‘ওলা’ ড্রাইভারের শাশুড়ি

‘ওলা’ ড্রাইভারের শাশুড়ি

মানুষ যখন জীবনে চলার কোনো বাঁকে সাফল্য অর্জন করে, বহুদিনের স্বপ্ন যখন তার পূরণ হয়, তখন তার সবাইকে ডেকে সেটা জানাতে ইচ্ছে করে, সবার সাথে নিজের আনন্দের অনুভূতিটাকে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হয়, বিশেষত কাছের মানুষগুলোর সাথে। সেইজন্যই প্রতিটা সমাজতাত্ত্বিক বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা থাকে মানুষ একটি সামাজিক জীব। কিন্তু সেই সৌভাগ্য মনোরমার হল না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই মাথা নাড়েন মনোরমা। আজকের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে যখন ভেতরের ভালোলাগাটাকে মনোরমা কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেন না, তখন পাশে আপনার বলতে সেরকম কেউ নেই।

পিন্টু বলে ট্রেনার ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিল মনোরমার ভাবগতিক, এবার বলেই ফেলল, ”কাকিমা, কাকুকে একটা ফোন বরং করেই ফেলুন! এত ভালো একটা খবর! কলকাতায় আপনিই মনে হয় প্রথম!”

মনোরমা অল্প হেসে কিছু বললেন না। থাক বাইরের লোকের কাছে আর নিজের দুঃখের কথা বলে লাভ কি! বলতে তো প্রথমদিনই গিয়েছিলেন মনোরমা, উৎসাহ ফেটে পড়ছিল তখন, আশুতোষকে না বললে আর কাকেই বা বলবেন! আশুতোষ শুনে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়েছিলেন, তারপর জিজ্ঞেস করেছিলেন মনোরমা মশকরা করছেন কিনা। পরে যখন বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা সত্যি, রসিকতা নয় মোটেই, তখন কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তারপর ফেটে পড়েছিলেন, ”তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? লোকে শুনলে তো তোমার গায়ে ঢিল ছুড়বেই, আমাদের বাড়ির সামনেও শান্তিধাম কথাটা মুছে দিয়ে পাগলাগারদ লিখে দিয়ে যাবে!” আরো কিছুক্ষণ তিরস্কার করেও ক্ষান্ত হননি, পাশের ঘর থেকে ডেকে এনেছিলেন ছেলেমেয়েকে। জয় এসে তো প্রথমে হেসেই খুন, সে হাসি থামতেই চায় না, তারপর বলল, ”প্লিজ মা! আমার একটা প্রেস্টিজ আছে পাড়ায়। এভাবে আমাকে সবার কাছে হাসির খোরাক কোরো না!”

মেয়ে রিম্পি তার মোটা ডাক্তারি বই হাতে নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলেছিল, ”মা, এটাকে কি বলে জানো? মিডলাইফ অবসেসিভ ডিজঅর্ডার। মানুষের মাঝবয়সে এসে সব উদ্ভট খেয়াল চড়ে মাথায়। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি একটা ওষুধ দেবো, রাতে শোওয়ার আগে ক-দিন খাও। ঘুমটা ভালো হবে, দেখবে শরীরটাও ঝরঝরে লাগবে। আর আমি কালই প্রোফেসর সামন্তর সাথে এই নিয়ে একবার কথা বলব।”

মনোরমা আমতা আমতা করে নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছিলেন, ”মাঝবয়স কেন! তুই বিশ্বাস কর, এটা আমার ছোটোবেলা থেকেই শখ। এতদিন সংসারের চাপে হয়ে ওঠেনি। এখন যখন একটা সুযোগ পেয়েছি………… তোদের কত আজগুবি খেয়ালে আমি সবসময় সঙ্গত দিয়েছি, আর তোরা সামান্য একটা ব্যাপারে এরকম……”

জয়ের বোধ হয় মোবাইলে বারবার ফোন আসছিল, অধৈর্য হয়ে একটু জোর গলাতেই মা-কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল, ”ওফ, এনাফ মা। শোনো তুমি আমাদের মা ওকে! কিম কারদাশিয়ান মা নও, আটপৌরে বাঙালি মা! আর মা-কে আমরা শাড়ি পড়ে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়ানো, ঘরদোর গোছানো এসবের মধ্যেই দেখতে চাই।” তারপর একটা অদ্ভুত বিদ্রূপের গলায় বলেছিল, ”স্কুটি চালাবে বললে তবু মানা যায়! বাইক চালাবে, তাও এই বয়সে!” আশুতোষও যোগ দিয়েছিলেন সেই বিদ্রূপে। বাবা, ছেলে, মেয়ের হাহাহিহিতে ভরে গিয়েছিল ঘর।

মনোরমা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এদের জন্যেই কি সারাটা জীবন তিনি স্যাক্রিফাইস করলেন? জয় আর রিম্পি তখন একদম ছোট্ট, ওদের ঠিকঠাক দেখভালের জন্য নিজের ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন মনোরমা। চাকরিটা শুধু তাঁর পেশা ছিল না, নেশাও ছিল। একটা নামী পাবলিকেশন হাউজে গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কাজ ছিল। গ্রাফিক্স মানে তখন ছবি আঁকাকেই বোঝানো হত, কম্পিউটার তখন আর কোথায়! সরকারি আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে সেখানেই যোগ দিয়েছিলেন মনোরমা। শাশুড়ি অনেক বারণ করেছিলেন ভালো চাকরিটা ছাড়তে, তবু নিজের কেরিয়ার জলাঞ্জলি দেওয়ার আক্ষেপ কোনোদিনও করেননি মনোরমা, ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করার স্বপ্নেই বুঁদ হয়ে থেকেছেন। মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে, ছেলে ভালো চাকরি করছে, ভেবেছিলেন ছেলেমেয়ে মানুষ করা সার্থক, কিন্তু এ কেমন তৈরি হয়েছে জয় আর রিম্পি? মায়ের একটা সামান্য ইচ্ছে নিয়ে এত বিদ্রুপ করছে এরা?

মনোরমার গোটা ঘটনাটা মনে পড়তেই মনটা আবার ভারিক্কি হয়ে উঠল। হ্যাঁ। তিনি মানছেন তাঁর ইচ্ছেটা একটু অদ্ভুত বটে কিন্তু এই একটিমাত্র ইচ্ছেই তো সারাজীবন ধরে বুকে লালন করে এসেছেন তিনি। ছোট্ট থেকেই বাইকের প্রতি তাঁর ভীষণ আকর্ষণ। তখন রাস্তাঘাটে এরকম মুড়ি মুড়কির মতো বাইক দেখা যেত না। যখনই ওদের রেল কোয়ার্টার কলোনিতে কেউ বাইকে চড়ে আসতেন, পরম স্নেহে সেই বাইকে হাত বোলাতেন মনোরমা। সেই যখন কলেজে পড়তেন, ‘শোলে’ রিলিজ করেছিল, বন্ধুরা সবাই মিলে হলে দেখতে গিয়েছিলেন। অমিতাভ আর ধর্মেন্দ্রর সেই বাইকে চড়ে বিখ্যাত গান ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ দেখতে দেখতে কোথায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি! তখন থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন একদিন না একদিন বাইক চালিয়ে নিজের মনে ঘুরে বেড়াবেন তিনি। সেই সময় তাঁর বন্ধু বলতে ছিলেন পিসতুতো ভাই তপন। তারই বাইকে চুপিচুপি শিখেও ফেলেন মনোরমা চালানো। ভোর ভোর টিউশনি করতে যাবার পথে রেলের পরিত্যক্ত মাঠে গিয়ে শিখতেন তিনি। কিন্তু নিজে কিনে লোকসমক্ষে চালিয়ে বেড়ানোর সাহস হয়নি। তারপর তো বিয়ে, বিয়ের পর এতদিন ধরে সংসারের জোয়াল টানতে টানতেই নিজের সব শখ-আহ্লাদ ফুরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে যখন দেখলেন ট্যাক্সি অ্যাপ ওলা ওদের চার চাকা গাড়ির পাশাপাশি কলকাতার বুকে এবার বাইকও লঞ্চ করছে, ভেবেছিলেন একবার ঝালিয়ে নিয়ে নতুন করে চেষ্টা করবেন। কিন্তু কোথায় কি!

মনের দুঃখে ইচ্ছেটাকে পাকাপাকিভাবে সমাধিই দিয়ে দিচ্ছিলেন মনোরমা, বাধা দিলেন মৃণালিনী। এই একটা মানুষ যিনি বিয়ের পর থেকে মনোরমাকে সমস্ত ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। মৃণালিনী মনোরমার শাশুড়ি মা। বয়স আশির ওপরে, কিন্তু এখনো ভালোই খটখটে আছেন। মৃণালিনীকে দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান মনোরমা! এত পুরনো দিনের লোক এত আধুনিক মনস্কা আর তারই ছেলে আশুতোষ এরকম!

মৃণালিনী পুরো ঘটনাটা শুনে নিজের মনে গজগজ করেছিলেন, ”ব্যাটাছেলেগুলোর আবার কাজ কি! ওরা তো সবসময় মেয়েদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলোকে দাবিয়ে রাখতেই ভালোবাসে। ওদেরকে অত গুরুত্ব দিসনি তো! সবসময় স্বামীজীর কথা মনে করবি, শরীরের অর্ধেকটা অংশ যতদিন পাঁকে ডুবে থাকবে, পুরো সমাজটাও এরকম পচা গলাই থাকবে। পুরুষরা তো তাদের একচ্ছত্র অধিকারে ভাগ বসাতে গেলে রাগ করবেই, কিন্তু তাই বলে কি আমরাও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব নাকি! আমাদের অধিকার কেড়ে নিতে হবে।” একটু থেমে যোগ করেছিলেন, ”তুই তো চিরকালের বোকা, ভালো চাকরিটা দুম করে ছেড়ে দিয়ে ছেলেমেয়ের পেছনে পড়লি, এখন তারাই উল্টে মা-কে এরকম করছে! আমার বাপু খুব ভালো লাগে মেয়েরা বাইক চালাক, প্লেন চালাক, জাহাজ চালাক। তুই এক কাজ কর, দুপুরবেলা করে বেরিয়ে পড়ে প্র্যাকটিস কর আগে কিছুদিন। ওরা তো কেউ থাকে না। কেউ ফোন করলে আমি সামলে নেব।”

মনোরমা মিনমিন করে আপত্তি তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মৃণালিনীর উৎসাহে সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি।

দুপুরবেলা খেয়ে উঠেই সারাদিনের নুন-হলুদ শাড়ি ছেড়ে নিজের একমাত্র সালোয়ার কামিজ, যেটা শুধু বাইরে গেলেই পরা হয় আশুতোষ পছন্দ করেন না বলে, সেইটা পরে বেরিয়ে পড়তেন মনোরমা। গন্তব্য মোটর ট্রেনিং স্কুল। একমাস শিখে টু হুইলার-ফোর হুইলার দুটোরই কমার্শিয়াল লাইসেন্স বের করা মুখের কথা নয়। বাইক অল্প চালাতে জানলেও চারচাকা একদমই জানতেন না মনোরমা, কিন্তু ওলায় ড্রাইভের হয়ে গাড়ি চালাতে গেলে দুটোই জানতে হবে, শুধু বাইকে ওলা নাকি পারমিট দেবে না।

দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে প্র্যাকটিস করতেন মনোরমা। প্রথম প্রথম অবাক হলেও পরে ট্রেনিং স্কুল ওঁর উৎসাহ দেখে পিন্টুকে আলাদা ট্রেনার হিসেবে নিযুক্ত করেছিল। প্রথমদিকে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকত মায়ের বয়সি একজন সাধাসিধে গোলগাল মহিলা বাইক শিখছেন দেখে, পরে তারাও তাদের এই কাকিমাকে খুব উৎসাহ দিত। মোটর ভেহিকল ডিপার্টমেন্টের লাইসেন্স টেস্টে দুটোতেই পাশ করে অবশেষে আজ লাইসেন্সটা হাতে পেয়েছেন মনোরমা। ভাইভা আগেই হয়ে গিয়েছিল, তাতে প্রশ্ন করা হয়েছিল ”এই বয়সে! তাও কমার্শিয়াল লাইসেন্স! কেন!”

মনোরমা সোজাসাপটা উত্তর দিয়েছিলেন, ”আমার বাইক চালাতে ভীষণ ভালো লাগে। গাড়ি চালাতেও। ওলা বাইক লঞ্চ করছে শীগগিরই। আমি ওলার হয়ে বাইক আর গাড়ি দুটোই চালাতে চাই।”

ইন্টারভিউয়ার আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ”ওলা! এই বয়সের একজন মহিলা হয়ে আপনি ভাড়া গাড়ি চালাবেন, সঙ্গে বাইক! হয় নাকি!”

মৃণালিনীর শেখানো মতো মনোরমা স্মিত হেসেছিলেন, ”হওয়ালেই হয় স্যার!”

নিজের জমানো টাকা ব্যাংক থেকে আগেই তুলে নিয়েছিলেন, অন্য যা টাকা সবই আশুতোষের সাথে জয়েন্টে, তুললে ওঁর ফোনে অ্যালার্ট চলে যাবে। তাই বাকিটা দিলেন মৃণালিনী। সেই দিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা বাজাজ বাইক আর ছোট একটা পুরনো টাটা ইন্ডিকা কিনে ফেললেন মনোরমা। কিন্তু সেগুলো রাখবেন কোথায়? বাড়িতে তো নিয়ে আসা যাবে না। অগত্যা ট্রেনিং স্কুলের সাথে কথা বলে ওদেরই গ্যারেজে রেখে দিলেন সেদুটো।

হঠাৎ পিন্টু ডাকল, ”কাকিমা, যাবেন না?”

তাই তো! লাইসেন্স পেয়ে মনোরমা আনন্দে ভুলেই গিয়েছিলেন, আজই তো ওলা কোম্পানির সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা সল্টলেকে। পিন্টু ছেলেটা বড় ভালো, যাবে সঙ্গে।

গিয়ে যতটা অপ্রস্তুতে পড়তে হবে ভেবেছিলেন, ততটা হল না। ওলা অথরিটি ব্যাপারটাকে খুবই ইতিবাচকভাবে নিলেন। এমনকি প্রথম মহিলা ওলা ড্রাইভার হিসেবে অ্যাডভারটাইজও করতে চাইছিলেন তাঁরা, কিন্তু মনোরমা বারণ করলেন।

মনোরমার বাইক চালানো আর গাড়ি চালানো টেস্ট করে নিয়ে কাগজপত্র সব জমা নিয়ে নিলেন তাঁরা। গাড়ি আর বাইকে ওলার লোগো বসানো হয়ে গেল দুদিনের মধ্যেই।

শুরু হয়ে গেল মনোরমার ইচ্ছেপূরণ। শুধু দুপুরবেলাটা কাস্টমার নেন তিনি, একদিন বাইক আরেকদিন চার চাকায়, এইভাবে অল্টারনেট করে, তাও শুধু উইকডেজ। ফোনে পিঁ পিঁ আওয়াজ করে কাস্টমাররা রাইড বুক করলেই মৃণালিনী চেঁচিয়ে ওঠেন, ”ওরে, আরেকটা খদ্দের এল রে তোর! যা যা শীগগিরই বেরো রেডি হয়ে!”

মনোরমা রেডি হয়েই থাকেন, জলদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটো করে চলে যান ট্রেনিং স্কুলে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করেই ছুট লাগান। যদিও টাকার জন্য এসব করেন না মনোরমা। বাইক নিয়ে যখন কাস্টমারকে খুঁজতে যান, আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। কাস্টমার খুব অবাক হয়ে যায়, তবে এখনো অবধি বেশ পজেটিভভাবেই গ্রহণ করেছে সবাই তাঁকে। একদিন তো একটা কাস্টমার ছবিই তুলে নিলেন মনোরমার।

যেদিন কাস্টমার থাকে না, সেদিন বাইকটা নিয়ে চলে যান দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে অনেক দূর। ফাঁকা রাস্তায় চালাতে চালাতে নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হয় মনোরমার। ঠাণ্ডা হাওয়ায় চুল উড়তে থাকে, সঙ্গে মনও। কিন্তু বেশিক্ষণ চালানো যায় না। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই ফিরে আসেন বাড়ি। শাড়ি পরে জলখাবার বানিয়ে অপেক্ষা করেন ছেলেমেয়ের জন্য।

এভাবেই চলছিল। চলতও যদি না সেদিন ঘটনাটা ঘটত। সেদিন একটা কল পেয়ে বারোটার সময়েই নাকে মুখে গুঁজে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মনোরমা। তাড়াহুড়োয় নিজের ফোনটা নিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। ওলার দেওয়া ফোনে একটার পর একটা কল পাচ্ছিলেন সেদিন। শেষ কাস্টমারকে বেলুড়ে নামিয়ে দিয়ে মনোরমা ভাবলেন আর নয়। সাড়ে চারটে বেজে গেছে, এবার ফেরার রাস্তা ধরতে হবে।

মনোরমার বাড়ি বরানগরে। বেলুড় থেকে বালি ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে আসছিলেন মনোরমা, স্কুলের গ্যারেজ আরেকটু এগিয়ে। হঠাৎ ওলার ফোনে একটা পিঁ পিঁ। একবার ভাবলেন দেখবেনই না, পরক্ষণে গাড়িটা সাইড করে বুকিংটা দেখলেন ফোনে। একটা বুকিং আসছে বরানগর চত্বর থেকে, ওলা থেকে রেড সিগন্যাল দেওয়া, তার মানে মেডিকেল এমারজেন্সি। কিন্তু এটা নেওয়া তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা তো তাঁর নিজের বাড়ির কাছাকাছি। ওখানে গেলে লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ইতস্তত করে বুকিংটা রিজেক্ট করলেন তিনি। আবার গাড়ি স্টার্ট করলেন। একটু খারাপ লাগছে, আজ বরানগর এলাকায় ট্যাক্সি ধর্মঘট আছে, তার ওপর ওই চত্বরে ওলার আর তেমন কোনো গাড়ি নেই মনোরমা জানেন। কিন্তু তাঁরও তো হাত পা বাঁধা।

বুকিংটা আরো দুবার এল, দুবারই রিজেক্ট করলেন মনোরমা।

এবার ওলা কোম্পানি থেকে একটা ফোন এল, ”ম্যাডাম আপনার লোকেশনের একদম কাছাকাছি একজন পেশেন্ট আছেন, আপনার রিজেকশন দেখে আমাদের বারবার ফোন করছেন। প্লিজ ওনাকে একটু হসপিটালে পৌঁছে দিন না, যদি সম্ভব হয়!”

মনোরমা আর ফেরাতে পারলেন না। অসুস্থ মানুষ, বিবেকে বাধল। কেউ দেখতে পেলে যা হবার হবে, মনোরমা আর বিশেষ চিন্তা করলেন না, তিন নম্বর বুকিংটা নিয়েই নিলেন। অ্যাকসেপ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন এল কাস্টমারের থেকে, ”একটু তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ! আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ইমিডিয়েটলি হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে, এখানে একটাও গাড়ি পাচ্ছি না।” ঠিকানাটা বলেই ফোনটা কেটে গেল।

মনোরমা স্থবির হয়ে গেলেন। আশুতোষের গলা! ঠিকানাটাও তাঁরই বাড়ির। তার মানে মৃণালিনী অসুস্থ! কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তো ঠিকই ছিলেন! আশুতোষই বা অফিস থেকে কখন ফিরে এল? মনোরমা আর আগুপিছু না ভেবে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাতে লাগলেন। তাঁকে ড্রাইভারের আসনে দেখে, এই গাড়ি দেখে ছেলেমেয়ে-স্বামীর প্রশ্নবাণ, বিদ্রূপের সামনে পড়ার থেকেও তাঁর সামনে তখন বড় হয়ে উঠেছে মৃণালিনী। এই মানুষটাই তাঁর আশ্রয়, তাঁর ভরসা, তাঁর কিছু হয়ে গেলে মনোরমা কার কোলে মাথা রাখবেন?

ঠিক পাঁচদিন বাদে অ্যাপোলো গ্লেন ঈগলস হসপিটালের সাততলার কেবিনে মৃণালিনী যখন চোখ খুললেন, তখন উদবেগে তাঁর সামনে ঝুঁকে বসেছিলেন মনোরমা। আশুতোষ, জয়, রিম্পি এরা দিনে দুবার করে এলেও মনোরমা হসপিটাল থেকে একমুহূর্তের জন্যও একদিনে বেরোননি।

মৃণালিনীর সেদিন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়। বাড়ির কাজের মেয়ে কমলা মনোরমাকে ফোনে না পেয়ে আশুতোষকে ফোন করে অফিস থেকে ডাকে। মনোরমাকে দেখে সবাই হাঁ হয়ে গেলেও অবস্থার জেরে কেউ কিছু বলেনি। যদিও জয় গাড়িতে যেতে যেতে শুরু করেছিল, ”মা তুমি……মাই গড! আমার কোনো বন্ধু এতদিনে ওলাতে তোমায় যদি……!”

আশুতোষ হাত নেড়ে জয়কে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর হসপিটালে ডাক্তার যখন বললেন আর কিছুক্ষণ দেরি হলে পেশেন্টকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ত, তখন আশুতোষ আলতো চাপ দিয়েছিলেন মনোরমার হাতে। সে হাতে রাগ ছিল না, ছিল অনুতাপে মোড়া ভালোবাসা।

মৃণালিনী চোখ মেলে হাসলেন, ”কিরে! মুখটা এমন শুকিয়ে গেছে কেন! ক-দিন কিছু মুখে দিসনি নাকি?”

মনোরমার চোখে জল, মৃদু স্বরে বললেন, ”মা! আমি সেদিন ছিলাম না, তোমার কত কি হয়ে যেতে পারত! আমি …… আমি আর কোনোদিনও বেরবো না তোমায় ছেড়ে!”

মৃণালিনী হেসে চোখ বুজলেন। তারপর মনোরমার কানে মুখ নিয়ে এসে চুপিচুপি বললেন, ”ধুর মুখপুড়ি! বেরবি না কেন! এবার থেকে তো ভাবছি আমিই তোর বাইকটা ওই ওলা না কি বলে ওখান থেকে বুক করব। আমায় ওই ফোনে টেপাটেপি শিখিয়ে দিবি। তারপর তুই আর আমি মিলে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাইতে গাইতে চলে যাব অনেক দূর। তুই উত্তমবাবু আমি সুচিত্রা। কিরে! আমায় নিয়ে যাবি না?”

মনোরমা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন মৃণালিনীকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *