৭-৮. টুলকার দুর্গম পথ

টুলকার পথও রীতিমতো দুর্গম। শাল, সেগুন শিশুগাছ তো বটেই, আরও কত যে লতা আর ঝোপঝাড়ে ভরে আছে জঙ্গল। মেঘলা আকাশে সূর্যও আজ মুখ লুকিয়েছে। বিকেল হওয়ার আগেই ঘোর আঁধার নামছে পথে। রাস্তাও ভারী উঁচু-নিচু, জিপ প্রায় লাফাতে লাফাতে চলেছে। কপাল ভাল, পথে দু’খানা বাইসনের দর্শন মিলল। বাঁকানো শিং, মহিষের মতো দেখতে প্রাণীগুলো ভারী শান্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে রাস্তা জুড়ে। পার্থ তো মহা পুলকিত। তক্ষুনি লাফিয়ে নেমে ফোটো তুলতে যাচ্ছিল। নিষেধ করলেন বিভূতি। যতই নিরীহ মনে হোক, বাইসন নাকি অতি ভয়ংকর, বাঘও তাকে সমঝে চলে। বিরক্ত হলে এমন তেড়ে আসবে, পার্থকে শিঙে না গেঁথে ছাড়বে না। আর তা না পারলে ঢুসো মেরে মেরে ক্ষতি করে দেবে গাড়িটার।

অগত্যা গাড়িতে বসেই শাটার টিপছে পার্থ। স্টার্ট বন্ধ করে কাঠ হয়ে বসে থাকার পর সন্তর্পণে একবার মাত্র হর্ন বাজালেন বিভূতি। ভারী অবহেলাভরে গাড়ির দিকে একবার মাত্র তাকাল বাইসন দুটো, তারপর দুলকি চালে সেঁধিয়ে গেল জঙ্গলে। জিপ ফের চলতে শুরু করার পর বনের মধ্যে দৃষ্টি চালিয়ে প্রাণী দুটোকে খুঁজল টুপুর। নাহ, কোত্থাও নেই। বড়সড় দুটো বাইসন যেন মিশে গিয়েছে গাছপালায়।

টুপুর নিজের মনেই বলল, যাহ, পুরো ভ্যানিশ!

মিতিন বলল, হ্যাঁ রে। জঙ্গলের মধ্যে প্রাণীদের নড়াচড়া একদম টের পাওয়া যায় না। হয়তো খুব কাছেই রয়েছে, কিন্তু তুই বুঝতে পারবি না।

বিভূতি বললেন, তাই তো জঙ্গলে খুব সতর্ক থাকতে হয়। সর্বদা সজাগ রাখতে হয় চোখ-কান।

নিঃশব্দে চরে বেড়ানোর ব্যাপারে হাতি সবচেয়ে সাংঘাতিক।

 মিতিন মাথা নেড়ে সায় দিল, হঠাৎ দেখবি সামনে এসে হাজির। অথচ তার দু’ সেকেন্ড আগেও শুকনো পাতা মাড়ানোর আওয়াজটা পর্যন্ত পাবি না।

কথা বলতে বলতেই ছোট একটা গ্রাম পেরোল গাড়ি। টিনের বোর্ডে নাম ঝুলছে গ্রামের, ছোটকাই। আবার ঘন জঙ্গল শুরু।

বুমবুম প্রশ্ন জুড়েছে, এখানে লোক থাকে কেন? ভয় করে না?

টুপুর বিজ্ঞের মতো বলল, গ্রামের লোকদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তারাও জন্তুজানোয়ারদের ঘাঁটায় না, জন্তুরাও তাই তাদের ক্ষতি করে না।

অতটা সিম্পল নয় রে, পার্থ ফোড়ন কাটল, এখানকার মানুষদের যথেষ্ট লড়াই করে বাঁচতে হয়।

বুমবুমের চোখ বড় বড়, কীরকম লড়াই?

যখন যেমনটা প্রয়োজন। ভালুক, চিতা তো প্রায়শই হানা দেয় গ্রামে। তখন ওরা লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরোয়। তবে সবচেয়ে মুশকিল, যখন হাতির পাল চড়াও হয়। খেতের ফসল নষ্ট করে। বাড়িঘর লন্ডভন্ড করে দেয়। তখন গাঁয়ের লোক দলবেঁধে বেরিয়ে এসে ক্যানেস্তারা পেটায়।

তা হলেই হাতিরা পালায়?

হ্যাঁ, ওই ক্যানেস্তারার আওয়াজটাকে ওরা একটু ভয় পায় কিনা। অনেক সময় অবশ্য ক্যানেস্তারাতেও কাজ হয় না। তখন ফরেস্ট গার্ডরা এসে…

বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট শব্দ। ঘ্যাচাং ব্রেক কষেছেন বিভূতি। লাফিয়ে নেমে পড়লেন সিট ছেড়ে। জিপের পিছন থেকে ঘুরে এসে বললেন, ঝামেলা হয়ে গিয়েছে স্যার। টায়ার বার্স্ট করেছে।

পটকা ফাটার মতো আওয়াজটায় বেজায় চমকেছিল টুপুর আর বুমবুম। উদ্বিগ্ন মুখে টুপুর বলল, তা হলে কী হবে এখন? গাড়ি আর যাবে না? এই জঙ্গলের মধ্যে?

ভয় পাচ্ছ কেন? বদলি টায়ার তো সঙ্গে আছে। তোমরা নেমে দাঁড়াও, আমি লাগিয়ে ফেলছি। আর জঙ্গল তো শেষ। টুলকা প্রায় এসেই গিয়েছে। টুলকায় টায়ার সারানোর একজন মিস্ত্রি আছে। তোমরা যতক্ষণ টুলকায় ঘুরবে, আমি ততক্ষণে খারাপ টায়ারটা মেরামত করে নেব।

সত্যি, টুলকা আর বেশি দূরে নয়। টায়ার বদলে সেখানে পৌঁছোতে মিনিট পনেরো মতো লাগল। ছোট্ট জনপদ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবজির খেত। মাটির ঘরের পাশাপাশি পাকা বাড়িও আছে অল্প কিছু।

হাঁটতে হাঁটতে বনবাংলোর দিকটায় গেল টুপুররা। গেটের মুখেই বনবিভাগের এক কর্মচারীর সঙ্গে দেখা। টুপুররা কিছু বলার আগেই সে দু’ হাত নাড়ছে, কোই রুম খালি নেহি হ্যায়। সব ফুল হ্যায়।

পার্থ কৌতূহলী মুখে বলল, বহুত টুরিস্ট আয়া হ্যায় কেয়া?

হাঁ সাব। কোই জাগাহ নহি মিলেগা। কাল দো সাব আয়ে থে, উনকো ভি হম ওয়াপস ভেজ দিয়া।

দো সাব? মিতিনের ভুরু জড়ো, দিখনেমে ক্যায়সে থে উয়োলোগ?

বহুত তাকতদার। কন্ধামে বহুত বড়া বড়া ঝোলা থা। এক সাবকা মোটি মোচ থি।

মিতিন হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছিলেন তাঁরা?

হিন্দিতেই জবাব এল, সন্ধের পর। সাতটা-আটটার সময়।

জায়গা না পেয়ে ওঁরা কী করলেন? চলে গেলেন?

হাঁ।

এখানে আর কোথাও থাকার ব্যবস্থা আছে?

না। তবে অনেকে গ্রামের লোককে বলে কয়ে এক আধ রাত থেকে যায়। কেউ কেউ ছোটকাইয়ে কারও বাড়িতে গিয়েও থাকে। যাদের খুব সাহস, তারা জঙ্গলের ওয়াচ টাওয়ারেও রাত কাটায়।

ওয়াচ টাওয়ার কত দূর?

এখান থেকে অনেকটা। সবচেয়ে কাছে করদাপাড়া। সেটাও তো প্রায় দশ কিলোমিটার।

ওঁরা কি কাল সেখানেই…

কে জানে! টুলকায় তো আজ সারাদিন দেখিনি, ছোকরা কর্মচারীটির চোখে জিজ্ঞাসা, আপনারা কি ওঁদের চেনেন?

না। জঙ্গলেই আলাপ হয়েছিল। ওঁরা তা হলে এখানে নেই। তাই তো?

থাকলে তো দিনে একবার চোখে পড়ত। তা আপনারা কি এখন ফিরে যাবেন?

পার্থ বলল, উপায় কী!

হেঁটে চারপাশ ঘুরুন না। কাছেই একটা সুন্দর ঝরনা আছে, ভীমধারা। ঝরনার ধারে হরিণ টরিনের দেখা মিলতে পারে।

পথনির্দেশ জেনে নিয়ে হাঁটা ধরল টুপুররা। টুলকা থেকে একটা চড়াই মতো রাস্তা উঠে গিয়েছে উপরে। সেই পথ ধরেই চলেছে চারজন। অল্প একটু গিয়েই বাঁক। ঘুরতেই টুলকা অদৃশ্য, সামনে ফের জঙ্গল। তেমন গভীর না হলেও বেশ গা ছমছমে। হঠাৎই বুমবুম জোরে চেপে ধরেছে টুপুরের হাত। আঙুল তুলে গাছের মগডালে কী যেন দেখাচ্ছে।

চোখ তুলে তাকাতেই টুপুরের হৃৎপিণ্ড ধড়াস। বেজির মতো দেখতে ওটা কী? রক্তের মতো লাল দু’খানা চোখ জ্বলছে যেন! গায়ের রং না লাল, না বাদামি। ইয়া মোটা লেজ। তড়াক তড়াক লাফ মারছে এ ডাল থেকে ও ডালে।

পার্থরও নজরে পড়েছে। ফিসফিস করে বলল, ভয় পাস না, ওটা জায়ান্ট স্কুইরেল। সাতকোশিয়ার স্পেশ্যাল।

প্রাণীটা কাঠবিড়ালি শুনে টুপুর খানিকটা আশ্বস্ত হল বটে, তবু একটা বুক ঢিপঢিপ ভাব যেন রয়েই গেল। চলতে চলতে সাবধানে দেখছে এদিক ওদিক। বাঁয়ে পাহাড়ের দিকটায় মাঝে মাঝে প্রকাণ্ড গর্ত। শুকনো ডালপালায় ঢাকা।

টুপুর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কী?

বোধহয় বাঘটাঘদের স্টোরেজ, পার্থ বেমালুম নির্ভয়ে বলল, গাঁ থেকে গোরু ছাগল তুলে আনে তো অনেক সময়। বেশি ভিতরে নিয়ে যায় না। মেরে এখানেই ঢাকা দিয়ে রাখে। পরে সময় সুযোগ মতো এসে পেটে চালান দেয়।

তার মানে, কাছাকাছি বাঘ আছে?

থাকা অসম্ভব নয়। এই জঙ্গলে যে দু-চারখানা বাঘ টিকে আছে, তারা নাকি টুলকার দিকেই… আর চিতাবাঘ তো আছেই।

টুপুরের শরীর হিম হয়ে গেল। বুমবুম কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, আমি আর যাব না।

যেতে আর হলও না। অদূরে কাঠের ডান্ডার মাথায় তির চিহ্নে নির্দেশিকা, ভীমধারার পথ।

এ রাস্তাটা তবু মন্দের ভাল। সরু বটে, তবে জঙ্গলটা ছেঁড়া ছেঁড়া। এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে পাহাড়ের প্রান্তে। সেখানে পৌঁছে টুপুর তো বেজায় হতাশ। শুধু টুপুর কেন, সকলেই। কোথায় গেল ভীমধারা? একটু দূরে পাহাড় থেকে একটা জলস্রোত গড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা নেহাতই ক্ষীণ।

পার্থ বিরক্ত মুখে বলল, দুর দুর, আসাটাই বৃথা।

চৈত্র মাসে পাহাড়ি ঝরনার চেহারা এরকমই হয়। বর্ষায় এরই রূপ একেবারে বদলে যাবে, মিতিন বাইনোকুলারটা চোখে লাগাল। নীচটা দেখতে দেখতে বলল, জায়গাটা কিন্তু ভারী সুন্দর।

কী ছিরিটা দেখছ? পাহাড়টা ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে, নীচে এবড়োখেবড়ো পাথর, সেখানে ডোবা মতো হয়ে খানিকটা জল জমে আছে, ব্যস।

আরও দ্রষ্টব্য আছে, মিতিন বাইনোকুলারটা এগিয়ে দিল পার্থকে, দ্যাখো তো, আর কিছু চোখে পড়ে কিনা?

যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে পার্থ জোর চমকেছে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, নীচে তো মানুষ! একটা নয়, দুটো!

হুম। কর্মবীর আর শক্তিধর। টুপুরও এবার দেখতে পেয়েছে দু’জনকে। খোলা চোখেই। দু’জনে একটা পাথরের উপর চিতপাত হয়ে শুয়ে। জলের ধারে।

বিস্মিত মুখে টুপুর বলল, ওঁরা ওভাবে পড়ে কেন? মরে টরে গেছেন নাকি?

মোটেই না, দিব্যি জ্যান্ত আছেন। নড়ছেন, পার্থ বাইনোকুলারটা মিতিনকে ফেরত দিল। চোখ সরু করে বলল, ওরা তা হলে এখানেই গা ঢাকা দিয়ে আছে?

তাই তো দেখছি, মিতিন ঠোঁট চাপল, চলো তো, গিয়ে কথা বলি।

কথা কীসের? গিয়ে ক্যাঁক করে ধরবে। জঙ্গলে রিভলভার নিয়ে ঘুরছে, এ কি মামদোবাজি পায়া হ্যায়?

রিভলভার তো আমার সঙ্গেও আছে পার্থ।

 তোমার ব্যাপার আলাদা। তুমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রাখতেই পারো।

ওঁদেরও হয়তো লাইসেন্স আছে, মিতিন মৃদু হাসল, উত্তেজিত হোয়ো না। চলো, আলাপটা একটু ঝালাই।

পাহাড়ের গা বেয়ে খাঁজ কাটা কাটা পায়ে চলার পথ। প্রায় সিঁড়ির মতো। সাবধানে পা ফেলে নামল চারজনে। টুপুরদের দেখেই কর্মবীর আর শক্তিধর উঠে বসেছেন।

ভুরু কুঁচকে শক্তিধর বললেন, আপনারা হঠাৎ এখানে?

আপনাদের পিছু পিছু এসে পড়লাম আর কী, মিতিন হাসছে। সহজ সুরেই বলল, বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালাম না তো?

রেস্ট নিতে তো জঙ্গলে আসিনি। আমরা দণ্ডীবাট করছি।

পার্থ সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল, সেটা কী?

পায়ে হেঁটে সাতকোশিয়া পরিক্রমা। পাক্কা সাঁইত্রিশ কিলোমিটার ঘোরা, সহজ কাজ তো নয়।

সে তো বটেই। তার সঙ্গে যদি মাঝে মাঝে হরিণের পিছু পিছু ঘুরতে হয়, তা হলে তো কাজটা আরও কঠিন।

একটু যেন চমকালেন কর্মবীর। পরক্ষণে স্বাভাবিক গলাতেই বললেন, কঠিন পরিশ্রম না করলে দু’বেলা দুটো অন্ন জুটবে কী করে মশাই? রাতবিরেতে জঙ্গলে কাটাবার ঝুঁকিই বা কেন নেব?

আমারও তো সেই প্রশ্ন। এত ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে চক্কর মারছেন কেন? পার্থ ফস করে বলে উঠল, আপনাদের মতলবটা কী?

আপনাদের সেবা করা, শক্তিধর বিটকেল সুরে হেসে উঠলেন। মিতিনের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই গাড়ি নিয়ে টুলকা এসেছেন?

অবশ্যই, পার্থ জবাব দিল, আমাদের তো হেঁটে-হেঁটে জঙ্গল চষার শখ নেই। বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যও নেই।

ব্যঙ্গটা যেন গায়েই মাখলেন না শক্তিধর। ফের মিতিনকেই বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই এখন টিকরপাড়াতেই ফিরবেন?

লিফট চান তো? মিতিন দু’হাত ছড়িয়ে দিল, ওয়েলকাম। চলে আসুন।

থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। দণ্ডীবাট তো মোটামুটি শেষ, টিকরপাড়ায় তাঁবুটার বুকিং এখনও আছে। ভাবছি, আজ টিকরপাড়া ফিরেই যাই।

ঝোলাঝুলি কাঁধে চাপিয়ে উঠে পড়লেন দু’জনে। টুপুর আর পার্থ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। মিতিনমাসির আক্কেলটা কী বুঝে উঠতে পারছে না টুপুর। জেনেশুনে দুটো সন্দেহজনক লোককে জামাই আদরে নিয়ে যাবে এখন? দিব্যি জঙ্গলের গল্পও জুড়ে দিল দুই মক্কেলের সঙ্গে। তবে কর্মবীর আর শক্তিধরের সঙ্গী হওয়ায় একটা বাঁচোয়া। ফের পাহাড়ে চড়তে হল না, শর্টকাট রাস্তা ধরে সবাই ফিরে এসেছে টুলকায়।

টায়ার সারিয়ে সারথিও প্রস্তুত। বিকেল বিকেলই রওনা দিল জিপ। বনবাংলোয় এসে কর্মবীর আর শক্তিধর চলে গেলেন তাঁবুর দিকে।

সন্ধে নেমে গিয়েছে। বাংলোর লনে বসে চা আর ভাজাভুজি খাওয়া হচ্ছিল। পাশের বাংলোয় আলো জ্বলছে। বেগুনি খেতে খেতে পার্থ হঠাৎ বলল, আমাদের কিন্তু একবার প্রোফেসরসাহেবের কাছে যাওয়া উচিত।

মিতিন কী যেন ভাবছিল। টক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ঠিক বলেছ। চলো, ভদ্রলোকের একটা খবর নিয়ে আসি।

বিভূতি রাতের রান্নায় ব্যস্ত। বুমবুমকে তাঁর জিম্মায় রেখে মিতিনরা গিয়েছে পাশের বাংলোয়। দরজা বন্ধ। কড়া নাড়তেই পাল্লা খুলেছে সুবাহু। একটু যেন থমথমে মুখ।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, স্যার এখন কেমন আছেন?

 ভাল নয়, জ্বরটা বেড়েছে।

 ও, একবার দেখতে পারি স্যারকে?

এখন? ওষুধ খেয়ে মশারির মধ্যে শুয়ে আছেন। বোধহয় ঘুমিয়েও পড়েছেন।

স্যারকে আজ আর ডিসটার্ব না করাই ভাল, সুবাহুর পিছন থেকে বিট অফিসারের স্বর উড়ে এল, তা ছাড়া আপনারা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছেন। ফরেস্ট ম্যালেরিয়া রোগীর কাছে বেশি না যাওয়াটাই নিরাপদ।

মিতিন বিট অফিসারকে দেখে অবাক যেন। বলল, আপনি? এই বাংলোয়?

পূর্ণচন্দ্র আলগা হাসলেন, আমিই তো ডাক্তারবদ্যির কাজ করছি। জঙ্গলে এসে অনেকেই তো এই অসুখে পড়ে, তাই কিছু মেডিসিন আমাদের কাছে মজুতই থাকে। সেগুলোই দিয়ে গেলাম। কমলে ভাল, নইলে কাল ওঁকে নিয়ে আঙুলে ছুটতে হবে।

পার্থ সুবাহুকে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের রান্নাবান্নার কী ব্যবস্থা?

চিন্তা করবেন না। পূর্ণবাবু সব কিছুর আয়োজন করে দিচ্ছেন।

আর কথা না বাড়িয়ে নিজেদের বাংলোয় ফিরল মিতিন, টুপুর আর পার্থ। রুমে এসে মেসোর সঙ্গে গল্প জুড়েছে টুপুর। জঙ্গলের মশা নিয়ে। সকালে নদীতে দেখা ঘড়িয়ালটাকে নিয়ে। টুলকা ভ্রমণ নিয়ে। শক্তিধর আর কর্মবীরকে নিয়ে। টিকড়পাড়া ফেরার পথে কর্মবীর আর শক্তিধর কেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন, তাই নিয়েও গবেষণার শেষ নেই দু’জনের। একমাত্র মিতিন চুপ। তার যেন কিছুই কানে যাচ্ছে না। সকালে ফাঁকা তাঁবুতে কুড়িয়ে পাওয়া কার্বন পেপারটা ব্যাগ থেকে বের করে আলোয় মেলে দেখল একটু। তারপর ফের সেটি ব্যাগে চালান করে চলে গেল রান্নার তদারকিতে।

কালই জঙ্গলে শেষ দিন। সকালে বাঘমুন্ডা যাওয়ার প্ল্যান। নৈশাহার সেরে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল সকলে। কোত্থেকে যেন একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। খুবই চেনা গন্ধ। জুইফুল? উঁহু। কামিনী? রজনীগন্ধা? নাহ, অনেকটা ল্যাভেন্ডারের মতো লাগে যেন! সাতকোশিয়ার জঙ্গলে কি ল্যাভেন্ডার ফোটে? পাশের বাংলো থেকে আজও ভেসে আসছে গিটারের সুর। কী নেশা রে বাবা! স্যারের অসুখেও গিটার বাজানোয় খামতি নেই।

সুরেলা গিটার আর ফুলের সৌরভে কখন যে চোখ জড়িয়ে এসেছিল টুপুরের। মিতিনমাসি যে কখন বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়, বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখছে দূরের তাঁবুর আলো, টুপুর টেরও পায়নি।

সকালে ঘুম ভাঙল বুমবুমের চিৎকারে। ঠেলছে টুপুরকে, অ্যাই ওঠ, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।

টুপুর চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, হলটা কী?

 খাঁচায় বড় ঘড়িয়াল দুটো নেই। আমি নিজের চোখে দেখে এলাম এক্ষুনি।

.

০৮.

বাংলোর সামনের লনটায় বিট অফিসার পূর্ণচন্দ্র বেহেরা ঘাড় ঝুলিয়ে বসে। পাশেই সুবাহু। তারও মুখে-চোখে প্রবল বিস্ময়। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা বিভূতিও কেমন থতমত মুখে দাঁড়িয়ে। তিনজনের কারও মুখে বাক্যটি নেই।

পার্থমেসোর সঙ্গে আবার একবার খাঁচাটা দেখে ফিরল টুপুর। ভোরবেলা থেকে এই নিয়ে তিনবার দেখা হল খোলা খাঁচাটা। প্রথমে বুমবুমের সঙ্গে, তারপর মিতিনমাসির পিছু পিছু। খাঁচায় ঢুকে কত কী যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করল মিতিনমাসি। আঙুল ঘষে ঘষে কী যেন পরখ করল খাঁচার মেঝেতে। দেখল, মাছবিহীন ছোট্ট-ছোট্ট জলাশয়গুলোও। তা মাসিও যে এরকম ঘটনায় দারুণ চমকেছে, এতে টুপুরের কোনও সংশয়ই নেই।

পার্থও রীতিমতো উত্তেজিত। রাগ-রাগ গলায় পূর্ণচন্দ্রকে বলল, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? ঘড়িয়ালগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্য সিকিয়োরিটি গার্ড রাখেননি?

পূর্ণচন্দ্র আমতা আমতা মুখে বললেন, না, মানে, রাজুই তো ছিল। রাতবিরেতেও গিয়ে ওদের দেখে আসত। ও হঠাৎ চলে গিয়ে বড় মুশকিল হয়েছে।

সে তো বোঝাই যাচ্ছে। খাঁচার দরজা খোলা পড়ে, কেউ নজর করেনি, পার্থ তেরছা চোখে তাকাল, ঘড়িয়ালদের খাবারদাবার কে দিচ্ছিল এখন?

খাবার মানে তো শুধু জ্যান্ত মাছ। স্থানীয় এক ধীবরকে বলা আছে, সে সাপ্লাই দিয়ে যায় নিয়মিত। রাজুর জায়গায় আমিই এখন ছাঁকনিওয়ালা জালে করে ছেড়ে দিচ্ছিলাম ফিশ পুলে।

কালও দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, রাত্রি তখন প্রায় ন’টা বাজে।

 তখনই বুঝি খাঁচার দরজাটা খুলে রেখে এসেছেন?

এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবে অনেক সময় তো একটুআধটু ফাঁক থেকে যায়। আর ওরা যে সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে…। পূর্ণচন্দ্র কপাল চাপড়াচ্ছেন, আর মাত্র তিনটে মাস গেলে কোনও অশান্তিই ছিল না।

কেন?

ওরা পূর্ণবয়স্ক হয়ে গিয়েছিল তো। এ বছরই বর্ষায় ওদের নদীতে ছেড়ে দেওয়া হত।

কথোপকথনের মাঝে মিতিন যেন কখন এসে দাঁড়িয়েছিল পিছনে। ফস করে হালকা সুরে বলল, তা হলে আর দুশ্চিন্তা করছেন কেন? জলের জীব জলেই চলে গিয়েছে, আপনাদের আর টানাটানির পরিশ্রম করতে হল না।

তা বললে কি আমার চলবে ম্যাডাম? মিয়োনো স্বরে বললেন পূর্ণচন্দ্র, নির্ঘাত শোকজ খেতে হবে।

রেঞ্জ অফিসে জানিয়েছেন?

অবশ্যই। শুনে তো রেঞ্জারসাহেবের কী চোটপাট!

সব দোষ আপনাদের ওই রাজুর। ব্যাটা আমাদের পাঁচশো টাকা নিয়ে কোথায় যে চম্পট দিল, অনেকক্ষণ পর সুবাহু মন্তব্য জুড়ল, রাজু থাকলে এসব কিছু ঘটত না।

পার্থ বলে উঠল, সে তো শুনলাম বাড়ি গিয়েছে।

তাই নাকি? আপনাকে কে বলল?

লবঙ্গির চৌকিদার। সুরজ মুন্ডা না কী যেন নাম। রাজু নাকি পনেরো দিন পর ফিরবে।

আশ্চর্য! আমাকে একবার জানিয়ে পর্যন্ত গেল না, পূর্ণচন্দ্র ঝেঁঝে উঠলেন, ফিরুক একবার। ওর চাকরি যদি না আমি খেয়েছি!

আহা, অত রেগে যাচ্ছেন কেন? ছেলেমানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে, মিতিন শান্ত করতে চাইল বিট অফিসারকে। স্বাভাবিক স্বরে বলল, আচ্ছা পূর্ণবাবু, ঘড়িয়াল দুটো নদীতে গেল কোন পথে?

কেন? খাঁচার দরজা পেরোলেই তো রাস্তা। সুবাহু আগ বাড়িয়ে জবাব দিল, ঘষটে ঘষটে আর হাত-দশেক গেলেই পাহাড়কিনার। ওখান থেকে পাথর বেয়ে বেয়ে নদীতে নেমে যাওয়া কুমির ঘড়িয়ালদের পক্ষে কী এমন কঠিন! বাই দ্য ওয়ে, কাল শেষরাতে আমি ঘড়িয়ালের ডাকও শুনেছি।

আপনিও…? পূর্ণচন্দ্রর চোখ উজ্জ্বল হল, আমারও কানে এসেছে। তখন বোধহয় রাত তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে। ওই সময়ই বোধহয় পালিয়েছে।

ইস, ওই সময় যদি বেরিয়ে আসতেন, তা হলে বোধহয় দুই ঘড়িয়ালই ধরা পড়ে যেত, মিতিনের গলায় কৌতুকের সুর, যাক গে, ওই নিয়ে ভেবে তো আর লাভ নেই। বরং গুছিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করুন। এদিকে আমরাও ব্রেকফাস্ট সেরে বাঘমুন্ডায় বেরিয়ে পড়ি।

হ্যাঁ, ঘুরে আসুন। বাঘমুন্ডা খুব ভাল লাগবে। চৌকিদার চক্রধরকে ওখানে গাইড করে নেবেন, আপনাদের ভালভাবে ঘুরিয়ে দেবে।

বিভূতি রান্নাঘরে চলে গেলেন। সুবাহুও উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, আমিও রুমে যাই। সকালে এই ঘড়িয়াল ঘড়িয়াল করে স্যারের টেম্পারেচারটা দেখা হয়নি।

সুবাহুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মিতিন জিজ্ঞেস করল, জ্বর কমেনি প্রোফেসরসাহেবের?

ছাড়ছে, আসছে, ছাড়ছে। স্যার খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পারছি কী করি!

হুঁ, প্রবলেম। আপনার তো আজ আর কোথাও বেরোনো হচ্ছে না?

 প্রশ্নই ওঠে না। সারাদিন স্যারের কাছেই থাকব।

মিতিন রুমে ফিরেছে। পার্থ, টুপুর আর বুমবুমও। ঘরে ঢুকেই মিতিন টুকটাক গোছগাছ করছে। গুনগুন গান গাইতে গাইতে। টুপুর যেন ঠিক পড়তে পারছিল না মাসিকে। ঘড়িয়ালদের অন্তর্ধান এত সহজে মেনে নিল মিতিনমাসি? এমন একটা কাণ্ড ঘটার পরও ফুরফুরে মেজাজে বেড়াতে বেরোচ্ছে, এ যেন মাসির চরিত্রের সঙ্গে ঠিক মেলে না। টুপুরেরই কি তা হলে ধারণাটা ভুল? প্রাণী দুটোর নিখোঁজ হওয়াটা কি নেহাতই তুচ্ছ ব্যাপার? এতে কি কোনও রহস্যই নেই?

ক্ষুণ্ন মুখে জলখাবার সারল টুপুর। আজ সাদাসিধে মেনু। টোস্ট, ডিমসেদ্ধ, কলা খেয়ে উঠে গাড়িতে চাপল সবাই। জিপে স্টার্ট দিচ্ছেন বিভূতি, তখনই টুপুর দেখল, শক্তিধর আর কর্মবীর আসছেন বাংলোর দিকে। কাঁধের ঝোলা ছাড়াই।

টুপুরের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের ঝিলিক। ফিসফিস করে মিতিনকে বলল, এঁরা আসার পরই কিন্তু কাল ঘড়িয়াল দুটো হাওয়া হয়েছে।

তো?

 না মানে, একটু ক্রস করে দ্যাখো না। যদি কিছু বের করতে পারো।

ওঁরা আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন কেন?

কায়দা করেই না হয় জানবে। এঁরা যে সুবিধের লোক নন, তা তো আমরা আগেই দেখেছি।

ওঁদের সঙ্গে ব্যাকব্যাক করার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি কাজ আছে। সময় নষ্ট করাটা এখন উচিত হবে না।

এক্ষুনি বাঘমুন্ডা যাওয়াটা এতই জরুরি?

আহ, চুপচাপ চল তো।

অগত্যা টুপুরকে ঠোঁটে কুলুপ আঁটতেই হয়। ওদিকে গাড়ি চলতেই বুমবুমের স্বর ফুটেছে, ঘড়িয়াল দুটো কিন্তু খুব মজার ছিল তাই না মা?

কেন বল তো?

পাশের বাংলোর কাকু এসে দাঁড়ালেই মুখ হাঁ করত।

তাই নাকি?

হ্যাঁ গো। আমি কতবার খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, মুখ খোলেই না, মুখ খোলেই না। কিন্তু কাকুকে দেখলে ওমনি দু’জনে একসঙ্গে…

কাকুকে দেখলেই বোধহয় ওদের খিদে পেত, পার্থ ঠাট্টা জুড়ল, এখন অবশ্য দু’জনে মহানন্দে নদীর মাছ সাঁটাচ্ছে দেদার।

তাই কি?

মিতিনের আকস্মিক প্রশ্নে হোঁচট খেয়েছে পার্থ। সে ফের মুখ খোলার আগেই মিতিন বিভূতিকে বলল, আর এগোনোর দরকার নেই। গাড়িটা এবার থামান।

রাস্তার ধারে জিপ দাঁড় করালেন বিভূতি, কেন ম্যাডাম? বাঘমুন্ডা যাবেন না?

এক্ষুনি নয়। অন্য একটা কাজ মনে পড়ে গেল। টিকরপাড়া বাংলো থেকে আমরা কদ্দূর এসেছি?

বড়জোর এক-দেড় কিলোমিটার।

আমাদের বাংলোর পিছন দিয়ে যে রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে গিয়েছে, সেখানে কীভাবে পৌঁছোনো যায়?

গাড়ি তো যাবে না। হাঁটতে হবে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।

ঠিক আছে, আপনি এক কাজ করুন, বুমবুমকে নিয়ে পুরানাকোট চলে যান। ভূতবাংলোটার কথা বলছিলেন, ওটা দেখিয়ে আবার ঠিক এই জায়গায় ফিরে আসুন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুরে আসবেন, কেমন?

বুমবুম চোখ পিটপিট করল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

বাঘ খুঁজতে৷ যাবি তুই?

বুমবুম জোরে জোরে মাথা নাড়ল, না। কিন্তু একা একা ভূতের বাড়ি!

ভয় করছে?

 হ্যাঁ, বুমবুম করুণ মুখে পার্থকে বলল, বাবা, তুমিও চলো না।

দলছাড়া হতে মোটেই ইচ্ছে ছিল না পার্থর। মিতিন যে কিছু একটা করতে চলেছে, সে তো টের পেয়েই গিয়েছে। কিন্তু ছেলের আবদারও তো উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।

পার্থ-বুমবুমকে নিয়ে চলে গেল বিভূতির জিপ। তরতরিয়ে ডান দিকের জঙ্গলটায় ঢুকে পড়ল মিতিন। টুপুরকে সঙ্গে নিয়ে। শাল, সেগুন, শিশু, গামারের ছায়াঢাকা শুনশান অরণ্য। পায়ের নীচে শুকনো পাতা ভাঙছে খড়মড়। নিস্তব্ধ বনে ওই আওয়াজটুকুই যে কী কানে লাগে! গাছগাছালি তেমন একটা ঘন নয়, তবু প্রতি মুহূর্তে বুক ঢিপঢিপ। মনে হয়, এই বুঝি এসে পড়ল কোনও বুনো জন্তু!

কিছু বলব না, বলব না করেও টুপুর জিজ্ঞেস করে ফেলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি মিতিনমাসি?

মিতিনের কাঠ কাঠ জবাব, আশা করি, এটুকু আন্দাজ করার মতো বুদ্ধি তোর আছে।

বাংলোর পিছনের জঙ্গলটায়? কিন্তু কেন?

ছেঁড়া ছেঁড়া সুতোগুলো জুড়তে।

 মানে?

কথা না বলে জোরে পা চালা। আমার হিসেবমতো এখন অনেকটা হাঁটতে হবে।

ছমছমে অরণ্য চিরে আরও মিনিট দশেক চলার পর একটা মেঠো রাস্তায় এসেছে দু’জনে। বনপথই, তবে মোটামুটি চওড়া। বোঝা যায়, এদিক দিয়ে মানুষ আসা-যাওয়া করে রোজ।

মিতিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে ঘোরাল। তারপর একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আমাদের বাংলোটা পুবে। সুতরাং এখন পশ্চিমে হাঁটতে হবে।

কেন?

ফের প্রশ্ন? স্টার্ট ওয়াকিং।

বোধহয় একশো মিটারও এগোয়নি, জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে শুরু করেছে। রাস্তাটাও এবার পাহাড়ি, পাকদণ্ডীর মতো। চড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে টুপুরের গা ছমছম ভাবটা বেড়ে যাচ্ছিল যেন।

হঠাৎ থমকেছে মিতিন। পরক্ষণেই দৌড়ে গিয়ে একটা পলিথিনের খালি বস্তা কুড়োল জঙ্গল থেকে। আঙুলে তুলে শুকল একটু। তারপর আলগোছে জিভে ছোঁয়াল আঙুলটা।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, কী গো?

নুন।

জঙ্গলে নুনের বস্তা?

হুম। এটা না থাকলে হিসেব মেলে না। মনে হচ্ছে, গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গিয়েছি।

বস্তাটা ভাঁজ করে নিয়ে এগোল মিতিন। ছোট্ট একটা বাঁক ঘুরে ফের রুদ্ধ হয়েছে তার গতি। পথের ধারে একটা বড়সড় গর্ত। অনেকটা টুলকায় যেমন দেখেছে।

ঝুঁকে গর্তটা পর্যবেক্ষণ করল মিতিন। দেখছিল টুপুরও। বলল, ভিতরে তো কিছু নেই গো।

ভাল করে লক্ষ করা আছে। রাশি রাশি পিঁপড়ে।

তাই তো! এত পিঁপড়ে কেন?

ওদের খাদ্যবস্তু যে ছিল এখানে।

কোনও মরা জন্তুটন্তু?

 উত্তর না দিয়ে মিতিন উবু হয়ে বসেছে। হাত বাড়িয়ে গর্ত থেকে একটা দড়ি টানল। দড়ির সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসছে একটা ভাঙাচোরা কাঠের পাটাতন। চার-চারখানা চাকা লাগানো।

পাটাতনটাকে নেড়েচেড়ে দেখল মিতিন। তারপর একটা পাতলা হাসি ফুটেছে ঠোঁটে। মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, সব হিসেবই মিলে যাচ্ছে রে।

কীসের হিসেব? টুপুরের ভুরুতে ভাঁজ, তুমি ঘড়িয়াল অন্তর্ধানের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছ বুঝি?

গুড গেস, টুপুরের পিঠে আলগা চাপড় দিল মিতিন। হালকা চালে বলল, চল, অভিযানের প্রথম পর্ব শেষ। এবার ফিরি।

মিতিনের পাশাপাশি হাঁটছিল টুপুর। যেতে যেতে বলল, কাল রাত্তিরে ঘড়িয়াল দুটো চুরি করে এখানেই মারা হয়েছিল। তাই তো?

যা মনে আসে বলে যা। শুনছি।

 তারপর চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে চোররা। মাংসটা গর্তে ফেলা হয়েছিল, জন্তুজানোয়ার এসে খেয়ে গিয়েছে, বলেই টুপুরের খটকা লেগেছে। ভুরু কুঁচকে বলল, তা হলে হাড়গোড়গুলো গেল কোথায়? সেগুলোও কি সাবাড় হয়ে গিয়েছে?

তুইই বল।

টুপুর মগজ হাতড়াল। জবাব খুঁজে না পেয়ে বলল, হয়তো গর্তে নেই। হয়তো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। আর একটু খুঁজলে হয়তো মিলত।

ঘোড়ার ডিম, মিতিন এক ফুঁয়ে টুপুরের ধারণাটা উড়িয়ে দিল, আর কী মনে হচ্ছে বল?

ঘড়িয়ালের আওয়াজ শোনা গিয়েছিল শেষরাতে। তখনই কিংবা তারপর নিশ্চয়ই চুরিটা হয়েছে।

অর্থাৎ তিনটে-চারটের সময়। তারপর মাত্র ঘণ্টা ছয়েক গড়িয়েছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে দু-দুটো ঘড়িয়ালের মাংস কি কোনও জন্তুর পক্ষে চেটেপুটে খেয়ে ফেলা সম্ভব?

তাও তো বটে। তা হলে?

ভাব, ভাব। ভাবা প্র্যাক্টিস কর। কানে যা শুনবি, সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে ধরে নিস না। তোর কি ধারণা, ঘড়িয়াল দুটোকে মেরে ওই পাটাতনে চাপিয়ে এতটা দূর পর্যন্ত আনা হয়েছিল? এক-একটা ঘড়িয়ালের ওজন জানিস? অন্তত দেড়শো কেজি। তার উপর অতটা লম্বা, অন্তত বারো চোদ্দো ফুট।

টুপুর ভাবনায় পড়ে গেল। এ তো বেশ জটিল ধাঁধা!