কালো চিঠি

কালো চিঠি

হাওড়া থেকে বর্ধমান কর্ড লাইনে ছোট্ট একটা স্টেশন পড়ে, মধুসূদনপুর। খুবই অকিঞ্চিতকর অঞ্চল, আগে অজ পাড়াগাঁ-ই বলা চলত, এখানকার মানুষজন বেশিরভাগই চাষবাস করে জীবন কাটায়, বড়জোর দশ পনেরোজন ট্রেন ধরে চাকরি করতে যায় রোজ। তবে ইদানীং গ্লোবালাইজেশনের দৌলতে কোন গ্রামই তো আর সেই সবুজ শ্যামল জসীম উদ্দিনের কবিতায় পড়া গ্রাম টাইপের নেই, একটু হলেও শহুরে ছোঁয়া লেগেছে সব জায়গাতেই। মধুসূদনপুরেও তাই। এখানে ছেলেছোকরাদের হাতে এখন টুকটাক মোবাইল, ছোট্ট একফালি বাজারে আলু-পটল -ঝিঙের পাশেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে হাল আমলের কম্পিউটার গেমের দোকান। একটা সরকারি ব্যাঙ্কের ছোট ব্র্যাঞ্চও খুলেছে বাজার চত্বরে বেশ কয়েক মাস হল।

তো, এই বাজার চত্বরেই আমাদের দোলগোবিন্দবাবুর সিডির দোকান ‘ছবিঘর’। দোলগোবিন্দবাবু মধুসূদনপুরের বহুকালের বাসিন্দা নন, আগে থাকতেন এখান থেকে আরও কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে নবগ্রাম বলে একটা জায়গায়। ওখানে কি করতেন ঠিক জানা যায় না, তবে বিয়ে-থা করেননি, ঝাড়া হাত-পা মানুষ। বয়স পঞ্চাশের ওপারেই হবে, মোটাসোটা তেল চুকচুকে গড়ন। এই মধুসূদনপুরে ছিল ওনার মামার বাড়ি। মামা-মামি দুজনেই ছিলেন নিঃসন্তান, তাঁরা মারা যাওয়ার আগে তাঁদের সামান্য যেটুকু গচ্ছিত টাকা আর ছোট্ট একতলা বাড়িটা বছরকয়েক আগে তাঁদের একমাত্র ভাগনাকে দিয়ে যেতে নবগ্রামের মায়া কাটিয়ে দোলগোবিন্দবাবু এখানেই থিতু হয়েছেন। এখানকার মানুষজনের সাথে বিশেষ মেলামেশা করেননা বটে, তবে দশবছর আগে এই বাড়িতে জাঁকিয়ে বসে মামার জমানো টাকা দিয়ে যখন একদম বাজারের মুখে এই দোকানঘরটা ভাড়া নিয়ে দোলগোবিন্দবাবু সিনেমার সিডির দোকান করলেন, তখন অনেকেই তাঁর ব্যবসাবুদ্ধির প্রশংসা করেছিল।

মধুসূদনপুরে টিভির কেবিল কানেকশন থাকলেও তা একদমই পরিষ্কার নয়, আর বেশি চ্যানেলও আসে না। তাই দোলগোবিন্দবাবুর সিডির ব্যবসা হু-হু করে চলতে শুরু করেছিল। এখানকার মানুষজন বড় সরল, শহুরে প্যাঁচপোঁচ নেই বললেই চলে। সারাদিনের খাটুনির পর বাড়িতে এসে নিজেদের মনোমতো সিনেমা দেখার লোভে বেশ কয়েক মাস ধরে পয়সা জমিয়ে সিডি প্লেয়ার কিনে ফেলার লোক তাই ভালোই বাড়ছিল ক্রমাগত। তার ওপর বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষজন যাঁদের অবসর সময় কাটতেই চায় না, তাঁরা তাঁদের মনোমতো পুরনো আমলের কানন দেবী, প্রমথেশ বড়ুয়ার সিনেমার সিডি কিনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে মনের সুখে দেখতে শুরু করেছিলেন। দোলগোবিন্দবাবুও তাই সুযোগ বুঝে বাড়ির দোতলার গাঁথনি শুরু করে দিয়েছিলেন। সকাল থেকে সন্ধে দোকানেই কেটে যায়, তারপর বাড়ি ফিরে পুরনো দিনের সিনেমাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা, ব্যাস।

