আমাকে মোটা বোলো না

আমাকে মোটা বোলো না

রবিবারের সকালবেলা। রোজকার মতো তড়িঘড়ি উঠে স্নান করতে যাওয়ার তাড়া নেই, কোনোমতে অর্ধেক গিলে অর্ধেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে খেয়ে ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরতে যাওয়া নেই, এমনকি বালি থেকে বিচ্ছিরি ভিড় হওয়া বাসে করে লেডিজ সিটের সামনে চাতক পাখির মতো কে কখন কোন স্টপেজে নামতে পারে, সেই আন্দাজ করতে করতে ঝাঁকুনির গুঁতো খাওয়াও নেই।

কিছু কিছু মানুষজন আবার আছে, যাদের আবার কোথায় নামবেন জিজ্ঞেস করলে এমন চোখ ঘুরিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়, মনে হয় যেন তার এটিএম এর পিন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। এই সব আত্মসর্বস্ব পাবলিকগুলোকে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায় সানাইয়ের। কালকেই তো, লেডিজ সিটের মেয়েগুলো অনেক দূরে নামবে দেখে পেছনের একটা ভোঁদা টাইপ ছেলেকে জানতে চেয়েছিল, ”কোথায় নামবেন?” ওমা, কোথায় এককথায় উত্তর দেবে তা নয়, ছেলেটা কান থেকে হেডফোন খুলে ওর দিকে কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকল, তারপর ভ্রুটাকে প্রায় ইঞ্চিখানেক তুলে চোখ কুঁচকে ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ”কেন বলুন তো?”

রাগে গা রি-রি করে উঠেছে সানাইয়ের। একে তো সভ্যতা ভদ্রতা কিছুই জানে না এখনকার ছেলেপুলেগুলো, মেয়ে দেখলে উঠে বসতে দেওয়ার ভদ্রতা লুপ্তপ্রায়, অবশ্য সানাই সেটা চায়ও না, জেন্ডার ইকুয়ালিটির যুগে মেয়েরাই বা অ্যাডভান্টেজ নেবে কেন! কিন্তু তবু, একবার অফারও তো করা যেতে পারে! তাও করে না কেউ। তার ওপর এইরকম বেয়াড়া রিপ্লাই। সানাইও ছাড়ার পাত্রী নয় মোটেই, ভ্রুদুটোকে দ্বিগুণ উপরে তুলে ও একটু তির্যকভাবে শুনিয়ে দিয়েছিল, ”কেন আবার? আপনি উঠলে বসব তাই! যদি বলেন কাছে নামবেন তাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব, আর দূরে হলে অন্য সিটগুলোয় ট্রাই মারব। এমনভাবে জিগ্যেস করছেন যেন মনে হচ্ছে আপনার সাথে আপনার বাড়ি চলে যাবো আমি। কোত্থেকে যে এসব পাবলিক আসে, সত্যি!” শেষ কথাগুলো বলেছিল বেশ ঝালঝাল করে শ্লেষ মাখিয়ে, গলা চড়িয়ে, যাতে আশপাশ থেকে আরো ক-জন দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা সমর্থন জানিয়েছিলেন ওকে।

কি আশ্চর্য, ছেলেটা তাতেও থামেনি, উল্টে কিরকম বিচ্ছিরি একটা বিদ্রূপের গলায় চোখদুটোকে বড় বড় করে ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বলেছিল, ”বলা যায় না, চলে যাওয়ার প্ল্যান করতেও পারেন আমার বাড়ি!”

মনে পড়তেই ঠাস করে একটা চড় কষাতে ইচ্ছে হল সানাইয়ের। বলেও ছিল চেঁচিয়ে ও, ”ভদ্রভাবে কথা বলুন। এইসব অসভ্য ছেলেদের টেনে থাপ্পড় মারা উচিত!”

নেহাত ছেলেটা নেমে গেল তাই, নাহলে হাতাহাতি করেই ছাড়তো ও। অভদ্র বাঁদরের দল সব!

হাতদুটোকে পেছনে ঘুরিয়ে নিজেকে বিছানার উল্টোদিকের আয়নায় দেখতে দেখতে আড়মোড়া ভাঙল সানাই। গরমকাল এসে গেলেও পরপর দুদিন বৃষ্টি হওয়াতে বেশ একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আছে। তবু মনটা ভালো লাগছে না ওর একটুও। যবে থেকে এই বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু হয়েছে তবে থেকেই ওর মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে। না হয় ও প্রেম করে কাউকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি, তাই বলে কি এরকমভাবে জীবনসঙ্গী ঠিক করতে হবে নাকি। দু-দিনের আলাপে কতই বা চেনা যায়, বোঝা যায়? এখন আবার নতুন ফ্যাশন হয়েছে, হচ্ছে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, এদিকে বিয়ের আগে বছরখানেক ঘুরে টুরে একে অন্যকে জেনে চিনে নাও। আরে, যাকে বিয়ে করতেই হবে, তার সাথে ঘুরে টুরে যদি মনেও হয়, পোষাচ্ছে না, ক্যানসেল করতে চাইলে তেমন কেউ শুনবে কি? তখন বাবামা-ই বলবে, এমা সবাই জেনে গেছে, একটু মানিয়ে গুছিয়ে নে। তবে আর কি পার্থক্য রইলো আগেকার দিনের সঙ্গে? তবু কাউকে বোঝাতে পারে না সানাই।

মা তো বললেই বলবে, একেই তোর চেহারাটা একটু ভালোর দিকে, লোকে এখন রোগা মেয়ে বেশি পছন্দ করছে, এখন থেকে দেখাশোনা শুরু না করলে পরে বয়স বেড়ে গেলে দেখবি ভালো কাউকে পাচ্ছিস না, আফসোস করবি তখন।

এসব শুনলেই আরো রাগ উঠে যায় সানাইয়ের। সোজা কথা সোজা করেই বলো না বাপু, এত ঘোরপ্যাঁচ কিসের? সানাইয়ের চেহারা মোটেই শুধু ভালো নয়, ও খুবই মোটা। আগের মাসেই ওজন করিয়েছে, পঁচানব্বই কিলো থেকে কমেনি এক কেজিও। মরুক গে! ও কমাতেও চায় না। হ্যাঁ, ওর যদি এই ওজন নিয়ে চলতে-ফিরতে কোনো সমস্যা হত, হাঁটুতে ব্যথা, কি থাইরয়েড এইসব উপসর্গ থাকত, ও ভেবে দেখত। রীতিমতো সুস্থ সবল ফিট ও, আচ্ছা আচ্ছা রোগা মেয়েকে ওভারটেক করে ছুটে গিয়ে বাস ধরতে পারে সানাই, অফিসের প্রতিটা স্পোর্টস ইভেন্টে সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রাইজ পায়, তবু ও এই ওজন নিয়ে বদারড হবে কেন?

কিন্তু মুশকিল হল আমাদের সমাজ সব কিছুরই একটা করে মাপকাঠি বেঁধে দিয়েছে, বেশি রোগা চলবে না, বেশি মোটা চলবে না, বেশি ঘরকুনো ভিতু চলবে না, বেশি বারমুখোও চলবে না, প্রগলভতা বিচ্ছিরি, এদিকে কথা কম বলাও অসামাজিক। কাজেই এতরকম সোশ্যাল ট্যাবু দিয়ে বিচার করতে মানুষজন অভ্যস্ত, তারা লজিকের ধার ধারে না। নাহলে সানাইয়ের মতো মেয়ের কখনো চারমাস ধরে টাকা দিয়ে শাদি ডট কমে প্রোফাইল খুলে রেখেও বিয়ের ঠিক হয় না?

হতে পারে সানাই মোটা, তবু কম সুন্দরী নাকি? হোক না গায়ের রঙ একটু ময়লা, সুন্দর মুখশ্রীর কোনো দাম নেই নাকি? যত মোটা হচ্ছে, ওর স্কিনের গ্ল্যামার যেন উপছে পড়ছে, বসলে যেন মাছিও পিছলে যাবে। তার ওপর এত সুন্দর লম্বা ঘন চুল, নলেন গুড়ের রসগোল্লার মতো গোল ভরাট মুখ, ঘুমচোখে নিজেকে আয়নায় দেখতে দেখতে নিজের সৌন্দর্যে নিজেই মোহিত হয়ে যায় সানাই। সাধে কি ফাইনাল ইয়ারে পড়তে নামকরা একটা ফ্যাশন ব্র্যান্ড থেকে প্লাস সাইজের জন্য মডেলিং করার অফার এসেছিল? করল না নেহাত ওর ওসব ভালো লাগে না তাই, কিন্তু পেয়েছিল তো? তার ওপর এত ভালো চাকরি করে সানাই, সঙ্গে আঁকার হাতও ওর দারুণ। এই তো গেল মাসেই ওর একটা আঁকা প্রাইজ পেয়েছে বিদেশের একটা কনটেস্টে। চাকরি সামলেও এসব চালিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?

কিন্তু এইসব কথা ছেলের মায়েদের চোখে পড়ে না। কালো আর মোটা দেখেই কেউকেউ এমন হাবভাব করে যেন এইডসের জীবাণু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সানাই। আরে ছবি দেখেই তো এসেছিস বাপু, গাণ্ডেপিণ্ডে গিলেও যাচ্ছিস, তবে এসব ন্যাকামি কেন? আর দেখলিই যখন পরিষ্কার ‘না’ বলে দিয়ে যা, তা না করে বাবামা-কে হ্যাঁ না-এর মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখাই বা কেন? অসহ্যকর সব জিনিসপত্র! রোববার এলেই এখন মেজাজ খিঁচড়ে যায় তাই ওর। তবে এবার ও ঠিক করে নিয়েছে কিছুতেই আর বাবামায়ের কথা শুনবে না, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে।

মা কখন ঘরে ঢুকেছে খেয়াল করেনি ও, মা ব্যস্ত পায়ে এসে ওর স্তূপ করা জামাকাপড়গুলোকে একটা বাস্কেটে পুরছিল, আজ ওয়াশিং মেশিনে দেবে, ওকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে মা বলল, ”কিরে? ওঠ, আর দেরি করিস না। দই আর লেবুটা যদি চুলে মাখিস তো মেখে ফ্যাল, চুলটা বেশ ফোলে তাহলে, বেলা করে মাখলে আবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ছেলেটা ভারি ভালো, তোর ছবি দেখেই নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে তার। তার ওপর ফেসবুকে তোর আঁকাও দেখেছে নাকি। আমি একটা শাড়ি বেছে রেখেছি…।”

মায়ের কথা শেষ হল না, সানাই খিঁচিয়ে উঠল, ”আচ্ছা মা, তোমরা কি শুরু করেছ বলো তো? সারাটা সপ্তা অফিসে এত প্রেশার, তারপর একটা দিন একটু শান্তিতে রিল্যাক্সও করতে পারব না? প্রতিটা রোববার এই নাটক চলবে এখন? আমি কিছুতেই আজ বাড়ি থাকব না তুমি দ্যাখো! আমি এই উঠছি, রেডি হব, বেরিয়ে যাব, ফিরব সেই রাতে ন-টার পর।”

মা ওর হঠাৎ এমন বিদ্রোহে হকচকিয়ে গেল, ”ন-টার পর ফিরবি মানে? আর মিন্তিমাসির দেওরের শালারা যে আসবে আজ বিকেলে?”

সানাই দুমদাম করে উঠে বাথরুমে যেতে যেতে বলল, ”কোন শালা কার দেওরকে নিয়ে কোথায় আসবে তা নিয়ে আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি চুলে ডিম দই মাছ মাংস কিচ্ছু দেব না, আমি এই বেরিয়ে যাচ্ছি দ্যাখো! লাইফটা হেল হয়ে গেল আমার।”

বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ও দেখল মা পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে আনতে বাবাকে ডেকে এনেছে বাইরের ঘর থেকে। বাবা বলল, ”কি হয়েছে রে বুবু?”

সানাই মোটেই গলল না, এমনিতেই ওর গলার খুব জোর, একটু জোরে কথা বললেই আশপাশের একশো মিটারের মধ্যে সবাই শুনতে পায়, তবু ও যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, ”দ্যাখো বাবা, আমি তোমাদের পরিষ্কার বলছি, এই প্রতিটা রবিবার সেজেগুজে বসা, তারপর বোকা বোকা প্রশ্নের ন্যাকা ন্যাকা উত্তর দেওয়া, আমি আর পারছি না। আমি আজকেই কোনো মেসে চলে যাব।”

বাবা এবার আরো অবাক হয়ে বলল, ”কেন কি হয়েছেটা কি?”

সানাই এবার আরো রেগে গেল, ”কি হয়েছে বা কি হয়ে চলেছে সেটা তোমরা বুঝতে পারছ না? আমার কোনো সেলফ রেসপেক্ট নেই? আমিও একটা ছেলের মতো চাকরি করি, নরম্যাল খাইদাই বাথরুম যাই, তবে শুধুমাত্র মেয়ের বাবা-মা হওয়ার জন্য তোমরা সবসময় ইনফিরিয়র পজিশানে থাকবে আর ওরা ছেলের বাবা-মা বলে সুপিরিয়র হয়ে থাকবে কেন? আগের রোববার ওই মুশকো বৌটা কি বলছিল?” তারপর আগের রবিবারে দেখতে আসা পাত্রের মায়ের অনুকরণ করে ও বলতে লাগলো, ”আমরা খুব মডার্ন। ছেলের বৌ জিন্স পড়লেও কোনো আপত্তি নেই।” কথাগুলো বলেই ও ফেটে পড়ল রাগে, ”আরে ভাই, কে তোকে জানতে চেয়েছে তোর আপত্তি আছে কিনা? আমার শরীর, আমার জিন্স, আমি পরব না ছিঁড়ে ফেলব সেটা আমি বুঝব। কই তোমরা কাউকে বলো যে ছেলে জিন্স পড়লে আমাদের আপত্তি নেই? সেটা বলার প্রশ্নই আসে না, তাই না? কেন না ওরা ছেলের বাড়ি, না? এদিকে ছেলেমেয়ে নাকি এখন সমান। তবু এই বাইফারকেশন কেন?”

মা এবার রেগেমেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাবা থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, ”আচ্ছা বেশ, রাগারাগি করে তো কিছু লাভ নেই। তুই কি চাইছিস বল। তুই তো কাউকে নিজে থেকে পছন্দ করে রাখিসনি, তাই আমাদেরকে দ্যাখাশোনা করতেই হচ্ছিল। তা তুই কি বিয়ে করবি না?”

ঝগড়া করার সময় দু-পক্ষই গলা উঁচিয়ে ধারালো সংলাপ বললে অম্লান বদনে ঝগড়া চালিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু একপক্ষ ক্রমাগত শান্তভাবে কথা বলে চললে উত্তেজিত অন্যপক্ষের থতমত খেয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাবা প্রতিবার এই স্ট্র্যাটেজিটাই অত্যন্ত নিপুণভাবে খেলে ওকে হারিয়ে দেয়।

সানাই যথারীতি থমকে গেল, ”সেটা আমি একবারও বলিনি। কিন্তু আমার কিছু কন্ডিশন আছে।”

বাবা এবার বলল, ”বেশ তো। কি কন্ডিশন তোর বল?”

সানাই গলা ঝেড়ে বলল, ”আচ্ছা, ছেলের বাড়িতে গিয়ে তো আমাকে থাকতে হবে, তাই তো? ছেলেটা নিশ্চয়ই আমার বাড়ি এসে থাকবে না, রাইট?”

বাবা এবার বলল, ”হ্যাঁ, সেটাই তো কনভেনশন। চলে আসছে যুগযুগ ধরে।”

সানাই এবার বলল, ”দ্যাখো বাবা, যুগযুগের কথা বোলো না প্লিজ, যুগে যুগে মানুষ পালটায়, কাজেই নিয়মগুলোকেও পালটানো উচিত। আগে মেয়েরা কিছু করতো না, তাদের নিজস্ব কোনো আইডেন্টিটি ছিল না, কাজেই বাবার পরিচয়ে, স্বামীর পরিচয়ে তাদের বাঁচতে হত। কিন্তু এখন আর তা নেই। সে যাই হোক, তো আমাকেই যখন গিয়ে থাকতে হবে তখন তারা কেন আমাদের বাড়ি দেখতে আসবে, বরং আমি যাব তাদের বাড়ি দেখতে।”

মা এইবার চেঁচিয়ে উঠল, ”মানে? মেয়ে যাবে ছেলের বাড়ি পাত্র দেখতে? এরকম হয় কখনো? আর গলা দ্যাখো যেন মাইক বাজাচ্ছে, সারা পাড়াকে জানাবেন উনি! এরকম হয়না বুঝলি?”

সানাইও সঙ্গে সঙ্গে আরো চেঁচিয়ে মায়ের সাথে সঙ্গত করল, ”হওয়ালেই হয় মা। কোন রুলবুকে লেখা আছে যে মেয়েরা যেতে পারবে না দেখতে? আমাকেই যখন গিয়ে থাকতে হবে তখন তো আমারই যাওয়াটা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত! আমি গিয়ে দেখব যে ছেলের বাড়ির বাথরুমটা কেমন, বারান্দায় কতটা রোদ আসে, অফিস থেকে ফিরে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে হাওয়া খেতে পারবো কিনা, তারপর আমি ডিসাইড করব যে আমি ওখানে বিয়ে করব কিনা!”

মা এবার বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, ওর দিকে হতবুদ্ধির মতো চেয়ে বলল, ”এরকম নিয়ম তো নয় বল!”

সানাই এবার উত্তেজিত হয়ে বলল, ”নিয়ম নয় কারণ সব নিয়ম যুগযুগ ধরে ছেলেরাই তৈরি করেছে, আর তারা নিজেদের আপার হ্যান্ডে রেখে নিয়ম বানাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটাকে পাল্টাতে তো হবে, নাকি?”

মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বাবা এবার ইতি টানার ভঙ্গিতে বলল, ”যাকগে ছাড়। ঠিক আছে। তোর যখন এটাই ইচ্ছে, তুই-ই তাহলে ফোন করে ওদের বল যে ওরা যেন আজ না আসেন, তুই দেখতে যাবি ওদের বাড়িতে ছেলেকে, কেমন?” বাবা কথা শেষ করে ফোনের বোতাম টিপতে উদ্যত হল।

সানাই এবার একটু গুটিয়ে গেল, ”আ-আমি বলব কেন, তুমিই এটা বলো না!”

মা ওকে প্রায় ভস্ম করে দেবে, এমনভাবে তাকিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল, ”হে ভগবান! এটা বললে ওরা আর সম্বন্ধটাকে পাকা করবে ভেবেছিস?”

সানাইয়ের এবার মাথায় রক্ত উঠে গেল, আর রাগের বশে মানুষ অসমসাহসী কাজও করে ফ্যালে কখনো কখনো, ছেলের মায়ের ফোনে রিং করে কানে লাগিয়ে ও মা-র দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, ”না করলে না করবে। আমি জলে পড়ে নেই বুঝলে? তবু এই মেসেজটা তো পৌঁছবে!”

**********

ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক যখন সন্ধে সাড়ে ছ-টা, সানাই একটা কুর্তি-লেগিংস পড়ে মায়ের মিন্তিমাসির দেওরের শালার বাড়ি বসে বসে ঘামছিল। সকালের ঝগড়াঝাটির পর মা কিছুতেই নাকি যেচে অপমানিত হতে পারবে না বলে আসেনি, ও আর বাবাই এসেছে। ইয়েস! সানাই জিতেছে। জিতেছে একটা তথাকথিত গোঁড়া কনভেনশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু জিতে যে এইরকম গণ্ডগোলে পড়তে হবে, সানাই কল্পনাও করতে পারেনি। ইন ফ্যাক্ট সকালেও যখন ও ছেলের মা-কে ফোন করে যতদূর সম্ভব মিষ্টি করে বুঝিয়েছিল যে ও নিজে আসতে চায়, তখনো খুব একটা ঝড় ওঠেনি। এরা একটু অবাক হলেও বেশ ওয়েলকামই করেছিলেন।

কিন্তু এখন সানাইয়ের মনে হচ্ছে কেন এরা ফোনে শুনেই ‘না’ করে দিলেন না!

না, ওকে মোটা নিয়ে কোনো কথা শুনতে হয়নি, ছেলের বাবা-মা, জ্যেঠু সবাই বেশ ভালোভাবেই কথা শুরু করেছিলেন ওর আর বাবার সঙ্গে। কথা হচ্ছিলো ওর অফিস, অবসর সময়যাপন এসব নিয়ে। কিন্তু গোল বাঁধল ছেলেটা ঘরে ঢোকার পর। সানাই দিব্যি প্লেট থেকে একটা বিশাল সাইজের কমলাভোগ নিয়ে মুখে পুরেছিল, কিন্তু ছেলেটাকে দেখে মিষ্টিটা ওর মুখ থেকে পড়ে গেল দামি কুর্তিতে।

সবুজ একটা সুতির পাঞ্জাবি পরে ছেলেটা ঘরে ঢুকে প্রথমে চেয়ারে বসল। তারপর সানাইয়ের দিকে তাকাতেই নিজের ভ্রুটাকে প্রায় ইঞ্চিখানেক তুলে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ”আপনিই কাল আমায় থাপ্পড় মারার কথা বলেছিলেন না?”

বাবা হতভম্ব হয়ে সানাইয়ের দিকে তাকাল।

ছেলেটার বাবামা-ও থতমত খেয়ে গেছেন। ছেলেটার জেঠু, যিনি কিনা ওই মিন্তিমাসির দেওরের শালা, তিনিও দিশেহারা হয়ে পিটপিট করে চাইলেন, ”মানে! এসব কি বলছিস তুই টুবাই?”

টুবাই নামক অভদ্র বাঁদরটি সানাইয়ের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, ”ঠিকই বলছি জেঠু। এই মেয়েটা কাল বাসে আমার সাথে বেদম ঝগড়া করেছিলো। বলেছিল আমাকে চড় মারবে।”

সানাই এবার আর শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারল না, পরিস্থিতি ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”আমি প্রথমে মোটেই বলিনি, আপনিই বলেছিলেন আমি নাকি আপনার বাড়ি চলে যাব।”

ছেলেটা কিরকম ছদ্ম অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাল, তারপর সবার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, ”ভুল কিছু বলেছিলাম কি? আপনি তো মনে হয় আমার বাড়িতেই এসে বসে আছেন এখন!”

সানাইয়ের কান্না পাচ্ছিল এবার। ও বেশ বুঝতে পারছিল পরিস্থিতি ওর আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে, তবু ও শেষ চেষ্টা করল, ”বাবা চলো। এখানে আর নয়।”

বাঁদরটা এবার বলল, ”কেন? এখানে আর নয় কেন? আমাদের বাথরুমটা বেশ বড়, পরিষ্কার আর আমাদের ছাদটাতেও হাওয়া আসে দেদার! আপনার হাওয়া খেতে কোনো অসুবিধাই হবে না।”

সানাইয়ের নাকের পাটাদুটো ফুলছিল ঘনঘন, ছেলেটার মা তার মানে সানাইয়ের ফোনে বলা কথাগুলো সব রিলে করেছে অপোগণ্ডটাকে!

ও গোঁজ হয়ে বসে রইল।

**********

দিন দশেক পরে সাউথ সিটিতে মিট করে সানাই ঠিক করেই রেখেছিল বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে দেখা করতে এলেও ও ঠিক কাটিয়ে দেবে। আশ্চর্যভাবে সেদিনের ওরকম ঝগড়ার পরেও ছেলের বাড়ি রাজিই আছেন বিয়েতে। কিন্তু সানাই রাজি নয় মোটেই। ওরকম ডেঞ্জারাস ছেলেকে ও বিয়ে করতে পারবে না কিছুতেই।

আইসক্রিমে কামড় দিয়ে প্রথমেই সানাই বলল, ”দেখুন, স্পষ্টাস্পষ্টি একটা কথা বলি। আমি জানি আমি মোটা, আর আমার গায়ের রঙও ফর্সা নয়। আমি কিন্তু ডায়েটিং করে রোগা হতে পারব না।”

ছেলেটা সেইরকম গা পিত্তি জ্বলে যাওয়া হাসি হেসে বলল, ”হবেন না। আমি তো ছবিতে আপনাকে দেখেই পছন্দ করেছিলাম। আমার বেশ গোল কমলাভোগ টাইপ মিষ্টি বৌই পছন্দ। আর এইসব রোগা মোটা বেঁটে লম্বা এগুলো কোনো ফ্যাক্টরই নয় আমার কাছে। আরে মানুষ তো জ্যান্ত অবজেক্ট, কখনো রোগা, কখনো মোটা হবে এটাই স্বাভাবিক। চেয়ার টেবিল তো নয় যে চিরকাল একরকম কন্সট্যান্ট থেকে যাবে! ওসব ছাড়ুন!”

সানাই রেগে উঠতে গিয়েও ঠিক আর রাগতে পারছিল না। আড়চোখে ও ছেলেটার দিকে তাকাল, সেদিনও এইরকম সারাটা সময় ওকে লেগপুল করে গেছে বাঁদরটা। সারাটা জীবন কি এরকমই করে যাবে নাকি?

ছেলেটা আবার বলল, ”হ্যাঁ, শুধু আঁকাটা ছাড়বেন না। পারলে আমার একটা পোর্ট্রেট এঁকে দেবেন তো! ওই ছাদে গিয়ে হাওয়া খেতে খেতেই না হয় আঁকবেন! আর হ্যাঁ, আপনার সানাইটা একটু পারলে আস্তে বাজাবেন, রাতবিরেতে বড্ড কানে লাগবে তো?”

সানাই আর পারল না, দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল বাঁদরটার পিঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *