আচ্ছে দিন

আচ্ছে দিন

রাজন্যা অফিসে ঢুকলই কেমন পাঁচনগেলা মুখ করে, তারপর মুখটা একইরকম ভেবলে রেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল।

টেনশনে ওর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে।

অথচ নিয়মমতো আজ ওদের সবার সাপের পাঁচ পা দেখার কথা, আজ ডিপার্টমেন্টের কমিশনার সায়েব আসবেন না, বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মদিন, সেই উপলক্ষে মন্ত্রীর ডাকা একটা সভায় যাবেন, সঙ্গে ওনার হেড পিয়োন কাঠি চৌধুরীও যাবে।

বুড়ো চৌধুরী কিছুতেই ছুটি নেয় না, আর মাসছয়েক হয়তো বাকি রিটায়ারমেন্টের, চাকরি আছে সর্বসাকুল্যে একশো আশি দিন, আর ছুটি জমেছে ইএল, সিক লিভ, সব মিলিয়ে পাঁচশোরও বেশি। তবু কারুর সাধ্যি নেই তাকে ছুটি নিতে রাজি করানোর। বাড়ি থেকে বউও তাড়িয়ে দেয় বোধ হয়!

শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, ট্রেন ধর্মঘট, বাস ধর্মঘট, বুড়ো ঠিক তার ছাতা আর ভাঙা অ্যাটাচি নিয়ে হাজির হয়ে যাবে, আর কে পাঁচ মিনিট পরে ঢুকল, কে সাত মিনিট আগে বেরিয়ে গেল, এই নিয়ে চুকলি করবে কমিশনারের কাছে, সাধে কি আর ওর নাম কাঠি চৌধুরী! কাজ তো করেই না, তার উপর এইরকম কাঠিবাজি।

মানস রাজন্যাকে ঢুকতে দেখে বলল, ”আরিব্বাস! তুই এলি? আমি তো ভাবলাম সাড়ে এগারোটা বাজে, কাঠিও নেই, আজ বুঝি ডুব দিয়ে অরিন্দমের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে পড়বি!”

রাজন্যা গম্ভীরভাবে বলল, ”আমার বর তো আর এরকম সরকারি চাকরি করে না, আইটি-তে দুমদাম ছুটি পাওয়া যায় না, কাজেই আমি একা একা কোথায় ঘুরব, তাও আবার এই গরমে! অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলিস তুই!”

মানস ঠোঁট উল্টে বলল, ”পয়েন্ট!” তারপরই চোখ গোলগোল করে বলল, ”এই, ওই কেসটার কি খবর রে? মালটা তো একদম হাবুডুবু খাচ্ছে কুহেলির প্রেমে! আজকেই তো দেখা করার দিন, না? কি করবি কিছু ভেবেছিস?”

রাজন্যা কিছু বলার আগেই পাশ থেকে সুচরিতা এগিয়ে এল বেশ রসালো ভঙ্গিতে, ”হ্যাঁ, আমাকে আজ অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই বলেছে।”

রাজন্যা থম মেরে গেল, ”কি বলেছে?”

সুচরিতা মুখ চোখ নাচিয়ে বলল, ”বলছে ম্যাডাম, আমি না তিন-চার রাত ধরে ঘুমোতেই পারছি না, কি করি বলুন তো? আজ তো এক তারিখ, ও সত্যিই আসবে তো?” বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ল সুচরিতা, ”রাজন্যা, তুই যা শুরু করেছিস না! বেচারা দেবদাস না হয়ে যায়!”

তমাল ফুট কাটল, ”আজ থেকে জিএসটি-ও শুরু, অজয়ের ব্যাক টু সিঙ্গলহুডও শুরু! কি কো-ইনসিডেন্স মাইরি!” তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, ”শোন, আলতু ফালতু ঝেড়ে ফুটিয়ে দে। দেবদাস হয়ে থাকবে ক-দিন তারপর ভুলে যাবে।”

রাজন্যা হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না।

অথচ নাটের গুরু কিন্তু ও-ই।

রাজন্যা কি একটা বলতে যেতেই মানস চোখের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল।

