রাগিণীর রাগ

রাগিণীর রাগ

 দাদা হাসিমুখে বললেন, ”নমস্কার, ফিরে এলাম ব্রেকের পর, আপনারা দেখছেন ফ্লিপকার্ট প্রেজেন্টস দাদাগিরি সিজন সেভেন, এবার শুরু হবে আমাদের গুগলি রাউন্ড। প্রথমেই থাকছে হাওড়ার গুগলি।” সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত লাইট গিয়ে পড়ল হাওড়ার কন্টেন্সট্যান্টের দিকে।

জিনিয়া টিভির মধ্যে প্রায় ঢুকে পড়ে পারলে! সারাটাদিন কলেজ, তারপর সংসারে অক্লান্ত খাটুনির মাঝে ও হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে কখন রাতে এই দাদাগিরি দেখবে, বিশেষত গুগলি রাউন্ড। বস্তাপচা সিরিয়াল ওর কোনোদিনই ভাল লাগে না, স্কুলে পড়ার সময় খুব ভালো ক্যুইজ করত ও, সেই পুরনো নেশাটা ওকে আবার পেয়ে বসেছে। তার ওপর ছোটবেলা থেকেই ও দাদার অন্ধ ভক্ত। মুগ্ধ হয়ে ও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাবলীল অথচ আভিজাত্যে ভরা সঞ্চালনা দেখে। ও দাদাগিরির অডিশনেও যায় না, ফোনে উত্তর মেসেজও করে না কোনোদিন, তবু নিজেকে অদৃশ্যভাবে দাদাগিরির কোনো একটা সিটে বসিয়ে ফ্যালে, প্রতিযোগীদের আগেই উত্তর দিয়ে দিতে পারলে অদ্ভুত একটা আনন্দ হয় ওর। আর কি! জীবনের একঘেয়েমির মাঝে এটুকুই যা টাটকা বাতাস!

জিনিয়া রিমোটের ভল্যুমটা অনেকটা বাড়িয়ে দিল, একবার মনে হল ঘরে অরিন্দম ঘুমোচ্ছে, ওর ঘুম ভেঙে যেতে পারে, তাই চট করে গিয়ে দরজাটা ভালো করে টেনে দিয়ে এসে নড়েচড়ে বসল মাটিতে। কিন্তু হাওড়ার গুগলি ওর আর শোনা হল না। দুম করে লোডশেডিং হয়ে গেল।

অন্ধকারের মধ্যে প্রথমেই জিনিয়ার মনে হল হাতড়ে হাতড়ে সামনে থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভির পর্দায় ছুড়ে মারে! ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হল সবকিছু। ছোট থেকেই রেগে গেলে ওর জ্ঞান থাকে না। তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেলল ও। এখানে দিনের মধ্যে অন্তত চার ঘণ্টা কারেন্ট থাকে না। তার মধ্যেই জিনিয়া সব কাজ করে, কিন্তু কয়েকদিন ধরেই ঠিক এই সময়টায় যেন জিনিয়াকে শায়েস্তা করার জন্যই কারেন্ট চলে যাচ্ছে। ওর আর সহ্য হল না। দুম দুম করে গিয়ে পাশের ঘরে ঘুমন্ত অরিন্দমের পিঠে জোরে জোরে দুটো কিল বসিয়ে দিল।

অরিন্দম অঘোরে ঘুমচ্ছিল, হঠাৎ এরকম অযাচিত আক্রমণে ও ”কে কে!” করে উঠে বসল আর অন্ধকারে একদম হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

জিনিয়া চোখের জল মুছে চিৎকার করে বলল, ”খুব মজায় ঘুমোচ্ছ, না? তোমার কোনো মনুষ্যত্ব আছে? উফ বিয়ের আগে চিনতে আমি কি ভুল-ই না করেছিলাম! বেশ তো আমাকে বাড়ি থেকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে এসে এই গাড্ডায় ফেললে, আমার প্রতি কি তোমার কোনো কর্তব্যই নেই? তুমি কি মানুষ?”

