৫-৬. শ্রীনগর ছেড়ে বেরোনোর পর

শ্রীনগর ছেড়ে বেরোনোর পর থেকেই একটু একটু করে উপরে উঠছিল গাড়ি। বাইরে দৃশ্যপট অবর্ণনীয় সুন্দর। কাছে-দূরে বরফে মোড়া নানান মাপের পাহাড়ের সারি, তার গায়ে গায়ে ঘন সবুজের বাহার। বেশ খানিকটা নীচ দিয়ে একটা নদী বয়ে চলেছে। এঁকেবেঁকে। পাহাড়ের বুক চিরে।

টুপুরের মনটা ভরে যাচ্ছিল। কাল সন্ধেবেলা ডাল লেক দেখে বেশ খিঁচড়ে গিয়েছিল মেজাজ। কী নোংরা, কী নোংরা। কালচে সবুজ শ্যাওলায় ভরে আছে গোটা হ্রদ। বাঁধানো পাড়ে থিকথিকে টুরিস্টদের ভিড়, দু’দণ্ড শান্তিতে দাঁড়ানোর জো নেই। ফোটোতে যেমন দেখায়, হাউজবোটগুলো মোটেও তেমন মনোহর নয়। জলের মাঝে আলোকমালা, এইটুকুই যা তাদের শোভা। কিন্তু আজ যেন কাশ্মীর চিনিয়ে দিচ্ছে কেন তাকে ভূস্বর্গ বলা হয়।

চলতে চলতে নদী এখন একদম পথের ধারে। দামাল বাচ্চার মতো লাফাতে লাফাতে চলেছে। নুড়িপাথর টপকে-টপকে। ঝমঝম শব্দ উঠছে একটা। এপাশে পাহাড়ের গায়ে চরে বেড়াচ্ছে লোমশ ভেড়ার পাল। বরফ গলে গিয়ে কচি-কচি ঘাস গড়িয়েছে সবে। সেই সবুজে মুখ ডুবিয়েছে ভেড়ার দল।

মিতিন বলল, ভেড়াগুলোকে দ্যাখ টুপুর। এদের লোম থেকেই জগৎবিখ্যাত কাশ্মীরি উল তৈরি হয়।

সামনের সিট থেকে পার্থর ফোড়ন, এদের মাংস যে কেমন, কাল রাত্তিরেই টের পেয়েছিস। কী স্বাদ, আহা।

বুমবুম গোল-গোল চোখে নদী দেখছিল। পাহাড়ের এক বাঁকে এসে বায়না জুড়েছে, আমি জল টাচ করব।

থামানো হল গাড়ি। দৌড়ে নদীর পারে গিয়েছে বুমবুম। জলে হাত চুঁইয়েই চেল্লাচ্ছে, ওরে বাবা, কী ঠান্ডা।

ক্যামেরা বের করে খটাখট ফোটো তুলছিল পার্থ। সাবধানী সুরে বলল, সরে আয়। জলে পড়লে সিন্ধু যে তোকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঠিক নেই।

নদীর নামটা শুনে টুপুরের চোখ বড় বড়, এই সেই বিখ্যাত সিন্ধু? যার পাড়ে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতা?

হা হা। অনেকেই এই ভুলটা করে, নদীর আওয়াজ ছাপিয়ে পার্থর গলা গমগম করে উঠল, এটা লোকাল সিন্ধু। বেরিয়েছে কাছেই অমরনাথ পাহাড়ের এক গ্লেসিয়ার থেকে। সম্ভবত হিমবাহটার নাম খাজিয়ার।

ও। তার মানে কাশ্মীরে আসল সিন্ধু নেই?

তা কেন? আছে বই কী। তবে সেই লাদাখে। আমাদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হবে লেহতে পৌঁছে।

উঁহু, তার অনেক আগেই, মিতিন বলল, দেখলে বুঝবি এই নদীর চেয়ে সে অনেক বেশি তাগদদার।

এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে টুপুর বলল, জায়গাটা ভারী নির্জন। এখানে একটু বসা যায় না মেসো? পাখির ডাক আর নদীর আওয়াজ শুনব?

মন্দ বলিসনি। আধাঘণ্টা জিরিয়ে নে। আমিও একটু ঘুরে দেখি যদি দারুণ কিছু ল্যান্ডস্কেপ ধরা যায়।

সবে একটা পাথরে হেলান দিয়েছে টুপুর, ওমনি নাসিরের হাঁকাহাঁকি, চলুন স্যার। চলুন ম্যাডাম। একটুও সময় নষ্ট করবেন না।

পার্থ হালকা স্বরে বলল, কেন ভাই? মাত্র তো সাড়ে নটা বাজে। সারাদিনটাই তো এখনও পড়ে।

না স্যার। রাস্তা একদম ভাল নয়। দশদিন হল জোজিলা পাস খুলেছে। এখনও গাড়িঘোড়া নিয়মিত আসা যাওয়া করছে না। তার উপর এই সময়ে মাঝে মাঝেই জোজিলা পাসে বরফ পড়ে। তেমনটা হলে তো ব্যস, ওইটুকু পেরোতে দিন কাবার হয়ে যাবে।

বা রে, শুনেছি মিলিটারি নাকি সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ক্লিয়ার করে দেয়?

জোজিলায় ওই নিয়ম চলে না স্যার। গেলে বুঝবেন, সে কী ভয়ংকর রাস্তা। হরপল জান হাতে নিয়ে চলতে হয়। অথচ মাত্র বারোহাজার ফিট উঁচু। কাশ্মীর-লাদাখে এর চেয়ে ঢের ঢের উঁচু দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে। কিন্তু জোজিলায় বিপদের ভয় সবচেয়ে বেশি।

কেন?

যখন-তখন যেখানে সেখানে ধস নামে যে। মিনিটে মিনিটে জোজিলা তার রূপ বদলায়। প্রতিবার যাওয়ার সময়ে আল্লার কাছে দোয়া করি, যেন এবারের মতো ভালয় ভালয় জোজিলা পার হয়ে যাই।

টুপুরের মুখ শুকিয়ে আমসি। পার্থও যথেষ্ট ঘাবড়েছে। বুমবুমের হাত ধরে মিতিন মাথা নেড়ে বলল, সত্যি, পাহাড়ে ভাগ্য একটা বড় ফ্যাক্টর। দেখা যাক আমাদের কপালে কী আছে।

তুরন্ত গাড়িতে উঠে পড়েছে সবাই। স্টার্ট দিয়ে নাসির বলল, আর-একটা কথা ম্যাডাম। সোনমার্গে কিন্তু পেট পুরে লাঞ্চ সারবেন। কারগিলের আগে কোথাও আর আচ্ছা খানা মিলবে না।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, কারগিলে ক’টায় পৌঁছোব?

সাতটা-আটটা তো বাজবেই।… শীতে গোটা পথই তো বরফে ঢেকে থাকে, রাস্তা অনেক জায়গায় ভেঙে যায়। এখন মেরামতি চলছে। দেরি তো একটু হবেই স্যার।

যতই শুনছে, টুপুরের ধুকপুকুনি যেন বাড়ছে আরও। তবে এক ধরনের রোমাঞ্চও জাগছে মনে। এমন এক বিপদসংকুল রাস্তায় চলার সুযোগ পেয়েছে, এও কি কম সৌভাগ্য?

এঁকেবেঁকে চলছে গাড়ি। কখনও পাক খাচ্ছে পাহাড়। কখনও ছুটছে সোজা। চুপচাপ, নিসর্গে মগ্ন সবাই। মিতিন পর্যন্ত নীরব। সোনমার্গে আহারটাও যেন তেমন জমল না আজ। রুটি আর চিকেনই নিল সকলে, কিন্তু কেউই যেন ঠিক উপভোগ করল না আহার। উলটোদিকের অমরনাথ পাহাড় চেনাল নাসির, কোনও মন্তব্যই করল না কেউ। কঠিন পথের আশঙ্কা বুঝি ম্লান করে দিয়েছে টুপুরদের উচ্ছলতা।

ফের গাড়ি ছাড়তেই, বোধহয় টুপুরদের ভয় ভাঙাতে, হঠাৎ নাসিরের সঙ্গে গল্প জুড়েছে মিতিন, আপনি কতদিন এই রুটে গাড়ি চালাচ্ছেন নাসিরভাই?

তা প্রায় বারোবছর।

শুধু শ্রীনগর থেকে লেহ যান? অন্য কোথাও নয়?

লেহর ওপারেও যাই কখনও সখনও। নুবরা ভ্যালি, প্যাংগং লেক, খারদুংলা… তবে তার জন্যে আলাদা অনুমতি লাগে।

কারগিল থেকে সব টুরিস্টই কি শুধু লেহ যায়?

বেশির ভাগ। অবশ্য ফরেনাররা কেউ-কেউ জাঁসকর ভ্যালিতেও ঢোকেন।

সেখানে অনেক বৌদ্ধ গুম্ফা আছে, তাই না?

জি। বহোত পুরানা-পুরানা। আর দেখার কিছুই নেই।

আপনি গিয়েছেন জাঁসকর ভ্যালিতে?

একবার। পদুম পর্যন্ত।

লেহ আর জাঁসকর ভ্যালি ছাড়া কারগিল থেকে আর কোথায় যাওয়া যায়?

একটু চিন্তা করে নাসির বলল, না ম্যাডাম। আর সব দিকেই মিলিটারি পাহারা। টুরিস্টদের যেতে দেয় না।

আপনি যাদের আমন গেস্ট হাউজ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা কারগিলে কখন পৌঁছেছিলেন?

তা প্রায় রাত দশটা। জোজিলায় তিনঘণ্টা আটকে ছিলাম।

 পরদিন কখন জানলেন, আপনাকে লেহ যেতে হবে না?

তখন প্রায় ন’টা। আমি গাড়ি সাফসুফ করে তৈয়ার। যাঁর উমর বেশি, উনি সকালে কোথায় যেন বেরিয়েছিলেন। ফিরেই আমার ছুট্টি করে দিলেন। অচানক।

অন্যজন তখন কিছু বলেননি আপনাকে?

 উনি তো তখন সামনে ছিলেন না। শায়দ রুমমে থে।

আচ্ছা নাসিরভাই, আপনি তো পুরো একটা দিন দু’জনের সঙ্গে ছিলেন। কেমন লেগেছিল ওঁদের?

কম উমরকা যো থা, উনি তো একদম বাতচিৎ করছিলেন না। অন্যজন বহুত ফান্টুশ টাইপ। সোনমার্গে আড়াইশো রুপিয়ার খানা খেয়ে বেয়ারাকে দোশো রুপিয়া বখশিস…

বাক্য শেষ হল না, গাড়ি থেমেছে আচমকা। সামনে জোজিলা পাস চেকপোস্ট।

পরের দেড়টি ঘণ্টা যে কীভাবে কাটল টুপুরদের। শামুকের গতিতে এগোচ্ছে গাড়ি। কাদায় ডুবে-ডুবে যাচ্ছে চাকা। ডাইনে অতলস্পর্শী খাদ। বিপুল ভাঙাচোরা রাস্তায় গাড়ি একবার এদিকে হেলছে, একবার ওদিকে। প্রতিটি বাঁকই যেন মরণফাঁদ। ঘুরতে গিয়ে কেতরে যাচ্ছে গাড়ি। মাঝে মাঝে বরফ, পিছল পথে চাকা বশে রাখতে নাসিরের প্রাণান্তকর দশা। অভিজ্ঞ ড্রাইভারও ঘামছে দরদরিয়ে। কী সাংঘাতিক গিরিপথ রে বাবা! এমন কুচকুচে কালো করাল মূর্তিধারী পাহাড়ই বা টুপুর কখনও দেখেছে নাকি!

অবশেষে চূড়ায় উঠল গাড়ি। একটা লোহার ফলকে চোখ পড়ল টুপুরের। বড়-বড় করে লেখা ‘হোন্ড ইয়োর ব্ৰেথ, ইউ আর এন্টারিং লাদাখ।’

জোজিলা পেরিয়ে সত্যিই টুপুরের শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। চোখ যা দেখছে, তা কি ঠিক? একটু আগে আশপাশের পাহাড়গুলো ছিল সবুজে সবুজ, হঠাৎ কোথায় উবে গেল তারা? সামনে যত দূর চোখ যায়, শ্যামলিমার চিহ্নমাত্র নেই। এদিকের বিশাল উঁচু-উঁচু পর্বতমালা একদম ন্যাড়া। এমন লাল-লাল চেহারাও হয় পাহাড়ের?

মিতিন বুঝি টুপুরের চক্ষু ছানাবড়া হওয়াটা লক্ষ করেছে। টুপুরের কাঁধে আলগা ঠেলা দিয়ে বলল, এটাই লাদাখের বিউটি, বুঝলি। এ হল পারফেক্ট বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল। মৌসুমি বায়ুর খেল হিমালয়ের ওপারেই খতম, লাদাখের কপালে সারা বছরে তিন-চার ইঞ্চিও বৃষ্টি জোটে কিনা সন্দেহ। তারই এই পরিণাম। গাছপালা তো দূরস্থান, ঘাসপাতাও তোকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে।

হ্যাঁ, কেমন শুকনো-শুকনো চেহারা। যেন মরুভূমি।

 শুধু বালির বদলে পাথর, এই যা, বলেই মিতিন দু’দিকে ঘাড় নাড়ল, না-না, বালিও আছে। লেহর ওপারে। নুবরা উপত্যকায়। যেখান থেকে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির শুরু। সেখানে উটও দেখা যায়।

ইয়েস। দু কুঁজওয়ালা উট, বহুক্ষণ পর পার্থর স্বর ফুটেছে, ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল। শোনা যায় তৈমুরলং নাকি ভারত অভিযানের সময়ে সঙ্গে এনেছিলেন। সেই উটেরই বংশ নাকি ওখানে টিকে আছে কয়েকশো বছর।

তৈমুরলং এ পথে এসেছিলেন? এই ঠান্ডার দেশ পেরিয়ে?

ইয়েস মিস ওয়াটসন। লাদাখ বড় আজব জায়গা। এখানে শয়ে-শয়ে গিরিপথ। লা মানে গিরিপথ। আর দাখ মানে দেশ। এখানে স্থায়ী বাসিন্দা কোনও কালেই ছিল না। ওই গিরিপথ দিয়ে যে খুশি এসেছে এখানে। কখনও মধ্য এশিয়া থেকে মোঙ্গলরা, কখনও বালতিস্থানের দর্দরা, কখনও বা উত্তর ভারত থেকে মন উপজাতির লোকরা। চিনা উপজাতি হুরাও নাকি আস্তানা গেড়েছিল এখানে। আর তিব্বতিরা তো লাদাখকে প্রায় তিব্বতই ভাবে। এরকম একটা পাঁচমেশালি জায়গা দিয়ে তৈমুরংদের যাওয়া আসাটা তো খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে ভারতে আসার এই রাস্তাটা যখন সকলেরই চেনা। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে হুটহাট ঢুকে পড়া যায়।

কত ব্যবসায়ীও তো এই পথ দিয়ে যাতায়াত করত, মিতিন কাঁধে দোপাট্টা জড়াতে-জড়াতে বলল, ঘোড়া, খচ্চর, ইয়াকের পিঠে মালপত্র চাপিয়ে এই গিরিপথ দিয়ে তারা পাড়ি জমাত ভারতে। পরে তো এরই নাম হয়েছে গ্রেট ইন্ডিয়ান সিল্ক রুট।

লাদাখ নিয়ে গল্প চলছে তো চলছেই। নাসিরের কাছ থেকেও জানা হচ্ছে পথঘাটের বিবরণ। মাটিয়ান বলে একটা পুঁচকে জনপদে পৌঁছে টুপুর শুনল, এখানে নাকি এক বিচিত্র কুণ্ড আছে। মহাভারতের দ্রৌপদী নাকি আজও স্নান করেন সেখানে! সেই কুণ্ডের সামনে পাঁচ-পাঁচখানা পাহাড়। তাদের নাম পঞ্চপাণ্ডব!

আর একটু গিয়েই দ্রাস। পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম স্থান। বাইরে ঝলমলে রোদ দেখে জানলা নামিয়ে ঠান্ডাটা একটু বোঝার চেষ্টা করল টুপুর। পাঁচসেকেন্ড পরেই কাচ তুলে দিয়েছে। বাপস্ কী কনকনে বাতাস।

দ্রাসের পর আর তেমন ওঠাপড়া নেই রাস্তায়। গাড়ি তবু চলছে টিকিটিকি। সাবধানে। সাড়ে সাতটা নাগাদ কারগিলের সরকারি টুরিস্ট বাংলোয় ঢুকল। তখনও ফটফট করছে দিনের আলো।

নাসিরের ভরসায় না থেকে মিতিন হনহনিয়ে বাংলোর অফিসে চলে গেল। টুপুরকে নিয়ে। টুরিস্ট অফিসার, লাদাখি, বয়স সম্ভবত চল্লিশের এপারে। পরনে জিন্স, ফুলস্লিভ শার্ট, হাফহাতা সোয়েটার। চোখে ফোটোসান চশমা।

নেমপ্লেটে অফিসারের নাম দেখে নিয়ে মিতিন সপ্রতিভ স্বরে বলল, জুল্লে, মি. লুবজাং ইয়াবগো।

লুবজাং স্মিত মুখে বললেন, জুল্লে। ওয়েলকাম টু কারগিল। হাউ ক্যান আই সার্ভ ইউ ম্যাডাম?

চেয়ার টেনে বসল মিতিন। ইংরেজিতে বলল, একটা রুম চাই। ফোর বেড হলে ভাল হয়। থ্রি-বেডও চলবে।

কিন্তু…আগে থেকে বুকিং না থাকলে তো এখানে…

সম্ভব হয়নি স্যার। খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছি। কাল ইভনিং-এ শ্রীনগর ল্যান্ড করেই আজ সকালে স্টার্ট, মিতিন মৃদু হাসল, পথেও কমিউনিকেট করতে পারিনি। শোনমার্গের পর তো টাওয়ারই ছিল না।

টুরিস্ট?

বলতে পারেন। একটু অন্য কাজও আছে অবশ্য।

লেহ যাবেন তো? ক্ষণিক ভাবলেন লুবজাং, রাস্তা তো খুলে গিয়েছে, কালই রওনা হবেন নিশ্চয়ই?

মিতিনের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, লেহর রাস্তা বন্ধ ছিল নাকি?

জানেন না বুঝি? শুক্রবার বিকেল থেকেই তো লেহর দিকে হাইওয়ে ক্লোজড। খাটুলার আগে একটা বড় ল্যান্ডস্লাইড হয়েছিল। ইউ আর লাকি। আজ সকাল থেকে আবার গাড়ি যাচ্ছে।

ও। তা হলে এক রাতের জন্যই দিন। প্লিজ।

 ঠিক আছে। সাতনম্বরটা খুলে দিচ্ছি। সুট রুম, চারজনের স্বচ্ছন্দে কুলিয়ে যাবে।

থ্যাঙ্কস, উঠতে গিয়েও যেন থমকাল মিতিন। বিনীত সুরে বলল, একটা প্রশ্ন ছিল। আপনি তো বৌদ্ধ?

হ্যাঁ। ভগবান তথাগতর এক দীন অনুগামী।

 লাদাখে তো প্রচুর বৌদ্ধ ট্যুরিস্টের আসা-যাওয়া। তাঁদের অনেকে তো এখানেই ওঠেন। আপনার সঙ্গে কি তাঁদের পরিচয় হয়?।

অবশ্যই। পরিচয় পেলে আমি নিজে গিয়ে আলাপ করি, অমায়িক লুবজাং হাসলেন একটু, ভগবান তথাগতর অনুগামীদের প্রতি বাড়তি দুর্বলতা থাকা নিশ্চয়ই দোষের নয়।

একেবারেই না। বরং এটাই তো স্বাভাবিক। অনেকে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে গবেষণার কাজে আসেন, আপনি তো তাঁদের সাহায্যও করতে পারেন।

করি বই কী, লুবজাংয়ের স্বরে যেন জোর বেড়ে গেল, এই তো গত সপ্তাহেই একজন এসেছিলেন। ইয়ংম্যান ফ্রম কোলকাতা। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের উপর তিনি কাজ করছেন।

নাম দেবল বড়ুয়া? গবেষণা কি গেলুপা শাখার বৌদ্ধদের নিয়ে?

আপনি তাঁকে চেনেন?

একটু একটু। সম্প্রতি কলকাতায় আলাপ হয়েছিল। বলছিলেন কী এক গুম্ফার খোঁজে লাদাখ যাবেন, মিতিন টেবিলে ঝুঁকল, উনি কি এখানে আছেন এখনও?

না-না, শনিবারেই চলে গিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আত্মীয়গোছের একজন ছিলেন, উনিই নাকি তাড়াহুড়ো করে… আমি খুব শকড হয়েছিলাম। আমাকে না জানিয়েই যেভাবে চলে গেলেন!

কোথায় গেলেন ওঁরা?

কিচ্ছু জানি না। শনিবার সকালে অফিসে এসে শুধু যাওয়ার খবরটা পেলাম।

লেহর দিকে তো যাননি নিশ্চয়ই?

একটাই তো রাস্তা। সেটা বন্ধ থাকলে যাবেন কী করে?

 কাছেপিঠে আপনাদের গেলুপা শাখার বৌদ্ধদের কোনও গুম্ফা আছে?

হ্যাঁ। মূলবেখে। যেখানে আটাশফিট উঁচু বিখ্যাত বুদ্ধমূর্তি দেখতে যায় সবাই। ওখানে দুটি গুম্ফার একটি গেলুপা গোষ্ঠীর।

ও…তা ওঁরা মুলবেখে গিয়েছেন কি?

 না-না, শুক্রবারই মুলবেখ থেকে ঘুরে এলেন। বলছিলেন ওখানে কাজ হল না, বোধহয় ট্রেকিং ছাড়া গত্যন্তর নেই, লুবজাংকে হঠাৎ একটু বিস্মিত দেখাল, মি. বড়ুয়া বেশ বিখ্যাত ব্যক্তি, তাই না? চেনাজানার সার্কলটাও বেশ বড়?

কেন বলুন তো?

শনিবার রাত্রে দু’জন ভদ্রলোক ওঁর খোঁজ করছিলেন। উনি নেই শুনে খুব হতাশ হয়ে চলে গেলেন।

কে তাঁরা। এখানেই উঠেছিলেন?

 না। বললেন হোটেল সিয়াচেনে আছেন। দিল্লি থেকে এসেছেন।

কীরকম বয়স? চেহারাপত্ৰই বা কেমন?

আমার বয়সি কী একটু বড়। অ্যারাউন্ড চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। এডুকেশন লাইনের লোক বলে পরিচয় দিলেন, কিন্তু শরীরগুলো বেশ মজবুত। স্পোর্টসম্যান লাইক, লুবজাং থমকালেন একটু, এসব জেনে আপনার কী হবে?

কিছুই না। ধরুন, মেয়েলি কৌতূহল, মিতিন মিষ্টি করে হাসল, চলি তা হলে। রুমে যাই। কাইন্ডলি রুম সার্ভিসের স্টাফকে পাঠিয়ে দিন।

বেরিয়ে এল মিতিন। পার্থ আর বুমবুম গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। কী নিয়ে যেন জোর গবেষণা চলছে বাবা-ছেলের। দু’জনে ডাকছে মিতিনকে, বোধহয় তার মতামত জানতে চায়।

মিতিন থামল না। চলেছে ঘরে। অগত্যা টুপুরকেও যেতেই হয়। রহস্যের জাল ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশ, এই সময়ে মাসির পিছু ছাড়তে পারে টুপুর!

.

০৬.

গাড়িতে উঠেও চোখ খুলতে পারছিল না টুপুর। কাল দিনভর জার্নির ধকলে রাতে মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিল, ভোরের আলো ফুটতেই জাগিয়ে দিয়েছে মিতিন। ঠেলা মেরে-মেরে পার্থ আর বুমবুমকেও। তড়িঘড়ি তাদের তৈরি হতে বলেই ছুটল নাসিরকে তুলতে। আজকের গন্তব্য শুনেই সে বেঁকে বসেছিল, অনেক তুইয়ে-বুইয়ে তাকে রাজি করিয়েছে শেষমেশ। বাড়তি পনেরো হাজার টাকার কড়ারে। সাতটা বাজার আগেই সকলে সিটে আসীন, জিনিসপত্র তুলে কম্পাউন্ড ছেড়েছে নাসির।

বেরিয়েই তার প্রথম বাক্য, গাড়িতে তেল নিতে হবে ম্যাডাম।

এক্ষুনি? পার্থ একটা প্রকাণ্ড হাই তুলল, এখনও তো কারগিল ছাড়িনি?

কারগিলেই ট্যাঙ্কি ফুল করতে হবে। পিছনের ড্রামগুলোও ভরব। কারগিল থেকে পদুম দুশো চল্লিশ কিলোমিটার। যাতায়াতে পাঁচশো। গোটা জাঁসকর ভ্যালিতে এক বুঁদ ডিজেল মিলবে না, সবটাই বয়ে নিয়ে যেতে হবে।

এর পর আর কথা চলে না। টুপুর ঢুলতে ঢুলতেও টের পেল, আজও ভ্রমণটা খুব সুখের হবে না।

পেট্রলপাম্পে গাড়ি দাঁড়াতেই মিতিন টুক করে নেমে গিয়েছে। পলকে ভ্যানিশ। তেল ভরা শেষ, নাসির কখন স্টিয়ারিং-এ বসে প্রস্তুত, মিতিন আর আসেই না। বারবার ঘড়ি দেখছে নাসির, ছটফট করছে।

পার্থ বিরস মুখে বলল, তোর মাসি যে কী করে? কাশ্মীর দেখতে দিল না, কারগিলেও তিষ্ঠোল না, এখন তিনি কোন চুলোয় হাওয়া মারলেন কে জানে?

বুমবুম বলল, কারগিলে কী কী আছে বাবা?

এই কারগিলেই তো ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছিল, টুপুরই জবাব দিল, কাল দেখলি না বাংলোর কম্পাউন্ডে কেমন বাঙ্কার বানানো হয়েছিল। লোহার জালের নীচে।

শুধু যুদ্ধ দিয়ে কারগিলকে চেনাস না টুপুর, পার্থ উপদেশের সুরে বলল, কাল যে ইন্ডিয়ান সিল্ক রুটের কথা বলছিলাম, কারগিল থেকেই তার যাত্রা শুরু হত। বোখারা, সমরখন্দ, ইয়ারকন্দ, বার্মিয়ানের বড়-বড় সওদাগররা তখন ভিড় জমাত তিন পাহাড়ে ঘেরা এই কারগিলে। শহরটায় চক্কর মারলে সেই পুরনোদিনের একটা রেশ তো অনুভব করা যেত। এ ছাড়াও কারগিলের খোবানি খুব বিখ্যাত। পথের ধারেই দেখবি সাদা-সাদা ফুল ফুটে আছে…

কথার মাঝেই এসে পড়েছে মিতিন। বড়সড় একটা ঝোলা নিয়ে। গাড়িতে উঠেই জিভ কাটছে, সরি-সরি, তোমাদের অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি…

আমরা কি জানতে পারি মহারানি কোথায় গিয়েছিলেন? পার্থ গুলি ছুড়ল, কী জিনিস কেনার প্রয়োজন পড়ল সাতসকালে?

রেশন নিলাম, মিতিন মিচকে হাসল, সঙ্গে কিছু সঞ্চয় রাখাই তো ভাল।

নাসির গাড়ি ছুটিয়েছে। কারগিল শহরটা বেশ ঘিঞ্জি, পাশে-পাশে চলা সুরু নদীটার জলও বেজায় ঘোলা, পথের দু’ধারের দৃশ্যও তেমন তাকানোর মতো নয়, সাদা ফুলও নজরে পড়ছে না খুব একটা। সকলের হাতে বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে মিতিন, তাই কচকচ চিবোচ্ছে টুপুর। নীরবে।

পার্থ কিন্তু প্রশ্ন হানল, তা হঠাৎ জাঁসকরে যাওয়ার বাসনা চেগে উঠল যে বড়?

মিতিন বলল, দেবলের ওদিকেই যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

সে যে আবার শ্রীনগরেই ফিরে যায়নি, একথা কি জোর দিয়ে বলা যায়?

অবশ্যই। টেকনিক্যালি প্রায় অসম্ভব।

কেন?

কারণ, সে বাংলো ছেড়েছে শনিবার সকালে। ওইদিনই সন্ধেবেলায় দু’জন লোক তার খোঁজ করছিল। লেহর রাস্তা বন্ধ, অতএব তারা শ্রীনগর থেকেই এসেছে এবং সেই দিনই৷ দেখেছ, শ্রীনগর-কারগিল একটাই রাস্তা। তা হলে একই দিনে দেবল ওই পথে গেলে লোকদুটোর সঙ্গে মাঝে কোথাও দেখা হয়ে যেত।

শুধু এইটুকু আন্দাজ করেই এত দূরে পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিলে?

আজ্ঞে না স্যার। অন্য হিসেবও আছে, মিতিন ঈষৎ গম্ভীর, আমার ধারণা যে গুম্ফার সন্ধানে দেবল বেরিয়েছে, সেটা জাঁসকরেই আছে।

ধারণা ফারনা ছাড়ো। যুক্তির কথা বলো, পার্থ ধার বাড়াল আক্রমণের, সে যদি বৌদ্ধ পুঁথি নিয়ে গবেষণা করতে চায়, তবে তো লেহর কাছাকাছি হেমিস গুম্ফায় যাওয়া উচিত। ওখানেই তো বৌদ্ধদের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। আমি যতটুকু জানি, হেমিস থেকেই বই ছাপিয়ে অন্য সব গুম্ফায় পাঠানো হয়।

গোড়াতেই তুমি ভুল করছ। দেবল কোনও লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে বেরোয়নি। একটা প্রাচীন পুঁথি তাদের বাড়িতে ছিল, সে এসেছে সম্ভবত সেই পুঁথির উৎস সন্ধানে। কিংবা সেই পুঁথি নির্দেশিত পথে কোনও এক গুম্ফায় পৌঁছোনোই তার লক্ষ্য। কারণ পুঁথিতে মহামূল্যবান কিছুর সন্ধান দেওয়া আছে।

মানে? গুপ্তধন গোছের কিছু?

গোপনে রয়েছে যখন, গুপ্তধন তো বলাই যায়। তবে সচরাচর আমরা যেমনটা ভাবি, এ তেমন নয়। সোনাদানা, হিরে-জহরতের চেয়ে ঢের-ঢের দামি।

সেটা কী?

এমন কিছু, তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। আর দেবলের এই উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসা এও বলে দিচ্ছে, সেটা গেলুপা শাখার বৌদ্ধদের কোনও গুম্ফাতেই থাকার প্রবল সম্ভাবনা।

গেলুপা শাখা আবার কোত্থেকে এল? পার্থ ভুরু কোঁচকাল, বৌদ্ধদের তো তিনটেই শাখা। হীনযান, মহাযান আর বজ্রযান। প্রথমটা কট্টরপন্থী, মহাযানরা মাঝামাঝি, আর বজ্রযানরা বোধহয় শুধু জপতপ নয়, তন্ত্রসাধনাও করে…

তিব্বতে এটা একটু অন্য রকম। ওখানে বৌদ্ধধর্ম প্রথম পৌঁছোয় সেভেন্থ সেঞ্চুরিতে। থ্রু সাম মহাযানী ভিক্ষু। তারও তিনশো বছর পর পদ্মসম্ভব নামের এক বৌদ্ধ ধর্মগুরু যান তিব্বতে। তিনি ছিলেন বজ্রযান সম্প্রদায়ের, তখন থেকেই ওখানকার বৌদ্ধরা নানান শাখায় ভাগ হয়ে যায় সন্ন্যাসীর।

পার্থ তর্জনী উঁচোল, অতীশ দীপঙ্কর?

কারেক্ট। অতীশ গিয়ে তিব্বতি বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার আচরণে প্রথা প্রকরণে অনেক বদল ঘটান। তাঁর শিষ্যরাই বৌদ্ধদের আধুনিক গোষ্ঠী গেলুপা শাখার জন্মদাতা। যাদের প্রধান ধর্মগুরু দলাই লামা।

ও। তা দেবল কেন…

দেবলের তো আগ্রহ থাকবেই। দেবলরাও তো বজ্রযানী, গেলুপাদের প্রায় সমগোত্রীয়। তাই তো বলছি…

বলা আর হল না, আচমকা প্রবল ঝাঁকুনি। সুরু নদীর পাশে পাশে এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে টিকিয়ে-টিকিয়ে চলছিল গাড়ি, বড় গাড্ডা সামলাতে মরিয়া ব্রেক মেরেছে নাসির। বুমবুম প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ছিল, মিতিন তাকে ধরে নিয়েছে কোনওমতে।

আলগা ধমকের সুরে মিতিন বলল, থোড়া সাবধানিসে চলিয়ে নাসিরভাই।

এই কারগিল-পদুম রোডে গাড়ি এভাবেই চলবে ম্যাডাম। এর পর তো রাস্তা আরও বেহাল হবে। এখন তো সুরু ভ্যালি দিয়ে যাচ্ছি, পাহাড়ে ওঠার পর তো আর রাস্তাই থাকবে না, নাসির একটানা গজগজ করে চলেছে, আপনি তো আমার বাত শুনলেন না, জানেন এবছর এখনও রুটের বাস সার্ভিস শুরু হয়নি।

কেন? রাস্তা তো খুলে গিয়েছে?

সে আর ক’দিন? মাত্র তো একসপ্তাহ। তার মধ্যে বড়জোর তিন-চারটে ভাড়ার গাড়ি গিয়েছে জাঁসকরে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বলল, শেষ একটা গিয়েছিল গত শনিবার। তারপর এই আমরাই। কপালে যে কী আছে, সে খোদাই জানেন।

বিপদ হবে না নাসিরভাই, মিতিন মিষ্টি করে বলল, আমরা ভাল কাজে যাচ্ছি যে। না গিয়ে উপায় নেই।

কিউ?

শ্রীনগরে আমন গেস্ট হাউজ থেকে যাঁদের কারগিলে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের যে খুব বিপদ। কমবয়সি যে ছিল, সে তো আপনার ছোটভাইয়ের মতো। তাঁকে বাঁচাতেই তো আমরা ঝুঁকি নিয়েও বেরিয়েছি। আপনার মতো একজন ওস্তাদ ড্রাইভার সঙ্গে আছে, এটা আমাদের মস্ত বলভরসা। আপনি চান না, আপনার ভাইটা…

ব্যাস ব্যাস, মিতিনের তোয়াজে নাসির গলে জল। স্বরই বদলে গেল নাসিরের, আপ বেফিকর রহিয়ে ম্যাডাম। ম্যায় আপলোগকা সাথ দুঙ্গা। আখরি দম তক।

আপাতত একটু ব্রেকফাস্টের বন্দোবস্ত করা যায় না, নাসিরভাই? পার্থর অনুনয় শোনা গেল, নাকি গোটা রাস্তা শুধু ঝাঁকুনি খেয়েই থাকতে হবে?

পার্থকে আশ্বস্ত করে আধঘণ্টার মধ্যেই এসেছে একটা মাঝারি জনপদ। শাংখু। বাড়িঘর, স্কুল, ব্যাঙ্ক, খাবার হোটেলও আছে বেশ কয়েকখানা। ঝড়ের গতিতে পেটপুরে মোটা-মোটা বাজরার রুটি আর সবজি সাঁটিয়ে আবার গাড়িতে আরোহণ। এবার পথশোভা যেন বেড়েছে খানিকটা। দু’দিকে সবজেটে পাহাড়, মধ্যিখানে বয়ে চলা সুরু নদী এখন বেশ স্বচ্ছ সলিলা, ইতস্তত দেখা যাচ্ছে ফার-পাইন-দেবদারু, তাকিয়ে থাকলে বেশ আরাম হচ্ছে চোখে। রাস্তারও বেশ উন্নতি হয়েছে, ভরাপেটে একটু-একটু তন্দ্রাও আসছে যেন।

হঠাৎ বুমবুমের চিৎকার, অ্যাই টুপুরদিদি, দ্যাখ কী মজার পাহাড়।

টুপুর চোখ রগড়ে তাকাল। সত্যিই তো আজব দৃশ্য। পাশাপাশি দুখানা পর্বতশৃঙ্গ, দুটোই প্রায় সমান উঁচু। একটি বরফে সাদা হয়ে আছে, অন্যটিতে প্রায় তুষারই নেই। কী করে এমনটা সম্ভব হল?

জবাব মিলল নাসিরের কাছ থেকে। ওই দুই পাহাড় নাকি দুই ভাই, একজনের নাম নুন, অন্যজন কুন। দু’জনেই একুশ-বাইশ হাজার ফুট উঁচু, কিন্তু ভাইয়ে-ভাইয়ে নাকি একটুও মিল নেই। নুন খুব শান্তশিষ্ট, মাথাটা তার বরফে ঢাকা। কুন বেজায় রাগী, বরফ নাকি তার মাথার কাছাকাছি ঘেঁষতেই সাহস পায় না! নুন-কুনের পা ছুঁয়ে আছে এক হিমবাহ, নাম তার পারকিচিক। সে নাকি দুই ভাইয়েরই অনুগত, কিছুতেই দু’জনকে ঝগড়া করতে দেয় না। ভাইদের থামাতে খুব কান্নাকাটি করে পারকিচিক, তার চোখের জলই নাকি সুরু নদী হয়ে বইছে।

নুন-কুনের অভিনব কাহিনি শুনে মিতিন পর্যন্ত হেসে খুন। হাসতে হাসতেই টুপুরকে বলল, আসল কারণটা কী জানিস? পাহাড়ের গায়ে বা মাথায় কতটা বরফ জমবে, তা নির্ভর করে পাহাড়ের খাড়াইয়ের উপর। যে পাহাড়ে ঢাল কম, সেখানে বরফও বেশি। নুনের তুলনায় কুন অনেক বেশি খাড়া, তাই কুনের গায়ে বরফ টিকতে পারে না, গোটা বরফটা গিয়ে ওই নুন-পাহাড়েই জমা হয়।

তথ্যটা মেমারিতে চালান করে দিল টুপুর। তবে পারকিচিক হিমবাহটাকে দেখছিল মন দিয়ে। এমন ভাবে দুই পাহাড়ের পায়ের নীচে পড়ে আছে, ওকে কিন্তু নুন-কুনের বাধ্য অনুচর হিসেবে দিব্যি মানিয়ে যায়।

এবার পাহাড়ে চড়ছে গাড়ি। উঁহু, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। রাস্তা বলতে স্রেফ ভাঙাচোরা পাথর, তার উপর দিয়েই কোনওমতে গড়াচ্ছে গাড়ির চাকা। উঠতে-উঠতে কখন যে পাহাড়ের শৃঙ্গে পৌঁছোল, কখনই বা নামছে অল্প-অল্প, কিচ্ছুটি আর বোঝার বাসনা নেই টুপুরের। গাড়ি যখন হেলছে বিশ্রী ভাবে, অমনি মনে হচ্ছে এই বুঝি দু-তিনহাজার ফিট নীচে পড়ে গেল সবসুদ্ধ। পরক্ষণেই হয়তো কেতরে গিয়ে প্রায় ধাক্কা মারছে পাহাড়ের গায়ে। নিসর্গ দেখবে কী, টুপুর তো চোখ বুজে সিঁটিয়ে বসে। মনে একটাই চিন্তা কখন যে ফুরোবে এই পথ!

অবশেষে প্রাণ এসেছে ধড়ে। এই পাহাড় শেষ, এবার সমভূমি আসছে। হঠাৎ নাসির গাড়ি থামিয়ে হেঁকে উঠল, খবরদার, হুঁশিয়ার, আঁধি আ রহা হ্যায়…

আরে সত্যিই তো, সামনে ধুলোর ঝড় উঠেছে না! সমভূমি থেকে ধোঁয়ার মতো এদিক পানেই ধেয়ে আসছে যেন! পাক খাচ্ছে বাতাস, ছোট-ছোট পাথরকেও অবলীলায় আকাশে তুলে নিয়ে ঘূর্ণি এগোচ্ছে তীব্রগতিতে। একটা অদ্ভুত হুংকারও শোনা যায় কেন?

নাসির ঊর্ধ্বপানে হাতজোড় করে কাঁপছে ঠকঠক। তার প্রার্থনার গুণেই হোক, কী প্রকৃতির খেয়ালে, কয়েকমিনিট পরেই থেমে গেল ঝড়টা। তার আর চিহ্নই নেই, আবার ঝকঝক করছে নীল আকাশ, সমভূমি ফের নিথর। আধিটা যেন সত্যি নয়, শুধুই ক্ষণিক বিভ্রম। টুপুরদের মনের ভুল।

গাড়ি ছেড়েছে নাসির। সদ্য ঘাস গজানো সমভূমিতে নেমে জলের উপর দিয়েই পেরোল একটা সরু নদী। পাশে বসা পার্থকে বলল, কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছি স্যার।

পার্থ বলল,এমন শুকনো ধুলোর ঝড় এপথে হয় নাকি?

এই জায়গাটায় হয়। রংদুম গুম্ফার কাছে। তিনদিকে পাহাড় তো, এখানে এই খারাপ হাওয়াটা আসে হরদম। আঁধির মধ্যে পড়ে গেলে আস্ত গাড়িকেও দলে মুচড়ে চুরমার করে দেয়। সামনে চলুন, আরও কত খেল দেখবেন হাওয়ার।

অদূরে ছোট্ট টিলার মাথার রংদুম গুম্ফা। চূড়ায় হলুদ পতাকা। ওই পতাকা দেখেই নাকি বোঝা যায়, এটা গেলুপা বৌদ্ধদের গুম্ফা। এখানেই কেন যে দেবল থাকতে পারে না, বুঝল না টুপুর। মাসি যেন জাঁসকরের আগে কোথাওই থামতে রাজি নয়।

উপত্যকার মতো জায়গাটা পেরোতে-পেরোতে টুপুর শিহরিত হচ্ছিল। খাড়া-খাড়া গাঢ় লাল পাহাড়গুলো দেখে। বাতাসের ঝাপটায় কত যে অপার্থিব ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছে পাহাড়ের গায়ে। কোথাও ভল্লুক, কোথাও বা শাঁখ, কোথাও চাকা, কোথাও বা হরিণ। প্রকৃতিও যে কী নিপুণ চিত্রকর হতে পারে, স্বচক্ষে না দেখলে বুঝি বিশ্বাসই হত না টুপুরের!

স্বস্তির মেয়াদ শিগগিরি ফুরোল, আবার এসেছে চড়াই। বিকেলের মুখে মুখে একটা পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গাড়ি থামাল নাসির। বলল, কারগিল পদুম রোডে এটাই সবচেয়ে উঁচু গিরিপথ। প্রায় পনেরো হাজার ফিট। নাম পেনজি-লা। আপনারা এখানে একটু হাত-পা ছাড়ান। ইঞ্জিন গরম হয়ে গিয়েছে গাড়ির, সেও ততক্ষণে জিরিয়ে নিক।

প্রস্তাবটা দারুণ মনোমত হয়েছে বুমবুমের। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল সে, তিরবেগে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। খানিক দূরে সাদা-সাদা কয়েকটা সিমেন্টের বেদি চোখে পড়ল টুপুরের। কে এমন যত্ন করে বানাল? এই নির্জন জায়গায়?

পাশেই মিতিন। জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী আন্দাজ করতে পারছিস?

টুপুর কপাল কোঁচকোল, কারও সমাধি?

একদম ঠিক। কোনও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর, টুপুরের পিঠ চাপড়ে দিল মিতিন, সংস্কৃত কিংবা পালিতে একেই বলে চৈত্য। লাদাখি ভাষায় চোরতেন। গোটা লাদাখেই দেখবি চোরতেনের ছড়াছড়ি।

আচমকা কাঁধে টোকা, পিছনে একবার তাকা রে টুপুর।

পার্থর গলা পেয়েই টুপুর ঘাড় ঘোরাল। সঙ্গে-সঙ্গে শ্বাস আটকে গেল যেন। যা দেখছে, তা কি সত্যি? না স্বপ্ন? সুখানা পেল্লাই উঁচু পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে একটা বিশাল চওড়া নদী নেমে আসছে! আস্ত নদীটাই জমে তুষার? খানিকটা নদী যেন ঝুলছে শূন্যে!

টুপুরের ঠোঁট নড়ল, ওটা কী নদী?

ও তো নদী নয়, নাসির বলে উঠল, লাদাখের একটা বিখ্যাত গ্লেসিয়ার। নাম দ্রাং-দ্রুং।

নামের ওজনেই বোঝা যায়, হিমবাহটি হেলাফেলার বস্তু নয়। নাসিরই ফের বলল, ওই দ্রাং-দ্রুং থেকেই তো বেরিয়েছে স্টড নদী। এখন থেকে স্টড আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে চলবে। সেই পদুম পর্যন্ত। পুরো জায়গাটাই স্টড ভ্যালি।

পদুমও?

না-না। এখান থেকে স্টড গিয়ে পদুমে সরাপ নদীর সঙ্গে মিশে তৈরি হচ্ছে জাঁসকর নদী। তাই পদুম পৌঁছে উপত্যকার নাম হবে জাঁসকর।

বিকেলের চমৎকার আলো পেয়ে প্রাণের সুখে শাটার টিপছিল পার্থ। ক্যামেরাকে বিশ্রাম দিয়ে টুপুরকে বলল, এভাবেই উপত্যকার নামকরণ হয়। নদীর নামে। লেহর অনেকটা আগে জাঁসকর গিয়ে পড়বে সিন্ধুতে। তখন সেটা হয়ে যাবে সিন্ধু উপত্যকা। ব্যাপারটা বুঝলি?

মাথা নাড়তে নাড়তে সরে এল টুপুর। মিতিনমাসি হাত নেড়ে ডাকছে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল সেদিকে। একটা তেলের জারিকেন নাকের কাছে নিয়ে শুকছিল মিতিন। টুপুরই জিজ্ঞেস করল, এখানে পেলে বুঝি?

হুম। এতে পেট্রল ছিল। ভেরি স্ট্রেঞ্জ! মিতিন পলক আনমনা। পরক্ষণে ভ্যানিটিব্যাগ খুলে একটা দলা পাকানো কাগজ বের করল। টুপুরকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা দ্যাখ।

ভাঁজ খুলেই টুপুরের চোখ বড়-বড়, এ তো আনন্দবাজার পত্রিকা।

তারিখটা নোটিশ করেছিস?

জুনের চার।

অর্থাৎ গত মঙ্গলবার। যেদিন দেবল কলকাতা ছেড়েছিল। মানেটা বুঝলি?

মিতিনের চোখ জ্বলজ্বল করছে। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে নাসির দু’জনের কথোপকথন শুনছিল। কী বুঝেছে, কে জানে, এগিয়ে এসে সসম্ভ্রমে মিতিনকে বলল, এক বাত পুঁছু, ম্যাডামজি?

বেশক।

আপ জাসুস হ্যায় কেয়া?

সমঝ গয়া? মিতিন লঘু স্বরে বলল, তব আপ ভি তো জাসুস বন গয়া নাসিরভাই?

ভারী লজ্জা পেয়েছে নাসির। আড়ে-আড়ে দেখছে মিতিনকে। মুগ্ধচোখে। বুঝি মেয়ে ডিটেকটিভ দর্শন তার জীবনে এই প্রথম।