা এরা লজ্জা মনে করে। প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা শুভব্রত, কাছ থেকে দেখেছেন এদের মানসিকতা। বনের পশুরা যেমন ছেলেমেয়ে একটু বড় হয়ে গেলে তাদেরকে ছেড়ে দেয়, এদেরও তেমন। নস্ট্যালজিয়া, বুড়ো বাপমায়ের প্রতি ভালোবাসা এসব এদের মধ্যে নেই। সবটাই দূর থেকে হাই-হ্যালো। ভাবতে ভাবতেই নিজের মনের মধ্যে হোঁচট খেলেন শুভব্রত। তিনি নিজে কি সামান্য হাই-হ্যালোটুকুও করেছেন এই আঠাশটা বছরে? এতগুলো বছর ধরে নিজের বাবামায়ের প্রতি সুতীব্র অভিমান সময়ের সাথে সাথে অলঙ্ঘ্যনীয় দূরত্বে পরিণত হয়েছে। একবার খোঁজও নেননি এতগুলো বছরে বাবামা কেমন আছে জানতে! কিছুটা শ্রেয়সীর প্ররোচনায়, আর অনেকটাই নিজের উদাসীনতায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, এতগুলো বছরে তা নিয়ে একবারও অনুতাপ হয়নি শুভব্রতর, কিন্তু ধীরু আসার পর থেকে ওর সাথে দিনে দশ থেকে বারো ঘণ্টা থাকতে থাকতে অজান্তেই ইদানীং বড্ড মনে পড়ে ছোটবেলার দিনগুলো! ভোর হতে না হতেই কিছু ছোলা পকেটে নিয়ে বাবার সাথে গঙ্গার পাড়ে হেঁটে বেড়ানো, হাঁটতে হাঁটতেই বাবার কাছে ইংরেজি শেখা। মায়ের মুখটা মনে পড়তেই ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে শুভব্রতর। মনে হয় সব মান অভিমান দূরে সরিয়ে রেখে একছুটে চলে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখেন। ধীরুর কাছে সারাদিন তার বাবামায়ের কথা শুনতে শুনতে ভেতরে আত্মগ্লানিতে পুড়ে যাচ্ছেন শুভব্রত বেশ কিছ্যদিন ধরে।

”স্যার, কি ভাবছেন?”

ধীরু কখন বলা শেষ করে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে শুভব্রত বুঝতেই পারেননি। পার্টি প্রায় শেষের দিকে। সবাই ইতিউতি ডিনার শেষ করতে ব্যস্ত। স্কচের গ্লাসটায় আরেক পেগ নিয়ে তিনি লাল চোখে ধীরুর দিকে তাকালেন। ছেলেটা চুপচাপ ফ্রুটজ্যুসে চুমুক দিচ্ছে। শুভব্রত জানেন অ্যালকোহল অফার করলেই স্মিত হেসে বলবে, ”স্যার এসব খাওয়াতে আমার কোনো ছুঁৎমার্গ নেই। আমার বাবা সবসময় বলেন যে খেলেই খারাপ না খেলেই ভালো এমন কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু বাবা বলেন যে জিনিসটা খাব সেটা শরীরের পক্ষে উপকারী কিনা তা দেখে। অপকারী হলেও খাওয়া যায় সাময়িক জিভের স্বাদে, যেমন তেলেভাজা বা ফুচকা। কিন্তু যে জিনিস খেলে সে আমাকেই বশ করে ফেলবে, আমার নিজের প্রতি কোনো কন্ট্রোল থাকবে না সে জিনিস আমি খাব না স্যার।”

শুভব্রত গ্লাসটা শেষ করে দূরে শ্রেয়সীর দিকে তাকালেন। এই সব পার্টিতে যা হয়, ও-ই মধ্যমণি। কালার করা ফাঁপানো চুল ছড়িয়ে আছে খোলা পিঠের ওপর, কালো গ্লসি প্রিন্টের হল্টারনেক ব্লাউজ আর সোনালি শাড়ি। লালমুখো সব চাটুকারেরা ঘিরে ধরে আছে ওকে। শুভব্রত বারণ করেছেন আগে বেশ কয়েকবার, এই অফিস পার্টিগুলোতে এসব না পরে ফরম্যাল কিছু পরতে, শ্রেয়সী শোনেনি। ঘাড় বেঁকিয়ে উদ্ধতভাবে বলেছিল, ”তুমি তোমার অফিস নিয়ে ব্যস্ত, আমি কি নিয়ে থাকব? আর এরকম সাজতে আমার ভালো লাগে। আমার ব্যাপারে তুমি ইন্টারফেয়ার করবে না।”

অথচ এই শ্রেয়সীই প্রবলাবে ইন্টারফেয়ার করেছিল শুভব্রত আর ওর বাবামায়ের মাঝে, মনে পড়ল শুভব্রতর। বাবা ছিলেন পুরনো আমলের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া শিক্ষক। ছোট্ট থেকে শুভব্রতদের শেখাতেন, টাকা চলে গেলে আবার ফিরে আসে, সম্পত্তি চলে গেলেও তা আবার ফেরত পাওয়া যায়, কিন্তু চারিত্রিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা একবার চলে গেলে আর আসে না। বলতেন, ”এই সুন্দর পৃথিবীতে যখন জন্মেছিস, স্বামীজীর কথামতো কোনো একটা আঁচড় কেটে যাবি।”

ও আর দাদা হাঁ করে শুনত। দাদা সত্যিই অন্তর থেকে নিয়েছিল বাবার শিক্ষা, তাই ডাক্তারির দারুণ স্কলার হয়েও, লন্ডন থেকে এফআরসি এস পাশ করে এসে গ্রামগঞ্জের গরিব মানুষদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাবার গর্বে সেদিন বুক ফুলে গিয়েছিল মনে পড়ে ওর। ওর মাথায় হাত রখে বাবা বলেছিলেন, ”তুইও দাদার মতোই হোস। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিস খুব ভাল, পড়ে যেন দেশেই থাকিস। আমাদের এই পোড়া দেশের মানুষের জন্য কিছু করিস।”

কিন্তু করতে পারেননি শুভব্রত। বড়োলোক বাবার মেয়ে শ্রেয়সীর কাছে এই সমস্ত বস্তাপচা মূল্যবোধের কোনো দামই নেই। ওকে বিয়ের প্রথম শর্ত দিয়েছিল বিয়ের পর আমেরিকায় চলে যেতে হবে, সেখানে নিজেদের মত একটা বাংলো, একটা বড় গাড়ি, তবে না ফ্যামিলির কাছে ওর স্টেটাস থাকবে! নাহলে আর গরিব মাস্টারের ছেলেকে ও বিয়ে করবে কেন?

দাদা মুর্শিদাবাদের এক গ্রাম থেকে ফেরার সময় ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পরে বাবা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের পরই যখন শ্রেয়সীকে নিয়ে এখানে পাড়ি দেন শুভব্রত, মা-র চোখে জল থাকলেও বাবা কিছু বলেননি। মা বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ”খোকা, দু-বছর বাদেই ফিরে আসবি বলছিস, ততদিন সাবধানে থাকবি, বউমাকেও সাবধানে রাখিস।” বাবা চুপ ছিলেন কারণ তিনি জানতেন শুভব্রত আর ফিরবেন না। আচ্ছা বাবার সুযোগ্য পুত্র দাদাই কেন মরে গেল, শুভব্রত মরে গেলে এই পৃথিবীর তো কোনো ক্ষতিই হত না, বরং দাদা বেঁচে থাকলে আরও অনেক গরিব মানুষের উপকার হত!

ধীরু আবার ডাকতে শুভব্রত চমকে তাকালেন, ”কিছু বলবে?’ ‘

ধীরাজ শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, ”স্যার, একটা রিকোয়েস্ট ছিল। একবছর হয়ে গেল এখানে এসেছি, একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে চাই। এমনিতেই তো সামনে ক্রিসমাস, লম্বা ছুটি পড়ে যাবে। আমি নিউ ইয়ারের মধ্যেই ফিরে আসব। মা বারবার আমায় দেখতে চাইছেন।”

শুভব্রত হাসলেন। বললেন, ”ও, সেইজন্য তুমি আজ সারাটা দিন ধরে এত কেনাকাটা করলে?”

ধীরাজ চোখ নামিয়ে হাসল, ”স্যার, আমরা অনেক ভাইবোন। সবার জন্য না নিয়ে গেলে ওরা মুখভার করবে। ওদের জন্যেই তো এত খাটি বলুন!”

শুভব্রতর বুকটা মুচড়ে উঠল। সবার পরিবার আছে, বাবা মা, ভাই বোন আছে। তাঁর কেউ নেই। এককালে সব ছিল, উনি নিজে সেই সম্পর্কগুলোর টুঁটি ছিঁড়ে হত্যা করেছেন। আঠাশ বছর আগের দিনটার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। কয়েকদিন ধরেই মা বারবার ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখছিলেন দু-বছর তো হয়ে গেল আর কেন! এবার চলে আয় তোরা, আমরা বুড়োবুড়ি আর একা থাকতে পারছি না। তোর দাদা চলে যাওয়ার পর দিনগুলো অসহ্য হয়ে উঠেছে।

শ্রেয়সীর কাছেও মায়ের এই প্যানপ্যানানি অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তখন সবে সে পশ্চিমী দুনিয়ার রঙ-রসের স্বাদ পেয়েছে, উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির মতো। কয়েক মাসের অসহিষ্ণুতা ঠিকরে বেরিয়েছিল সেদিন শ্রেয়সীর লেখা চিঠিতে, ”মা, আপনারা কি মনে করেন, বাবা আর দাদার মতো ওই পচা গাঁয়ের এঁদো গলিতে মাস্টারি করে আর রুগিদের নোংরা ঘাঁটার জন্য শুভ জন্মেছে? কি পেয়েছেন বাবা ওই ক-টা পয়সার মাস্টারি করে? না ছেলেদের ভালো স্কুলে পড়াতে পেরেছেন না একটা ভালো বাড়ি! আপনারা কেন আমাদের এভাবে বিরক্ত করেন? আমরা আর কোনোদিনই ইন্ডিয়ায় ফিরব না। আমাদের আর বিরক্ত করবেন না।”

আচ্ছা সেদিন দোষ কি পুরোটাই শ্রেয়সীর ছিল? পাশে নীরব দর্শক হয়ে প্রচ্ছন্ন মদত কি শুভব্রত নিজেও দেননি? তারপর এই আঠাশটা বছরে ইন্ডিয়া থেকে একটা চিঠিও আর আসেনি। বাবামায়ের অভিমান তো ভাঙাতে পারতেন শুভব্রত একবার নিজে গিয়ে, একবারও তার তাগিদ অনুভব করেননি। কেরিয়ারের মইয়ে উঠতে উঠতে শেষ হয়ে গেছে যৌবন, সন্তানহীন ওদের দুজনের মাঝে দূরত্ব আরো বেড়েছে, শ্রেয়সী বুঁদ হয়ে থেকেছে ওর নিত্যনতুন পার্টি, ফ্যাশন নিয়ে আর শুভব্রত অফিসে। একটা সন্তান থাকলেও বোধ হয় আজ এতটা ফাঁকা লাগত না!

শুভব্রত বললেন, ”বেশ তো, ঘুরে এসো। আমার জন্যে কলকাতা থেকে ভালো কিছু নিয়ে এসো। অনেকদিন যাইনি কলকাতা।”

ধীরাজ হাসল, ”নিশ্চয়ই স্যার। আমার মায়ের হাতের নরমপাকের সন্দেশ আনব স্যার। আশা করি প্লেনে নষ্ট হবে না।”

শুভব্রত বাড়ি ফেরার সময় ড্রাইভ করতে করতে ভাবছিলেন, এই ক-মাসে ধীরাজ তাঁকে অনেকটা পালটে দিয়েছে। ধীরাজের কাছে প্রতিনিয়ত ওর বাবামায়ের কথা, শিক্ষা, ভালোবাসা শুনতে শুনতে এতদিনের জমে থাকা বরফ যেন গলে যাচ্ছে, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে মা-কে। কিন্তু যে পাপ তিনি এতগুলো বছরে করেছেন তার কি কোনো ক্ষমা আছে? একবার কোন বইয়ে যেন পড়েছিলেন, পিতৃ-মাতৃ ঋণ কখনো শোধ হয় না, তাই শোধ করতে হয় শোধ হয় পিতামাতা হয়ে। নিজের সন্তানদের বাৎসল্য স্নেহের মধ্যে দিয়েই চক্রাকারে আবর্তিত হয় ভালোবাসার এই প্রবাহ। শুভব্রতর হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, তিনি তো সেই পুণ্যেরও অংশীদার হলেন না, তার পিতৃমাতৃ ঋণ কিভাবে শোধ হবে তাহলে? শ্রেয়সী বিয়ের পরই স্পষ্ট জানিয়েছিল বাচ্চা সে চায় না, বাচ্চা মানুষ করে সাধারণভাবে জীবন কাটাতে সে চায় না, সে চায় নিজের মতো করে বাঁচতে।

শুভব্রত ঝট করে পাশে বসে মোবাইলে খুটখাট করা শ্রেয়সীর দিকে তাকালেন, ”ক্রিসমাসে চল না ইন্ডিয়া ঘুরে আসি।”

শ্রেয়সী অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল, ”ইন্ডিয়া! কেন? এতকাল বাদে?”

—”চল না, খুব ইচ্ছা করছে।”

শ্রেয়সী পাত্তাই দিলো না, ”আর ইউ ম্যাড? ক্রিসমাসে আমাদের ক্লাব থেকে লাসভেগাস যাওয়ার কথা, কবে থেকে ঠিক হয়ে আছে! হঠাৎ করে ইন্ডিয়া যেতে যাব কেন! হঠাৎ হঠাৎ তোমার কি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নস্টালজিয়া উথলে ওঠে নাকি!”

শুভব্রতর চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল। শ্রেয়সীর সাথে এখন কথা বলা মানেই পারস্পরিক খোঁচা আর তিক্ততা। শ্রেয়সীর বাবামা লন্ডনে ওদের ছেলের কাছে থাকেন বহুদিন ধরে, তাই শ্রেয়সীর টান থাকবে না ইন্ডিয়া যাওয়ার এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুভব্রত কি বলে এতদিন টান অগ্রাহ্য করে থাকলেন?

ধীরাজ ছুটি নিয়ে চলে যাওয়ার পর শুভব্রত আরো অস্থির হয়ে উঠলেন। শ্রেয়সীও ওর বন্ধুদের সাথে লাসভেগাস চলে গেছে। একেবারে নিউইয়ার কাটিয়ে ফিরবে। ওদের ওই মাতলামি, লোক দেখানো গা জড়াজড়ি অসহ্য লাগে শুভব্রতর। অফিসও ছুটি। এদেশে এসময় সবাই লম্বা ছুটি কাটাতে যায়। সারাটাদিন একা একা থেকে অবসাদ এসে গ্রাস করছিল তাঁকে, এ কি বয়সের লক্ষণ?

দু-দিন বাদে আর থাকতে না পেরে শুভব্রত ইন্ডিয়ার টিকিট কেটে প্লেনে চড়ে বসলেন। মন উচাটন, এতগুলো বছরের পাপের অনুতাপ দগ্ধে দগ্ধে খাচ্ছে তাঁকে। দাদা মারা যাওয়ার পর কোথায় তিনি একমাত্র ছেলে হয়ে বাবামায়ের দেখাশোনা করবেন, তা না, স্বার্থপরতার চূড়ান্তে গিয়ে এতগুলো বছর কাটিয়েছেন তিনি। আচ্ছা, বাবামা আছেন তো? যদি না থাকেন? এই পাপ তিনি রাখবেন কোথায়? ধীরাজ যেদিন ওঁর কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিল, থাকতে না পেরে সব খুলে বলেছিলেন ওকে, সব শেষে বলেছিলেন, ”ধীরাজ, জানো তোমার কথা শুনে আমারও ভীষণ ইচ্ছে করে বাবামায়ের কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু বাবা- মা কি আমাকে ক্ষমা করবেন? আমি যা করেছি তারপরেও?”