অজয় ফাইলগুলো সাজিয়ে সবার টেবিলে রাখতে এসেছে। ছেলেটা ভারি ভালো, নতুন ঢুকেছে গ্রুপ ডি পিয়োন হিসেবে। সরকারি অফিস, এখানে কেউ কাউকে মানে না, পিয়োনদের মেজাজ শুনলে মনে হয় তারা অফিস এসে বুঝি কৃতার্থ করছে! সেখানে এই ছেলেটা এত কাজের, যে যা বলে, কখনো মুখে না নেই। কোনো কাজ পেন্ডিং রাখে না, ভাউচার বাঁধা থেকে শুরু করা, ফাইল সই করিয়ে ঠিকঠাক দপ্তরে পৌঁছনো, পোস্ট অফিসে যাওয়া সব করে একনিষ্ঠভাবে, বারবার গুঁতোতে হয় না। বয়স ত্রিশের নীচেই হবে, খিদিরপুরে বাড়ি। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো ছিল, সেখান থেকে চাকরি পেয়েছে। ওই পোস্টে ঢুকে বেশিরভাগই ভাবে বুঝি বিরাট হিল্লে হয়ে গেল জীবনে, কাজ করি না করি চাকরি তো আর যাবে না! প্রথম প্রথম ঠিক থাকলেও বুড়ো পিয়োনদের মগজ ধোলাইয়ে কয়েক মাসেই সব ক-টা এক গোয়ালের গোরু হয়ে যায়। বসে বসে খালি খৈনি চিবোবে আর মোবাইলে গান শুনবে, সিনেমা দেখবে। আর কাজ করতে বললেই ঝাঁঝিয়ে উঠবে।

কিন্তু এই ছেলেটা তেমন নয়। কাঠি আর যাই করুক, ওর মাথাটা খেতে পারেনি।

রাজন্যার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অজয় একগাল হাসল, ”গুড মর্নিং ম্যাডাম!”

রাজন্যা হাসল। পাশ থেকে মানস বলল, ”কি ব্যাপার বাওয়া অজয়! আগে তো রোজ একটাই জামা পরে আসতে, এখন দেখছি রোজ নতুন নতুন জামা! আজ আবার শার্ট ইন করে বেল্ট পরে এসেছ। হিরো হয়ে গেলে তো পুরো!”

সুচরিতা পাশ থেকে কপট রাগের ভঙ্গিতে টিপ্পনি কাটল, ”তুই থাম। ও যে অফিসে আসছে এ-ই অনেক। অন্য কেউ হলে মাথা ঠিক রাখতে পারত না। কি বলো অজয়? আর আজ তো সেই দিন!” বলতে বলতে সুচরিতা রাজন্যার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।

অজয় একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ”হ্যাঁ, ওইজন্যই নতুন জামা পরে এলাম। ও আসবে তো ম্যাডাম?”

”আলবাত আসবে! মোদির আচ্ছে দিনও আজ থেকে শুরু, তোমারও আচ্ছে দিন!” সুচরিতা হেসে বলল।

রাখি এসেছিল টেবিলে টেবিলে জল দিতে, সেও খুব মজা পেয়েছে কয়েকদিন ধরে গোটা ব্যাপারটায়। যদিও সে ভেতরের ব্যাপারটা জানে না।

রাজন্যার গা ঘেঁষে চুপিচুপি হাসল, ”অজয় দাদাবাবু নাকি একটা মেয়েকে ভালোবেসেছে খুব, সত্যি দিদি? কোথায় থাকে মেয়েটা?”

রাজন্যা ম্লান হাসল। রাখি মেয়েটা খুব ভালো। ওদের এই নতুন শিফট হওয়া অফিসে এখনো অবধি ক্যান্টিন নেই, তাই ওরা নিজেরাই সবাই মিলে রাখিকে রেখেছে রান্নাবান্না করে দেওয়ার জন্য। সবাই মিলে মাসের শেষে টাকা দেয় ওকে। কাঠি আর ওর চ্যালারা একটু আপত্তি তুলেছিল প্রথমে, ”মেয়েছেলে মানুষ, এতগুলো লোকের রান্নাবান্না, বাজার দোকান, পারে নাকি? লোক রাখা হোক তার চেয়ে!”

তাতে বাধা দিয়েছিল শম্ভুদা। বয়স্ক ক্লারিকাল স্টাফ শম্ভুদা, রিটায়ারমেন্টের আর বছরখানেক বাকি, সেই খুঁজে পেতে এনেছিল রাখিকে। বলেছিল, ”তোরা থাম দিকিনি! মেয়েটা ভদ্রঘরের, একটা ছোট ছেলে আছে, অভাবে লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করছে, এর চেয়ে না হয় এখানেই রান্নাবান্না করল!”

সত্যিই, মেয়েটার বয়স কুড়িও হবে না, প্রথম দিন এসেই ছলছল চোখে রাজন্যাকে বলেছিল, বিয়ের ছ-মাসের মধ্যেই ওর বরটা নাকি পার্টির গণ্ডগোলে খুন হয়েছিল। তারপর ছেলে হয়েছে, শ্বশুরবাড়িও জায়গা দেয়নি। বাধ্য হয়ে ওকেই কাজে বেরোতে হয়েছে। সেই ছেলে এখন তিন বছরের।

অন্য কেউ রাখির সঙ্গে দরকার ছাড়া তেমন কথা না বললেও রাজন্যার ভারি মায়া লেগেছিল রোগা পাতলা চেহারার ওই শ্যামলা নরম সরম মেয়েটাকে। কথা বলার সময় রাখির নাকের পাতলা টিকটিকে নথটাও দুলত কেমন তিরতির করে। রাজন্যা কাজের ফাঁকে গল্প করত, ওর ছেলেটার জন্যও জিনিস পাঠাত টুকটাক। ওর পুরনো স্মার্টফোনটাও রাখিকে দিয়ে দিয়েছে, ছেলের ছবি দেখে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই।

রাজন্যা কতবার জিগ্যেস করেছে, ”রাখি, তোমার বরের জন্য খুব কষ্ট হয়, বলো?”

রাখি প্রথমে চুপ করে থেকেছে, তারপর কাছে এসে বলেছে, ”সত্যি কথা বলবো দিদি?”

”হ্যাঁ, বলো?” রাজন্যা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল।

রাখি সরল সাদা হেসেছিল, ”একটুও কষ্ট হয় না গো দিদি! এত মারত না, পিঠের কালশিটে শুকোত না গো! এখন তো তবু খেটে খাচ্ছি। ছেলেটা মানুষ হোক এটাই শুধু চাই।”

রাজন্যার মন বেশ নরম, এসব শুনে ও রাখির হাতের ওপর হাত রেখেছিল, ”তুমি একটা বিয়ে করতে পারো তো রাখি! এইটুকু বয়স তোমার!”

রাখি হেসেছিল, ”কি যে বলেন দিদি! এ কি আর আপনাদের ভদ্দরঘর নাকি? ছেলে কোলে আমায় কে বিয়ে করবে? করলেও সেই মদোমাতাল বুড়ো, তখন সেই মার খেয়েই মরতে হবে।”

রাজন্যা শুনে আর কিছু বলতে পারেনি।

এখনো রাখির প্রশ্নের কোনো উত্তর ও দিতে পারল না।

একটা লিমিট পর্যন্ত ও-ও মজা নিচ্ছিল, কিন্তু কাল রাত থেকে মনে হচ্ছে, এসব না করলেই ভালো হত! বেচারাকে শুধু শুধু আশা দেখানোর কোনো মানে হয়?

না, ও খুব খারাপ করেছে কাজটা। অরিন্দম অবধি পুরোটা শুনে টুনে রেগে গিয়েছিল কাল রাতে, ”কি করলে তুমি এটা? ছি ছি! এটা তো এক ধরনের সাইবার ক্রাইম!”

রাজন্যা আমতা আমতা করেছিল, ”আরে সুচরিতারা এমন করল, আমিও বার খেয়ে …!”

অথচ শুরুটা কিন্তু ও এত ভেবেচিন্তে করেনি, কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় তা এখন বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিকড় চলে গেছে অনেক গভীরে।

রুবির একদম মোড়ে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের ইনকাম ট্যাক্স অফিসের ঝাঁ চকচকে নতুন এই অফিস। বছর কয়েক হল ডালহৌসি পাড়া থেকে আস্তে আস্তে এই নতুন কর্পোরেট ধাঁচের অফিসে কাজকর্ম গুটিয়ে আনা হচ্ছে। আগেকার দিনের মতো চেম্বার সিস্টেম উঠে গিয়ে মার্কিন স্টাইলে কিউবিকল প্যাটার্নে তৈরি করা হয়েছে নতুন বিল্ডিং এ। জিএসটি শুরু হতে চলেছে খুব শিগগিরই, সেই নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে রাজন্যাদের যেমন খাটনি যাচ্ছিলো, তেমনই সাধারণ মানুষের মনেও একটা কি হবে কি হবে ভাব তৈরি হয়েছে। গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স চালু হলে সেটা ভালো হবে, নাকি বুমেরাং হয়ে আরো বেশি করের বোঝা চাপবে তাই নিয়ে লোকজনের প্রশ্নের শেষ নেই।

শুধু রাজন্যা কেন, ওরা সবাই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। অফিসেও ইদানীং অনেকে এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, বাড়িতেও তাই। পাড়ার লোকেদের কাছে ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করে মানেই বেশ খাতিরের চোখে তাকায় সবাই। ফলে শনি রবিবারও শান্তি নেই, কেউ না কেউ ঠিক এসে হাজির, ”ভাবলাম আমাদের পাড়ার মেয়ে এতবড় চাকরি করতে আর একে তাকে জিজ্ঞেস করি কেন! রাজন্যা মা, বল তো, এই জিএসটি-টা কি? ইনকাম ট্যাক্স কি আরো বেড়ে যাবে নাকি রে? মোদি তো দেখছি আমাদের নিঃস্ব করে দেবে রে!”

উফ! বোঝাতে বোঝাতে পাগল হয়ে গেছে রাজন্যা, জিএসটি-তে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সগুলোকে সব অ্যাসেম্বল করে দেওয়া হচ্ছে, আর ইনকাম ট্যাক্স হল ডাইরেক্ট ট্যাক্স, একদম প্রত্যক্ষভাবে মানুষের থেকে নেওয়া হয়। সেখানে জিএসটি-র কোনো ভূমিকাই নেই।

কিন্তু কে শোনে কার কথা!

যত দিন এগিয়ে আসছে জিএসটি চালু হবার, তত বাড়িতে তো বটেই, অফিসেও আনাগোনা বাড়ছে লোকজনের। সবার মুখেই এক কথা, ”ইনকাম ট্যাক্স কি আরো বেড়ে যাবে?”

এই ব্যাপারেই সপ্তাখানেক আগে গল্পটা শুরু হয়েছিল বেশ অদ্ভুতভাবে। রোজকার মতো অফিস শুরু হয়েছিল, সেদিন কাজের বেশ একটু চাপই ছিল, বারোটা বাজতেই অজয় বেরিয়ে গিয়েছিল পোস্ট অফিসে। রোজই ওইসময় অফিসের নানারকম চিঠিপত্র পোস্ট করতে যায় ও, ফেরে প্রায় দেড়টা নাগাদ। রাজন্যা, মানস, সুচরিতা এরা সবাই এই ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর, ওরাও নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল সেদিন।

একটা মেয়ে এসেছিল, অন্য সবার মতোই প্রশ্ন করতে, কোথাও থেকে বোধ হয় শুধু অজয়ের নামটুকু জেনে এসেছিল, প্রথমেই এসে জিজ্ঞেস করেছিল, ”আচ্ছা, অজয়বাবু আছেন? ওনার সাথে একটু কথা ছিল।”

অজয়কেও যে কেউ বাবু বলে ডাকতে পারে, সেটা দেখতে ওরা সবাই মুখ তুলে তাকিয়েছিল। অবশ্য এই অফিসের পিয়োনরাও বাইরে এমন হাবভাব করে যেন তারা কোনো বড় অফিসার।

কিন্তু, অজয় তো তেমন নয়!

রাজন্যাই কথা শুরু করেছিল, ”তুমি … আপনি অজয়কে চেনেন?”