এহেন উপর্যুপরি দোষারোপে কাঁচা ঘুম ভেঙে অরিন্দম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বাইরে থেকে জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে, তাতে ও লক্ষ করল কি জিনিয়ার কান্নাভেজা মুখ? মনে তো হয়, না! জিনিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে আবার চেঁচাল, ”হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন? মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুই যেন বুঝছ না! আমাকে তো বাড়ির বিনা পয়সার কাজের লোক বানিয়েই দিয়েছ, এখন কি মেরে ফেলে আমার বাবার থেকে টাকা আদায়ের ধান্দা তোমার? খুব শখ ছিল, না? বামন হয়ে চাঁদ ধরে ফেললে! তোমার মনে হয় না, আমি বিয়ের আগে কিভাবে মানুষ হয়েছি আর এখন কিভাবে কাটাচ্ছি? আমাদের বাড়িতে ঠিকে ঝি ছাড়াও দুটো কাজের লোক ছিল, কোনোদিন এক গ্লাস জল পর্যন্ত নিজে নিয়ে খাইনি আমি! গাড়ি ছাড়া এক পা চলতাম না। কি ছিল না আমার, রূপ, গুণ সব ছিল। আমার থেকে কত খারাপ দেখতে পড়াশুনোতেও লবডঙ্কা মনীষা কত ভালো বিয়ে করে বরের সাথে লন্ডন চলে গেল। আর আমি? বাবামা-কে দুঃখ দিয়ে তোমার সাথে পালিয়ে এসে ঘর মোছা, কাপড় কাচা থেকে শুরু করে তোমার এঁটো বাসন পর্যন্ত মাজছি, আর তার সাথে কলেজও করছি! তাই দেখে তোমার খুব আনন্দ, না?”

অরিন্দমের এতক্ষণে ঘুমের ঘোর পুরোটাই কেটে গেছে, ও বলল, ”তুমি তো সব জেনেই আমাকে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেছিলে জিনি! আমি তো তোমার কাছে কিছু লুকোইনি! আমি তো বলেছিলাম তুমি পারবে না, আমি সবে এই ছোট চাকরিটা পেয়েছি, গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে। কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। আমাকে আর একটু সময় দাও আমি একটু গুছিয়ে নিই……।”

জিনিয়া কেঁদে ফেলল, ”কত? আর কত সময় দেব তোমায়? সাতমাস তো হয়ে গেল। এই সাতমাসে আমার চেহারাটা কি হয়েছে তাকিয়ে দেখেছ একবারও? ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে যাও, ফেরো রাত্তির সাড়ে নটায়, খাবার মুখের সামনে ধরে দিই, খেয়ে ঘুমিয়ে পরো, আমার দিকে তাকাবার সময় হয় তোমার?”

অরিন্দম বুঝে উঠতে পারছিল না কিসের জন্য জিনিয়ার হঠাৎ এমন রাগ, তবু অপরাধীর গলায় বলল, ”সারাদিন ফ্যাক্টরিতে আগুনের সামনে ঘুরে ঘুরে লেবারগুলোকে কাজ করাতে হয় জিনি, একমুহূর্ত বসি না, এসে খুব ঘুম পেয়ে যায়! কিন্তু তোমারও সত্যি খাটনি হচ্ছে জিনি, সারাদিন কলেজ, তারপর আবার এসে এত পরিশ্রম! আচ্ছা আমি এবার থেকে এসে ভাত ডাল ফুটিয়ে নেব, তুমি বিশ্রাম নেবে।”

জিনিয়া আরো রেগে গেল, ”কেন? বিশাল মহানুভবতা দেখাচ্ছ বুঝি? তুমি রোজগার করবে, রান্না করবে আর আমি বসে বসে খাব? সেরকম বান্দা আমাকে পাওনি বুঝলে! জিনিয়া সেনগুপ্ত কারুর দয়ার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকে না! তোমার ধারণা আছে যে সারাদিনের ক্লান্তির পরে টিভিতে কোনো একটা প্রিয় প্রোগ্রাম দেখতে বসে লোডশেডিং হয়ে গেলে কেমন লাগে? ভেবে দেখেছ কোনোদিন? মনে হয়েছে কোনোদিনও ইনভার্টারটা লাগাই, কতবার বলেছি তোমায় গরমে আমার খুব কষ্ট হয়, দম আটকে আসে? পাত্তাই দাওনি, তুমি শুধু নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত!”

অরিন্দম এতক্ষণে ঝগড়ার উৎস বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। জিনিয়া এর আগেও অনেকবার বলেছে ইনভার্টার কিনতে, কিন্তু এখন কেনা অসম্ভব ওর পক্ষে। মাইনে পায় সাড়ে বারো হাজার টাকা, সেখান থেকে বাড়িতে পাঠাতে হয় চার হাজার টাকা, মেদিনীপুরের বাড়িতে মা আর ছোটভাইটা না হলে না খেয়েই মরে যাবে! বাকি টাকার মধ্যে তিন হাজার টাকা যায় বাড়ি ভাড়া, তাছাড়া গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি, জিনিয়ার পড়াশুনোর খরচা তো আছেই, বাকিটায় টেনেটুনে মাস চালাতে হয়। ইনভার্টার কেনা মানে প্রায় কুড়ি হাজার টাকার ধাক্কা, কোত্থেকে পাবে ও! এখনো দুটো বন্ধু দশ হাজার টাকা পায় ওর কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলল, ”জিনি তোমার এখন নিশ্চয়ই আফসোস হচ্ছে ঝোঁকের মাথায় আমাকে বিয়ে করে?”

জিনিয়া রাগে ফেটে পড়ল, জোরে জোরে মাটিতে পা ঠুকতে ঠুকতে বলল,”হ্যাঁ হচ্ছে! সারাক্ষণ হচ্ছে! তুমি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছ!” বলে ও দুমদাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

জিনিয়া প্রথমে ঘর থেকে বেরিয়ে কি করবে বুঝতে পারল না। এই ছোট্ট ঘুপচি ফ্ল্যাটটায় একটা মাত্র ঘর, এক চিলতে বারান্দা, তাতেও পা ফেলার জো নেই, বাড়িওয়ালার সব অকাজের জিনিসপত্রে ভর্তি! রাগ দেখিয়ে যাবেই বা কোথায়? রাতের খাওয়া আগেই মিটে গেছে, ও অন্ধকারে বারান্দায় গিয়ে ওই জঞ্জালের মধ্যেই বসে পড়ল। এখান থেকে আকাশ দেখা যায় না, চারপাশে শুধু ইমারৎ। জিনিয়া মশার কামড় খেতে খেতে দূরের বাড়িগুলো দেখতে লাগল। এতক্ষণ একনাগাড়ে অনেক কিছু বলে ফেলেছে ও মাথা গরম করে, এবার ওর অনুতাপ হতে লাগল। এইজন্যই অরিন্দম ওকে রাগিণী বলে ডাকে! কেন যে রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারে না ও! বেচারা অরিন্দমই বা কি করবে, জিনিয়াকে সুখী রাখার জন্য ও কত কষ্টই না করছে! জিনিয়া আজ অনেক কিছু আজেবাজে বলে ফেলল, অরিন্দম নাকি ওকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছে। কথাটা মনে হতেই জিনিয়ার মনটা মরমে মরে গেল। ছি ছি। ছোট থেকে এই মাথা গরম হলে আজেবাজে বলার রোগটা ওর আর গেল না। অরিন্দম কষ্টেসৃষ্টে টিউশনি করে কেমিস্ট্রিতে এম এসসি পড়ছিল, আর সাথে সাথে এদিক-ওদিক টুকটাক ফাংশনে সিন্থেসাইজার বাজাচ্ছিল। ছোট থেকে ও প্রথাগতভাবে কোথাও বাজানো শেখেনি, পাশের বাড়ির এক দাদা শিখত, সেই থেকে নাকি দেখে দেখে শেখা। কিন্তু ওর বাজানো দেখে কেউ তা বলবে না। ওর বাজনার অসাধারণ মূর্ছনাতেই প্রেমে পড়েছিল জিনিয়া, কলেজের ফেস্টে। সঙ্গীতের প্রতি ওর জন্মগত আকর্ষণ।

জিনিয়া পরে জানতে পেরেছিল সিন্থেসাইজারটা ওর নিজেরও নয়, সেই দাদারটা ভাড়া করা। ছোটখাটো কিছু ব্যান্ড ওকে বাজাতে ডাকত, প্রোগ্রাম পিছু টাকা দিত। তা থেকেও বেশ খুচখাচ রোজগার হত। জিনিয়ার বাড়ি থেকে হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক করে ফেলায় জিনিয়াই বলেছিল যে করে হোক বিয়ে করতে! অরিন্দম বরং নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল, ”জিনি, আমাকে আর দেড় বছর সময় দাও, এম এসসি-টা হয়ে গেলে কোথাও না কোথাও কেমিস্টের কাজ ঠিক জুটিয়ে নিতে পারব। এখন বিয়ে করলে আমরা অকুল পাথারে পড়ব, আমার বাড়ির কথাও তো ভাবতে হবে। ছোটোভাইটার পড়াশুনো আছে, মায়ের ওষুধ! তাছাড়া আমার খুব ইচ্ছা বাজানোটা ভালো করে শিখি।”

কিন্তু জিনিয়ার পক্ষে তখন দেড় বছর তো দূর, দেড় মাসও অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। একেই ওদের বাড়ির সোনার ব্যবসা, পড়াশুনোয় কারুরই তেমন আগ্রহ নেই। বাবার বন্ধু অতীশকাকুর ছেলের সাথে ছোট থেকেই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল। সেই ছেলে বিদেশ চলে যাবার আগে বিয়ে করে নিয়ে যেতে চাইছিল। জিনিয়া আকুল হয়ে বলেছিল, ”অরি, এখন বিয়ে না করলে আমরা আর কোনদিনও এক হতে পারব না!” অরিন্দম তখন শুধু জিনিয়ার জন্য মাঝ পথে এম এসসি-র পড়া ছেড়ে দিয়ে একটা পেস্টিসাইড কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসেবে ঢোকে। মন্দিরে গিয়ে বিয়ে, রেজিস্ট্রির পর এখানে এসে ঘর বাঁধা। ওর মেসের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি, আলমারি আর একটা খাট ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু জিনিয়াকে কলেজ ছাড়তে ও দেয়নি। বলেছিল, ”তুমি কিন্তু পড়বে জিনি। যত কষ্টই হোক আমাদের, তোমাকে বি এসসি-টা কমপ্লিট করতেই হবে।”

জিনিয়ার মনে হল একছুট্টে গিয়ে অরিন্দমকে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা চুমু খায়। জিনিয়ার জন্য ও পড়া ছেড়েছে, সবচেয়ে যেটা ভালোবাসত, সেই সিন্থেসাইজার বাজানো ছেড়েছে, তবু জিনিয়াকে পড়া ছাড়তে দেয়নি। পরক্ষণেই চিরাচরিত ইগো এসে বাধা দিল ওকে। ও কেন নিজে যাবে? ইস, ও কোনোদিন কারুর কাছে নত হয়নি। অরিন্দম নিশ্চয়ই প্রত্যেকবারের মতো এবারেও একটু বাদে এসে ওকে ঠিক ডেকে নিয়ে যাবে, গিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে আদর করবে। জিনিয়া ভাঙবে তবু মচকাবে না, মশার কামড় খেতে খেতে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল ও।

পরেরদিন সকালে জিনিয়ার যখন ঘুম ভাঙল, তখন রোদ বেশ চড়া করে উঠেছে। পাশের মিউনিসিপ্যালিটির কলে জল নিতে আসা মেয়েদের কোলাহলে ওর ঘুমটা ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসল। বিছানায় শুয়ে রয়েছে ও। তার মানে রাতে অরিন্দম ঠিক ওকে নিয়ে এসেছে ভেতরে! ইয়েস! ও জিতেছে! চটজলদি উঠে বাইরে এসেই দেখল আটটা বাজে। অরিন্দম নেই। অরিন্দম তো সাড়ে ছ-টার ট্রেনে বেরোয়, জিনিয়ার উঠতে এত লেট হয়ে গেল? কি খেয়ে গেল, টিফিন কি নিজেই করে নিয়ে গেল? ও ব্যস্তসমস্ত হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, টিফিন ক্যারিয়ারটা যেমন ঠিক তেমনই রয়েছে। কালরাতের পর এই রান্নাঘরে আর কোনো হাত পড়েনি বোঝা যাচ্ছে। ওর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আনমনে কলেজের জন্য রেডি হতে লাগল। ইশ, কাল ওরকম কেন বলল ও? অরিন্দম খুব রেগে গেছে তার মানে। ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনোদিনও ও দাদাগিরিই দেখবে না!

স্নান করে এসে জামা বার করতে গিয়ে আলমারিটা খুলতেই টুক করে ওর পায়ের সামনে কি একটা পড়ে গেল। নীচু হয়ে তুলতেই দেখল অরিন্দমের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সব কাগজপত্রের ফাইলটা। এটা তো অনেকটা ভেতরে ছিল, এত সামনে কি করে এল? খুঁতখুঁতে মনে জিনিয়া রেডি হতে লাগল। অরিন্দমের অ্যাকাউন্টের সব খুঁটিনাটিই ওর জানা, অরিন্দম ওর কাছে কিচ্ছু লুকোয়না। ব্যাঙ্কে মাত্র হাজার তিনেক টাকা পড়ে আছে, যেটা থেকে ও অল্প অল্প করে ও বন্ধুদের ধার মেটায়, আর একটা ছোট রেকারিং, সেটাও তো পাঁচ বছরের আগে ম্যাচিওরড হবে না। তাহলে কি এমন দরকার পড়ল হঠাৎ?

জিনিয়া কিছু খেতে পারল না। বেচারা কোন সকালে কিচ্ছু না খেয়ে চলে গেছে, আর ও খাবে, তাই হয় নাকি? ফোন করলো দু-বার, অরিন্দম তুলল না। ইহ, খুব রাগ বাবুর! আজ আসুক না বাড়ি, না খেয়ে বেরনোর মজা জিনিয়া দ্যাখাবে! রাগে গসগস করতে করতে ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে নীচে নামল ও। ওদের ফ্ল্যাটের নীচেই বাজার, সেখানে জমজম করছে দোকানপাট। স্টেশনারি থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রনিকস সব কিছুরই দোকান রয়েছে।

কিন্তু কলেজে গিয়ে ও আর থাকতে পারল না, পেট দাউদাউ করে জ্বলছে, খিদে সহ্য করতে ও কোনোকালেই পারে না। ক্যান্টিনে গিয়ে তিন-চার পিস ব্রেড অমলেট খেয়ে একটু শান্ত হল ও। ফোন অরিন্দম এখনো তুলছে না। সারাটা দিন কাউকে কিছু না বললেও মনটা ওর উচাটন হয়ে রইল। বিকেলের দিকে একটা ক্লাস বাকি থাকতেই ও বেরিয়ে পড়ল। মনটা একদম ভালো লাগছে না। বাড়ি গিয়ে যে করেই হোক অরিন্দমের ফ্যাক্টরিতে ফোন করে আচ্ছাসে ঝার দিতে হবে ওকে। তবেই মনটা শান্ত হবে।

স্টেশন থেকে নেমে ওদের ফ্ল্যাট মিনিটদশেকের হাঁটা পথ। এমনিই অন্যমনস্ক ছিল, তার ওপর ফ্ল্যাটে ঠিক ঢোকার আগেই যে বাম্পারটা সেটায় হোঁচট খেয়ে একদম চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল জিনিয়া। কোমরে জোর লেগেছে, মুখ বিকৃত করে উঠতে যেতেই ততক্ষণে আশপাশের দোকানের লোকেরা ছুটে এসেছে। মাত্র সাত মাস এখানে এলেও সবার সাথে ভালো মতো পরিচিতি হয়ে গেছে ওদের। মাসকাবারি থেকে টুকিটাকি সব এই বাজার থেকেই কেনে ওরা। মুদির দোকানের বটব্যাল জ্যেঠু ওকে তুলতে তুলতে বললেন, ”এই শীগগির কেউ জল নিয়ে এসো, পড়ে গেলে কি করে মা? কোথাও লাগেনি তো?”

মিনিটদশেক বাদে ওকে সবাই যখন ধরাধরি করে ওর ফ্ল্যাটে দিয়ে এল তখন ব্যথাটা একটু কমেছে। পাশেই অজয়দার মিষ্টির দোকান, তার ফ্রিজের বরফ দিয়ে দিয়ে আরাম হচ্ছে এখন অনেক। অজয়দার বউ বীথিদি বললেন, ”তাও কি ভাগ্যি! দিনের বেলা পড়েছে! এখন তো এমনিই রাত হলেই লোডশেডিং হচ্ছে, রাতে পড়ে গেলে কি কেলেংকারিই না হত!”

ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানের মালিক শঙ্করকাকু বললেন, ”সে তো ঠিকই। তবে আমাদের জামাই বড় ভালো। এই ক-মাস ধরে দেখছি তো, এত ভালো ছেলেটা! এই তো আজ সকালে আমার দোকানে এসে ইনভার্টারের জন্য অ্যাডভান্স করে গেল, বারবার বলছিল জিনিয়ার বড্ড কষ্ট হয় কাকু, বাচ্চা মেয়ে তো, অত গরম সহ্য করতে পারে না!”

জিনিয়া চমকে উঠল, বলল, ”মানে? টাকা কোথায় পেল?”