ধীরাজ হেসে বলেছিল, ”স্যার, আমার বাবা কি বলেন জানেন? বলেন, ছেলেমেয়েদের ওপর বাবা মা কি করে রাগ করবে? তাঁরা তো বাবামায়েরই রক্ত, বাবামায়েরই শরীরের অংশ। ছেলেমেয়ে ভুল করেছে মানে সেটা বাবামায়ের শিক্ষা দেওয়ার ব্যর্থতা। আপনি গিয়েই দেখুন না স্যার, তাঁরা সব ভুলে আপনাকে জড়িয়ে ধরবেন, আপনি দেখবেন! আর যদি একটু বকুনি খানই, হজম করে নেবেন। তবু তাঁরা যতদিন এই পৃথিবীতে আছেন, তাঁদের ভালোবাসাটুকু নিংড়ে নিন স্যার। জানবেন একমাত্র এই দুটো মানুষই আপনাকে কোনো স্বার্থ ছাড়াই ভালোবাসেন।”

জার্মানি থেকে ফ্লাইট চেঞ্জ করে যখন দমদমে নামলেন শুভব্রত তখন টানা ছত্রিশ ঘণ্টার জার্নিতে শরীর ক্লান্ত। তবু এতদিন বাদে এসে মনটা তাঁর আনন্দে নেচে উঠল। প্রিপেড ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে শ্রীরামপুরের দিকে যেতে যেতে আনন্দে চোখে জল এসে গেল শুভব্রতর। জন্মভূমির টান বোধ হয় একেই বলে! খুব ছোটবেলায় একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল শুভব্রতর, সপ্তায় একদিন করে বাবা স্কুল কামাই করে তাঁকে নিয়ে হাওড়া এসে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতেন টানা এক বছর। মনে পড়তেই মনটা ভিজে উঠল তাঁর।

 শ্রীরামপুরে গাড়ি ঢুকতে প্রথমে কিছু চিনতেই পারলেন না শুভব্রত! যখন চলে গিয়েছিলেন তখন শ্রীরামপুর একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল মাত্র, মাহেশের রথ, গঙ্গার ধারের চার্চ ছাড়া ছিল না কিছুই তেমন। কিন্তু এখন তো প্রায় শহর। ঝাঁ-চকচকে বিগ বাজার, অত্যাধুনিক মলের পাশ দিয়ে ছুটে চলল গাড়ি লাহিড়ীপাড়ার দিকে। বাড়ির গলিটায় ঢুকতেই নিজের হৃৎপিণ্ডের হাতুড়ি পেটার মতো শব্দটা শুনতে পাচ্ছিলেন শুভব্রত।

নিজেদের ছোটো একতলা বাড়িটা চেনা চেনা লাগলেও সামনে কিসব সাইনবোর্ড দেখে মুহূর্তের জন্য কনফিউজড হয়ে গেলেন শুভব্রত। পাশের চায়ের দোকানের ছেলেটা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে, ”কাউকে খুঁজছেন স্যার?”

”হ্যাঁ মানে” শুভব্রত আমতা আমতা করলেন, ”অনেকদিন বাদে এলাম তো, ঠিক চিনতে পারছি না, জীবনকৃষ্ণ লাহিড়ী, স্কুলের মাস্টার ছিলেন, তাঁর বাড়িটা………”

ছেলেটা একগাল হেসে বলল, ”ঠিক বাড়ির সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছেন স্যার। এটাই তো ওঁর বাড়ি। বাবা বাড়িতে অনাথ আশ্রম করেছেন তো, তাই বুঝতে পারেননি। আসুন আসুন।” বলতে বলতে ছেলেটা এগিয়ে গেল বাড়ির ছোট্ট গেটের দিকে, ”আমিও এখানেই মানুষ স্যার। নর্দমার ধারে পড়েছিলাম, বাবা তুলে নিয়ে এসে বড় করেছিলেন। পড়াশুনোয় মাথা ছিল না, তাই দোকান দিয়েছি আর আশ্রমের কাজ করি। আপনি বুঝি বাবার পুরনো ছাত্র স্যার?”

শুভব্রত বিস্ময়ে ঘাড় নাড়লেন। বাড়িটা ভেতরটা একইরকম আছে, সেই ছোট্ট একফালি বাগান, একটেরে বাড়ি। এই বাগানে তিনি আর দাদা একসময় কত খেলেছেন, এখন কিছু বাচ্চা ছোটাছুটি করছে, বাবার হাতে তৈরি করা নতুন ফুলগুলোকে দেখতে পেলেন শুভব্রত বাচ্চাগুলোর মাঝে। কিছু ছোটমেয়ে ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে রেলিঙগুলো।

ছেলেটা বলেই চলল, ”ভালো সময়ে এসেছেন স্যার, আমাদের আরেক দাদাও এসেছেন পরশু, আজ একটা ছোট পিকনিক আছে, একদম খাওয়াদাওয়া করে যাবেন স্যার।”

বাড়ির দিকে যত এগোচ্ছিলেন তত যেন কে তাঁর পা টেনে ধরছিল। ঘরে ঢুকে দেখলেন, বাবা সেই একইভাবে আগের মতো সোজা হয়ে বসে পড়াচ্ছেন। সামনে অনেক ক-টা কিশোর-কিশোরী। চুলগুলো ধপধপে সাদা হয়ে গেছে, মুখেও বলিরেখা থাবা বসিয়েছে, তবু কণ্ঠস্বর আজও ঋজু, ”ছোট্ট ক্যাসাবিয়াঙ্কাকে আস্তে আস্তে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করছিল, তবু সে জাহাজের ডেক থেকে একচুলও নড়ল না, তার বাবার আদেশ অমান্য করবে না বলে। তার বাবা তাকে ডেক থেকে কোথাও যেতে বারণ করেছিলেন। এই একই জিনিস আমরা আমদের পুরাণে নচিকেতার মধ্যেও পাই। তোমরাও নিজেদের এভাবেই তৈরি করো যাতে……।”

শুভব্রত আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না, চারদিকে না তাকিয়ে ”বাবা!’ বলে গিয়ে জীবনকৃষ্ণর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লেন।

পাশ থেকে কেউ একটা বলে উঠল, ”একি স্যার! আপনি!”

শুভব্রত প্রবল বিস্ময়ে তাকাতেই দেখলেন ধীরাজ বসে আছে বাবার কোল ঘেঁসে। হাতে অনেক গিফটের বাক্স।

ধীরাজ বলল, ”বুঝেছি স্যার, আপনিই তাহলে শুভদা? আপনার কথা বাবা- মায়ের মুখে অনেক শুনেছি। আমিই এই অনাথ আশ্রমে প্রথম আসি। যদিও এতদিনে ভুলেই গেছি বাবামা আমার সত্যিকারের বাবামা নন!”

শুভব্রতর চোখের জল তখন বাবার পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে। স্থান কাল পাত্র ভুলে ম্যানহাটন আসোসিয়েটসের দুঁদে ভাইস প্রেসিডেন্ট শুভব্রত লাহিড়ী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ”আমাকে ক্ষমা করো বাবা!”

ধীরে ধীরে বাবার অশক্ত কাঁপা কাঁপা হাত নেমে এল শুভব্রতর উপর, ”উঠে আমার কাছে আয় খোকা!”

পাক্কা পনেরো দিন পরে শুভব্রত যখন শ্রীরামপুর ছাড়লেন, তখন তাঁর হাত ভর্তি মায়ের বানানো খাবারের ব্যাগ আর কোলে ছোট্ট একটা শিশু। বাবার আশ্রম থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। পিতৃঋণ শোধ করতেই হবে, এই মাটির তালটাকে বাবার মন্ত্রে দীক্ষিত করে। শিগগিরই আবার আসবেন।

তাঁর নিজের জীবনের সব ভুলগুলোকে ফুল করে ফোটাতেই হবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *