৯-১১. ছোট্ট পাথরের সমতলে

ছোট্ট পাথরের সমতলে তাঁবু গাড়ছিল নাসির। দক্ষ হাতে। ঠাই ঠপাঠপ আওয়াজ হচ্ছে গজাল পোঁতার। সামান্য তফাতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বহে চলেছে সরাপ নদী। পাথরে ধাক্কা খেতে-খেতে। বিকেল প্রায় শেষ, সূর্য ডুবে গিয়েছে পাহাড়ের পিছনে, তবে আঁধার তেমন গাঢ় নয়। একটানা হালকা গর্জনসহ আবছায়ামাখা বহতা নদীকে দেখে রীতিমতো ভয় করে এখন।

টুপুর একটা পাথরের উপর বসে। এখনও সমে ফিরতে পারেনি, ধড়াস ধড়াস কাঁপছে বুক। এর-ওর-তার মুখে আগে ট্রেকিং-এর গল্প শুনেছে, কখনও সখনও রোমাঞ্চিতও হয়েছে বই কী। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা যে আদতে এত ভয়ংকর হতে পারে, এমনটা সে কদাচ ভাবেনি। উফ, কী যে গেল আজ! ইছরে বড় রাস্তা থেকে তরতরিয়ে অনেকটা নেমে যখন ছোট্ট সেতুটা পেরোল, মন তখনও ভাল লাগার উত্তেজনায় ভরপুর। খানিক চড়াই হেঁটে পড়ল একটা মালভূমি মতো জায়গা। সেখানে পাশাপাশি কয়েকটা চোরতেন। সমাধিগুলোর মাথায় বৌদ্ধদের লাল-নীল-হলদে পতাকা পতপত উড়ছে। দেখে বেশ প্রফুল্লতাই জেগেছিল টুপুরের। তখনও কি ছাই আন্দাজ ছিল, সামনে কী রাস্তা পড়বে এবার?

রাস্তা কোথায়, স্রেফ পাহাড়ের গা ঘেঁষে নুড়িপাথরের উপর দিয়ে হেঁটে চলা! কখনও পথের বহর তিন-চারফুট। কখনও বা কমতে-কমতে একফুটও নয়। পায়ের তলায় নুড়িপাথর সরে সরে যাচ্ছে, সরসর ঝরছে অবিরাম। একবার পা পিছলোলেই পাথরে ঠোক্কর খেতে-খেতে গড়িয়ে পড়তে হবে নীচে নদীর জলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু অনিবার্য। এক-দু জায়গায় তো লাফিয়ে পেরোতে হল ওই সরু পথ। নেহাত মিতিনমাসি বা নাসির তাকে ধরে নিয়েছে, নইলে তো টুপুর এত দূর পৌঁছোতেই পারত না। তার উপরে এক-এক সময়ে কি সাংঘাতিক চড়াই। বিশ-পঁচিশ মিনিট টানা উঠতে হচ্ছে, কোমর বেঁকে যাওয়ার দশা। তারপরেই তো আরও বিপদ, রাস্তা বেজায় ঢালু হয়ে খাড়া নামছে। তখন শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা যে কী মুশকিল। পাহাড়ের এবড়োখেবড়ো গা আঁকড়ে, পা টিপে টিপে, কীভাবে যে ওই ঢালগুলো পেরিয়েছে, তা বুঝি টুপুর নিজেও জানে না। সারাক্ষণ মনে হয়েছে এই বুঝি শেষ, এই বুঝি গেলাম পরপারে।

তাও ভাগ্যিস বুমবুমের জন্যে একটা সুবন্দোবস্ত করেছিল নাসির। ইছরের গুম্ফায় গাড়ি রাখতে গিয়ে কোত্থেকে একটা খচ্চর ভাড়া করে আনল। ওই জন্তুটির পিঠে শুধু বুমবুম নয়, চাপানো হয়েছিল মালপত্রও। অসীম সহিষ্ণু প্রাণীটির কল্যাণে অনেকটা ঝাড়া হাত-পা হয়ে হেঁটেছে সবাই।

বুমবুম তবু ভীষণ ক্লান্ত। যতটা না ধকলে, তার চেয়ে বেশি বোধহয় আতঙ্কে। মাঝে-মাঝেই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠছিল, এখন সে চুপটি মেরে লেপটে আছে পার্থমেসোর গায়ে। মাটিতে ছড়িয়ে বসে, একটা পাথরে হেলান দিয়ে, এখনও হাঁপাচ্ছে পার্থমেসো। অবসর পেয়েও সিগারেট ধরায়নি। সম্ভবত দমে টান পড়েছে বলে প্রিয় বদ নেশাটিকে বর্জন করেছে আপাতত।

মিতিনমাসিই শুধু দিব্যি ফিট। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নাসিরের কর্মকাণ্ড, নিজেও হাত লাগাচ্ছে, খচ্চরের পিঠ থেকে মাল নামিয়ে জড়ো করছে তাঁবুর পাশে। ভার হালকা হতেই খচ্চরটা নড়েচড়ে উঠল। এগোচ্ছে জলের পানে। মিতিনমাসিও গেল তার সঙ্গে। নদীর পাড়ে উবু হয়ে বসে আঁজলা ভরে জল খাচ্ছে।

হঠাৎ পার্থ বলে উঠল, ধন্যি তোর মাসির উৎসাহ। দেবল তো খ্যাপা বটেই, কিন্তু তোর মাসি তার ডাবল ছিটিয়াল।

টুপুরেরও খানিকটা তাই মনে হচ্ছিল। তাও ক্ষীণ প্রতিবাদ করল, মাসি কি অকারণে ঝুঁকি নিচ্ছে? নিশ্চয়ই মনে করছে দেবল বড়ুয়াকে সাহায্য করা উচিত।

জানি না বাপু। তবে এই নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে বাস মোটেই কাজের কথা নয়।

সে কি এমনি-এমনি থাকছে? কাছেপিঠে জনবসতি নেই বলেই তো…

এই দুর্গম রাস্তায় মানুষ থাকাটাই তো আশ্চর্যের।

 মিতিন এদিকেই আসছিল, পার্থর কথা শুনতে পেয়েছে। গলা তুলে বলল, জায়গাটা অত নির্জন ভেবো না। আশপাশে গ্রামটাম আছে। নদীর পাড় থেকে আলো দেখা যাচ্ছিল।

তো সেখানে গেলেই হত।

এখনও হাঁটার এনার্জি আছে তোমার? এই পাহাড়ি পথে? অন্ধকারে?

পার্থ জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নাসিরের ডাক, তাম্বু তৈয়ার ম্যাডাম। আপলোগ আ যাইয়ে।

ছোট্ট তাঁবুটায় ঢুকে টুপুর একটু স্বস্তি পেল যেন। কোনওক্রমে ঠেসেটুসে পাঁচজন থাকতে পারবে রাতটা। কিন্তু খাবার? পেট তো চুঁই চুঁই করছে।

মিতিন বুঝি পড়ে ফেলেছে টুপুরের মন। বলে উঠল, এবার ডিনারটা সেরে নিলে হয়।

পার্থ বলল, কী খাব? নদীর জল?

উঁহু। সুখাদ্য তো মজুত। খানআট-দশ বানরুটি। আর সাহেবদের দেওয়া ম্যাকাডেমিয়া নাটস।… ও হ্যাঁ, দু’টিন চিজ আছে ব্যাগে।

কোত্থেকে পেলে?

 কলকাতা থেকেই নিয়ে বেরিয়েছিলাম স্যার। কখন কী জোটে—না জোটে..

ইউ আর সিম্পলি অসাম মিতিনমাসি, টুপুর খুশিতে আটখানা, বের করো। চটপট।

তার আগে জল নিয়ে আয়। বোতল ভর্তি করে।

শুধু খাবার নয়, দু’খানা টর্চ বেরোল ব্যাগ থেকে। একটা ফোর সেলের, ইয়া গোবদা। একখানা সরু লম্বা। সঙ্গে মোমবাতিও। দুটো বোতলে জল ভরে আনল নাসির। কম্পমান মোমবাতির আলোয় শুরু হল নৈশভোজ। আহা, খিদের কী মহিমা। শুকনো বানরুটির মাঝে শক্ত-শক্ত চিজ পুরে হাঁউহাঁউ চিবোচ্ছে সকলে। ম্যাকাডেমিয়া নাটস যেন অমৃত। বুমবুম যে বুমবুম, সেও বিনা প্রতিবাদে গপাগপ গিলছে। সাধে প্রবাদটা এসেছে, হাঙ্গার ইজ দ্য বেস্ট সস!

আহার শেষ করেই নাসির লম্বা হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু নাসিকা গর্জন। পার্থ বেরিয়েছিল তাঁবু থেকে। হঠাৎ চিৎকার করে ডাকছে, টুপুর, শিগগির আয়।

খোলা আকাশের নীচে গিয়ে দাঁড়াতেই টুপুরের গা শিরশির। শীতে নয়, এক অলৌকিক দৃশ্যে। ওপারের পাহাড়ের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ। স্নিগ্ধ আলোয় ভেসে যাচ্ছে ধরণী। চন্দ্রকিরণে নদীর জল চিকচিক। যেন রুপোর কুচি!

পার্থ উল্লসিত গলায় বলল, শব্দটা আমি পেয়ে গিয়েছি রে টুপুর।

কীসের শব্দ?

 সেই যে, কলকাতায় খুঁজছিলাম। রাত্রির বিশেষ রূপ। পাঁচ অক্ষর।

কী পেলে?

শব্দটা জোছনামত্তা। দেখ, জ্যোৎস্নায় কেমন মাতাল হয়ে আছে চরাচর। একেই তো রবিঠাকুর বলেছেন, যামিনী জোছনামত্তা।

সত্যিই তাই। জ্যোৎস্না যেন রাত্রিকে পাগল করে দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ কী করে যে এমন সুন্দর সুন্দর শব্দচয়ন করতেন! প্রকৃতির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে!

মিতিন তাঁবুর মুখে এসে ডাকছে, অ্যাই, চলে এসো তোমরা। ঠান্ডা লাগলে আর দেখতে হবে না।

দু’জনে ফিরেছে অন্দরে। পার্থ ঠাট্টা জুড়ল, টিকটিকিদেবী কি আগামীকালের পরিকল্পনা ভাঁজছিলেন?

হুম। কাল তো বিস্তর হাঁটা। রোড নিশ্চয়ই আরও টাফ হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য। পার্থ হাত উলটোল, এই রাস্তায় আসার কী দরকার ছিল তোমার দেবল বড়ুয়ার? তুমি তো আবার কায়দা মেরে বলছিলে, সে এমন কিছুর সন্ধানে এসেছে যা সোনাদানার চেয়েও দামি?

হ্যাঁ তো।

সেটা কী, আন্দাজ করতে পারলে কিছু?

এখন অনেকটাই নিশ্চিত। স্যান্ডর সোমা দ্য কোরোস, ওরফে কোরোসি সোমা স্যান্ডরের, পুঁথি নির্দেশিত কোনও এক মহাগ্রন্থের খোঁজে।

এই ভজকট নামটি কোত্থেকে পেলে? শুনি?

এক মহাপণ্ডিত। তিব্বতিরা যার নাম দিয়েছিল ফাই-গ্লিন-গি-গ্রুয়া-পা। অর্থাৎ, বিদেশি ছাত্র। সঙ্গে একটা উপাধিও ছিল। বোসাৎসু। মানে বোধিসত্ত্ব। বৌদ্ধদের জগতে এটাই সর্বোচ্চ সম্মান। তাঁর মৃত্যুর নব্বই বছর পরে জাপানিরাও তাঁকে হাঙ্গেরিয়ান বোধিসত্ত্ব নামে সম্মান জানায়।

দেবল এঁর খোঁজ পেল কোত্থেকে?

মনোজ বড়ুয়ার ঊর্ধ্বতন অষ্টমপুরুষ হেমকান্ত এই সাহেবের সঙ্গেই তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম নিয়ে গবেষণা করতেন। মনোজবাবুর বাড়িতে যে পুঁথিটি পাওয়া গিয়েছে, ইনিই তার রচয়িতা।

এই সাহেব যে সেই সাহেব, কী করে বুঝলে? মনোজবাবু তো নামটা বলতে পারেননি।

আজকের দিনে এটা কি খুব কঠিন? উইকিপিডিয়া ঘাঁটলেই তো অনেক তথ্য মেলে। সেখান থেকে মাথা খাঁটিয়ে দরকারিটুকু খুঁজে নিতে হয়, বুমবুমকে ভাল করে কম্বলে ঢেকে দিল মিতিন। সোজা হয়ে বলল, মনোজবাবু যে হেমকান্তর কথা বলেছেন, তিনি প্রায় দুশোবছর আগের লোক। উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, মোটামুটি ওই সময়েই কলকাতায় এসেছিলেন হাঙ্গেরিয়ান সাহেবটি। তখন আমাদের এশিয়াটিক সোসাইটির নাম ছিল রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি। সাহেব যে শুধু সেখানে গবেষণা করতেন তাই নয়, পাক্কা চারবছর সোসাইটির লাইব্রেরিয়ানও ছিলেন। কলকাতা থেকেও একবার তিব্বতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল তাঁর। তবে ডুয়ার্সে তাঁর ম্যালেরিয়া হয়, মারা যান দার্জিলিংয়ে। বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন সাহেব। তার মধ্যে বাংলাও ছিল।

অর্থাৎ তুমি একে একে দুই করেছ? কিন্তু ফুকতালের গুম্ফায় সাহেব একটি মহাগ্রন্থ রেখে গিয়েছেন, এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোচ্ছ কী করে?

প্রথমত, দেবলের মতো এক জ্ঞানপাগল ছেলের লাদাখে ছুটে আসা। কোনও বাধাবিঘ্ন না মেনে। হয়তো সে লেহ্-র দিকেও যেতে পারত। কিন্তু রাস্তা বন্ধ থাকাটা তাকে জাঁসকরের দিকে ঠেলে দেয়। তখনই সে খেয়াল করে, জাঁসকরেই জীবনের অনেকবছর কাটিয়েছিলেন স্যান্ডর। এবং সেটা এই ফুকতাল গুম্ফায়। কিংবা ফুকতালেই আসছিল। আগে থেকে না জানিয়ে।

হুমম সাহেব তা হলে এই রাস্তা দিয়েই গিয়েছিলেন?

তখন এই পথটা ছিল নাকি? জাঁসকর উপত্যকারই সেভাবে কেউ খবর জানত না। এদিকেও বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল, শুধু এইটুকু জ্ঞান সম্বল করে তিনি পাড়ি জমান এই প্রায় অগম্য উপত্যকায়। ফুকতাল গুম্ফাটি বাইরের পৃথিবীর সম্পূর্ণ অগোচরে ছিল তখনও। এটিও স্যান্ডরের আবিষ্কার।

স্যান্ডর তো দেখছি মহাখ্যাপা লোক?

সে আর বলতে। ওঁর জীবনী শুনলে তাক লেগে যাবে। স্যান্ডর ছিলেন হাঙ্গেরির ম্যাগিয়ার সম্প্রদায়ের মানুষ। জনশ্রুতি আছে, দুর্ধর্ষ হুনদের একটা শাখার বংশধর এই ম্যাগিয়াররা। পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জানতেই স্যান্ডর নাকি এশিয়ায় আসেন। গ্রিস, মধ্য-এশিয়া, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, সব চষে তারপর যান তিব্বতে। সেখান থেকে লাদাখ। এই জাঁসকরে ঢুকে ফুকতালে আস্তানা গাড়েন। প্রায় দেড়বছর ছিলেন ফুকতালের গুম্ফায়। তখন তিব্বতি ভাষাটাকে একেবারে গুলে খান। তারপর প্রচুর তিব্বতি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে আসেন কলকাতায়। ওখানে বসে রচনা করেন প্রথম টিবেটান টু ইংলিশ ডিকশনারি।

বুঝেছি, পার্থ ফুট কাটল, কিন্তু মহাগ্রন্থটা কী? যা পেতে দেবল দৌড়োচ্ছে?

সম্ভবত একটি গেথংপা।

সে আবার কী?

বিশেষ ধরনের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। যা মেনে বৌদ্ধদের নানান অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ নির্ধারিত হয়। অনেকটা পাঁজি টাইপ।

তা নিশ্চয়ই আরও পাওয়া যায়। স্যান্ডরসাহেবেরটার বিশেষত্ব কী?

ওতে নাকি প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র লিপিবদ্ধ আছে। উইথ টীকা। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুক্ত অনেক তন্ত্রমন্ত্রের উল্লেখও তাতে পাওয়া যায়। গ্রন্থটি উদ্ধার করা গেলে বৌদ্ধধর্মের উপর গবেষণার এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।

অ। তাতেই বা দেবলের কী লাভ?

কী বলছ তুমি? বিশ্বজোড়া খ্যাতি হবে দেবলের। বৌদ্ধধর্মের গবেষক হিসেবে অমর হয়ে থাকবে তার নাম। এ কি কম মূল্যবান?

বহুক্ষণ একটা প্রশ্ন টুপুরের মাথায় বুড়বুড়ি কাটছিল। বলেই ফেলল, এগুলোও সব উইকিপিডিয়ায় আছে?

না। গেথংপা সংক্রান্ত তথ্যটি সাপ্লাই করেছেন জনৈক বইপোকা। যাঁকে তোরা সবাই চিনিস৷

টুপুর ফ্যালফ্যাল তাকাল, কে গো?

আমাদের অবনীদা। তোর বাবা। মনোজবাবুর খবরটা শুনে তোর বাবাকে ফোন করেছিলাম। উনিই বললেন, লাদাখের কোনও গুম্ফায় নাকি এক সাহেবের লেখা গেথংপা আছে। তবে সেটা যে ঠিক কোথায়, এখনও নাকি তা রহস্যের আড়ালে। এক্ষেত্রেও আমি দুই আর দুই চার করছি।

কিন্তু… টুপুরের এখনও খুঁতখুঁতানি যায়নি। বলল, দেবলের অভিযানের রিজন নয় বোঝা গেল। এর মধ্যে দেবলের বিপদের সম্ভাবনা কোথায়? দুটো লোক ফলোই বা করছে কেন?

ওরে, গেথংপাটি উদ্ধার হলে তার বাজারমূল্য কী হবে, ভাবতে পারিস?

দাম তো হবেই কিছু। দু-চার লাখ তো বটে৷

পুরো গোল্লা পেলি। প্রাচীন পুঁথি, মূর্তি, ছবি কেনাবেচার একটা দুনিয়াজোড়া মার্কেট আছে রে হাঁদা। প্লেনে আসার সময়ে আমিও ওই বাজারে একটু ঢুঁ মারছিলাম। সেখানে এখনই ওই পুঁথি নিয়ে দামাদামি শুরু হয়ে গিয়েছে। সম্ভাব্য মূল্য দেখলাম এককোটি তিরিশলাখ।

অ্যাঁ? পার্থর স্বর ঠিকরে উঠল, ওই লোভেই কি দু’জন পিছু নিয়েছে?

ওরা পেশাদার ক্রিমিনাল। টাকা দিয়ে কেউ লাগিয়েছে।

কীভাবে বুঝলে?

এদের গতিপ্রকৃতি দেখে। কোটি টাকা দিয়ে কেনাবেচার লোক মোটরসাইকেলে ঘুরবে না। এই পথে যাওয়ার প্রাণের ঝুঁকিও নেবে না। আর যেরকম ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এরা মুভ করছে, তাতে পেশাদারিত্বই প্রমাণিত হয়।

আর-একটা কথা, পার্থ বিজ্ঞের মতো বলল, গেথংপার তো এখনও দর্শন নেই। অ্যান্টিক মার্কেটে তার দাম চলে আসে কী করে?

তিনটে পয়েন্ট তোমাদের দিতে পারি। তার থেকে ডিডিউস করো। একনম্বর, চন্দ্রকুমার ত্রিবেদী দেবল বড়ুয়ার ফেসবুক ফ্রেন্ড। দু’নম্বর, চন্দ্রকুমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি খুলেছেন মাত্র বাইশদিন আগে। তিননম্বর, ভুবনেশ্বরে চন্দ্রকুমার ত্রিবেদী নামে কোনও ঐতিহাসিকের ট্রেস মেলেনি।

মানে? চন্দ্রকুমারও জালি?

ভাবো। কম্বল মুড়ি দিয়ে। কাল ভোরে উঠে ফের হনটন, মাথায় রেখো।

আচমকা রহস্যের জাল বুনে দিয়ে শুয়ে পড়ল মিতিন। টুপুরই বা আর কী করে? মাটন রোলের মতো নিজেকে মোটা কম্বলে পেঁচিয়ে মগজটাকে এতালবেতাল ঘোরাল কিছুক্ষণ। শ্রান্ত শরীর কখন যে তলিয়ে গিয়েছে নিদ্রায়।

শেষ রাতে ঘুম ছুটে গেল। পার্থ ঠেলছে, অ্যাই টুপুর, কীসের একটা আওয়াজ হল না?

তাঁবুর দুয়ার থেকে মিতিনের ফিসফিস, আস্তে।… কী একটা যেন বাইরে ঘুরছে।

কী কাণ্ড, নাসিরও জেগে গিয়েছে। অস্ফুটে বলল, বাহার মত জাইয়ে ম্যাডাম। ডেঞ্জার হো সকতা।

বিপদ তো ভিতরেও হতে পারে, বলে পা টিপে বেরোল মিতিন। একহাতে জোরদার টর্চ, অন্যহাতে ট্রেকিং-এর লাঠি। পিছন পিছন বাকি তিনজন।

অকস্মাৎ টুপুরের রক্ত হিম। একটু দূরে বড় পাথরের উপর কী ওটা? ফটফটে চাঁদের আলোয় গায়ের ডোরাগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো।

বাঘ নাকি? এই বরফের দেশে?

নাসিরের গলা ঠকঠক, ইয়ে তো স্নো-লেপার্ড হ্যায়। বহুৎ খতরনাক। অ্যাটাক করলে আমাদের ছিঁড়ে খাবে।

মিতিন ঝাং করে টর্চ ফেলল তুষারচিতার মুখে। চোখ লক্ষ্য করে। অমনি কাজ হল। তীব্র আলোয় বেজায় চমকেছে চিতা। অস্বস্তিতে নড়ে উঠল যেন। এক-পা, এক-পা করে পিছোচ্ছে। আচমকা উলটো দিকে ঘুরে লাফ মারল। মাত্র কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে কোথায় যে মিলিয়ে গেল প্রাণীটা।

নাসির বিড়বিড় করছে, ইয়ে চিতা ইধর কিউ আয়া? এসময়ে তো নীচে নামে না খুব একটা?

পার্থ বলল, কিছু মরেছে নাকি? কাছাকাছি?

মিতিন বলল, উঁহু। স্নো-লেপার্ড শুধু নিজের শিকার করা প্রাণীই খায়।… কিছু মারল টারল নাকি?

বলতে-বলতে পায়ে-পায়ে এগোল মিতিন। চিতা যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ছিল, সন্তর্পণে উঠেছে সেখানে। টর্চ চালাচ্ছে এদিক-ওদিক।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কী একটা নড়ছে যেন? মানুষ না?

ওমা, তাই তো! পাথরের ওপাশে, বেশ খানিকটা নীচে, লোকটার একদম সামনে গিয়ে টুপুর শিউরে উঠেছে। আরে, এ যে দেবল বড়ুয়া।

.

১০.

তাঁবুতে বয়ে এনে তক্ষুনি দেবলের শুশ্রূষা শুরু করে দিল মিতিন। মারাত্মক জখম হয়েছে দেবল। কাঁধ নাড়াতেই পারছে না, তার পা দু’খানাও প্রায় অসাড়, পাঁজরেও চোট খেয়েছে জোর। ফেটে গিয়েছে কপাল, মুখমণ্ডলে রক্ত শুকিয়ে জমাট। গা-হাত-পাও ছড়ে গিয়েছে অজস্র জায়গায়।

ফাস্ট-এড বক্স খুলে তুলো দিয়ে মোছানো হল তার ক্ষত, পায়েও শক্ত করে ক্রেপব্যান্ডেজ বেঁধে দিল মিতিন। খুব কষ্ট হচ্ছে চিবোতে, তাও অল্প করে ম্যাকাডেমিয়া নাটস খেল দেবল। একটু-একটু করে চাঙ্গা হচ্ছে। মনোজ বড়ুয়া মিতিনদের পাঠিয়েছেন শুনে মুখ-চোখও যেন খানিক উজ্জ্বল ক্রমশ।

স্বর জড়িয়ে যাচ্ছিল দেবলের। তবু দুর্বল গলায় যেটুকু যা বলল, রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো। ইছরে পৌঁছে নাকি আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন চন্দ্রকুমার। উপায়ান্তর না দেখে ওখানেই গুম্ফায় আশ্রয় নিতে হয় দেবলদের। দু’রাত সেখানে কাটানোর পর যখন রওনা দিচ্ছে, দু’জন লোকের সঙ্গে দেখা হয় ইছরে। দেবলরা ফুকতাল যাবে শুনে তারাও সঙ্গী হতে চায়। প্রস্তাবটা নাকি মোটেই পছন্দ হয়নি চন্দ্রকুমারের, খারিজ করে দেন তৎক্ষণাৎ। লোকদুটো অমনি তর্ক জুড়ে দিল, ভয় দেখাতে লাগল। চন্দ্রকুমার তো রেগে কাঁই, তার সঙ্গে ওই দু’জনের হাতাহাতি বাধার উপক্রম।

অতিকষ্টে দেবলই ঝগড়া থামায়, তখনই খুইয়েছে নিজের মানিব্যাগ।

খেয়াল হয়েছে অনেক পরে। চারজনেই তখন ফুকতালের পথে। ফিরে গিয়ে ব্যাগ খুঁজবে ভাবছে, আবার চন্দ্রকুমারের শরীর গড়বড়। এই নদীর পাড়েই তারা তাঁবু খাঁটিয়েছিল, একটা বাড়তি দিন রয়ে গেল সেখানে। দ্বিতীয় রাতে হঠাৎ সেই দুই মক্কেল চড়াও হল দেবলদের উপর। কাঠের বাক্সে রাখা পুঁথিখানা তাদের চাই। তাদের হাতে খোলা রিভলভার দেখে চন্দ্রকুমার পর্যন্ত ভয়ে ঠকঠক। অগত্যা যে পুঁথিখানা সে যক্ষের মতো আগলে-আগলে চলছিল, চন্দ্রকুমারকেও যা সে দেখায়নি, ছেড়ে দিতে হল লোকদুটোকে। তার পরে যা ঘটল! পরদিন সকাল হতে না-হতেই লোকদুটো তাকে ঠেলে দিল পাহাড় থেকে! একেবারে নদীর কিনারে গিয়ে পড়েছিল। দেবল, প্রায় একদিন জ্ঞান ছিল না, চেতনা ফেরার পর কোনও রকমে ঘষটে ঘষটে ফেরার চেষ্টা করছিল। পাহাড়ি রাস্তাটায়। মাঝে-মাঝেই তো লোকজন যাতায়াত করে পথ দিয়ে, যদি তারা রক্ষা করে দেবলকে। তাতেও বিপত্তি, বাঘগোছের কোনও একটা প্রাণী খানিক আগে দেবলের কাছে এসেছিল, কী জানি তাকে শুঁকেই চলে গেল…

শুনতে-শুনতে টুপুরের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। পার্থ বলে উঠল, বোধহয় আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছিল লেপার্ডটা…

আর আমিও এই বিজন বিভুইয়ে প্রাণে বেঁচে গেলাম…

কিন্তু চন্দ্রকুমার? মিতিনের প্রশ্ন, তিনি গেলেন কোথায়?

লোকদুটো যা সাংঘাতিক… তাঁকেও হয়তো কোথাও ফেলে দিয়েছে। হয়তো তিনি মরেই গিয়েছেন।

হুম।… তা আপনার সব পরিশ্রম তো ব্যর্থ হয়ে গেল।

দেবলে, দাড়িভরা মুখখানা করুণ পলকে। চোখের কোল চিকচিক করছে।

ভুল তো আপনার, পার্থ গজগজ করছে, একা এলেই পারতেন। সঙ্গে চন্দ্রকুমারকে আনার কী প্রয়োজন ছিল?

দেবল ধরা গলায় বলল, অল্প ক’দিনের আলাপে উনিই তো যেচে আসতে চাইলেন। আমিও দেখলাম পুঁথিখানা আমার কাছে রাখা আর সেফ নয়।

কেন?

কাগজে খবরটা বেরোনোর পর থেকেই নানান খারাপ-খারাপ প্রস্তাব আসছিল যে। ফোনে। ইমেলে। কেউ দশলাখ টাকা দিতে চাইছে, কেউ অফার করছে বিশলাখ…তা সামান্য কিছু প্রাপ্তির লোভে তো স্যান্ডর কোরোসির ওই পুঁথি ছাড়তে পারি না। চন্দ্রকুমারের প্রস্তাব পেয়ে আমি তাই দেরি করিনি। অচেনা জায়গায় যাব, একজন উৎসাহী সঙ্গী মিলছে… উনিই টিকিট কেটে ডাকলেন…

অমনি বাড়িতে না জানিয়ে চলে এলেন? পার্থর গলায় এবার অভিভাবকের সুর, বাবা-মাকে টেনশনে ফেলে…

উপায় ছিল না। চন্দ্রকুমার যে অভিযানের কথাটা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে অনুরোধ করেছিলেন। ফিরে গিয়ে সবাইকে নাকি উনি চমকে দেবেন! দেবলের মুখখানা করুণ দেখাল, আমার স্বপ্নপূরণ হল না। বেহাত হয়ে গেল ফুকতালের পুঁথি।

আশা ছাড়বেন না। আমি তো আছি, অনেকক্ষণ পর মিতিনের গলা শোনা গেল। বাইরে সকাল ফুটছে, সেদিকে তাকিয়ে বলল, সবার আগে জানা দরকার, আপনি এখন কেমন ফিল করছেন? যেতে পারবেন ফুকতালে?

গিয়ে আর লাভ আছে কোনও?… ওরা হয়তো…

ওদের কথা ছাড়ুন।… আপনি কী করবেন সেটাই বলুন।

 কনুইয়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল দেবল, উহ করে উঠল যন্ত্রণায়। কাতর গলায় বলল, শরীর কি চলবে?

ক্ষণেক চিন্তা করে মিতিন ডাকল নাসিরকে। বলল, দেবলবাবুকে কি আমাদের খচ্চরের পিঠে বসিয়ে দেওয়া যাবে? আমার ছেলের সঙ্গে?

নাসির কাঁধ ঝাঁকাল, জরুর। এমন ভাবে রসসি বেঁধে দেব, বিনা তকলিফে দেবলজি পৌঁছে যাবেন।

বেচারা প্রাণীটা এত লোড টানতে পারবে তো? এই পাহাড়ি রাস্তায়?

আরামসে। এটাই তো ওর কাজ ম্যাডামজি। রুটি-রুজি।

ব্যস, সমাধান হয়ে গেল। বাঁধা-ছাঁদা সেরে একঘণ্টার মধ্যে রওনা। পাহাড়ি বাহনটিকে লাগাম ধরে সামলে-সামলে নিয়ে চলেছে নাসির। আজকের রাস্তা আরও বিঘ্নসংকুল, চড়াই উতরাই আরও বেশি, তবু যেন কালকের মতো কষ্ট হচ্ছে না। নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে কত যে কারুকার্য, নয়ন মেলে দেখতে-দেখতে ক্লান্তি যেন উবে যাচ্ছে। শুধু একটা বিচিত্র জায়গায় এসে হাড়ে কাঁপুনি লেগে গেল হঠাৎ। এক পাহাড় ছেড়ে আর-এক পাহাড়ে উঠছিল টুপুররা, মধ্যিখানে পাথুরে পাঁচিলের নীচে সকাল দশটায় কী যে ঘন অন্ধকার! ঠিক সেখানেই উপর থেকে ভীমবেগে নেমে আসছে হিমবাহ গলা জল, বিপুল গর্জন তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সরাপে। একটা ছোট্ট কাঠের ব্রিজ ধরে পেরোতে হল ধারা, পায়ের চাপে মড়মড় করছে দুর্বল পাটাতন। ওই আঁধার, জলের হুংকার, দুলন্ত সাঁকো, কেন যেন খচ্চরটিও আচমকা ছটফট করছে… সব মিলিয়ে এক করাল আতঙ্কের পরিবেশ। আশ্চর্য, কয়েকমিনিট পরে যেই নীল আকাশের দর্শন মিলল, আবার সব কিছু একদম স্বাভাবিক, হুস করে পালিয়ে গেল আকস্মিক ভয়ডর।

পথে একটা গ্রামও মিলেছে। মাত্র আট-দশ ঘর মানুষের বাস। লোকগুলো ভারী ভাল। টুপুর যেই না বলছে জুল্লে, অমনি সবাই মিলে কোরাসে ধ্বনি তুলছে, জুল্লে-জুল্লে। বুমবুমকে দেখে তারা কী খুশি, পাহাড়ি বউ মেয়েরা তাকে আদর করছে খুব। বুমবুমের সুবাদে না চাইতেই খাবার মিলল, গরম-গরম সেদ্ধ চটজলদি নুডলস যেন অমৃত হয়ে গলা দিয়ে নামছে। এই প্রায় নির্জন জনপদেও ছোট্ট একটা স্কুল। পাহাড়ি পথ ভেঙে দূর-দূর গাঁ থেকে পড়তে এসেছে জনা পনেরো-কুড়ি বাচ্চা, দেখে তো টুপুর অভিভূত। আহা রে, এরা তো এই দেশেরই ছেলেমেয়ে, অথচ কত কষ্ট করে যে এদের লেখাপড়া শিখতে হয়!

সরাপ নদী আগাগোড়াই চলছে টুপুরদের পাশে-পাশে। নদীর ওপারে পটে আঁকা ছবির মতো গ্রাম। মাঠেঘাটে চাষও হচ্ছে, এখনই গ্রামের মাটি গাঢ় সবুজ। লাল পাহাড়ের মাঝে ওই সবুজটুকু কী যে মধুর লাগে। চারটে নাগাদ থামল টুপুররা। বাঁয়ে একটা পোক্ত লোহার সেতু, সেখানে আর-একটা নদী এসে মিলেছে সরাপের সঙ্গে।

মিতিন বলল, এটাই তো পুর্ণে ব্রিজ। সোজা রাস্তাটা চলে গিয়েছে দারচায়।

নাসির সায় দিল, হাঁ ম্যাডামজি। এবার বাঁয়ে যেতে হবে। ব্রিজের ওপারে।

বেশি দূর এগোতে হল না। ব্রিজের একটু পরেই লোকালয়। এদিকের আর-পাঁচটা গ্রামের চেয়ে চেহারা অনেকটা আলাদা। পাকা দোতলা বাড়ি আছে, ঘরদোরও বেশি, এমনকী একটা রেস্তরাঁও মজুত। বড় সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘প্যারাডাইস কাফে’। নীচে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু লুংনাক ভ্যালি, ল্যান্ড অফ বুদ্ধ’।

বেরিয়ে এসেছেন এক মহিলা। হাতজোড় করে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বলে পার্থ দারুণ খুশি। এখানে ফারনিশড ঘর মিলবে, কমোড সমেত। পিছনেই আছে রুমগুলো। ঝটিতি বুক করে এল তিনখানা রুম। আজ রাতটা সে একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে চায়।

সারাদিন খচ্চরের পিঠে ঠায় বসা দেবল খুবই কাহিল। নাসির আর মিতিন মিলে তাকে ধরাধরি করে নামাল। বুমবুমও আবার অবতরণের সুযোগ পেয়ে মহা আহ্লাদিত। ঘুরে ঘুরে দেখছে রেস্তরাঁ। অতি সাধারণ বন্দোবস্ত, প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার আছে কয়েকখানা। দেবলকে এনে বসানো হল চেয়ারে। খানা বলতে আছে রুটি আর রাজমা, তবে বানাতে সময় লাগবে। এক্ষুনি মিলবে শুধু নুডলস, এই খাদ্যটিই পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি চালু।

পার্থ, বুমবুম আর নাসির এক টেবিলে, বাকিরা পাশেরটায়। সুড়ুৎ সুড়ুৎ নুডলস গিলতে গিলতে মিতিন কথা বলছিল মহিলার সঙ্গে। হিন্দি-ইংরেজির মাঝে একটা-দুটো স্থানীয় শব্দ মিশিয়ে। কাজে লাগতে পারে ভেবে কলকাতা থেকে বেরোনোর সময়েই নাকি শিখে এসেছে মিতিন। মহিলাই বললেন, এখানে নাকি দারচা-মানালি রুটের ট্রেকাররা বারোমাস ভিড় জমায়, বিদেশিদের আনাগোনাও লেগে থাকে বছরভর। কেউ সামনের মাঠে তাঁবু খাটায়, কেউ বা ওঠে হোটেল রুমে। তবে এখন তেমন কেউ নেই, শুধু তিনজন এসেছে পরশু। তারা দু’খানা রুম নিয়েছে বটে, কিন্তু গতকাল সকালে সেই যে দু-আড়াইঘণ্টার পথ ফুকতাল দেখতে বেরোল, এখনও ফেরেনি।

চন্দ্রকুমার আর বাকি দু’জন… সবাই এক দলে? টুপুর বেশ অবাক হয়েছে, ওরা না ইছরে ঝগড়া করেছিল? তার পরেও তো নাকি…।

স্রেফ নাটক। দেবলের কনফিডেন্সে থাকার তাল, পার্থ বিজ্ঞের মতো রায় দিল। ভুরু কুঁচকে মিতিনকে বলল, কিন্তু পাখি কি উড়ে পালাল? অন্য পথে?

মহিলা জানালেন ফুকতাল থেকে ইছরে যাওয়ার আর-একটি রাস্তা আছে, চা-আনমো-জেতাং হয়ে। কিন্তু ওই পথে ধস নেমেছে, যাওয়া আসাও বন্ধ।

ওয়াও। ক্যাচ, কট, কট, পার্থ পলকে উজ্জীবিত। দেবলকে বলল, আর আপনার ভাবনা নেই ভাই। স্যান্ডরসাহেবের বইটাও রক্ষা পেয়ে গেল।

দেবলের দু’চোখে আলো জ্বলে উঠল, ভরসা দিচ্ছেন?

আমি না, ভরসা দেবেন উনি, মিতিনকে দেখাল পার্থ। মিতিনকেই বলল, কী ম্যাডাম, আপনার গণনা কী বলছে? তারা কি অলরেডি গুম্ফা থেকে স্যান্ডরসাহেবের বইখানি হাতিয়ে ফেলেছে? না এখনও লড়ে যাচ্ছে?

দেবল চোখ পিটপিট করল, ফুকতালে? স্যান্ডর কোরোসির কী বই?

সে তো আপনিই ভাল জানেন, পার্থ হাসছে, ওই যে, গেতংপা না কী যেন নাম? ফুকতাল গুম্ফায় বসে নাকি রচনা করেছিলেন স্যান্ডরসাহেব?

ও তো একটা আদ্যিকেলে মিথ। ওরকম কোনও বই তো সত্যিই নেই৷

মানে? পার্থ প্রায় পড়ে যাচ্ছিল চেয়ার থেকে, কোনওমতে সামলেছে। বিস্ফারিত চোখে বলল, তা হলে আপনি ফুকতালে যাচ্ছিলেন কেন?

একবার পার্থকে দেখল দেবল, একবার মিতিনকে। তারপর ঢোক গিলে বলল, যে পুঁথিটি আমার কাছে ছিল, ওটি বাংলা ভাষায় রচিত একমাত্র গেতংপা। আমি যাচ্ছিলাম পুঁথিখানি ফুকতালে রেখে আসতে।

বলেন কী? কেন?

স্যান্ডর কোরোসি ওই নির্দেশই যে লিখে গিয়েছেন স্বহস্তে। পুঁথিটি যেন রক্ষিত হয় নদীপাড়ের সেই অনাদি প্রাচীন গুহা গুম্ফায়, যার প্রতিষ্ঠা করেছেন লামা জংখাপার শিষ্য গেলুপা বৌদ্ধ শ্ৰমণ গাংসেম-সেরাপ জাংপো, যেখানে বসে সাধনা করেছেন মহাগুরু পদ্মসম্ভব। সমস্ত শর্ত মেনে, ওই পুঁথিতে আঁকা দিক নির্দেশ মিলিয়ে তবে না মহান ফুকতাল গুম্ফার সন্ধান মিলেছিল।

ও। ফুকতাল গুম্ফায় তা হলে কিছুই লুকোনো নেই।

আমার পড়াশোনা তো তাই বলছে। অবশ্য গুম্ফাটি দর্শনীয়। গেলুপা বৌদ্ধদের খুব পবিত্র স্থানও বটে।

পার্থ হঠাৎ হাহা হেসে উঠল। হাসি তার আর থামছেই না। টুপুরেরও পেটে বুড়বুড়ি কাটছিল। এত সামান্য কারণে এমন একটা অভিযান, ভাবা যায়? দিল্লি থেকে যারা এসেছে কী ঠকানটাই না ঠকল তারা? এখন হয়তো দু’জনে, থুড়ি তিনজনে, ফুকতালে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে!

মিতিন হঠাৎ প্রশ্ন করল, তা আপনার আসার উদ্দেশ্যটি জানতেন চন্দ্রকুমার?

এড়িয়ে গিয়েছি। জানলে তিনি আসতেন নাকি?

কী বলেছিলেন তাঁকে?

সত্যি-মিথ্যের মাঝামাঝি। আমার পুঁথিটা শুধুই গাইডবুক। বিশেষ একটা প্রয়োজনে পুঁথিখানি অনুসরণ করে লাদাখের একটি গুম্ফায় যেতে হবে।

হুম, মিতিন কয়েক সেকেন্ড টরে টক্কা বাজাল টেবিলে। আঙুল থামিয়ে গম্ভীর ভাবে দেবলকে বলল, আপনি খুব টায়ার্ড। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আজ আর একদম বেরোবেন না। নাসিরভাই, আপনিও ওঁর কাছে থাকুন। প্লিজ।

দেবল মিনমিনে গলায় বলল, আমি কিন্তু এখন অনেকটা বেটার।

আহ, যা বলছি, করুন। অনেক গোল পাকিয়েছেন, এবার ঠান্ডা মাথায় জট ছাড়াতে দিন।

ধমকে কাজ হয়েছে, টেবিলে ভর দিয়ে উঠল দেবল। নাসির এসে ধরেছে তাকে, নিয়ে যাচ্ছে রুমে। মিতিনও গেল সঙ্গে। ফিরল মিনিটপনেরো পর। কাঁধে ঢাউস ব্যাগখানা চাপিয়ে। শীতল স্বরে বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

জবাব না দিয়ে মিতিন বলল, তোরা এখানেই থাকিস। এদিক ওদিক কোথাও ঘোরাঘুরির দরকার নেই।

পার্থ অপ্রসন্ন মুখে বলল, যদি চন্দ্রকুমার আর ওই লোকদুটো চলে আসে, তাদের সঙ্গে আলাপ জমাব কি? না এখানেই গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব?

পার্থকে একবার দেখে নিয়ে মিতিন বলল, রাতে না ফিরলে চিন্তা কোরো না। সকালে ফুকতাল রওনা দিয়ো।

হনহনিয়ে হাঁটা দিল মিতিন। দু’মিনিটে গ্রাম ছাড়িয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে।

 টুপুর আর পার্থ হতবুদ্ধি। বুমবুমও ভ্যাবাচ্যাকা। কারও কিছু করার নেই, বসে-বসে সময় কাটাও। হাঁ করে আকাশ দেখছে টুপুর। একসঙ্গে তিন-চার রকমের নীল ছড়িয়ে আছে আকাশময়। হঠাৎ নীলের মাঝেই সাদা বিন্দু। আস্তে-আস্তে বড় হচ্ছে বিন্দুটা। কখন যে বিন্দুটাকে ঘিরে একটা মেঘ তৈরি হয়ে গেল! কী আশ্চর্য, মেঘটা ছোট হচ্ছে যে! দেখ না দেখ, মেঘটা মিলিয়েই গেল শূন্যে! এমন দৃশ্য বুঝি শুধু এখানেই মেলে! ঠিক যেন কেসটার মতো। একটা পুঁথি ঘিরে দানা বাঁধল রহস্য, আবার যেন উবেও গেল! কেন যে এখনও ছোটাছুটি করছে মিতিনমাসি!

ভাবনার মাঝে কখন যেন অন্ধকার নেমেছে। বইছে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। পার্থ বুমবুম সামনের মাঠে হাঁটছিল, এবার তোড়জোড় করছে ঘরে যাওয়ার।

তখনই হঠাৎ মাসির গলা। কার সঙ্গে যেন কথা বলতে বলতে ফিরছে। সামনে আসতেই চেনা গেল। চন্দ্রকুমার। সঙ্গে দু’জন গাঁট্টাগোট্টা লোক। তিনজনেরই মুখ শুকনো, চেহারা যেন ঝোড়ো কাক। মিটিমিটি হেসে মিতিন আলাপ করিয়ে দিল টুপুরদের সঙ্গে। তারপর হাসি মুখেই সবাইকে নিয়ে চলেছে দেবলের ঘরে।

দরজা ভেজানো ছিল। ঠেলে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে আসছিল তিনমূর্তি। তক্ষুনি যেন বদলে গেল মিতিন। ব্যাগ খুলে কী বের করছে মাসি? রিভলভার!

মিতিনের গলা বজ্র কঠোর, ডোন্ট মুভ। ডোন্ট ফোর্স মি টু শুট। এবার সুড়সুড় করে আপনাদের রুমে চলুন।… নাসিরভাই, ফোর্স কখন পৌঁছোচ্ছে?

অমনি নাসিরের তুরন্ত জবাব, এনি মোমেন্ট ম্যাডামজি। কালই তো পদুম থানায় খবর চলে গিয়েছে। রাত্রের মধ্যে তো আসছেই।

গুড। এঁদের আপাতত রুমে পুরে তালা দিয়ে দিন, মিতিনের গলায় পুরো পুলিশি মেজাজ, আর হ্যাঁ, ওঁদের ফায়ার আর্মসগুলোও জিম্মা করে নিন। মোটরসাইকেলের টুলবক্সটাও। কেসের জন্য ওটা খুব ভাইটাল। ভিতরে একটা পুরানা কিতাব আছে, সাবধানিসে রাখনা।

ইয়েস ম্যাডামজি। আমি সব নিয়ে রাখছি।

নাসির যেন অফিসারের বাধ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট। নির্ঘাত মাসি ট্রেনিং দিয়েছে, বুঝে গেল টুপুর। মাসির আকস্মিক ভোলবদলে তিনমূর্তি কিন্তু বেজায় নার্ভাস। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কারও মুখেই বাক্যি সরছে না।

মিতিন এবার চন্দ্রকুমারের দিকে ফিরেছে। একপা-একপা করে একদম সামনে গিয়ে হিমেল স্বরে বলল, মি. ত্রিবেদী, আশা করি দরজা-জানলা ভেঙে পালানোর ছেলেমানুষি করবেন না। আপনাদের জেনে রাখা ভাল, ইছরে রেখে আসা মোটরসাইকেলটিও এখন পুলিশের হেফাজতে।

এবার কথা ফুটেছে চন্দ্রকুমারের। মিনমিন করে বললেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের অপরাধটা কী?

কতগুলো বলব? মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেবল বড়ুয়ার বিশ্বাস অর্জন, একটি ধর্মীয় স্থান থেকে মূল্যবান পুঁথি চুরির চক্রান্ত, একটি নিরীহ যুবককে হত্যার ষড়যন্ত্র… এতক্ষণ চোস্ত হিন্দিতেই হুকুমদারি চালাচ্ছিল মিতিন। আচমকা নিখাদ বাংলায় বলল, আচ্ছা চন্দ্রকুমারবাবু, গুপ্তপুঁথির আশায় আপনি মনোজ বড়ুয়াকে এখনও পর্যন্ত কত টাকা দাদন দিয়েছেন? পাঁচলাখ, দশ, কুড়ি? নাকি আরও বেশি? কিন্তু সেই পুঁথিটাই তো নেই। সব টাকা জলে গেল তো!

মিতিনমাসির সপ্রতিভ অভিনয়ে মুগ্ধ হচ্ছিল টুপুর। তিনমূর্তির একটু একটু করে নুয়ে পড়াও মন্দ লাগছিল না। কিন্তু শেষ অংশটিতে টুপুর স্তম্ভিত। মুখ হাঁ হয়ে আছে পার্থমেসোর, বন্ধ হচ্ছে না। বুঝি বিস্ময়ে আটকে গিয়েছে চোয়াল।

এ যে অবিশ্বাস্য! নাকি লোভের দুনিয়ায় এটাও স্বাভাবিক? মাথায় ঢুকছিল না টুপুরের।

.

১১.

সন্ধে নেমেছে পদুমে। টুরিস্ট বাংলোর বিছানায় হাত-পা মেলে দিয়েছিল টুপুর। চোখ বুজে অভিজ্ঞতা সাজাচ্ছিল মনের ভাঁড়ারে। বারবার ভেসে উঠছে। ফুকতালের সেই বিচিত্র গুম্ফা। পাহাড়ের মুখে ঠিক যেন একটা মৌচাকের মতো ঝুলছে। ভিতরটাও কেমন রহস্যমাখা। প্রায় অন্ধকার ঘরে জ্বলছে মোমবাতি, মোঙ্গলিয়ান ছাঁদের বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে নিমীলিত চোখে ধ্যান করছেন হলুদ টুপির লামারা, অদ্ভুত একটা ঘি-পোড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে, গম্ভীর একটা ধ্বনি ভাসছে বাতাসে। কত যে ছোট-ছোট কুঠুরি গুম্ফায়! আলোবাতাসহীন ওই সব ঘরগুলোতেই কী প্রসন্ন মুখে বাস করছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর দল! ফুকতাল যাওয়ার রাস্তাটাও যে কী বিচিত্র! ঘন-ঘন পাহাড়ি বাঁক, কোথা থেকে যে উদয় হচ্ছে নতুন নতুন পাহাড়। সেগুলোর মাথাও যেন অবিকল কোনও মন্দিরের চূড়া। অত খাঁজখোঁজ পেরিয়ে অমন একটা অগম্য জায়গায় কেন যে দু-আড়াই হাজার বছর আগে আস্তানা গেড়েছিল মানুষ? ভগবানের আরাধনা করতে হলে এত নির্জনতা লাগে? নীচের ওই সুন্দর খাজিয়ার নদীটা নাকি বছরে আটমাস বরফ হয়ে থাকে, ভাবা যায়!

কী রে টুপুর, লেটে গেলি নাকি? খুব টায়ার্ড?

পার্থমেসোর গলা। মেসোর পিছন পিছন গোটা দলটা। তিনদিনে দেবল অনেকটাই সমে ফিরেছে, হাঁটছে টলোমলো পায়ে। নিজেই চেয়ার টেনে বসল। স্যান্ডর কোরোসির বাংলা গেতংপাটি স্বহস্তে ফুকতাল গুম্ফার প্রধান লামাকে সমর্পণ করতে পেরে তার মন এখন সদাই প্রসন্ন, উবে গিয়েছে ব্যথাবেদনা। নাসির তো ভক্ত বনে গিয়েছে মিতিনমাসির, তার ছায়ার মতো ঘুরছে সারাক্ষণ। তিন বজ্জাতকে দিনভর পাহারাদারির সময়েই বুমবুম আর নাসিরে ভারী দোস্তি হয়েছে, এখনও কী এক বিচিত্র ভাষায় দিব্যি গল্প করছে দু’জনে।

পার্থ বিছানায় বসে তারিফের সুরে বলল, তোর মাসি একটা খেল দেখাল বটে। শুধু ভয় দেখিয়েই দু-দুটো দিন একটা ঘরে আটকে রাখল তিন মক্কেলকে!

মিতিন হাসছে, ওইটুকু ঝুঁকি নিতেই হয়েছিল। জানিই তো গুন্ডা-বদমাশ ক্রিমিনালরা বেসিক্যালি ভিতুই হয়। কারণ প্রকৃত সাহসী মানুষরা সাধারণত অপরাধপ্রবণ হয় না। তা ছাড়া বুঝেই গিয়েছিলাম, এরা খুন-খারাপির লোক নয়। তত সাংঘাতিক হলে, দেবলকে কি জ্যান্ত ছেড়ে যেত? আর পুঁথিটা না পেয়ে ওরা তখন এতটাই হতাশ, ওদের আর প্রতিরোধের ক্ষমতাই ছিল না।

মিঃ ওয়াংচুক কিন্তু যথেষ্ট ঝুলিয়েছিলেন। এলেনই তো দু’দিন পর।

যুক্তি দিয়ে ভাবো। ওদের পাকড়াও করার পরদিন সকালে চিঠি পাঠালাম। তা গ্রামের সেই লোকটাকে তো পদুমে পৌঁছোতে হবে। উনি তো তার পরদিনই পড়িমড়ি করে হাজির হয়েছিলেন। এই পাণ্ডববর্জিত দেশে সেটাই যথেষ্ট তাড়াতাড়ি মশাই। তিনজনকেই গারদে পুরেছেন, ব্যস এতেই আমি নিশ্চিন্ত।

তা বটে, পার্থ মাথা নাড়ল। পরক্ষণে চোখ সরু করে বলল, এবার কি মহারানিকে একটা-দুটো প্রশ্ন করতে পারি? আশা করি আর এড়িয়ে যাবে না?

মিতিন ঠোঁট ওলটাল, শুনি, কী জানতে চাও?

মনোজবাবুর স্টেটমেন্টে অনেক গলতি ছিল, মানছি। কিন্তু তাঁকে এই দেবলদের অভিযানের সঙ্গে লিঙ্ক করলে কীভাবে?

গোটা ঘটনাটা মনে-মনে সাজাতে হয়েছে। হয়তো অবিকল এভাবেই ঘটেনি, তবু অনেকটাই মিলে যাবে।

কীরকম? বাড়িতে পুঁথিটি মেলার পর শুধু দেবলবাবুই যে লোভনীয় অফার পেয়েছিলেন, তা নয়। মনোজবাবুকেও তো অনেকে অ্যাপ্রোচ করেছে। সেরকমই একজন লোক চন্দ্রকুমার ত্রিবেদী। কলকাতার একজন সন্দেহজনক অ্যান্টিক ডিলার, আন্তর্জাতিক বাজারেও যাঁর কিঞ্চিৎ পরিচিতি আছে। সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, চোরাচালানদার বলেই তাঁর খ্যাতি। বাড়িতে একটা পুঁথি আবিষ্কার হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি নেমে পড়লেন আসরে। স্যান্ডরসাহেবের গুম্ফায় লুকোনো গুপ্তপুঁথি সম্পর্কিত প্রবাদটি তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। বাজারদরও। তাই ঐতিহাসিকের মিথ্যে পরিচয়ে ভালমানুষ ছেলেটার সঙ্গে মিতালি পাতালেন ফেসবুকে। দেবলের কাছে ভাসা-ভাসা কিছু তথ্য পেয়ে তিনি এবার গোপনে যোগাযোগ করলেন বাবার সঙ্গে, তাঁকে মোটা একটা অগ্রিম ধরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তও হলেন মোটামুটি। কিন্তু ছেলেটিকে তো নিয়ে যেতে হবে সেই গুম্ফায়। মনোজবাবুই তখন ব্যবস্থা করলেন দেবলকে পাঠানোর। চন্দ্রকুমারের নাম করে প্লেনের টিকিটও এসে গেল দেবলের হাতে।

দেবল নীরবে শুনছিল। মৃদু স্বরে বলল, আমি কিন্তু এসব কিছু জানতাম না, বিশ্বাস করুন। টিকিটও ছিল চন্দ্রকুমারবাবুর কাছে। দমদম এয়ারপোর্টেই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।

টুপুর বলে উঠল, ও, তুমি বলছ ছেলের জন্য মনোজবাবুর দুশ্চিন্তা ধাপ্পাবাজি? কিন্তু তোমাকে দু’লাখ টাকার চেক দেওয়াটাও তো হিসেবে মেলে না মিতিনমাসি।

ভাবনাটা আরও ছড়া, মিতিন সামান্য আনমনা সুরে বলল, মনোজ ছেলেকে লুকিয়েই টাকাপয়সার ডিল করেছেন বটে, কিন্তু তিনি তো বাবা। চন্দ্রকুমারের সঙ্গে দেবলকে পাঠানোর পরই তাঁর মনে হল, কাজটা হয়তো ঠিক হয়নি। যে লোক অবলীলায় কিছু না পেয়েই দশলাখ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে যায়, সে তো টাকার জন্য তাঁর ছেলেকে হাপিসও করে দিতে পারে। ছেলে চোখের আড়াল হওয়ার পর ভয়টা আরও বেড়ে গেল মনোজের। তাই আমার কাছে দৌড়ে আসা।

 পার্থ তেরচা চোখে তাকাল, তুমি আন্দাজ করলে কীভাবে মনোজবাবুই দেবলবাবুদের কাশ্মীর পাঠিয়েছেন?

উঁহু, এটা অনুমান নয়, মিতিন ভুরু নাচাল, একটু দুষ্টুমি করতে হয়েছে মশাই।

কীরকম?

শঠে শাঠ্যং, দেবলকে একবার দেখে নিয়ে মিতিন চোখ টিপল, মনোজবাবুর কার্ডে ওঁর ইমেল আই ডি ছিল। ওঁর মেলগুলো হ্যাক করলাম। লালবাজারের সাইবার ক্রাইম ডিটেকশন ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে। অনিশ্চয়বাবুর সৌজন্যে।

হ্যাঁ, কাশ্মীরগামী বিমানের টিকিট ওঁর ইনবক্সে মজুত। চন্দ্রকুমারের নামও তো ওখানেই মিলল। দেবলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ফ্রেন্ড লিস্ট থেকেও পেলাম নামটা। অনিশ্চয় মজুমদার চন্দ্রকুমারের আসল পরিচয়টা কনফার্ম করলেন। যদিও অতীতে শ্রীঘর বাস করেননি চন্দ্রকুমার, কিন্তু পুলিশের কালো তালিকায় তাঁর নাম তো আছেই। এর পরেও অঙ্ক না মিলে পারে?

ও। নাটকটা জেনেই প্লেনে উঠেছিলে? তার পরেও অত তাড়াহুড়োর কী দরকার ছিল?

ছিল মশাই, মিতিন একটু গম্ভীর হল, বাবার সাইকোলজি স্টাডি করতে পেরেছিলাম বলেই গোড়া থেকে অত সিরিয়াস ছিলাম, কোথাও সময় নষ্ট করতে চাইনি। বুঝতে পারছিলাম দেবল যে-কোনও মুহূর্তে বিপদে পড়বে। প্লাস উনি একটা হিন্টও দিয়েছিলেন। দেবল নাকি তাঁকে ফোনে বলেছে তার পিছনে ফেউ লাগতে পারে।

দেবল অবাক মুখে বলল, কিন্তু আমি তো বাবাকে ফোন করিনি। চন্দ্রকুমার মানা করেছিলেন।

ফোন চন্দ্রকুমার নিজেই করেছিলেন। কাশ্মীরের হোটেল থেকে। ওটাই তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল। তখনই মনোজবাবু আভাস পেয়েছিলেন, চন্দ্রকুমার তাঁর আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের সহকারীদের দিল্লি থেকে আমদানি করছেন। নার্ভাস হয়েও দু’-তিনদিন দোলাচলে ভুগে অবশেষে মনোজবাবু বেসরকারি গোয়েন্দার শরণাপন্ন হন, মিতিন অল্প হাসল, কী দেবলবাবু, আমার হিসেবে কি ভুল আছে মনে হয়?… বাড়ি গিয়ে স্বচ্ছন্দে মেলাতে পারেন। আর বোধহয় লুকোছাপা করবেন না মনোজবাবু।

জবাব দিল না দেবল। মাথা নামিয়ে বসে। বোধহয় বাবার কৃতকর্মের লজ্জা এড়াতে।

বাংলোর কর্মচারীটি এসে ডাকছে। রাতের আহার প্রস্তুত, পরোটা আর সবজি, মিতিনরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলে তারও ছুটি মেলে।

গুটিগুটি পায়ে ডাইনিং হলে যাচ্ছে টুপুররা। পথে পার্থ থামাল টুপুরকে। নিচু গলায় বলল, তোর মাসির তো লস হয়ে গেল রে?

টুপুর ফিসফিস করল, কেন গো?

পুঁথি নেই, চন্দ্রকুমার অ্যান্ড কোম্পানি জেলের লপসি খেতে চলেছে, কলকাতায় ফিরে পাঁচলাখের বাকি টাকা চাইতে গেলে মনোজবাবু না পেটান।

মিতিনের ঠিক কানে গিয়েছে কথাটা। মুচকি হেসে বলল, আমার হিসেব কিন্তু বলছে টাকাটা মিলবে। তবে মনোজবাবুর আর দর্শন পাব কিনা বলা কঠিন।

এমনটা কী করে সম্ভব? টুপুরের মাথায় ঢুকছে না।

আশ্চর্য, তাই কিন্তু ঘটল। দেবলকে নিয়ে কলকাতায় ফেরার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দরজায় দেবল। হাতে তিনলাখ টাকার চেক। মনোজ বড়ুয়া ধন্যবাদ জানিয়েছেন মিতিনকে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব নয়।

মিতিনমাসির গণনায় মোহিত টুপুর। কিন্তু সহসা উদাসও। দরজায় দেবলকে দেখামাত্র আবার যে মনে পড়ে গিয়েছে সেই অসামান্য রূপবান উপত্যকা। লাল পাহাড়ের দেওয়াল ঘেরা, ছাদ সেখানে নীল আকাশ। তাদের আলোয় মোহিনী হয়ে ওঠে রাত, তুষারচিতাও সেখানে হিংস্রতা ভুলে মানুষকে মারতে ভুলে যায়। বাতাসের তুলি দিয়ে পাহাড়ের ক্যানভাসে সেখানে রং বোলায় প্রকৃতি। মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের ফারাক সেখানে এক ফুটও নয়, অথচ নিসর্গের মোহে মনেই পড়ে না সে কথা।

এমন অপরূপ জাঁসকর উপত্যকাতেও কেন যে অকারণে লোভের থাবা বাড়ায় মানুষ! ভাবলেই ব্যথিয়ে ওঠে টুপুরের মনটা। এখনও।