বাড়ির পিছনভাগে চওড়া বারান্দা। সামনের মতোই। সেখান থেকে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি নেমেছে। নীচে প্রশস্ত চাতাল। বাঁধানো চাতালের ডান হাতে ঠাকুরঘর। ছোটখাটো একটা মন্দিরও বলা যায়। আবার যেন মন্দির নয়ও। রং গেরুয়া, মাথায় সুন্দর চূড়া, তবু কেমন যেন বিদেশি ছাঁদ। উলটো দিকে খানতিনেক তালাবন্ধ ঘর। সম্ভবত কাজের লোকরা থাকত একসময়। চাতাল শেষে ফের সিঁড়ি, মাটি পর্যন্ত। খানিক গিয়ে গঙ্গায় যাওয়ার বাহারি গেট। ফটকের ওপারে লম্বা রোয়াক বানানো আছে, লোকজনের বসার জন্যে। পশ্চিমে কুলকুল বয়ে চলেছে গঙ্গা, গুমমাট শ্রাবণেও আজ ফুরফুরে বাতাস ধেয়ে আসছে নদী থেকে, দিব্যি এক আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে বিকেল।
গেটের খানিক আগে বায়ে ঘুরলেন মীনধ্বজ। হাঁটতে হাঁটতে পাঁচিলের প্রায় কোনায় এসে থামলেন। জমির এক জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বললেন, এই সেই অকুস্থল।
একনজরে সেভাবে কিছুই বোঝার উপায় নেই। খোঁড়া জায়গাটা এখন একেবারেই সমতল। একটাই যা তফাত, আশপাশে প্রচুর ঘাস-আগাছার মাঝে ওই ফালি জমিটুকু একদম ন্যাড়া।
মিতিন উবু হয়ে মাটিটা টিপে-টিপে দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এ যে দেখি রীতিমতো পিটিয়ে-পিটিয়ে প্লেন করা হয়েছে!
হ্যাঁ, সন্দীপনই লোক লাগিয়ে দুরমুশ করিয়েছে। খোঁড়া মাটি চালান করে দিয়েছে ভিতরে।
কেন?
যাতে জায়গাটাকে আর আলাদা করে আইডেন্টিফাই না করা যায়।
অর্থাৎ, আগে জায়গাটার কিছু বিশেষত্ব ছিল?
তা একটু ছিল বইকী। একটা পাথরের স্ল্যাব গাঁথা ছিল ওখানে। সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। ওই পাথরের তলায় গুপ্তধন থাকতে পারে, এমন আজগুবি চিন্তা ভুলেও কখনও মাথায় আসেনি। তবে এখন গুপ্তধনের গুজব যদি রটে, আর বাইরের লোক জমিতে আলটপকা একটা পাথর গাঁথা দেখতে পায়, তা হলে তাদের মনে তো সন্দেহ জাগতেই পারে। নয় কি?
মানে পাথরচাপা গুপ্তধন! তা প্রস্তরখণ্ডটি গেলেন কোথায়?
চোররা তো ওটা উপড়েই ফেলেছিল। এখন ওই পাঁচিলের ধারে পড়ে আছে।
গিয়ে দেখি একটু?
শিওর।
ত্বরিত পায়ে পাথরটার কাছে গেল মিতিন। আয়তাকার খণ্ডটিকে চাগাড় দিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। প্ৰচণ্ড ভারী, একা পেরে উঠল না, পার্থও হাত লাগাল। কোনওক্রমে খাড়া করার পর দু পিঠে হাত বুলিয়ে দেখল কী যেন। ফের স্বস্থানে শুইয়ে দিয়ে বলল, প্রথম কাজ শেষ। এখন আপনার বাড়িটা একটু ঘুরেঘুরে দেখি চলুন।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে এবার দোতলায় ওঠার পালা। ঘরের কোনও অন্ত নেই। গোটা তিন-চার খোলা, বাকিগুলোয় তালা ঝুলছে। দরজা-জানলাগুলো একই প্যাটার্নের। লম্বা-লম্বা, কাঠ আর কাচের পাল্লা বসানো। মাথায় রঙিন কাচের নকশা। কড়িবরগাওয়ালা উঁচুউঁচু সিলিংয়ে অদ্ভুত এক প্ৰাচীন গন্ধ।
মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে পার্থ বলল, আপনার পূর্বপুরুষদের টেস্ট ছিল। খাসা বাড়িখানা বানিয়েছিলেন কিন্তু।
ধুস, আমরা বানাতে যাব কেন? মীনধ্বজ হেসে ফেললেন, বাড়িটা তো ছিল এক পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর। নাম ফ্রান্সিস ডি অলমিডা। ব্রিটিশদের সঙ্গে কোনও কারণে তাঁর বিবাদ বেধেছিল, তখনই প্রায় জলের দরে আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা শিখিধ্বজ শাল্মলীবক্ষ বাগচীকে বাড়িটা বেচে দিয়ে তিনি দেশে ফিরে যান। এখন থেকে প্রায় সওয়াশো বছর আগে।
তখন থেকেই বুঝি আপনারা এখানে?
না, না। শিখিধ্বজ তো কখনওই থাকেননি। বাগবাজারে আমাদের সাবেকি বসতবাড়ি ছিল, উনি সেখান থেকে অবসরে এখানে বেড়াতে আসতেন। তাঁর ছেলে সিংহধ্বজ অবশ্য পাকাপাকিভাবে বাস করার কথা চিন্তা করেছিলেন। ভেতরে উঠোনে মিনি চ্যাপেল ছিল, চ্যাপেলটাকে তিনিই মন্দিরে পরিণত করেন। আমাদের কুলদেবতা রাধাগোবিন্দর পূজার্চনাও তখন থেকেই শুরু। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এখানে বসবাসের সাধ তার পূর্ণ হয়নি। তার আগেই তিনি হৃদরোগে মারা যান। মোটামুটি ঠাকুরদার আমল থেকে আমরা নুরপুরে আছি।
আপনি কি এ বাড়ির একাই মালিক এখন?
হ্যাঁ। আমার কোনও ভাইবোন নেই।
তা পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি..শরিকি ভাগাভাগি…?
সেই দায় থেকেও আমি মুক্ত। শিখিধ্বজ উইল করে বাড়িটা সিংহধ্বজকে দিয়ে গিয়েছিলেন। সিংহধ্বজের ছিল এক ছেলে, দু মেয়ে। ঠাকুরদার সেই দুই বোন স্বেচ্ছায় এই সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দেন। আবার আমার ঠাকুরদার দু ছেলে। আমার কাকা পীতধ্বজ পৰ্বতবক্ষ বাগচী এই বাড়ির অংশের বিনিময়ে বাগবাজারের বাড়িখানা পেয়ে যান। সুতরাং তালেগোলে এ বাড়ির আর কোনও ভাগীদার থাকল না।
গল্প শুনতে-শুনতে গোটা দোতলাটাই চক্কর মারা হয়ে গেল। শেষে স্টাডিতে এনে টুপুরদের বসালেন মীনধ্বজ। চরম অগোছাল ঘর। দেওয়াল-আলমারি, র্যাক, টেবিল, ইজিচেয়ারের হাতল, মেঝে, সর্বত্র শুধু বই আর বই। একটি টেবিলে কোনওক্রমে স্থান পেয়েছে কম্পিউটার, টিভিকে বসানো হয়েছে বেঁটে টুলে।
চটপট চেয়ারে স্তূপীকৃত বইগুলো মেঝেয় নামিয়ে দিলেন মীনধ্বজ। অপ্রস্তুত মুখে বললেন, এর মধ্যেই কষ্ট করে বসতে হবে কিন্তু!
মিতিন বসল না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বলল, নেক্সট স্টেপটায় এগনোর আগে একটা-দুটো চিন্তা আমার মাথায় ঘুরছে। কিছু ডেলিকেট প্রশ্ন করছি, আশা করি জবাব দিতে আপনার অসুবিধে নেই?
বলুন কী প্রশ্ন?
যেমন ধরুন, গুপ্তধন থাকার মতো আপনাদের সঙ্গতি ছিল কি না। সেকেন্ডলি, ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখার কোনও জোরালো কারণ কখনও ঘটেছিল কি?
পার্থ ফস করে বলল, শুধু ওঁদের কথাই ধরছ কেন? সেই পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ফ্রান্সিস ডি অলমিডা, তারও তো কোনও লুকনো সম্পদ থাকতে পারে?
তিনি এই বাড়িতে ধনসম্পত্তি পুঁতে রেখে দেশে চলে গেলেন? ভদ্রলোক কি উন্মাদ ছিলেন?
তা অবশ্য ঠিক। পার্থ মাথা চুলকোল, যদি কিছু থাকেও, সেটা মীনধ্বজবাবুরই পূর্বপুরুষ…!
মীনধ্বজ একটু সময় নিয়ে বললেন, দেখুন ম্যাডাম, আমি চিরকাল পড়াশোনা নিয়েই থেকেছি। তার ওপর বহুকাল বিদেশে। তাই পূর্বপুরুষদের কাহিনি আমার খুব একটা জানা নেই। তবে যতদূর যা শুনেছি, রাজশাহিতে… মানে এখন যেটা বাংলাদেশে… আমাদের নাকি জমিদারি ছিল। প্রজাদের খাজনার টাকাতেই আমার পূর্বপুরুষরা বসে-বসে খেতেন। গানবাজনার চর্চা করতেন, পায়রা ওড়াতেন, বিড়ালের বিয়ে দিতেন…। ফুর্তির দাপটে সেই জমিদারি একসময় নাকি ক্রোক হয়ে যায়। তবে ততদিনে আমার গুণধর পূর্বপুরুষরা বেশ কয়েকটা বাড়ি তৈরি করে ফেলেছেন উত্তর কলকাতায়। ঠাকুরদাকে… পরে আমার বাবাকেও দেখেছি, ওইসব বাড়ির ভাড়ার টাকাতেই তাঁরা দিব্যি সংসার চালাতেন। অভাব অনটন হয়নি, সচ্ছলই ছিলাম, তবে সাংঘাতিক রইস অবস্থা আমাদের আর ছিল না। এমনকী, আমাকে বিদেশে পাঠানোর জন্যে মাকে গয়না পর্যন্ত বেচতে হয়েছিল। এমন একটি পরিবারে গুপ্তধন থাকার সম্ভাবনা কতটা তা আপনিই বিচার করুন। তবে হ্যাঁ, শিখিধ্বজের সময়ে তো যথেষ্ট রমরমা ছিল, তিনি যদি এখানে কিছু পুঁতেটুতে রেখে থাকেন…!
তা কী করে সম্ভব? তিনি তো এখানে থাকতেনই না! ফাঁকা বাড়িতে কি…?
হ্যাঁ। সেটাও একটা ভাবার বিষয় বটে।
মীনধ্বজ চুপ করে গেলেন। পার্থও আর রা কাড়ছে না। মিতিনও ভাবছে কী যেন।
খানিক পরে মিতিন বলল, এবার একটা-দুটো ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আপনি তো দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন?
হ্যাঁ। প্রায় চল্লিশ বছর।
আগাগোড়াই কানাডায়?
নাঃ। প্ৰথমে বছরদশেক বস্টন। বাকি সময়টা ওদেশে। টরন্টোর কাছে ওয়াটারলু বলে একটা ছোট শহর আছে, ওখানেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম। অঙ্ক। পিওর ম্যাথমেটিক্স।
হঠাৎ চলে এলেন কেন?
আমার স্ত্রী বছর আষ্টেক আগে ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। তিনি ছিলেন আমেরিকান। আমার ছেলেমেয়ে দুজনেই ওখানে সেটলড। একজন অটোয়া, অন্যজন ভ্যাংকুভারে থাকে। একা-একা ওয়াটারলুতে মন্দ ছিলাম না, তবে বছর চার-পাঁচ ধরে মনে হচ্ছিল, একাই যদি থাকি, কেন নুরপুরে নয়? মরতে হলে দেশের মাটিতে মৃত্যুই তো ভাল। তাও ফাইনাল ডিসিশান নিতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল।
আপনি যে পার্মানেন্টলি চলে আসছেন, তা কি এখানে কাউকে জানিয়েছিলেন?
তেমন কেউ তো নেই। বাবা বছর কুড়ি আগে গত হয়েছেন, মা গিয়েছেন সাত বছর। তবে সন্দীপনকে ইন্টিমেট করেছিলাম আসার মাসছয়েক আগে।
সন্দীপনবাবু কতদিন এ বাড়ির দেখাশোনা করছেন?
বছরতিনেক। তার আগে তো সন্দীপনের বাবাই…
তিনি কি মারা গিয়েছেন?
না না, আছেন। তবে বয়স হয়েছে তো, আর পেরে উঠছিলেন না। আমাকে জিজ্ঞেস করেই উনি সন্দীপনের হাতে বাড়ি ছেড়েছেন।
এটা কি সন্দীপনবাবুর হোলটাইম জব?
ওর বাবা পর্যন্ত তাই ছিল। তবে সন্দীপনকে আমি ছাড় দিয়েছি। ক টাকাই বা মাইনে, মাত্র আট হাজার। আজকালকার দিনে তাতে কি চলে? সন্দীপন একটা টিউটোরিয়াল হোম খুলেছে। আরও দুজন বন্ধু মিলে। দুটো রোজগারে ওর মোটামুটি কুলিয়ে যায় বলেই মনে হয়।
সন্দীপন বিয়ে-থা করেছেন?
উঁহু। এখনও ঝাড়া হাত-পা।
ও কে। আপাতত এইটুকুই যথেষ্ট। মিতিন ঘড়ি দেখল, এবার কি আমি এ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
সন্দীপনকে ডাকি তা হলে?
তিনি আসুন না ধীরেসুস্থে। তার আগে একবার করুণাকে মিট করি। আপনি বরং ততক্ষণ আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে…।
করুণাকে কী জিজ্ঞেস করবেন? ও কী-ই বা জানে?
অনেক সময় বিন্দুতেও সিন্ধুদৰ্শন হয় মিস্টার বাগচী।
বেশ, বলুন কথা। শুধু একটাই রিকোয়েস্ট, ভূতটুতের প্রসঙ্গ তুলবেন না। মেয়েটির হাতের রান্না ভারী চমৎকার। ভয় পেয়ে কাজ ছেড়ে পালালে আমার সমূহ বিপদ।
কী সরল অনুনয়! টুপুর ফিক করে হেসে ফেলল।
.
০৪.
রান্নাঘরটি যথারীতি বড়সড়। ছিমছাম, সাজানো-গোছানো। গ্যাস, চিমনি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, টোস্টার, মিক্সার-গ্রাইন্ডার…! আধুনিক রন্ধনশালার সমস্ত উপকরণই মজুত। দেওয়ালে কাঠের খোপটোপ বসিয়ে দিব্যি বাহার আনা হয়েছে ঘরখানায়।
মিশকালো গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে আটা মাখছিল করুণা। হাত চালাতে চালাতে গান গাইছে গুনগুন। মিতিন-টুপুরের আকস্মিক আবির্ভাবে চমকাল জোর।
কাছে গিয়ে অবলীলায় করুণার কাঁধে হাত রাখল মিতিন, তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম ভাই!
মিতিনমাসির এই কায়দাটা ভালই কাজ দেয়, দেখেছে টুপুর। ঘনিষ্ঠ ব্যবহারে আপ্লুত হয়ে অনেক সময়ই মনের-প্রাণের কথা বলে ফেলে কাজের লোকজন।
করুণা অবশ্য সহজ হয়নি। অঙ্কুটে বলল, আমার সঙ্গে কী কথা দিদি?
বা রে, এক জায়গায় বেড়াতে এলাম… বাড়ির সবার সঙ্গে চেনাজানা করব না? এবার থেকে হয়তো মাঝেমাঝেই আসব।
কেন?
এমনিই। জায়গাটা ভারী সুন্দর তো!
আমি জানি আপনারা কেন এসেছেন। শ্যামলা রং ছোট্টখাট্টো চেহারার বউটার ঠোঁটে পলকা হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল, গুপ্তধনের খোঁজ করতে, তাই না?
টুপুর অবাক। আড়ি পেতে শুনেছে নাকি?
মিতিন অবশ্য তেমন বিস্মিত নয়। স্বাভাবিক গলাতেই বলল, মীনধ্বজবাবু বলেছেন বুঝি?
না না, সাহেব আমার সঙ্গে ওসব নিয়ে আলোচনা করেন না। আমি আন্দাজেই…।
ও। মিতিন আর ঘাঁটাঘাঁটিতে গেল না। নরমভাবেই বলল, যাক গে যাক, যা কানে গিয়েছে তা কানেই রাখে। পাঁচকান কোরো না, হ্যাঁ?
করুণা ঢক করে ঘাড় নাড়ল।
দু-এক সেকেন্ড নীরব থেকে মিতিন ফের বলল, তুমি তো জেনেই ফেলেছ কেন এসেছি। এবার তা হলে তোমায় কয়েকটা প্ৰশ্ন করি?
ঠিকঠাক জবাব দিয়ো। টুপুর ফুট কাটল, বানিয়ে বললে মাসি কিন্তু ধরে ফেলে।
বানিয়ে-বানিয়ে কেন বলব? করুণা যেন সামান্য বেঁঝে উঠল, আমি কাজ করি, চলে যাই। আগড়ুম বাগড়ুম বকে আমার কী লাভ?
বটেই তো বটেই তো। মিতিন করুণার পিঠে আলতো চাপড় দিল, তুমি থাকো কোথায় গো?
এই তো, বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে বাঁয়ে একটা রাস্তা ঢুকেছে… হেঁটে গেলে মিনিটকুড়ি লাগে।
শুধু কি এই বাড়িরই কাজ করো?
হ্যাঁ দিদি, গোটা দিনটা তো এখানেই কাটে। সেই সকাল আটটায় ঢুকি, সন্ধের আগে ছুটি মেলে না। ঢাউস বাড়ির দোতলা, একতলা ঝাড়পোঁছ, বাসনমাজা, কাচাকুচি, রান্নাবান্না, সাহেবকে খেতে দেওয়া… কম কাজ?
একা হাতে সব করো?
সন্দীপনদাদা ঘর পোঁছাপুছির জন্য আলাদা লোক রাখতে চেয়েছিলেন, সাহেব রাজি হননি। বাড়িতে গণ্ডায়গায় লোক ঘুরে বেড়ালে সাহেবের অস্বস্তি হয়।
তা হলে মাইনেও নিশ্চয়ই ভালই পাও?
তিন হাজার দেন।
কবে কাজে লেগেছ?
সাহেব আসার পর থেকেই। এই তো… চারমাস চলছে। যখন এলাম, তখন তো সাহেবের অর্ধেক বাক্সপেটরা খোলাই হয়নি। তারপরেও আবার একপ্রস্থ জিনিসপত্র এল। অবিশ্যি সবেতেই শুধু বই আর বই। আমি আর সন্দীপনদাদা যে কতদিন ধরে খালি বই গোছগাছ করেছি! করুণা ঠোঁট ওলটাল, অত বই পড়ে মানুষের যে কী হয় কে জানে?
বোধ হয় তোমার সাহেবের মতো খ্যাপাটে বনে যায়!
কথাটা মনে ধরল করুণার, মুখ টিপে-টিপে হাসল। তার হাসির মাঝেই মিতিন আচমকা জিজ্ঞেস করল, তা এ বাড়ির গুপ্তধনের ব্যাপারে তুমি কী জানো?
করুণা যেন থতমত, আমি কী বলব?
শোননি, দুটো চোর গুপ্তধন খুঁজতে এসে ধরা পড়েছিল?
একথা তো নুরপুরের লোকের মুখে-মুখে ফিরছে দিদি। তারা নাকি গেঁওখালি থেকে এসেছিল, পুলিশ নাকি তাদের খুব পিটিয়েছে…।
গেঁওখালি? টুপুর মিতিনমাসির দিকে তাকাল, সে তো পূর্ব মেদিনীপুরে। সেখান থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এসে মাটি খুঁড়ছিল?
গেঁওখালি কী এমন দূর, বোন? আমাদের ঘাট থেকে ফেরি ধরলে জোর দশ-পনেরো মিনিট। সারাক্ষণই তো এপার-ওপার চলছে।
ঠিকই তো। মিতিন সায় দিল, তুমি আর কিছু শোননি?
বললাম যে… সবাই আলোচনা করছে…!
আচ্ছা, গুপ্তধনের কথা কি ইদানীং উঠেছে? নাকি আগেও ছিল?
গুজব তো একটা ছিলই দিদি। তবে আগে কেউ তেমন মাথা ঘামাত না। গঙ্গার ধারে এমন একটা প্রাসাদ পড়ে থাকলে কত কথাই তো রটে। ছেলে দুটো ধরা পড়তে এখন মাতামাতি শুরু হয়েছে। কদিন যা গেল, বাব্বাঃ! ভিড়ে ভিড়, গেট টপকে এসে সব উঁকিঝুঁকি মারছে… টিভির লোকরাও তো খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল। সাহেব তো তখন রেগে কাঁই। ঠাকুরমশাইকে এই মারেন, তো সেই মারেন।
ঠাকুরমশাই? মানে এ বাড়ির কুলপুরোহিত?
হ্যাঁ গো দিদি। রোজ দুবার করে আসে, আর খানিক অং বং চং করে চলে যায়।
গুজবটা বুঝি উনিই ছড়াচ্ছেন?
ওই অপকম্মো আর কে করবে? সারাক্ষণ গাঁজার নেশায় টং, মুখেও অহরহ আজগুবি বুলি। নুরপুরের কেউ ওর কথা ধরে না। ছেলে দুটো বাইরের ছিল বলেই হয়তো… আর ওরা দুটোতে হানা না দিলে থোড়াই লোকে ঠাকুরমশাইয়ের গপপো নিয়ে মাথা ঘামাত।
তা হলে কি গুপ্তধনের খবরটা ভুল?
বললাম তো, আজগুবি। মাটির তলে মাটি, তার তলে ঘড়াঘড়া মোহর… আহা, কী উপাখ্যানই না ফেঁদেছেন। বাড়ির মালিক খোঁজ রাখেন না, অথচ উনি সব জেনে বসে আছেন, হুঁহ!
তুমি দেখছি ঠাকুরমশাইকে একদমই পছন্দ করো না?
ওই খিটখিটে বুড়োটাকে দেখলেই গা জ্বলে। নিজে সারাদিন কোথায় পড়ে থাকে তার ঠিকঠিকানা নেই, আমি ঠাকুরদালানে পা রাখলেই চোটপাট! এঁটো কাপড়ে উঠবি না, চৌকাঠ মাড়াবি না, আমাকে ছুঁবি না…!
বুঝলাম, উনি তোমায় খুবই হেনস্থা করেন? মিতিন ঠোঁট টিপল, আচ্ছা করুণা, তুমি, সন্দীপনবাবু আর ঠাকুরমশাই ছাড়া আর কার-কার যাতায়াত আছে বাড়িতে?
তেমন তো কাউকে দেখি না। কম্পিউটারের একটা লোক আসে মাঝেমধ্যে, উপরে সাহেবের ঘরে বসে কী সব খুটুরখাটুর করে। আর মাসে এক-দুবার মুনিশ লাগিয়ে সন্দীপনদাদা বাইরের ঝোপঝাড় সাফা করান। এ ছাড়া গ্যাস কিংবা ইলেকট্রিকের লোকটোক…ব্যস।
এ বাড়িতে কোনও দরোয়ানও তো দেখলাম না?
শুনেছি সন্দীপনদাদারাই এ বাড়িতে থাকতেন। এখন তো আর…।
হুম। তা তোমার সাহেব কি সারাক্ষণ বাড়িতেই বন্ধ থাকেন? বেরোনটেরোন না?
খুব কম। হপ্তায় হয়তো এক-আধদিন… নিজেই গাড়ি চালিয়ে…। তবে সকাল-দুপুর যখনই যান, সন্ধের মধ্যে ফিরবেনই। লেখাপড়া ছেড়ে নড়তেই যেন আলিস্যি। শুধু পড়তে-পড়তে হাঁপ ধরলে ছাদে খানিক হাঁটেন, নয়তো গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে থাকেন একা-একা।
বাঃ, অনেক গল্প করা গেল। মিতিনের মুখ খুশি-খুশি, এবার তোমার বিষয়ে কিছু শুনি? বাড়িতে কে কে আছেন?
শাশুড়ি, বর, মেয়ে আর ছোট ননদ। মেয়ের সাত পুরে আট চলছে। ইশকুলে পড়ে। ননদের অবশ্য অঘ্রানে বিয়ে।
কী করেন তোমার বর?
আগে ভ্যানরিকশা চালাত। মালিকের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল, বসিয়ে দিয়েছে। ইদানীং তেমন কিছু করে না। সন্দীপনদাদা বলেছেন, ব্যাঙ্ক লোনে রিকশা কিনিয়ে দেবেন। সেই আশাতেই দিন গুনছে।
তোমাদের সন্দীপনদাদা তো খুব ভাল লোক?
সে আর বলতে! আমাকে কথা দিয়েছেন, ননদের বিয়ের খরচাও জোগাড় করে দেবেন। দয়ার প্রাণ না হলে আজকাল এমনটা কেউ করে? বলে একটু থামল করুণা। চোখ পিটপিট করে মিতিনকে দেখল। গলা নামিয়ে বলল, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব দিদি?
কী?
এত যে প্রশ্ন করছেন…আপনি কি মেয়েপুলিশ?
কাছাকাছি। মেয়েগোয়েন্দা।
করুণা কী বুঝল কে জানে, একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, গুপ্তধন আছে কি না জানি না। আমার বর বলে, বড় বাড়ির ব্যাপার, মণিমাণিক্য কোথাও থাকতেও পারে। কিন্তু দিদি, সেটা উদ্ধার কি সোজা কথা? মেয়েরা কি এসব কাজ পারে?
অ্যাই, তুমি আমার মাসিকে কী ভাবছ বলো তো? টুপুর আর মুখ বুজে থাকতে পারল না। চোখ ঘুরিয়ে বলল, মাসির এলেম সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? কত খুনে-ডাকাত-বদমাশ ধরেছে জানো? এই তো, কিছুদিন আগেই…!
কেউ তার গুণপনার ব্যাখ্যান শুরু করলে চটপট তাকে থামায় মিতিন। কিন্তু কী আশ্চর্য, এখন চুপচাপ শুনে যাচ্ছে? নাকি শুনতেই পাচ্ছে না? হঠাৎই করুণা-টুপুরকে হতবাক করে তিরবেগে দরজায় ছুটে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে কাকে যেন কড়া ধমক, আপনার এই অভ্যেসটাও আছে তা হলে?
বাইরেটায় এসে টুপুর থ। হাড়ডিগডিগে বেঁটেখাটো চেহারার এক বৃদ্ধ কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে। ধবধবে সাদা চুল, কপালে রক্ততিলক, ড্যাবাড্যাবা দুটো চোখ করমচার মতো লাল। খেঁটো ধুতির প্রান্তখানা খালি গায়ে চাদরের মতো জড়ানো, হলদেটে পৈতে থেকে একথোকা চাবি ঝুলছে।
ইনিই তবে এ বাড়ির ঠাকুরমশাই?
মিতিন ফের দাবড়াল, আড়াল থেকে কী শুনছিলেন, অ্যাঁ?
কিছু না তো। ঠাকুরমশাই ঢোক গিললেন, করুণার কাছে একটু জল চাইতে এসেছিলাম। কথা চলছে বলে ভিতরে ঢুকিনি।
মিথ্যে বলবেন না। চলুন, চলুন আমার সঙ্গে।
কোথায়?
আপনারই জায়গায়। ঠাকুরদালানে।
এমন কর্তৃত্বের সুরে হুকুম ছুড়ল মিতিন, সুড়সুড় করে হাঁটা শুরু করলেন বৃদ্ধ। করুণার ভারী আল্লাদ হল, হাসল মুখে আঁচল চেপে।
পিছনের চাতালে এসে থামল মিতিন বেজার মুখে বৃদ্ধও তীক্ষ্ণ চোখে তাকে নিরীক্ষণ করে মিতিন বলল, নেশা করে আছেন মনে হচ্ছে?
ঠাকুরমশাইয়ের গোমড়া জবাব, বাবার প্রসাদকে নেশা বলে না।
শিবঠাকুরের ভক্ত হয়ে এখানে রাধাগোবিন্দর সেবা করেন?
এটা আমাদের বংশের পেশা। আমরা ছিয়াশি বছর ধরে এ বাড়িতে পুজো করছি।
অ। আপনারাও তিন পুরুষ? সন্দীপনবাবুদের মতো?
না। আমরা চার। আমার ঠাকুরদার বাবা এই মন্দিরের প্রথম পূজারি। দেখে বুঝতে পারবেন না, এই মন্দির আগে ফিরিঙ্গিদের গির্জা ছিল।
মন্দিরের কাহিনি শুনেছি। মীনধ্বজবাবু বলেছেন।
তা হলে নিশ্চয়ই এও জানেন, আমার ঠাকুরদার বাবা ঈশ্বর ভুজঙ্গমোহন চক্রবর্তী গির্জাটিকে শোধন করে মন্দির বানানোর পরামর্শ দেন। তারই উপদেশমতো যিশু আর মা মেরির মূর্তি বাড়ির নীচে যত্ন করে রাখা আছে?
বাড়ির নীচে মানে?
তলায়। গৰ্ভগৃহে। ঠাকুরমশাইয়ের চোখ তেরচা হল, কেন, মীনধ্বজ বলেনি বাড়ির নীচে ঘর আছে? অন্তত তিন-চারখানা?
টুপুর আর মিতিন চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। অমনি তাল বুঝে বৃদ্ধ তরতরিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি ধরছিলেন, মিতিন হাঁ হাঁ করে উঠল, আরে আরে, চললেন কোথায়? কথা যে শেষ হয়নি?
কিন্তু আমার যে আরতির সময় হয়ে গিয়েছে?
আহা, একদিন দু-পাঁচ মিনিট দেরি হলে রাধাগোবিন্দর কিছু ক্ষতি হবে না।
ঠাকুরমশাই ঘুরে দাঁড়ালেন, বেশ, বলুন কী জিজ্ঞাস্য?
মিতিন কেজো গলায় বলল, আমার পরিচয় তো আপনি জেনে ফেলেছেন। নিশ্চয়ই আগমনের কারণটাও আন্দাজ করতে পারছেন?
পারছি।
আপনি তো এ বাড়ির সঙ্গে বহুকাল ধরে যুক্ত, হঠাৎ এখন গুপ্তধনের গল্পটা শুরু করলেন কেন বলুন তো?
অনঙ্গমোহন চক্রবর্তী এমনি-এমনি কিছু বলে না। শ্লেষ্মাজড়ানো প্রবীণ স্বর ঘড়ঘড় বেজে উঠল, সে যা শোনে, তাই পাঁচজনকে শোনায়।
কী শুনেছেন আপনি?
আমার বাপ-ঠাকুরদা যা বলতেন। মাটির তলে মাটি, তার তলে ঘড়া-ঘড়া মোহর…!
অর্থাৎ আপনি বলতে চান গুপ্তধন সত্যিই আছে?
অতশত জানি না। যা শুনেছি, তাই বলি।
তা, হঠাৎ মীনধ্বজবাবু ফেরার পরেই কথাটা চাউর করা শুরু করলেন কেন?
বাজে অভিযোগ। মোহরের গল্প আমি চিরকালই বলছি। আগে কেউ পাত্তা দিত না, এখন লোকে বিশ্বাস করছে। এতে আমার কী অপরাধ? আমি কি কখনও গুপ্তধন হাতানোর চেষ্টা করেছি? অপরাধী-অপরাধী ভাব মুছে ফেলে বেশ তেজের সঙ্গে কথা বলছেন অনঙ্গমোহন। ক্ষয়াটে শরীর টানটান করে বললেন, শুনুন ভাই, পুজোআর্চা করে খাই বটে, আমরা কিন্তু খুব ফ্যালনা পরিবার নই। আমাদের একটা বংশমর্যাদা আছে। আড়াইশো বছর ধরে নুরপুরে আমাদের বাস। এখানেই আমাদের আদি বাড়ি। এককালে আমাদের বিশাল রমরমা ছিল। আমার পূর্বপুরুষরা হাতি ছাড়া কোথাও নড়তেন না। একবার মন্বন্তরের সময় দশ-দশখানা গ্রামকে আমরা একাই…!
বুঝেছি, বুঝেছি। আপনারা অতি উচ্চ ঘর। দুহাত তুলে মিতিন থামাল অনঙ্গমোহনকে। ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে বলল, কাজের কথায় আসুন তো। ছেলে দুটোকে আপনি গুপ্তধনের গল্প কবে শুনিয়েছিলেন?
কোন ছেলে?
যারা মাটি খুঁড়তে গিয়ে ধরা পড়ে।
তাদের আমি চিনিই না। ফেরিঘাটের চা-দোকানে গিয়ে অনেক সময় গল্পগাছা করি, তখন ওরা হয়তো শুনেও থাকতে পারে।
হুম। আর-একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো? আপনি গুপ্তধনের খবর জানেন, অথচ মীনধ্বজবাবুর এ সম্পর্কে কোনও আইডিয়াই নেই, এটা কী করে সম্ভব?
দেখুন, এ বাড়ির মেঝেতে কান পাতলে মোহরের ঝনঝন শোনা যায়। আমার ঠাকুরদা বলতেন, সঙ্গে অনেক দীর্ঘশ্বাসের শব্দও নাকি কানে আসে। শুধু মোহর নয়, বাড়ির নীচে নাকি মানুষের পাপও জমে আছে। মীনধ্বজ যদি কিছুই না শুনতে পায়, সেটা তার দুর্ভাগ্য।
আপনি নিজে কখনও শুনেছেন?
অনঙ্গমোহন জবাব দিলেন না। ঢুলুঢুলু চোখে হাসলেন মিটিমিটি।
হাসিটাকে একটুও পড়তে পারল না টুপুর।