শঙ্করকাকু বললেন, ”কেন, আমাকে বলেই তড়িঘড়ি ব্যাঙ্কের দিকে চলে গেল তো, বলল কি রেকারিং আছে ওটা প্রি-ম্যাচিওর করে অর্ধেকটা এখন দেবে, বাকিটা মাসে মাসে দেবে। বলল আজ একটু দেরি করে কাজে যাবে। বড় ভালো কিন্তু ছেলেটা।”

জিনিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। দশ বছরের ওই রেকারিং উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরেই করেছিল অরিন্দম, ওর টিউশনির টাকা থেকে অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে, না খেয়ে, না ঘুরে প্রতিমাসে পাঁচশো টাকা করে ফেলত ওতে, এই সেদিনও বলছিল, উফ অর্ধেক তো হয়েই গেছে, আর পাঁচ বছর টেনে দিতে পারলেই আমার স্বপ্নের সিন্থেসাইজারটা কিনতে পারব জিনি, রোল্যান্ড কোম্পানির! সেটা ও ভাঙিয়ে ফেলল?

সবাই চলে যাওয়ার পরেও জিনিয়া ওর কান্না থামাতে পারছিল না। কাল রাতে কত কটু কথা বলেছে ও, আর অরিন্দম নিজের সবচেয়ে সাধের জিনিষ, যেটার জন্য ও দিন রাত না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, একটা মাত্র ছুটির দিনে ওই দাদার থেকে চেয়েচিন্তে এনে প্র্যাক্টিস করে, সেটা কেনাটাতেই জলাঞ্জলি দিল? এবার জিনিয়া কি করবে? ও তো জীবনে কোনোদিন কারুর কাছে স্যরি চায়নি!

অরিন্দম বাড়ি ফিরল অন্যদিনের তুলনায় আরো দেরি করে, দেরি করে যাওয়াটা ওভারটাইম করে পুষিয়ে দিতে হয়েছে ফ্যাক্টরিতে। জিনিয়া গম্ভীর মুখে দরজা খুলে দিল। আজ ওর মাথা কালকের থেকেও গরম। বাথরুমে হাত-মুখ ধুয়ে যখন ফ্রেশ হয়ে বসেছে অরিন্দম, তখন রান্নাঘর থেকে খুন্তিটা নিয়ে এসে অরিন্দমকে জোরে জোরে পেটাতে পেটাতে বলল, ”কি ভেবেছ কি তুমি? এত বড় সাহস তোমার, আমাকে না জানিয়ে রেকারিংটা ভাঙিয়ে ইনভার্টার কিনতে গেছ? তোমাকে আজ আমি পিটিয়েই মেরে ফেলব দাঁড়াও!”

অরিন্দম মার সামলাতে সামলাতে বলল, ”আরে, আরে আমি কি করব, তোমার গরমে কষ্ট হয়, দাদাগিরি দেখতে পারো না………।”

জিনিয়া ওর চুলের মুঠিটা ধরে চিৎকার করল, ”তাই বলে তোমাকে আমি বলেছি সিন্থেসাইজারের টাকাটা দিয়ে ইনভার্টার কিনতে?”

 অরিন্দম কাতর স্বরে বলল, ”জিনি, তোমাকে বিয়ে করেছি তো ভালোবেসে। আর ভালোবাসা মানে তো তোমাকে ভালোবাসা, নিজেকে তো নয়! তুমি কষ্টে থাকলে আমি তো আরও কষ্টে থাকব জিনি!”

জিনিয়া আর পারল না। খুন্তিটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অরিন্দমের মাথাটা বুকে চেপে ধরে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ”কাল সকালেই শঙ্করকাকুকে বারণ করে দিয়ে আসবে তুমি! আর যে টাকাটা তুলেছ সেটাকে আবার ব্যাঙ্কে রেখে আসবে।” তারপর অস্ফুটে বলল, ”আমার ইনভার্টার চাই না, আমার দাদাগিরিও চাই না, আমার সৌরভ গাঙ্গুলি চাই না, আমার কিচ্ছু চাই না! আমার এই তিল তিল করে গড়া সংসার আর ক্যাবলা অরিন্দমই ভালো!” পরক্ষণেই গলা চড়িয়ে বলল, ”আর কোনোদিনও যদি আমাকে না জিজ্ঞেস করে টাকা তোল, এই খুন্তি আমি তোমার পিঠে ভাঙব, মনে থাকে যেন!”

অরিন্দম এত পিটুনি খেয়েও বোকার মতো হাসছিল, বলল, ”যত রাগই সিন্থেসাইজারে বাজাই না কেন, আমার রাগিণীবউয়ের রাগে সব ভুলে যাই! খুব লেগেছে কিন্তু!” তারপর জড়িয়ে ধরল ওর রাগী বৌকে।

**********

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *