ইন্দিবর

ইন্দিবর

ওদের ছোট্ট খেলনার মতো ট্রেনটা হাল্কা একটা বাঁক নিয়ে রাস্তা ক্রস করে একদম খাদ বরাবর চলতে শুরু করতেই দূরে ঘুম স্টেশনের সবুজ চালাটা দেখা গেল আর অমনি টই হাততালি দিয়ে উঠল, ”ওই তো! ঘুম স্টেশন! পৃথিবীর সবথেকে উঁচু স্টেশন, না বাবা?”

কোয়েল জানলা দিয়ে বাইরের সুন্দর প্রকৃতি দেখছিল, প্রশ্ন শুনে অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। অরিন্দম হেসে তার সাড়ে চার বছরের ছেলেকে কোলে তুলে নিল, ”না বাবা, অনেক আগে ছিল। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্টেশন হল চীনের ট্যাঙ্গুলা বলে একটা স্টেশন, তিব্বতের কাছে। তবে, আমাদের ঘুম ভারতের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু।”

টই বাবার দাড়িতে অঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে বলল, ”ঘুম নাম কেন বাবা? এখানে এলে কি সবার ঘুম পায়?”

শিলিগুড়ি থেকে টয় ট্রেনে ওঠা থেকে শুরু করে টইয়ের হাজারো প্রশ্ন শুরু হয়েছে। এই ঘোর বর্ষাকালে ওরা যখন দার্জিলিঙের টিকিট কাটছিল, আত্মীয়- স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই ভ্রূ কুঁচকেছিল, বাবা বলেছিলেন, ”এই ডিপ্রেশনের ওয়েদার! এখন কেউ দার্জিলিং যায় নাকি! ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে গিয়ে বিপদে পড়বি। নর্থ বেঙ্গল তো শুনছি ভাসছে! কোথায় কোন পাহাড়ে ধস টস নেমে কেলেঙ্কারি হবে। একেই তো এখন ঘুরতে যাওয়া মানেই টেনশন, যেরকম সব জায়গায় ব্লাস্ট হচ্ছে! এই প্যারিস তো এই ইস্তাম্বুল! চারদিকে কি অবস্থা বল তো! ক্যানসেল কর এখুনি!”

কোয়েল এসব শুনে ভয় পেয়ে গেলেও অরিন্দম শান্তভাবে বলেছিল, ”কিছু হবে না, চলো তো!” তারপর মুচকি হেসে ঠেঁট উল্টে বলেছিল, ”তোমাদের জন্যই তো এই হাঙ্গামা! দশ বছর আগেও জুলাই মাসটা ঘোর বর্ষাকালই ছিল মশাই, তবু এইসময় ডেট ঠিক করেছিলে কেন?”

কোয়েল তখন ওদের জমজ দুই ছেলে টই আর টম্বুরকে পড়াতে বসেছিল, অরিন্দমের বলার ভঙ্গিমায় ও হেসে ফেলেছিল, ”বা রে! কলেজের এক্সকারশন তো ওই সময়েই ছিল! আমি কি করব! তোমাকেই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে মশাই যাওয়ার? যতসব পাগলামি!”

অথচ অরিন্দমের এই পাগলামিটাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে কোয়েল। ওদের সম্পর্ক দেখে সবাই লাভ ম্যারেজ বলে ভুল করে, কিন্তু না, রীতিমতো খবরের কাগজ থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে ওদের। কিন্তু অ্যারেঞ্জড ম্যারেজেও এত বন্ধুর মতো সম্পর্ক বোধ হয় খুব কমই দেখা যায়।

কোয়েল ফের জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছোট্ট ঘুম স্টেশনটা দেখতে দেখতে ভাবল, শুধু ছেলেদের নামেই নয়, সত্যিই ওর জীবনটা টইটম্বুর হয়ে ভরে উঠেছে সুখে, তৃপ্তিতে। তবু কিসের জন্য ছুটছে ও এখন দার্জিলিং? পরক্ষণেই ও নিজেই নিজের মনকে বোঝায়, ও কোথায় যাচ্ছে? যাচ্ছে তো অরিন্দম ওকে ধরে বেঁধে নিয়ে। বিয়ের পর একদিন গল্পচ্ছলে ওকে বলে ফেলেছিল ঘটনাটা, তারপর থেকে যে ও মনে করে রেখে দিয়েছে, সেটা কোয়েল কি করে জানবে?

এত জায়গা ঘুরেছে কোয়েল, পাহাড় থেকে সমুদ্র, তবু দার্জিলিঙের প্রেমে যেন বারবার পরে ও। সবচেয়ে ভালো লাগে এই টয়ট্রেনটা, ছোট্ট একটা ট্র্যাক দিয়ে কু ঝিক ঝিক করে ছুটে চলেছে, এই দেখল রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে যাচ্ছে, ওমা একটু বাদেই দেখবে ডানদিক ঘেঁসে চলছে, কারুর বাড়ির সামনে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়ের মাঝখান দিয়ে, কারুর দোকানের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কেটলির সামনে দিয়ে টুকটুক করে কেমন ছুটে চলে। এত আস্তে যে, যে কেউ ওঠানামা করতে পারে। কোয়েলের হঠাৎ দশ বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। ওদের কলেজ এক্সকারশনের ষোলো জনের টিম। সেদিনও একজন এরকমই বারবার ওঠা নামা করছিল। কিছুটা আনন্দে, আর অনেকটাই জানলার পাশে বসা কোয়েলকে ইমপ্রেস করার চেষ্টায়।

অরিন্দমের কথায় কোয়েলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল, ”কি ভাবছেন ম্যাডাম অমন আনমনা হয়ে? দশ বছর আগের বাতাসিয়া লুপে চলে গেছেন বুঝি?”

কোয়েল কপট রাগের ভঙ্গিতে হাসে, ”তুমি আমাকে এরকম খোঁটা দেবে বলে নিয়ে এলে বুঝি?”

টম্বুর তো অনেক আগেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গিয়েছিল, এতক্ষণ অনর্গল বকে বকে টইও ঘুমিয়ে পড়েছে অরিন্দমের কোলে। একেই চূড়ান্ত অফ সিজন, তার ওপর গত কয়েকদিনের উত্তরবঙ্গের বন্যায় ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। গোটা টয়ট্রেনের দুটো কামরায় ওরা চারজন আর বেশ কিছুটা দূরে এক গুজরাটি ফ্যামিলি ছাড়া কেউ নেই। অরিন্দম সাবধানে ঘুমন্ত টইকে শুইয়ে দিয়ে বউয়ের কাছে উঠে এল, কোয়েলের কাঁধে হাত রেখে কাছে টানবার ভঙ্গিতে বলল, ”উফ, এতক্ষণে একটু আমার বউটাকে একটু কাছে পাওয়া গেছে! বাচ্চা তো নয় যেন অ্যাটম বম্ব!”

কোয়েল হেসে অরিন্দমের হাতের ওপর হাত রেখে বলল, ”কি দরকার ছিল বল তো এইরকম বর্ষার মধ্যে আসার! ও হয়তো ভুলেই গেছে!”

অরিন্দম বলল, ”ওসব এক কথা বাদ দাও তো! শোন না, কেসটা আরেকবার বল না প্লিজ! সেই কবে শুনেছিলাম, তারিখটা ছাড়া সব ভুলে গেছি। আরেকবার বল না!”

বাতাসিয়া লুপের পুরো বৃত্তটায় টয় ট্রেনটা তখন চক্কর কাটছে। এই এক মজা, এখানে ট্রেনের পেছনে বসলে সামনেটা পুরো দেখা যায়। কোয়েলের হঠাৎ মনে পড়ল এই বাতাসিয়া লুপেই প্রথম ওদের কথা হয়েছিল। ও আনমনে বলল, ”ধুর, ছাড়ো তো!”

অরিন্দম বলল, ”না না, প্লিজ বল!”

কোয়েল নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল, ”ওই তো, কলেজ থেকে আমরা এক্সকারশনে এসেছিলাম ফাইনাল রেজাল্ট বেরোনোর পর, একটা ফেয়ারওয়েল ভিজিট হিসেবে। ও ছিল ফিজিক্স অনার্স, আর আমি ইকোনমিক্স। আগে মুখ চেনা থাকলেও সামনাসামনি কথা কখনো হয়নি। এখানে এসেই আলাপ হয়।”

অরিন্দম বলল, ”হুম, কি নাম বলেছিলে আমার মি. সতীনের?”

কোয়েল কটমট করে তাকাল, ”উল্টোপাল্টা বকবে না। সতীন কেন হতে যাবে!” তারপর আবার জানলা দিয়ে দূরে তাকাল, ”ইন্দিবর। ইন্দিবর আলি।”

সত্যি, রোগা পাতলা ফর্সা চশমা পড়া ছেলেটার মধ্যে যে কি দেখেছিল কোয়েল! ওই আটদিনের মধ্যেই যেন কত কাছাকাছি চলে এসেছিল ওরা। ইন্দিবর মানে নীল রঙের পদ্মফুল, নীলপদ্মের মতোই পবিত্র ছিল ও। বাংলাদেশের ঢাকা থেকে পড়তে এসেছিল কলকাতায়, কিছুটা লাজুকতায় আর কিছু বাঙাল ভাষার টানের জন্য চুপচাপ থাকত সবসময়।

ম্যালের বাঁ পাশের গভর্নর রোডের ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটত ওরা, পর পর সব ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর পাশ দিয়ে চলতে চলতে কত হাবিজাবি বকত কোয়েল, ইন্দিবর হাসিমুখে চুপচাপ শুনত। কোয়েলকে ও ডাকত কোকিলপাখি বলে।

শিলিগুড়ি নেমে আসার আগের দিন সকালে ওরা সবাই মিলে কেভেন্টার্সে গিয়েছিল কফি খেতে। সেই বিখ্যাত কেভেন্টার্স, সত্যজিৎ রায়ের প্রচুর সিনেমার যেখানে শ্যুটিং হয়েছে, যার খোলা ছাদে এক কাপ কফি নিয়ে বসলে পুরো দার্জিলিংটাকে, এমনকি দূরের পাহাড়ের গায়ের চা বাগানগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। দূরের বিশাল উঁচু ক্লক টাওয়ারের ঘড়ির কাঁটার টিকটিক করে এগোনো দেখতে দেখতে ইন্দিবর লাজুক মুখে চোখ মাটির দিকে নামিয়ে রেখে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল ওকে।

দার্জিলিং স্টেশন আসতে কোয়েলের হুঁশ ফিরল। টম্বুরকে অরিন্দম কোলে নিয়ে লাগেজগুলো নামাচ্ছে ট্রেন থেকে। ও টইকে তুলে নিয়ে নেমে এল। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। ইশ, এত বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে আসার কোনো মানেই হয় না! না পাবে দূরের কোনো সুন্দর ভিউ, না পারবে ম্যালে গিয়ে শান্তিতে বসতে! অথচ, দশ বছর আগের সেইদিনটায় কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল না একফোঁটাও। শুধু সকালে ইন্দিবরের কথা শোনার পর বিকেলে যখন চুপি চুপি কাউকে না জানিয়ে ওরা দুজন কেভেন্টার্সে গিয়েছিল, কোয়েল যখন জানিয়েছিল এই সম্পর্ক অসম্ভব, শুধু ধর্ম আলাদা হওয়ার জন্য নয়, ইন্দিবরের আর ওর পরিবারের কোনোদিকেই কোনো মিল নেই, তখন যেন ওর অন্তরের দুঃখটা কালো আষাঢ়ে মেঘ হয়ে গর্জে পড়েছিল কেভেন্টার্সের ছাদে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজতে ভিজতে ইন্দিবর ওর আঙুলটা ধরেছিল, আর তখনই এই অদ্ভুত প্রস্তাবটা দিয়েছিল, যেটা কোয়েল না করতে পারেনি, বলা ভালো, না করতে চায়নি ও। সেইদিনটা ছিল সাতই জুলাই। ঠিক দশ বছর পরে ২০১৬ সালের সাতই জুলাই যত ঝড়ই বয়ে যাক দুজনের জীবন দিয়ে, যত বাধাই আসুক, ওরা আবার ঠিক দেখা করবে কেভেন্টার্সের ছাদে, সকাল দশটায়। কালই সেই দিন।

হোটেলে পৌঁছে লাঞ্চ সেরে নিয়ে ওরা ম্যালের দিকে হাঁটতে বেরল। আগামীকাল সকালটা যত এগিয়ে আসছে, হাসিখুশি স্বভাবের কোয়েল ততই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। সেটা লক্ষ করে অরিন্দম স্ত্রীর হাত ধরে বলল, ”কি হল, এত চুপচাপ কেন? আচ্ছা, দেখলে চিনতে পারবে তো?”

কোয়েল ভেতরের উষ্মাটা চাপতে পারল না, ঝংকার দিয়ে উঠল, ”তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। অনেক কথাই তো অনেকে দেয়, কজন সেটা রাখে? হয়তো ও ভুলেই গেছে! কি দরকার ছিল আসার? আমি কাল সকালে কিছুতেই কেভেন্টার্সে যাব না।”

অরিন্দম ওর মনের আলোড়নটা বুঝতে পেরে ওর হাতে একটা আলতো চাপ দিল, কোনো কথা বলল না। ম্যাল প্রায় ফাঁকা, বৃষ্টিভেজা বেঞ্চগুলো দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ বাদে কোয়েল হঠাৎ অস্ফুটে বলল, ”আচ্ছা, কেমন দেখতে হয়েছে বল তো ওকে!”

অরিন্দম নরম স্বরে বলল, ”কাল আমি টইটম্বুরকে নিয়ে চিড়িয়াখানার দিকটা ঘুরে আসব, তোমাকে কেভেন্টার্সে ঠিক দশটায় পৌঁছে দেব।”

কোয়েল চমকে উঠে বলল, ”না, খবরদার না! তুমি যাবে এবং থাকবে আমার সঙ্গে।”

অরিন্দম বলল, ”আচ্ছা আচ্ছা সে দ্যাখা যাবে, তবে আমি ভাবছি অন্য কথা।”

কোয়েল ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”কি?”

অরিন্দম বলল, ”কাল তো ঈদ, উনি আসতে পারবেন তো?”

কোয়েল মুখে বলল, ”না এলেই বাঁচব! চারজনে কেভেন্টার্সে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করে চলে আসব।” মনে মনে ভাবল, কতটুকুই বা চিনেছিল ও মানুষ ইন্দিবরকে ওই ক-টা দিনে? তবু সদ্য কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা দেওয়া সবুজ মনে ওই ক-টা সোনালি দিন যেন চিরস্থায়ী হয়ে গেঁথে গেছে! কলকাতা ফিরে যাওয়ার পর আর কোনো খোঁজ পায়নি ওর, রাখার চেষ্টাও করেনি। অরিন্দমের সাথে বিয়ের আগে ওর অতীত প্রেম বলতে কিছুই ছিল না, কিন্তু ওই স্বল্পভাষী নরম গলায় কথা বলা ছেলেটার সাথে কাটানো এক সপ্তাহের হাল্কা ভালোবাসাটুকু যেন স্নিগ্ধ পারফিউমের মতো জড়িয়ে রেখেছে ওকে।

এই দশ বছরে ফেসবুকে বারকয়েক খোঁজার চেষ্টা করেছে কোয়েল, পায়নি। ভাল স্টুডেন্ট ছিল, হয়তো বিদেশে কোথাও সেটল করে গেছে। এখানে আসার আগে খেলাচ্ছলে অরিন্দম আর ও মিলে লিঙ্কড ইনের মতো প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও ঢুঁ মেরেছে দু-তিনবার। ‘ইন্দিবর আলি’ বলে একজন ফিজিক্সের প্রোফেসরকে খুঁজে বের করেছিল অরিন্দম, ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে পড়ান তিনি, কিন্তু ছবি না থাকায় কোয়েল বুঝতে পারেনি ও-ই সে কিনা। সে হলে তো এখানে আসা বেকার হল, ফ্লোরিডা থেকে দশ বছর আগের দেওয়া কথা রাখতে নিশ্চয়ই কেউ দার্জিলিং ছুটে আসবে না!

পরের দিন সকালে উঠে কোয়েল যখন রেডি হচ্ছিল, অরিন্দম মুখ দেখেই বুঝতে পারছিল, ও ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। চিয়ার আপ করার ভঙ্গিতে ও বলল, ”আরে এত টেনশনের কি আছে! আমি তো নেট থেকে খুঁজে বের করে ফেলেছি ইন্দিবরবাবুকে!”

কোয়েল ওর ওভারকোটের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে অবাক চোখে তাকিয়েছিল, ”সত্যি! আমাকে বলোনি তো! কি করে ও এখন?”

অরিন্দম গম্ভীর গলায় বলল, ”আরে, তুমি দু হাজার ষোলো সালের আজকের দিনে কেভেন্টার্সে যাবে বলে বেচারা আশায় আশায় থেকে শেষমেশ কেভেন্টার্স রেস্টুরেন্টটাই কিনে ফেলেছে। চল, ওদের রিসেপশনে গেলেই মালটাকে দেখতে পাবে।”

কোয়েল এরকম বেয়াড়া রসিকতায় রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে মোবাইলটা বের করল ও, ওই প্রান্তে মায়ের উদবিগ্ন গলা, ”কিরে তোরা কোথায়?”

কোয়েল বলল, ”এই তো! একটু হাঁটতে বেরবো এখন। তোমরা কেমন আছ?”

মা আবার উদবিগ্ন গলায় বলল, ”অরিন্দম, টইটম্বুর কোথায়?”

কোয়েল এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ”আরে সবাই রয়েছে। তুমি এরকম করে কথা বলছ কেন, কি হয়েছে?”

মা এবার একটু সামলে নিয়ে বলল, ”কুট্টিমামাকে মনে আছে?”

কোয়েলের বাবা জন্মসূত্রে এদেশীয় হলেও মা খাঁটি পূর্ববঙ্গীয়। কুট্টিমামা মায়ের কিরকম এক তুতো ভাই, এখনো বাংলাদেশেই থাকে। কোয়েলের বিয়েতে শেষ এসেছিল। ও বলল, ”মনে থাকবে না কেন! কি হয়েছে কুট্টিমামার?”

মা এবার কেঁদে ফেললো, ”কুট্টি আর নেই রে! কাল রাতে বাংলাদেশের একটা হোটেলে বিশাল বড় জঙ্গি হামলা হয়েছে, ওখানে কি কারণে কুট্টি গিয়েছিল………অনেকে মারা গেছে রে!”

কোয়েল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এতদিন এইসব জঙ্গি হামলার খবর কাগজে পড়েছে, আর ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়েছে যে ওর পরিবারের সবাই অক্ষত রয়েছে, শেষে সেখানেও আঘাত আছড়ে পড়ল!

মা একনাগাড়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে যাচ্ছিল, ”প্রায় চল্লিশ জন মারা গেছে রে! রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়েছিল, তারপর রাত দুটো আড়াইটে নাগাদ পুলিশ সব ক-টা জঙ্গিকে মারতে পেরেছে। ওরা হুমকি দিচ্ছে সব ট্যুরিস্ট প্লেসই নাকি ওদের মেন টার্গেট! আ-আমার খুব ভয় করছে। তোরা তাড়াতাড়ি ফিরে আয়!”

ঘণ্টাখানেক বাদে কেভেন্টার্সে পৌঁছে ছাদের ওপর একটা টেবিলে কোয়েল গুম হয়ে বসেছিল। মনটা বিষাদে ভর্তি হয়ে গেছে। নিরপরাধ মানুষগুলোকে অতর্কিতে হত্যা করে কি বীরত্বের প্রমাণ দিতে চায় এরা?

অরিন্দম খুব ছটফটে, বেশিক্ষণ একটানা কোথাও বসতে পারে না, কিছুক্ষণ উশখুশ করেই বলল, ”কই গো, দশটা পাঁচ হয়ে গেল তো! কোথায় তোমার ইন্দিবর?”

কোয়েল ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”তোমার তোমার করছ কেন? আমার থেকে তো তোমার বেশি ইন্টারেস্ট দেখছি!”

সাড়ে দশটা নাগাদ অরিন্দম আর বসে থাকতে পারল না, টইটম্বুরও চিড়িয়াখানা যাওয়ার বায়না করে যাচ্ছে ক্রমাগত, কোয়েলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর জন্য কিছু সসেজ আর হ্যাম অর্ডার দিয়ে নীচ থেকে একটা খবরের কাগজ নিয়ে এসে ওর মুখের সামনে রেখে বলল, ”তুমি একটু এগুলো খাও, কাগজ- টাগজ পড়ো, আমি কাছেপিঠেই এইদুটোকে নিয়ে একটু ঘুরছি। আমার তো মনে হচ্ছে না আর আসবে, তবু এলেই আমাকে টুক করে একটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিও, বুঝলে? অমনি আমি হাজির হয়ে যাব।”

 এগারোটা যখন বাজতে চলল, তখন কোয়েলও অধৈর্য হয়ে উঠল। সত্যিই তো, কবে কোন হাল্কা কথার কথা, তার জন্য ও হাঁ করে বসে রয়েছে। বার্গারটায় ও একটা কামড় দিতে যাবে, এমন সময় ভেতরে রিসেপশনে বসে থাকা ম্যানেজার ভদ্রলোক হঠাৎ এগিয়ে এলেন, ”ম্যাডাম, আপনি কি কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন?”

কোয়েল ভ্রূ কুঁচকোল, ”কেন বলুন তো!”

ভদ্রলোক স্মিত হেসে বললেন, ”আসলে ম্যাম, এখানে দশটার সময় আমাদের একজন কাস্টমারের আসার কথা ছিল তাঁর এক পুরনো বান্ধবীকে মিট করতে, কিন্তু এক মাস আগে উনি একটা চিঠি দিয়ে আমাদের বলে যান, যদি তিনি কোনো কারণে আজ দশটায় এখানে আসতে না পারেন, তবে তার চিঠিটা যেন আমরা তাঁর বান্ধবীকে দিয়ে দিই। আমরা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি আপনি দশটার একটু আগে থেকে এসে অপেক্ষা করছেন, তাই ভাবলাম আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করি। আপনার নামটা একটু বলবেন প্লিজ?”

কোয়েলের মুখচোখ আলোকিত হয়ে উঠল, ”হ্যাঁ, আমিই! আমার নাম কোয়েল। আচ্ছা উনি কি এখানে প্রায়ই আসেন?”

ম্যানেজার বাদামি এনভেলাপে মোড়া চিঠিটা দিতে দিতে বললেন, ”না, গত সাত-আট বছর ধরে উনি ঠিক বছরের এই সময়টাতেই এখানে এসে রোজ ব্রেকফাস্ট করতেন। আগে তেমন আলাপ হয়নি, গত মাসে হঠাৎই এলেন, তখন চিঠিটা দিয়ে গেলেন।”

কোয়েল বিহ্বল চোখে চিঠিটা হাতে নিল। ইন্দিবর প্রতিটা বছর এখানে আসত! কেন? আর আসতই যখন এবছর পারল না কেন আসতে!

হাল্কা ব্রাউন শক্ত কাগজে নীচে কালিতে লেখা একটা চিঠি।

”কোকিলপাখি,

তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে, তখন আমি অনেকদূরে চলে গেছি। অবশ্য জানিনা, তুমি সত্যিই আজ কেভেন্টার্সে এসেছ কিনা। হয়তো আসোনি। হয়তো তোমার মনেই নেই আমাকে! হয়তো দশ বছর আগের সেই ছোট্ট কোকিলপাখি এখন তার ছানাপোনাদের নিয়ে বিষম ব্যস্ত! তবু যদি আসো, সেই আশায় চিঠিটা লিখছি।

জানো কোকিলপাখি, তোমার সাথে দেখা হবার পর থেকে এই দশটা বছরে আমার জীবনটা খুব তাড়াতাড়ি বদলে গেল। তবু হাজার ব্যস্ততার মাঝেও গত ন-টা বছরের সাতই জুলাই তারিখটা কিন্তু আমি কেভেন্টার্সের ছাদেই কাটিয়েছি। এই ন-টা বছর ধরে আসলে রিহার্সাল দিয়েছি কি করে দশ নম্বর বারে তোমার সাথে কথা কইবো। অনেক ক-টা বছরে ওই দিনটায় আমাদের ইফতার পড়েছে, রমাদান চলেছে, তবু আমি এসেছি। অথচ নিয়তির কি পরিহাস দেখ, ফাইনাল ম্যাচের দিনই আমি অ্যাবসেন্ট!

তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, কেন? সব কথা তো বলতে পারব না কোকিলপাখি, এটুকু বলি, মহাভারতের অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে তোমার? অভিমন্যু ব্যূহে ঢোকার রাস্তাটা জানতো, বেরোতে কি করে হয়, সেটা ওকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। আমারও হয়েছে সেই দশা। ক্ষণিকের আবেগে, মুহূর্তের দুর্বলতায় যে পথে চলে এসেছি একবার, চাইলেও আর ফেরার উপায় নেই! এখন নিজের ভুল বুঝতে পারি, বুঝি যে, কোনো ধর্মই নৃশংস হতে শেখায় না। আমরা ভুল পথে চলছি। কিন্তু ফেরার পাসপোর্টটাই হারিয়ে ফেলেছি যে!

আমাদের দেখা করার সময়টাতে আমার একটা খুব দরকারি কাজ পড়ে গেছে। তাই চাইলেও আসতে পারলাম না। তুমি ভালো থেকো কোকিলপাখি।

আমি জানিনা তুমি যখন এই চিঠিটা পড়ছ আমি তখন কোথায় থাকব, তবে যেখানেই থাকি, সেখান থেকে তোমায় চুপিচুপি বলি, ২০০৬ সাল থেকে আজ অবধি একটা মুহূর্তের জন্যও আমি তোমারে ভুলি নাই। আমার মতো ভালো তোমারে কেউ কোনোদিনও বাসতে পারবে না।

ভালো থেকো সুখে থেকো।

—তোমার নীল রঙের ঝরে যাওয়া পদ্মটা।”

পড়তে পড়তে কোয়েলের চোখদুটো নিজের অজান্তেই ভিজে উঠেছিল। সব ক-টা কথা ও ঠিক বুঝতে পারল না, তবু কাঁদছিল ও। শেষ লাইনক-টা পড়ে চোখ মুছে অরিন্দমকে ফোন করতে যাবে, হঠার টেবিলের একপাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে রক্তাক্ত পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি জঙ্গিটাকে দেখে ও বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল। দশটা বছর কেটে গেলেও সেদিনের সেই পাতলা দাড়ি আর চোখদুটোকে চিনতে পারল ও!

 না, ইন্দিবর কথা রেখেছে! সশরীরে না হোক, কাগজের পাতা থেকে সাতই জুলাই তারিখে সে কোয়েলকে দেখা দিয়ে গেল।

**********

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *