৭-৮. ছোট্ট পদুম শহর

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ছোট্ট পদুম শহরে যেন গাঢ় নিশুতি। একটা-দুটো পথবাতি টিমটিম করছে। মানুষ তো দূরস্থান, কুকুর-বিড়ালও দেখা যায় না রাস্তায়। এলাকা যেন ঘুমিয়ে কাদা।

পদুমের টুরিস্ট বাংলোর লোহার গেটে ধাক্কা মারছিল পার্থ। সাড়াশব্দ নেই। হতাশ হয়ে পার্থ বলল, এখানে নিশ্চয়ই আরও হোটেলটোটেল আছে? দেখে আসব?

প্রস্তাবে জল ঢেলে দিল নাসির। বলল, লাভ নেই স্যার। বেড়ানোর মরসুম শুরু হয়নি। একটা হোটেলও খোলা পাবেন না।

তা হলে? রাতটা কি এখানেই কাটাতে হবে?

 টুপুর কাঁপতে কাঁপতে বলল, ঠান্ডা খুব বাড়ছে গো মেসো। এবার নির্ঘাত জমে যাব। কী কনকনে হাওয়া!

পার্থ বলল, বেঘোরে প্রাণ হারিয়ে লাভ নেই। যা একখানা জায়গা, সাতদিনের আগে ডেথ নিউজটাও বেরোবে না। চল বরং গাড়িতে গিয়ে বসি।

এত অল্পে হাল ছেড়ে দিলে? মিতিন এগিয়ে এল, দাঁড়াও, আমি দেখছি।

বলেই হাত দুখানা মুখের সামনে চোঙার মতো ধরে উৎকট সুরে চেঁচিয়ে উঠল মিতিন, কোইইই হ্যাঅ্যাঅ্যায়? হ্যায় কোওওওই?

আশ্চর্য ব্যাপার, বারদুয়েক চিৎকারের পরই গেটে শব্দ। তালা খুলছে কেউ। সামান্য ফাঁক হল দরজা। কম্ফর্টার মোড়া একটা পাহাড়ি লোক বেরিয়েছে।

মিতিন অনেকটা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, জুল্লে, জুল্লে।

চোখ পিটপিট করে লোকটাও বলল, জুল্লে।

 গাড়ি আর সহযাত্রীদের দেখিয়ে মিতিন আঙুলে ইশারা করছে, টুরিস্ট হু। অন্দর যানেকো মাংতা।

বোধহয় বুঝেছে লোকটা। গেট খুলে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে নাসির। কম্পাউন্ডটি বেশ বড়সড়। দোতলা বাড়ি। খানদশ বারো ঘর তো আছেই। পাশে আলাদা করে একটা ডাইনিং হলও নজরে পড়ল টুপুরের। যাক, শুধু আশ্রয় নয়, আহারেরও বন্দোবস্তও হবে।

হায় রে কপাল! রুম চাওয়ামাত্র লোকটা দু’দিকে মাথা নাড়ছে। ম্যানেজারবাবু নেই, ঘর দিতে পারবে না। অনেক বলে কয়ে তাকে নিমরাজি করাল নাসির। তবে লোকটা সাফ জানিয়ে দিল, খানা কিছু জুটবে না।

এবার পার্থর কাকুতি-মিনতি। বুমবুমকে দেখিয়ে বলল, বাচ্চা ভুখা হ্যায়। ইসকে লিয়ে তো কুছ করো।

অবশেষে খানদশেক ডিমসেদ্ধর প্রতিশ্রুতি মিলেছে। মিতিন আর চাপাচাপি করতে নিষেধ করল। পাহাড়ি মানুষরা নাকি ভারী জেদি হয়। দুম করে বেঁকে বসলে ওইটুকুও জুটবে না। সঙ্গে প্রচুর বানরুটি আছে, একটা রাত চালিয়ে নেওয়া যাবে।

দোতলায় একটা ঘর খুলে দিতে টুপুরের মনটা ভাল হয়ে গেল। দিব্যি পরিচ্ছন্ন। বড়-বড় বিছানা, লেপকম্বলও মজুত। এমনকী, কমোডও আছে বাথরুমে। এর বেশি আর কী চাই।

পার্থর গলাতেও তারিফ। বিছানায় চিত হয়ে বলল, এতটা আমি আশা করিনি। এমন দুর্গম জায়গাতেও কারেন্ট আছে! ফ্যাটফ্যাট টিউব জ্বলছে!

এটা সৌরবিদ্যুতে চলছে। খেয়াল করোনি, কম্পাউন্ডে ঢুকেই ডানদিকে একটা প্রকাণ্ড সোলার প্যানেল, গায়ে ভাল করে শাল জড়াতে-জড়াতে মিতিন বলল, লাদাখের এই দিকটায় ঘরে ঘরে কারেন্ট। সর্বত্র সৌরবিদ্যুৎ।

টুকটাক কথার মধ্যেই যে যার মতো বদলে নিল পোশাক। বুমবুম ঘুমিয়ে পড়ছিল, এবার তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে মিতিন। নাসির এসে জানিয়ে গেল সেও ঘর পেয়েছে একতলায়। তার কপালেও দু’খানা ডিমসেদ্ধ, মিতিন বানরুটিও দিল তাকে। টুপুরও নিশ্চিন্ত হয়ে বসল কম্বল মুড়ি দিয়ে। রাত বাড়ছিল।

আহারের পর সিগারেট খেতে বেরিয়েছিল পার্থ। ফিরে বলল, আমরা দারুণ সময়ে এসেছি, বুঝলি টুপুর।

কেন?

এখন শুক্লপক্ষ। বোধহয় দশমী-একাদশী কিছু হবে। চমৎকার একটা চাঁদ উঠেছে। ঝকঝকে আকাশে দারুণ লাগছে রে চাঁদটাকে।

দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে এল টুপুর। চোখ গোল-গোল করে বলল, সত্যি গো। যেন পাহাড় থেকে চাঁদ উঠছে! চূড়ার বরফ চিকমিক করছে আলোয়।

হুম। তবে এই সব সিন প্রাণভরে উপভোগ করা যাবে কি? তোর মাসি হয়তো কাল সকাল থেকে আবার দৌড় করাবে, পার্থ ভুরু নাচাল, এর পর আমরা কোথায় যাব ম্যাডাম?

দেখা যাক। সকাল তো হোক।

আমি কিন্তু বলে রাখছি, সকালবেলা ভ্যালিতে যত খুশি চক্কর মারো, রাতে এই গেস্ট হাউজেই ফিরব। দুমদাম কোথাও নিয়ে ফেলার তাল কোরো না। বেড়ানোর একটা স্টেজ অন্তত এনজয় করতে দাও।

স্ট্রেঞ্জ! টুপুর না বলে পারল না, দেবল বড়ুয়াকে নিয়ে তোমার একটুও ভাবনা হচ্ছে না? যাকে খুঁজতে…।

আমি তো খোঁজাখুঁজির কোনও মানেই পাচ্ছি না। যদি ধরেও নিই সে এই ভ্যালিতে এসেছে, তাতেও দুশ্চিন্তার কোনও কারণ আছে কি? তার বিপদের কোনও চান্স এখনও দেখা যায়নি। সুতরাং খামকা দৌড়াদৌড়িরই বা কী প্রয়োজন?

বা রে, তাকে পেতে হবে না?

সে তো এমনিই ধরা দেবে। জাঁসকর ভ্যালি থেকে বেরোনোর একটাই রাস্তা। আর আমরা সেখানেই বসে।

হুঁ। এখানে তো কোনও হোটেলও খোলা নেই। অতএব দেবল পদুমে থাকলে তো নিশ্চয়ই এই বাংলোয়…

নেই, পার্থ বুড়ো আঙুল নাড়ছে, আছে শুধু এক সাহেব মেমসাহেব। বাকি সব রুম ঢুঁঢুঁ। খবর নিয়েছি।

এখানে সে আদৌ এসেছিল কি?… যাই হোক, এখন সে নেই, এটাই আসল কথা। তাই তো মিতিনমাসি?

বলে যা। শুনছি।

একটু উৎসাহ পেল টুপুর। কপালে মোটা ভাঁজ ফেলে বলল, তা হলে সে গেল কোথায়? এমন কোথাও গিয়েছে, যেখানে ট্রেকিং করে পৌঁছোতে হয়? মি. লুবজাংকে তো দেবল সেরকমই একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল।

গুড মেমারি, মিতিন হাত দোলাল, কন্টিনিউ।

 টুপুর দ্বিগুণ উৎসাহে বলল, এবার তা হলে জানতে হবে, পদুম থেকে কোথায়-কোথায় ট্রেকিং করা যায়।

পার্থ বলল, যদ্দুর শুনেছি, জাঁসকর থেকে নাকি হেঁটে লেহ যাওয়া যায়। পথে কিছু গুম্ফাটুম্ফা পড়ে। তা ছাড়া জাঁসকরের মধ্যে দিয়ে বোধহয় মানালি যাওয়ারও একটা রাস্তা আছে। হাঁটাপথে।

ধুস। মানালি তো হিমাচল প্রদেশে। সেখানে যাওয়ার জন্যে সে জাঁসকরে ঢুকবে কেন?

পদুম লেহ ট্রেকিং নিয়েও তো একই কথা বলা যায় টুপুর। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে তো দেবল লেহ যেতে পারে। রাস্তা খোলা পর্যন্ত ওয়েট করে। আর ওই সব গুম্ফা যাওয়ার জন্যে তো লেহ থেকেই ট্রেকিং করা সুবিধে।

আহ, তোমরা ভুল ট্র্যাকে ঢুকেছ, মিতিন মৃদু ধমক দিল, একটা কথা মাথায় ভাল করে ঢুকিয়ে নাও, দেবল মোটেই ট্রেক করতে বেরোয়নি। তবে তার নিজের কাজের খাতিরে হয়তো তাকে পাহাড়ে হাঁটতে হতেও পারে। তা ছাড়া ডোন্ট ফরগেট, পিছনে আরও দু’জন লোক আছে। অশোক পারেখ আর রাকেশ শ্রীবাস্তব। লুবজাং যাদের সম্পর্কে বলেছেন, স্পোর্টসম্যান লাইক ফিজিক।

পার্থ বলল, কিন্তু তারা যে জাঁসকরে এসেছে, এমন প্রমাণ এখনও তুমি পাওনি। এবং নাসিরের কথা অনুযায়ী কারগিলের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে জাঁসকরমুখো কোনও গাড়ি শনিবারের পর ভাড়া হয়নি।

হয়তো তারা আমাদের মতো এসেছে, টুপুর বলে উঠল, শ্রীনগর থেকে। গাড়ি ভাড়া নিয়ে।

হ্যাঁ, তা হতে পারে, পার্থ ঘাড় নাড়ল, তবে তাদেরও কিন্তু এখানেই উঠতে হবে। নয় কি?

মিতিনকে এবার যেন একটু দূরমনস্ক দেখাল। বুমবুম ঘুমোচ্ছে, তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, আর-একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারছি না।

কী গো?

আগে কনফার্মড হই, তারপর শুনিস। অনেক রাত হয়েছে, এখন ঘুমিয়ে পড়।

আলো নিভেছে ঘরের। বালিশে মাথা রাখল টুপুর। নরম উলের কম্বলে দারুণ আরাম, তবু কেন যেন জাঁকিয়ে নিদ্রা আসছে না? আবছা তন্দ্রায় কত যে কল্পদৃশ্য ভাসছে মস্তিষ্কে।… আপাদমস্তক শীতপোশাকে মুড়ে হিমবাহের উপর দিয়ে হাঁটছে দেবল। পাশে-পাশে ওই লোকটা। চন্দ্রকুমার ত্রিবেদী যার নাম। পিছন-পিছন দুটো ভল্লুক। হঠাৎ দেবল ঘুরে তাকাল। অমনি ভল্লুক দুটো লুকিয়ে পড়ল পাথরের আড়ালে। কারওকে দেখতে না পেয়ে আবার বেশ নিশ্চিন্তে হাঁটছে দুই মূর্তি। ভল্লুক দুটোও বেরিয়ে পড়ল। এগোচ্ছে দুলে দুলে। খুব কাছে এসে ঝাঁপাতে যাচ্ছে দেবলদের উপর, অমনি কোথা থেকে একটা বড় বরফের চাঁই খসে পড়ল। বরফের সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে চারটে প্রাণী। গড়াতে-গড়াতে নীচে এক নদীতে গিয়ে পড়ল। ওটা কি স্টড নদী? হিমবাহটা কি দ্রাং-দ্রুং?

ছবি ডুবে গেল আঁধারে। কখন যে ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছে টুপুর। জাগল তীব্র আলোর ঝলকানিতে। চোখ খুলে দেখে, সোনা রং রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে ঘর। লাফিয়ে পুবের জানলায় গেল টুপুর। কাচে চোখ রাখতেই চলকে উঠেছে হৃৎপিণ্ড। তিনদিকে খাড়া-খাড়া পাঁচিলের মতো পাহাড়। মাথায় তুষারের মুকুট। নীচে বিস্তীর্ণ সমভূমি। সেখানে ছড়ানো-ছেটানো ঘরবাড়ি। তারও ওপারে দু’দিক থেকে দু’খানা নদী এসে মিশেছে।

হঠাৎ পিছনে মিতিনের গলা, জুল্লে মিসিবাবা। রাতে শান্তিতে ঘুম হয়েছে তো?

হ্যাঁ। পরশুর ঘুম পুষিয়ে নিয়েছি, টুপুর হাসল, কালও পাহাড়ি বুড়োটাকে জুল্লে বলছিলে। জুল্লে মানে কী?

কিছুই না। লাদাখি ভাষার হাই-হ্যালো। ওদের ভাষা বললে লাদাখিরা খুব খুশি হয়।… বাই দ্য বাই, বাংলোর কেয়ারটেকারকে তোর বুড়ো মনে হল?

বুড়ো নয়? মুখময় রিংকল, গায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে…

ভয়ংকর ঠান্ডার দেশে চামড়া অনেক তাড়াতাড়ি ইলাস্টিসিটি লুজ করে রে। তখন মাত্র চল্লিশ বছরের লোককেও সত্তর বলে ভুল হয়।

মগজের ভাঁড়ারে আর-একটা তথ্য জমা পড়ল টুপুরের। বাইরেটা দেখতে দেখতে বলল, নদী দুটোর নাম কী গো? একটা তো স্টড…

বানানটা টি এস এ আর এ পি। কী উচ্চারণ করবি? সরাপ? না সারাপ? মিতিন টুপুরের পিঠে হাত রাখল, দুই নদী মিলে হয়েছে জাঁসকর।

কী অসাধারণ লাগছে গো। ওই মিটিং পয়েন্টে যাওয়া যায় না?

আমরা কাজে এসেছি টুপুর। এবার তৈরি হয়ে নাও।

এক্ষুনি? কোথায় যাব?

 সেটা পরের চিন্তা। আপাতত প্রস্তুতিটা সেরে রাখো।

একটু মিতিনমাসির আদর খেয়ে ব্রাশ-পেস্ট নিয়ে বাথরুমে যাচ্ছিল টুপুর। হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, বুমবুম আর মেসো কোথায়?

চরতে বেরিয়েছে। মর্নিংওয়াক চলছে বাবা-ছেলের।

 তুমি কখন উঠলে?

যেমন উঠি কলকাতায়। ভোর পাঁচটা।

 ব্যায়ামও সারা?

ইয়েস মাই ডিয়ার। চটপট নীচে আয়। আমি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করি।

প্রাতরাশটি একটু অদ্ভুত হল। গুঁড়ো-গুঁড়ো ডিমভাজা দিয়ে মোটা-মোটা পুরি। এ মরসুমে এখনও আলু এসে পৌঁছোয়নি পদুমে, তাই এই আয়োজন। পার্থর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। পাকিয়ে রোল বানিয়ে গোটাআষ্টেক পুরি খেয়ে ফেলল।

মুখ ধুয়ে এসে পার্থ বলল, উফ টুপুর, কী মিস যে করলি তুই!

কেন?

বেরোলে দেখতে পেতিস কোন রাজ্যে এসেছিস। জায়গাটার কী নাম হওয়া উচিত জানিস? ঘুঁটেনগর। যেদিকে তাকাবি, সেদিকে শুধু ঘুঁটে আর ঘুঁটে। বাড়ির বারান্দায় ঘুঁটের তাল, ছাদে ঘুঁটের পাহাড়, সামনে একটা ধর্মস্থান পড়ল, তারও দরজায় থাকে থাকে খুঁটে। এমনকী, একটা ভাঙা রাজবাড়িও দেখলাম, সেখানেও সোনাচাদির বদলে শুধুই ঘুঁটে।

ঠাট্টা কোরো না স্যার, মিতিন হাসল, ঘুঁটেই এদের প্রাণভোমরা। বছরে আট-ন’মাস পুরো উপত্যকা ঢাকা থাকে বরফে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন ঘুঁটেই এদের জ্বালানি, ঘুঁটেই এদের রুমহিটার। ঘুঁটে না জমিয়ে রাখলে চলবে কেন।

কেয়ারটেকার চা দিয়েছে। চুমুক দিল পার্থ-মিতিন। তখনই ডাইনিংহলে নাসিরের প্রবেশ। সামনে এসে বলল, ম্যাডামজি, খবর লায়া।

সন্ধান মিলেছে সেই ড্রাইভারের? দু’জন বাবুকে কারগিলের টুরিস্ট বাংলো থেকে যে নিয়ে এসেছিল?

জি ম্যাডাম। তার নাম সোনম ওয়াংদি। সে কারগিলে ফেরেনি। এখন আর যাবেও না।

কেন?

এটা ওদের খেতির সময়। গ্লেসিয়ার গলা নদীর জলে তিনমাস চাষ হবে ভ্যালিতে। গোটা জাঁসকরে এখন চাষের মরসুম।

তাও তো বটে। কোথায় গ্রাম সোনমের?

দূর আছে। অন্তত তিরিশ কিলোমিটার। জাংলা গুম্ফার ওপারে। আরও একটা খবর পেলাম। অ্যালপাইন টুর নামে একটা ট্র্যাভেল কোম্পানি আছে পদুমে। তারা বারোমাস খোলা থাকে। শীতেও চাদরে নিয়ে যায়।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, চাদরটা কী?

মিতিন বলল, শীতে এখানে সব নদীই জমে যায়। সেই বরফের উপর হাঁটাকে স্থানীয় ভাষায় বলে চাদর।

ও বাবা, সে তো ডেঞ্জারাস। ওই বরফে তো শুনেছি অনেক ক্রেভাস থাকে। আই মিন, ফাটল-টাটল…

হুঁ। বুঝতে না পারলে অবধারিত মৃত্যু। ছ’মাস পরে হয়তো বডি মিলবে, মিতিন ফের নাসিরের দিকে ফিরেছে, তা অ্যালপাইনে কী জানলেন?

রবিবার সকালে নাকি বাংলো থেকে দু’জন ইন্ডিয়ান গিয়ে ওঁদের কাছে ট্রেকিং মেটিরিয়াল চাইছিল। কাঁটা দেওয়া শু, স্টিক টেন্ট… ভাড়ায় দেয় না বলে কিনেই নিয়েছে। আর ওইদিন বিকেলেই নাকি তারা পিঠে ব্যাগট্যাগ চাপিয়ে হাওয়া।

ও, মিতিনকে যেন খানিক উত্তেজিত দেখাল, তারপর? কোন দিকে গেল?

শায়েদ ইছরে। রোড বিল্ডিং কন্ট্রাক্টরের একটা ট্রাক যাচ্ছিল, তাতেই নাকি উঠেছে।

ইছর কোথায়? টুপুর জিজ্ঞেস করল, অনেক দূর?

চল্লিশ কিলোমিটার হবে। ওখান থেকে দারচা মানালির ট্রেকিং শুরু হয়।

মিতিনের চোখমুখ সহসা উজ্জ্বল, যাক, আমাদের খোঁজাটা বোধহয় খানিক সহজ হয়ে গেল।

নাসিরের চোখ বড়-বড়, আপনারাও ইছর যাবেন নাকি?

মনে তো হচ্ছে। চলুন, আগে একবার অ্যালপাইনে ঢুঁ মেরে আসি।

টেবিল ছেড়ে উঠল মিতিন। নাসিরকে নিয়ে ডাইনিংহল থেকে বেরোচ্ছিল, একটা পুলিশের জিপ ঢুকছে কম্পাউন্ডে। সানগ্লাস পরা এক বেঁটেখাটো অফিসার নামলেন লাফিয়ে। তাঁকে দেখামাত্র কেয়ারটেকার হুড়মুড়িয়ে আসছিল, তাকে থামিয়ে মিতিন এগিয়ে গেল। সপ্রতিভ সুরে বলল, জুল্লে অফিসার। এনি প্রবলেম?

জুল্লে, অফিসার পলক জরিপ করলেন মিতিনকে। অন্যদেরও। বিচিত্র উচ্চারণে ইংরেজিতে বললেন, দেবল বড়ুয়া নামে কেউ কি ছিলেন এখানে?

টুপুর বেজায় চমকেছে। হঠাৎ দেবলের খোঁজ করে কেন পুলিশ!

.

০৮.

পুলিশ অফিসার যা শোনালেন, তাতে টুপুরের তো চক্ষু চড়কগাছ। ইছর নামের গ্রামটিতে, পথের ধারে একখানা মোটরবাইক পাওয়া গিয়েছে। কোনও আরোহীর সন্ধান মেলেনি। মোটরবাইকের কাছে পড়েছিল একটা মানিব্যাগ। হাজারচারেক টাকা ছাড়া একটি ডেবিট কার্ড ছিল পার্সে। কার্ডের মালিকের নাম দেবল বড়ুয়া। এ ছাড়া মিলেছে একটি বিল। পদুমের টুরিস্ট বাংলোর।

কেয়ারটেকার খবর দিয়েছিল, বাংলোর ম্যানেজার দাওয়া নরবু ছুটতে ছুটতে হাজির। পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে বিলটি নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। ঘাড় নেড়ে বললেন, ইয়েস। দেবল বড়ুয়ার নামেই রুম বুক হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা তো রোববার চলে গিয়েছেন।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, মোটরবাইকটি আপনারা কবে পেয়েছেন?

খবরটা এল কাল রাতে। মঙ্গলবার থেকে নাকি পড়ে আছে।

পুরো একদিন পর জানলেন?

পদুমের ওপার থেকে চটজলদি ইনফরমেশন আসে না ম্যাডাম। মোবাইল সার্ভিস নেই। একটাই মাত্র স্যাটেলাইট ফোন আছে, তাও রারুতে। মিলিটারির জিম্মায়। হয়তো আরও দেরিতে পেতাম… নেহাত ইছর থেকে একজন সাইকেলে পদুমে এসেছে… সে যেচে থানায় খবর দিয়ে এল।

আপনারা নিয়মিত টহল দেন না?

গাড়ির তেল এখানে অঢেল নয়। মাসে দু’বার হেলিকপ্টারে সাপ্লাই আসে। কারগিল থেকে। মেপে-মেপে খরচ করতে হয়, হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে অফিসারের। ঈষৎ রুক্ষস্বরে মিতিনকে বললেন, পুলিশকে এত প্রশ্ন করছেন কোন এক্তিয়ারে? আপনি কে?

আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, ভ্যানিটিব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করল মিতিন। বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমিও দেবল বড়ুয়াকেই খুঁজছি।

পুলিশ অফিসারের যেন বিশ্বাস হল না। উলটে পালটে দেখছেন কার্ডটা। সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছেন।

মিতিন গ্রাম্ভারী গলায় বলল, দেবল বড়ুয়ার বাবা আমাকে এই কাজে নিয়োগ করেছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান অনিশ্চয় মজুমদারের সম্মতি নিয়েই আমি বেরিয়েছি। কোনও সংশয় থাকলে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর দফতরে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিন। তাতে আপনার সাহায্য পেতে আমার সুবিধে হবে।

কাজ হয়েছে। মিতিনের স্বরের জোরালো প্রত্যয় বুঝি অভিভূত করেছে অফিসারকে। গলা ঝেড়ে বললেন, ওকে ম্যাডাম। আমি জিগমি ওয়াংচুক। অফিসার ইন চার্জ পদুম পি এস। অ্যাশিওর করছি, পদুম পুলিশ আপনার পাশেই থাকবে।… কিন্তু দেবল বড়ুয়ার কেসটা কী? ইজ হি রিয়েলি মিসিং?

অনেকটা সেই রকমই, সংক্ষেপে গোটা উপাখ্যানের অনেকটাই অফিসারকে শুনিয়ে দিল মিতিন। দেবলের হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে বেরোনো, গত বুধবার শ্রীনগর থেকে ফোন, তার কারগিল যাওয়া, জাঁসকরে আসা, কিছুই বাদ দিল না। দেবলের সঙ্গে যে একটা মূল্যবান পুঁথি আছে, সেটাও জানাল। উল্লেখ করল চন্দ্রকুমার ত্রিবেদীর কথাও। কাহিনি শেষ করে বলল, একটা ব্যাপারে এখন একশো শতাংশ নিশ্চিত হলাম। আমরা ভুল পথে আসিনি।

অফিসার বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, আপনি কী করে যে গোটা পথটা নিখুঁত ভাবে ট্রেল করলেন? তাও মাত্র তিনদিনে? এত কঠিন রাস্তা…

সঙ্গে ফ্যামিলি ছিল তো, ওরাই আমায় ইন্সপায়ার করেছে, পার্থ, টুপুর আর বুমবুমের সঙ্গে ওয়াংচুকের পরিচয় করিয়ে দিল মিতিন। হেসে বলল, তা এখন কীভাবে এগোনো যায়?

আমি কী বলব? সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে আপনি তো যথেষ্ট দক্ষ, ওয়াংচুক মুহূর্ত ভাবলেন, তবে আমার একটা অনুমান আপনাকে জানাতে পারি। হয়তো তাতে আপনার অনুসন্ধানের কিছু সুবিধে হবে।

হ্যাঁ, বলুন না প্লিজ।

দেবল বড়ুয়া সম্ভবত দারচা-মানালির পথে গিয়েছে।

 কীভাবে বুঝলেন?

কারগিল-পদুম-মানালি হাইওয়ে ইছর পর্যন্তই তৈরি হয়েছে। তারপরে আর রাস্তা নেই। ওখান থেকেই দারচা-মানালি রুটের ট্রেকিং শুরু হয়। হয়তো সেই কারণেই ইছরে মোটরসাইকেল রেখে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছে। মঙ্গলবার ভোরে।

কিন্তু দেবলরা মোটরসাইকেলে যে ইছর গিয়েছিল, সেটা কি জোর দিয়ে বলা যায়? আমি যত দূর জানি, ওরা পদুম ছেড়েছে ট্রাকে চড়ে। রোববার বিকেলে।

তা কী করে হয়? আমি ইছর থেকে ফেরার পথে রারু গ্রামেও গিয়েছিলাম। কেসটার তদন্ত করতে। রোববার রাতে তারা রারু গ্রামেই উঠেছিল। ওখানে টুরিস্টদের জন্যে হোমস্টে-র ব্যবস্থা আছে, তারই একটিতে। রারুতে যা শুনলাম, মোটরসাইকেলেই এসেছিল দেবলরা। তারপর সোমবারও নাকি ওখানে ছিল। শেষ রাতে তারা মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়।

ও, একটু থমকে থেকে মিতিন বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য ইনফরমেশন মি. ওয়াংচুক।

ইটস ওকে। কিন্তু আমার তো টেনশন রয়েই গেল ম্যাডাম। মোটরসাইকেলটা পড়েই আছে, আনাতে হবে।

জিগমি ওয়াংচুক জিপে উঠলেন। স্টার্ট দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন, এখন আপনি কী করবেন? দেবল বড়ুয়ার জন্যে অপেক্ষা? নাকি ফিরে যাবেন?

দেখি। ভাবি।

কোনও প্রয়োজন পড়লে স্বচ্ছন্দে জানাবেন কিন্তু।

 জিপটা অদৃশ্য হওয়ার পরও দাঁড়িয়ে আছে মিতিন। চিন্তান্বিত মুখে। পুলিশ দেখে ইউরোপিয়ান দম্পতি বেরিয়ে এসেছিলেন। রীতিমতো প্রবীণ, কেউই সত্তরের নীচে নন। ভদ্রলোক অন্তত সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, রোগাসোগা মহিলাটিও প্রায় ছ’ফুটি। বিপুল কৌতূহল নিয়ে পার্থর কাছে তাঁরা শুনছিলেন ঘটনাটা। ব্যস, পার্থকে আর পায় কে, দিব্যি গপ্পো জুড়েছে। দু’মিনিটেই জেনে নিল তাঁদের পরিচয় আর আগমনের কারণ। ভদ্রলোকের নাম ওলগেন জোহানসন। মহিলার নাম হানা। মেলবোর্নের বাসিন্দা। বৃদ্ধ বয়সে দু’জনের নাকি বৌদ্ধধর্মের প্রতি খুব অনুরাগ জেগেছে। ছ’দিন হল এসেছেন পদুমে, দু’খানা সাইকেল জোগাড় করে নাকি বিভিন্ন মনাস্ট্রিতে ঘুরছেন। কারসা, জাংলা, স্টোংডে, বরদান, মোনে… পাঁচ-পাঁচখানা গুম্ফা ঘোরা শেষ। এবার নাকি যাবেন এক পাহাড়ের মাথায় জংকুল গুম্ফায়। এক্ষুনি ফেরার তাড়া নেই, আরও দশ-বারোদিন নাকি এখানে থাকবেন দম্পতি।

আলাপচারিতার মাঝে হঠাৎ মিতিন হিন্দিতে বলে উঠল, তোমরা সবাই একবার রুমে এসো। নাসিরও। জরুরি কথা আছে।

ওলগেনের ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি শুনতে বেশ লাগছিল টুপুরের, কিন্তু ভঙ্গ দিতে হল আড্ডায়। মিতিনের পিছু পিছু সবাই এল রুমে।

ঘরে ঢুকেই মিতিন বিনা ভূমিকায় বলল, এখনও পর্যন্ত তোমরা সকলে আমার ইচ্ছেমতো চলেছ। এবার প্রত্যেককেই নিজের-নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বুমবুম বলল,আমাকেও?

হ্যাঁ। কারও উপর আমি আর জোর করব না।

 পার্থ বলল, হেঁয়ালি করছ কেন? খুলে বলো না।

এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, দেবলরা ইছর ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছে। এবং কারগিলের সেই অশোক পারেখ আর রাকেশ শ্রীবাস্তবও।

যাহ বাবা, অশোকরা কী করে পিকচারে এল?

কেন, ওই মোটরসাইকেল। ওই বাহনে চেপেই তো তারা কারগিল থেকে পাড়ি দিয়েছে। পদুমে না থেকে তারা সোজা চলে গিয়েছিল রারুতে। কারণ তারা আগেই বুঝে গিয়েছে, কোথায় চলেছে দেবলরা।

কীভাবে?

যে বা যারা ওদের লাগিয়েছে, হয়তো তারা এবিষয়ে ওয়াকিবহাল। সেই সূত্রে ওরাও, মিতিন টুপুরের দিকে তাকাল, পেনজি-লায় পড়ে থাকা পেট্রলক্যানটার কথা মনে আছে? ওরকম ক্যান শুধু মোটরসাইকেল আরোহীরাই সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। তাই তো নাসিরভাই?

নাসির ঘাড় দোলাল, হাঁ জি। আমরা তো ড্রাম রাখি। ছোটা ক্যানে আমাদের কী হবে?

অশোকরা একটাই ভুল কাজ করেছে। ক্যানটা খাদে ফেলে দিলেই চুকে যেত, মিতিন বলল, আর রারুতে দেবলরা ছিল, না অশোকরা, মি. ওয়াংচুকের পক্ষে তো তা জানা সম্ভব নয়। দেবলরাও দু’জন, অশোকরাও দু’জন। সুতরাং তার হিসেব মিলে গিয়েছে।

তা হলে দেবলরা ছিল কোথায়? ওই পার্সই বা ইছরে এল কোত্থেকে? তাও কিনা মোটরসাইকেলের ধারে?

নাসির ফস করে বলে উঠল, ওরা দু’জন রোড কন্ট্রাক্টরের তাঁবুতে ছিল হয়তো।

হতে পারে। তবে দেবলদের সঙ্গে অশোকদের একবার অন্তত মোলাকাত হয়েছে, এটা স্বচ্ছন্দে বলতে পারি। আর তার পরে কী ঘটেছে, কিংবা ঘটছে, তা জানাই এখন আমার কাজ।

মানে? পার্থ যেন আঁতকে উঠল, দারচা-মানালি রুটে যাওয়ার মতলব করছ নাকি?

আমার তো উপায় নেই। মনোজ বড়ুয়ার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি… প্রফেশনাল এথিক্স তো আমায় মানতেই হবে। তবে আর কারও সেই বাধ্যবাধকতা নেই।

পার্থর চোখ সরু, কী বলতে চাইছ? তুমি একাই যাবে?

যদি তোমরা কেউ না যাও। কোনও জোরাজুরি নেই। যদি কেউ যেতেও চাও, আগেই জেনে রাখা ভাল, দারচা-মানালি রুট ভয়ংকর বিপজ্জনক। সর্বদাই তেরো-চোদ্দো হাজার ফিট অলটিটিউডে হাঁটা। কখনও আরও বেশি। জুনের গোড়ায় এখনও পথে অনেক জায়গায় বরফ থাকবে। পিছল রাস্তায় একবার পা হড়কালে আর রক্ষে নেই। যে-কোনও সময়ে ধস নামতে পারে, তুষারঝড়ে পড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পথে কোথায় কীভাবে থাকব, তার স্থিরতা নেই। খাবারদাবার কী জুটবে, কিছুই জানি না।

মিতিনমাসি বলে চলেছে একদমে। শুনতে-শুনতে টুপুরের যেন হাঁটুর জোর কমে আসছিল। গলা যেন শুকিয়ে কাঠ। তবু নিজেকে অবাক করে ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলে উঠল, আমি যাব মাসি। তোমার সঙ্গে থাকব।

আবেগে চলিস না টুপুর। জীবনমরণের ব্যাপার। দুর্যোগে পড়লে তোকে বাঁচাব, সে ক্ষমতাও নেই আমার।

তবু… টুপুর হঠাৎ অকুতোভয়, তোমার যা হওয়ার… আমারও তাই হবে।

অ। তার মানে তোরা দু’জনে যাচ্ছিস? আর তোদের ছেড়ে দিয়ে আমি পদুমে বসে-বসে সারাক্ষণ টেনশন করব? পার্থ চোখ পাকাল, ওটি হচ্ছে না চাঁদু। আমিও টিমে আছি।

বুমবুম চোখ গোল গোল করে শুনছিল। এবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছে, আমি একা থাকব নাকি?

টুপুর হাসছে মিটিমিটি, কেন কী অসুবিধে। আমি বলে যাব, ওই সাহেব দাদু-দিদার সঙ্গে সাইকেলে বেড়াবি।

না-আ-আ-আ। আমি তোমাদের সঙ্গে যাব। যাবই।

আচ্ছা বাবা আচ্ছা। চেল্লানি থামাও, মিতিন বুমবুমের চুল ঘেঁটে দিল। নাসিরকে বলল, তা হলে চলুন ভাই, অ্যালপাইনে গিয়ে ট্রেকিং-এর সাজ সরঞ্জাম কিনে নিই।

 জি ম্যাডাম।

আর একটু কষ্ট করতে হবে। আমাদের ইছর অবধি পৌঁছে দিন। তারপর চাইলে পদুমে আমাদের জন্যে ওয়েট করতে পারেন। ফিরে গেলেও কিছু বলার নেই।

কেয়া বোল রহেঁ হ্যায় ম্যাডাম? নাসির যেন ভারী অবাক, ম্যায়নে আপকো জবান দিয়া না? সাথ-সাথ রহুঙ্গা? আখরি দম তক?

টুপুর হাঁ। এই প্রায় অচেনা চালকও হবে তাদের অভিযানের সঙ্গী! এত বিপদ আছে জেনেও?

ব্যস, সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। একঘণ্টায় কেনাকাটা শেষ। বিলটিল চুকিয়ে, একপেট রুটি আর স্কোয়াশের সবজি খেয়ে, বাহিনী প্রস্তুত। তারা ট্রেকিং-এ যাচ্ছে শুনে ওলগেন আর হানা দুখানা ইয়া-ইয়া বাদামের প্যাকেট উপহার দিয়ে গেলেন। ম্যাকডেমিয়া নাটস। এ নাকি দুধের বিকল্প। খেলে বহুক্ষণ ভরাট থাকে পাকস্থলী।

ইছরের পথে রওনা দিয়েছে গাড়ি। পাহাড় কেটে রাস্তা, কিন্তু দু’ধার পুরো ন্যাড়া ন্যাড়া নয়। দর্শন পাওয়া যায় গাছগাছালির। দু-দুখানা মাঝারি মাপের গুম্ফা পড়ল পথে। বরদান আর মুনে। দেখার ইচ্ছে ছিল টুপুরের, মিতিনমাসি গাড়ি থামাতে দিল না। ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে এসে গিয়েছে রারু। গ্রামটি দেখে টুপুর চমকেছে রীতিমতো। মাঠঘাট নরম সবুজ ঘাসে ছাওয়া। চাষবাসও শুরু হয়েছে দিব্যি। চরে বেড়াচ্ছে ইয়াক। উঁহু, পুরো ইয়াক নয়, খানিকটা যেন গোরু গোরু ভাবও আছে চেহারায়! চাষের কাজে লাগে বোধহয়! বারো-তেরো হাজার ফুট উঁচুতে এমন একটা গ্রাম ভাবা যায়!

রারুতে গাড়ি থামিয়ে হঠাৎ নেমে গেল মিতিন। সবাইকে বসিয়ে রেখে। মিনিট পনেরোর মধ্যে ফিরেছে। মুখ আরও থমথমে। শুকনো গলায় বলল, যা ভেবেছিলাম, তাই। হোমস্টে-তে দেবলরা ছিল না। দেবলের ফোটো দেখালাম, কেউ চিনতে পারল না।

পার্থ বলল, ও। তার মানে সামনে চারজন আছে?

সংখ্যায় তাই বোঝায় বটে। আসলে টু এগেনস্ট টু।

 অর্থাৎ তারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ?

সে রকমই তো লাগছে।

দু’পক্ষে মারামারি হয়েছিল নাকি? তখন কি দেবলের পার্স পড়ে গিয়েছে?

গবেষণা পরে, মিতিন লাফিয়ে গাড়িতে উঠল, চলুন নাসিরভাই, এগোনো যাক।

ইছরে পৌঁছোতেই দেখা মিলল মোটরসাইকেলটির। পাহাড়ের খাঁজ ঘেঁষে দাঁড় করানো, যাতে হাওয়ায় না উলটে যায়। তন্নতন্ন করে মোটরসাইকেলের কেরিয়ার ঘাঁটল মিতিন, কিচ্ছু পাওয়া গেল না।

মিতিনের ভুরুতে ভাঁজ, গাড়ির টুলবক্স গেল কোথায়?

নাসিরও যেন অবাক, তাজ্জব কী বাত, ম্যাডামজি। টুলবক্স ছাড়া তো পাহাড়ে কেউ গাড়ি বের করে না।

পাহাড়ে তো চুরি হওয়ার কথা নয়, মিতিন মাথা দোলাচ্ছে, উঁহু, এ তো খারাপ লক্ষণ।

রাস্তার কাজ বন্ধ, রোড কন্ট্রাক্টরের লোকও নেই ইছরে। অনেকটা নীচ দিয়ে বইছে সরাপ। নদীর উপর একটা ছোট্ট ব্রিজ। ওপারে পায়ে-চলা পথ। এঁকেবেঁকে পাহাড়ের মধ্যে রাস্তাটা যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, বোঝা দায়।

ওয়াইড লেন্সে সেতুকে ক্যামেরাবন্দি করে পার্থ বলল, অতঃ কিম?

মিতিন আঙুল তুলে সামনের সাইনবোর্ডটা দেখাল। তিরচিহ্ন দিয়ে বলা, ব্রিজের ওপার থেকে দারচা-মানালি হাঁটাপথের শুরু।

পার্থ ঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, বুঝলাম। তা দুটো দশ তো বাজে, আজকের মতো এখানেই তাঁবু ফেলি।… নাসির, গাড়ি কোথায় রাখবেন?

নাসির বলল, চিন্তা নেই স্যার। সামনে ইছর মনাস্ট্রি। ওখানেই রেখে দিচ্ছি। গুম্ফায় গাড়ি রাখার ভাল ব্যবস্থা আছে। দলাই লামা এলে ওই গুম্ফাতেই ওঠেন কিনা।

দলাই লামা এখানে আসেন? এই অজ জায়গায়?

জি। পাহাড়ের ভিতরে নাকি একটা বড় গুম্ফা আছে। দলাই লামা পায়ে হেঁটে গিয়েছেন সেখানে।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, কী নাম গুম্ফাটার? ফুকতাল?

 জি। শুনেছি হলুদ-টুপি লামাদের গুম্ফা।

অর্থাৎ গেলুপাদের? মিতিনকে আরও উত্তেজিত দেখাল, সেটা ঠিক কোথায়?

আমি তো যাইনি। শুনেছি দারচার পথে একটা ব্রিজ পড়ে। সেখানেই ভাগ হয়েছে ফুকতালের রাস্তা।

ইউরেকা! পলক থমকে থেকে মিতিন সহসা চেঁচিয়ে উঠল, দেবলের গন্তব্য পেয়ে গিয়েছি রে টুপুর।

দেবল ফুকতালে গিয়েছে? টুপুরের চোখ পিটপিট, কী করে বুঝলে?

 প্রশ্ন পরে। এবার ফাইনাল ল্যাপের যাত্রা শুরু। এক্ষুনি।