মেয়েটা মাথা নেড়েছিল, ”নানা, আমার মামার চায়ের দোকান আছে তো সামনে, ওখানে অজয়বাবু চা খেতে যান। মামাই একটু ওনার ফোন নম্বরটা নিতে পাঠাল, ওই কি ট্যাক্স চালু হচ্ছে, সেই ব্যাপারে জানতে চায়।”

ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে মেয়েটা চলে গিয়েছিল, কিন্তু ওইখান থেকেই শুরু হয়েছিল এই উটকো ঝামেলাটা।

একটু পরেই অজয় কাজ সেরে ফিরতে তমাল বেশ সিরিয়াস মুখে বলেছিল, ”অজয়, তোমাকে খুঁজতে একটা মেয়ে এসেছিল, বলছিল অজয়বাবুকে ভীষণ দরকার! খুব টেন্সড ছিল কিন্তু।”

অজয় খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল, ”মেয়ে? কে বলুন তো?”

”দ্যাখো, তোমার চেনা কেউ হয়তো!” তমাল একটা রহস্যময় ভঙ্গি করে রাজন্যার দিকে আঙুল দেখিয়েছিল, ”রাজন্যা ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করো। ও-ই কথা বলেছে।”

সেইসময় যে কি হল রাজন্যার, আগে থেকে প্ল্যান করে তমালদের ফাঁদে পা দিয়ে ও-ও অভিনয় শুরু করে ফেলল, ”হ্যাঁ গো, একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছিল তোমার সাথে।”

সেই শুরু, তারপর ফেসবুকে ফেক প্রোফাইল খোলা, তা থেকে অজয়ের ফোনে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অজয়ের সঙ্গে চ্যাট করতে শুরু করা, সব হয়েছে রাজন্যার ফোন থেকে। অজয় এমনিই অত ইন্টারনেটের কারিকুরি বোঝে না, একটা ফুলের ছবি দেওয়া প্রোফাইল থেকে রাজন্যা চ্যাট করতে শুরু করেছিল অজয়ের সাথে। কিছুটা অন্যদের উসকানিতে, কিছুটা নিজেও একটা মজা পাচ্ছিল।

সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড। রাজন্যা আড়চোখে দূরে অজয়কে দেখে নিয়েই একেকটা পিং করছে মেসেঞ্জারে, আর অজয়ের ফোনে টুং শব্দ হতেই সবাই ওকে আওয়াজ দিচ্ছে, ”জিও অজয়! দ্যাখো দ্যাখো এবার কি লিখল কুহেলী!”

প্রথম প্রথম অজয় বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু দিন দুয়েক বাদ থেকে অজয়ও বেশ সলজ্জ ভঙ্গিতে রেসপন্ড করা শুরু করল। রাজন্যা ওর কল্পনা মিলিয়ে মিশিয়ে আস্তে আস্তে তৈরি করছিল কুহেলী বলে একটা কলেজে পড়া মেয়েকে, যে কিনা অজয়কে রোজ অফিস আসতে দ্যাখে তার বাড়ির লুকনো বারান্দা থেকে, যে কিনা ভালোবেসে ফেলেছে অজয়কে কিন্তু সলজ্জ ভঙ্গিতে ঠিক প্রকাশ করে উঠতে পারছে না।

কত কি যে লিখত রাজন্যা! ”অজয় তুমি প্রাইভেটে পরীক্ষা দাও, তুমি আরো বড় চাকরি পাবে, এভাবে জীবন কাটিও না,” তারপর, ”অফিস থেকে বেরিয়েই ক্লাবে আড্ডা মারতে যাও কেন? পড়তে বসতে পারো না?” অজয়ের নিজের মুখ থেকেই শোনা কথাগুলোকে নিয়ে কি যে হাবিজাবি লিখে যেত রাজন্যা, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

একদিন অফিস থেকে বেরিয়েই রাজন্যা দেখল, অজয় লিখেছে, ”তুমি আমাকে এতটা ভালোবাসো, আমাকে সবসময় পড়তে বল, এদিকে আমি তো তোমাকে চিনিই না!”

ও তড়িঘড়ি লিখল, ”তুমি আমাকে খুব ভালো করে চেনো অজয়। আর আমি তোমাকে যে কতটা ভালোবাসে তুমি জানো না!”

একটু বিরতি, তারপরই দেখল, অজয়ের লেখা ফুটে উঠেছে স্ক্রিনে, ”তোমার সাথে কথা বলতে বলতে তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কাল আমি মা-কে তোমার কথা বলেও দিয়েছি। মা বলেছে এক তারিখ তুমি যখন অফিসে আসবে, তোমার যেন একটা ছবি তুলে নিয়ে যাই। আচ্ছা, তোমার নাম কি সত্যিই কুহেলী?”

রাজন্যা সেদিন আরো কিছুক্ষণ নিজের মনগড়া কথা লিখে তারপর থেমেছিল।

কিন্তু তারপরই ওর মনে একটা খারাপ লাগা শুরু হল। ছেলেটা সরল বিশ্বাসে ওর বাড়িতেও সব বলে দিয়েছে? এ বাবা! কিন্তু এর তো কোনো পরিণতি নেই! কি দরকার এরকমভাবে কষ্ট দিয়ে?

রাজন্যা একটু খোলামেলা স্বভাবের বলে অজয় ওকে পরের দিন এসে একটু লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে বলল, ”ম্যাডাম! কুহেলী বলে মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে। কি বলি বলুন তো!”

রাজন্যা তখনো মজা করে যাচ্ছিল, কপট সিরিয়াস স্বরে বলেছিল, ”সেকি গো অজয়!”

অজয় মাটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ”হ্যাঁ, দেখলাম না, চিনলাম না, এদিকে নাকি আমার জন্য পুজো দিতে যাচ্ছে কালীঘাটে! আমি তো হাঁ!”

”তারপর” রাজন্যা জিজ্ঞেস করেছিল।

”কি বলব বলুন তো! মেয়ের গলায় তো কোনোদিনও এসব শুনিনি! কীরকম একটা হচ্ছে এসব মেসেজ পড়ে!” অজয়কে খুব বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল, ”তবে আমি ওকে অফিসে আসতে বলেছি ম্যাডাম। আপনার সাথে আলাপ করিয়ে দেব। সারাদিন মেসেজ করে যাচ্ছে, কাজকর্ম সব মাথায় ওঠার জোগাড়! পাগলি একদম।” রাজন্যা আড় চোখে দেখল অজয় ওর ফোনের ওয়ালপেপার পালটে মেয়েটার ফেসবুক প্রোফাইলের ডাউনলোড করা ছবিটা সেট করেছে।

সুচরিতা পাশে এসে ফিসফিস করল, ”কি হাঁদা দ্যাখ, ওটা তো মনের ছবি সিরিয়ালের অ্যাকট্রেসটার ছবি, সেটাও জানে না। কি বোকা রে বাবা! ভাবছে কি সুন্দরীই না ওর ওই কুহেলী! হি হি! খুব প্রেম করার শখ!”

রাজন্যার আর ভালো লাগছিল না এই বেয়াড়া মজাটা।

রাখি এসে তার দু-দিন বাদে রাজন্যাকে দুঃখ করে বলল, ”অজয় দাদাবাবুর খাওয়া একদম কমে গেছে জানেন দিদি! আগে তিনবার ভাত নিত, এখন একবারও খায়না ঠিকমতো! মেয়েটা কবে আসবে বলুন তো!”

রাজন্যা বলেছিল, ”ওই যে, এক তারিখ!”

আজ সেই কালান্তক এক তারিখ। সকালে উঠে থেকে মেসেঞ্জারে অজয়ের এত মেসেজ পেয়েছে যে অরিন্দম পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে গেছে, ”কি করছ বলো তো! আমাকে তো ভুলেও একটা মেসেজ করো না, আর কোথাকার একটা ছেলের সাথে দিনরাত …!”

রাজন্যা রাগেনি, একটু ভয়ে ভয়ে বলেছিল, ”আমি খুব চাপে আছি গো! আজ তো কেউই আসবে না, ছেলেটা দুঃখ পাবে না?”

অরিন্দম ডিমের কুসুমটা একবারে মুখে পুরে বলেছিল, ”তোমার তো এইরকমই কার্যকলাপ! লোকেও নাচায়, তুমিও নাচো! এখন কেউ যদি ওর কানে কথাটা তুলে দেয়, যে কুহেলী সেজে তুমিই ওইসব করছিলে, ওর কাছে তোমার প্রেস্টিজটা কোথায় যাবে ভেবেছ?”

রাজন্যা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল, ”তবে কি আজ অফিস যাবো না?”

”অফিস না গেলে তো আরোই ফাঁস হয়ে যাওয়ার চান্স! তোমাকে সবাই বলির পাঁঠা করে, আর তুমিও তাই হও। কাজ তো কিছুই নেই, তাই এইসব অপকর্ম করে চলেছ। আমাদের মতো হলে বুঝতে! জল খাওয়ার টাইম পাই না তো এইসব কাজ!”

রাজন্যা বসে আছে গুম হয়ে। অজয়কে তখন ঝোঁকের বশে লিখে ফেলেছিল এক তারিখ ঠিক দুপুর বারোটায় যাবো। ঘড়ির কাঁটা এখন দেড়টা ছুঁই ছুঁই। অজয় আজ দেরি করে বেরল, বেচারার মুখটা কেমন ম্লান হয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে।

যাওয়ার আগে রাজন্যাকে বলে গেল, ”কোথাও আটকে পড়ল কিনা কে জানে! ফোন নম্বরও তো দেয়নি। আপনি এলে একটু বসতে বলবেন ম্যাডাম!”

রাজন্যার তখন এত খারাপ লাগছিল বলার নেই।

অজয় পোস্ট অফিস গেছে ঠিকই, কিন্তু বারবার মেসেজ করে যাচ্ছে, তুমি এলে না কেন? কখন আসবে? প্লিজ এসো, অমুক তমুক …!

সবাই এদিকে অলস ভঙ্গিতে কাজ গোটাতে ব্যস্ত। সব ক-টা দুটোর পরই কেটে পড়বে, কেউ বৌয়ের সাথে সিনেমায়, কেউ আবার বন্ধুবান্ধব মিলে চলে যাবে অ্যাকোয়াটিকা। তমালের তো আর পনেরো দিন বাদেই বিয়ে, বাছাধন আজই সেরে ফেলবে প্রি-ওয়েডিং ফটোশ্যুট, ওর হবু বৌ ঝিমলির নাকি আর তর সইছে না! আর সুচরিতা তো কেয়া শেঠের কি প্যাকেজ বুক করে ফেলেছে।

ও মাথার রগদুটো টিপে বসে রইল কিছুক্ষণ, অরিন্দম ঠিকই বলেছে, সবাই এখন মজা মারছে, আর ও মাঝখান থেকে মরছে।

একমুহূর্ত চুপ করে বসে রইল ও, তারপর একটা লম্বা মেসেজ টাইপ করতে লাগল অজয়কে, ”আমি যাব না অজয়। আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম। আমার নাম কুহেলী নয়। আমি দেখতেও অত সুন্দর নই। তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।”

মেসেজটা পাঠাবার সাথে সাথে বন্যার স্রোতের মতো মেসেজ ঢুকতে লাগল, ”প্লিজ এমন করো না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি যেমনই হও, যেই হও, আমি তোমাকেই চাই। প্লিজ তুমি এসো আজ! আমি ঠিক আড়াইটের সময় অফিসে ঢুকব। আমাদের সামনের লবির বাঁদিকে যে জলের কলগুলো আছে, সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকব আমি, যদি তুমি না আস, বুঝব আমাকে বলা সব কথাগুলো তোমার মিথ্যে, আমাকে বড় হতে বলা, আমাকে ভালো মানুষ হতে বলা সব মিথ্যে!”

রাজন্যা একটা ঢোঁক গিলল।

ওদিকে ঝড়ের বেগে অজয়ের মেসেজ ঢুকছে, ”তুমি কি ভাবো আমার কোনো খারাপ নেই? সব মানুষেরই ভালো মন্দ থাকে। তোমার ভালো খারাপ সবটুকু নিয়েই আমি তোমায় চাই।”

অজয় ঢুকল প্রায় দুটো বেজে দশ মিনিটে, চুল উশকো-খুসকো, ততক্ষণে অফিস প্রায় ফাঁকা। ও পড়িমড়ি করে গিয়ে ক্যান্টিনে দু-মুঠো খেয়ে এসেই রাজন্যার কাছে এল, ”ম্যাডাম, ও কেন বুঝতে পারছে না যে আমি ওকে খুব ভালোবাসি! ও যেমনই হোক, ওর সবসময় আমার খেয়াল রেখে বলা কথা, আমাকে উৎসাহ দেওয়া, আমি যে এইগুলোকেই ভালোবাসি ম্যাডাম! এই প্রথম জীবনে কাউকে এতটা ভালোবাসলাম, তাও না দেখে!”

রাজন্যা কি বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অজয় বলল, ”আমি একটু বাইরেটা আছি ম্যাডাম। কোনো দরকার লাগলে বারান্দা থেকে হাঁক দেবেন, চলে আসব।” বলেই ও আর দাঁড়াল না।

রাজন্যা পুরো ডিপার্টমেন্টে একা বসেছিল। বেরিয়ে যেতেও ইচ্ছে করছিল না ওর। পুরো মেজাজটাই তেতো লাগছিল।

ঘড়িতে এখন ঠিক আড়াইটে।

ও অজয়কে ”আসব না” জানিয়ে মেসেজ করতে গিয়ে অলস কণ্ঠে হাঁক দিল, ”রাখি! একটু জলটা ভরে দাও তো আমার!”

কোনো সাড়া পেল না।

হঠাৎ ওর মনে হল, রাখি তো এইসময়েই বাইরের কলে বাসনগুলো ধুতে যায়!

কি সাংঘাতিক!

বিদ্যুৎগতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে বারান্দার দিকে উঁকি মারল রাজন্যা।

যা ভেবেছে ঠিক তাই!

অজয় রাখিকে কুহেলী ভেবে ভুল করেছে। রাখি বাসনগুলো ধুচ্ছে, আর অজয় ওর সামনে এসে কিসব বলছে।

রুদ্ধশ্বাসে দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটল রাজন্যা ওদিকে, চেঁচিয়ে বলতে গেল, ”অজয়, তুমি ভুল করছ! ও কুহেলী নয়, কুহেলী বলে কেউ নেই, আমরা মজা করেছিলাম!”

কিন্তু তার আগেই ও শুনল অজয় রাখিকে বলছে, ”রাখি, তুমি!”

রাখি তাকাল অজয়ের দিকে।

অজয় বলল, ”বুঝেছি, তুমি ভাবছিলে তুমিই কুহেলী এটা জানতে পারলে আমি তোমায় ভালোবাসব না? তোমার ছেলে আছে বলে?”

রাজন্যা হতভম্ব হয়ে গেল।

রাখি শুধু বলতে গেল, ”আপনি কি বলছেন আমি …!”

অজয় রাখিকে কোনো কথাই বলতে দিল না, এগিয়ে এসে রাখির হাতদুটো জড়িয়ে ধরল, ”আমি ওরকম মানুষ নই। আমি তোমাকে এই কয়েকদিনে খুব ভালোবেসে ফেলেছি, তোমার সুন্দর মনটাকে। আর তোমার হাতের রান্নার তো আমি এমনিই ভক্ত।”

রাখি অবাক হয়ে গেল, ”আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আমার যে …!”

অজয় মাঝপথেই বলল, ”আমাকে বিয়ে করবে রাখি?”

রাজন্যা হাঁ করে তাকিয়েছিল সামনের দিকে। ওর পা আর সরছিল না।

এত ভালো কিছু শেষ হতে পারে?

টুং করে ওর ফোনে একটা হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরতে থাকা একটা জোক ঢুকে ওর ঝটকাটা ভাঙিয়ে দিল, ”জিএসটি মানে গুড ডে, সুইট রিলেশনশিপ অ্যান্ড ট্রু লাভ! আচ্ছে দিন আ গয়া মিত্রো!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *