০৭-৯. এমন তাজ্জব

এমন তাজ্জব জীবনে হয়নি টুপুর। ভদ্রলোক বলছেনটা কী? খোদ শেঠ রুস্তমজি কালো হন্ডা সিটিটা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন? আর সেই গাড়িতেই কিনা রনি নিখোঁজ?

পার্থরও চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার দশা। ধন্ধমাখা মুখে একবার টুপুরকে দেখল, পরক্ষণে মিতিনকে। প্রায় পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে তার মাথা। কী যেন বলতে গেল মিতিনকে, স্বর ফুটল না।

মিতিনও প্রথমটায় চমকেছিল। তবে সামলে নিয়েছে এখন। স্বাভাবিক গলাতেই ফের জিজ্ঞেস করল, গাড়ির জন্য কবে ফোন করেছিলেন রুস্তুমজি?

দ্বিজেন হালদার মুখ বেঁকিয়ে বললেন, আশ্চর্য, মিস্টার জরিওয়ালা কেন ফোন করতে যাবেন? তাও এত সামান্য ব্যাপারে? ফোন এসেছিল ওঁর অফিস থেকে।

কে করেছিলেন?

অতশত বলতে পারব না। কেউ একজন করেছিল, গাড়ি চলে গিয়েছে, ব্যস। দ্বিজেন হালদার ঈষৎ তেরিয়া, আপনারা এসব জেনে কী করবেন?

উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন জুড়ল মিতিন, রুস্তমজির নাম করে যে-কেউ ফোনে গাড়ি চাইলেই আপনি পাঠিয়ে দেন?

এমন বেঁকিয়ে-চুরিয়ে বলছেন কেন? দ্বিজেন যেন এবার বেশ ক্ষিপ্ত। সামান্য চড়া গলাতেই বললেন, হ্যাঁ, দিই। মিস্টার জরিওয়ালার সঙ্গে এভাবেই আমার বিজনেস চলছে আজ পনেরো বছর ধরে। জাস্ট একটা রিং পেলেই গাড়ি চলে যায়। কখনও ওঁর অফিস, কখনও এয়ারপোর্ট, কখনও হোটেল… এনি ড্যাম প্লেস, যেখানে ওঁরা হুকুম করেন। মাসের শেষে থোক বিল পাঠাই, দিন পনেরোর মধ্যে পেমেন্ট এসে যায়। আমার সিস্টেমে কি ভুলচুক আছে কোনও?

এবারও প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল মিতিন। নিরীহ স্বরে বলল, ওঁরা কি কাল ওই হন্ডা সিটিটাই চেয়েছিলেন?

অবশ্যই। নইলে আমি পাঠাব কেন? বিশেষ কোনও নির্দেশ না থাকলে ইন্ডিকা-ফিন্ডিকা গোছের কিছু যায়।

আপনার কি ওই একটাই কালো হন্ডা সিটি?

হ্যাঁ। কালো রঙে একটা আভিজাত্য আছে তো, অনেক ক্লায়েন্টই ওটা লাইক করেন।

মিস্টার জরিওয়ালার অফিসে ওই গাড়িটি কি এবার প্রথম গেল?

দ্বিজেন হালদার একটু ভেবে বললেন, বোধহয়। সাধারণত কোনও বড় হোটেল-টোটেলই তো গাড়িটা বুক করে।

আর-একটা প্রশ্ন না করে পারছি না মিস্টার হালদার। গাড়িটা যে টাওয়ার অফ সাইলেন্সে পাঠাতে বলা হল, এতে আপনি অবাক হননি?

ভাবলাম, মিস্টার জরিওয়ালার কোনও পারসি গেস্ট এসেছেন। বলতে-বলতে দ্বিজেন হালদারের ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের রেখা, দেখুন ম্যাডাম, অবাক হওয়া আমার পেশা নয়। ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্ট রাখাটাই আমার কাজ। তাঁরা চাইলে ধাপার মাঠেও আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিতে পারি।

বুঝলাম। মিতিন তর্জনীটা তুলল, আচ্ছা, মিস্টার জরিওয়ালারাই কাল গাড়িটা নিয়েছেন, এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত তো?

মানে? আর কে নেবে?

একবার ফোন করে কনফার্মড হয়ে নিলে হত না?

 দুম করে মেজাজ হারালেন দ্বিজেন হালদার, আপনারা এবার আসুন তো ম্যাডাম। কী ব্যাপারে, কাকে নিয়ে তদন্ত করতে এসেছেন আমি জানি না। তবে এখানে গোয়েন্দাগিরি ফলিয়ে কোনও লাভ নেই। দ্বিজেন হালদার আজ পর্যন্ত কোনও কাঁচা কাজ করেনি। করেও না।

বেশ। চলি তা হলে। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।

মিতিন বেরিয়ে আসছিল, পিছন থেকে দ্বিজেন হালদারের গলা উড়ে এল, ম্যাডাম, আপনার কার্ড ফেলে গেলেন যে!

ঘুরে দাঁড়িয়ে মিতিন মিষ্টি করে হাসল, ওটা থাক। আপনার দরকার হতে পারে।

বিচ্ছিরি একটা মুখভঙ্গি করলেন দ্বিজেন হালদার। বঙ্কিম হেসে বললেন, ওকে। থাক। অ্যাজ ইউ প্লিজ।

বাইরে এসে পার্থ গরগর করে উঠল, আচ্ছা খিটকেল লোক তো! ভালভাবে কথা বলতে জানে না?

মিতিন আলগাভাবে বলল, গোয়েন্দা দেখলে কে আর খুশি হয়?

ভদ্রলোকের হাবভাব কিন্তু বেশ সন্দেহজনক গো মিতিনমাসি৷ টুপুর ফুট কাটল, একবার জানতে পর্যন্ত চাইলেন না, কেন হঠাৎ অফিসে ডিটেকটিভ এসেছে।

এই ধরনের লোকদের কী বলে জানিস? ওভার কনফিডেন্ট। একদিক দিয়ে দেখলে এরা খুব নির্বোধও। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে।

হাঁটতে-হাঁটতে পার্কিং-লটে এল তিনজনে। পার্থই চালকের আসনে বসল। মিতিন তার পাশে। পিছনে টুপুর।

গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে পার্থ জিজ্ঞেস করল, নেক্সট গন্তব্য কী জানতে পারি?

ভাবছি।

রুস্তমজির অফিসে একবার ঢুঁ মারবে নাকি?

না, থাক। বাড়িই চলো। টায়ার্ড লাগছে।

বিকেল পাঁচটাতেই দম ফুড়ুৎ?

যা কিছু ভাবতে পারো। তবে আজকের পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট।

ফেরত পথে তা হলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হসপিটালের কাছটায় দাঁড়াই! কয়েক প্লেট স্টিমড মোমো কিনে নিই? পেটটা চুঁইচুঁই করছে। দুপুরে জমিয়ে টিফিনটা হল না…!

কেনো। টুপুরেরও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।

বুমবুমটাও মোমো খুব ভালবাসে।

হুম।

গাড়ি দৌড় শুরু করার পর মিতিনের মুখে আর বাক্যিটি নেই। কী যেন ভাবছে। ভেবেই চলেছে। পথে মোমো কেনা হল, চিপস আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খেল পার্থ-টুপুর, মিতিন যেন দেখেও দেখল না।

টুপুরও বেশি ঘাঁটাল না মিতিনমাসিকে। চিন্তার সময় খোঁচাখুঁচি করলে মাসি রেগে যায়।

বাড়ি ঢুকেই মিতিন সোজা স্নানে। শীতল জলধারায় বুঝি তাজা করছে শরীর-মন।

পার্থ আর টুপুর মোমো নিয়ে বসে গেল। বুমবুমও লাফাতে লাফাতে হাজির। টপাটপ তুলে গপাগপ পুরছে মুখে। সুড়ুৎ-সুড়ুৎ চুমুক মারছে চিকেন স্টকে। আরতি কফিও বানিয়ে দিল চটপট।

খেতে-খেতে পার্থমেসোর সঙ্গে তর্ক চলছিল টুপুরের। ওই দ্বিজেন হালদার লোকটাকে নিয়েই। টুপুরের ধারণা, দ্বিজেন হালদার নিশ্চয়ই অপহরণ কেসে যুক্ত, পার্থ মোটেই সহমত নয়। যুক্তি, পালটা যুক্তির কাটাকুটি বেধেছে জোর।

টকটকে লাল চাটনিতে চিকেন মোমো মাখাতে-মাখাতে পার্থ বলল, মাথা ঠান্ডা করে ভাব। আমরা তিন-তিনজন হানা দিয়েছি…। ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে লোকটা কি একটুও ব্যাকফুটে যেত না?

আরে বাবা, রুস্তমজি ডিটেকটিভ লাগিয়েছেন, এ সংবাদ তো এখন ক্রিমিনালদের অজানা নেই। দ্বিজেন হালদার তাই হয়তো আগে থেকেই অ্যালার্ট ছিলেন। ইচ্ছে করে মিসলিড করছিলেন আমাদের। শেঠ রুস্তমজির নাম জড়িয়ে কেসটাকে যদি ঘেঁটে দেওয়া যায়…!

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। তোর মাসি রুস্তমজিকে একটা ফোন করলেই তো সত্যি-মিথ্যেটা ফাঁস হয়ে যাবে। আর এই বুদ্ধিটুকু নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের ঘটে আছে! আমার রিডিং, দ্বিজেন হালদার অভদ্রতা করেছে বটে, কিন্তু নাটক করেনি।

অর্থাৎ কেউ একজন ফোনে গাড়ি চেয়েছিল, আর ভদ্রলোক অমনি কোনও কিছু যাচাই না করে রুস্তমজিদের নামে হন্ডা সিটিখানা পাঠিয়ে দিলেন?

এরকমটা হয়েই থাকে টুপুর। একে নামী কোম্পানি, তায় পুরনো ক্লায়েন্ট, এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুনের কড়াকড়ি খুব একটা থাকে না রে। জাস্ট একটা ফোনকলই যথেষ্ট।

যদি তোমার লজিক মেনেও নিই…, দ্বিজেন হালদারের মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগল না, গাড়িটাকে কোথায় রিপোর্ট করতে বলা হচ্ছে? স্টেশন নয়, এয়ারপোর্ট নয়, হোটেল কিংবা অফিস নয়…, গাড়ি যাবে কিনা সেই টাওয়ার অফ সাইলেন্সে? কথাটা কি একটু সাজানো লাগে না?

এটাই তো প্রমাণ করে, রুস্তমজির অফিস থেকেই গাড়িটা চাওয়া হয়েছিল।

আশ্চর্য, শহরে এত জায়গা থাকতে টাওয়ার অফ সাইলেন্স কেন?

টাওয়ার অফ সাইলেন্স কী জানিস?

খুব জানি। পারসিদের সিমেট্রি। পারসি ধর্মে দাহ করা বা সমাধি দেওয়ার প্রথা নেই। ওরা একটা মিনারের চূড়ায় ডেডবডি রেখে আসে, চিল-শকুনে সেই মৃতদেহ খায়।

কারেক্ট। পারসিরা মনে করে, অন্য কোনও পদ্ধতিতে মৃতদেহ সৎকার হলে আগুন, মাটি আর জল অপবিত্র হবে। সুযোগ পেয়ে পার্থ জ্ঞান বিতরণ করল, কলকাতায় প্রথম টাওয়ার অফ সাইলেন্স, পারসিদের ভাষায় যাকে বলে দখমা, তৈরি হয়েছিল আঠেরোশো বাইশ সালে। যিনি বানিয়েছিলেন তাঁরও নাম রুস্তমজি। পুরো নাম, রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথের বন্ধু। পরে প্রথমটি বন্ধ করে দ্বিতীয় দখমাটি বানানো হয়। উনিশশো বারো সালে।

তো? টুপুর রীতিমতো অসহিষ্ণু। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এর সঙ্গে কেসের কী সম্পর্ক?

নেই। আবার আছেও। এটুকু তো অন্তত পরিষ্কার হল, গাড়িটা নিশ্চয়ই কোনও পারসি…!

ঘোড়ার মাথা। মিতিন ঘরের দরজা থেকে টিপ্পনী ছুড়ল হঠাৎ। ভিজে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে এসে বসল সোফায়। ভ্রূ নাচিয়ে বলল, যত সব আজগুবি ভাবনা মাথায় আসে কোত্থেকে? গাড়ি বেলেঘাটার টাওয়ার অফ সাইলেন্সে গেলে কোনও পারসিই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, এমনটা ধরে নেওয়ার কি কোনও কারণ আছে?

আমিও তো তাই বলছি। টুপুর কলকল করে উঠল, মেসো খামোখা এই কেসে পারসিদের ঢোকাচ্ছে। কিছুতেই বুঝতে চাইছে না, এটা দ্বিজেন হালদারের একটা চাল।

চাল, না ভাত, এক্ষুনি দেখতে পাবি। চিরুনি রেখে একখানা মোমো তুলল মিতিন। কামড় দিয়ে বলল, দশটা মিনিট অপেক্ষা কর। নিউজ আসছে।

আরতি মিতিনের কফি আনল। টেবিলে কাপ রেখে বলল, আমি তা হলে এবার রওনা দিই?

রুটিটুটি সব কমপ্লিট?

হ্যাঁ। ঝাল-ঝাল আলুর দমও বানিয়েছি। সঙ্গে মেটে-চচ্চড়ি।

আয় তা হলে। মোমো খেয়েছিস?

হ্যাঁ। দাদা দিয়েছে।

আরও তো অনেক রয়েছে, তোর মেয়ের জন্য দু-চারটে নিয়ে যা। শাশুড়ির জ্বর হয়েছে বলছিলি, সেরেছে?

না গো। ভাবছি আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

দেখিস বাবা, সিজন চেঞ্জের সময় নানান রোগব্যাধি হয়। মেয়েকেও সাবধানে রাখিস। সারাদিন ঠাকুরমার কাছে থাকে, তার যেন ছোঁয়াচ না লাগে।

ঘাড় নেড়ে গোটাচারেক মোমো ঠোঙায় ভরে নিল আরতি। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েছে কি বেরোয়নি, মিতিনের মোবাইলে ঝংকার।

খুদে যন্ত্রটি কানে চেপেই মিতিনের ঠোঁটে মুচকি হাসি। মাইক্রোফোনের বোতামটা টিপে দিয়ে বলল, আরে, দ্বিজেনবাবু যে? এত তাড়াতাড়ি আমায় স্মরণ করলেন যে বড়?

দ্বিজেন হালদারের আর্তস্বর ধ্বনিত হল, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে ম্যাডাম। আমি তো ধনেপ্রাণে মারা গেলাম!

কেন? মিতিনের গলায় মধু ঝরছে, কী হল?

আপনারা যাওয়ার পর মনটা কেমন খচখচ করছিল। হঠাৎ এসে এত প্রশ্ন করলেন…! নির্ঘাত কোনও কারণ আছে…! তবু রুস্তমজির অফিসে ফোন করতে পারছিলাম না, যদি ওঁরা কিছু মাইন্ড করেন…! শেষে মরিয়া হয়ে এই খানিক আগে অশোকবাবুকে ফোন করেছিলাম।

অশোকবাবু মানে মিস্টার জরিওয়ালার প্রাইভেট সেক্রেটারি?

হ্যাঁ ম্যাডাম। উনিই তো বেশিরভাগ সময় যোগাযোগ করেন। এবার অবশ্য উনি ফোন করেননি…! তখনই আমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল…! আজকাল যা সব কাণ্ড ঘটছে…!

আহা, কী হয়েছে বলবেন তো?

অশোকবাবু যা বললেন, তাতে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। ওঁদের অফিস থেকে কাল নাকি কোনও গাড়িই চাওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, গত পনেরো দিনের মধ্যে রুস্তমজিদের কোনও গেস্টও আসেননি কলকাতায়!

অর্থাৎ আপনার গাড়ি গায়েব, তাই তো?

সেরকমই তো দাঁড়ায়। আমার ড্রাইভারকে রিং করলাম, এক দুবার নয়, বারদশেক। এক উত্তর আসছে, মোবাইলটি এখন বন্ধ আছে!

খুবই দুঃসংবাদ। আমি অবশ্য এরকমই কিছু আন্দাজ করেছিলাম। মিতিনের স্বরে এতটুকু হেলদোল নেই। ঠান্ডা গলায় বলল, এখন কী করবেন?

ভেবে পাচ্ছি না। আপনিই বলুন…! আমার নিশ্চয়ই এক্ষুনি পুলিশকে জানানো উচিত?

সেটাই নিয়ম। তবে এ ক্ষেত্রে আপনার একটু বিপদ আছে। হাতে হাতকড়িও পড়তে পারে।

কেন? দ্বিজেন হালদারের গলা কাঁপল, কী করেছি আমি?

কাল দুপুর তিনটে নাগাদ আপনার ওই হন্ডা সিটিতে সেন্ট পিটার্স স্কুলের একটি বাচ্চাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। শুনলে আপনার আরও খারাপ লাগবে, অপহৃত বাচ্চাটি শেঠ রুস্তমজি জরিওয়ালার একমাত্র সন্তান।

অ্যাঁ, অ্যাঁ, অ্যাঁ? বিস্ময় আর আতঙ্ক একসঙ্গে ঠিকরে উঠল ওপারে। তারপর বেশ কয়েক সেকেন্ড কোনও আওয়াজ নেই। অবশেষে ফের সরব হলেন দ্বিজেন হালদার। ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, কই, অশোকবাবু তো আমায় কিছু বললেন না?

মিস্টার জরিওয়ালা ঘটনাটি যথাসম্ভব গোপন রেখেছেন। অশোকবাবুরও জানার কথা নয়।

ও। আপনি বুঝি মিস্টার জরিওয়ালার ছেলের কেসের ব্যাপারেই?

হ্যাঁ। আমি রনিকে খুঁজছি।

বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। আমার গাড়ি গিয়েছে, ক্লায়েন্টও গেল, আজ হোক, কাল হোক, পুলিশও আমায় ধরবে…! কী গাড্ডায় যে পড়লাম?

আমার একটা বুদ্ধি নেবেন?

হ্যাঁ, বলুন, বলুন। আমি একটি আস্ত বুরবক, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।

আপাতত মুখে চাবি দিয়ে রাখুন। অন্তত কাল আর পরশু, দুটো দিন। ঘুণাক্ষরেও কাউকে কিছু জানাবেন না, রুস্তমজির অফিসেও আর যোগাযোগ করবেন না। পুলিশের হ্যাঁপাটা আমি দেখছি। যদি অপকর্মের ভাগীদার না হন, নির্ভয়ে থাকতে পারেন।

গাড়িটা ফেরত পাব তো? প্রায় দশ লাখ টাকা দাম…!

দেখা যাক, আপনার কপালে কী আছে! কথা শেষ হতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল পার্থ। দুহাতে তালি বাজিয়ে বলল, বেড়ে মজা, বেড়ে মজা! সিংহের রোয়াব ছেড়ে দ্বিজেন হালদার এখন নেংটি ইঁদুর! আর-একটু স্ক্রু টাইট দিলে না কেন?

ভুল করছ পার্থ, কাউকে জব্দ করা আমার কাজ নয়। মিতিনের শান্ত জবাব, আমার এখন একটাই টার্গেট, ক্রিমিনালদের পাকড়াও করা।

এবং রনিকে অক্ষত দেহে উদ্ধার। টুপুর বাকিটা যোগ করে দিল, আমাকে তো রনির চিন্তাই বেশি কুরে কুরে খাচ্ছে।

সেই দুর্ভাবনা কি আমারও নেই রে? মিতিন শুকনো হাসল, রনিকে যারা ধরে রেখেছে, তারা অত্যন্ত ধড়িবাজ। পুলিশ বা গোয়েন্দাকে ঠকানোর জন্য তাদের বন্দোবস্ত প্রায় নিখুঁত।

যা বলেছ। গাড়ির ক্লুটাও কেমন যেন পিছলে গেল। কে গাড়ি নিয়েছে, বোঝার তো কোনও জো রাখেনি।

তাতে কী! না চাইতেই দু-চারটে সূত্র তো হাতে এসেইছে। কিছু ফাঁকফোকরও।

যেমন?

প্রত্যেকের স্টেটমেন্ট খুঁটিয়ে স্মরণ কর। মিতিন কফিতে চুমুক দিল, এনিওয়ে, আমি যা স্মেল পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে রুস্তমজির অনুমানই সঠিক। টাকাটাই তাদের মূল লক্ষ্য। খুনখারাপিতে যাওয়ার মতো হিম্মত তাদের হবে না।

পার্থ চোখ কুঁচকে বলল, তুমি যেন তাদের মনের কথা পড়ে ফেলেছ?

কিছুটা তো বটেই। আমার প্রেডিকশন সহজে ভুল হয় না। দেখলে তো, দ্বিজেন হালদারের ফোন কেমন এসে গেল!

ওটা তো স্রেফ ঝড়ে বক। দ্বিজেনবাবু যদি রুস্তমজির প্রাইভেট সেক্রেটারিকে ফোন না করতেন, তা হলেই তোমার কেরামতি গন।

একেই তো থটরিডিং বলে স্যার। আমি একশো পার্সেন্ট শিয়োর ছিলাম, ভদ্রলোক রুস্তমজির অফিসে কনট্যাক্ট করবেনই।

ধরো, যদি না করতেন?

তা হলে তো কেস অবিলম্বে সলভড। দ্বিজেন হালদারকে খোদ কিডন্যাপার বলে কোমরে দড়ি পরাতাম। মিতিন মুখ টিপে হাসল, এক্ষুনি আর-একটা ভবিষ্যদ্বাণী করব?

কী?

রাতে আজ আর-একটা ফোন আসবে।

এটা বলতে টিকটিকি হওয়ার প্রয়োজন নেই। পার্থ হা-হা হাসছে, তোমার ক্লায়েন্ট নিশ্চয়ই রাত্তিরে একটা কল করবেন!

আমি রুস্তমজির কথা বলিনি। উনি তো করবেনই। অন্য একজনের কথা বলছি।

টুপুর বলল, আমি বলব?

শুনি।

রনিদের স্কুলের প্রিন্সিপাল-ম্যাডাম। ভদ্রমহিলা খুব টেনশনে আছেন।

তিরটা ভালই ছুঁড়েছিলি। তবে একটুর জন্য ফসকাল। টুপুরের মাথায় আলগা চাঁটি মেরে মিতিন বলল, ফোনটা আসবে রনির ক্লাসটিচারের, মিস প্রিয়াঙ্কার।

.

০৮.

ছেঁড়া-ছেঁড়া একটা স্বপ্ন দেখছিল টুপুর। এক গভীর জঙ্গল…, বুমবুম ঝোপঝাড়ের মাঝখানে কম্পিউটার বসিয়ে রোডর‍্যাশ খেলছে…। হঠাৎই দুই মুশকো খেলুড়ে বেরিয়ে এল মনিটরের কালো গাড়ি থেকে…। মুখ বেঁধে ফেলল বুমবুমের…। পাঁজাকোলা করে বুমবুমকে তুলল গাড়িটায়… কম্পিউটারের পরদায় ফের ছুটল গাড়ি…। টুপুরও দৌড়োল পিছন-পিছন… আচমকা সামনে এক পাহাড়…। লোক দুটো বুমবুমকে পাহাড়ের গুহায় ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিল… প্রকাণ্ড একখানা পাথর এনে আটকে দিল গুহার মুখ…। কোত্থেকে তখনই প্রিয়াঙ্কাম্যাডাম আর রনিদের স্কুল-গেটের সেই দরোয়ানটা হাজির… টুপুর ছুট্টে প্রিয়াঙ্কাম্যাডামের কাছে গেল…। প্রিয়াঙ্কাম্যাডাম হাত বাড়িয়ে দিলেন, কার্ড কই, কার্ড…! টুপুর চিৎকার করে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু স্বর ফুটল না…। পিছন থেকে কে যেন ডাকল টুপুরকে…। একবার ডাকল, দুবার…!

ওই ডাকেই বুঝি বিকট স্বপ্নখানা ভেঙে খানখান। চমকে চোখ খুলে টুপুর দেখল, সামনে মিতিনমাসি। হাতে চায়ের কাপ।

ভ্রূ কুঁচকে মিতিনমাসি বলল, কী রে, উঠবি না?

এখনও স্বপ্নের রেশটা কাটেনি টুপুরের। চোখ রগড়ে বলল, অনেক বেলা হয়েছে বুঝি?

সাড়ে সাতটা। আমার কত কাজ হয়ে গেল, তুই এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস?

কী কাজ করলে? টুপুর ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

অনিশ্চয়দার সঙ্গে কয়েকটা দরকারি কথা সেরে নিলাম। রুস্তমজির সঙ্গে কিছু বাতচিত হল…!

কিডন্যাপিং-এর খবরটা অনিশ্চয় আঙ্কলকে জানিয়ে দিলে নাকি?

ঝেড়ে কাশিনি, তবে সামান্য হিন্ট দিয়ে রেখেছি। আল্টিমেটলি পুলিশকে তো লাগবেই। তা ছাড়া পদে-পদে কত ইনফরমেশন চাইতে হচ্ছে…। চায়ে চুমুক দিয়ে চোখে একটা রহস্যময় হাসি ফোটাল মিতিন, তোর বাবাকেও একটা ফোন লাগিয়েছিলাম।

আমার বাবাকে? কেন গো?

হঠাৎ মনে পড়ল, তোর বাবার একবার পারসিয়ান ভাষা শেখার খুব ঝোঁক চেপেছিল। ভাবলাম, সেই সূত্রে যদি কোনও পারসি বন্ধুটন্ধু থাকে…!

আছে?

অবশ্যই! এক পারসি অধ্যাপকের সঙ্গেই নাকি তোর বাবার বেজায় খাতির। ভদ্রলোকের নাম রতন দস্তুর। কপালটা আমার এমনই ভাল, ওই রতন দস্তুর নাকি টানা আট বছর পারসি ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। কলকাতার পারসিকুলের হাড়হদ্দ তাঁর নখদর্পণে।

তো? পারসিদের খোঁজখবর জেনে কী হবে?

বা রে, রুস্তমজি মানুষটি কেমন, বাজিয়ে দেখতে হবে না? তাঁর সম্পর্কে ডিটেলে জানলে কোনও সমাধানসূত্র তো মিলতেও পারে!

মানে?

মানেটা পরে শুনিস। এখন ঝটাপট মুখটুখ ধুয়ে আয়, নাস্তা রেডি হচ্ছে।

ভ্যাবলা মুখে দাঁত মাজতে গেল টুপুর। পেস্ট লাগাল ব্রাশে, দৃষ্টি বাথরুমের আয়নায়। হঠাৎ এ কী খেয়াল মিতিনমাসির? রুস্তমজিকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে জাগল যে বড়? রুস্তমজি যেমনই হন, অপহরণের সঙ্গে তাঁর কী যোগ? নাকি মিতিনমাসি রুস্তমজির পরিবার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে চান? কোন দিকে গড়াচ্ছে মিতিনমাসির সন্দেহ? রুস্তমজির কোনও আত্মীয়স্বজন…? মাত্র এক কোটি টাকার লোভে নিশ্চয়ই রুস্তুমজির ভাই অপকর্মটি করাননি! তাঁর নিজেরই তো অগাধ সম্পত্তি। তা হলে? কলকাতার পারসিমহলের কেউ? গাড়িটা টাওয়ার অফ সাইলেন্সে গিয়েছিল বলেই কি এমন একটা ধারণা জন্মাল মিতিনমাসির? কিন্তু কাল তো ওই পয়েন্টটাকে সেভাবে আমলই দেয়নি!

না, মিতিনমাসির থই পাওয়া দুষ্কর। কখন যে কোন দিকে মগজ ছোটাছুটি করে! অবশ্য মিতিনমাসির আন্দাজ যে খুব একটা ভুল পথে চলে না, এ প্রমাণ তো টুপুর কাল রাত্তিরেও পেয়েছে। রুস্তমজির আগেই ফোন এসে গেল প্রিয়াঙ্কাম্যাডামের। রনির পুরনো আই-কার্ডটি নাকি ঠিকঠাকই আছে, চাইলে প্রিয়াঙ্কাম্যাডাম মিতিনমাসির বাড়ি এসে দেখিয়ে যেতে পারেন। খুব কাকুতি মিনতিও নাকি করছিলেন মহিলা, যাতে পুলিশকে না জানানো হয়, যেন তাঁর চাকরিটা বজায় থাকে…। মিতিনমাসি অবশ্য তাতেও বিশেষ গলেনি, বরং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য প্রিয়াঙ্কাম্যাডামের উপর এখনও বেশ ক্ষুব্ধ। তবে সম্ভবত মিতিনমাসির সন্দেহের তালিকা থেকে তিনি বাদ পড়েছেন।

টুকটাক চিন্তাগুলো মাথায় নাড়াচাড়া করতে-করতেই টুপুর খাওয়ার টেবিলে এল। কমিক্স মুখে একমনে দুধ-কর্নফ্লেক্স খাচ্ছে বুমবুম। পার্থ খবরের কাগজে মগ্ন। আরতি পাহাড়প্রমাণ ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে রেখে গেল, প্লেটে-প্লেটে তুলে দিল মিতিন।

খাবারের গন্ধেই বুঝি চোখ তুলল পার্থ। টেবিলের আহার্য বস্তু পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, আজও কি তোমাদের হোল-ডে আউটিং? দুপুরে খেতে ফিরছ না?

সম্ভাবনা কম। হাতে তো মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা! মিতিন টম্যাটো সসের বোতলটা টানল। চোখ তেরচা করে বলল, তুমি কি আজ আমাদের সঙ্গে থাকছ না?

থাকতেই পারি। প্রেসে একটা ফোন করে দিলেই তো আমি ফ্রি। পার্থকে রীতিমতো চনমনে দেখাল, বাই দা বাই, কোন পথে আজ যাত্রা শুরু?

প্রথমে রুস্তমজির অফিস যাব।

কেন?

প্রশ্ন নয়। গেলেই দেখতে পাবে।

রুস্তমজি কি আজই মুক্তিপণের টাকাটা রেডি করছেন?

কাল রাতে তো তাই বললেন।

তবে কিডন্যাপারদের ফরমায়েশ মতো টাকার ব্যবস্থা করতে কিন্তু কালঘাম ছুটে যাবে বেচারার। পার্থ একখানা ফ্রেঞ্চ-টোস্ট তুলল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে-দেখতে বলল, কত ফ্যাচাং, ভাবো। বাবুরা নতুন নোট নেবেন না, হাজার টাকার নোট চলবে না, গোটাটাই চাই পাঁচশো আর একশোয়। এভাবে এক কোটি ক্যাশ জড়ো করা সোজা কথা নাকি?

টুপুর মুখ বেঁকিয়ে বলল, লোকগুলো মহা শয়তান। কাল রাত্রিরে রুস্তমজিকে টাকার অর্ডার দিল, কিন্তু কোথায় দিতে হবে কিছুতেই ভাঙল না।

কিডন্যাপারদের তো ওটাইনিয়ম। খেলিয়ে-খেলিয়ে হুকুম জারি করে, উলটোপালটা চরকি খাওয়ায়। এই যদি বলে টালায় এসো, তো দুঘণ্টা পরে বলবে টালিগঞ্জে অপেক্ষা করছি। কখনওই সোজা পথে হাঁটবে না, মানুষকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লোকগুলো পাকা খেলুড়ে। বারবার পাবলিক বুথে যাচ্ছে, ভুলেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে না।

হুম। ওতে যে নেটওয়ার্ক দেখে বাবুদের অবস্থানটি ধরা সহজ হয়। পার্থ চোখ সরু করল, আচ্ছা মিতিন, কাল কোন বুথ থেকে ওরা ফোন করেছে, ট্রেস করা গেল?

শিয়োর। দমদমের যশোর রোড থেকে এবং এটি আগের বুথটার কাছেই।

টুপুর অবাক হয়ে বলল, এত তাড়াতাড়ি তুমি জানলে কীভাবে?

ভেরি সিম্পল। ওই নাম্বারে জাস্ট একটা কল৷

ও মা, তা হলে আগের বার অনিশ্চয় আঙ্কলের সাহায্য নিলে কেন?

পুলিশকে একটু ছুঁইয়ে রাখতে হয়। নইলে কাল যখন হেল্প চাইব, অনিশ্চয়দার গোঁসা হতে পারে। বলতে বলতে মিতিনের নজর বুমবুমে। চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই, তুই হাঁ করে কী গিলছিস রে?

বুমবুমের পিলে-চমকানো জবাব, কেসটা স্টাডি করছি।

টুপরের চোখ বড়-বড, তুই জানিস কেসটা কী?

জানি তো। রনি বলে একটা ছেলে স্কুল থেকে কিডন্যাপড হয়েছে। এক কোটি টাকা র‍্যানসম চেয়েছে দুষ্টু লোকগুলো। মা ওই পাজি লোকগুলোকে ধরবে।

খুব হয়েছে। এখন দুধটুকুন শেষ করে ওঠো তো! মিতিন লঘু ধমক দিল ছেলেকে, গিয়ে স্কুলের বইখাতা ঠিকঠাক গুছিয়ে নাও। স্কুলবাস আসার মুহূর্তে এটা পাচ্ছি না, ওটা কোথায় গেল, এসব যেন শুনতে না হয়।

টুপুর বলল, আর শোন, স্কুলবাসে ওঠা-নামার সময় খুব সাবধান। চেনা-অচেনা কেউ ডাকলেও যাবি না। সোজা বাসে উঠবি, আর বাস থেকে নেমে স্ট্রেট বাড়ি।

জানি। তোকে জ্ঞান দিতে হবে না।

আলোচনার আসর থেকে হঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে বেশ ক্ষুণ্ন হল বুমবুম। তবে মার ভয়ে চলেও গেল টুপুরকে একটা ভেংচি কেটে।

ছেলেকে দেখতে-দেখতে পার্থ তারিফের সুরে বলল, বুমবুমের কী আই-কিউ দেখেছ? চুপচাপ থাকে, কিন্তু সব অবজার্ভ করে।

এবং মগজে গেঁথে নেয়। মিতিন আলতো হাসল, ভাল গোয়েন্দাদের এই ফোটোগ্রাফিক মেমারিটা থাকা একান্তই জরুরি। একবার যা দেখবে বা শুনবে, সেটা ভোলা চলবে না।

বুমবুম বড় হয়ে তা হলে ডিটেকটিভ হবে বলছ?

উঁহু, তার জন্য অনেক চর্চা দরকার। আসলে বাচ্চাদের ফোটোগ্রাফিক মেমারিটা থাকে। এর সঙ্গে ঘটনা পরম্পরা সাজানো, সেগুলোকে সঠিক উপায়ে বিশ্লেষণ করার জন্য চাই দীর্ঘ অভ্যাস। নইলে শুধু গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েই থাকতে হবে টুপুরের মতো।

টুপুরের আঁতে লাগল কথাটা। আহত মুখে বলল, আমি কি কিছু বিশ্লেষণ করতে পারি না?

পারিস? আচ্ছা বল তো, কাল সারাদিনে কেসের কোন পয়েন্টটা তোকে বেশি স্ট্রাইক করেছে?

স্কুলের ওই আইডেন্টিটি কার্ডের ব্যাপারটা? বলেই জোরে জোরে মাথা নাড়ল টুপুর, না না, ওই কালো হন্ডা সিটি…, মানে যেটা ভাড়া করা হয়েছিল।

ভেবেচিন্তে বল।

বুঝেছি। তুমি নিশ্চয়ই ফোন-বুথে আসা লোক দুটোর কথা বলছ? যারা সাইকেলে…!

তুত, ওগুলো তো কেসের সূত্র, ক্লু। স্ট্রাইকিং পয়েন্টটা আলাদা।

যেমন?

আমরা যে কেসটা টেকআপ করেছি, ক্রিমিনালরা তা জানল কী করে?

এটা কী এমন কঠিন? ঘটনাটা জানে তো মাত্র চারজন। রুস্তমজি, লীলাম্যাডাম, বি এম ডব্লিউর ড্রাইভার, আর কাজের মেয়েটি। বলেই টুপুর তড়াক লাফিয়ে উঠল, তারক, তারক। ড্রাইভার তারকই তো সোর্স।

আর-একজনকে বাদ দিলি। রনির স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।

উনি কেন জানাতে যাবেন? উত্তেজনায় আঙুল নাচাল টুপুর, তারকই বলেছে।

অত সহজে দুয়ে-দুয়ে চার করিস না। তারকই বা জানবে কী করে যে আমি ডিটেকটিভ? আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায়, লেটারবক্সে, কোথাও তো পেশাটা লেখা নেই। রুস্তমজিও নিশ্চয়ই তারককে আমাদের পরিচয় দেননি।

তবু… মনে তো হতেই পারে। রনিকে পাওয়া যাচ্ছে না… তারপরই আমাদের ডাকা হল…!

ভুল করছিস টুপুর। দুজন মহিলা, তার মধ্যে একজন স্কুলগার্ল, এদের ঝট করে ডিটেকটিভ বলে ধরা যায় কি?

অনুমান তো করাই যায়।

উঁহু, খটকাটা থেকেই যাচ্ছে।

টুপুর চুপ করে গেল। মিতিনও খাচ্ছে নীরবে। পার্থ দুজনকে ঝলকে দেখে নিয়ে বলল, এবার আমি দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি?

স্বচ্ছন্দে, তবে তাড়াতাড়ি। হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।

যশোর রোডের বুথটায় তুমি কখন কল করেছিলে?

কাল রাত্তিরেই। রুস্তমজির ফোন আসার মিনিট পনেরো পর।

অর্থাৎ অ্যারাউন্ড সাড়ে দশটা? ওপাশে কে ফোন ধরেছিল?

একজন মহিলা, নাম নীলিমা বসাক। তাকে আমি জিজ্ঞেসও করেছি, নটা কুড়ি থেকে সাড়ে নটার মধ্যে কে বা কারা বুথে ফোন করতে এসেছিল। মহিলা জানিয়েছেন, একজনই এসেছিল, সাইকেলে। বয়স বছর চল্লিশ। চেহারা নেহাতই সাদামাটা এবং মহিলা তাকে আগে কখনও দেখেননি। ।

সে যাই হোক, দুটো ফোনকলের ঘটনা কি প্রমাণ করে দিচ্ছে না যে, দুষ্কৃতীরা কাছেপিঠে কোথাও থাকে? অন্তত লেক টাউন থেকে খুব দূরে নয়?

হতে পারে।

তা হলে তো কেসের সমাধান হয়েই গিয়েছে। এবার অনিশ্চয়দাকে জানিয়ে দাও। গোয়েন্দা বিভাগের আই জি ওই এলাকায় খানাতল্লাশি চালাক। কালো হন্ডা সিটিও বেরিয়ে আসবে, সঙ্গে রনিও।

কী সহজ পন্থা? মিতিন দুদিকে মাথা নাড়ল, মাঝখান থেকে রনির প্রাণটা যাক আর কী!

আহা, তুমি আর রুস্তমজি দুজনেই তো নিশ্চিত, ওদের খুনখারাপিতে যাওয়ার মুরোদ নেই!

ঠিক কথা। তবে ধরা পড়ার আশঙ্কা প্রবল হলে তারা মরিয়া হয়ে কী কাণ্ড ঘটাবে তা কি আগে থেকে বলা যায়? সুতরাং ওই ঝুঁকিতে আমি যাবই না। মিতিন যেন সামান্য দম নিয়ে বলল, তা ছাড়া ওই ঝুঁকি নিয়ে কোনও লাভও নেই।

কেন?

ক্রিমিনালরা যথেষ্ট চতুর। আমরা যে দুটো বুথেরই লোকেশন বের করে তাদের ধাওয়া করতে পারি, তারা ভাল মতোই জানে। তবু তারা দুটো কাছাকাছি বুথ থেকে ফোন করছে। সাইকেলও খানিক তফাতে রাখতে পারত, যাতে বুথ-মালিকের চোখে না পড়ে। কিন্তু রাখেনি। কেন? কারণ, তারা চায়, আমরা যেন ধরেই নিই তারা ধারেকাছে থাকে। যেখান থেকে সাইকেলে আসা-যাওয়া করা যায়।

তার মানে, রনিকে আরও দূরে কোথাও রেখেছে?

অন্তত তুমি যেরকমটা অনুমান করছ, সেরকম কোথাও নেই। ওরা চায়, অন্ধের মতো খুঁজে-খুঁজে আমরা নাকাল হই। ইতিমধ্যে টাকা দেওয়ার সময়টাও চলে আসুক। তখন মুক্তিপণটা নিয়ে, রনিকে ফেলে রেখে তারা চম্পট দেবে।

পার্থ ভারী নিরাশ হল। গোমড়া স্বরে বলল, তবে তো ফোনবুথের ক্ল কোনও কাজেই লাগবে না!

কিছুই ফ্যালনা নয় স্যার। যদি তাকে ঠিক-ঠিক ইউজ করা যায়।

ছোট্ট একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে মিতিন ঢুকে গেল স্নানে। পার্থ আর টুপুর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কী যে ধাঁধায় তাদের ফেলল মিতিন!

.

০৯.

রুস্তমজির অফিস একটি বহুতল বাড়ির পঞ্চম তলায়। প্রবেশপথে কাচের দরজা। পেরোলেই রিসেপশন কাউন্টার, সাবেকি পি বি এক্স বোর্ড নিয়ে এক বাঙালি তরুণী সেখানে বিদ্যমান। অফিসটিও বেশ পুরনো ধাঁচের। প্রকাণ্ড ঘরখানায় আধুনিক ধারার কিউবিকল-টিউবিল নেই, ছড়ানো-ছেটানো টেবিলে কাজ করছে জনাতিরিশেক কর্মচারী। কিছু-কিছু টেবিলে কম্পিউটার মজুত।

মিতিন রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে বলল, আমরা একটু মিস্টার জরিওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

প্রয়োজনটা জানতে পারি?

একটা চ্যারিটির ব্যাপারে এসেছি। উনি ডোনেশন দেবেন বলেছিলেন।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি?

ইয়েস, এগারোটায়।

ছোট্ট পি বি এক্স বোর্ডখানার সুইচ নামিয়ে কার সঙ্গে যেন টেলিফোনে কথা বলল মেয়েটি। তারপর ঘাড় হেলিয়ে মিতিনদের বলল, প্যাসেজ ধরে এগিয়ে যান। মিস্টার জরিওয়ালার চেম্বার একদম শেষে। গিয়ে সেক্রেটারিকে স্লিপ দিন, উনি স্যারের কাছে পাঠাবেন।

রুস্তমজির ঘরের ঠিক বাইরেটায় তার একান্ত সচিব অশোক মজুমদারের প্রকোষ্ঠ। কাঁচ দিয়ে ঘেরা। এখানেও টেবিলে কম্পিউটার আর অজস্র কাগজপত্র এবং টেলিফোন।

ল্যান্ডলাইনে কথা বলছিলেন অশোক মজুমদার। বয়স বছর পঞ্চাশ, মাথায় হালকা টাক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পুরু লেন্সের ওপারে চোখ দুটো কেমন ড্যাবড্যাবা, নিষ্প্রাণ।

মিতিন-পার্থর সঙ্গে টুপুরের মতো এক কমবয়সি আগন্তুককে দেখেও কোনও জিজ্ঞাসা ফুটল না অশোক মজুমদারের মুখমণ্ডলে। রিসিভারে হাত চেপে বাড়িয়ে দিলেন দর্শনার্থীদের স্লিপ। চটপট ফোনালাপ শেষ করে ঢুকলেন রুস্তমজির রুমে। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বেরিয়ে ভাবলেশহীন স্বরে বললেন, যান ভিতরে।

রুস্তমজির নিজস্ব কক্ষটি ভারী ছিমছাম, সাদামাটা। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীসুলভ জাঁকজমক নেই কোথাও, বরং একটু যেন সেকেলে ধরনের। কাঠের আলমারি, স্টিলের ক্যাবিনেট ছাড়া আসবাব বলতে একখানা সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর কটা চেয়ার। দেওয়ালে দুটো ফোটো ঝুলছে। চোগা চাপকান, টুপিধারী পারসি ভদ্রলোকটি সম্ভবত রুস্তমজির বাবা। অন্যটি এক শ্মশ্রুধারী সন্ন্যাসীর। জরথুস্ত্র।

একটি মোটা কুরসিতে বসে ছিলেন রুস্তমজি। উঠে দাঁড়িয়ে পার্থর সঙ্গে আলাপ করলেন। আসন গ্রহণ করতে বললেন মিতিনদের। বসতে-বসতে টুপুরের মনে হল, আজ যেন কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে রুস্তুমজিকে। ও হ্যাঁ, চোখে আজ সোনালি ফ্রেমের চশমা! পরশু তো ছিল না।

মিতিনের মনেও বুঝি একই প্রশ্ন জাগল। জিজ্ঞেস করল, এটা কি আপনার রিডিং গ্লাস?

হ্যাঁ, ম্যাডাম। তবে সামান্য মাইনাস পাওয়ারও আছে।

সব সময় পরেন না বুঝি?

একেবারেই পরতাম না। ইনফ্যাক্ট, আজ থেকেই শুরু করলাম। বলতে বলতে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন রুস্তমজি। চোখ কচলে বললেন, খুব অসুবিধে হচ্ছে। তবে ডাক্তারের হুকুম, সারাক্ষণ চোখে লাগিয়ে রাখতে হবে।

প্রথম-প্রথম ওরকম অস্বস্তি হয়। সয়ে যাবে আস্তে-আস্তে।

হুম! রুস্তমজি একটুক্ষণ চুপ। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, তা ম্যাডাম, আপনাদের প্রোগ্রেস কদ্দূর?

এগোচ্ছে। কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য পেয়েছি। আপনার টাকার বন্দোবস্ত কমপ্লিট?

আজ বিকেলের মধ্যে পুরোটা রেডি হয়ে যাবে।

ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মিস্টার জরিওয়ালা, কীভাবে ব্যবস্থাটা করলেন যদি জানতে পারতাম…!

কয়েক সেকেন্ড স্থিরদৃষ্টিতে মিতিনকে দেখলেন রুস্তমজি। শুকনো হেসে বললেন, আপনার প্রশ্নটা আমি বুঝতে পারছি ম্যাডাম। কিন্তু টাকার সোর্স আপনাকে যে বলা সম্ভব নয়। তবে এইটুকু শুনে রাখুন, ব্যবসায়ীদের নানা সময়ে এই ধরনের কাঁচা টাকার প্রয়োজন হয় এবং কোনও প্রশ্ন ছাড়াই সেই টাকা জোগান দেওয়ার লোকও আছে কলকাতায়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার এই টাকা জোগাড়ের সংবাদ কাকপক্ষীও জানে না। কীভাবে করছি, কোত্থেকে করছি, কিচ্ছু না। এমনকী, লীলাকেও কথাটা ভাঙিনি। এখন সমস্যা শুধু একটাই। পাঁচশো আর একশো মিলিয়ে তো, টাকার আয়তনটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে।

পার্থ মাথা দুলিয়ে বলল, অর্থাৎ ক্যারি করার অসুবিধে, তাই তো?

হ্যাঁ, সাহেবজি। কীভাবে নিয়ে যেতে হবে, ঝোলায় না ব্রিফকেসে, এখনও তো জানায়নি। প্লাস আমাকে আমার গাড়িতে যেতে অ্যালাও করবে কি না তাও তো বুঝছি না। যদি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ইউজ করতে বলে ট্যাক্সি বা বাস গোছের কিছু, তা হলে হয়তো প্রবলেমে পড়ে যাব।

তা বটে। ওভাবে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও তো আছে।

আমি আর ওসব নিয়ে ভাবতে চাই না, সাহেবজি। রুস্তুমজির মুখখানা ভারী ফ্যাকাশে দেখাল। সত্যি বলতে কী, ভাবনা করার ক্ষমতাও বুঝি লোপ পাচ্ছে। এবার বড় অসহায় বোধ করছি যেন।

স্বাভাবিক। এমন একটা সঙ্কটে পড়েছেন!

একটা নয় সাহেবজি, অনেক। নিজের কষ্ট চেপে এক দিকে স্ত্রীকে সামলাচ্ছি, অন্য দিকে বাইরের লোকের সামনে নরমাল থাকতে হচ্ছে, এ যে কী কঠিন। অফিসে আসতে প্রাণ চাইছে না, তবু তো জোর করে আসছি। যাতে আমার অফিসের কেউ কিছু আঁচ না করতে পারে। এই তো, সকালে এক বন্ধু ফোন করেছিল। হেসে-হেসে তার সঙ্গে কথা বলতে হল। এভাবে বুকে পাথর চেপে কি নিশ্বাস নেওয়া যায়?

কিন্তু স্যার, রনির মিসিং হওয়ার খবর তো আরও দুজন জানে। তাদের মাধ্যমে কানাকানি হওয়া তো মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

আশঙ্কাটা আমার মাথায় ছিল। পরশুই দুজনকে তাই কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছি। বলেছি, যদি কেউ সামান্যতম মুখ খোলে, সঙ্গে-সঙ্গে তাকে পুলিশে হ্যান্ডওভার করব।

তবু খবরটা কিন্তু চাউর হয়েছে, মিস্টার জরিওয়ালা। না হলে গোয়েন্দা নিয়োগের সমাচারটি ক্রিমিনালদের কানে পৌঁছোল কীভাবে?

আমার ধারণা, ওরা আন্দাজে একটা ঢিল মেরেছে। লীলাকে ভয় দেখিয়ে বোধহয় বুঝে নিতে চাইছে, সত্যি-সত্যি আমি কারও সাহায্য নিচ্ছি কি না। কারণ, কাল রাতে যখন ফোনটা করল, তখন কিন্তু আর গোয়েন্দার প্রসঙ্গ তোলেনি।

গুড অবজারভেশন, মিতিন এবার নাক গলাল কথোপকথনে। চোখ কুঁচকে বলল, এমন একটা চাল ক্রিমিনালরা দিতেই পারে। কারণ, ওরা জানে, আপনার চেয়ে ম্যাডামকে কাবু করা বেশি সহজ।

লীলাও কিন্তু ওদের কাছে গোয়েন্দা নিয়োগের কথাটা স্বীকার করেনি। একটাই কথা শুধু বলে গিয়েছে, আমি কিছু জানি না। আপনারা আমাকে ছেলে ফিরিয়ে দিন। 

আচ্ছা মিস্টার জরিওয়ালা, ওরা কি ম্যাডামকে আর রনির গলা শুনিয়েছিল?

না।

আপনাকে? কাল রাতে?

উঁহু।

বোঝা গেল প্রথমবারও ফোনের সময় রনি ধারেকাছে ছিল না। ওরা টেপ করা গলা শুনিয়েছে।

বটেই তো। টুপুর উৎসাহিত স্বরে বলল, ফোনবুথের ভদ্রলোক তো কোনও বাচ্চার কথা বললেনও না। তা ছাড়া রনি নিশ্চয়ই তখন বুঝে গিয়েছে, সে বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছে। সুতরাং তাকে পাবলিক প্লেসে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভবই না।

একটা কঠিন অঙ্কের সমাধান করলি তো! মিতিনের ঠোঁটে যেন হালকা বিদ্রূপ। পরক্ষণে হাসি মুছে গলায় প্রশ্ন ফুটল, আপনি কিন্তু লীলাম্যাডামের কাছে আসা ফোনটার নাম্বার এখনও দেননি, মিস্টার জরিওয়ালা।

ও হ্যাঁ, একদম ভুলে গিয়েছি। রুস্তমজিকে যেন ঈষৎ অপ্রস্তুত দেখাল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বললেন, এখানে নোট করা আছে, লিখে নিন। তবে এটাও একটা পাবলিক বুথেরই নাম্বার। আমি ডায়াল করে দেখেছি।

কথাবার্তার মাঝেই দরজায় অশোক মজুমদারের কণ্ঠ, আসতে পারি স্যার?

কী ব্যাপার?

জামশেদপুর ডিলারের একটা চালান সই করানোর ছিল। আজই জিনিস পাঠাতে হবে।

আপনিই তো সই মেরে দিতে পারতেন, অশোকবাবু।

তবু নতুন পার্টি তো স্যার, আপনি যদি একবার…! বলতে বলতে চালানের বইটি রুস্তমজির টেবিলে রাখলেন অশোক মজুমদার। বুকে কাগজটায় চোখ বোলাচ্ছেন রুস্তমজি, ফের অশোকের গলা, চশমাটা পরে নিন স্যার।

সরি। অভ্যেস হয়নি তো, খেয়াল থাকছে না। রুস্তুমজি ফের চশমা চড়ালেন। সই করতে-করতে বললেন, ফ্রেমটা কিন্তু অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কানে লাগছে।

আমি তো আপনাকে বলেছিলাম স্যার, কোনও বড় দোকান থেকে করান। আপনি শুনলেন না।

বউবাজারে ওই চশমার দোকানটার সঙ্গে আমাদের কত বছরের সম্পর্ক বলুন তো! বাবা-মা দুজনেই ওদের কাস্টমার। ছোট থেকে দেখছি, বউবাজারের মেটকাফ স্ট্রিটে আমাদের পবিত্র অগ্নিমন্দিরে গেলে বাবা একবার অন্তত দাস অ্যান্ড কোম্পানি-র দোকানে ঢুকবেনই। ঐতিহ্যটা কি হুট করে ভাঙা যায়?

কথাটা যেন অশোক মজুমদারের পছন্দ হল না। বিরস মুখে বললেন, তা হলে আর কী! কষ্ট করে পরুন কদিন। নেক্সট যেদিন মন্দিরে যাবেন, দেখিয়ে নেবেন।

আজ আপনার মুড অফ মনে হচ্ছে? রুস্তুমজি টিপ্পনী কাটলেন, হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছেন বুঝি?

আমার প্র্যাকটিস আছে স্যার। মিসেস তো প্রায়ই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি যায়।

এবার তারা ফিরছে কবে?

রবিবারের আগে নয়।

এ কদিন হোম ডেলিভারি আনিয়ে নিন। মেজাজ শরিফ থাকবে।

প্রসঙ্গটায় যেন অস্বস্তি বোধ করছিলেন অশোকবাবু। আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।

রুস্তমজির ঠোঁটে একফালি হাসি, দেখেছেন তো, কী সিরিয়াস টাইপ! তবে আমার ভালমন্দের দিকে কিন্তু খুব নজর। পুরনো লোক তো, প্রায় আত্মীয়ের মতো হয়ে গিয়েছেন।

সেরকমই তো মনে হল, মিতিনও মৃদু হাসল। এখানে কতদিন চাকরি করছেন?

বছর কুড়ি। যবে থেকে কার্পেটের বিজনেসটা টেকআপ করেছি, প্রায় তখন থেকে।

ও।

মিতিন আর প্রশ্নে গেল না। ঠান্ডা মাথায় চমৎকার সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করল গতকালের কার্যবিবরণী। কে জানে কেন, ভাড়ার গাড়ির বিষয়টা এড়িয়ে গেল কায়দা করে। এর পর কালপ্রিটদের ফোন এলে রুস্তমজিকে কী কী জেনে নিতে হবে, তাও শেখাল ভালভাবে।

নীচে নেমে সোজা পার্কিং-লট। রুস্তমজির বি এম ডব্লিউ গাড়ির জানলায় তারক সিটে ঢুলছিল। তাকে ডেকে তুলল।

মিতিনদের দেখে তারক হতচকিত। মাথায় টুপিটি চড়িয়ে বেরিয়ে এল তাড়াতাড়ি। শশব্যস্ত মুখে বলল, ইয়েস ম্যাডাম?

মিতিন সরু চোখে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি কে?

আজ্ঞে… মানে…! মিতিনের চোখে চোখ রেখেও তারক দৃষ্টি নামিয়ে নিল, আপনাকে তো ঢাকুরিয়া থেকে আনলাম।

কেন আপনার মনিবের বাড়ি গিয়েছিলাম বলুন তো?

চমকে তাকিয়েও তারক ফের নতমস্তক। নিরুত্তর। নখ খুঁটছে।

মিতিনের স্বর সামান্য কঠোর হল, বুঝতে পারছেন কী, আমি খুব সুবিধের লোক নই? এখন যা যা জানতে চাইব আশা করি জবাব মিলবে?

বলুন?

পরশুদিন ঠিক কটায় রনির স্কুলে পৌঁছেছিলেন?

বিকেলে?

নয়তো কি সকালের কথা বলছি? কখন আপনি বাচ্চাটাকে আনতে গিয়েছিলেন?

যেমন যাই, তিনটেয়।

উঁহু, মিথ্যে বলবেন না।

দু-পাঁচ মিনিট হয়তো লেট হয়েছিল।

বাজে কথা। আপনি সাড়ে তিনটের আগে পৌঁছোননি।

হতেও পারে। ঘড়ি দেখিনি।

কবজিতে রিস্টওয়াচ, তাও দেখেননি?

তারক উত্তর দিল না। গোঁজ মেরে রইল।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে মিতিন গলা একধাপ চড়াল, আপনার দেরির কারণেই কিন্তু রনি নিখোঁজ হল। অর্থাৎ রনি হারিয়ে যাওয়ার জন্য আপনি কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।

ও, স্যারের ছেলে হারানোর কেসে আপনি আমাকে জড়িয়ে দিতে চাইছেন? নার্ভাস তারক হঠাৎই তেরিয়া। মুখ-চোখ আমূল বদলে গেল। আঙুল নেড়ে বলল, কৈফিয়ত আমার তৈরি আছে ম্যাডাম। পরশু সাহেবের কাজ করতে গিয়েই আমার দেরি হয়েছিল।

কী কাজ?

সাহেবের চশমা ডেলিভারি নেওয়ার ছিল বউবাজার থেকে। খামোকা দোকানে আমাকে বসিয়ে রাখল। তিনটের আগে নাকি ওদের কারখানা থেকে জিনিস আসে না। সেই চশমা নিয়ে যেতে যেতে আমার তো দেরি হতেই পারে।

আগে রনিকে তুলে নিয়ে চশমার দোকানে যাননি কেন?

তখন কি জানতাম, একদিন লেট হলে রনি হাপিস হয়ে যাবে?

পার্থ ফস করে বলে উঠল, আপনি যে সত্যি-সত্যি বউবাজারে আটকে গিয়েছিলেন, এটা প্রমাণ করতে পারবেন?

সাক্ষীসাবুদ রাখতে হবে এমনটা তো ভাবিনি। তবু খোঁজ করে দেখতে পারেন। তারক গজগজ করল, মনে যদি কু মতলব থাকত, কবেই তো রনিকে গায়েব করতে পারতাম।

মিতিন যেন শুনেও শুনল না। জিজ্ঞেস করল, রনির আই-ডি কার্ড তো গাড়িতেই থাকে, তাই না?

হ্যাঁ, ড্যাশবোর্ডে রাখা ছিল। এখন ম্যাডামের কাছে। তারকের স্বর ধীরে ধীরে নরম হল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, রনির এখনও কোনও খোঁজ পাননি, না?

উত্তর না দিয়ে মিতিন বলল, আপনি কদ্দিন মিস্টার জরিওয়ালার গাড়ি চালাচ্ছেন?

প্রায় তিন বছর। বি এম ডব্লিউটা কেনার আগে থেকে। তখন সাহেবের ফোর্ড গাড়িটা চালাতাম।

আর রাকেশ কতদিন কাজ করছেন?

আমার চেয়ে অনেক কম, বছরখানেক।

রনির সঙ্গে কার বেশি ভাব, আপনার না, রাকেশের?

অবশ্যই আমার। গাড়িতে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে বকবক করে। কোন ভিডিয়ো গেমস কীভাবে খেলতে হয়, স্কুলে ক্রিকেটম্যাচে ও কত রান করেছে, কোন সিনেমাটা ভয়ের, কোনটা হাসির, সব আমাকে বলা চাই। যথেষ্ট চালাক-চতুর ছেলে। ওকে যে কেউ ভুলিয়েভালিয়ে তুলে নেবে, ভাবতেও পারিনি।

হুম, তা রাকেশ কেমন?

এমনিতে মন্দ নয়। তবে ভীষণ ফাঁকিবাজ। ঘনঘন ডুব মারে। মেমসাহেব নিজেও গাড়ি চালান তো, সেইজন্য ওর আরও সুবিধে।

সাহেব নিজে চালান না গাড়ি?

খুব কম। ক্কচিৎ-কখনও হয়তো কোনও পার্টিতে গেলে আমায় তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন। তখনই যা…!

আচ্ছা, রাকেশ কি মিছে কথা বলে ছুটি নেন?

সেটা তো বলতে পারব না। তবে ফাঁকিবাজদের তো একটু গপ্পো বানানোর অভ্যেস থাকে।

দেশে যাওয়ার নাম করে কলকাতায় বসে নেই তো?

কে জানে? বলেই তারকের চোখ সরু, কেন বলুন তো? রাকেশকেও কি আপনি সন্দেহ করছেন?

বাদ দেওয়ারও তো কারণ দেখি না। কাজটা তো কারও একার নয়, বেশ শলাপরামর্শ করেই হয়েছে।

মানে? কথায়-কথায় খানিক সহজ হল তারক, আবার আড়ষ্ট রীতিমতো। হাতজোড় করে বলল, দয়া করে আমাকে এর মধ্যে টানবেন না ম্যাডাম। আমি কিন্তু সত্যিই কিছু জানি না। এমনই কপাল, একদিন যেতে লেট হল, আর সেদিনই সর্বনাশটা ঘটল? সাহেব-মেমসাহেবের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছি না পর্যন্ত। কী মনোকষ্টে যে ভুগছি, সেটা যদি জানতেন!

কিন্তু আমার যে কয়েকটা খটকা থেকে যাচ্ছে তারকবাবু। মিতিন চোখ নাচাল, কাইন্ডলি সেগুলো একটু ক্লিয়ার করবেন?

কী কী খটকা?

সেদিন ম্যাডামকে তো স্কুল থেকে আগে সাহেবের অফিসে নিয়ে আসা উচিত ছিল। অথচ আপনি ম্যাডামকে বাড়ি ফেরার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কেন?

এরকম বলেছি? কই, মনে তো পড়ছে না।

তারপর ধরুন, আপনি সাহেবের কাজেই গিয়েছিলেন এবং তার জন্য আপনার দেরি হয়েছে। অথচ কথাটা আপনি সাহেব মেমসাহেবকে জানাননি। কেন?

বিশ্বাস করুন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। ওঁরা যা নার্ভাস ছিলেন, তখন যদি কথাটা বলি, ওঁরা হয়তো আমাকেই…! তাই ভয় পেয়ে…!

হুম। মিতিন আগাপাশতলা দেখল তারককে। তারপর হঠাৎই প্রশ্ন হানল, আমাদের চৌরঙ্গিতে আনার সময় আপনার মোবাইলে পরপর দুটো কল এসেছিল। কার-কার?

একটা আমার বাড়ি থেকে, দিদির ফোন। তাড়াতাড়ি ফিরব বলেছিলাম। দেরি দেখে ফোন করছিল। দ্বিতীয় ফোনটা মজুমদার সাহেবের। জানতে চাইছিলেন, স্যারের চশমা পেয়েছি কি না।

হুম! মিতিন চোখ ঈষৎ তেরচা করল, আচ্ছা তারকবাবু, রনিকে আনতে যাওয়ার সময় কখনও কাউকে সঙ্গে নিতেন কি? মানে অফিসের কেউ?

ওরে বাবা, স্যারের গাড়িতে যাকে-তাকে তুলব? একবার সুজয়বাবুকে গাড়িতে উঠিয়ে যা বকুনি খেয়েছিলাম!

কে সুজয়বাবু?

মজুমদারসাহেবের ছোট ভাই৷ ক্যাশে কাজ করতেন।

এখন নেই?

ছেড়ে দিয়েছেন। তারক একটু দম নিল, একবার মজুমদার সাহেবের জ্বর। অফিসে আসছিলেন না। তখন স্যার আমাকে ওঁর সল্টলেকের বাড়িতে একটা ফাইল আনতে পাঠিয়েছিলেন। ওদিকের রাস্তাঘাট তো তেমন চিনি না, ভেবেছিলাম সুজয়বাবু তো ওই বাড়িতেই থাকেন, ওঁকে সঙ্গে নিলে সুবিধে হবে। কিন্তু ভাইকে সাহেবের গাড়িতে দেখে মজুমদারসাহেবের সেদিন কী চোটপাট! সেই থেকে স্যার-ম্যাডাম না বললে কাউকে গাড়িতে ওঠাই না।

মজুমদারসাহেবকেও নয়?

উনি এ গাড়ি চড়েন না। তা ছাড়া তার তো নিজের গাড়ি আছে, সানত্রো।

মিতিন এদিক-ওদিক চোখ চালিয়ে বলল, কোন গাড়িটা?

এখন কদিন আনছেন না। ব্রেকের কী গন্ডগোল হয়েছে, সারাতে দিয়েছেন।

ও! মিতিন ঠোঁট সামান্য সুচলো করল, চশমাটা কি পরশুই সাহেবকে দিয়েছিলেন?

না ম্যাডাম। ওই ঘটনার পর মাথাতেই ছিল না। কাল বিকেলে ফেরার পথে মনে পড়ল, তক্ষুনি দিয়ে দিয়েছি।

তারককে আর কোনও জেরায় গেল না মিতিন। একটুক্ষণ ভাবল কী যেন। তারপর অন্যমনস্ক পায়ে হাঁটা লাগাল নিজেদের গাড়ির দিকে।