কিন্তু ‘ছবিঘর’-এর যেদিন বারোবছর পূর্ণ হল, জুলাই মাসের সেই বৃষ্টির দুপুরে দোলগোবিন্দবাবুকে দেখা গেল গোমড়া মুখে দোকানে তার চেয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, আকাশের কালো মেঘ মুহুর্মুহু গজরাচ্ছে। একটু আগেই দুপুরের খাওয়া শেষ করেছেন। আগে পাশেই একটা পাইস হোটেলে খাওয়াটা সেরে নিতেন, কিন্তু বছরপাঁচেক হল নতুন ছেলেটাকে রাখার পর সে-ই দুজনের জন্য বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসে।

 দোলগোবিন্দবাবু আনমনে তাঁর একমাত্র কর্মচারীর দিকে তাকালেন। রমেন একমনে কালকের নতুন স্টকের সিডিগুলো ক্যাটালগে লিখছে, একটা করে কপি কম্পিউটারে চালিয়ে টেস্ট করছে, আবার এনলিস্ট করছে। দোলগোবিন্দবাবু একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থেকে নিজের মনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নাহ ছেলেটা বড় ভালো। বয়স এখনো পঁচিশ পেরোয়নি। ওর মা দোলগোবিন্দবাবুর বাড়িতে কিছুকাল ঠিকে ঝির কাজ করত। মাঝে দোকানের বিক্রি এত বেড়ে গিয়েছিল যে দোলগোবিন্দবাবু একা মাল নিয়ে আসা আর দোকান চালানো একসাথে সামলাতে পারছিলেন না, তাই ওকে রেখেছেন। আর সত্যি বলতে কি, ছেলেটা এসে দোকানের কাজ করার ধরনটাই বদলে দিয়েছে। আগে দোলগোবিন্দবাবু ব্যবসা মানে বুঝতেন সাপ্লায়ারের কাছ থেকে সিডি আনা, সেগুলো পাইল আপ করে রেখে বিক্রি করা। কোনো কাস্টমার এসে সিডি খারাপের কমপ্লেন করলে মান্ধাতা যুগের সেকেন্ড হ্যান্ড সিডি প্লেয়ারটায় বড়জোর একবার চালিয়ে দেখা।

কিন্তু রমেন এসে বোঝাল ওইসব সাবেক আমলের দোকানদারি আর চলে না বাজারে। দোকানের গেট-আপ সুন্দর করতে হবে আর সব ধরনের কাস্টমারের পছন্দ অনুযায়ী সিডি আনাতে হবে, শুধু দোলগোবিন্দবাবুর নিজের বা কয়েকটা বুড়ো কাস্টোমারের মর্জিমাফিক নয়। তাই ইংলিশ, হিন্দি থেকে শুরু করে নতুন বাংলা সিনেমা, সব ধরনের ফিল্মের সিডি আনতে লাগল দোকানে। শুধু তাই নয়, সিডিগুলোকে এরকমভাবে ফেলে রাখলে হিসেবের গরমিল হতে পারে, তাই সেগুলোকে সময়মতো টেস্ট করে তার রেজিস্টার মেইন্টেন করাটাও রমেনই শুরু করেছে। বারো ক্লাস ফেল হলে কি হবে, ছেলেটার বুদ্ধি আছে আর কাজে উৎসাহও আছে খুব।

রমেন কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দোলগোবিন্দবাবু টেরই পাননি, হুঁশ ফিরল রমেনের কথায়, ”এরকম আনমনা হয়ে কি ভাবছ জ্যাঠা? কি হয়েছে?”

দোলগোবিন্দবাবু মৃদু মাথা নাড়লেন। কি আর বলবেন! ছেলেটা এত কাজ করেও যদি শোনে দোলগোবিন্দবাবু ওকে এই মাসটা গেলেই ছাড়িয়ে দেবেন, সে-ই বা কি ভাববে! কিন্তু দোলগোবিন্দবাবুরও তো আর কোনো উপায় নেই। একে তো সামনের ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে রমেনের উৎসাহে কম্পিউটার কিনলেন, দোকানটাকে একটু মাজাঘষা করলেন, তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে মধুসূদনপুরে হঠাৎ নতুন ইন্টারনেট কানেকশনের রমরমা। নাহ! রমেন ছেলেটা করিৎকর্মা হলেও দোকানের পক্ষে পয়া নয় মোটেই।

এতকাল এখানে কম্পিউটারের আগমন ঘটলেও ইন্টারনেট ছিল না, কারণ তিনটে গ্রাম পেরিয়ে যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, তাদের এতদূর নেট কানেকশন আসে না। কিন্তু ইদানীং ভোদাফোন, এয়ারটেলের হঠাৎ সস্তায় নেট কানেশনের অফার আসতে দোলগোবিন্দবাবুর দোকানের ব্যবসা সাঙ্ঘাতিকভাবে মার খেতে শুরু করেছে। মানুষজন যদি বাড়ি বসে পঞ্চাশ টাকা খরচ করে নেট প্যাক রিচার্জ করে অনলাইনে সিনেমা দেখতে পারে, তবে একটা সিনেমার সিডি তারা দোকান থেকে খরচ করে কিনবে কেন! গত দু-মাসে সর্বসাকুল্যে হাজার টাকারও বিক্রি হয়নি।

যুগের নিয়মেই একের পর এক জিনিস মার্কেট থেকে অবসোলেট হয়ে যায়, আগে ভিসিআর এর যুগ ছিল, তারপর এল সিডি। সেও শেষের পথে। দোলগোবিন্দবাবু একা মানুষ, দোকান না চললেও খুব একটা চিন্তা করতেন না, তাঁর একার ঠিকই চলে যাবে, কিন্তু ঝোঁকে পড়ে ব্যাঙ্কের যে লোনটা নিয়ে ফেলেছেন, সেটা শোধ করবেন কি করে এভাবে চললে! এর মধ্যেই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সুকুমারবাবু তিনদিন তাগাদা দিয়ে ফোন করেছেন। তাঁর নেওয়া লোন ওভারডিউ হয়ে গেছে বেশ কয়েকমাস হল। সে ম্যানেজারের আপন দাদা আবার পুলিশের নাকি দুঁদে বড়কর্তা, এসব ভেবে ভেবে রাতে আর ঘুম হয় না দোলগোবিন্দবাবুর।

দোলগোবিন্দবাবু ব্যাপারটা রমেনকে বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কাছাকাছি কড়কড়াৎ শব্দে কোথাও ভীষণ জোরে বাজ পড়ল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে দোলগোবিন্দবাবু দেখলেন তাঁর দোকানের সামনের রাস্তা দিয়ে বাজারের কিছু চেনা ছেলেপিলে বিপ্লব মজুমদারের বডি নিয়ে যাচ্ছে সৎকারের জন্য। বিপ্লব মজুমদার দোলগোবিন্দবাবুর প্রতিবেশী, আজ সকালেই মারা গেছেন। এতক্ষণ বাদে সব মিটল বোধ হয়!

দোলগোবিন্দবাবু বল হরি, হরি বোল শুনতে শুনতে বিপ্লব মজুমদারের স্বর্গত আত্মার প্রতি কপালে হাত জড়ো করে নমস্কার করলেন। আহা, লোকটা অনেক টাকার ব্যবসা দিয়েছে তাঁকে! বুড়ো বয়সে কথা বলার লোক পেত না, বাড়ির লোক সিডি প্লেয়ারের সামনে বসিয়ে দিয়েছিল। টুকটুক করে লাঠি নিয়ে আসত দোকানে, আর হাজারো সিডি নিয়ে যেত! দোলগোবিন্দবাবু মুখে আফসোসের চুকচুক আওয়াজ করলেন। এই মন্দাতে এত ভালো কাস্টোমারটাও চলে গেল!

রমেনকে এই মন্দার ব্যাপারটা খুলে বলতেই হল। একটু আভাস তো আগে থেকে দিয়ে রাখতে হবে বেচারাকে, নাহলে মাসের শেষে দুম করে ছাঁটাই হলে আরও কষ্ট পাবে যে!

রমেন সব শুনেটুনে গালে হাত দিয়ে বসল, ”হুম, ব্যাপারটা আমিও লক্ষ করেছি বটে, বুঝলে জ্যাঠা! এই শালা ইন্টারনেটের জন্য কেউ আর সিডি কিনছেই না মাইরি!”

দোলগোবিন্দবাবু কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, ”তবে তুইই বল! তার ওপর আগে আমার মেন কাস্টোমার বেস বলতে ছিল এই তল্লাটের সব বুড়োগুলো। কেউ ইস্কুলের চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে, কেউ আবার পোস্ট অফিস। রোজ অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা সেল তো হতই ওদের দিয়ে। তা সেই বুড়োগুলোও লাইন দিয়ে সব মরতে লেগেছে, এগুলো সব আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত বুঝলি তো? নিজেরাও ওপরে যাবে, আমার দোকানটাকেও লাটে তুলবে!”

রমেন চিন্তান্বিত গলায় বলল, ”সেটাই তো! ছেলেছোকরাগুলো নেট থেকে সিনেমা দেখলেও বুড়োগুলো তো আর সেটা পারবে না! কিন্তু এ যেন একের পর এক মরছে!”

দোলগোবিন্দবাবু আরো উত্তেজিত হয়ে কি বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ রমেন হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, ”কিন্তু জ্যাঠা, তুমি কিন্তু এই মরে যাওয়া বুড়োগুলোর থেকেই প্রচুর টাকা ঝাড়তে পারো মাইরি!”

দোলগোবিন্দবাবু থমকে গেলেন। অন্যসময় হলে রমেনের এই কথায় কথায় মাইরি বলার বদভ্যাসটায় এক দাবড়া দিতেন, কিন্তু এখন বললেন, ”মানে! মরে গেছে, তার কাছ থেকে আবার কি করে টাকা পাবো! সে কি স্বর্গে গিয়ে সিনেমা দেখবে নাকি! কিসব আবোল-তাবোল বকছিস বল তো!”

ততক্ষণে রমেনের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে, ”আলবাত পাবে। তার বাড়ির লোকই দেবে! ভালো করে শোন জ্যাঠা, সলিড একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়!”

*

বর্ষাকালের সেই দুপুরে দোলগোবিন্দবাবু আর রমেনের কথোপকথনের পর প্রায় একবছর কেটে গেছে। দোলগোবিন্দবাবুর ব্যবসা যে আগের থেকে প্রায় চতুর্গুণ ফুলেফেঁপে উঠেছে, তা দোকানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। খদ্দেরের দেখা তেমন না মিললেও হাল ফ্যাশানের রট আয়রনের অফিস ফার্নিচার বসানো হয়েছে, তৈরি হয়েছে সিডি রাখার রকমারি তাক। দোলগোবিন্দবাবু এখন আর সামনের চেয়ারে বসেন না, তাঁর ছোট্ট প্রাইভেট কেবিন দোকানের ভেতরদিকটায়।

সামনে কর্পোরেট স্টাইলের ডেস্কে বসে রমেন, সামনের কম্পিউটারে সে সদাই ব্যস্ত। মডার্ন স্টাইলে ছবিঘরে এখন কম্পিউটারে জেনারেটেড ইনভয়েস আর ক্যাশমেমো দেওয়া হয়। এমনকি ওয়ার্যা র‌্যান্টি কার্ডও দেওয়া হয় প্রিন্টেড। রমেন হাতে লেখা বিল পছন্দ করে না। ওতে নাকি দোকানের মান থাকেনা। ব্যাঙ্কের সেই লোন কবেই শোধ হয়ে গেছে, বরং নতুন ওভারড্রাফট নিয়ে কেনা হয়েছে আরও দুটো কম্পিউটার।

ফেব্রুয়ারি মাস। হাল্কা শীতের পড়ন্ত দুপুরে দোলগোবিন্দবাবু তাঁর কেবিনে পুরনো একটা মুভিতে মগ্ন আর রমেন ঝড়ের গতিতে কম্পিউটারে টাইপ করছিল। সে ম্যানেজার হলেও ইচ্ছে করেই দোকানে আর কোনো কর্মচারী রাখেনি। শুধু কর্মঠ বলেই নয়, আরো একটা গূঢ় কারণ আছে।

পাশ থেকে চায়ের কাপে আলগা চুমুক দিয়ে রমেন চিঠি টাইপ করা শুরু করল,

প্রবাল সেনগুপ্ত,

৩৪, বসুনগর

হাওড়া।

মাননীয়া শ্রীমতী বীথি সেনগুপ্ত,

প্রথমেই জানাই আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত এইরকম অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, কিন্তু পেশাগত কারণেই আমরা অত্যন্ত নিরুপায়।

আপনার পরলোকগত স্বামীকে আমরা গত বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁর চাহিদামতো অসংখ্য ইরোটিক মুভির সিডি যথাযথভাবে বিক্রি করতে পেরে আমরা অত্যন্ত তৃপ্ত। উনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন ভদ্রলোক। গত ২৩ তারিখ উনি কিছু সিডি আমাদের দোকান থেকে কিনে নিয়ে যান, যেগুলোর দাম তিনি পরে মেটাবেন বলেছিলেন, সেই বিলটি আমাদের ইনভয়েস সহ আপনাকে এই চিঠির সঙ্গে আমরা পাঠাচ্ছি।

আপনাকে এটাও জানাতে চাই যে, এই ধরনের মুভির সিডিগুলি কিন্তু অত্যন্ত দুর্লভ আর অধিকাংশই ভারতে নিষিদ্ধ, তাই দুর্মূল্যও বটে। তাই আশা রাখি যথাযথ গোপনীয়তার সঙ্গেই আপনি আপনার স্বামীর এই বিশাল নিষিদ্ধ মুভির কালেকশনকে যত্নে রাখবেন। যাতে আমাদের পরবর্তী স্টেপ না নিতে হয় তাই আমাদের এই বিলটি আপনাকে যথাসম্ভব দ্রুত মিটিয়ে দেবার অনুরোধ জানাই। আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর সঙ্গে দেওয়া হল।

 মুভিগুলি হল :

 সেক্স মেশিন – ৫৬০ টাকা

 হার্ডকোর ন্যটি সিস্টার্স – ১২৫৪ টাকা

 পিজ্জা ডেলিভারি বয় – ৯৯৯ টাকা

 ব্যাড গার্লস – ৮২০ টাকা

 মোট — ১০৫২০ টাকা।।

 ধন্যবাদান্তে

 দোলগোবিন্দ বটব্যাল

 প্রোপ্রাইটর, ছবিঘর।

রমেশ টাইপ করা শেষ করে প্রিন্ট নিতে নিতে খেয়াল করল পাশে এসে দোলগোবিন্দবাবু কখন দাঁড়িয়েছেন।

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, ”হ্যাঁ রে, একে কি চিনিস তুই?”

রমেন তাচ্ছিল্যভরে খামে চিঠি মুড়তে মুড়তে বলল, ”ধুস! চেনা মালগুলোকে তো আগেই ঝেড়েমুছে সাফ করে নিয়েছি। নতুন আর পাবো কোথায়! আর এ তো কলকাতার দিকের মাল!”

দোলগোবিন্দবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ”সেকি! তবে ওর বর সত্যিই মরেছে কিনা জানলি কি করে! আর কলকাতা থেকে এতদুরে কিনতে আসবেই বা কেন সে!”

রমেন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”ওফ জ্যাঠা! অ্যাদ্দিনে এই চিনলে আমায়? এই বুড়োটা মুধুসূদনপুরে প্রায়ই তাস খেলতে আসতো। আরে ক্যুরিয়ার সার্ভিসের পল্টু আছে না? ওর সাথে সব ফিট করা আছে, বলিনি তোমায়? ওর নেটওয়ার্ক একদম সলিড! বাড়িতে কম্পিউটার করত, এমন বুড়ো আশপাশে মরলেই খবর দিয়ে যায়। আর দেবে নাই বা কেন, কম বখশিস দিই নাকি! আর তাছাড়া…!” রমেন মোবাইলে খুটখাট করতে করতে বলল, ”এ এমন কেস জ্যাঠা, বুড়োর বউ তো দূর, ছেলেপুলেরাও লজ্জায় কিস্যু করতে পারবে না, জানাজানি হবার ভয়ে, তাই সুড়সুড় করে বিল মিটিয়ে দেবে বুঝলে!’

দোলগোবিন্দবাবু নিশ্বাস ফেলেন। কথাটা ভুল কিছু নয়। এই কয়েক বছরের মধ্যে রমেন নয়নয় করে লাখপাঁচেক টাকা কামিয়ে ফেলেছে এই ধান্দা করে। শুরুটা করেছিলো বিপ্লব মজুমদারকে দিয়ে। বুড়োর নামে ৬০০০ টাকার ঐ সব সিনেমার বিল পাঠাতেই বুড়োর বড়ছেলে পরের দিনই বিগলিতভাবে দিয়ে গেল, সঙ্গে আবার পঞ্চাশ টাকা এক্সট্রা যাতে এই খবরটা পাঁচকান না হয়। বাবার বুড়োবয়সের কেচ্ছা কে-ই বা পাঁচকান করতে চায়! তারপর একে একে, নতুনপল্লির সাধন চক্কোত্তি, পূর্বপাড়ার বিশ্বেশ্বর সমাদ্দার, পারুল কাননের মাধব নন্দী সবার বাড়িতেই বিল গেল।

প্রথম প্রথম দোলগোবিন্দবাবু ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকলেও এখন বুঝেছেন যে, এ এমন একটা ব্যাপার যে স্ত্রী তো বুঝবেই না, আর ছেলেপুলেরা বুঝলেও লজ্জায় টুঁ শব্দটি না করে টাকা দিয়ে নিঃশব্দে কাজটা মিটিয়ে ফেলতে চাইবে, তাই জানাজানি হবারও কোনো ভয় নেই।

কিন্তু রমেন ব্যাটা ইদানীং বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। অচেনা অজানা সদ্য সদ্য মরে যাওয়া লোকজনের বাড়ি ব্লু ফিল্মের সিডির মোটা বিল পাঠিয়ে দিচ্ছে। দোলগোবিন্দবাবু মাথা নাড়েন, এত লোভ কি ভালো? কিন্তু রমেনের মতো তিনি নিজেও তো লোভ সংবরণ করতে পারছেন না। যেজন্য কাজটা শুরু, সে লোন কবেই চুকেবুকে গেছে, তবু নতুন জিনিসের আকর্ষণে আরও জড়িয়ে পড়ছেন ক্রমশ।

বীথি সেনগুপ্তর বাড়ি থেকে সেবার কড়কড়ে দশ হাজার টাকা লাভ হতে মনের আনন্দে দোলগোবিন্দবাবু রমেন আর ওর মা-কে নিয়ে দিনসাতেকের জন্য পুরী ঘুরে এলেন। নাহ, ক্যাপিটাল ভালোই জমেছে, এবার দোকানটাকে সত্যি সত্যি এক্সপ্যান্ড করতে হবে, ক-দিন ধরেই ভাবছেন, একটা জেরক্স মেশিন কিনবেন, তাতে আয় বাড়বে। আর এখন এরকমভাবে টাকা পাওয়ার পদ্ধতিটা খুব একটা খারাপও লাগে না দোলগোবিন্দবাবুর, কারুর ক্ষতি তো হচ্ছে না এতে!

পুরী থেকে ঘুরে আসার দু-দিন বাদে একদিন বিকেলবেলা দোলগোবিন্দবাবু সামনের ডেস্কে বসেছিলেন। রমেন আধঘণ্টার জন্য কোথায় বেরিয়েছে। দোলগোবিন্দবাবু অলসভঙ্গিতে আনন্দবাজার পড়ছিলেন। রমেনের মতো তাঁরও অভ্যেস হয়ে গেছে আগে ওবিচুয়ারির পেজ ওল্টানো, কোন মালদার পার্টি কোথায় মারা গেছে, সে সম্পর্কে ভালো খোঁজ পাওয়া যায়। শ্রাদ্ধশান্তির খবর পড়তে পড়তে আড়চোখে একবার বোল্ড ফ্রেন্ডশিপগুলোর দিকেও তাকাচ্ছিলেন। রমেনের আনা ওইসব সিডিতে যে বিদেশি মেয়েগুলোকে দেখেন, এরাও কি এমনই হবে? উত্তেজনায় দোলগোবিন্দবাবুর চোখ চকচক করে উঠল। টাকার তো অভাব নেই, একবার ট্রাই মারতে দোষ কি?

ঠিক এই সময় দোকানের দরজা খুলে ঢুকলেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। দোহারা পেটানো চেহারা অথচ একটা সৌম্য ভাব আছে, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। ইতস্ততভাবে বললেন, ”আচ্ছা, দোলগোবিন্দ বটব্যাল আছেন?”

দোলগোবিন্দবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ”হ্যাঁ আমিই, বলুন?”

ভদ্রলোক বললেন, ”আপনিই কি প্রোপ্রাইটর?”

ইতিমধ্যে রমেন কখন এসে পড়েছে, এহেন প্রশ্নে সে বেশ মেজাজ দেখিয়ে বলল, ”আরে কি দরকার বলুন না! কিসের সিডি কিনবেন বলুন?”

ভদ্রলোক ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, ”না, আমি কিছু কিনতে আসিনি। দোলগোবিন্দবাবু, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।”

রমেনকে তেমন পাত্তা না দেওয়ায় সে বোধ হয় আরও চটে গেল, বলল, ”আরে মশাই, আমি এই দোকানের ম্যানেজার। বলুন না কি দরকার!”

ভদ্রলোক এবার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, ”গতকাল আমরা আপনাদের এই বিলটা ক্যুরিয়ার মারফত পাই।”

রমেন একঝলক চোখ বুলিয়ে নিল। হুম, আশিস সরকার। মনে পড়েছে। একে সে আগের সপ্তাতেই চিঠি পাঠিয়েছিল। পল্টু কোত্থেকে খোঁজ পেয়েছিল কে জানে! যূর মনে পড়ছে বেলুড়ে বাড়ি। ও স্মার্টলি বলল, ”ওহ, হ্যাঁ বলুন। হ্যাঁ উনি মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগেই এসে ওই মুভিগুলো কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন সঙ্গে অত টাকা ছিল না তাই… আর আমাদের উনি অনেকদিনের কাস্টোমার তো তাই আমরা…!”

ভদ্রলোক এবার ভারি অবাক হয়ে বললেন, ”আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়! বাবা এদিকে কোনোদিনও আসেনইনি। আর এগুলো ওঁর পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।”

রমেন এবার মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে বলল, ”আরে মশাই, এসব ব্যানড পর্নোগ্রাফিক সিডি শুধু এতল্লাটে আমাদের দোকানেই পাওয়া যায়, অনেকেই লুকিয়ে চুরিয়ে কিনতে আসেন। আর আ-আপনার বাবা, মানে, ইয়ে কি বলে আশিসবাবু তো প্রায়ই আসতেন, সে কি আর আপনাদের বলেকয়ে আসবেন? অনেক দূর দূর থেকে আমাদের দোকানে কাস্টমার আসে, বুঝলেন? হে হে!”

ভদ্রলোক এবারও বেশ অবাক হয়েই বললেন, ”আপনারা অন্য কারুর সঙ্গে আমার বাবাকে গুলিয়ে ফেলছেন না তো? কারণ আমার বাবার পক্ষে এগুলো কেনা কোনোমতেই সম্ভব নয়!”

রমেন এবার খিঁচিয়ে উঠল, ”ধুর মশাই, ফালতু ক্যাঁচরা করছেন তো তখন থেকে! বলছি, আপনার বাবাই কিনেছেন!”

ভদ্রলোক এবার বাইরে কাউকে ডাকলেন, ”ভাই, ভেতরে আয়।”

পর্দা সরিয়ে যিনি ঢুকলেন, তাঁকে দেখে দোলগোবিন্দবাবু এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এখানকার ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সুকুমারবাবু।

সুকুমারবাবু বললেন, ”দোলগোবিন্দবাবু, আমি ইচ্ছে করেই ঢুকছিলাম না ভেতরে। ইনি আমার দাদা, লালবাজারে আছেন।”

দোলগোবিন্দবাবুর মুখটা ভয়ে এইটুকু হয়ে গেছে, তার মধ্যেই তুতলে কোনোমতে কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পুলিশ ভদ্রলোক তাঁকে থামিয়ে দিয়ে রমেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”এসব সিডি তো ব্যানড, সেজন্য তো আপনারা অ্যারেস্টেড হবেনই, আর দু-নম্বর হল, এগুলো কি শুধু অডিও পর্ণোগ্রাফি?”

রমেনের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে, তবু তার মধ্যেই ও শেষ খড়কুটো ধরার চেষ্টা করতে করতে বলল, ”কে-কেন স্যার?”

সুকুমারবাবুই দাদার হয়ে উত্তরটা দিলেন, ”কারণ আমার বাবা অন্ধ ছিলেন। প্রায় পনেরো বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওনার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়! তো তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে লুকিয়ে এই দোকান থেকে উনি ওগুলো নিয়ে যেতেন, কিন্তু উনি এই সিডিগুলো নিয়ে কি করবেন বলতে পারেন?”

তারও আধঘণ্টা বাদে যখন পুলিশের ভ্যানে দোলগোবিন্দবাবু আর রমেনকে তোলা হচ্ছিল, তখন রুমালে মুখ লুকোতে লুকোতে দোলগোবিন্দবাবু ভাবছিলেন, একেই বলে লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু! অন্যকে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়ে নিজেই ব্ল্যাকমেলড হয়ে গেলেন।

**********

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *