৯-১০. সন্ধের কলকাতা

সন্ধের কলকাতা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে হালকা জ্যাম। গাড়িতে মিতিনের পাশে টুপুর শুকনো মুখে বসে। দু-দুটো দিন বেশ রোমাঞ্চের স্বাদ মিলেছিল, আজ বাড়ি ফিরে আবার শুরু হবে পুরনো রুটিন। সেই অ্যালজেব্রা, সেই জ্যামিতি, সেই ইতিহাস, ভূগোলের নীরস জগৎ। উফ, ভাবলেই কান্না পায়!

মানিকতলার মোড় পেরিয়ে খানিকদূর গিয়েই গাড়ি ডাইনে ঘোরাল মিতিন। একটা আধোচেনা রাস্তায় ঢুকছে।

টুপুর একটু অবাক হয়েই বলল, কী গো, আগে অন্য কোথাও যাবে নাকি?

মিতিনের সংক্ষিপ্ত জবাব, হুঁ।

তোমার কোনও কাজের ব্যাপারে?

 শুধু আমার নয়, তোরও কাজ।

মানে?

আমরা বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিটে যাচ্ছি। আলোকচাঁদ শেঠের বাড়ি।

হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল টুপুরের। কোনওক্রমে উত্তেজনা দমন করে বলল, কেন গো মাসি? মূর্তিটা কি তবে উনিই…

যদি সত্যিই চুরিটা হয়ে থাকে, তবে ওঁরই কালপ্রিট হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। আমার মেথড অফ এলিমিনেশন তো তাই বলছে?

যদি ঘটে থাকে মানে? চুরিটা কি হয়নি?

দেখা যাক। সময়ই বলবে।

কী হেঁয়ালি মার্কা উত্তর। পরের প্রশ্নটা করে উঠতে পারল না টুপুর, তার আগেই আবার বাঁক নিয়েছে গাড়ি। এবার ঢুকছে একটা সরু রাস্তায়। ও মা, সামনেই তো পরেশনাথের মন্দির। ওই তো মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। এটাই তবে বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিট!

গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে একঝলক মন্দিরটা দেখল টুপুর। তাদের বাড়ি থেকে মোটেই তেমন দূর নয়, তবু সেই ছেলেবেলার পর আর আসা হয়নি। পাশাপাশি আরও তিনটে জৈন মন্দির। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার গুণে বেশ একটা পবিত্রতার ভাব আছে প্রতিটি মন্দিরে। কিন্তু ছেলেবেলার সেই মুগ্ধতা যেন আর জাগছে না।

মিতিন মন্দিরের পাশের রাস্তা ধরে এগোচ্ছে গাড়ি নিয়ে। মন্দির পেরোতেই চওড়া হয়েছে রাস্তা। আবার ক্রমশ সরু। সেই পথের ধার ঘেঁষে একটা মরচে ধরা লোহার ফটকের সামনে পার্ক করল গাড়ি। স্টিয়ারিং লক করে ডাকল টুপুরকে, নেমে পড়।

লোহার গেটের ওপারে এক দর্শনীয় বাড়ি। বাহারি দেখনদারির জন্য নয়, স্রেফ প্রাচীনত্বর কারণেই চোখ আটকে যায়। ইস, কী চেহারা! একসময়ের গোল গোল ডোরিক থামগুলো থেকে ইটের দাঁত বেরিয়ে আছে, রঙের বালাই নেই, প্লাস্টার খসে গিয়ে খোবলা খোবলা হয়ে গিয়েছে, গা-ময় ঝুলের আস্তরণ জালের মতো ঢেকে ফেলেছে জীর্ণ গৃহের সর্বাঙ্গ। শহরে এমন বাড়ি টিকে আছে এখনও!

টুপুর সংশয়ের সুরে বলল, এ বাড়িতে মানুষ থাকে নাকি?

হ্যাঁ রে বাবা, আছে লোক। ওই দ্যাখ, উপর দিয়ে আলো।

তাই তো ঘুলঘুলি দিয়ে ক্ষীণ একটা দীপ্তি যেন আসছে বটে। কিন্তু এই বাড়িতে জগৎশেঠের বংশধর বাস করছে এমনটা কল্পনা করা বেশ কঠিন।

মিতিন নিচু গলায় বলল, ঘাবড়ে গেলি নাকি? সাবধানে পা ফেলে আয়। আমার পিছন পিছন। বলেই লোহার গেট ঠেলল মিতিন। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে খুলে যেতেই পলকা বিস্ময়। একটা চকচকে বিদেশি গাড়ি দাঁড়িয়ে। আলোকচাঁদের?

চওড়া ভাঙাচোরা পাঁচধাপ সিঁড়ি মাড়িয়ে একটা বারান্দায় উঠল দু’জনে। সামনে আটফুটি দরজা, পাল্লার মাথায় সার বসানো রঙিন কাচের অর্ধবৃত্ত। জলুস নেই কাচের, কিন্তু আভিজাত্যের গরিমা ঠিকরোচ্ছে যেন।

দরজার ফ্রেমে কলিংবেল। টিপল মিতিন। কোনও সাড়াশব্দ নেই। অনন্ত প্রতীক্ষার পর আবার আঙুল রেখেছে সুইচে, খুলে গিয়েছে পাল্লা। এক মাঝবয়সি ফরসা লম্বা টাকমাথা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে। রীতিমতো কর্কশ ভঙ্গিতে প্রশ্ন জুড়লেন, কী চাই?

টুপুরকে অবাক করে দিয়ে মিতিনও পালটা তেরিয়া গলায় বলল, আপনিই শেয়ার ব্যবসায়ী আলোকচাঁদ শেঠ?

হ্যাঁ। তো?

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে আসছি। একটা চুরির তদন্তে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।

আলোকচাঁদ পলকের জন্য থতমত। পরক্ষণে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, কী চুরি? কার চুরি? আমি কোনও চুরিটুরির খবর রাখি না।

বাজে কথা থামান। আপনার কাকার কোটি টাকার মূর্তি চুরি হয়ে গেল, আপনি তা জানেন না? মিতিনের স্বর আরও কঠোর হল, আপনি কি চান লালবাজারে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে আপনাকে জেরা করি? ওখানে কিন্তু বয়সটয়স মানে না, যাকে তাকে থার্ড ডিগ্রি দেয়।

আলোকচাঁদ মিনিটখানেক রা কাড়লেন না। নিশ্বাস ফেলছেন জোরে জোরে। তারপর আচমকাই স্বরে মধু, আসুন, ঘরে বসে কথা বলি।

অন্দরটা বাইরের মতো হতশ্রী নয়। ঢুকেই অনেকটা খোলা জায়গা, হিন্দি সিরিয়ালের সেটের মতো। বেশ কয়েকটা ভারী সোফা শোভা পাচ্ছে সেখানে। তবে চেহারায় আদ্যিকালের ছাপ৷ একটা পেল্লাই সাইজের দেওয়াল ঘড়িও দৃশ্যমান। টিউবলাইটের আলোয় বুঝতে অসুবিধে নেই ঘড়ির পেণ্ডুলামটি অচল। বৈঠকখানার সাজসজ্জার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘড়ির সময়ও থেমে আছে বহুকাল। উঁচু কড়িবরগার সিলিং যেন সাক্ষী দিচ্ছে দূর অতীতের।

টুপুরের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছেন আলোকচাঁদ। মিতিন গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, ও আমার বোনঝি। ভবিষ্যতে পুলিশে জয়েন করতে চায়। তাই ওকে সঙ্গে রাখি।

তা বেশ তো। চটপট একটা কাঠ কাঠ হাসি ফোঁটালেন আলোকচাঁদ। বিনয়ী স্বরে বললেন, কী জানতে চান আমার কাছে?

বেশি ধানাইপানাই করবেন না, মিতিন তেজের সঙ্গে বলল, সাফ সাফ বলুন দেখি, আহিরচাঁদের মূর্তিটি গেল কোথায়?

সে তো চুরির জন্য কে যেন অ্যারেস্ট হয়েছে শুনলাম।

তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। কারণ সে মূর্তি নেয়নি। খবর আছে, বিকেলে একজন মাত্র লোক আহিরচাঁদজির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। উনি তখন ছিলেন না, ওঁর ঘরে অনেকক্ষণ একা বসেছিল লোকটা। সে যখন বেরিয়ে যায়, দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়েছিল, তাই দরজার কড়ায় তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। সে যদি দরজা হাট করে রেখে দিত, তা হলে হয়তো তাকে ধরাই যেত না। কেন যে সে এমন একটা সিলি মিসটেক করল…

বাহ, এখন তো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলালেই আসামি ধরা পড়ে যাবে।

আলোকচাঁদের নির্বিকার মন্তব্যে মিতিন যেন ঈষৎ অপ্রতিভ। মাসি যে কায়দা করে চালটা দিয়েছিল, এতেই সাধারণ অপরাধীর ফেঁসে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই আলোকচাঁদ তো দিব্যি কেটে বেরিয়ে গেলেন! নাকি ইনি সত্যিই নিরপরাধ?

মিতিন সহসা সুর বদলেছে, মুখে একটা হাসি টেনে বলল, সে তো আমরা জানিই। তবু আপনাকে সন্দেহের তালিকায় বাইরে আনতে গেলে একটুখানি বিরক্ত তো আপনাকে করতেই হবে। যদি আপনি সহযোগিতা করেন…

কীভাবে?

আপনার বাড়িটা একবার তল্লাশি করতে চাই।

আপনার ওয়ারেন্ট আছে নিশ্চয়ই?

আজ্ঞে না। সার্চটা আমি আন-অফিশিয়াল রাখতে চাই, মিতিন আচমকা গলা খাদে নামাল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, আহিরচাঁদজির সঙ্গে আমার বাতচিত হয়েছে। উনি বলেছেন, মূর্তি ফেরত পেলে উনি চুরির কেসটা তুলে নেবেন।

হঠাৎ মাসি-বোনঝিকে চমকে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন আলোকচাঁদ। তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, কাকা ভেবেছেনটা কী, অ্যাঁ? আমাকে উনি চোর প্রমাণ করতে চান? আসল চোর তো কাকা নিজে।

মানে? একজন সাধুসন্ত মানুষের নামে এ কী অপবাদ!

হুঁ, সাধু! ওই মূর্তিটা কি ওঁর? আমাদের পরিবারের জিনিসটি তো চুরি করেই নিয়ে গিয়েছিলেন? সেই মূর্তি যদি আমি নিয়েও আসি, সেটাকে কি চুরি বলে?

আহিরচাঁদজি তো সেই মূর্তিটা ফেরত দিতেই সেই রনকপুর থেকে…

তাই তো জানতাম। এখন তো দেখছি ওঁর মতলব অন্য। উনি এসেছেন নিজের ধান্ধায়।

কী বলছেন? উনি কলকাতায় একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন…

বিলকুল বকোয়াস। তেমন ইচ্ছে থাকলে রনকপুর থেকে আসার আগেই তো জানাতেন। কলকাতায় পা রাখার পরের দিন হঠাৎ মন্দির বানানোর বাসনা জেগে উঠল! আলোকচাঁদ মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, নেহি জি, জরুর ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।

কী হতে পারে?

ও আমি জানি না। লেকিন আমি ভি মারোয়াড়ি। শেঠ মানিকচাঁদ, ফতেচাঁদের বানিয়া রক্ত আমার শরীরেও তো থোড়াবহুত আছে। তিরিশ বছর ধরে শেয়ার মার্কেটের ওঠানামাও দেখছি। সুতরাং নাফা লোকসানের আমি গন্ধ পাই ম্যাডাম। সন্ন্যাসী হোক যাই হোক, বড় কোনও দাওয়ের বেপার না থাকলে চাচাজি শহরে রয়ে যেত না।

বাড়ির অংশ বাগানোই কি সেই দাঁও?

 না না, তার চেয়েও বড়া কিছু আছে।

কী সেটা? আপনার ভাই আকাশচাঁদজি কি জানেন কিছু?

আলোকচাঁদ চোখ সরু করে ক্ষনেক দেখলেন মিতিনকে। তারপর গরগরে গলায় বললেন, আকাশ তো চাচাজির দলে আছে। উনার পার্টনার বনেছে।

এমন ধারণা হল কেন?

মূর্তি কলকাতায় আমার কাছে জিম্মা করে দিয়ে চাচাজির চলে যাওয়ার কথা। সেই মূর্তি তো দিচ্ছেনই না, উলটে বাড়ির অংশ না দিলে মামলা করার ভয় দেখাচ্ছেন চাচাজি। কাল আকাশের সঙ্গে ওই নিয়ে ডিসকাস করতে গেলাম, ও আমায় উলটোসিধা বলে ভাগিয়ে দিল, আলোকচাঁদের মুখে বাঁকা হাসি, এবার দ্যাখ, তোর চাচাজি তোকে কী দেয়!

শুনেছি আপনার চাচাজির কাছে নাকি কী সব নথি আছে? মিতিন হাওয়ায় কথাটা ভাসিয়ে দিল, বোধহয় গুপ্তধন বা ওই ধরনের কিছু?

আলোকচাঁদের চোখের মণিজোড়া দপ করে জ্বলে উঠল। পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক। ধূর্ত হেসে বললেন, আছে তো আছে। এ বাড়িতেই আছে। থাকবে। এ বাড়ির ভাগ তো আমি কাউকে দিব না। মরার আগে গভর্নমেন্টকে বাড়ি দিয়ে যাব, সেও ঠিক আছে, লেকিন ওই চাচা-ভাতিজার কপালে কিছু মিলবে না।

বুঝলাম, মিতিন ঠোঁট চাপল, তা যে কাজের জন্য আসা, সেটা হয়ে যাক।

কী বলুন তো?

আপনারা তিনজনে যতখুশি লড়াই করুন। কিন্তু পুলিশকে তার কাজটা করতে দিন, মিতিন অল্প হাসল, মূর্তিটা এবার ফেরত দিন।

আলোকচাঁদ আকাশ থেকে পড়লেন, মূর্তি তো আমার কাছে নেই।

আপনি কিন্তু একটু আগেই স্বীকার করেছেন…

উঁহু, আমি বলছি, মূর্তিটা যদি এনেও থাকি, কাজটা অন্যায় নয়, আলোকচাঁদ নির্বিকার, তার অর্থ কিন্তু এই নয়, পার্শ্বনাথজির মূর্তি আমি সরিয়েছি।

তা হলে তো এ বাড়িটা একটু খুঁজেপেতে দেখতে হয়। যদি সার্চ ওয়ারেন্টের কথা বলেন তো আনিয়ে নিতে পারি। তাতে কি আপনার সম্মান বাড়বে?

আলোকচাঁদ কী যেন ভাবলেন একটু, তারপর উঠে দাঁড়ালেন। সহজ গলায় বললেন, বেশ, দেখুন আমার ঘরটর। সন্দেহটা মিটিয়েই যান।

পাঞ্জাবির নীচে কোমরে বাঁধা বটুয়া থেকে মস্ত একটা চাবির গোছা বের করলেন আলোকচাঁদ। বসার জায়গার লাগোয়া একখানা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, এটাই ছিল আমাদের বৈঠকখানা। এখান থেকেই শুরু হোক।

ঘরটা মোটামুটি বড়ই। আগেকার দিনের আসবাবে ঠাসা। নানান কিসিমের পুতুলে সাজানো কাচবসানো কাঠের শোকেস, চিত্রবিচিত্র রং করা সিলিং, শ্বেতপাথরের টেবিল, প্রকাণ্ড ডিভান, সর্বত্র অতীতের ছোঁয়া। দেওয়ালে পরপর পূর্বপুরুষদের অয়েল পেন্টিং, বাঁধানো ফোটোও আছে কয়েকটা। পুরনো হলেও এ ঘরের কোনওকিছুই তেমন মলিন নয়। দেখেই মালুম হয়, নিয়মিত হাত পড়ে এই কক্ষে।

একটামাত্র টিউবলাইটের ম্যাড়মেড়ে আলোয় চতুর্দিক নিরীক্ষণ করতে করতে মিতিন বলল, আপনার কাজের লোকজন কোথায়?

সারাদিনের জন্য কেউ থাকে না, আলোকচাঁদের তুরন্ত জবাব, পিতাজির আমলের একজন আছে, সকাল ছ’টায় আসে, সন্ধের মুখে মুখে চলে যায়।

দু’বেলার রান্নাবান্নাও কি তিনিই করেন?

আমি একাহারী। সূর্যাস্তের পর জলও স্পর্শ করি না।

আপনি তো খুব সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ।

ধর্মের অনুশাসন মেনে চলি। একজন সত্যিকারের জৈনের মতো, আলোকচাঁদ ঈষৎ উষ্মার সঙ্গে বললেন, সেই জন্যেই তো বলছি, চাচাজি কেন, মন্দির কি আমিই বানাতে পারি না? মূর্তি আমাকে দিয়ে যেতে ওঁর কী অসুবিধে ছিল? যত্তসব অন্যের কাঁধে চেপে নাম কেনার ফিকির!

হুম! মিতিন অল্প ঘাড় নাড়ল। ঘরময় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থামল। একটা বাঁধানো ফোটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে?

আমার পিতাজি, আলোকচাঁদ দু’হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, স্বর্গীয় শ্রীদীপচাঁদ শেঠ।

মিতিন ডাকল, অ্যাই টুপুর, দ্যাখ তো এঁকে চিনতে পারিস নাকি?

টুপুর সরু চোখে দেখল ফোটোটা। পাগড়ি মাথায় এক সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোক। মুখখানা বেশ ফোলা ফোলা, মোটা পাকানো গোঁফ, চৌকো ফ্রেমের চশমাপরা বড় বড় চোখ…টুপুর কি কখনও দেখেছে?

টুপুর দু’দিকে ঘাড় নাড়ল, উঁহু, মনে পড়ছে না তো।

ভাল করে লক্ষ কর।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল টুপুর। চোখজোড়া যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। আকাশচাঁদের সঙ্গে হালকা মিল আছে কি? নাকি অন্য কারও কথা বলছে মাসি? টুপুর হাল ছেড়ে দিল। মিতিন টুকুস করে স্মার্টফোনে একটা ফোটো তুলে নিল ছবিটার।

অমনি আলোকচাঁদ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এসব কী হচ্ছে?

মিতিনের জবাব হামেহাল হাজির, আমার বোনঝিকে ওদের স্কুল থেকে জৈনদের উপর একটা প্রোজেক্ট করতে বলেছে। ওতে আপনার বাবার ফোটোটা দিয়ে দেব ভাবছি। অভিজাত জৈন হিসেবে ওঁর চেহারাটা বেশ মানাবে।

উনি তো অভিজাতই ছিলেন।

শেষ বয়সে মাথাটায় একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, এই যা…।

কে বললেন? চাচাজি? উনি চলে যাওয়ার দুঃখেই কিন্তু পিতাজি…

পুরনো কাহিনি বলছেন আলোকচাঁদ, কিন্তু মিতিন যেন শুনছেই না। খোঁজাখুঁজিতেও মন নেই, একের পর-এক তৈলচিত্র দেখে চলেছে। ছবির একদম কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে কী যেন। চিত্রকরের নাম খুঁজছে? হবেও বা। দেওয়ালের মধ্যিখানে প্রথম জগৎশেঠ ফতেচাঁদের ছবিটি বিশাল। রক্তবর্ণ পাথরবসানো পাগড়িধারী ব্যবসায়ীর প্রতিকৃতির সামনে পা আটকে গিয়েছে মিতিনের। পাথরটাই দেখছে গভীর মনোযোগে।

সন্ধান মিলল?

আলোকচাঁদের বিদ্রূপ মেশানো প্রশ্নের জবাবে মিতিনের মুখে কুলুপ।

আলোকচাঁদ ফের বললেন, এবার আমাদের রান্নাঘর, ভাঁড়ার, দাসদাসীদের রুমগুলোয় চলুন। বহুকাল অবশ্য ব্যবহার হয় না। তারপর দোতলা। আলমারি-বিছানা-তোষক-বালিশ খুলে ছিঁড়ে দেখুন কুছ মেলে কিনা।

মিতিন একটুও চটল না। বরফশীতল স্বরে বলল, থাক, আর দরকার নেই।

সে কী? কেন? জোশ খতম?

বলতে পারেন। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।

আলোকচাঁদকে চমকে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল মিতিন। টুপুরকে নিয়ে নতমস্তকে বিদায় জানাল আলোকচাঁদকে।

বাইরে এসেও মিতিন ম্রিয়মাণ। স্টার্ট দিল গাড়িতে, চলছে ধীরে। পরেশনাথের বড় মন্দিরটার গেটে দাঁড়াল। টুপুরকে বলল, চল, ভিতরটায় গিয়ে বসি একটু।

টুপুর মাসির চকিত ভাবান্তরে অবাক, কেন গো? মিশন ফেল করল?

পুরোটা নয়। শুধু একটা পয়েন্ট মিলছে না। বোধহয় মহিমাপুরে যেতে হবে।

মহিমাপুরে কেন?

ওখানেই জগৎ শেঠদের আদি বাড়ি। স্বপ্নের তালা খোলার চাবি হয়তো ওখানেই মিলবে।

বুঝলাম না। কী হেঁয়ালি করছ?

চল, বুঝিয়ে বলছি।

অন্দরের প্রশস্ত চাতালটা প্রায় ফাঁকা। অদূরে মন্দিরের সিঁড়ি। উপরে মূল মন্দিরে ঝলমল করছে আলো। সেদিকে তাকিয়ে মিতিন বলল, সুন্দর না মন্দিরটা?

সো-সো। আমার খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না।

কেন রে? ছেলেবেলায় তো পরেশনাথ মন্দিরের নাম শুনলেই লাফাতিস!

ছেলেবেলায় কী বিশাল মনে হত। মন্দিরের চুড়োটা কত উঁচু দেখাত তখন। এখন মোটেই সেরকম লাগছে না, টুপুর বিজ্ঞের সুরে বলল, ছেলেবেলায় দেখা অনেক প্রকাণ্ড জিনিসই বড় হলে আর তত বড় লাগে না। ফলে সেই চার্মটা আর আসে না।

হঠাৎ মিতিনের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। টুপুরকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঠাসঠাস চড় মারছে নিজের গালে। বিড়বিড় করছে, ছিঃ, এই সামান্য জিনিসটা খেয়াল হয়নি?

টুপুর অস্ফুটে বলল, কী খেয়াল হয়নি গো মাসি?

আচমকা টুপুরকে জড়িয়ে ধরেছে মিতিন। চকাস করে গালে চুমু খেল। টুপুরের নাকখানা নেড়ে দিয়ে বলল, ওরে, তুইই তো আমায় মোক্ষম সমাধানটা দিলি।

টুপুর হতবুদ্ধির মতো বলল, মানে?

মানে বুঝে আজ কাজ নেই, শচীন দেববর্মনের সুরে গেয়ে উঠল মিতিন। হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল টুপুরকে, এখন বাড়ি চল। বাকিটা কাল হবে।

কাল কী হবে?

যবনিকা উত্তোলন।

কীসের?

উঁহু, এখন কোনও প্রশ্ন নয়। চটপট গাড়িতে ওঠা এক্ষুনি ফিরতে হবে। রাতভর কত কাজ, কত কাটাকুটি প্লাস-মাইনাস…আর হ্যাঁ, কাল স্কুল থেকে ফিরে…হা হা হা…মাদারির খেল দেখবি…ঝিকিসঝ্যাক… চিচিংফাঁক…

কী আবোলতাবোল বকছে মাসি? পাগল হয়ে গেল নাকি? অথবা টুপুরই যা দেখছে শুনছে, তা সত্যি নয়। স্বপ্ন।

.

১০.

শ্বাস বন্ধ করে কতক্ষণ থাকতে পারে মানুষ? এক মিনিট? সোয়া মিনিট? দেড় মিনিট? বড়জোর দু-আড়াই মিনিট? টুপুর একবার দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে চেষ্টা করে দেখেছিল, মাত্র সাতাত্তর পর্যন্ত গুনেই হা হা করতে করতে ভেসে উঠেছিল জলের উপর। সেই টুপুরকে কিনা প্রায় পাক্কা একটা দিন নিশ্বাস চেপে থাকতে হচ্ছে। টুপুর যে এখনও দম ফেটে অক্কা পায়নি, এই তো ঢের!

হ্যাঁ, শ্বাস বন্ধ করে থাকাই তো! সেই যে মিতিনমাসি কাল রাতে হাতিবাগানের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল, তারপর থেকে দম তো আটকেই আছে। রাতে একদম ঘুম হল না, শুধুই মনে পড়ছে কালকের বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিটের অভিযান আর মাসির অসংলগ্ন আচরণ। সকালে স্কুলেও গেল ওই ভাবতে ভাবতে। সেখানে তো আর-এক কাণ্ড, শালিনী স্কুলেই আসেনি। বিকেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে শুনল, না এসেছে মাসির ফোন, না মেসোর! মান খুইয়ে নিজেই ফোন করল মাসিকে।

একবার। দু’বার। তিনবার। শুধুই এনগেজড টোন। মাসি না কথা দিয়েছে, আজ জব্বর খেল দেখাবে! বিকেল গড়িয়ে সন্ধে তো হতে চলল, আর কত প্রতীক্ষা করবে টুপুর!

রাস্তার আলো জ্বলে গিয়েছে। অগত্যা বই খুলে বসতেই হয়। কাল। ম্যাথসের ক্লাস টেস্ট, শালিনীর স্বপ্নরহস্য সমাধানের চেয়ে সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সবে জ্যামিতির থিওরেমে চোখ রেখেছে, ডোরবেলে ডিং ডং।

দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই পার্থমেসো। পিছনে উঁকি দিল টুপুর, মাসি কই?

আলোকচাঁদ শেঠের বাড়িতে। সহেলিদির অনুমতি করিয়ে নিচ্ছি, চটপট আয়।

পোশাক বদলাতে বিশ সেকেন্ড, মাকে হাত নাড়তে আর পাঁচ। আধ মিনিটেই টুপুর গাড়িতে। উদগ্রীব গলায় বলল, কী হল আজ?

কিচ্ছু জানি না। শুধু তোকে তুলে আনতে বলল।

কে আছে ওখানে? শুধু মিতিনমাসি?

 কিছুই জানি না রে। তুইও যে তিমিরে, আমিও সেই তিমিরে।

বুকে ঠাঁই ঠকাঠক নেহাই নিয়েই ফের বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিট। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাটা আজ যেন আরও বেশি নির্জন। সামনে পথবাতিটা জ্বলছে না, আধো আলোছায়ায় আলোকচাঁদের বাড়ি আজ আরও রহস্যময়।

দরজা খোলাই ছিল। ঢুকে থমকে গেল টুপুর। আলোকচাঁদের বসার জায়গা তো প্রায় ভরতি। দুই ভাই, সন্ন্যাসী কাকা, এমনকী, স্বয়ং অনিশ্চয় আঙ্কলও ডিভানে আসীন। সবচেয়ে বড় চমক, শালিনী! বাবার পাশে গুটিসুটি মেরে বসে!

ধন্দ লাগল টুপুরের। শালিনীর বাবা-জ্যাঠা-দাদু কাউকে না-কাউকে আজ অপদস্থ করবে মাসি, এখানে শালিনীকে না রাখাটাই তো ঠিক ছিল। যাকগে, মাসি যা ভাল বুঝছে, তাই করছে নিশ্চয়ই! মিতিনের একহাতে স্মার্টফোন, অন্য হাতে একটা কাগজ। টুপুরকে আঙুল নেড়ে ডাকল। কাছে যেতেই নিচু গলায় বলল, শালিনী হংসোমধ্যে বকো যথা হয়ে আছে, তুই আর ও একসঙ্গে বোস। তার আগে এই ফোটোগুলো দ্যাখ আমার ফোনে।

সামান্য ঝুঁকল টুপুর। মাসির ফোনের মনিটরে পরপর পাঁচখানা ফোটো। প্রথম ফোটোতে আকাশচাঁদ, আলোকচাঁদের বাবা। পরেরটায় মাথায় পাগড়ি নেই। তারপরেরটায় গোঁফ উধাও। তারপরেরটায় গালের ফোলাভাবটা কম। শেষের ফোটোয় চশমাটাও নেই। কী কাণ্ড, এ তো আহিরচাঁদ! ফোটোশপে একটু কারিকুরি করতেই মিলটা চলে এসেছে! এই জন্যই মাসি কাল বারবার বলছিল, ছবির মানুষটাকে টুপুর চেনে, অথচ টুপুর বুঝতেই পারেনি! নাহ, টুপুর মোটেই মাসির থার্ড আইয়ে কাজ করার যোগ্য নয়।

ব্যস্ত মানুষ অনিশ্চয় মজুমদার ঘড়ি দেখছেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, কী প্রজ্ঞাপারমিতা ম্যাডাম, এবার স্টার্ট করলেই তো হয়।

অনিশ্চয়ের ভরাট গলায় পুরো নামটা উচ্চারিত হতেই মিতিন টানটান। হাতের কাগজটায় আলগা দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, আমার কাহিনির শুরু একটা বাচ্চা মেয়ের স্বপ্ন থেকে। তারও আগে প্রশ্ন থাকে, মেয়েটি, আই মিন শালিনী, ওই স্বপ্নটি দেখল কেন?

অনিশ্চয় বললেন, স্বপ্ন দেখার নির্দিষ্ট কারণ থাকে নাকি?

থাকে তো বটেই, তবে সর্বদা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। আসলে স্বপ্ন ব্যাপারটা কী? আমাদের মনেরই একধরনের ক্রিয়াকলাপ, যা ঘুমের ভিতরে চালু হয়। মানুষের মগজই সেটা চালায়, কন্ট্রোল করে। আর আমাদের মগজ এক অসামান্য কম্পিউটার। আমাদের জন্মের মুহূর্ত থেকে সে আপনাআপনি অন হয়ে যায়। তারপর থেকে অবিরাম চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। এর মেমারির কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয় যা কিছু দ্যাখে, শোনে, ফিল করে, সবই এর অসীম ভাণ্ডারে জমা হয় এবং তার কণামাত্র পুরোপুরি ডিলিট হয় না। বড়জোর রিসাইকেল বিনে জমা থাকে। স্বপ্ন অনেক সময়েই ওই রিসাইকেল বিন থেকে উঠে আসা স্মৃতি, জেগে থাকা অবস্থায় যা আমাদের মনেই নেই। অনেক সময় অবশ্য সরাসরি স্মৃতিটা আসে, তখন অনেক কিছুই হয়তো নানান উদ্ভট চেহারায় ফিরে আসে। আবার কখনও বা জমা থাকা মেমারি অবিকল সেই চেহারাতেও স্বপ্নে দেখা দেয়।

এবার পার্থ উসখুস করে উঠল, তোমার লেকচারটা বেশ ইন্টারেস্টিং, কিন্তু ধরতাই হিসেবে খুব লম্বা হয়ে যাচ্ছে না?

আলোকচাঁদও বললেন, হ্যাঁ ম্যাডাম, কাটছাঁট করুন। মূর্তির কেসটায় আসুন।

মিতিন স্মিতমুখে বলল, আপনার ভাইঝির স্বপ্ন আর মূর্তি হাপিশ হওয়া, দুটোই কিন্তু এক কেসের দু’পিঠ।

আলোকচাঁদ অবাক সুরে বললেন, মানে?

আপনার ভাইঝি স্বপ্নটি না দেখলে মূর্তিটি খোয়া যেত না। আবার মূর্তিটি না গায়েব হলে স্বপ্নটার অর্থ উদ্ধার করা যেত কিনা সন্দেহ।

আকাশ-আলোক-আহির মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। আহিরচাঁদই বললেন, বেশ, আপনার ভাষণই শুনি তবে।

মিতিন শান্তভাবে বলল, না, আপনাদের আর বিরক্ত করব না। স্বপ্নটা আপনাদের কারও অজানা নয়। শুধু বলি, স্বপ্নের উৎসটি আকস্মিক।

কীরকম?

আকাশজি-আলোকজি আপনারা খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, আপনার চাচাজির সঙ্গে আপনাদের বাবার বেশ মিল। অন্তত খুব ছেলেবেলায় শালিনী তার দাদুকে যেমনটা দেখেছিল, সেই চেহারাটা এখনকার আহিরচাঁদজির সঙ্গে অনেকটাই মেলে। আমি কি ভুল বলছি, আকাশচাঁদজি?

একটু চমকেই কাকার দিকে তাকালেন আকাশচাঁদ। তাঁর মুখে ক্রমশ একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। দু’দিকে ঘাড় দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাই তো। চাচাজিকে শেষ বয়সের পিতাজির মতোই লাগছে বটে। কিন্তু তখন তো আমার শালু এত্তটুকুন। ভাল করে কথাও ফোটেনি।

একদম ঠিক, মিতিন সায় দিল, কিন্তু ওর মগজের গুহায় দাদাজির ছবিটা রয়েই গিয়েছিল।

আহিরচাঁদের মুখখানা শালিনীর অজান্তে উশকে দিল সেই আবছা স্মৃতি। তার সঙ্গে এই বাড়িটার পুরনো কিছু গল্প। আহিরচাঁদজি যা শুনিয়েছিলেন শালিনীকে। সব মিলেমিশে খুব বাচ্চাবেলায়, প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় এবাড়িতে দাদুকে যেমনটি দেখেছিল, সেটাই ফিরে এল স্বপ্নে। কিন্তু দুঃস্বপ্ন হয়ে।

কেন? দুঃস্বপ্ন কেন? টুপুরের পাশে বলা শালিনীর মুখ দিয়ে আচমকা প্রশ্ন ঠিকরে এল, দাদাজি নিশ্চয়ই আমাকে খুব ভালবাসতেন, আদর করতেন। তাঁর মেমারি অমন ভয় দেখানো হবে কেন?

স্বপ্নটা স্মরণ করো, ওখানেও তিনি তোমাকে আদরই করছিলেন। যেমন দাদাজিরা করেন নাতি-নাতনিদের। কিন্তু স্মৃতি সামান্য বেঁকেচুরে গিয়ে তোমাকে ভীষণ ঘাবড়ে দিয়েছিল।

কিন্তু এর মধ্যে পার্শ্বনাথজির মূর্তিটা কোথায়? ফের আলোকচাঁদের গলা বেজে উঠেছে, আপনি এইমাত্র বললেন না স্বপ্নের জন্যই চুরি…

হ্যাঁ, আলোকচাঁদজি। আমি এখনও তাই বলছি, মিতিন শান্ত, তবে সেজন্য আহিরচাঁদজিকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা প্রয়োজন।

যাঃ বাবা, আমি কী করলাম?

সেই প্রসঙ্গেই তো আসছি, মিতিনের ঠোঁটে একচিলতে হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল, আপনি অল্পবয়সে গৃহত্যাগ করেছিলেন বটে, কিন্তু কিছুদিন ধরেই কলকাতায় ফিরে আসার জন্য ছটফট করছিলেন। তার কারণও ছিল। আপনি নেতার আসনে থাকতে ভালবাসেন, কিন্তু কিছুতেই রনকপুরের আশ্রমটির কর্তৃত্ব পাচ্ছিলেন না। আমার কথা অস্বীকার করতে পারেন, আহিরচাঁদজি? খবরটা কিন্তু পাক্কা, খোদ রনকপুর থেকে পাওয়া।

আহিরচাঁদ নীরস গলায় বললেন, মারোয়াড়িই হই বা রাজস্থানি, বাংলাই আমার দেশঘর সব কিছু। সেখানে ফিরতে চাওয়াটা কি দোষের?

একেবারেই না। বরং বাংলাকে, কলকাতাকে, ভালবাসা তো আপনাদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। নয় নয় করে প্রায় তিনশো বছর আপনাদের পরিবার আছেন এরাজ্যে। সেই সুবাদে আপনারা তো আমাদের অনেকের চেয়েই বেশি বাঙালি।

তা হলে খামোকা রনকপুরের কথা পাড়ছেন কেন?

একেবারে অকারণে নয় গুরুজি। ওখান থেকেই আপনার ফেরার প্ল্যান শুরু হয়েছিল কিনা।

কী বলছেন? নিজের শহরে আসব, তার জন্য প্ল্যান লাগে নাকি?

আপনি তো একজন সাধারণ জৈন সাধু হয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে চাননি। একটু বিশেষ মর্যাদার আসন চেয়েছিলেন আপনি। তার জন্য এগিয়েছেন ধাপে ধাপে৷

তাই বুঝি? আপনি সব জেনে ফেলেছেন দেখছি?

আহিরচাঁদের শ্লেষ গায়ে মাখল না মিতিন। ঠান্ডা গলায় বলল, আপনার দুই ভাইপোর রনকপুরে যাতায়াত আছে, প্রথমে তাঁদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য পার্শ্বনাথজির কাহিনিটা বাতাসে ভাসিয়ে দিলেন। মানে, আপনার কাছে ওই মূর্তিটা আছে, আপনি সেটি ভাইপোদের হাতে তুলে দিতে চান, এইসব।

হ্যাঁ, তাই তো চেয়েছিলাম। এখনও চাই।

দাঁড়ান, আমি সবটা বলে নিই। এর পর আপনি নামলেন ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিতে। শুধু ছোট ভাইপোকে বললেন সেই কাহিনিটা, যা বিশ্বাস করে আপনার বড় ভাই দীপচাঁদজি শেষজীবনে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।

কোন কাহিনি? হিরে-জহরত? আকাশচাঁদ প্রায় লাফিয়ে উঠেছেন, চাচাজির কাছে ফারসিতে যেটা লেখা আছে?

গয়না, পাথর, সোনাদানা আদৌ আছে কিনা, অন্য কথা। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

আলোকচাঁদ রাগী চোখে একবার ভাইকে দেখছেন, একবার চাচাজিকে। তাঁর দৃষ্টিটা পড়ে নিয়ে মিতিন বলল, কিন্তু ওই গুপ্তধনের গাজর নাকের ডগায় ঝুলিয়ে আকাশচাঁদজিকে হাত করে ফেললেন চাচাজি। উদ্দেশ্য, জমিবাড়ির অংশ ফেরত চাওয়ার সময়ে যেন আকাশচাঁদ তাঁর পক্ষে থাকেন। কিন্তু শালিনীর স্বপ্ন যে প্ল্যানটাকেই বদলে দিল।

কীভাবে?

আহিরচাঁদজি খুবই বুদ্ধিমান মানুষ। পণ্ডিতও। আমি স্বপ্ন সম্পর্কে গোড়ায় যা-যা বললাম, সবই ওঁর জানা। স্বপ্নটা শোনামাত্র উনি বুঝে গেলেন, ওই দেওয়াল ফাঁক হয়ে যাওয়াটা কোনও অলীক ঘটনা নয়। ঘোরতর বাস্তব এবং ওই দেওয়ালের ওপারেই সন্ধান মিলতে পারে গুপ্তধনের।

তাই পাঁচকান করতে মানা করেছিলেন? টুপুরের মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়েই গেল, যাতে গুপ্তধনের ব্যাপারটা বেশি চাউর না হয়?

সেটাই তো স্বাভাবিক। ওই কারণে শালিনীর উপর একগাদা বারণ চাপল। ওদিকে জমিবাড়ির অর্ধেকের বদলে বাড়ির আসল জায়গাটা চেয়ে বসলেন আহিরচাঁদজি। জুড়লেন মন্দির বানানোর বাসনাটা। ব্যস, অমনি আলোকচাঁদজি চটে লাল। মূর্তিটাও কাছছাড়া করছেন না, উলটে এই আবদার, তিনি মানবেনই না। তখন আহিরচাঁদজি আর-একটি মতলব ভাঁজলেন। মূর্তিটাই চুরির নামে ভ্যানিশ হয়ে গেল।

মানে? অনিশ্চয়ের ভাঁটার মতো চোখ দুখানা ঝলসে উঠল, চুরিই হয়নি মূর্তি? গোটাটাই সাধুজির নাটক?

কিন্তু কেন? টুপুরের প্রশ্ন, মিছিমিছি সব্বাইকে ব্যস্ত করে ওঁর কী লাভ?

আছে। একটা নয়, দুটো। এক নম্বর, মূর্তি না উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত নির্বিবাদে রয়ে যেতে পারবেন কলকাতায় এবং এই বাড়িতে এন্ট্রি নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, এটাই বেশি মারাত্মক, আলোকচাঁদকে বাড়ি থেকে হঠানো।

তা কী করে সম্ভব?

সেইখানেই তো আহিরচাঁদের খেল। আলোকচাঁদ সেদিন বিকেলে আসবেন বলেছিলেন ধর্মশালায়। রোজ দেব দেব বলেও দিচ্ছেন না, সেদিন তিনি মূর্তি নেবেনই। আকাশকে সঙ্গী করতে ভাইয়ের বাড়ি গেলেন আলোকচাঁদ। চাচাজি ভাইকে শিখিয়ে রেখেছিলেন, যেন সে ওইদিন কোনও ভাবে দাদাকে এড়িয়ে যায়। এবার চুরির পর পুলিশি তদন্ত হলে আলোকচাঁদের ধর্মশালায় আগমন প্রকাশ পাবেই। কোথাও না-কোথাও তাঁর আঙুলের ছাপ মিলবেই। তখন গ্রেফতার হবেন আলোকচাঁদ, সেই অবসরে আকাশকে নিয়ে এবাড়িতে ঢুকে পড়বেন চাচাজি এবং নিশ্চিন্তে খোঁজ চালাবেন গুপ্তধনের।

আইব্বাস, নিখুঁত ছক! পার্থ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ঝানু ক্রিমিনালদেরও মাথায় আসবে কিনা সন্দেহ!

কিন্তু ফেল। আলোকচাঁদ সেদিন গেলেন না ধর্মশালায়।

 সে যাই হোক, বদমাইশি বুদ্ধিটার তারিফ করব না!

ওভাবে ওঁকে অসম্মান কোরো না। আহিরচাঁদজির মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মন্দ ছিল না। ধনরত্ন পেলেও উনি তো ভোগ করতেন না। মন্দির গড়তেন। জৈন সন্ত হিসেবে একটা স্থায়ী কীর্তি রচনা করতেন, মিতিন আহিরচাঁদের চোখে চোখ রাখল, এটাই তো আপনি চেয়েছিলেন, তাই না গুরুজি?

আহিরচাঁদ নীরব। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নামিয়ে নিয়েছেন মাথা।

তা হলে কি হিরে-জহরত নেই? আকাশচাঁদের দুরুদুরু জিজ্ঞাসা, চাচাজির ওই লেখাটায় কিন্তু…

ওটা জাল, মিতিনের ঘোষণায় চমকে তাকালেন আহিরচাঁদ। মিতিন তাঁকেই বলল, হ্যাঁ, ওটা আপনি বানিয়েছেন। একটা পুরনো পুরনো চেহারাও দিয়েছেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি।

আহিরচাঁদের দুচোখে প্রবল বিস্ময়। মিতিন বলল, ওই দলিলে এমন কয়েকটা ফ্রেঞ্চ শব্দ রয়েছে, যেগুলো আড়াইশো বছর আগের ফারসিতে ছিলই না। যেমন, লেখার একদম শেষে আছে, মের্সি। অর্থাৎ ধন্যবাদ। এটাও ফ্রেঞ্চ। কিন্তু সবে দেড়শো বছর আগে ঠাঁই পেয়েছে ফারসি ভাষায়। ফ্রেনচ ভাষা থেকে।

সুতরাং দলিলটি শেঠ ফতেচাঁদের সময়ে লেখাই হয়নি। আপনি ফারসি শিখেছেন বড়জোর তিরিশ বছর আগে, তাই হয়তো অজান্তেই হয়ে গিয়েছে ভুলটা।

টুপুরের চোখ কপালে। মাসি ফারসি শিখল কবে? কিংবা ফ্রেনচ? নাকি বাবার বন্ধু প্রোফেসর শমিউদ্দিনজেঠুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল? মাসির পক্ষে অসম্ভব নয়। নাকি বাবাই? ফারসি আর ফ্রেনচ, বাবা তো দুটোই শিখেছিল…

ওদিকে আর-এক নাটক। আহিরচাঁদ উঠে দাঁড়িয়েছেন। এক পা, এক পা করে এগোচ্ছেন দরজার দিকে। মিতিনই উঠে গিয়ে থামাল তাঁকে। নরম সুরে বলল, আপনাকে যে আরও কিছু জানানোর ছিল, গুরুজি।

আহিরচাঁদ আস্তে আস্তে মাথা নাড়াচ্ছেন। ভাঙাভাঙা গলায় বললেন, কিন্তু আমার যে আর কিছু শোনার নেই।

তবু গুপ্তধনের রহস্যের চিরতরে ইতি হোক, এ কি আপনি চান না?

থমকালেন আহিরচাঁদ। এবার বড় ভাইপো সরব হয়েছেন, হ্যাঁ-হ্যাঁ, যেটুকু যা আছে, যদি পাওয়া যায়…

চলুন, সবাই মিলেই সন্ধান করি, মিতিন মুচকি হাসল, যদিও কিস্যু মিলবে না…

কেন? কেন? কেন?

 কোরাসে বেজে ওঠা প্রশ্নে কান না দিয়ে মিতিন গটগট করে ঢুকল কালকের ঘরটায়। থামল একটু। এবার এক পা, এক পা করে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের ছবির সামনে। টুর গাইডের ভঙ্গিতে বলল, আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, শালিনীর স্বপ্নে দ্বিতীয় একজনের কথা বলা হয়েছে…ইনিই সেই দ্বিতীয়জন।

একসঙ্গে অনেক বিস্ময়ধ্বনি, তাই বুঝি!

ইয়েস, মিতিন হাত বাড়িয়ে ছবির ফ্রেমের খাঁজ থেকে একটা সরু লোহার শলাকা বের করে আনল। শলাকাটি ছোঁয়াল ফতেচাঁদের পাগড়িতে। উঁহু, পাগড়ির রক্তবর্ণ পাথরে। তারপর আচমকাই ডান পা তুলে দিয়েছে দেওয়ালে। শলাকা যেখানে ছবিকে ছুঁয়েছে, তার খাড়া নীচটায়। ঘাড় ঘুরিয়ে গোটা দঙ্গলকে বলল, মনে রাখুন, শালিনীর স্বপ্নে এটাই লাথি।

বলেই শলাকা আর পা দিয়ে একসঙ্গে চাপ। অমনি এক বিকট ঘড়ঘড় শব্দ। আওয়াজে কেঁপে উঠেছে সকলে। পরক্ষণে পিলে চমকানো কাণ্ড। ছবিসুদ্ধ আস্ত দেওয়াল দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে।

মিতিন উঁকি দিল দেওয়ালের ওপারে। তারপর মৃদু হেসে বলল, সিঁড়ি আছে। যান, সরেজমিন করে আসুন।

হুড়মুড়িয়ে ছুটেছে সকলে। পাথরের সিঁড়ি ধরে নামছে টুপুরও। বড়ঘরের চিলতে আলো এসে পড়েছে মাটির তলার কুঠুরিতে। খোলা সিন্দুক, তামার প্রকাণ্ড জালা রয়েছে বেশ কয়েকটা। সবগুলোই বেবাক ফাঁকা। সোনা রুপো-হিরে-মুক্তোর একটি কুচিও পড়ে নেই।

একই প্রক্রিয়ায় মিতিন বন্ধ করল দেওয়াল। জুড়ে দিল জগৎশেঠ ফতেচাঁদের ছবি। অবসন্ন মুখে আবার বসার জায়গায় ফিরেছেন আকাশ আলোক-আহির।

ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে আলোকচাঁদই বলে উঠলেন, আশ্চর্য, ধনরত্ন সব উধাও! গেল কোথায়?

মিতিন কাঁধ ঝাঁকাল, তা তো জানি না। আপনাদের পূর্বপুরুষরাই শেষ করে গিয়েছেন নিশ্চয়ই। হয়তো মন্দির বানিয়েছেন, দানধ্যান করেছেন কিংবা ব্যবসায় খুইয়েছেন। তবে এটা বলতে পারি, গুপ্তকক্ষ আবিষ্কার করেই দীপনাথজির মাথার গোলমাল হয়েছিল। কুঠুরি শূন্য, এই ধাক্কাটা উনি সামলাতে পারেননি।

তাই হবে হয়তো, আলোকচাঁদ একটা ওজনদার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পরের মুহূর্তেই সরু চোখে বললেন, যাক গে যাক, তার জন্য শোক করাও বোকামি। কিন্তু পার্শ্বনাথজির মূর্তিটার হদিশ মিলবে কি?

মিতিন মিটিমিটি হাসছে, আপনি দেখেছেন মূর্তিটা? কলকাতায়? রনকপুরে?

উঁহু।

 আকাশচাঁদজি, আপনি?

না, চাচাজি বলেছিলেন তোমাদের হাতেই তো তুলে দেব, একবারেই দেখো। ধর্মশালায় একবার শুধু নজরে পড়েছিল, ওঁর আলমারিতে একটা জিনিস যেন মোড়া আছে কাপড়ে। ওইটাই বোধহয়…

সরি। ওই কাপড়টাই ছিল শুধু। ভিতরে ভোঁভোঁ।

মানে?

আহিরচাঁদজির কাছে কোনও মূর্তি ছিলই না। সুচারু ভাবে ওই গল্পটা ফেঁদেছিলেন আপনাদের চাচাজি। কলকাতায় পায়ের নীচে শক্তপোক্ত মাটি পাওয়ার আশায়। শালিনীর স্বপ্ন এঁকে সে সুযোগও করে দিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম, সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল!

দুই ভাই কটমট চোখে দেখছেন কাকাকে। মিতিন অনিশ্চয়কে বলল, চলুন, আমরা এবার উঠি। ওঁরাও এখন নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াগুলো শান্তিতে সারতে পারবেন।

.

চারজনে বেরিয়ে আসছে ঘর ছেড়ে, হঠাৎ দৌড়ে এল শালিনী। ঢিপ করে মিতিনকে প্রণাম করে বলল, মাসি, ইউ আর আ জিনিয়াস! ইউ আর গ্রেট!

অনিশ্চয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, যাক, কেসটায় কিছু ফি মিলল তা হলে!

পার্থও হাসছে। হাসছে টুপুরও।

ওফ, সত্যি, মাসি খেল দেখাল বটে আজ! আচ্ছা, মাসিকে আজ থেকে ভানুমতী বলে ডাকলে কেমন হয়!